ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

জুতো

জুতো

একটু আগে আমি আমার ছেলেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। পা থেকে জুতো খুলে মারতে গিয়েছিলুম, ছেলের মা এসে মাগুর মাছ ধরার মতো আমার হাতটা কপাত করে ধরে ফেলে বললে, যা করেছ, এই পর্যন্ত ঠিক আছে, সবটা একসঙ্গে খরচ করে ফেলো না। হাতে কিছু রাখ।

পায়ের জুতো হাতেই ধরা রইল। সে একবার মাত্র আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। জামার সামনের দিকটা মনে হয় ছিঁড়ে গেছে, কারণ ওই জায়গাটা ধরে আমি বার কয়েক ঝাঁকনি মেরেছিলুম মোক্ষম। শাসন এক জিনিস, অর্থনীতি এক জিনিস। যুদ্ধের সময় ক্ষয়ক্ষতির চিন্তা করলে যুদ্ধই করা যায় না। মাথার চুল এলোমেলো। দু-একবার ধরে টানাটানি করেছিলুম। প্রতিপক্ষের চুল সবসময়েই একটা দুর্বল জায়গা। ওই কারণেই মনে হয় হিন্দি ছবি, ইংরেজি, ছবির ভিলেনরা সব ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে। কি মজা! প্রেমেও মুন্ডিত মস্তক, হিংসাতেও মুন্ডিত মস্তক। একদিকে মহাপ্রভু, বিপরীতে অমরীশ পুরি।

একবার মাত্র তাকিয়ে সে চলে গেল। আমার শরীর তখন রাগের উত্তাপে ধোঁয়া ছাড়ছে। ক্যানেডিয়ান রেল ইঞ্জিনের মতো। আমি তো ইঞ্জিনই। সংসারের বগি টানছি উদয় অস্ত।

আমার স্ত্রী কাটা ল্যাংড়া আমের চারপাশে ভ্যানভ্যান মাছির মতো কেবলই গুঞ্জন করছিল—তোমার শাসনের অভাবেই ছেলেটা বখে যাচ্ছে। বাপ হয়েছ শাসন করতে পারো না। এখন আবার বলে গেল, তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি। একালের উঠতি বয়েসের ছেলের গায়ে হাত তুলতে গেলে কেন? বকাধমকা করে ছেড়ে দিলেই পারতে। ও যদি তোমাকে ঘুরিয়ে ঘুসি মারত। সামনের পাটির সব কটা দাঁত খসে পড়ে যেত। বত্রিশটার মধ্যে কটাই বা আছে।

তুমি কেমন মহিলা ভাই! যেতেও কাটো আসতেও কাটো।

ও যখন আমার দিকে তাকাতে-তাকাতে চলে যাচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল, আমিই চলে যাচ্ছি। আমার আত্মাটাই বেরিয়ে চলে গেল। আমার জীবনের অতীত পথ ধরে অনিশ্চিতে হারিয়ে যেতে চাইছে।

প্যাঁপ্যাড়, প্যাঁপ্যাড় করে সানাইয়ের রেকর্ডে ঝালা মারছেন ওস্তাদ বিসমিল্লা। দেয়ালে আলোর মালা চুর-চুর হয়ে ঝুলছে। বসন্তের উতলা বাতাস থেকে-থেকে ঝাপটা মারছে। পাড়া উপচে নিমন্ত্রিতরা এসে গেছেন। মেয়েদের শাড়ির খসখস শব্দ। কর্তারা গায়ে চড়িয়েছেন পাঞ্জাবি। মুখে পাউডার ঘষেছেন। কারও বগলে শাড়ি, কারও হাতে ধরা টেবিল পাখার কান। কেউ বুকের কাছে ধরে আছেন এক তাড়া গোলাপ। যারা দল পাকিয়ে এসেছেন, তাঁরা চাঁদা তুলে উপহার কিনেছেন, মশলা গুঁড়োর মেশিন। আত্মীয়দের কারও কারও পকেটে ছোট্ট ভেলভেটের বাক্স। সোনার একটা কিছু না দিলে ইজ্জত থাকবে না। সেটা কী! পাতলা ফিনফিনে সোনার কানের দুল। যেন মাদ্রাজি পেপার ধোসার টুকরো। ফুঁ দিলে উড়ে যাবে, তবু দিতে হবে। সিড়িতে বাচ্চাদের হুটোপাটি। মাছের আঁশটে গন্ধের সঙ্গে দিশি সেন্টের গন্ধ মিশে বিচিত্র সুবাস। আইবুড়ো মেয়েদের সঙ্গে লোভী আইবুড়ো ছেলেদের ফচকেমি। নড়বড়ে ফোলডিং চেয়ারে মনমরা বৃদ্ধ। লাল ঠোঁট সুন্দরী। একপাশে আঁচল সরে যাওয়া সাটিন চকচকে বুকের হঠাৎ ঝলকানি। হাতে রোগা বইয়ের প্যাকেট ধরা বেকার বন্ধুর ঝলসে ওঠা চোখ। জলে পচা রজনীগন্ধার বিচিত্র গন্ধ। যেন গভীর রাতের বউবাজার।

হচ্চেটা কী? আমার বিয়ে। একটা হেরে যাওয়া ছেলে টোপর মাথায় দিয়ে আর কিছু পারলে না, বিয়ে করে এল। ওরে পড় পড়। ফার্স্ট হ, সেকেন্ড হ। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। পি আর এস। পি এইচ ডি. ঈশান স্কলার। ওরে পড়-পড়। পড়ে গেল প্রেমে। তখন কি আর বুঝেছিল ছোকরা, জীবনযুদ্ধে হেরে যাচ্ছে! ওই ভোলাবাবুর ছেলে ম্যারিন ইনজিনিয়ার হয়ে পি ও লাইন্সে চলে গেল। চল্লিশ হাজার টাকা মাইনে। আজ ম্যানচেস্টারে তো কাল ব্রুকলিনে। শ্যামলবাবুর ছেলে অক্সফোর্ডে চেয়ার পেয়েছে। সত্যেনবাবুর ছেলে জার্মানিতে। আর তুমি! বগলে গানের খাতা নিয়ে, চটি ফ্যাটং ফ্যাটং করে ঘুরছিস। একদল ছেলে আর মেয়ে গাদাগাদি করে বসে, দুলে দুলে গান, নাকি সুরে, আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো। ছেলে আমার ফাংশানে গান গাইছে। সেই গান গাইতে গিয়েই তো কেলেঙ্কারিটা হল। কনুইতে-কনুই ঠেকল, হাঁটুতে হাঁটু। চুল এসে গায়ে ঝাপটা মারল। আড়চোখে তাকাতাকি। তারপরে সরাসরি। তারপরে হাত ধরাধরি। তারপরে হৃদয়ে-হৃদয়ে থ্যাসকা থেসকি। ওই একই ধারা। প্রথমে ঘুসঘুসে জ্বর, তারপর কাশি, তারপর ছিটে ছিটে রক্ত, তারপর ভলকে-ভলকে। তারপর লাংস ফুটো। তারপর চোখ উলটে গান, শূন্য সমাধি মোর ঢেকে দিয়ো ফুলদলে। প্রেমের সঙ্গে ব্যর্থ জীবনেরই যোগাযোগ। জীবনে ব্যর্থ না হলে প্রেম হয় না। বড়লোকদের জীবনে প্রেম নেই। আছে এনগেজমেন্ট। বিজনেসটাও এনগেজমেন্ট, প্রেমটাও এনগেজমেন্ট।

কবিতার সঙ্গে এদিকে আমার প্রেম চলেছে, ওদিকে আমার বাড়িতে খাঁইখাঁচা খোলকত্তাল চলেছে। হতভাগা সেকেন্ড ডিভিশান মারতে-মারতে এগোচ্ছে, কোথায় মনমরা হয়ে কোণের ঘরে কেতরে-থাকবে, তা না পাঞ্জাবি পরে চেকনাই মেরে, আধবোজা চোখে গান ধরেছেন—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে! কথাবার্তা সব বন্ধ। খাওয়াদাওয়ারও তেমনি ছিরি। খাতিরও সেইরকম; কিন্তু প্রেমের অসীম ক্ষমতা। আমার বুদ্ধিসুদ্ধি যে কিছু কম ছিল তা নয়; আসলে ম্যালনিউট্রিশানে তেমন খোলতাই হতে পারল না। সারাটা জীবনই কেমন ঝিম মেরে রইলুম।

শেষে পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে একটা চাকরি পেয়ে গেলুম। সেও ওই নাকিসুরে গান গেয়ে। ভদ্রলোক গান শুনে মোহিত। দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়। ‘করো কী তুমি?’

‘অথেন্টিক বেকার।’

‘আমার সঙ্গে দেখা কোরো।’

ক্ষমতাশালী অফিসার। চাকরিটা হল। শর্ত একটাই। আমার মেয়েটাকে একটু তালিম দিতে হবে। সা রে গা মা প্যাঁ সাঁ। মাঝে-মাঝে মনে হত ওর মায়ের উল বোনা কাঁটা দিয়ে নাকটা খুঁচিয়ে দি। পাইপটাকে ক্লিয়ার করে দেখি পা, সা বেরোয় কি না। যত বিরক্তিই লাগুক তালিম চালাতে হবে। পিতার অনুরোধ। পিতা কেন? পিতা তিনজন, জন্মদাতা, অন্নদাতা, স্ত্রীদাতা।

ভোলাবাবুর ছেলের ষাট হাজার টাকা মাইনে। আমার!

এই নিয়ে গুঞ্জন, তবু বাড়িতে সত্যনারায়ণ হল। বাতাসা, সিন্নি। কবিতাকে নিয়ে কাটলেট খেলুম ধর্মতলার দোকানে। গঙ্গার ধারে ঘণ্টাঘরের কাছে দুজনে হাত ধরাধরি করে ঘুরলুম অনেকক্ষণ। বিয়ের পরে ফিনল্যান্ডে যাব হনিমুনে এইরকম একটা সিদ্ধান্ত নিলুম সিমেন্টের আসনে বসে। ঘন অন্ধকারে একটা চুমুও খেলুম কবিতার নোনতা-নোনতা গালে।

এমন সময় কে একজন হেঁড়ে গলায় বলল, বেশি পেঁয়াজি করো না, পুলিশে তুলে নিয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, মানিয়েছে বেশ। ফাল্গুনে সম্পর্কটা ফাইনাল করে ব্যাপারটাকে আউটডোর থেকে ইন্ডোর নিয়ে যাও। সেই ভদ্রলোককে আজও ভুলিনি আমি। সেদিন আরও একঘণ্টা তাঁর সঙ্গে পাশাপাশি বসে গল্প হয়েছিল। উত্তর কলকাতার খাস বনেদি। যৌবনে গোবরবাবুর আখড়ায় কুস্তি করতেন। বেনারসে বাড়ি আছে। রোজ রাতে দুজন পালোয়ান পাউডার দিয়ে মাসাজ করে। লুচি আর ল্যাংড়া আম খেতে ভালোবাসেন। পুরোনো আমলের দুটো দামি গাড়ি আছে। সাইডে ঝোলান হর্ন। ভ্যাঁক-ভ্যাঁক বাজে। দুজনে মিলে ভদ্রলোককে একটা রবীন্দ্রসংগীত শোনালুম, ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি। আমাদের বিয়েতে ভদ্রলোককে নিমন্ত্রণ করেছিলুম। তিনি এসেওছিলেন। বিয়েবাড়ির ইজ্জত বেড়ে গিয়েছিল। যেমন চেহারা তেমনি সাজ। দামি উপহার এনেছিলেন। জীবনের কোনও খেলায় যে টেক্কা ফেলতে পারেনি, এই একটা খেলায় ফটাস করে টেক্কা মেরে দিয়েছিল সে। মধ্যবিত্তরা বড়লোক দেখলে কেমন যেন থলথলে হয়ে যায়। কিছুক্ষণের জন্যে আমার আত্মীয়স্বজনেরা কেমন যেন ন্যাদোস মাছের মতো হয়ে গিয়েছিল, গরমে রাখা আইসক্রিমের মতো।

বাড়ির ভেতরের রকে বসে আছি। পাজামা আর গেঞ্জি পরে। রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে লুঙ্গিটা যায় না। ক্ল্যাসিক্যালের সঙ্গে যায় হয়তো। পাশে একটা ঢাঁই ফুলগাছের টব। জুঁই লতা ইনিয়ে বিনিয়ে ধ্রুপদী আলাপের ঢঙে বাথরুমের টিনের চালের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। পাশেই দুটো ছোট টব। বেলফুল। জবরদস্ত নাম তার—মোতিয়া বেল। বসে-বসে ভাবছি, কোথা থেকে কোথায় এলুম। আমার রেসের ঘোড়া পালিয়ে গেল আস্তাবল ছেড়ে। ডার্বি জেতা আর হল না! এই তো বছর সতেরো আগের কথা।

কবিতার ছেলে হল। নাক দেখেছ, চোখ দেখেছ, রং দেখেছ! এ ছেলে বড় হলে দেখবে, কত বড় হয়েছে! জনে-জনে এসে বলে যেতে লাগলেন। কেউ একটা টাকা দিয়ে মুখ দেখলেন, কেউ দেখলেন প্রসাদী ফুল দিয়ে। যাঁরা অধিকতর হিসেবি, তাঁরা বললেন, কোনও কিছুই থাকবে না। আর্শীবাদই সব। গুরুজনের আর্শীবাদ। কেউ পা থেকে একটু ধুলো নিয়ে ছেলের কপালে ঠেকিয়ে দিলেন। সে তো একটা লাল লেংটি ইঁদুর তখন। তলপেটে নাভির কাছে, সাদা একটা পটি বাঁধা। মিনিয়েচার মানুষ। সবই আছে। পুতুলের আকৃতি।

কবিতা সকাল সন্ধে একবার করে সংসারের তোলা তুলতে বেরোয়। যারা কবিতার কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিখবে, তারা কোনওদিন রবীন্দ্রসদনে কেরামতি দেখাতে পারবে না, বড়জোর অফিসক্লাবের অনুষ্ঠানে, বা কারও ফেয়ারওয়েলে একটা দুটো, প্যাঁপোঁ হারমোনিয়াম সহযোগে গাইতে পারে।

কবিতা ফাউটিকে আমার কোলে গচ্ছিত করে দিয়ে টিউসানিতে বেরিয়ে যেত। আমি তখন দোলায় শুইয়ে মৃদুমৃদু দোল দিতুম। হুঁহুঁ করে গাইতুম, ওই মহামানব আসে। মদালসা নিজের ছেলেকে দোল দিতে-দিতে বলতেন ত্বমসি নিরঞ্জন:। আমি বলতুম, বি এ ক্যান্সার স্পেসালিস্ট। এ ক্যান্সার স্পেসালিস্ট। তোমার অঢেল টাকা হবে খোকা। আষ্টেপৃষ্ঠে মার্বেল সাঁটা বাড়ি। তিনখানা তিন রকমের গাড়ি। আমরা যেমন ন মাসে ছ মাসে ঝাড়গ্রাম, কি বহরমপুরে, কি বারুইপুরে বেড়াতে যাই, তুমি সেইরকম মাসে-মাসে যাবে, ভিয়েনা, হামবুর্গ, ক্যালিফোর্নিয়া, টেলাভিভ। বি বি বি এ ক্যান্সার স্পেসালিস্ট। নির্জন ঘর। ঘুলঘুলিতে চড়াইয়ের সংলাপ। আমি আমার দোলাচ্ছি। ব্যাটা আমার অনকোলজিস্ট হবে। বউ হবে গাইনি। একজন চালাবে কাঁচি, আর একজন মারবে রে। পেশেন্টের ভিটেয় ঘুঘু। আমাদের প্যালেস।

সেই ছেলে বড় হল। আমরা দূরবিনের চোখে তাকিয়ে আছি। রেসের মাঠে যারা গ্যালারিতে বসে থাকে, তারা এইরকম করে, ঘোড়া ছুটছে, তারা লাফাচ্ছে, ফার্স্ট, সেকেন্ট ফার্স্ট, সেকেন্ড। উত্তেজনায় পেছন দিকটা আর আসনে থাকতে চাইছে না। উঠে-উঠে পড়ছে। আমার আর কবিতার সেই অবস্থা, সৌরভ ফার্স্ট, ফার্স্ট, ফার্স্ট। কোথায় কী! প্রত্যেক দৌড়েই, সৌরভ লাস্ট। অনেক হেপাজত করে, ভালো একটা স্কুলে দেওয়া হয়েছিল। আমরা পোড়া পেতলের মতো মুখ করে, অমাবস্যার রাতে সংকল্প করেছিলুম—ছেলেকে আমরা অমানুষের মতো মানুষ করব। টপ, টু দি টপ অ্যান্ড টু দি টপ। বেস্ট স্কুল, বেস্ট কোচিং। এক একটা সাবজেক্টের জন্যে এক একজন টিউটর। সপ্তাহে দুদিন কোচিং তিনশো টাকা। কেউ থাকেন ঘুঘুডাঙায়, কেউ থাকেন গড়পারে। সকলেই মহা মহারথী। ঘরের বাইরে সব সময় দশ থেকে পনেরো জোড়া জুতো খোলা। ভেতরে শিক্ষকমশাই ময়ান দিয়ে কেরিয়ার তৈরি করছেন। লটারির টিকিটের দোকানে লেখা থাকে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারি, প্রথম পুরস্কার, হিমাচল, দ্বিতীয় পুরস্কার, সিকিম, প্রথম পুরস্কার। সেইরকম, মাধ্যমিকে একশোজন, ছটা লেটার। আমরা সংকল্প করেছিলুম—বলো, সন্তান হওয়া, আর ক্যান্সার হওয়া একই কথা। এর ক্যারিয়ারে আর ওর আরোগ্যে সর্বস্বান্ত হতেই হবে। ক্যারিয়ার হলেও হতে পারে, ক্যান্সারের রুগি ফিরে এসে কপচাচ্ছে, প্রায় অসম্ভব। ফিরে সে আসতে পারে, তবে স্বপ্ন দিয়ে গর্ভে আসবে। আবার শুরু থেকে শুরু করবে। ব্রজেনের বাপ, সেই যে গো, থ্রোট ক্যান্সারে পৌষে গেল, ও মা! ফাল্গুনে স্বপ্ন দিয়ে ছেলের বউয়ের পেটে চলে এল। তোমাদের মায়া ছাড়তে পারলুমনি গো।

আমরা সংকল্প করলুম, বেস্ট এডুকেশান, প্রয়োজনে আমি ক্রীতদাস হব, প্রয়োজনে তুমি ক্রীতদাসী। সিনেমায় যেমন দেখি, ক্যাসিনো রয়ালে চাকা ঘুরছে। সব দান লাগাচ্ছে। টান, টান উত্তেজনা। হারে কি জেতে! রাত শেষে রাস্তায়। ফকির!

মাধ্যমিকে একটা দরকচা মার্কা রেজাল্ট হল। তেল যত পুড়ল, আলো তত হল না। আয়নার সামনে সোহাগে গলা জড়াজড়ি করে দুজনে যখন দাঁড়াই, চিনতে পারি না। যত না সময় গেছে, তার চেয়ে বেশি প্রবীণ। বড়লোকেরও চুল পাকে, কিন্তু মুখটা হয় রাবনের মতো, গাল দুটো যেন রামের বোতল। শরীরটা যেন খাপ খোলা কুলফি, মালাই। আমাদের মতো এমন চোয়াড়ে, লক্ষ্মীছাড়া নয়। সৌরভ আমাদের বাবা, মা না বলে দাদু, দিদাও বলতে পারে।

শিক্ষকমশাইরা বললেন, ঘাবড়াবার কিছু নেই। ব্যাপারটাকে জীবন-মরণ সমস্যা করে তুলবেন না। একালে সবই সম্ভব। খাতাপত্তর সেভাবে দেখা হয় না। অনেক সময় ফুরনে খাতা পরীক্ষা হয়। যার ফেল করার কথা, সে পেয়ে গেল লেটার। মশাই, এর নাম কলিকাল। আর জেনে রাখুন, মাধ্যমিকটা সব নয়। মাধ্যমিকে সাতটা লেটার, উচ্চমাধ্যমিকে রসগোল্লা। ওই উচ্চটার জন্য কোমর বেঁধে লাগুন। পারলে আরও কিছু টাকা খরচ করুন। ল্যান্ডে আর ল্যাডে ইনভেস্টমেন্টে সব সময় গুড রিটার্ন। আবার কী খরচ। শুনে আমরা দুজনেই অবাক। টোট্যাল এডুকেশানের মধ্যে হেলথটাও পড়ে। একজন ডায়াটেসিয়ানের পরামর্শ নিন। সৌরভ সবসময় কেমন যেন ঝিম মেরে থাকে। ওর অক্সিজেন ডিফিসিয়েন্সি হচ্ছে। অক্সিজেন-ফুড দিতে হবে। ভিটামিন-ফুড, প্রাোটিন-ফুড শুনেছি, অক্সিজেন-ফুড তো শুনিনি। একটু ইয়োগা করান। ইয়োগাটা কী। পরে বুঝলুম। আমরা মধ্যবিত্তরা যাকে যোগ বলি, বড়লোকরা সেইটাকে বলে ইয়োগা। ইয়োগায় ফুসফুস দিয়ে রক্তে অক্সিজেন ঢোকে। সেই রক্ত মাথায় চড়ে বুদ্ধি খোলায়। স্মৃতি, ধৃতি সব বেড়ে যায়। এই যখন চলছে, তখন আমাদের সামনের বাড়ির সদানন্দবাবু একটা স্কুপ নিউজ দিলেন, মশাই! ছেলেটার দিকে একটু নজর রাখুন। শুধু বাঁধো না তরীখানি করে জীবন কাটালে হবে?

আমি না বুঝেই বোকার মতো জোর গলায় বললুম, কেন? আমি তো খুব কষে জল খাওয়াচ্ছি।

ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, জল খাওয়াচ্ছেন। জলে কী আছে?

ব্যাপারটা খোলসা করে বললুম তাঁকে। জলই হল একমাত্র অক্সিজেন-ফুড। আগে খুব ডিম খাওয়াতুম। ডিমে বলছে বুদ্ধি কমে যায়।

ডিমে বুদ্ধি কমে কি না, তিনি জানেন না; কিন্তু ডিমে কাম বৃদ্ধি হয়। সৌরভ সাতসকালে টুথব্রাশ মুখে নীচের কলতলা ছেড়ে ছাতে যায় কেন? অক্সিজেন নিতে! আজ্ঞে না। ওই একটি জায়গায় আছে পতনের রহস্য। ভালো করে অনুসন্ধান করুন। আমি একজন ওয়েলউইশার।

একটা বাড়িকে পার্টিসান করে দু ভাগ করা হয়েছিল বহুকাল আগে। একটা ভাগ আমার পিতামহ কিনেছিলেন। পার্টিসানের সময় ছাতের উত্তরদিকে একটা বিভাজন-পাঁচিল তোলা হয়েছিল। ওপাশটা এখন কাদের দখলে জানি না। দু তিন ঘর ভাড়াটে আছে। এক ভাড়াটের মাথায়-মাথায় দুই মেয়ে। ছোট মেয়েটার সঙ্গে সৌরভের প্রেম চলছে।

আমি লো প্রেসারের রুগি। একটু দেরিতে ঠেলেঠুলে বিছানা থেকে নিজেকে তুলি। ততক্ষণে সৌরভের প্রেমপর্ব শেষ হয়ে যায়। কবিতা ভোরে উঠলেও ব্যস্ত থাকে। পাঁচিলের ওপাশে তিনি, এপাশে ইনি।

সামনের বাড়ির ভদ্রলোক তাঁর দোতলার জানলাটা আমাকে গোয়েন্দাগিরির জন্য ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। নিজের ছেলেকে দেখছি ভোরের মসৃণ আলোয়। অনেকটা আমার মতোই দেখতে। তরুণ বয়সের আমি। মেয়েটাও কবিতার মতোই আকর্ষণীয়। আমি আমার অতীত দেখছি ভূত দেখার মতো। ভদ্রলোক মাঝে-মাঝে মন্তব্য জুড়ছেন—এই বয়েসটা খুব খারাপ। শিক্ষার সঙ্গে ব্রহ্মচর্যের অতিশয় যোগ। মেধা তৈরি না হলে স্মৃতি হবে না। স্মৃতি না হলে ধারণাশক্তি জন্মাবে না। আপনার ছেলের সর্বনাশ তো আলসের ওপারে থেকে লতিয়ে উঠছে। হার্ড ডেজ। নশো নিরানব্বই পাওয়া ছেলে নরেন্দ্রপুরে অ্যাডমিসান পাচ্ছে না। ভরতি হচ্ছে ক্যাঁচোর ম্যাঁচোর স্কুলে।

আমি শুনেছি, আবার শুনছিও না। ও ছাতে আমার ছেলে কত কথাই বলছে, হাত নেড়ে মুখ নেড়ে, চোখ উলটে, হেসে-হেসে। কবিতাকেও একসময় আমি এইভাবে কত অপ্রয়োজনীয় কথা বলেছি। প্রেমের ‘প্রাোলোগ’টা এইরকম। ময়ূরীর সামনে ময়ূর এইভাবেই পেখম তুলে নাচে। ‘এপিলোগ’টা আমি বলতে পারি। শুনবে না। প্রেম অন্ধ, প্রেম বধির।

শোনো ছোকরা—অল্পবয়সে, যৌবন উদ্দামে, মেয়েরা ম্যাগনেট। ছেলেরা লোহা। ম্যাগনেটের কাছাকাছি গেলেই সড়াক করে টানবে। ম্যাগনেটের সঙ্গে জড়াজড়ি করে সংসারে প্রবেশ। বছর কয়েকের মধ্যেই চুম্বক তার চৌম্বক শক্তি হারাবে। তারপর লোহাও লোহা, চুম্বকও লোহা। একজন খুন্তি আর একজন খোন্তা। তাতল সৈকতে পড়ি বারিবিন্দুসম।

আমি যত না রাগলুম, কবিতা তার ডবল রাগল। ইদানিং তার প্রেমে অ্যালার্জি হয়েছে। ঝোঁকের মাথায় আমাকে বিয়ে করে জীবনটা ভেস্তে গেছে। না যেতে পেরেছে, কুলুমানালি, না যেতে পেরেছে কন্যাকুমারী। না দিতে পেরেছি বমকাই, না পেরেছি কাঁথাস্টিচ।

সৌরভ পড়ে না, সৌরভ বাড়ি থাকে না, জামায় সিগারেটের গন্ধ। মেয়েটা সেজেগুজে বেরিয়ে যাওয়ার পরই, সৌরভ বেরিয়ে যায়। আমার সর্বনাশ হয়েছে হোক, আর একটা মেয়ের সর্বনাশ যেন না হয়! ঘুরছে ফিরছে আর একই কথা বলে চলেছে কবিতা।

অবশেষে উচ্চমাধ্যমিকে সৌরভচন্দ্র লেটারের বদলে লবডঙ্কা পেয়েছে।

তার মানে, এ ঘোড়া আর রেসের মাঠে দৌড়াবে না। এ তোমার সেই ছ্যাকড়া গাড়ি টানবে। না পাবে ছোলা, না পাবে দানাপানি। আমার পিতা পরাজিত, আমি পরাজিত, আমার ছেলে পরাজিত। পরাজয়ের উত্তরাধিকার বহন করছি আমরা। আমাদের তুই জাতে তুলতে পারলি না ছোকরা! ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস। প্যারিসে পোস্টিং। আমি আর কবিতা চলেছি আইফেল টাওয়ার দেখতে। সৌরভ কচাং করে ছবি তুলে অ্যালবাম করে রাখছে। ক্ষতবিক্ষত যোদ্ধা দম্পতি, জীবনশেষে বিজয়ীর হাসি হাসছে।

গেট আউট, গেট আউট, ফ্রম মাই হাউস। বাপের তেল কল দেখেছ! যাও তোমার আনারকলির কাছে। আউটরামে গিয়ে নৌকো চাপো।

সৌরভ কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। আমি দূর করে দিয়েছি। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। সব ভাবনাই একসময় শেষ হয়। ভাবতে গেলেও রক্তে অক্সিজেনের প্রয়োজন। রক থেকে ভেতরে গেলুম। খাটের ওপর ভাঙা হারমোনিয়াম। তার ওপরে গীতিবিতান। সেই গানটা গাইতে ইচ্ছে করছে, কোন খেলা যে খেলব কখন, ভাবি বসে সেই কথাটাই।

দশটা বাজল।

কবিতা বেগুন ভাজতে-ভাজতে বললে—সত্যি সত্যিই চলে গেল না কী! একবার খোঁজ নাও। আমারও একটু ভয়-ভয় করছিল। ছেলেটা খুব সেন্টিমেন্টাল। বুদ্ধিতে তো আমিও হেরেছি। হেরো বাপের হেরো ছেলেই হয়। কেন খাওয়ার খোঁটা দিলুম! বসে-বসে অন্ন ধ্বংস করছিস! শরীরও তো নেই, যে সাইকেল রিকশা চালাবি! আর কি, লেখাপড়া তো যথেষ্ট হল, এইবার বিয়েটা রেজিস্ট্রি করে ফেল। প্রথমে বোকার মতো পাশের বাড়িতেই গেলুম। বোকা আমি। সৌরভ সোনার পদক পায়নি যে প্রেমিকাকে দেখাতে যাবে।

পাশের বাড়িতে তখন খানা-পর্ব চলেছে। লুচি ভাজার গন্ধ। টিভিতে এক ঝাঁক মেয়ে শরীর দুলিয়ে বিপর্যয় নাচ নাচছে। আমাকে দেখামাত্রই সবাই এমন একটা ভাব করল যেন ভূত দেখেছে। কিছু জিগ্যেস করার আগেই বললে, সৌরভ এখানে নেই।

—এসেছিল কী?

—সৌরভ এখানে আসে না।

বাড়িতে মনে হয় বাইরের আত্মীয়স্বজনরা এসেছে। জোর গুলতানি। মেয়েটাকে কোথাও দেখছি না। পায়ে-পায়ে বেরিয়ে এসে একবার ওপরদিকে তাকালুম। চাঁদের আলোয় দই সাদা আকাশ। পালকের মতো মেঘ। আলসের ওপরে একটা মাথা জেগে আছে। ভালো করে দেখলুম। সেই মেয়েটি। তারার চাঁদোয়ার তলায় একা বিরহিণী। এই উদ্বেগেও একটা হারিয়ে যাওয়া গানের কলি মনে এল, জেগে আছি একা, জেগে আছি কারাগারে। আকাশ আর আমি কিছুক্ষণ মুখোমুখি থেকে মোড়ের দিকে এগোলুম।

দোকানপাট সবই বন্ধ। একটা পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান খোলা। মোড়ের মাথায় যেসব ছেলেরা গুলতানি করত, তারা নেই। রিকশা স্ট্যান্ড খালি। কম্যুনিস্ট পথ খানাখন্দ নিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেছে, ভাঙনের স্লোগান দিতে-দিতে।

কাকে জিগ্যেস করি, আমার ছেলে কোথায় গেছে! কবি-কবি চেহারা। বিষণ্ণ মুখ। বিস্ময় মাখা বড়-বড় চোখ। ছিপছিপে। ফরসা কেউ নেই। কাকে জিগ্যেস করব। দূর থেকে হরিনাম সংকীর্তনের শব্দ ভেসে আসছে। ওইদিকে ছোট একটা আশ্রম আছে।

সৌরভ কীর্তন ভালোবাসে না। তবু এগিয়ে গেলুম। বলা যায় না। সময় কাটাবার জন্যে যেতেও পারে। একটি তুলসীমঞ্চকে ঘিরে একদল ভক্ত নরনারী নাম সংকীর্তনে মত্ত। সৌরভের দেখা পেলুম না।

এ পাড়ার সবই বদলে গেছে। পুরোনো মুখ আর চোখে পড়ে না। সবই নতুন। পুরোনো জনপদের চারপাশে বড়-বড় বাড়ি উঠেছে। কত ফাঁকা জায়গা ছিল, সবই অদৃশ্য। চড়াই পাখির মতো জনসংখ্যা বেড়েছে। এসব আমার আগোচরেই হয়েছে। এইভাবে কোনওদিন দেখা হয়নি। নিজের ছেলেকে খুঁজতে বেরিয়ে মনে হচ্ছে, আমি এক রিপ ভ্যান উইঙ্কল। দীর্ঘ এক ঘুমের পর জেগে উঠেছি।

সৌরভের বন্ধু কারা, কোথায় তারা থাকে, তাও তো জানি না। রাস্তার ওপর প্রাচীন কালীমন্দির। এখন বন্ধ। লম্বা দড়িতে মহাকালের ঘণ্টা দুলছে। ছাদের তলায় খোলা চাতাল। সেখানে কে একজন শুয়ে আছে চাদর মুড়ি দিয়ে। শরীরের দৈর্ঘ্য দেখে মনে হচ্ছে, সৌরভ হলেও হতে পারে, একবারও ভাবলুম না, সৌরভ চাদর কোথা থেকে পাবে।

কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। চাদর সরিয়ে তো দেখা যায় না! কায়দা উদ্ভাবন করলুম। খোঁচা মেরে জিগ্যেস করলুম, দাদা! দেশলাই আছে!

চাদরের তলা থেকে ঘুম জড়ানো গলায় কর্কশ উত্তর এল—শালা, মাতাল। রোজ আমাকে জ্বালাবে, মারব পেছনে ক্যাঁত করে এক লাথি। তোর বাপের কাছে দেশলাই চা গে যা না!

পালিয়ে এলুম। চাদরের তলায় কাশি শুরু হয়ে গেছে। ব্রংকাইটিসের কাশি। কিছু দূর যেতেই দেখি শবযাত্রার ছোট মতো একটা মিছিল আসছে। সম্পন্ন কেউ একজন মারা গেছেন। প্রচুর ফুল দিয়ে ঢাকা একটি খাট। ধূপের সুগন্ধ। গম্ভীর হরিধ্বনি। মুহূর্তের জন্য মনটা কেমন হয়ে গেল। বেশ কিছুটা পথ অকারণে তাদের পিছু-পিছু গেলুম। ওঁরা তবু একটা কোথাও যাচ্ছেন, আমার তো কোনও গন্তব্য নেই। এতবড় একটা পৃথিবী, অভিমানী একটা ছেলেকে কোথায় রেখেছে, কে জানে!

পথের একটা দিক বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে শ্মশানের দিকে চলে গেছে। আর একটা দিক সোজা গিয়ে ঠেকেছে একটা মাঠে। একসময় এখানে প্রাসাদের মতো একটা বাড়ি ছিল। কোনও এক রানির বাড়ি। সেই বাড়ির ধ্বংসাবশেষ ক্রমশ লোপাট হতে-হতে এখন দুটো মাত্র স্তম্ভ পড়ে আছে। মাঠের শেষে একটা ঝিল। চারপাশে গাছগাছালি। চাঁদের আলোয় নিথর, নিস্তব্ধ এক আয়োজন। অশরীরীদের মিলনভূমি।

গাটা ছমছম করে উঠল। মাঠটার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে রইলুম কিছুক্ষণ। একপাশে একটা দরমার ঘর। এই ঘরে এক বুড়ি থাকত। এখন কে থাকে জানি না; কিন্তু নাকডাকার আওয়াজ পাচ্ছি। সৌরভ যখন ছোট ছিল, সেই স্বপ্নের কালে এই মাঠ, ওই ঝিল, আমার আর কবিতার খুব প্রিয় ছিল। আমরা শীতের দুপুরে বসে থাকতুম পাশাপাশি আর সৌরভ খুব ছোটাছুটি করত। লাল একটা বল নিয়ে খেলত। তখনও সৌরভ আমাদের আনন্দ। তখনও দেনাপাওনার সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তখনও সে রেসের ঘোড়া হয়ে যায়নি। সৌরভ যখন কিশোর হল তখন এই মাঠটা ছিল তাদের খেলার জায়গা। যৌবনটা আমি অনুমান করে নিচ্ছি, ওই ঝিলটা ছিল ওদের প্রেমের জায়গা।

মন বলছে, সৌরভ এখানে থাকলেও থাকতে পারে। আমরা তাকে যতই অসম্মান করি, সৌরভের আত্মসম্মান জ্ঞান খুব প্রখর। সে ভিখিরির মতো কারও বাড়িতে এক রাত্রের জন্যেও আশ্রয় নিতে যাবে না।

চাঁদের আলোয় ফটফট করছে মাঠ। এ-ধারে ও-ধারে কয়েক টুকরো সাদা কাগজ, প্লাস্টিকের ব্যাগ পড়ে আছে। স্তম্ভ দুটোর আড়ালে দেখলুম। কেউ নেই। অতীত ঐশ্বর্যের দু টুকরো ছায়া। নাচঘরের ঘুঙুরের বোল। ঘোড়ার পায়ের শব্দ। বুক দুরদুর করছে, তবু এগোচ্ছি ঝিলটার দিকে। জলে ঝলসে আছে চাঁদের আলো। পরিরা চান করতে নামবে। এ যেন কোনও অলৌকিক পৃথিবী! আমরা যখন ঘুমোই তখন সাহসের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে অজানা। বিষয়ীদের ভয় পায়।

ঝিলের ধারে সাবুগাছের তলায় পাশাপাশি কী যেন দুটো জিনিস পড়ে আছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেইখান থেকে ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। কাছে গিয়ে দেখলুম, এক জোড়া চপ্পল। ছেঁড়া নয়। প্রায় নতুনই। পাশাপাশি কে যেন যত্ন করে খুলে জলে নেমে গেছে।

ঝিলের দিকে তাকালুম। জলের বুকে ছোট-ছোট ঠোঁটের বিষাক্ত, মায়াবী হাসি। সাপের ছোবলের মতো। হঠাৎ মনে হল, এখানে অনেক সাপ আছে। ভয়টা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে উবু হয়ে বসলুম। চটি দুটোর সাইজ কত। গত পুজোয় সৌরভকে কে চটি কিনে দিয়েছিল? আমি? মনে পড়ছে না। ইদানীং নিজের জিনিস সে নিজেই কিনত। আমাদের পছন্দর সঙ্গে তার পছন্দ মিলত না। সৌরভের পায়ের মাপ আমি জানি না। বহুকাল তার পায়ের দিকে তাকাইনি। সত্যি কথা বলতে কি, অনেকদিন তাকে খুঁটিয়ে দেখা হয়নি। আমার চোখে, সে ছিল শুধুই প্রত্যাশা। পরীক্ষা আর রেজাল্ট। গাছের দিকে তাকাইনি, শুধু ফল দেখেছি।

নিজের পায়ের দিকে তাকালুম। মনে হচ্ছে, জুতোটা আমারই পায়ের মাপে।

চারপাশে তাকালুম। কেউ কি আছে, যাকে আমি প্রশ্ন করতে পারি, হ্যাঁ মশাই, পিতা আর পুত্রের পায়ের মাপ কী এক হয়।

পরে দেখলেই হয়; কিন্তু কীরকম একটা ভৌতিক ভাব হচ্ছে। মানুষ নেই, জুতো পড়ে আছে।

চ্যাঁ চ্যাঁ করে তীব্র সুরে প্যাঁচা ডাকল তিনবার।

কেউ কি আসছে। যে আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানে। ঝিলটা কি খুব গভীর? সৌরভ কতটা নীচে শুয়ে আছে। কখন সে ভেসে উঠবে।

কে যেন দূর থেকে ডাকল—বাবা!

আমার হাত দুটো দু পাশে ছড়িয়ে গেল, ছোট-ছোট পায়ের ছোটার শব্দ কানে আসছে। সাদা মোজা পরা গোল গোল পা, পায়ে সাদা জুতো। ওইভাবে অনেকক্ষণ রইলুম, কই কেউ তো আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল না! বকের ছানা ডেকেছিল। মাঝে-মাঝে এইভাবেই ডাকে।

একটা ঘোর লেগে গেল। যুধিষ্ঠির দাঁড়িয়ে আছি—সরোবরের তীরে।

—বলো এই ঝিলে কী দেখছ?

—যক্ষরাজ জল দেখছি।

—হল না, পারলে না। এ জল নয়, তোমার অসুস্থ উচ্চাশা। বলো, এর তলায় কী আছে?

—আমার সন্তান, সৌরভ।

—আবার পারলে না, এর তলায় আছে তোমাদের ভবিষ্যৎ।

চপ্পল জোড়া হাতে নিয়ে ফাঁকা মাঠে এসে দাঁড়ালুম। মনে হচ্ছে, সভা চলছে। অনেক-অনেক লোক। আমি নেতাদের মতো মাইক্রোফোনে বলছি— বন্ধুগণ! জাল ফেলতে হবে জাল।

সবাই অমনি সমস্বরে বলছে—জাল ফেলতে হবে জাল।

পাগল হয়ে যেতে পারি। এই মাঠে মায়া আছে।

জুতো জোড়া বুকের কাছে। বাড়ির পথ ধরেছি। রাত মনে হয় অনেক হল। দূরে এক জোড়া মানুষ আসছে।

বাবা!

কে? ভূত!

না কবিতা আর সৌরভ।

কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

তোর জুতো কোথায়?

আমার জুতো আমায় পায়ে।

তা হলে, এই জুতোটা আমাকে কে মেরে গেল?

কে মেরে গেল এই জুতো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *