জ্ঞান ও বিজ্ঞান
মহাপ্রভু ব্রাত্যজনদের বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। প্রেমের প্লাবনে একটা যুগকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। শাস্ত্র থেকে ধর্মকে মুক্ত করেছিলেন। আচার- অনুষ্ঠান, ‘ডুকৃঞকরণে’ কারারুদ্ধ মানুষের ভগবানকে মুক্ত করে মানুষের নাগালে এনে দিয়েছিলেন। চণ্ডাল! তুমিও ‘দ্বিজশ্রেষ্ঠ’ যদি ‘হরিভক্তিপরায়ণ’ হও। ভগবানের চোখে মানুষের তো কোন জাত নেই। কে বলেছে, ভগবানকে পাবার জন্য সর্বত্যাগী হতে হবে! ভক্তি, বিশ্বাস, প্রেম আর নাম—এই হলো সেই চার চাকার গাড়ি। চেপে বস, দেখ কি হয়! তিনি ছিলেন অবতার, ঠাকুরের কথায়, “বাহাদুরি কাঠ”।
তুলসীদাস বললেন :
“জ্ঞান গরিবী হরি ভজন, কোমল বচন অদোখ।
তুলসী কভু ন ছোড়িয়ে, দমা শীল সন্তোখ।।”
জ্ঞান, গরিবী, হরিভক্তি, মধুর বচন, ক্ষমা, সৎপ্রকৃতি, সন্তোষ কখনো ছেড়ো না, তাহলে তাঁকে পাবে না। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, জ্ঞান! জ্ঞান কাকে বলে! ডিগ্রি, ডিপ্লোমার তাগা-তাবিজ। না, সে তো তোমার ব্যবহারিক জ্ঞান। ও দিয়ে তোমার ক্যাশবাক্সের তালা খোলা যাবে। গাড়ি-বাড়ি-হ্যানাত্যানা হবে। অহঙ্কারের লেজ বেরবে। এঁড়ে তর্ক করতে শিখবে। শকুন হয়ে যাবে। কনকর্ডে চড়ে মেঘলোকের সীমানার বহু ঊর্ধ্বে উঠলেও মন পড়ে থাকবে ভাগাড়ে। কামিনী আর কাঞ্চনে। ঐ জ্ঞানে ভগবানকে পাওয়া যাবে না। ঈশ্বরকে জানার নাম জ্ঞান, ঈশ্বরকে না জানার নাম অজ্ঞান। সব তাঁর। আকাশ, বাতাস, জীবজগৎ, শাস্ত্র, বিজ্ঞান, দয়া, মায়া, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা—সবই তাঁর বিভিন্ন প্রকাশ। তিনি গাড়ি চাপছেন, তিনি ভিক্ষা করছেন। তিনি দাতা হয়ে দান করছেন, আবার তস্কর হয়ে হরণ করছেন। “মহামায়ানুভাবেন যথা।” মহামায়া, পরমেশ্বরী-শক্তি। অঘটন-ঘটন-পটীয়সী ব্রহ্মাত্মিকা শক্তি। ঠাকুর বলছেন : “তাঁর ইচ্ছা যে খানিক দৌড়াদৌড়ি হয়, তবে আমোদ হয়। তিনি লীলায় এই সংসার রচনা করেছেন। তিনিই মহামায়া। তিনিই শক্তিরূপিণী, আদ্যাশক্তি। জগৎকে মুগ্ধ করে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তিনি অজ্ঞান করে রেখে দিয়েছেন।” তথাপি “মমতাবর্তে মোহগর্তে নিপাতিতাঃ/মহামায়াপ্রভাবেন সংসারস্থিতিকারিণা।” তিনিই কারণ। “মহামায়া হরেশ্চৈতত্তয়া সংমোহ্যতে জগৎ।” জ্ঞানও তাঁর অজ্ঞানও তাঁর। শ্রীভগবান অর্জুনকে বলছেন, তুমি কাকে মারবে সখা? আমি যে আগেই সব মেরে রেখেছি। তুমি নিমিত্ত মাত্র “ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্বমেব নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্।।”
অর্জুন জ্ঞান দর্শন করলেন। শোনা কথা, কেতাবী জ্ঞান নয়—প্রত্যক্ষ দর্শন। সাধারণ মানুষী চোখে এই দর্শন অসম্ভব। শ্রীভগবান বললেন, তোমাকে আমি দিব্যচক্ষু দান করছি
“ন তু মাং শক্যসে দ্রষ্টুমনেনৈব স্বচক্ষুষা
দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্।।”
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারমশাইকে বলছেন, যে-চোখে জগৎ দর্শন হচ্ছে, সেই চোখে ভগবানকে কি দেখা সম্ভব? না। পরিষ্কার একটি—না। “তাঁকে চর্মচক্ষে দেখা যায় না। সাধনা করতে করতে একটি প্রেমের শরীর হয়—তার প্রেমের চক্ষু, প্রেমের কর্ণ। সেই চক্ষে তাঁকে দেখে, সেই কানে তাঁর বাণী শুনা যায়। আবার প্রেমের লিঙ্গ যোনি হয়।… এই প্রেমের শরীরে আত্মার সহিত রমণ হয়।… ঈশ্বরের প্রতি খুব ভালবাসা না এলে হয় না। খুব ভালবাসা হলে তবেই তো চারিদিক ঈশ্বরময় দেখা যায়। খুব ন্যাবা হলে তবেই চারিদিক হলদে দেখা যায়। তখন আবার ‘তিনিই আমি’ এইটি বোধ হয়। মাতালের নেশা বেশি হলে বলে, ‘আমিই কালী’। গোপীরা প্রেমোন্মত্ত হয়ে বলতে লাগল, ‘আমিই কৃষ্ণ’। তাঁকে রাতদিন চিন্তা করলে তাঁকে চারিদিকে দেখা যায়—যেমন প্রদীপের শিখার দিকে যদি একদৃষ্টে চেয়ে থাক, তবে খানিকক্ষণ পরে চারিদিক শিখাময় দেখা যায়।”
দু-ধরনের জ্ঞান। অচেতন জ্ঞান আর চেতন জ্ঞান।
অচেতন জ্ঞান কেমন? আমি বিরাট বিজ্ঞানী, এই তোমাদের বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে দিলাম। এই নাও রেডিও, টিভি। এই নাও লেসার, কনকর্ড। এই নাও ফ্যাক্স, পেজার। এই নাও রোবট, নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড। বিজ্ঞানের কী অগ্রগতি! মানুষ কী করছে রে ভাই! মানুষের কী মাথা, কী পাওয়ার! এই হলো অচেতন জ্ঞান। এরই নাম—ঠাকুরের কথায়—হাম্বা, হাম্বা। চেতন জ্ঞান গুম মেরে কিছুক্ষণ বসে থেকে প্রশ্ন করবে, তুমি কি করেছ ভাই! শক্তি ছিল, তাই না তুমি জেনারেটারে সেই শক্তি ধরলে! শক্তি যদি না থাকত? জল না থাকলে বাষ্প হতো? আকাশ না থাকলে, বায়ুমণ্ডল না থাকলে তোমার শব্দতরঙ্গ, তোমার দেহছবি, অক্ষরের ছবি দূর যাত্রায় ভাসাতে পারতে? একটা কোয়ার্জ ক্রিস্টাল তিনি যদি তোমাকে না দিতেন তাহলে তোমার ইলেকট্রনিক্সের ভেলকি কি দেখাতে পারতে? সবই তিনি দিয়ে রেখেছেন। মানুষ যত এগোবে তত পেতে থাকবে। মানুষ তো এগোবে না, এগোবে কাল। কাল যেন সেই অরণ্য। ঠাকুরের গল্পটি এখানেও প্রযোজ্য। কাঠুরিয়াকে সন্ন্যাসী বললেন : “এগিয়ে যাও।” এগিয়ে যাওয়াটা হলো জ্ঞান। আরণ্যক মানুষ কাঠকুটো, ডালপালা, বন্য পশুতেই সন্তুষ্ট ছিল। প্রকৃতি কখনো রুদ্র, কখনো শান্ত, কখনো বর্ষা, কখনো বসন্ত। চতুর্দিকে মৃত্যুর উৎসব। অন্ধকার মানে মৃত্যু। অরণ্যের গভীর অন্ধকারে জগৎ অদৃশ্য। নির্দেশ ছিল—এগিয়ে যাও। কাল এগোল। পাওয়া গেল বৃক্ষের অরণ্য, মোটা গাছ, মোটা কাঠ। আস্তানা তৈরি হলো, জনপদ গড়ে উঠল, চাষের জমি বেরল, বল্কলে ঢাকা পড়ল নিরাভরণ দেহ। হঠাৎ পাওয়া গেল চকমকি পাথর। মাথায় জ্ঞান তো ছিলই, ছিল কৌতূহল, অনুসন্ধিৎসা, উদ্যম বাঁচার তাগিদ, গোষ্ঠী-প্রীতি। প্রেম ছিল, অনুভূতি ছিল, অধিকারবোধ ছিল, হিংসা ছিল, অহিংসা ছিল, শূন্যতা ছিল, পূর্ণতার বোধ ছিল, ভয় ছিল, সাহস ছিল, অপরাজেয় হবার বাসনা ছিল। তিনি বলেছিলেন—এগিয়ে যাও। পাওয়া গেল চন্দনের বন, অর্থাৎ পাওয়া গেল সুন্দরকে, জীবনের সুগন্ধকে। এগিয়ে যাও, পাওয়া গেল তামা, লোহা, ধাতু, হীরা, মণিমুক্তা। পাওয়া গেল জটিল সভ্যতা। গতি, প্রতিযোগিতা।
বহির্জগতে মানুষের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এগোতে লাগল মন ও মনন। বিজ্ঞানীর প্রাথমিক বোধের অহঙ্কার বারে বারে থমকাতে লাগল। আইনস্টাইন বললেন অবশেষে—
“The belief in an external world independent of the perceiving subject is the basis of all natural science. Since however, sense perception only gives information of this external world or of ‘physical reality’ indirectly, we can only grasp the latter by speculative means. It follows from this that our notions of physical reality can never be final.”
জগৎ সম্পর্কে অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বাস্তব সম্পর্কে আমার জ্ঞান মানে আমার ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যতটুকু আসছে! মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান। তারপর অনুমান আইনস্টাইন বললেন, বাস্তব সম্পর্কে আমাদের ধারণা কখনোই শেষ সিদ্ধান্ত হতে পারে না। ‘এই আমার শেষকথা’ যদি কেউ বলেন, তাহলে ঠাকুর যা বলেছিলেন সেই কথাই হলো—’মতুয়ার বুদ্ধি’, ‘আমার ঘড়ি ঠিক চলছে”।
আইনস্টাইন বললেন : “In our endeavour to understand reality we are somewhat like a man trying to understand the mechanism of a closed watch.” একটা খোপে ভরা ঘড়ি দেখছি যেন! ডায়াল, কাঁটা, সংখ্যা, শব্দও শুনছি টিকটিক। কিন্তু এমন ঘড়ি, যা খোলার উপায় নেই! আইনস্টাইন বলছেন : “If he is ingenious he may form some picture of a mechanism which could be responsible for all the things he observes, but he may never be quite sure his picture is the only one which could explain his observations.” খোলসা মাথার মানুষ একটা ধারণা করতে পারে মাত্র। বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা; কিন্তু সংশয় থেকেই যাবে, কারণ খুলে দেখার তো উপায় নেই। এই হলো বিজ্ঞানের আস্তিকতা। আমার ব্যাখ্যার বিপরীত ব্যাখ্যাও আসতে পারে। বিজ্ঞানীরা তার জন্য প্রস্তুত থাকেন। সম্প্রতি কোয়ান্টাম ফিজিক্স প্রশ্ন তৈরি করেছে—যা দেখছি তা কি দেখছি! দেখার জন্য আলোর প্রয়োজন। একটা বাক্সের মধ্যে একটি বস্তু অন্ধকারে পড়ে আছে। সেই বস্তুটিতে আলো ফেললে তবেই দেখা যাবে। আলোর একটা ভর আছে। নিক্ষিপ্ত আলো প্রক্ষিপ্ত হবে। বস্তুর যে-স্বরূপ ধরা পড়বে তা কি প্রকৃত স্বরূপ! সেইটাই কি ‘রিয়ালিটি’! আলো না থাকলে বস্তুটিও নেই। তখনই প্রশ্ন, মানুষ না থাকলে বিশ্ব কি থাকবে? আমৃত্যু আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন : “To his death Einstein believed in a casual universe, one that simply does not exist on the level of atomic events.” ঠাকুর বলছেন : “এই সংসার মজার কুঠি।” ঘট আর সূর্যের উপমা দিচ্ছেন। দশটি জলপূর্ণ ঘট। প্রত্যেকটিতে সূর্যের প্রতিফলন। দশটি সূর্য দশটি ঘটে টলটল করছে প্রতিবিম্ব হয়ে। ঘটগুলিকে এক এক করে ভাঙা হচ্ছে। নটি ঘট নটি সূর্য, আটটি ঘট আটটি সূর্য। এমনি করে একটি ঘট একটি সূর্য। ঠাকুর প্রশ্ন করছেন, শেষ ঘটটিও ভেঙে দেওয়া হলো, রইল কি! নিজেই উত্তর দিচ্ছেন, কি রইল কে বলবে? কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীদেরও সেই এক কথা—বাস্তব কি? “What is reality?” বিখ্যাত সাহিত্যিক বোরেস লিখছেন : “We have dreamed the world, we have dreamed it as enduring, mysterious, visible, omnipresent in space and stable in time, but we have consented to tenuous and eternal intervals of illogicalness in its architecture that we may know it is false.
ঠাকুর চাষার গল্প বলছেন। বেশি বয়সে একটি ছেলে হয়েছিল। ছেলেটি বড় হলো, হঠাৎ একদিন মারা গেল। পরিবার খুব কাঁদছে, চাষার চোখে এক ফোটাও জল নেই। পরিবার প্রতিবেশীদের কাছে দুঃখ করছে—এমন ছেলেটি গেল এঁর চোখে একটু জল পর্যন্ত নেই। অনেকক্ষণ পরে চাষা পরিবারকে সম্বোধন করে বলছে : “কেন কাঁদছি না জান? আমি কাল স্বপন দেখেছিলাম যে, রাজা হয়েছি আর সাত ছেলের বাপ হয়েছি। স্বপনে দেখলাম যে, ছেলেগুলি রূপে গুণে সুন্দর। ক্রমে বড় হলো, বিদ্যা ধর্ম উপার্জন করল। এমন সময় আমার ঘুম ভেঙে গেল; এখন ভাবছি যে, তোমার ঐ এক ছেলের জন্য কাঁদব, কি আমার সাত ছেলের জন্য কাঁদব!” ঠাকুর বলছেন, জ্ঞানের দৃষ্টিতে স্বপ্নে আর বাস্তবে কি ফারাক? গীতার সেই বিখ্যাত শ্লোক—
“যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ।।”
শঙ্করাচার্য বলছেন একই কথা—”রাগদ্বেষাদিসঙ্কুল সংসার স্বপ্নবৎ; স্বকালে অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থাতেই স্বপ্নকালীন ঘটনাগুলি সত্য বলে বোধ হয়; কিন্তু জাগ্রদবস্থায় অসত্যবৎ প্রতীয়মান হয়। সংসারও সেইরূপ অলীক; যতদিন অবিদ্যা বিদ্যমান থাকে, ততদিনই সংসার সত্য। আত্মবোধ জন্মালে আর সে- জ্ঞান থাকে না, তখন সবই অলীক বোধ হয়।”
“সংসারঃ স্বপ্নতুল্যো হি রাগদ্বেষাদিসঙ্কুলঃ।
স্বকালে সত্যবদ্ভাতি প্রবোধেসত্যবদ্ভবেৎ।।”
জল আন্দোলিত হলে চাঁদের ছবি ভেঙে টুকরো টুকরো, খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়। চিত্ত স্থির হলে তবেই অখণ্ড আত্মস্বরূপের আভাস ধরা পড়ে। ঠাকুর বলছেন : “যতক্ষণ জল ঘোলা থাকে, ততক্ষণ চন্দ্রসূর্যের প্রতিবিম্ব তাতে ঠিক ঠিক দেখা যায় না, তেমনি মায়া অর্থাৎ ‘আমি’ এবং ‘আমার’ এই জ্ঞান যতক্ষণ না যায়, ততক্ষণ আত্মার সাক্ষাৎকার ঠিক ঠিক হয় না।”
একালের ভোগবাদী মানুষ ফোঁস করে উঠবেন—রাখুন মশাই আপনার আত্মার সাক্ষাৎকার। এসেছি, একদিন পটল তুলব, তার মাঝে তেড়ে বেঁচে থাকি। ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স, শেয়ার, গাড়ি-বাড়ি, বিদেশভ্রমণ, হ্যাট, ম্যাট, গ্যাট। স্বামীজী বললেন, ঠিক আছে, অতিশয় উপাদেয় কথা। গীতার আগে ফুটবল— একথা আমারই। আমার গুরুও বলেছেন, আগে অন্ন, পরে ধর্ম; কিন্তু আত্মতত্ত্বটি জানলে তোমার শক্তি যে আরো বেড়ে যাবে, বাবা–ভোগের শক্তি, কর্মের শক্তি। আরো ভাল ডাক্তার, উকিল, ম্যানেজার, ইঞ্জিনিয়ার, গৃহী, বিষয়ী হতে পারবে। রোগ, শোক, জরা, ব্যাধির সদা-আতঙ্ক থেকে মুক্ত হবে। মানসিক ব্যাধি দূর হবে। সিজোফ্রেনিয়া, প্যারানোয়িয়া। প্রতিযোগিতায় ভেটকে পড়বে না। রেসের মাঠে দৌড়টা আরো জোরদার হবে।
ঠাকুর বলছেন, ঘোলা জলে একটি নির্মলি (ফলবিশেষ) ফেলে দিয়ে কিছুকাল স্থির রাখ। সব ময়লা নিচে পড়ে যাবে। স্ফটিকজলে তখন স্ব- স্বরূপকে দেখতে পাবে। ‘নো দাইসেলফ।’ নিজের ঘর চিনতে পারবে। তখন এই বিস্রস্ত সংসারকে বাগে আনা আরো সহজ হবে। সেলফ ম্যানেজমেন্ট, কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট। তোমার ‘আমি’-টা তখন মায়াশূন্য ‘বজ্র আমি’ হবে।
শঙ্করও এই নির্মলির কথা তাঁর ‘আত্মবোধ’-এ বলেছেন :
“অজ্ঞানকলুষং জীবং জ্ঞানাভ্যাসাদ্ বিনির্মলম্।
কৃত্বা জ্ঞানং স্বয়ং নশ্যেজ্জলং কতকরেণুবৎ।।”
নির্মলিবীজের রেণু যেমন মলিন জলকে নির্মল করে স্বয়ং বিলয়প্রাপ্ত হয়, জ্ঞানরূপিণী বিদ্যাও সেইরকম জ্ঞানাভ্যাসবশে অজ্ঞানকলুষরূপ জীবত্বভ্রম দূর করে আত্মতত্ত্বকে যথেষ্ট নির্মল করে স্বয়ং বিনাশপ্রাপ্ত হয়। ঠাকুর বলছেন, চাল-কলা বাঁধা বিদ্যার প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কারণ তুমি সন্ন্যাসী নয়— সংসারী হবে। তোমার পরিবার আসবে। সন্তান হবে। তাদের প্রতিপালন করতে হবে। পরিষ্কার বলছেন : “কতকগুলি ঋণ আছে। দেবঋণ, ঋষিঋণ আবার মাতৃঋণ, পিতৃঋণ, স্ত্রীঋণ। মা-বাপের ঋণ পরিশোধ না করলে কোন কাজই হয় না। স্ত্রীর কাছেও ঋণ আছে। হরিশ (হরিশ কুণ্ডু—কলকাতার উপকণ্ঠে গড়পারে বাড়ি ছিল। ব্যায়াম-শিক্ষকের কাজ করতেন। ঠাকুরের স্নেহভাজন হয়েছিলেন সরল শান্ত স্বভাবের জন্য। পরবর্তী কালে মস্তিষ্কবিকৃতি হয়েছিল।) স্ত্রীকে ত্যাগ করে এখানে এসে রয়েছে। যদি তার স্ত্রীর খাবার জোগাড় না থাকত, তাহলে বলতুম, ঢ্যামনা শ্যালা!”
এই আমাদের ঠাকুর। এই ঋণের সঙ্গে স্বদেশঋণও যুক্ত হবে। ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, শিক্ষক, কর্মী, শ্রমিক, সৈনিক—সবই চাই; কিন্তু জ্ঞানরূপিণী বিদ্যাও চাই। সেই বিদ্যায় কি দর্শন হবে—জগৎ দুঃখে জরে নেই। ঠাকুর দেখেছিলেন—”এক-একবার দেখি বরষায় যেরূপ পৃথিবী জরে থাকে— সেইরূপ এই চৈতন্যতে জগৎ জরে রয়েছে।” সেই দর্শন হতে পারে। “তাঁর চৈতন্যে জগতের চৈতন্য। এক-একবার দেখি, ছোট ছোট মাছের ভিতর সেই চৈতন্য কিলবিল করছে।”