1 of 2

জেলখানা – জরাসন্ধ

জেলখানা – জরাসন্ধ

হরেকরকম নালিশ কয়েদিদের। হারাধন দাস চার-পাঁচ মাস বাড়ির কোনও খবর পায়নি, চিঠি লিখবার মতো কেউ নেই তার, একটা পিটিশন চায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। পিটিশন মঞ্জুর করলেন বড়সাহেব। পুলিশের মারফত খবর সংগ্রহ করে জানিয়ে দেওয়ার ভার নেবেন ম্যাজিস্ট্রেট। রহিম শেখের সাত বছর জেল। জানতে পেরেছে তার বউ নাকি ‘নিকা বসতে’ চলেছে পাশের গ্রামের ফাজেল মোল্লার সঙ্গে। সেও পিটিশন চায় নিকা যাতে বন্ধ হয়। বড়সাহেব মাথা নাড়লেন, তা হয় না। ও-ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেটের কিছু করবার নেই। পরান বাগদির ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে নিয়ে গেছে গুপি সাঁতরা। তারও একটা পিটিশন দরকার বাঁশ উদ্ধারের জন্য। মঞ্জুর হল না। যে জেলে এসেছে তার ফেলে আসা বাড়ি-ঘর, জমি-জিরেত রক্ষা করবার দায়িত্ব সরকারের নয়।

একজন বললে, একটা সুটকেস-এ কিছু মূল্যবান দলিলপত্র রয়ে গেছে তার বাড়িতে। সেটা সে জেল হেফাজতে রাখতে চায়। বড়সাহেব সম্মতি দিলেন। কেউ যদি এসে জমা দেয়, সুটকেস রাখবার ব্যবস্থা হবে জেল-গুদামে, যাওয়ার সময় ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

একটু দূরেই দাঁড়িয়ে-ছিল জগা, জগন্নাথ পাড়ুই। কার সঙ্গে মারামারি করে বছরদুয়েকের মেয়াদ নিয়ে এসেছে। বড়সাহেবের উত্তর শুনে জোরে-জোরে মাথা নাড়ছিল। ‘কিছু বলবে?’ জিজ্ঞাসা করলেন জেলার।

‘আজ্ঞে না, হয়ে গেছে।’

বড় জমাদার বলল, ‘ও পাগলা আছে, হুজুর।’

বড়সাহেব চলে গেলে অন্য কয়েদীরা চেপে ধরল, ‘এই জগা, অমন করে মাথা নাড়ছিলি কেন?’

জগা কিছু ভাঙল না, চোখে-মুখে খুশি-মাখা রহস্য ফুটিয়ে বলল, ‘আছে, আছে।’

দিনকয়েক পরে গেটের সামনে হুলুস্থূল কাণ্ড। একজন গাঁয়ের লোক একটা বড়সড় বকনা নিয়ে এসেছে। বন্দুকধারী সান্ত্রি টহল দিচ্ছিল। হুঙ্কার দিল, ‘হট যাও!’

সে হটল না, বলল, ‘এজ্ঞে, এটা জমা দেব।’

‘কী জমা দেবে? এই গোরু?’

‘এজ্ঞে।’

সান্ত্রি তো অবাক! গোরু জমা দেবে জেলখানায়! এটা কি খোঁয়াড় না পিঁজরাপোল? লোকটাকে হাঁকিয়ে দিতে যাচ্ছিল, সে ভয়ে-ভয়ে বলল, ‘এজ্ঞে, চিঠি আছে।’

‘কই, দেখি?’

ট্যাঁক থেকে বের করল একখানা চারভাঁজ-করা ময়লা পোস্টকার্ড। তার গায়ে জেলখানার রবার-স্ট্যাম্পের ছাপ। তাকে দাঁড়াতে বলে সান্ত্রি চিঠিখানা পাঠিয়ে দিল অফিসে। তারপর সেটা ঘুরতে লাগল এ-টেবিল থেকে ও-টেবিলে। যে দ্যাখে তারই মুখ চুন।

অফিস হয়েই গেছে চিঠিখানা। মাথার ওপরে ইংরেজিতে লেখা ‘কয়েদি নম্বর ১২৩৭-এর জগন্নাথ পাড়ুই’। অর্থাৎ, পোস্টকার্ডখানা ওই লোকটিকে দেওয়া হয়েছিল, সেইসঙ্গে চিঠি লেখার অনুমতি। মাঝখানে আঁকাবাঁকা অক্ষরে কয়েকটা লাইন, তার লেখা বা কাউকে দিয়ে লেখানো। উলটো পিঠে জেলের গোলমোহর, তার মধ্যে বড়সাহেব, অর্থাৎ, সুপারিন্টেন্ডেন্টের সই, নীচে ছোট্ট করে কানাইবাবুর ‘কে’ নামের আদ্যক্ষর বা ইনিশিয়াল।

জেল থেকে কয়েদিদের যত চিঠি যায়, কানাইবাবুর কাজ হল সেগুলো দেখে দেওয়া, জেলের বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখছে কি না, কিংবা এমন কোনও কথা আছে কি না, যা বাইরে যাওয়া উচিত নয়। চিঠি পড়ে পিঠে রবার স্ট্যাম্প মেরে, তার মধ্যে ‘কে’ বসিয়ে, বান্ডিল বেঁধে নিয়ে যান বড়সাহেবের কাছে। তাঁর পক্ষে অত চিঠি পড়া সম্ভব নয়। তিনি শুধু দেখেন ‘কে’টা ঠিক আছে কি না। তারপর সই করে দেন।

জগন্নাথের পোস্টকার্ডখানা হাতে পড়তেই কানাইবাবু একেবারে বসে পড়লেন। একটানা, প্রায় একই ধরনের কথা পড়তে-পড়তে মাঝে-মাঝে একটু ঢুলুনি আসে। হয়তো সেইফাঁকেই কখন ‘কে’ বসিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এখন উপায়? হতভাগা পোস্টকার্ডখানা আর-একবার আগাগোড়া পড়লেন। জগন্নাথ পাড়ুই লিখেছে তার কোনও ভাইকে—

এই চিঠি পাইবামাত্র আমার মঙলীকে জেলখানার গেটে আনিয়া জমা করিয়া দিবা। অন্যথা না হয়। বড়সাহেবের হুকুম আছে।

ইতি—

তোমার জগাদা।

অফিসে কিছু লেখাপড়া-জানা কয়েদি কাজ করে। তাদের বলে রাইটার। তাদেরই কারও মারফত খবরটা জগার কাছে পৌঁছে গেল। সে কাজকর্ম ফেলে ছুটে এল। কতদিন তার মঙলীকে দেখেনি! কেমন আছে কে জানে!

চেঁচামেচি শুনে জেলারবাবু তাকে ডেকে পাঠালেন, ধমক দিয়ে বললেন, ‘এসব কী লিখেছিস? বড়সাহেব বলেছেন গোরু জমা দিতে?’

জগা হাতজোড় করে বলল, ‘আজ্ঞে, আমার সামনেই তো একজনকে সুটকেস জমা দেওয়ার হুকুম দিলেন।’

‘সুটকেস আর গোরু এক হল?’

‘আজ্ঞে হুজুর, আমার তো সুটকেস-টুটকেস নেই। থাকবার মধ্যে ওই বকনাটা। ওই আমার সব।’

‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু ওটা থাকবে কোথায়? খেতে দেবে কে?’

‘সে-কথা আমি কেমন করে জানব, হুজুর!’

জেলারবাবু রেগে উঠলেন : ‘ওসব হবে না। …এই, কে আছিস? ওকে ভেতরে নিয়ে যা।’

জগা গেলে তো! অফিসের মধ্যেই কাঁদতে লাগল, সে বড়সাহবের কাছে নালিশ করবে। অগত্যা তাকে সেখানেই হাজির করা হল। চিঠির ব্যাপারটাও চাপা রইল না। তিনি যখন পোস্টকার্ডখানা পড়ছেন, জগা সিপাইদের হাত এড়িয়ে টেবিলের নীচে ঢুকে তাঁর পা দুটো চেপে ধরল, কিছুতেই ছাড়বে না। ক্রমাগত এক কথা : ‘আমার আর কেউ নেই, হুজুর। বকনাটাকে না রাখলে সে ঘাস-জল না পেয়ে মরে যাবে।’

জেল-সুপার মহা ফ্যাসাদে পড়লেন। কানাইবাবুর ওপর একহাত নিলেন, ‘ডিসমিস করব’ বলে শাসালেন। কিন্তু সে তো গেল পরের কথা। এখন একে ঠেকান কেমন করে? চিঠিটার পিঠে সই করে তিনিও তো জড়িয়ে পড়েছেন। অনুমতি একরকম দিয়েই ফেলেছেন বলা চলে। তাই বলে কয়েদির সম্পত্তি হিসেবে একটা জলজ্যান্ত গোরু তো আর জমা রাখা যায় না জেলখানায়! এর পিছনে খরচ আছে। সেটা কে দেবে? থাকবে কোথায়, দেখাশোনাই বা করবে কে?

বড় জমাদার রামোদর সিং এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। এর আগেই সে বকনাটাকে দেখে এসেছে। খেতে না পেয়ে রোগা হয়ে গেছে, কিন্তু জাত ভালো। যত্ন-আত্তি করলে বছরখানেকের মধ্যেই বাচ্চা দেবে। চার-পাঁচসের দুধ একটানেই পাওয়া যাবে, আশা করা যায়।

দু-কদম এগিয়ে গিয়ে বুটে বুট ঠুকে বড়সাহেবকে একটা টানা সেলাম দিয়ে রামোদর সিং জানাল, সরকার থেকে যখন গোরুটার ভার নেওয়া সম্ভব নয়, হুজুরের হুকুম পেলে সে-কাজটা অগত্যা সে-ই করতে পারে! বকনা বাছুর, মা ভগবতীর অংশ। তারা পাঁচজন থাকতে না-খেয়ে মারা যাবে! কিছু না করাটা বড় অধর্মের কাজ হবে।

জেল-পাঁচিলের বাইরে বড় জমাদারের সরকারি কোয়ার্টার। সেখানে গরু রাখার হুকুম নেই। সাহেব বললেন, ‘রাখবে কোথায়?’

উত্তরটা আগেই ভেবে রেখেছিল রামোদর। সঙ্গে-সঙ্গে বলল, শহরতলির কোনখানে তার এক ভাই আছে। একটা ছোটখাটো খাটালের মালিক। সেখানে রেখে দেবে। খরচ-পত্তর সব তার। কয়েদি যখন খালাস পাবে, তার গোরু তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

শহরতলির খাটালে নয়, জেলখানার বাসাতেই গোপনে ‘মানুষ’ হতে লাগল মঙলী। বড় জমাদার ডিউটি থেকে বেরিয়ে উর্দি খুলেই লেগে যায় তার সেবায়। কোত্থেকে জুটিয়ে আনে কচিঘাস, নিজে হাতে খড় কাটে, খৈল আর ভুষি দিয়ে জাবনা মেখে সামনে দাঁড়িয়ে খাওয়ায়। দেখতে-দেখতে চেহারা ফিরে গেল বকনাটার।

জগা মাঝে-মাঝে জিগ্যেস করে, ‘আমার মঙলী ভালো আছে তো, জমাদারসায়েব?’

‘ভালো আছে মানে? দেখলে চিনতে পারবি না!’

‘গেটের সামনে একটু আনতে বলবেন? একবারটি দেখতাম।’

‘খেপেছিস? বড়সাহেব জানতে পারলে আর রক্ষে থাকবে না।’

বছরখানেক পরে চমৎকার একটি বাচ্চা হল মঙলীর। এবার তার খাবার-দাবারের দিকে আরও নজর দিল রামোদর। গোরুর দুধ মুখে। মাস দুই যেতেই দু-বেলা মিলিয়ে তার পরিমাণ দাঁড়াল পাঁচ-ছ’ সের। কিছুটা খায়, বেশিরভাগ বাবুদের কাছেই লুকিয়ে বিক্রি করে। তার ভাইয়ের খাটালের দুধ! কারও কিছু বলবার নেই। ব্যাপারটা জানাজানি হলেও চাপা থাকে।

ইদানীং জগা আর বড়-একটা তার মঙলীর খবর নেয় না। তার একমাত্র লক্ষ্য, প্রাণপণ খেটে যতটা সম্ভব বেশি রেমিশন আদায় করে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া। ভালো কাজ করলে কয়েদিরা পুরো মেয়াদ থেকে মাসে-মাসে কিছুটা করে মাপ পায়। দু-বছর যার সাজা, মাস তিন-চার বাকি থাকতেই সে বেরিয়ে যেতে পারে।

জগার খালাসের দিন এসে গেল। বড়সাহেব তাকে ভোলেননি। ‘খালাসী’ সেরেস্তার ডেপুটি জেলারকে জিগ্যেস করলেন, ‘ওর সেই গোরুটা ঠিক আছে?’

‘আজ্ঞে স্যার, গেট থেকে বেরোলেই দিয়ে দেওয়া হবে।’

কিছুক্ষণ পরে গেটের দিক থেকে একটা শোরগোল শুনে সুপার ঘণ্টা বাজিয়ে বেয়ারাকে ডাকলেন। সে বলল, ‘জগা পাগলা গরু নিতে চাইছে না।’

‘কেন?’

‘বলছে, ”এটা আমার মঙলী নয়।”’

জগাকে আবার আনা হল সাহেবের সামনে। সে হাতজোড় করে বলল, ‘ও-গরু আমি নেব না। আমার মঙলীকে দিতে বলুন।’

সাহেবকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে তিনি হেসে বললেন, ‘তোমারই তো লাভ। বকনার বদলে দুধলো গোরু পেয়ে যাচ্ছ। দুধ খাবে—গরিব মানুষ, কিছুটা বেচতে পারবে।’

‘চাই না, হুজুর! পরের জিনিস নিয়ে অধম্মো করতে পারব না। আমার জিনিস আমাকে ফিরিয়ে দিন।’

সকলে বোঝাতে চেষ্টা করল, ‘এই তোর সেই বকনা। ছোট ছিল, বড় হয়েছে, বাচ্চা দিয়েছে।’

জগা রুখে উঠল, ‘আমার বকনা আমি চিনি না! আমাকে দেখলেই ছুটে এসে গলাটা বাড়িয়ে দিত, আর ওই ধেড়ে গোরুটা একবার তাকিয়েও দেখল না!’

বলতে-বলতে তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।

পাগলের কথা শুনতে গেলে বড়সাহেবের চলে না। ওকে সরিয়ে নেওয়ার হুকুম দিলেন। জগা যেতে চায় না। সিপাইরা তাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়ে গেল। রাস্তার খোরাকি বাবদ কিছু পয়সা দেওয়া হয়েছিল তার হাতে, খালাসের সময় যেমন দেওয়া হয়। সেটা সে সাহেবের সামনেই টান মেরে ছুড়ে ফেলে দিল।

গেটের বাইরে গিয়েও হল্লা করছে দেখে জেলারবাবু লোকটাকে হটিয়ে দেওয়ার হুকুম দিলেন। সেনট্রি যখন তাকে ধাক্কা মারতে-মারতে নিয়ে যাচ্ছে, তখনও সে চেঁচাচ্ছে : ‘আমার মঙলীকে ফিরিয়ে দাও!’

ব্যাপারটা জানতে পারলাম অনেক পরে। জেলখানায় অনেকরকম লোক আসে—কেউ কয়েদি হয়ে, কেউ কয়েদিদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে। এমনি একদিন এল বুধন।

‘স্যার, জগা পাগলা আছে?’

‘আরে, সে তো কবে খালাস হয়ে চলে গিয়েছে! তাকে তুমি চিনতে নাকি?’

লোকটি একহাত জিভ কেটে বলল, ‘স্যার, সে তো আমার সাক্ষাৎ বোনাই ছিল।’

একটু থেমে আবার বলল, ‘ভাগ্নীটাকে তো ও-ই নিজের হাতে খুন করেছে। বোনটারও অনেক দোষ ছিল। স্বভাবচরিত্তির তেমন ভালো ছিল না।’

নড়েচড়ে বসলাম : ‘আরে, তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ, স্যার। জগার ছোট ছেলেমেয়ে, বিশেষত ছোট মেয়েদের প্রতি টান। কিন্তু বোনটার জন্যে…মেয়েটা বেশ বড় হয়েছিল, সাত-আট বছরের হবে। একদিন বোনটা ধরা পড়ল হাতে-নাতে। বেদম মারছিল জগা। তারপর…।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটা বলল, ‘বোনটা বলে বসল, ”লছমী তোর মেয়েই নয়, তাকে অত আদর করিস কেন?” কী যে হল জগার, মেয়েটাকে…।’

থেমে গেল বুধন। তার দু-চোখে জল।

জল আমারও চোখে—এই তাহলে জগার আসল রহস্য! সে তাহলে মঙলীর মধ্যে তার লছমীকেই খুঁজত! যে-লছমী বড় হলেও বদলাবে না, মরে গেলেও চলে যাবে না। এক, আদি, অকৃত্রিম স্থির-বয়েসের সেই আদরের মেয়েকে সে হারাতে চায় না কিছুতেই।

অপরাধ-তত্ত্বের একটা বিচিত্র পরিচ্ছেদ আমার চোখের সামনে খুলে গেল—অপরাধীর অবচেতন মনে সেই চিরন্তন স্নেহ-সম্পর্কটা কীভাবে পরিবর্তিত হয়, তা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বিশেষত কিঞ্চিৎ অপ্রকৃতিস্থ বলে জগার মনে তা এমন বিচিত্র রূপ ধরেছে।

জগার জন্যে মনটা এখন সহানুভূতিতে ভরে গেল।

মাসিক গোয়েন্দা

পুজো সংখ্যা, ১৯৭১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *