জ্বালা
এই পৃথিবীতে মানুষের কত জ্বালা আছে? সবচেয়ে বড় জ্বালা হল পেটের জ্বালা। ক্ষিদে। দিন শুরুই হল খা-খা করে। এই খা-খা শব্দটা আমি কাকের কাছ থেকে পেয়েছি। বেলগাছের ডালে কাকের বাসা। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়েছে। ইয়া বড় একটা ঠোঁট ফাঁক করে খা-খা করে যাচ্ছে। মা-টাকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। সে বেচারা এখান ওখান থেকে যা পাচ্ছে যোগাড় করে আনছে। বাচ্চাটার কি আগ্রাসী ক্ষিদে। মুখে পড়া মাত্রেই নিমেষে গিলে নিচ্ছে। লিকলিকে গলা আর এতখানি একটা ঠোঁট তুলে আবার খা—খা। মা-টা বাসা ছেড়ে দূরের ডালে গিয়ে বসে আছে হতাশ হয়ে। অত চাহিদার যোগান সে দেয় কি করে। ওদিকে ভোরে আকাশে চিল চককর মারছে। নদীর ধারে আকাশে শকুনের ঝাঁক উড়ছে। একটা মড়া ভেসে এসে তীরে ঠেকেছে। এখনি শুরু হয়ে যাবে টানাটানি, ছেঁড়াছিঁড়ি। নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি।
জীবজগৎ থেকে দৃষ্টি ফেরাই মানুষের জগতে। সভ্য মানুষ অতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে না ঠিকই; তবে সকলেই পেটের দাস। পেটের জ্বালায় ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায় রাত ভোর হওয়া মাত্রই। তিনটের সময় আগুন পড়ে গেল বড় রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে। বসে গেল ঢাউস কেটলি। চায়ের জল ফুটছে সিঁ সিঁ। কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা প্রথমেই আসবেন খবরের কাগজের হকাররা। তিনশো পঁয়ষট্টি দিন মানুষের দরবারে সাত সকালেই যাঁরা বিশ্বের টাটকা খবর পৌঁছে দেন। কাগজ দিতে সামান্য দেরি হলেই আমরা যাঁদের ওপর মুখিয়ে উঠি। একটি সাইকেল যাঁর বাহন। প্রবল বর্ষার সঙ্গে যাঁরা লড়াই করেন একটুকরো পলিথিনের ভরসায়। সামান্যই রোজগার। পরিবারটি হয়তো বিশাল। কাঁচা একটা পাঁউরুটি আর ছোট্ট এক গেলাস সস্তার চা হল যাঁদের দেহযন্ত্রের প্রাত:কালীন জ্বালানি। এই প্রাতরাশে আর একটু উঁচু আয়ের মানুষ অভ্যস্ত নন। ভয় পাবেন খেতে। বলবেন অ্যাসিড হবে। ভালো করে সেঁকতে হবে। পুরু করে মাখন মাখাতে হবে অথবা জেলি। চা আসবে সুদৃশ্য কাপে। ভুরভুরে গন্ধ তুলে। এঁরা উঠবেন বেশ দেরিতে। সূর্য তখন আকাশ পরিক্রমায় একের চার এগিয়ে গেছেন। এঁরা সারা জীবন শুনেই এলেন, সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে। দেখা হল না কোনও দিন। আসলে মানুষ যত শিক্ষিত সভ্য আর বিত্তশালী হবে ততই সে প্রকৃতিবিমুখ হবে। জানালা ঢেকে দেবে মোটা পর্দায়। মুক্ত বাতাসের বদলে ব্যবস্থা করবে যান্ত্রিক ঠান্ডার। দিনের আলোর চেয়ে পছন্দ করবে রাতের আলো। চির রাত্রিতে বসবাস, যেন শিক্ষিত উচ্চপদস্থ পেঁচার দল। মানুষের এই প্রজাতির তলায় আর এক জাতি আছে যাদের সংখ্যা অনেক, এরা হল মধ্যবিত্ত। এই মধ্যবিত্ত সমাজের খ্যাঁকোরম্যাকোর প্রায় ভোর থেকেই শুরু হবে। পরিবারের পাঁচন বড়ি খেয়ে শয্যাত্যাগ। চটের ব্যাগ হাতে, পায়ে ক্ষয়া চটি। সব বেরিয়ে এলেন। গতি বাজারের দিকে। শাক-পাতা, আলু-মুলো, কুমড়ো-কচু যে যা পারলে খাবলা-খাবলি করে থলেতে ভরে গলদঘর্ম হয়ে বাড়িমুখো হল। বাজার মানে, আবর্জনা-ভরা, কাদা-থকথকে একটা জায়গা। মনোরম, পরিচ্ছন্ন কোনও পরিবেশ নয়। সেই পরিবেশেই পেটের দায়ে বেপারিরা বসে আছেন গায়ে গা লাগিয়ে। মাছের এলাকার দুর্গন্ধে তিষ্ঠনো দায়। সেইখানেই বসে বিক্রেতা পরমানন্দে লেড়ো বিস্কুট চিবিয়ে চায়ে চুমুক মারছেন। কোনও বিকার নেই। পচা মাছের গন্ধ যেন আতরের গন্ধ। আসলে কোনও জিনিসই তো জিনিস নয়। শেষ মেষ সবই টাকা। এই পৃথিবীর বড় মধুর জিনিস। এই টাকার জন্যে মানুষ নর্দমায় গলা ডুবিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। লাশকাটা ঘরে পচা মড়া সেলাই করতে-করতে ঘুগনি খেতে পারে, কারণ পেটের জ্বালা নিরসনে টাকাই একমাত্র সহায়। আর এই পেট এমন এক জিনিস, যার সম্পর্কে বলতে গিয়ে কাব্য করে বলা হয়েছে, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়। এর মধ্যে পেটও পড়ে। আয় বুঝে ব্যবস্থা। যাঁদের ট্যাঁকের জোর প্রবল তাঁরা বিলাতি কায়দায় ‘হেভি’ ব্রেকফাস্ট’ করবেন। এক চুমুক ফলের রস। টোস্ট। ডবল ডিম। ঠান্ডা দুধে ভুট্টার চুরমুর যাকে ইংরেজি ভাষায় বলা হবে—করন ফ্লেকস, আধ হাত কলা, সঙ্গে কফি। ডাক্তারের নির্দেশ থাকলে, এই সময় গোটাকতক ক্যাপসুলও চালিয়ে দিতে হবে। আজকাল প্রেসক্রিপসানে ডাক্তারবাবু লেখেন—ওয়ান ক্যাপ উইথ বি. এফ.। কোনও নিম্নবিত্ত রোগী এই প্রেসক্রিপসন পেয়ে বলবেন, ‘আমার তো ব্রেক ফাস্ট নেই ডাক্তারবাবু।’
‘সে কি, সকালে তাহলে কি খান?’
একেবারে সাতসকালে খাই পরিবারের নির্ভেজাল গালাগাল; কারণ ভোরের আলোয় স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে সংসারের অভাব। এই নেই, সেই নেই, তাই নেই। সকালেই মনে পড়ে যায় পাওনাদারদের কথা। মুখের চুলো, আর উনুনের চুলো একসঙ্গে জ্বলে ওঠে। এর মধ্যেই এসে হাজির হয় এক কাপ গজগজে চা।’
‘গজগজে চাটা কি?’
‘পরিবার গজগজ করতে-করতে এক কাপ চা ঠকাস করে সামনে বসিয়ে দিয়ে যাবার সময় ঝামটা মেরে বলে যায়, আঁচ কামাই যাচ্ছে, ঘরে কিচ্ছু নেই।’
‘একেবারে খালি পেটে চা! আলসারে মরবেন না! একটা দুটো বিস্কুট তো খেতে পারেন।’
‘আজ্ঞে আমরা সাত জন। সাত দু-গুনে চোদ্দটা বিস্কুট লাগবে। তা হলে বিস্কুটই হবে আর কিছু হবে না। মাঝবেলায় আমরা পেট ঠেসে ভাত ডাল আর ঘ্যাঁট পুরে দি পেটে। আবার সেই রাতে। এর মাঝে আর টুঁ*্যা-ফোঁ কোরো না। জল খাবারের বালাই নেই আমাদের।’
‘পেট জ্বালা করে?’
‘আজ্ঞে করে। ফাঁক পেলেই করে।’
‘তখন কি করেন?’
‘অভ্যাস করি। জ্বালা নিয়ে বেঁচে থাকার অভ্যাস।’
‘পেটে তাহলে প্রাোটিন, ফলমূল কিছুই পড়ে না?’
‘আজ্ঞে প্রাোটিন ভোরবেলা পাঁচিলে বসে কোঁকর কোঁ ডাক শোনায় আর ফল-ফুল দোল খায় গাছের ডালে। পেটে টেনে আনার মতো চাঁদির জোর নেই ডাগদার সাব। জ্বালা নিয়ে বেঁচে থাকাই আমাদের অভ্যাস!’