জ্বলন্ত চক্ষু
সে রাইকেলা থেকে আসছিলুম কলকাতায়।
সেকেন্ড ক্লাস কামরায় আমি ছিলুম একলা। অচেনা লোকের মুখ দেখতে হবে না বলে মনটা হল খুব খুশি। ট্রেনে মানুষ হয় বিশেষরূপে স্বার্থপর।
জানলার ধারে বসে খানিকক্ষণ দেখলুম চাঁদের আলো দিয়ে ধোয়া নির্জন পৃথিবীটাকে। ছবিতে আঁকা পাহাড় আর বন, মাঠ আর নদী। আরও দূরে চোখ চালালে মনে হয় সেখানে যেন গড়ে উঠেছে অজানা অচেনা অস্ফুট এক স্বপ্নরাজ্য।
নির্জনতার ভিতর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাস ছুটে ট্রেন গতি কমিয়ে প্রবেশ করলে জনকোলাহল মুখর জামসেদপুর স্টেশনে। সেইখানেই লুপ্ত হল আমার একলা থাকার আনন্দ। হঠাৎ কামরার দরজা খুলে গেল সশব্দে। ভিতরে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল এক বৃদ্ধ শিখের দীর্ঘমূর্তি। তার সমস্তই মস্ত। লম্বা-চওড়া প্রকাণ্ড দেহ, প্রকাণ্ড দাড়িগোঁফ, প্রকাণ্ড পাগড়ি। বয়স ষাটের ওপরে বোধ হয়, কিন্তু বলিষ্ঠ দেহ সিধে হয়ে রয়েছে সরল যষ্টির মতো। সূতীক্ষ্ন দৃষ্টির ভিতর দিয়ে বেরুচ্ছে যেন আগুনের ফিনকি।
আগন্তুক এদিককার একখানা আসন দখল করলে। লক্ষ করলুম তার সঙ্গে মোটঘাট কিছুই নেই। সে বেশদূরের যাত্রী নয় ভেবে মনে মনে কিঞ্চিত আশ্বস্ত হলুম।
শিখ যাত্রী আমার দিকে তাকিয়ে রইল নীরবে নির্নিমেষ নেত্রে। ভালো লাগল না তার দৃষ্টির তীব্রতা। জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসলুম।
পাহাড় আর জঙ্গল। আলোক আর অন্ধকার। নির্জনতা আর নিস্তব্ধতা। যদিও রেলগাড়ির শব্দ ভেঙে দিচ্ছিল স্তব্ধতাকে।
কিন্তু এভাবে কতক্ষণ আর বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়? কবিরা হয়তো সারা রাত জেগে বসে পাহাড়ে-প্রান্তরে বনে জ্যোৎস্নার উৎসব দেখতে পারেন; কিন্তু কবিতা লেখা দূরের কথা, মিল কাকে বলে তাই আমি জানি না।
আবার ভিতর দিকে ঘুরে বসলুম। আবার দেখলুম সেই জাগ্রত জ্বলন্ত দৃষ্টি।
অপরিচিত লোকটির আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকার অর্থ কী?— এ হচ্ছে অভদ্রতা। কঠিন ভাষায় প্রতিবাদ করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু শিখের প্রকাণ্ড দেহের খাতিরে সে ইচ্ছাটা দমন করতে বাধ্য হলুম। শক্তির বিরুদ্ধে বিরক্তি ব্যর্থ।
ও দৃষ্টিকে ফাঁকি দেবার সবচেয়ে নিরাপদ উপায় হচ্ছে, বিছানায় লম্বমান হয়ে দুই চোখ মুদে ঘুমিয়ে পড়া। তারপরও লোকটা যদি আমার পানে চেয়ে সারা রাত কাটাতে চায়, আমার তাতে আপত্তি নেই একটুও।
পাতলুম বিছানা। পড়লুম শুয়ে। মুদে ফেললুম দুই চক্ষু।
দুই
আমি হিন্দি ভাষায় শুনলুম, ‘বাবাজি কি এইভাবে ঘুমোবেন?’ জ্বালালে দেখছি। চোখ না খুলেই বললুম, ‘হ্যাঁ।’
‘ঘুমোবেন না।’
ভাবলুম, মন্দ আবদার নয়! আমি জেগে বসে থাকি, আর উনি আমাকে দৃষ্টিবাণ দিয়ে ক্রমাগত বিদ্ধ করতে থাকুন সারা রাত ধরে। ঘুমোবো বই কী! আলবাত ঘুমোব!
আবার শুনলুম, ‘বাবাজি ঘুমোবেন না।’
‘কেন ঘুমোবো না?’
‘এ কামরায় ঘুমোলে আপনি বিপদে পড়বেন।’
‘বিপদ?’
‘হ্যাঁ।’
লোকটা বলে কী? এতক্ষণ পরে চোখ খুললুম। কারণ এর পরেও চোখ না-খোলা হচ্ছে ডাহা বোকামি।
দেখলুম ওদিককার আসনের উপর থেকে অদৃশ্য হয়েছে সেই বৃদ্ধ শিখের মূর্তি।
কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। চেহারা দেখে বোঝা যায় সেও শিখ।
সবিস্ময়ে উঠে বসলুম। বৃদ্ধ শিখই বা কোথায় গেল, আর এই যুবকই বা এখানে চলে এল কেমন করে? ইতিমধ্যে ট্রেন তো কোথাও থামেনি! রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলুম।
ব্যাপারটা হচ্ছে হতভম্ব ভাবটা লক্ষ না-করে যুবক যেন নিজের মনেই বললে, ‘হ্যাঁ বিশেষ করে এই কামরাটাই হচ্ছে বিপদজনক।’
ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে শুধোলুম, ‘কেন?’
‘অজিত সিং এখানে বেড়াতে আসে।’
‘কে অজিত সিং?’
‘আমার শ্বশুর।’
অজিত সিং-এর পরিচয়টা স্পষ্ট হল না। বললুম, ‘আপনার শ্বশুর এখানে আসেন বলেই কি এই কামরাটা বিপদজনক?’
‘হ্যাঁ। অজিত সিং হচ্ছে হত্যাকারী।’
‘বোঝা যাচ্ছে, নিজের শ্বশুর সম্বন্ধে যুবকের ধারণা খুব উচ্চ নয়। কিন্তু অজিত সিং লোকটা কে? হঠাৎ মনে একটা সন্দেহ জাগল। জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আপনার শ্বশুর কি বৃদ্ধ?’
‘হ্যাঁ।’
‘মস্ত লম্বা-চওড়া দেহ।’
‘ঠিক। অজিত সিং বুড়ো, তবু এখনও খুব জোয়ান, কিন্তু তাকে কি আপনি দেখেছেন?’ যুবকের চোখে-মুখে ও স্বরে উত্তেজনা।
বললুম, ‘কাকে আমি দেখেছি জানি না, তবে জামসেদপুর থেকে এক বৃদ্ধ শিখ এই কামরায় উঠেছিল বটে। কখন যে নেমে গিয়েছে তা বলতে পারি না। বোধ হয় আমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।’
যুবক ব্যস্তভাবে কামরার এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আমার কাছে এসে দাঁড়ায়। ‘তাহলে এর মধ্যে অজিত সিং এখানে এসেছিল? হায়, হায়, এত করেও তাকে ধরতে পারলুম না! নিশ্চয়ই সে আমার ভয়েই পালিয়েছে— ধূর্ত শয়তান! আর বাবুজি, তুমিও বেঁচে গিয়েছ।’
‘মানে?’
‘আমি এখানে না এলে তোমাকে সে খুন করত!’
‘কী অপরাধে?’
‘অপরাধ কী আবার? বিনা অপরাধে। সে হচ্ছে হিংস্র পশুর মতো। এই কামরায় সে কয়েক জন যাত্রীকে খুন করেছ— তোমাকেও করত।’
গা শিউরে উঠল। এ যা বলছে তা কি সত্য? বৃদ্ধ শিখের সেই অসহনীয় দীপ্ত চক্ষুর কথা মনে হল। তার দৃষ্টিতে একটা হিংস্র বন্য ভাব দেখেছি বটে। বাঘ হয়তো সেইভাবেই তাকায় শিকারের দিকে।
যুবক বললে, ‘অজিত সিং তাই আমাকে খুন করেছে আর সেই অপরাধে তার ফাঁসি হয়েছে। ফাঁসির পরেও আমি তাকে ছাড়িনি। তার পিছনে পিছনে সর্বদা আছি ছায়ার মতো ঘুরি। আর কত কাল এইভাবে যাবে জানি না, কিন্তু একদিন-না-একদিন তাকে ধরবই ধরব! আর শোনো বাবুজি, সে আমাকে খুন করেছিল এই কামরার ভিতরেই। সাবধান, খুব সাবধান! এখনও এই কামরায় এলে তার মাথায় জাগে খুনের নেশা!’
তিন
ট্রেন একটা স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে। যুবক হঠাৎ কামরার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল।
যুবককে খুন করবার অপরাধে অজিত সিংহের ফাঁসি হয়েছে এবং তারপরেও ট্রেনে চড়ে ভ্রমণ করছে তারা দুজনে।
চমৎকার গল্প! কোনো গাঁজাখুরি উপন্যাসের লেখকও এমন উদ্ভট কল্পনা মাথায় আনতে পারেনি!
ট্রেন ছুটছে। খানিকক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে উন্মত্ত যুবকের কথা ভাবতে লাগলুম। তারপরে মনে মনে হেসে আবার শয়নের উদ্যোগ করেছি, হঠাৎ চোখ পড়ল ওদিককার আসনে। এ কী চরম বিস্ময়!
মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসে আছে সেই বৃদ্ধ শিখ! তার জ্বলন্ত চোখ দুটোও স্থির হয়ে আছে আমার দিকে।
প্রথমটা আমার সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন হয়ে গেল দারুণ আতঙ্কে! হিংস্র হত্যাকারী অজিত সিং। যাত্রীদের সে খুন করে। আমার এখানে তার আবির্ভাবের কারণ কী! এতক্ষণ কোথায় লুকিয়ে ছিল সে?
তারপরেই মনে পড়ল সব কথা। আমি হো-হো করে হাসতে লাগলুম।
পুরু ভুরু সংকুচিত করে বৃদ্ধ বিরক্ত স্বরে বলল, ‘হাসছ কেন?’
‘তুমি কি অজিত সিং?’
‘আমার নাম তোমাকে কে বললে?’
‘তোমার জামাই।’
‘কে শের সিং? সে আর কী বলেছে?’
‘তাকে তুমি খুন করেছ। তাই বিচারে তোমার ফাঁসি হয়েছে।’
‘সত্য কথা।’
আমি আবার হো-হো করে হেসে বললুম, ‘তোমরা শ্বশুর-জামাই কেউ কম যাও না। ধন্য তোমরা। কিন্তু এ কী-কীরকম ঠাট্টা?’
‘ঠাট্টা?’
‘ঠাট্টা নয়তো কী? চলন্ত ট্রেনে ওঠা-নামা করে যাত্রীদের মিথ্যে ভয় দেখিয়ে তোমরা কী আনন্দ পাও বাবা? জেনে রাখো এত সহজে ভয় পাব না।’
অজিত সিংহের চোখ দুটো আরও তীব্র হয়ে উঠল, কিন্তু মুখে সে কিছুই বললে না।
‘নিহত শের সিং আর ফাঁসিকাঠে মৃত অজিত সিং দুজনেই জীবন্ত। দুজনেই হয়তো বিনা টিকিটেই রেলপথে ভ্রমণ করছে আর খোশমেজাজে করছে যাত্রীদের পিলে চমকে দেবার চেষ্টা। এমন আজগুবি ঠাট্টার কথা কে কবে শুনছে! দোহাই সিংহমশাই, দয়া করে অমন কটমটিয়ে আমার দিকে আর চেয়ে থাকবে না। ঠাট্টারও একটা সীমা আছে। আপাতত আমাকে একটু ঘুমোতে দেবেন কি? নইলে আমি অন্য কামরায় যেতে বাধ্য হব। পরের স্টেশন আসতে আর দেরি নেই!’
অজিত সিং গম্ভীর স্বরে ধীরে ধীরে বললে, ‘তোমার ধারণা, আমরা তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছি।’
‘নিশ্চয়!’
‘তোমার ধারণা আমরা জীবিত?’
‘তা আর বলতে।’
‘মূর্খ!’ অজিত সিং দাঁড়াল। তার কাঁধ থেকে পৈতার মতো বন্ধনীতে ঝুলানো কৃপাণ দুলে উঠল। জ্বলজ্বল করছে তার দুটো নৃশংস চক্ষু।
মনে মনে প্রমাদ গুণে ভাবলুম, ব্যাপার তো সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না? ঠাট্টাটা এইভাবে সাংঘাতিক হয়ে উঠবে নাকি? শ্বশুর আর জামাই, দুজনেই নিশ্চয় উন্মাদরোগগ্রস্থ। ঘুম থেকে উঠে কার মুখ দেখেছি, আজকের যাত্রা শুভ নয়।
প্রচণ্ডস্বরে অজিত সিং বললে, ‘শের সিং, শের সিং! তুমিই হচ্ছ আমার দুষ্ট গ্রহ— কুক্ষণে আমি তোমাকে হত্যা করেছিলুম! আমার কাছ থেকে অনেক শিকার তুমি কেড়ে নিয়েছ, কিন্তু আজ আর তুমি পারলে না! তুমি আসছ জেনেই আমি গা ঢাকা দিয়েছিলুম, কিন্তু তুমি বিদায় হবার পর আবার আমি ফিরে এসেছি! এবারে আমার হাত থেকে কেউ আর শিকার ছিনিয়ে নিতে পারবে না— এবারে জয়ী হব আমিই, হা-হা-হা-হা-হা-হা…’
কী ভীষণ সেই অট্টহাস্য, ফেটে গেল যেন আমার কান! কাঁপতে-কাঁপতে আমি উঠে দাঁড়ালুম।
আচম্বিতে নিভে গেল কামরার আলো।
বিস্ফারিত চোখের সামনে দেখলুম, নীলবর্ণ অগ্নিতে ভরা দু-দুটো নিষ্ঠুর, ক্রুদ্ধ ও বুভুক্ষু দৃষ্টি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
পায়ে পায়ে পিছোতে পিছোতে কামরার একপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালুম।
সেই অপার্থিব, ভয়ঙ্কর চোখ দুটো তখন যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে।
দৈবগতিকে হাত লেগে গেল বৈদ্যুতিক বাতির চাবিতে। দপ করে আবার জ্বলে উঠল আলো— সঙ্গে সঙ্গে বাইরেও দেখা গেল সারি সারি বৈদ্যুতিক আলোক, জনতার কণ্ঠস্বর। ট্রেন প্রবেশ করছে খড়গপুর স্টেশনে।
কামরার ভিতর দাঁড়িয়ে আছি একলা। কোথায় অজিত সিং আর তার সেই জ্বলন্ত চক্ষু। আমার মাথা কি হঠাৎ খারাপ হয়ে গিয়েছিল? আমি কি এতক্ষণ ধরে এক দুঃস্বপ্ন দেখছিলুম?
স্বপ্নই হোক আর যাই-ই হোক বাবা, আর এ-কামরায় নয়! চুলোয় যাক একলা থাকার আনন্দ। আমি চাই এখন জনতায় পরিপূর্ণ একখানা কামরা। বসবার জায়গা না-পেলে দাঁড়িয়ে যেতে রাজি আছি। তাড়াতাড়ি প্লাটফর্মে নেমে পড়ে চিৎকার করলুম ‘কুলি কুলি’।