জোড় বিজোড়

জোড় বিজোড়

খেলিতে বসিয়া যদি খেলার প্রতিপক্ষ না পাওয়া যায়, কিংবা খেলিতে খেলিতে প্রতিপক্ষ যদি বলে আর খেলিব না, অথবা খেলার সময় এক পক্ষের যদি খেলায় মন না বসে—তাহা হইলে খেলা আর খেলা থাকে না, শুধু দিন যাপনের, শুধু প্রাণ ধারণের গ্লানি হইয়া দাঁড়ায়। তা সে তাস-পাশাই হোক, আর জীবনের গভীরতম খেলাই হোক।

কিন্তু খেলার নেশা যাহার কাটে নাই, তাহাকে ঠেকাইয়া রাখা যায় না, যেমন করিয়া হোক সে খেলিবেই। কানাকড়ি নিয়াও খেলিবে। পৃথিবীতে এই অবুঝ খেলোয়াড়দের লইয়াই বিপদ।

ছয় বৎসর পূর্বে নির্মলের সহিত যখন নির্মলার বিবাহ হইয়াছিল, তখন সকলে আনন্দে জয়ধ্বনি করিয়াছিল। শুধু যে নামের সহিত নাম মিলিয়াছিল তাহা নয়; সব দিক দিয়াই রাজযোটক ঘটিয়াছিল। নির্মল জমিদারের ছেলে হইয়াও নির্মল চরিত্র এবং নির্মলা যেন হিমালয় শৃঙ্গের নিষ্কলঙ্ক তুষার দিয়া গড়া একটি প্রতিমা।

দুইটি তরুণ তরুণী পরস্পর আকৃষ্ট হইয়াছিল যেমন চুম্বক আর লোহা আকৃষ্ট হয়। দার্শনিক উপমা দেয়া যায়—চণকবৎ। চণকের একটি দানায় যেমন দুইটি দল থাকে সেইরূপ, দ্বিদল হইলেও এমন দৃঢ়সংবদ্ধ যে এক বলিয়া মনে হয়।

যৌবনের বিচিত্র রসে উচ্ছলিত দিনগুলি কাটিতে থাকে, হাসি অশ্রু আনন্দ বিষাদ সমস্তই পরস্পরকে আশ্রয় করিয়া। জগতে যেন তৃতীয় প্রাণী নাই; বিশ্ব সংসার সঙ্কুচিত হইয়া একটি গৃহের একটি কক্ষে আবদ্ধ হইয়াছে।

একটি গৃহের একটি কক্ষ! বাসক রজনীর স্বপ্ন-সুরভিত পালঙ্ক শয্যা। হৃদয়ের পূজা-মন্দির, বিদেহ দেবতার দেউল। এখানে দুইটি তদ্গত পূজার্থী ছাড়া আর কাহারও প্রবেশাধিকার নাই।

একটি একটি করিয়া বছর কাটে। বহির্জগতে পরিবর্তন হয়, যেন রঙ্গমঞ্চের নাট্যাভিনয়। নির্মলের বাবা মারা যান, নির্মল জমিদার হইয়া বসে। বৈঠকখানায় শিকারলোলুপ বন্ধুর দল ফাঁদ পাতিয়া নির্মলকে ধরিবার চেষ্টা করে। কিন্তু তাহাদের চেষ্টা সফল হয় না। অন্দরমহলে মাসি-পিসির দল হা-হুতাশ করে—নির্মলের সন্তান হইল না। কিন্তু নির্মল সন্তান চায় না; তাহার নিভৃত মিলনমন্দিরে ভাগীদার জুটিবে ইহা তাহার অসহ্য। সে যাহা পাইয়াছে তাহাতেই তাহার হৃদয় পূর্ণ হইয়া আছে।

মাঝে মাঝে নির্মল হঠাৎ শিকার করিতে চলিয়া যাইত; তিন-চার দিন বনে জঙ্গলে বন্দুক ঘাড়ে ঘুরিয়া বেড়াইত, তারপর গৃহে ফিরিয়া আসিত। তখন মনে হইত জীবনের রস আরও গাঢ় হইয়াছে। রসনার স্বাদ তীক্ষ্ণতর হইয়াছে। স্বেচ্ছাকৃত বিরহের পর মিলন মধুরতর হইয়া উঠিত।

এমনিভাবে ছয়টি বছর কোথা দিয়া কাটিয়া গেল। নির্মলের বয়স এখন ত্রিশ, নির্মলার তেইশ, যৌবনের মধ্যাহ্ন। কিন্তু মধ্যাহ্নেও কখনও কখনও সূর্যগ্রহণ হয়। তখন পৃথিবী অন্ধকার হইয়া যায়; কিছুক্ষণের জন্য মনে হয় এই অকাল-রাত্রি বুঝি আর প্রভাত হইবে না।

নির্মল সহসা একদিন অনুভব করিল তাহার ক্রীড়ামন্দিরে সে একা, তাহার খেলার সাথী কখন চলিয়া গিয়াছে। বাহিরের বিপুল সংসার তাহার লীলা-সঙ্গিনীকে গ্রাস করিয়া লইয়াছে।

এই ব্যাপার একদিনে ঘটে নাই। কিন্তু খেলায় মত্ত ছিল বলিয়া নির্মল তাহা দেখিতে পায় নাই, হঠাৎ নেশার ঘোরেই তাহার চোখ খুলিয়া গেল। নির্মলা আর তাহার অন্তরের অন্তরতমা নয়, সে সংসারের গৃহিণী হইয়া বসিয়াছে।

প্রেয়সী নারী যখন অন্তরের পালঙ্ক শয্যা ছাড়িয়া সংসারের সিংহাসনে আরোহণ করে তখন সে কী হারাইল এবং কতখানি লাভ করিল তাহার হিসাব কেহ রাখে নাই। নির্মলাও হিসাব করিয়া কিছু করে নাই; জোয়ারের জল যেমন অলক্ষিতে তীরস্থ শিলাখণ্ডকে নিমজ্জিত করে তেমনিভাবে নিজের অজানিতেই নির্মলা সংসারের অলক্ষ্য-গ্রসমান জলতলে ডুবিয়াছিল। প্রকৃতির বশে মানুষ যাহা করে তাহার উপর নিগ্রহ চলে না।

সংসার নারীকে স্বভাবতই আকর্ষণ করে। সংসারের অশেষ বৈচিত্র্য অনিবার্য কর্মপ্রবাহের আঘাতে আঘাতে ভাঙা-গড়ার খেলা, শাসন পালন ও নিয়ন্ত্রণের অফুরন্ত সুযোগ—এই সব মিলিয়া সংসারকে বুদ্ধিমতী ও কর্মিষ্ঠা নারীর কাছে পরম লোভনীয় করিয়া তোলে। বিশেষত যে-সংসার কর্ণধারের অভাবে স্রোতের মুখে যথেচ্ছা ভাসিয়া চলিয়াছে তাহার হাল নিজের হাতে ধরিবার লোভ কোনও নারীই সম্বরণ করিতে পারে না। কিন্তু নির্মলের মন মানে না। পুষ্পে কীট সম তাহার মর্মে তৃষ্ণা জাগিয়া থাকে, লাঞ্ছিত ভ্রমরের ন্যায় তাহার আকাঙক্ষা বাঞ্ছিতকে ঘিরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। কেন এমন হইবে? না, সে তাহার প্রেয়সীকে সংসারের স্রোতে ভাসিয়া যাইতে দিবে না; নিজের দৃঢ় বাহুবন্ধনের মধ্যে ধরিয়া রাখিবে।

কিন্তু কি দিয়া তাহাকে ধরিয়া রাখিবে? জাল দিয়া মাছ ধরা যায়, জলকে ধরিয়া রাখা যায় না। নির্মলা ও নির্মলের সম্বল ছিল মনের সম্বন্ধ, তাহাতে স্থূলতা ছিল না। দাম্পত্য জীবনের স্বাভাবিক মান অভিমান রতি বিরতি সবই ছিল, কিন্তু তাহার প্রকাশ ছিল অতি সূক্ষ্ম। ভ্রূকুটি রচনা দ্বারা কোপ প্রকাশ পাইত, নিগ্রহের অভিব্যক্তি হইত মৌন দ্বারা, স্মিতহাস্যে অনুনয় এবং দৃষ্টিতে প্রসন্নতা ব্যক্ত হইত; মনের গভীর কথা ভাষার অপেক্ষা রাখিত না। তাই নির্মলার মনকে যখন ধরিয়া রাখিবার প্রয়োজন হইল তখন নির্মল দেখিল নির্মলার মন ধরা-বাঁধার বাহিরে চলিয়া গিয়াছে; যে অন্তর্লোকবাসিনী নীরব ইঙ্গিতের অর্থ বুঝিত সে এখন ভাষার ভাষ্য ছাড়া কিছুই বোঝে না। স্থূল সংসার নির্মলার অনুভূতিকে স্থূল করিয়া দিয়াছে।

নির্মল বাক্যের দ্বারা অভিযোগ প্রকাশ করিতে ভ্যস্ত নয়, কুণ্ঠা তাহার কণ্ঠ চাপিয়া ধরে। কেবল মর্মমূলে অনির্বাণ মুর্মুর-দহন জ্বলিতে থাকে।

একদিন হঠাৎ নির্মলাকে কিছু না বলিয়া নির্মল শিকারে বাহির হইয়া গেল। অন্তঃপুরে নির্মলা দাসীর মুখে সংবাদ পাইয়া একটু বিমনা হইল, পূর্বে এমন কখনো ঘটে নাই। তারপর সে গৃহকর্মে মন দিল। মাস-কাবারী বাজার আসিয়াছে। অবহেলা করা চলে না।

নির্মল জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু ফেলিয়াছে; মাঝে মাঝে শিকারের সন্ধানে বাহির হয়। কিন্তু শিকারে তাহার মন নাই; আবার বাড়ি ফিরিবার নামেও মন বিমুখ হইয়া ওঠে।

সাত দিন এইভাবে কাটিবার পর হঠাৎ নির্মলে মন দড়ি-ছেঁড়া হইয়া উঠিল। গৃহ আবার তাহাকে টানিতেছে। সে তাঁবু তুলিয়া ফিরিয়া চলিল।

বাড়ি ফিরিয়া নির্মল আপন প্রসাধনকক্ষে বেশবাস পরিবর্তন করিতেছিল, নির্মলা হাসি হাসি মুখে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল—‘একটা মজার জিনিস করেছি। দেখবে এস।’

নির্মল হর্ষোৎফুল্ল চক্ষে নির্মলার পানে চাহিল। এই সাত দিনের ব্যবধান কি আবার তাহাদের মিলাইয়া দিল! অন্তরের ধন কি অন্তরে ফিরিয়া আসিল?

নির্মল পত্নীর পিছু পিছু শয়নকক্ষে আসিয়া উপস্থিত হইল….

দেখিল ঘর হইতে তাহাদের প্রকাণ্ড পালঙ্ক অন্তর্হিত হইয়াছে, তৎপরিবর্তে ঘরের দুই পাশে দুইটি অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট খাট বিরাজ করিতেছে।

নির্মলা উজ্জ্বল চোখে চাহিয়া বলিল—‘কলকাতা থেকে জোড়া খাট কিনে আনিয়েছি, বিলিতি দোকান থেকে। কি সুন্দর স্প্রিংয়ের গদি দ্যাখো। আমি কাছে শুলে যদি তোমার ঘুম নষ্ট হয়—এখন থেকে আলাদা শোব। কেমন, ভাল হয়নি?’

নির্মল বজ্রাহতের দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর নিঃশব্দে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

শুধু ঘর হইতে নয়, এক ঘন্টার মধ্যে নির্মল বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া গেল। নির্মলা শঙ্কিত হইয়া ভাবিল—এ কি হল! এতে রাগের কি আছে!

জানা গেল নির্মল কলিকাতায় গিয়াছে। কয়েকদিন কিছু ঘটিল না। নির্মলা অনেকটা নিশ্চিন্ত হইয়া সংসারের কাজকর্মে মন দিল; ভাবিল—রাগ পড়িলেই বাড়ি ফিরিবে।

পনেরো দিন পরে নির্মল ফিরিল। সঙ্গে লাল চেলি পরা একটি মেয়ে। মেয়েটি নির্মলার মতো সুন্দরী নয় কিন্তু বয়েস সতেরো আঠারো, সিঁথিতে সিন্দুর।

নির্মলা পাকশালে রান্নাবান্নার তদারক করিতেছিল, নির্মল একেবারে সেইখানে উপস্থিত হইল। নব-বধূকে সম্বোধন করিয়া বলিল—‘শোভা, ইনি তোমার দিদি, এঁকে প্রণাম কর।’

২১ অগ্রহায়ণ ১৩৫৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *