1 of 2

জিরো জিরো গজানন রেগেছে

জিরো জিরো গজানন রেগেছে

বেপারীটোলা লেনের এয়ারকন্ডিশনড চেম্বারে বসে দৈনিক হযবরল কাগজের একটা খবর পড়েই সোজা হয়ে বসল গজানন।

পুঁতিবালা।

নিস্তব্ধ ঘরে আচমকা বাজখাঁই ডাক শুনেই চমকে উঠল বেচারা পুঁতিবালা। হাতে কোনও কাজকর্ম নেই। কাত হয়ে বসে তাই আদিরসাত্মক ছবির বই দেখছিল, এমন সময়ে ব্রেনের ওপর এক ধাক্কা।

হাত থেকে বইটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে।

সটান হয়ে বসে থাকা গজাননের চোখ গিয়ে পড়ল মলাটে।

চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। সেকেন্ড কয়েক চেয়ে থেকেই যেন সভয়ে চোখ বন্ধ করল গ্রেট স্পাই।

বলল বজ্রগর্জনে, বইটা মুড়ে রাখ।

চোখ মুদেই বললে কিছুক্ষণ পরে–রেখেছিস?

ভেসে এল পুঁতিবালার করুণ স্বর–হ্যাঁ।

চোখ খুলল গজানন। চোখে রক্তের ছিটে। প্রমাদ গুণল পুঁতিবালা। পুঁতি, আবার ওইসব ছাইপাঁশ দেখছিস?

সময় কাটছিল না।–

ড্যাম ইওর সময়। গোল্লায় যাচ্ছে দেশটা…গোল্লায়! একদল ছেলেমেয়ে হেরোইন খেয়ে মরছে–আর একদল পর্নোগ্রাফি নিয়ে মাতছে। ছ্যাঃ…ছ্যাঃ…ছ্যাঃ!

শরমে মরে গেল পুঁতিবালা। যৌবনের পাখা যখন ফুরুক-ফুরুক করে সবে বেরোতে আরম্ভ করেছে, তখন অভাবের জ্বালায় সেই যে স্বভাবটা নষ্ট করে ফেলেছিল, এখনও তার ছিটেফেঁটা রয়ে গেছে ভেতরে-ভেতরে। চড়া দুনিয়া আর কড়া গজাননদাকে লুকিয়ে মাঝেমধ্যে একটু-আধটু এদিক-ওদিক করে ফ্যালেকিন্তু এরকম হাতেনাতে ধরা পড়েনি কখনও।

পুঁতিবালার লজ্জারাঙা অবনত নয়ন মুখখানার দিকে চেয়ে মায়া হল গজাননের। অমনি জল হয়ে গেল চিড়বিড়ে রাগটা।

হযবরল কাগজটা পুঁতিবালার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গলার স্বর নামিয়ে বললে গ্রেট গজানন– পাপিষ্ঠা। খবরের কাগজ না পড়লে স্পাইগিরি করা যায় না কতবার আর বলব?

পাপিষ্ঠা গালাগালটা গজাননের নরম মুডের গালাগাল। বুকের ধড়ফড়ানিটা একটু কমল পুঁতিবালার। একে তো ওই বাবরি চুল আঁকাল বটগাছ বললেই চলে–তারপর কটমট চাউনিতে যদি রক্তের ছিটে দেখা যায় হৃৎপিণ্ডটা মনে হয় যেন সাঁৎ করে তলপেটেই গেল নেমে। মা দুর্গার অসুরকে দেখেও এত ভয় হয় না।

চোখ তুলে মিঠে সুন্দরী পুঁতিবালা প্রথমে দেখল ছুঁড়ে ফেলে-দেওয়া কাগজটার দিকে। তারপর আড়চোখে দেখে নিল গজাননের চোখ দুটো।

না। রক্তের ছিটে নেই, চোখও আর পাকানো অবস্থায় নেই।

ধাতস্থ হয়ে কাগজটা তুলে নিল পুঁতিবালা।

কাষ্ঠ হেসে বললে, কোন পৃষ্ঠায়? কত নম্বর কলমে?

এঃ! বিদ্যে জাহির করা হচ্ছে আবার! দে, দে, দেখিয়ে দিচ্ছি। কাগজ হাতে উঠে গেল পুঁতিবালা লীলায়িত ভঙ্গিমায়–দেখেই আবার খেঁকিয়ে ওঠে গজানন–এটা কি নাট্যশালা? আঁ? বৈজয়ন্তীমালার নাচ হচ্ছে নাকি?

ফিক করে এবার হাসল পুঁতিবালা। লিপস্টিক রাঙানো পাতলা ঠোঁট জোড়ার তলায় যেন লাইনবন্দি কমল হিরে ঝিলমিলিয়ে উঠল।

বলল, মাগো! কী ব্যাকওয়ার্ড! বৈজয়ন্তীমালা এখন আর নাচে না–রিটায়ার করেছে। এম পি হয়েছে জানো না?

হয়েছে নাকি? ঢোক গেলে গ্রেট গজানন। স্পাই বিজনেসে এসে ইস্তক সিনেমা-টিনেমাগুলোও রেগুলার দেখা হচ্ছে না। দেখলেই তো সময় নষ্ট। দেওয়ালের পোস্টারটা এক ঝলক দেখেও নিল। বড়-বড় হরফে সেখানে লেখা আছেটাইম ইজ মানি। সময়ই হল গিয়ে টাকা।

কই? কোন খবরটা গজানো?

চমকে ওঠে গজানন–এই তো এইটা!

খবরটা পড়ল পুঁতিবালা। সঙ্গে-সঙ্গে কালো কালো চোখ দুটো কীরকম যেন হয়ে গেল। বললে অস্ফুট গলায়, শম্ভ নায়েক মানে সেদিন যে এসেছিল?

হ্যাঁ। সেই শম্ভ নায়েক। হেরোইন নেশার টাকা জুগোতে-জুগোতে যে ফতুর হয়েছিল–

আত্মহত্যা করার আগে হিরোইন স্মাগলার যেন ধরা পড়ে তোমাকে কাকুতিমিনতি করে বলে গেছিল।

সেই শম্ভ নায়েকই ফট করে আত্মহত্যা করে বসল।

অথচ হিরোইন স্মাগলার ধরা পড়ল না।

পুঁতিবালার ফুটুনি স্তব্ধ হতে না হতেই বাজল লাল টেলিফোন। অর্থাৎ কল এসেছে ত্রিশূল দপ্তর থেকে।

.

২.

গজাননের কীর্তিকলাপ যাঁরা এর আগে পড়েছেন, তাঁরা জানেন ত্রিশূল কী জিনিস। শিবের হাতে যে অস্ত্রটি দেখা যায়, এ সে বস্তু নয়, যদিও মহিমায় শিবের হাতিয়ারের সমান যায়।

আজ্ঞে হ্যাঁ, এই সেই গুপ্ত সংস্থা ভারতের স্বার্থরক্ষায় যার জন্ম, ভারতের মানুষ, ভারতের মাটি, ভারতের গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে যার দাপটে বহু বিদেশি গুপ্তচর সংস্থারও ঘিলু নড়ে উঠেছে বিলক্ষণ।

ত্রিশূল সেন্ট পারসেন্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কোটি-কোটি মুদ্রার খেলা চলছে ত্রিশূল এর রক্তচক্ষু অতন্দ্র রাখার জন্যে।

রামভেটকি সুরকিওয়ালা এই ভয়ঙ্কর প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় মাথা। পাঠকপাঠিকারা অনেকেই জানেন, রামভেটকিকে দেখলে মানুষের শাখামৃগ পূর্বপুরুষদের কথা মনে পড়ে, কম্যান্ডো থাকার সময়ে বেমক্কাগুলি খেয়ে সে হাঁপানি রোগে ভোগে এবং এন্তার তাড়ি খায় (হাঁপানির ওষুধ বলে)! প্রতাপে আর ব্যক্তিত্বে, নিষ্ঠুরতায় আর বিচক্ষণতায় সে কিন্তু অদ্বিতীয়।

এহেন রামভেটকির কর্কশ স্বর ধ্বনিত হল গজাননের কর্ণরন্ধ্রে লাল টেলিফোনের রিসিভার কানে লাগাতেই।

জিরো জিরো গজানন?

আই, আই, স্যার, মার্কিন সিনেমা দেখে এই বুকনি সম্প্রতি রপ্ত করেছে গজানন।

হেরোইন মানে নায়িকা নয়…জানা আছে তো?

আই অ্যাম নট সো ফুল, স্যার।

জানি, জানি, গজানন। হেরোইন যে দেশটাকে জাহান্নমে নিয়ে যাচ্ছে, তাও নিশ্চয় জানো।

সেই কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ। শম্ভ নায়েক সুইসাইড করেছে।

ওটা সুইসাইড নয়–হোমিসাইড।

মা…মানে?

মার্ডার। হেরোইন স্মাগলারের ঠিকানা বের করার চেষ্টা করেছিল শম্ভ নায়েক, তাই তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হল।

কপালের শিরা ফুলে ওঠে গজাননের নাম কী ব্যাটাচ্ছেলের?

তার আসল নাম কেউ জানে না। হেরোইন কিঙ নামেই তার নাম ডাক নেশারু মহলে।

হেরোইন কিঙ!

ইয়েস, মাই ডিয়ার গজানন—

জিরো জিরো গজানন।

অফকোর্স, অফকোর্স জিরো জিরো গজানন। আমার এক এজেন্ট তার হাতে গতকাল খুন হয়েছে।

আপনার এজেন্ট?

ডাবল এজেন্ট বলতে পারো। হেরোইন কিঙের এজেন্টকে আমারও এজেন্ট বানিয়েছিলাম। কাঁটা দিয়ে কাটা তোলা বলতে পারো। কিন্তু ধুরন্ধর কিঙ তাকে গতকাল শেষ করে দিয়েছে।

কোথায়? কীভাবে?

বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু মাল আসছিল। এই এজেন্টকে ভার দেওয়া হয়েছিল। আর আমি তাকে ভার দিয়েছিলাম, ওই সূত্র ধরে কিঙকে কাত করতে। কিন্তু..

.

কিন্তু ব্যাপারটা হয়েছিল অন্যরকম। রামভেটকি সুরকিওয়ালা নিজেও তা জানে না।

বিজু সেন নমাসে ছমাসে একবার ফিল্ডে নামে, মানে মাল পাচার করে। মোটা মুনাফা লুটে হাওয়া হয়ে যায় মাস কয়েকের জন্যে। শিলং থেকে গোঁয়ার নানান খানদানি হোটেলে তাকে দেখা যায় বিভিন্ন বিউটির সঙ্গে, দামি সুরা আর দামি গাড়ি নিয়ে মেতে থাকে মাসের পর মাস।

সে একা। একেবারে একা। প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার আসরে সঙ্গী নেওয়া বিপজ্জনক। তাই সে একা।

মাথায় সে খুব লম্বা নয়, খুব বেঁটেও নয়। কিন্তু পেটাই চেহারা। নাক-মুখ-চিবুকের গড়ন দেখে মনে হয় বুঝি মার্কিন মুলুকে তার জন্ম। বিশেষ করে তার টকটকে গায়ের রং আর কোবাল্ট ব্লু চোখ দেখে ভুল করে অনেকেই।

বিদেশিনী মা আর ভারতীয় বাবার মিশ্র শোণিত ধমনীতে ধারণ করেই সে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তাই তার চেহারায় সাগরপারের ছাপ এত বেশি।

চরিত্র? অতীব নিষ্ঠুর। টাকা ছাড়া সে আর কিছু বোঝে না। এই দুনিয়ায় টাকা থাকলেই সব থাকে–নইলে সব ফক্কা। নিকষ এই তত্ত্ব এবং জীবনদর্শন বিজু সেনকে অমানুষ করে তুলেছে। কৈশোর থেকেই।

ইছামতী নদীর ধারে এই বিজু সেনকেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছিল গত রাতে–এ কাহিনি যখন শুরু হচ্ছে, ঠিক তার আগের রাতে।

নদীর ওপারে বসিরহাটের আলো দেখা যাচ্ছে। টর্চের নিশানা করতে হবে এপার থেকে। নৌকো চলে আসবে তক্ষুনি। তিরিশ কিলো সাদা গুঁড়ো নিয়ে সেই নৌকোয় চেপে বসবে বিজু সেন।

তিরিশ কিলো! ছেষট্টি পাউন্ড। খাঁটি সাদা গুঁড়ো। হেরোইন। পলিথিন প্যাকেটে মোড়া রিফাইনড হেরোইন। প্রায় ষোলো কোটি টাকার মাল। খুচরো বাজারে গেলে দশগুণ দাম।

জীবনে এত টাকার মাল পাচারে নামেনি বিজু সেন। চার মাস ঘাপটি মেরে থেকেছে সে। এইরকম মোটা একটা দাঁও পেটার জন্যে। ছেষট্টি পাউন্ড হেরোইন পাচারই অবশ্য তার মূল লক্ষ্য নয়।

বিজু সেন খুন করতে চায় হেরোইন কিঙ-কে। স্মাগলার নৃপতিকে স্বহস্তে নিধন করে সে নিজেই রাজ সিংহাসন দখল করতে চায়। চার মাস ধরে সেই প্রস্তুতিই চালিয়ে এসেছে সে।

আকাঙ্ক্ষা তার আকাশচুম্বী–স্বপ্ন ছুঁয়ে যায় স্বর্গকে। হেরোইন কিঙ-এর অনেক মাল সে পাচার করেছে, লুটেছে অনেক টাকা, জেনেছে অনেক গলিঘুজির খবর–হেরোইন আমদানির কারবারে যা নিতান্তই দরকার।

এবার তাই সরে যেতে হবে স্বয়ং রাজামশায়কে। রাতের অন্ধকারে নীলকান্তমণির মতো জ্বলছে বিজু সেনের কোব্যাণ্ট ব্লু নয়নযুগল। বুকে ঝুলছে হাইপাওয়ার বাইনোকুলার। ইনফ্রারেড লেন্স লাগানো দূরবীন। যাতে রাতের অন্ধকারেও হাজার গজ দূর থেকে সামান্যতম নড়াচড়াও চোখ না এড়ায়।

ঢিলে শার্টের তলায় বগলের ফাঁকে চামড়ার ফিতেতে ঝুলছে পয়েন্ট থ্রি এইট ক্যালিবারের রিভলভার। হয়তো দরকার হবে না। বিপদ এলে অস্ত্র চালানোরও সুযোগ মিলবে না। রাইফেল

আনেনি সেই কারণেই…

হিপ পকেটের টর্চটাই কাজে লাগাবে নৃপতি-নিধনের পর। ইস্পাতকঠিন ঠোঁট বেঁকিয়ে মৃদু হাসে বিজু সেন।

ধুরন্ধর কিঙ কিন্তু একাজের ভার তাকে দেয়নি। মজাটা এইখানেই। ছেষট্টি পাউন্ড হেরোইন পাচার হবে বাংলাদেশের বর্ডারের ওপর দিয়ে

এ খবরটা তাকে দিয়েছে একজন পুলিশ দারোগা।

বিজু সেনের অন্তরে তাই সামান্য সংশয় আছে বইকী। দারোগা যে খবর জানে–সে খবর নিশ্চয় আরও অনেকে জেনে বসে আছে। কিঙ বরাবর কাজ করে নিখুঁতভাবে–এবারে বিজু সেনকেও সে জানায়নি। কিন্তু জেনেছে দারোগা।

রাত দশটা। সময় হয়েছে। কয়েকশ গজ চওড়া এই ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে এখুনি আসবে কিঙ। মাঠের ওপারে নারকেল গাছগুলোর তলা দিয়ে আবির্ভূত হবে তার মূর্তি।

ঝোপের মধ্যে গুঁড়ি মেরে বসল বিজু সেন।

মিনিট পনেরো পরেই দেখা গেল একটা ছায়ামূর্তিকে। পরনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। হাতে একটা ব্যাগ। হনহন করে মাঠ পেরিয়ে আসছে।

দূরবীন কষতে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসতে হয়েছিল বিজু সেনকে। দুলে উঠেছিল ঝোঁপটা। তারার আলোর ঝিকিমিকিও নিশ্চয় দেখা গেছিল দূরবীনের লেন্সে।

জীবনমরণের খেলায় সামান্য ওই ভুলটুকুই যথেষ্ট।

মাঠের ওপারে কয়েকশ গজ দূরে ঝোঁপের মধ্যে লক্ষ্য স্থির হয়ে গেল শক্তিশালী ম্যাগনান আগ্নেয়াস্ত্রের–টেলিস্কোপিক নাইট-শাইট ফিট করা মারণাস্ত্রের বুলেটটা নিক্ষিপ্ত হল নির্ভুল লক্ষে।

বিজু সেনের টুটি উড়ে গেল। বিশাল গর্ত দিয়ে কলকল করে বেরিয়ে এল রক্ত।

মাঠের মাঝে লুঙ্গি পরা লোকটা চমকে উঠল আওয়াজ শুনে। দশটা টাকা তাকে দেওয়া হয়েছে ব্যাগটাকে মাঠ পার করে দেওয়ার জন্যে। নদীর ধারেই নাকি লোক দাঁড়িয়ে আছে। বর্ডার পেরোলেই…

কিন্তু গুলি ছুঁড়ল কে? কার দিকে?

ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটতে যাচ্ছে নিরীহ মানুষটা, মারণাস্ত্র থেকে ছুটে এল লক্ষ্যভেদীর আর একটা বুলেট। হৃৎপিণ্ড ছুঁড়ে বেরিয়ে গেল মৃত্যুদূত।

ঝোঁপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে গেল হেরোইন কিঙ। বিজু সেন যে ডাবল এজেন্টের কাজ নিয়ে তাকেই নিকেশ করে হেরোইন-সম্রাট হওয়ার স্বপ্ন দেখছে–এখবর পেয়েই জাল পাততে হয়েছিল কিঙকে। টোপ ফেলেছিল অনেক কায়দা করে।

রামভেটকি সুরকিওয়ালা কল্পনাও করতে পারেনি পুরো প্ল্যানটা কিঙ-এরদারোগাও তার হাতের পুতুল। অজান্তে কবর রচনা করে ফেলেছে বিজু সেনের।

.

৩.

গজানন, কী বুঝলে? রামভেটকির প্রশ্নটা টেলিফোনের তারের মধ্যে দিয়ে এসে কিলবিলিয়ে ওঠে গ্রেট গজাননের ব্রেনের মধ্যে।

দাঁতে দাঁত পিষে বাজনা বাজানোর চেষ্টা করল গজানন। দেখে মুখ টিপে হেসে ফেলে পুঁতিবালা। কিড়মিড় আওয়াজের বদলে একটা বিচ্ছিরি আওয়াজ গিয়ে পৌঁছল রামভেটকির কানে।

গজানন, এটা কিসের শব্দ?

আমি রেগেছি।

রেগেছ? জিরো জিরো গজানন রেগেছে। তবে আর কী, কিঙ এবার কঙ হবে।

কিঙ কঙ হবে?…

মানে, কি কঙের যে দশা হয়েছিল, তাই হবে। মানে, পটল তুলবে। তাই তো?

ইয়েস, বস্। গজানন তার মুন্ডু ছিঁড়বে। গেণ্ডুয়া খেলবে। কিন্তু তাকে পাব কোথায়?

সেটাই তোমার কাজ। খুঁজে নিতে হবে।

খুঁজব কোন চুলোয়?

ল্যাঙ্গুয়েজ!…ল্যাঙ্গুয়েজ!..মাই ডিয়ার গজানন, তুমি হলে ভীষণ ভয়ঙ্কর প্রচণ্ড টঙ্কার– ত্রিশূলের বাণ নিয়ে ধ্বংসের মন্ত্র কপচাতে-কপচাতে যাচ্ছ অভুত প্রলয়কে অঙ্কুরে বিনাশ করতে। তোমার মুখে চুলোয় শব্দটা মোটেই খাপ খায় না।

বসো, আমার মাথা ভেঁ-ভো করছে আপনার ল্যাং…ল্যাং..

ল্যাঙ্গুয়েজ শুনে–এই তো? বৎস গজানন, বৎস বললাম বলে ফির ভি রেগে যেও না। তুমি যাচ্ছ সেই খাঁটি বাংলাভাষার দেশে–

আই মীন বাংলাদেশে?

ইয়েস, ইয়েস, মাই বয়, গ্রেট হারামজাদা কিঙ এখন রয়েছে বাংলাদেশে।

হেরোইন নিয়ে আসেনি ইন্ডিয়ায়?

বড্ড হুঁশিয়ার যে! ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েই পিছু হটে গেছে। বিবরে প্রবেশ করেছে।

স্যার, বিবর না কবর–কী বললেন?

ননসেন্স! বেলেঘাটায় থেকে তোমার কালচারটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে দেখছি।

এইবার আঁতে ঘা লাগে গজাননের। মাতৃভূমির নিন্দে শুনলে যে কোনও স্বদেশপ্রেমীরই গোঁসা হয়। আমাদের গ্রেট গজাননও বেলেঘাটায় মাটিকে ভালোবাসে।

অতএব সে গর্জে উঠল তৎক্ষণাৎ মিঃ রামভেটকি সুরকিওয়ালা!

ভড়কে গেল রামভেটকি কী..কী হল?

আপনি জানেন, যার আছে অনেক টাকা, সেই থাকে বেলেঘাটা?

তা-আমি তো জানতাম, যার নেই পুঁজিপাটা, সেই থাকে বেলেঘাটা।

ওটা আগেকার কথা। এখন দিন চেঞ্জ হয়েছে। এটাও কি জানেন, যার আছে অনেক টাকা, তার থাকে ইজ্জৎ, কালচার?

তা…হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, গজানন।

তাহলে কথা ফিরিয়ে নিন। বলুন বেলেঘাটায় থেকে গজাননের কালচার এক্কেবারে ভালচার হয়ে গেছে।

ভা…ভা…ভালচার! কিন্তু ভালচার মানে তো

শকুনি। আমিও তাই। স্পাইরা শকুনি ছাড়া আর কী? অনেক উঁচুতে উড়লেও নজর থাকবে ঠিক ভাগাড়ের দিকে–যেখানে দেখিবে মড়া, ঠোকরাইয়া দ্যাখো তাই।

গজানন, ইউ আর গ্রেট।

আই অ্যাম! আই অ্যাম! গোঁফ নেই, তবু গোঁফে তা দিয়ে নেয় গজানন। কালচারের সঙ্গে ভালচারের মিলটা ফটাং করে মাথায় এসে গেল। সত্যিই, কী রহস্যময় ব্রেন।

পুঁতিবালা পর্যন্ত অবাক হয়ে দেখছে গজাননকে। কী অপূর্ব কালচার! ভালচার না হলে আদর্শ স্পাই তো হওয়া যায় না। মাতাহারির কথা মনে পড়ে যায় পুঁতিবালার। মাতাহারিকে যদিও ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল। রাইফেলের নলচেগুলো কিন্তু লক্ষ্যস্থির করতে পারেনি। সমানে বুক দুলিয়ে গেছিল মাতাহারি ট্যারা করে ছেড়েছিল রাইফেলধারীদের।

কী দুর্জয় সাহস। মৃত্যু সামনে–অথচ বুক দোলাচ্ছে মাতাহারি। আপন মনেই নিজের পীন পয়োধরা একবার দুলিয়ে নেয় পুঁতিবালা।

পরক্ষণেই মাতাহারির স্বপ্ন টুটে যায় গজাননের আচমকা চিৎকারে, কী বললেন? কিন্তু এখন

টেলিফোনে ভেসে এল কড়া ধমক–গজানন, আর কোনও কথা নয়, শহরটার নাম টেলিফোনেও বলা ঠিক নয়। বড় ক্রশ কানেকশান হচ্ছে আজকাল। কোড ল্যাঙ্গুয়েজে যা বললাম। তা মনে রেখো। ঠিক দু-ঘণ্টা পরে একটা লাল রংয়ের পটিয়াক গাড়ি যাবে বেপারীটোলা লেনে। তোমাকে সটান বর্ডার পার করে ঠিক সেই জায়গাটায় পৌঁছে দেবে। গাড়ি থাকবে তোমার হেপাজতে। বাংলাদেশের ড্রাইভার্স লাইসেন্স করা আছে–তোমার পাশপোর্ট হচ্ছে মহম্মদ হোসনের নামে। ইন্ডিয়ান টুরিস্ট। বুঝেছ?

জি হ্যাঁ। পুঁ

তিবালাকে নেওয়া যাবে না।

যাবে না?

না। বড় ডেঞ্জারাস গেম, গজানন। কিঙ ওই শহরেই আছে খবর পেয়েছি। সাদা গুঁড়োও তার কাছে। তুমি তাকে খুঁজে বের করবে, মুন্ডু ছিঁড়বে–

গেণ্ডুয়া খেলব।

যা খুশি। যদি তার আগে তোমার মুণ্ডু ভেঁড়া যায়?

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলোরে!

ননসেন্স!

লাইন ডেড হল। গজানন প্রোজ্জ্বল চোখে পুঁতিবালার দিকে চাইল। বলল, এই ছুঁড়ি, এবারকার অ্যাডভেঞ্চারে তোর ঠাই নেই।

পুঁতিবালা কিছু বলল না। একটা কথাও না।

কিন্তু পুঁতিবালা যে কী চীজ, তা গজাননও জানত না। মেয়েরা যখন গুপ্তচরী হয়, বাঘিনীদেরও হার মানায়। পুঁতিবালা যে লাইন থেকে এসেছে, সে লাইনে মোহিনী হওয়ার ছলাকলা শিক্ষার বিলক্ষণ স্কোপ ছিল। পুঁতিবালা এই মস্ত আর্ট-টি রপ্ত করেছে।

বাকিটা তার বডি খেলিয়ে ঠিক ম্যানেজ করে নেয়।

ফলে, বাংলাদেশের সেই শহরটিতে গজানন যখন ঢুকল তার গাড়ি নিয়ে অনেক পেছনে একটা ট্যাক্সিতে বোরখাপরা একটা মেয়েকেও দেখা গেল-ফলো করছে গজাননকে। গজানন গিয়ে উঠল একটা ফাইভ স্টার হোটেলে, পুঁতিবালাও (বোরখা পরিহিতা) উঠল সেখানে। রেজিস্টারে গজানন নাম লেখালো মহম্মদ হোসেন। পুঁতিবালা লিখল সুলতানা রাজিয়া। তারপর কী অপূর্ব কৌশলে, কী দৈবক্রমে জানা নেই–দু-জনেরই ঘর পড়ল পাশাপাশি–একই করিডরে।

তখন রাত হয়েছে। হোটেলের ঘরেই ধড়াচূড়ো পালটে নিল গজানন। রিভলভারটা নেবে কি নেবে না ভাবল সেকেন্ড কয়েক। তারপর না নেওয়াটাই ঠিক করল। যাচ্ছে তো খড়ের গাদায় উঁচ খুঁজতে। সিকিউরিটিতে রিভলভার ধরা পড়লেই যাবে সব গুবলেট হয়ে।

এদিকে পাশের ঘরে পুঁতিবালা কী করছে?

বোরখা ছুঁড়ে ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে। পটাপট ব্লাউজ খুলে সড়াৎ করে শাড়ি আর সায়া খুলে–না…না…অতটা সে যায়নি!)…পরনের একটি মাত্র জাঙ্গিয়ার মতো পরিধেয়কে লোলুপ নয়নে দেখছে। একবার নিতম্ব নাচিয়ে দেখে নিল সব ঠিকঠাক আছে কিনা।

আছে, আছে। পুঁতিবালা এখনও মরেনি। মাতাহারিও বোমকে যাবে তার এই অপ্সরী মূর্তি দেখলে। বুকের এক চিলতে আবরণী থাকুক দরকার হলে টান মেরে খুলে ফেলা যাবে।

রাইফেল, রিভলভার, চাকু, হাতবোমকেও এখন আর ভয় পায় না পুঁতিবালা। মুখের রং টঙগুলো আর একবার ফ্রেস করে নিল গজাননের চ্যালা। কিঙকে রং নিয়েও যদি ঘায়েল করতে না পারা যায় তাহলে পুঁতিবালার লাইন ছেড়ে দেওয়া উচিত।

বোরখাটা মাথা দিয়ে গলিয়ে নিয়ে দরজা ফাঁক করে দাঁড়াল পুঁতিবালা।

আর ঠিক সেই সময়ে আঁকড়াচুলো গজানন গ্যাটর-গ্যাটর করে বেরিয়ে গেল ওর ঠিক নাকের ডগা দিয়ে। নাকে এল আতরের গন্ধ।

গজাননদা আতর মেখেছে। বলি ব্যাপারটা কী!

নীরস কাঠখোট্টা গজাননদা গন্ধদ্রব্য কস্মিনকালেও দু-চক্ষে দেখতে পারে না–নাকে শুঁকে ফেললে পচা গোবর শুঁকে ফেলেছে, এমনিভাবে নাক সিঁটকোয়।

সেই মানুষটা কিনা সারা গায়ে আতর মেখে পাঁচতারকা হোটেলের অলিন্দ পথ হাঁটছে। মতলবটা কী দেখতে হচ্ছে তো!

সুরুৎ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল পুঁতিবালা। গটগট করে চলল গজানন ওরফে মহম্মদ হোসেনের পেছন-পেছন। উঠল একই লিফটে। একতলায় নামল একইসঙ্গে। চোখ পাকিয়ে জিরো জিরো গজানন একবারটি দেখেছিল পাশের বোরখাধারিণীকে। সন্দেহ করেনি। করবেটা কী করে? বোরখা ছুঁড়ে দেখবার ক্ষমতা তো নেই। থাকলে দেখতে পেত হেসে কুটিপাটি হচ্ছে পুঁতিবালা। আর মনে-মনে বলছে-বটে! বটে! গজাননদা! বিদেশে এসে শেষকালে কামিনীকাঞ্চনে মজবে! আমি থাকতে তা হতে দেব না। সাধনার ব্যাঘাত ঘটতে দেব না!

একতলায় লিফট থেকে বেরিয়ে গজানন জিগ্যেস করে নিল, গেমরুম কোথায়। গেমরুম মানে জুয়ো খেলার আড্ডাঘর। এ হোটেলে সে ঘর আছে একতলারও নিচে মানে পাতালঘরে।

গজানন চলল সেই দিকে। পকেটে কাড়ি কাড়ি টাকায় একবার হাত বুলিয়ে নিল। টাকার বান্ডিলে হাত বুলোলে নার্ভ-টার্ভগুলো বেড়ে ঠান্ডা হয়ে যায়!…তারপরেই জমাটি ঠেঙানি শুরু করা যায় শীতল মস্তিষ্কে।

কে জানে পাতাল ঘরে এখুনি তাই শুরু হবে কিনা! এসে গেছে গেমরুম। পুরো করিডরটা এয়ারকন্ডিশন করা। গেমরুমের দরজায় খেলাটেলার ছবি থাকলে বোঝা যেত ঘরটায় কী হয়।

কিন্তু যে ছবি রয়েছে, তা দেখলে ভুল ধারণা ঢুকে যায় মগজে।

একটা মেয়ের ছবি। ঘূর্ণমান গ্যালারি থেকে রাশি-রাশি নক্ষত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে সে যেন নেমে আসছে মতে। অহো! অবতীর্ণ হওয়ার কী অপূর্ব ছন্দ! মনোমুগ্ধকর নিঃসন্দেহে। অবশ্য সেইরকম মনই মুগ্ধ হবে এই তিলোত্তমাকে দেখলে।

কেননা, প্রথম মানব আদম প্রথম মানবী ঈভকে পরিধেয় আবিষ্কারের বহু আগে যে সজ্জায় দেখেছিল কটাক্ষময়ী এই ললনাও যে রয়েছে সেই সজ্জায়।

দেখেই সভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল গজানন। সামলে নিল অবশ্য মুহূর্তের মধ্যেই। এসব মামলা হাতে নিলে চোখ খোলা রাখা দরকার–চোখের সামনে যা-ই পড়ুক না কেন–দেখতেই হবে।

অতএব খুঁটিয়ে দেখল গজানন। কোথায় যেন পড়েছিল, ভালো করে চোখ মেলে দেখার নাম পর্যবেক্ষণ, তাই পর্যবেক্ষণ করল অতীব নিষ্ঠার সঙ্গে।

খুব একটা খারাপ লাগল না। নারীদেহ বরাবরই তার কাছে একটা অজ্ঞাত মহাদেশ অথবা মহাসমুদ্র হারিয়ে যাওয়ার চান্স এত বেশি…

কিন্তু এই রূপসিটির অধরে, ললাটে, নয়নে, গ্রীবায় এবং সেখান থেকে পদযুগল পর্যন্ত প্রদেশগুলিতে এমন-এমন সব পেলব সৌন্দর্য আছে যা অচল মনকেও সচল করে দিতে পারে!

একদা মানসিক ক্লিনিকবাসী গজাননেরও ব্রেনের কোষগুলো অদ্ভুতভাবে সচল হয়ে ওঠে।

দরজার সামনে টুলে বসেছিল হোটেলের লোক। সাধারণ কর্মচারী নয়। লড়াকু চেহারা। চুল এত ছোট করে কাটা যে মুঠো করে ধরা সম্ভব নয়। চোখ দুটি মার্বেলগুলির মতো গোল-গোল। গায়ে সিকি ছটাক চর্বিও নেই। জামাটা মোটা কাপড়ের অনেকটা ফতুয়ার মতো দেখতে, প্যান্টটা তো পাছা কামড়ে রয়েছে।

ঠোঁট ফাঁক করে অত্যন্ত অমায়িক হাসি হেসে-হেসে গজাননের পর্যবেক্ষণ পর্ব অবলোকন করছিল লোকটা। হাসিটাকে অনেক ট্রেনিং দিয়ে অমায়িক করবার চেষ্টা করেও পারছিল না। মনে হচ্ছিল যেন একটা হিংস্র হায়না দাঁত খিঁচিয়ে আছে।

গজাননের পর্যবেক্ষণ পর্ব প্রলম্বিত হচ্ছে দেখে সে টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

বললে, ভেতরে যাবেন?

চমকে ওঠাটাকে বিউটিফুলি ম্যানেজ করে নিল গজানন। আদি জেমস বন্ড মানে সীন কোনারির চার্মিং হাসি হাসল।

বললে–অফ কোর্স।

আমি সিকিউরিটি স্টাফ। আপনাকে নতুন দেখছি, সার্চ করব।

হোয়া-ট!

অবিচল কণ্ঠ সিকিউরিটি স্টাফের নিয়মিত এলে আর করব না। ঝুঁকি নিতে চাই না। অনেক ধরনের লোক তো এখানে আসে।

অনেক ধরনের লোক এখানে আসে! এবং এই জন্যেই তো গজাননের আবির্ভাব এই নির্বান্ধব পুরীতে। পাঁচতারা হোটেলের গেমরুমে লাখ টাকার খেলা দেখাতে যারা আসে, তাদের লাখ টাকা সাদাপথে আসে না কখনওই। কালোপথে পাথর পথিকদের পেট থেকেই তো খবর পাওয়া যাবে কিঙ মহাপ্রভুর।

বুক চিতিয়ে বললে বেলেঘাট্টাই মস্তান (প্রাক্তন)–ও ইয়েস। ভাগ্যিস, রিভলভার আনেনি। সঙ্গে!

দরজা খুলে ধরল গাঁট্টাগোট্টা লোকটা। ছোট্ট একটা চেম্বার। তার পরের দরজাটা খুললে গেমরুমে ঢোকা যায়। পৃথিবীর সবরকম কান ফাটানো শব্দ বোধহয় সেখানে মিশেছে। ছোট্ট চেম্বারে তার রেশ ভেসে আসছে গুমগুম করে।

কম্যান্ডোর চাকরি করত নাকি কদমছাঁট এই মর্কটটা? দ্রুত হাত বুলিয়ে গেল গজাননের সর্বাঙ্গে। বাহুমূল, ঊরুসন্ধি কিছু বাদ গেল না।

কপট অমায়িক হেসে বললে, যান। খুলে ধরল দরজা গেমরুমের।

কান ঝালাপালা আওয়াজে প্রথমটা মাথা ধাঁধিয়ে গেল গজাননের। কীরকম যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে মনে হল। তারপরেই তেড়েমেড়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

বোরখাপরা পুঁতিবালা দাঁড়িয়েছিল করিডরে। বোরখাটা খুলবে কিনা তাই নিয়ে ভাবছিল। গজাননদার সামনে খোলা মানেই কেলেঙ্কারি। অথচ মন চুলকোচ্ছে বডিখানা কাউকে দেখাতে স্বভাব যায় না মলে।

এসে গেল সেই সুযোগ। গজাননকে গেমরুমে চালান করে দিয়ে করিডরের দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল কদমছাঁট লোকটা।

বোরখার মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললে রুক্ষ কণ্ঠে–ফরমাইয়ে?

দরজাটা খুলুন, কাটকাট কথা পুঁতিবালার।

বোরখা পরে ভেতরে যাওয়া যায় না।

তাই নাকি? তাই নাকি? কেন যাওয়া যায় না শুনতে পারি?

সার্চ করিয়ে যেতে হয়।

তাই বলুন। সার্চ করিয়ে গেলেই হবে। তা করুন না।

বোরখা খুলতে হবে।

তাই নাকি? তাই নাকি? এই খুললাম, বলেই হ্যাঁচকা টানে মাথা গলিয়ে বোরখা খুলে যেন হাওয়ায় উড়িয়ে দিল পুঁতিবালা। দুই হাত দু-পাশে ছড়িয়ে সশব্দে তুড়ি দিয়ে কবজি ঘুরিয়ে বললে সে এক অপরূপ কায়দায়কী সার্চ করবেন, মিঃ সার্চম্যান? কী আছে আমার–এই বডিখানা ছাড়া। বলতে-বলতেই মোক্ষম মোচড় দিল বক্ষ শোভায় মাতাহারি-স্টাইলে।

চোখের মধ্যে আলপিন ফুটিয়ে দিলেও বোধহয় এত তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করত না দ্বাররক্ষক। আঁতকে উঠে দরজা খুলে দিয়ে বললে কী হচ্ছে কী খোলা জায়গায়! যান ভেতরে।

বিজয়িনী পুঁতিবালা এক পা দিল ছোট্ট চেম্বারে।

বললে ঘাড় ঘুরিয়ে–-মিঃ সার্চম্যান, সার্চ করবেন কি বন্ধ জায়গায়? আসুন, আসুন, কতক্ষণই বা আর লাগবে।

ভেতরের দরজা খোলার জন্যে বেগে ছোট্ট চেম্বারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে কদমছাঁট–গায়ে গা ঘষটে যেতেই এককালের বাজারি মেয়ে পুঁতিবালা দেখিয়ে দিল তার ফর্মটা।

ঝাঁ করে জাপটে ধরল বেঁটে লোকটাকে। সশব্দে চুম্বন করল ঠিক ঠোঁটের ওপর। সাঁৎ করে বেরিয়ে গেল বাইরে। করিডর থেকে বোরখাটা তুলে নিয়েই পরে নিল চোখের পলক ফেলতে ফেলতে। ফিরে এল চেম্বারে। মূহ্যমান কদমছাঁটকে বললে দেবী চৌধুরানির গলায়–খুলুন দরজা।

ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি গোছের শুকনো হাসি হেসে দরজা খুলে ধরল কদমছাঁট। দৃপ্ত ভঙ্গিমায় পুঁতিবালা ঢুকে গেল ভেতরে।

বোরখার মধ্যে থেকে কিন্তু তার চোখ ঘুরছে মস্ত বড় ঘরটার এদিকে থেকে সেদিকে। জগঝম্প আওয়াজে কানের পরদা ফুটিফাটা হলেও আশ্চর্য হবে না পুঁতিবালা। এ কী পাগলের কারখানা রে বাবা! একদিকে সারি-সারি ভিডিও গেম নিয়ে বিকট বাজনা বাজিয়ে জুয়ো খেলে যাচ্ছে একপাল পুরুষ এবং মহিলা। যত না খেলছে, চেঁচাচ্ছে তার চাইতে বেশি। আর এক পাশে একটা হাঁটু সমান উঁচু মঞ্চে উল্লোল নাচ নাচছে একটি যোড়শী, গেমরুমের সামনের দরজায় আঁকা ছবির সঙ্গে তার মিল আছে শুধু একটি ব্যাপারে…পাঠক-পাঠিকাদের অনুমানের ওপরেই সে ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া গেল।

মঞ্চের সামনে বেশ কিছু চৌকোনা টেবিল আর প্রতিটা টেবিলের চারদিকে চারখানা চেয়ারে বসে নানা বয়সি পুরুষরা উকট উল্লাসে ফেটে পড়ছে আদিম নৃত্য দেখে ষড়রিপুর প্রথম রিপুকে যা প্রজ্বলন্ত করার পক্ষে যথেষ্ট।

একজন তরুণ আর সইতে পারল না প্রথম রিপুর অগ্নিদহন। ছিটকে গেল মঞ্চের ওপর। যেন তৈরি হয়েই ছিল ষোড়শী। আঁকাবাঁকা বিজলী রেখার মতো মঞ্চের ওপর তরুণটিকে খেলিয়ে নিয়ে উন্মত্ত অট্টরোল সৃষ্টি করে সাঁৎ করে অদৃশ্য হল পেছনের দরজায়–তরুণটিও তিন লাফ মেরে ঢুকে গেল ভেতরে।

বন্ধ হয়ে গেল দরজা। পরমুহূর্তে আর একটি ললনা পাশের দরজা দিয়ে ছুটে এল মঞ্চে যেন গেমরুম-এর দরজায় আঁকা ছবির অনুরূপ একটি মূর্তি…শুরু হয়ে গেল হাসি মুখে মদির চোখে আদিম নৃত্য…

এতক্ষণে দম আটকে দেখছিল পুঁতিবালা। বহুবল্লভা পুঁতিবালা! কিন্তু এ হেন রাধাবল্লভী নাচ তাকেও কখনও নাচতে হয়নি।

তোবা! তোবা! বেশ বোঝা যাচ্ছে এই খেলাই চলবে সারারাত। কিন্তু জিরো জিরো গজানন গেল কোথায়? পুঁতিবালা আসবার আগেই গ্রীনরুমে উধাও হয়নি তো একটা চলমান ছবির পেছন পেছন?

বড্ড উৎকণ্ঠা হয় পুঁতিবালার। বড় আনাড়ি এই দাদাটি। তাই তো একলা ছেড়ে দেওয়া যায় না। সঙ্গে-সঙ্গে থাকতে হয়,–আড়ালে থেকে রক্ষা করতে হয়।

ওই তো…ওই তো গজাননদা! কিন্তু সামনে ওই মেয়েছেলেটা আবার কে? গজাননদার ঝাকড়া চুল দেখেই মজেছে মনে হচ্ছে। খুব যে হেসে-হেসে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে কথার রঙ্গ হচ্ছে! ওই তো চেহারা! কালো! তবে হ্যাঁ, চেহারায় চটক আছে বটে। কালো মেয়েরা একটু সেক্সি হয় ঠিকই। কিন্তু এই ঢলানিটা যেন একটু বেশি রকমের সেক্সি। যৌনতা বুঝি উপচে-উপচে উঠছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত গড়িয়ে-গড়িয়ে নামছে শরীরের খাঁজ খোঁদল বেয়ে পাহাড়ি ঝরনার মতো!

গজানো পটে গেল নাকি? মরেছে! তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় পুঁতিবালা, এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে উদ্দাম নাচ দেখতে থাকে, যেখানে গজাননের চোখ যাবে না কিন্তু ওদের কথা কানে ভেসে আসবে।

বলছে কী হারামজাদী? আঁ! নেমন্তন্ন করছে গজাননদাকে। বলছে ছেনালিগলায়–মিঃ ওয়ান্ডারম্যান, আপনার জন্ম কি হারকিউলিসের ঔরসে? চলুন আমার ঘরে।

পুঁতিবালার ইচ্ছে হল তেড়ে গিয়ে ঠাস করে একটা চড় কষায় আন্নাকালীর গালে। আস্পর্ধা তো কম নয়। গজানো বোঝে কি এ সবের? হারকিউলিসের সঙ্গে বাপের তুলনা! এই রাত্রে তাকে ঘরে তোলার মতলব? গজাননদা, গজাননদা, কথার ফাঁদে পা দিও না মরবে বলে দিলাম। ওই আন্নাকালী তোমাকে খেয়ে ফেলবে।

কী বলছে গজানো? হাসছে। হাসিটা কিন্তু বেশ প্যাচাল ধারাল। হাজার হোক জিরো জিরো গজানন তো। কায়দা কানুনগুলো প্র্যাকটিস করছে ভালোই।

বলছে হেসে-হেসে ডার্লিং, আপনার হাজব্যান্ড অ্যাংরি হতে পারেন।

ওঃ! আবার ইংলিশ ছাড়া হচ্ছে! স্বামী মহাশয় রাগ করবেন বলেই যাওয়ার ইচ্ছে নেই। রাগ না করলেই সুড়সুড় করে চলে যেতে, তাই না গজানো? মাইরি, তোমাদের এই পুরুষ জাতটাকে দেবা ন জানন্তি–

বলে কী কেলে মেয়েমানুষটা? উৎকর্ণ হয় পুঁতিবালা।

আন্নাকালী বলছে, আমার হাজব্যান্ড এখন ডিউটিতে।

এত রাতে?

সারা রাতই তো ওর ডিউটি। তাই সারারাত আমার বড় একা-একা লাগে–ঘরে তো আর দ্বিতীয় প্রাণী নেই। চলুন না–

ডার্লিং, আমি এসেছি দেশ দেখতে–

ও নটি বয়! নতুন দেশের নতুন মেয়েদের আগে দেখতে হয়। আমার দেশকে ভালোবাসি বলেই তো এত ডাকাডাকি, মিঃ সন অফ হারকিউলিস!

আরে বাস্! এ যে দেখছি ছেনালিপনায় মহারানি। গজাননদা, গজানো, অমন করে আন্নাকালীর মুখের দিকে চেয়ে আছে কেন?

তারা! তারা! ব্রহ্মময়ী! গজাননদা, তুমিও? তুমিও ওই মেয়ে হ্যাংলাদের দলে?

বিড়বিড় করে আবার কী বলা হচ্ছে আন্নাকালীকেও। পুঁতিবালার কানকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না, গজাননদা, যত আস্তেই বলো না কেন।

কেয়াবাত! গজাননদা, তোমার চোখ এত ধারালো?

খুব আস্তে বললেও কথাগুলো সুস্পষ্ট ধ্বনিত হল পুঁতিবালার কানে–আপনি ড্রাগ অ্যাডিক্ট? হেরোইন খান?

চোখের তারা খুব একটা কাপল না আন্নাকালীর।

বললে একই রকম নিনাদী কণ্ঠেওটা তো স্ট্যাটাস সিম্বল, মিঃ…মিঃ..

হোসেন। মহম্মদ হোসেন।

বুঝলেন কী করে?

আপনার চোখের তারা দেখে। আসলে আন্দাজ মিশিয়ে ঢিল ছুঁড়ছিল গজানন–লেগেছে ঠিক জায়গায়। আমারও ইচ্ছে যায় জিনিসটা চেখে দেখতে।

ও মাই মিঃ ওয়ান্ডারম্যান। তাহলে চলে আসুন আমার ঘরে। ভয় নেই, আমার গাড়িই আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাবে হোটেলে।

গেল! গেল! সব গেল! পুঁতিবালা ইচ্ছে করে বোরখার ভেতর থেকেই হাউমাউ করে ওঠে। গজানো, ও গজাননদা, তোমার এতটা মতিচ্ছন্ন হয়েছে, জানা ছিল না তো! হেরোইন খাওয়ার শখ হয়েছে! আঁ! হেরোইন কিঙকে ধরতে এসে হেরোইন চেখে দেখবার শখ হয়েছে! কী চাখতে চাও, গজাননদা! কষ্টিপাথরের মতো কালো ওই ঢলানিটাকে? ওটা তো বাজারের মেয়েরও অধম– ঘরে স্বামী থাকতে পরপুরুষ নিয়ে ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

ও কী! একি কাণ্ড! গজাননদা যে ঢলানিটার পেছন-পেছন চলল গো! ওমা কী হবে গো! ওরা যে গাড়ি করে যাবে। পুঁতিবালা সঙ্গে যাবে কেমন করে?

হিল্লে একটা হবেই। পুঁতিবালাও মেয়ে কম নয়। কোথাকার কে এসে গজাননদাকে বাগিয়ে নিয়ে যাবে–সেটি হতে দেওয়া চলবে না।

আন্নাকালীর পেছন-পেছন গ্রেট-গজানন যাচ্ছে অন্য দরজার দিকে। যে দরজা দিয়ে ভেতরে এসেছে–সে দরজা দিয়ে নয়। কেলে ঢলানি এখানকার সব খবরই রাখে তাহলে। ইস। আবার তাঁতের শাড়ি পরা হয়েছে। কালচার তো কচু! পরপুরুষকে নিয়ে রাত কাটাস। তবে হ্যাঁ, শাড়িটা চমৎকার। পছন্দ আছে বটে ঢলানির।

আগে বেরিয়ে যাক দুজনে, ওঃ! হাঁটছে দ্যাখো, ঠিক যেন কপোত-কপোতী। ঝাড়ু মার পুরুষ জাতটার মুখে। গজাননদার এতখানি অধঃপতন হবে, ভাবতেই পারেনি পুঁতিবালা।

বেরিয়ে গেছে ওরা। বেরোবে পুঁতিবালা। না কোথাও বাধা নেই। হোটেলের পেছনদিকটা যে এত অন্ধকার, কে জানত। অন্ধকারই বা হবে না কেন। যা কাণ্ডকারখানা চলেছে ভেতরে তাদের জন্যেই তো দরকার অন্ধকারের যবনিকা।

গেল কোথায় দুশ্চরিত্র দুটো? ওই তো…ওই.ওই কিন্তু একটা ছায়া কেন? হরি! হরি! দুজনে গায়ে গা দিয়ে এক হয়ে গেছে। গজাননদাকে হয় হারামজাদী চুমু খাচ্ছে, নয় তো গজাননদাই–

আচম্বিতে গাছের আড়াল থেকে ধেয়ে এল দুটো ছায়ামূর্তি।

ছিটকে সরে গেছে গজাননদা আর আন্নাকালী। আন্নাকালী ছুটছে হরিণীর মতো। কোথায় যাচ্ছে? ওহো। গাড়ি এনেছিল। সেই গাড়িতে উঠে বসে ঝড়ের মতো চালিয়ে দিয়েছে। হেডলাইটের ডবল আলোয় অন্ধকার ছিঁড়েখুঁড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দুর হতে দুরে।

গজাননদাকে দুদিক থেকে ঘিরে ধরেছে দুই আগন্তুক। ঠিক হয়েছে।

বিদেশে এসে বিদেশিনীকে আস্বাদনের বড় শখ হয়েছিল। এখন ঠেলা সামলাও।

বোরখাটা খুলে অলিম্পিক স্পিড় দেওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে পুঁতিবালা প্ল্যান কষা হয়ে গেছে কীভাবে ক্যারাটে ঝেড়ে দুদিকে ছিটকে দেবে দুই হানাদারকে, এমন সময়ে…

গম্ভীর গলায় বললে একজন আগন্তুক মানিব্যাগটা বার করুন।

ব্যাগ বের করে ছুঁড়ে দিল গজানন। সঙ্গে-সঙ্গে ছুঁড়ে দিল নিজেকেও। মরি! মরি! এ সেই বিখ্যাত গজানন লম্ফ। হনুমানও যা দেখে লজ্জা পায়।

মানিব্যাগ লুফবে, না গজাননকে রুখবে? শূন্য পথে ধেয়ে আসছে যে দুটোই। চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতেই ভ্যাবাচ্যাকা আগন্তুকের ঘাড়ের ওপর গিয়ে পড়ল গজানন, তারপর গোঁ-গোঁ একটা আওয়াজ শোনা গেল।

নেতিয়ে পড়ে কাতরাচ্ছে লোকটা। হাত-টাত ভেঙে দিল নাকি গজানো? গুণের তো শেষ নেই তোমার। রাগলে চণ্ডাল! উন্মাদ। কী করছ তখন আর খেয়াল থাকে না।

দ্বিতীয় লুঠেরাটা মহা ধড়িবাজ তো! ধরাশায়ী দোস্তের বুকের ওপর থেকে গজাননদা উঠে দাঁড়াতে-না-দাঁড়াতেই তীরের মতো ছুটে এসে অন্ধকারেই ছোঁ মেরে মাটি থেকে কী তুলে নিয়ে ভো দৌড় দিল অন্ধকারে।

কাওয়ার্ড! দুটো মার খেয়ে গেলি না গ্রেট গজাননের হাতে? বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দিত।

একী! গজাননদা আমার মানিব্যাগ বলে অন্ধকারে বিলীয়মান মূর্তিটার পেছনে তেড়ে যেতেই ভুলুণ্ঠিত আহত লোকটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

রাম! রাম! এত ভীতু! জিরো জিরোর আসল খেল না দেখেই চম্পট দিলি! এখনও তো তার অ্যাসিস্ট্যান্ট নামেনি আসরে। নরম হাতের গরম ধোলাইয়ে পিত্তি ছরকুটে যেত তোদের!

বোরখাটা পরে দিল পুঁতিবালা। বডি খেলানোর যাও-বা একটা চান্স পাওয়া গেল মিল্ড হয়ে গেল।

গজানো ফিরে আসছে। পলাতকদের পালাতে দিয়ে ফিরে আসছে।

অন্ধকারে গা-ঢাকা দিল পুঁতিবালা।

দরজা খুলে গেমরুমে ঢুকে গেল গ্রেট গজানন। কিছুক্ষণ পরে ঢুকল পুঁতিবালা। কিন্তু গজাননকে দেখতে পেল না।

বেরিয়ে এল সামনের দরজা দিয়ে। ওই তো করিডোরের মোড় ঘুরে হোটেল অফিসের দিকে যাচ্ছে গজানো।

যাক। মানিব্যাগের জন্যে হাল্লাক হয়ে মরুক। যাচ্ছে তো নালিশ ঠুকতে। পুলিশকে খবর দেবে কি?

.

৪.

দিতেও পারে। দাদার প্ল্যানটা ঠিক বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। কিঙ-য়ের শহরে পা দিতে না দিতেই এই যে হামলা, একি শুধু মানিব্যাগের লোভে?

মনে তো হয় না।

আড়াল থেকে সব দেখল পুঁতিবালা। অফিস থেকে পুলিশ অফিসেই টেলিফোন করল গজানো। তারপর গটগট করে লিফটে চড়ল। পুঁতিবালাও উঠল লিফটে। আড়চোখে তাকে একবার দেখে নিল গজানন। কটমটে চাহনি দেখে মনে-মনে হেসে কুটিপাটি হল পুঁতিবালা। লিফট থেকে সটান নিজের ঘরে ঢুকল গ্রেট গজানন। পুঁতিবালা নিশ্চিন্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল একতলায়। সেখান থেকে পাতাল ঘরের গেমরুমে।

আসল গেমটাই যে এখনও খেলা হয়নি।

কদমছাঁট এবার তাকে দেখেই একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে শুধু বললে–আবার?

কী আবার? প্রচণ্ড মুখ ঝামটানি দেয় পুঁতিবালা সার্চ হবে নাকি আবার?

না, না, না, না, বলতে-বলতে দরজা খুলে ধরে পাংশু মুখে বললে কদমছাঁট–যান।

যাব তো বটেই, কিন্তু বোরখাটা রইল এখানে। যাওয়ার সময়ে নিয়ে যাব, কেমন?

–বলেই বোরখা খোলা হয়ে গেল পুঁতিবালার। ছোট্ট চেম্বারে পুঁটলি পাকিয়ে ফেলে ঝ করে ঢুকে পড়ল গেমরুমে।

সত্যিই! শেষ নেই ওই আদিম নাচের! এখনও মঞ্চে চলছে সেই একই উদোম লীলা। জঘন্য!

ওভাবে পুরুষ মজাতে সবাই পারে। পারবি পুঁতিবালার মতো? এই দ্যাখ!

কটিতে আর বক্ষদেশে যার সামান্যতম বস্ত্রের আবরণ, এহেন লাস্যময়ীর দিকে মুনি ঋষিরও দৃষ্টি চলে যায়। পুঁতিবালাও চুম্বকের মতো ঘরসুদ্ধ লোকের নজর কেড়ে নিল চক্ষের নিমেষে।

কিন্তু পুঁতিবালার নজর কাড়ল কে?

একজন পুলিশ অফিসার। বয়েস চল্লিশের ওপরে। সেই কারণেই শিকার ভালো।

তাছাড়া পুলিশের লোক। হাতে রাখা দরকার।

বার কাউন্টারে হাতে স্কচ হুইস্কি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ব্রোঞ্জ মূর্তির মতো সেই অফিসার। বেশ চেহারা। পছন্দ হয় পুঁতিবালার।

চোখে-চোখে আমন্ত্রণ বিনিময় হয়ে যায় তৎক্ষণাৎ। কাছে এগিয়ে যায় পুঁতিবালা।

এক গেলাস জিন উইথ লাইম অ্যান্ড বিটার চেয়ে নিয়ে চুমুক দিয়ে চোখ রাখে পুলিশ অফিসারের চোখের ওপর।

নেশা জড়ানো চোখ নয়। বেশ হুঁশিয়ার। কর্তব্যেনিরত নিঃসন্দেহে।

গেলাসটা চোখের সামনে তুলে ধরে মদিরার ফিকে হলুদ রংটা দেখতে-দেখতে যেন আপনমনেই বলে পুঁতিবালা–আমার নাম রাজিয়া সুলতানা। আজ এসেছি। তিনশো দু-নম্বর ঘর। একা। সঙ্গ পেলে বাঁচি।

যাচ্ছি, বলে গেলাসটা এক চুমুকে শেষ করে দিল পুলিশ অফিসার। খর নজর কিন্তু পুঁতিবালার ওপর।–আমার নাম আমিনুল হক। ডি আই জি। চলুন।

এক চুমুকে গেলাস শেষ করে দিয়ে কাউন্টারে রুম নাম্বারটা বলে দিল পুঁতিবালা। পেমেন্ট হবে বিলে। বডি খেলানোর সুযোগটাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর উদগ্র অভিপ্রায় নিয়ে অগ্রসর হল দরজার দিকে।

ছোট্ট কোর্টশিপ। পাঠক-পাঠিকারা ক্ষমা করবেন। পুঁতিবালার মতো মেয়েরা এসব মামুলি ব্যাপারে নাহক সময় খরচ করতে রাজি নয়।

.

পরের দিন ডি আই জি আমিনুল হকের সামনে এসে বসল গ্রেট গজানন।

বলল–আমিই ফোন করেছিলাম আপনাকে। আমার মানিব্যাগ চুরি গেছে কাল রাতে।

গম্ভীর গলায় বললে, ব্রোঞ্জ মূর্তি–হোটেল অফিস থেকেও কমপ্লেন এসেছে। কিন্তু আপনি হোটেলের পেছনে গেছিলেন কেন?

ব্যক্তিগত ব্যাপার।

মৃদু কঠিন হাসল, ব্রোঞ্জ মূর্তি–তাহলে আপনার মানিব্যাগ খোয়া যাওয়ার ব্যাপারটাকেও ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে ধরতে পারেন। সরি, আপনি আসতে পারেন।

গ্রেট গজাননের মাথায় চড়াত করে রক্ত উঠে গেল কথাটা শুনেই। তারপরের কথাটা শুনেই কিন্তু রক্ত নেমে গেল মুখ থেকে।

কেটে-কেটে বললে, ব্রোঞ্জ মূর্তি–জিরো জিরো গজানন, ছেষট্টি পাউন্ডের অর্ধেক যদি আমাকে দিয়ে যান, তাহলে আপনাকে হেল্প করতে পারি।

কিছুক্ষণ সব চুপ। চোখে-চোখে চেয়ে দুই বড় খেলোয়াড়।

তারপর আশ্চর্য শান্তগলায় বললে গজানন—

সব জানেন?

জানাটাই আমার কাজ।

কিঙয়ের ঠিকানা?

এখনও জানি না। তবে জানতে পারব। আপনার পেছনে লেগে থাকলেই জানতে পারব। কেননা, কিঙ আপনার পেছনে লেগেছে।

এত তাড়াতাড়ি?

তাই তার নাম কিঙ। আপনার নিস্তার নেই, গ্রেট গজানন। মরবেনই। হয় তার হাতে, আর না হয়–একটু থেমে খুব আলতোভাবে–আমার হাতে।

চেয়ে রইল গজানন। সর্ষের মধ্যেই ভূত থাকে–সুতরাং তার চোখের পাতা কাঁপল না।

বললে, ছেষট্টি পাউন্ডের অর্ধেক দেব না। দশ পাউন্ড বড় জোর।

তেত্রিশ পাউন্ড।

না। তাহলে আগে পুঁতিবালার নাচ দেখবার জন্যে তৈরি হোন।

পুঁতিবালা। এবার কিন্তু আর চমকানি আটকাতে পারে না গজানন–সে কোথায়?

এখন বলা যাবে না। তেত্রিশ পাউন্ড।

বিশ পাউন্ড।

তেত্রিশ পাউন্ড।

ও-কে, ও-কে। রাজি। পুঁতিবালা কোথায়?

এখন বলা যাবে না।

কিঙ কোথায়?

আগে বলুন হোটেলের পেছনে কেন গেছিলেন?

এক মহিলার আমন্ত্রণে।

কী নাম তার? কীরকম দেখতে?

খুব কালো। দারুণ স্মার্ট। বিউটিফুল ফিগার। হেরোইনের নেশা আছে। তাই তার সঙ্গ ধরেছিলাম।

খুব কালো! দারুণ স্মার্ট। বিউটিফুল ফিগার! হেরোইনের নেশা আছে! নাম কী বলেছিল?

মমতাজ সিরাজ!

বিসমিল্লা।

চেনেন?

আপনি যে হোটেলে উঠেছেন, তার মালিকের বেগম।

জয় মা কালী!

গ্রেট গজানন।

জিরো জিরো গজানন।

ইয়েস, ইয়েস, আপনি আজ রাতে আবার গেমরুমে যাবেন?

সে কি আর আসবে?

দেখা যাক।

তা এল বইকী মমতাজ। স্বপ্নিল চোখে হেরোইনের আভাস ফুটিয়ে সে আবার আমন্ত্রণ করল গজাননকে। গতরাতের ঘটনা প্রসঙ্গে শুধু বললে, ভয়ে পালিয়ে গেছিলাম, মিঃ ওয়ান্ডারম্যান!

অন্ধকারের উৎপাতদের আমার বড় ভয়।

কাজেই মমতাজের গাড়ি চেপে গজানন গেল শহর থেকে দূরে নিরালা একতলা বাড়িটায়।

পুঁতিবালা তখন কোথায়?

ফাইভ স্টার হোটেলে অন্তত নেই। ব্রোঞ্জ মূর্তি যখন একটু ঘুমিয়ে ছিল, তখন ঘুমের ঘোরে সে উচ্চারণ করেছিল শুধু একটি কথা–পুঁতিবালা, মার্ভেলাস!

ব্যস, ভোর হতেই বিদেয় হল পুলিশ অফিসার। তারপর হাওয়া হয়ে গেল পুঁতিবালা।

.

হে পাঠক! হে পাঠিকা! আসুন এবার গজাননের পেছনে। দেখুন তার আজব কীর্তি।

মমতাজ গাড়ি চালায় ভালো। বাংলাদেশে বিলিতি গাড়ির ছড়াছড়ি এখন। মমতাজের গাড়ি নির্মিত জাপান দেশে। টয়োটা।

দরজা খুলে প্রথমে গজানন উঠেছিল ভেতরে। উঠেই দেখে নিয়েছিল সিটের তলায় খাঁজের মধ্যে, পয়েন্ট থ্রি এইট স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন রিভলভারটা গোঁজা আছে কিনা।

আছে। নিশ্চিন্ত হয়েছিল গজানন। এ কাজটা তাকে করতে হয়েছে মমতাজের অজান্তে। গেমরুমে রিভলভার নিয়ে ঢোকা অনুচিত। ধরা পড়ে যেতে পারে। তাই টয়লেটে ঘুরে আসার নাম করে সটান গেছিল নিজের ঘরে। রিভলভারটা নিয়েই দৌড়ে গেছিল হোটেলের পেছন দিকে– যেখানে আছে মমতাজের গাড়ি। গাড়িটা কী ধরনের গত রাতেই তা দেখে রেখেছিল গ্রেট গজানন। দরজায় চাবি লাগানোর অভ্যেস নেই মমতাজের, তাও লক্ষ করেছিল চকিতে। দুই আততায়ী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে মমতাজ ছুটে গিয়ে এক ঝটকায় দরজা খুলে উঠে বসেছিল সিটে–সবই দেখেছে জিরো জিরো। তাই রিভলভার লুকিয়ে রাখার প্ল্যানটা আগে থেকেই রেখেছিল মগজের মধ্যে।

নিজে যে সিটে বসবে এখুনি, সেই সিটের তলায় রিভলভার আর কিছু বাড়তি বুলেট রেখে অন্ধকারেই ফের মিশে গেছিল গজানন। ফিরে এসেছিল গেমরুমে।

তারপর সেই একই কথার চর্বিতচর্বণ। একই কথার ছেনালিপনা। একই কথা নিয়ে ঢলাঢলি। উস্কে দিয়েছে গজানন এবারে। মমতাজ সে রাতে ডিপ ব্লু শাড়ি পরেছে। খুবই মিহি শাড়ি। অত্যন্ত হালকা। তার আশ্চর্য কালো তনু ঘিরে গাঢ় নীল বসন আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে যৌনতাকে। হেরোইন সেবন কি আজ মাত্রা ছাড়িয়েছে? যেন একটু বেশি বকছে মমতাজ। একটু যেন বেশি প্রগলভা। ক্ষণে-ক্ষণে গজাননের গায়ে গা দিচ্ছে, গালে গাল ঠেকাচ্ছে, চোখের সঙ্কুচিত তারা কাম টু-দ্য-বেড় আমন্ত্রণ জানিয়ে চলেছে।

গজানন ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুমান করেছে, অভিযান পৌঁছেছে সম্ভবত অন্তিম পর্বে। আমিনুল হক নামধারী পুলিশ অফিসার যখন হিরোইন কারবারে লিপ্ত এবং কিঙয়ের হদিশ জানতে আগ্রহী–তখন হোটেল মালিকের ব্যাভিচারিণী বউকে নিয়ে তার নিরালা আলয়ে গেলে প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়তে পারে।

প্রাণ দিতে প্রস্তুত গজানন। মেন্টাল ক্লিনিকের ডাক্তারবাবু শাঁখের আওয়াজের মতো গলাবাজি করে তাকে বলেছিলেন–গজানন, দেশের জন্যে তোমার ট্যালেন্টকে কাজে লাগিও নিজের জন্যে নয়।

গজানন আজ তাই এক্কেবারে বেপরোয়া। যে নরাধমরা হেরোইন প্রবেশ করাচ্ছে, ইন্ডিয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, যুবসমাজকে মেরুদণ্ডহীন করে ছাড়ছে তাদের পালের গোদাকে সে জবাই করবে নিজের হাতে। একটার পর একটা খুন করে যাবে। সে যে রেগেছে, তার প্রমাণ রেখে দেবে রক্তগঙ্গার মধ্যে। যদি নিজের রক্তও মিশে যায় তার মধ্যে মিশুক। কেউ তো কাঁদবে না। এক-আধফোঁটা চোখের জল হয়তো ফেলত পুঁতিবালা, সে ছুঁড়িও তো নিপাত্তা। কেনই বা এসেছিল পেছন-পেছন। আমিনুল যদি তাকে কবজা করে থাকে তাহলে সর্বনাশ।

গজানন সে চেষ্টাও করবে বলে ঠিক করেছিল, আমিনুলের কাছ থেকে ঠিকানা বের করবেই পুঁতিবালার।

কিন্তু তার আর দরকার হয়নি।

পুলিশ অফিস থেকে ফিরে হোটেলে ঢুকতে যাচ্ছিল গজানন–আজই সকালবেলা। গাড়ি পার্ক করার জায়গায় ঝাড়ন হাতে দাঁড়িয়েছিল একটা ছেলে। ময়লা গাড়ি ঘষে সাফ করে দেয়। বিনিময়ে নেয় সামান্য দক্ষিণা।

গজানন গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই ছেলেটা একগাল হেসে দাঁড়াল সামনে।

হাসি দেখে পিত্তি জ্বলে গেছিল গজাননের কী চাই? গাড়ি মুছতে হবে না।

নীরবে একটা চিরকুট এগিয়ে দিয়েছিল ছোকরা। তাতে মেয়েলি হাতে লেখা–দাদা গো দাদা মমতাজকে নিয়ে কাদা! আমিনুলকে সাবধান–সে জানে তোমার নামধাম!

ছড়া পড়েই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল গ্রেট গজানন। ছড়া লেখা হচ্ছে! ছড়া লেখবার সময় এটা! ফাজিল ভেঁপো মেয়ে কোথাকার! কোথায় একটু পাশে এসে দাঁড়াবে, তা না আড়ালে টিটকিরি দিচ্ছে মমতাজকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করা হচ্ছে বলে। বেশ করছে গজানন, আলবত করবে, একশোবার করবে। তুই পুঁতিবালা, তুই কি কম যাস? কাজের ফিকিরে যত অকাজ আছে–সবই তো করিস। গজানন না হয় দেশের জন্যে, দশের জন্যে মমতাজকে নিয়ে একটু খেলবে।

কিন্তু কোথায় গেল ফচকে মেয়েটা? চোখ পাকিয়ে ছোকরাকে শুধোয় গজানন–চিঠি কার কাছে পেলি?

ওই তো ওখানে দাঁড়িয়ে…যাঃ! চলে গেছে। আপনাকে তো চিনিয়ে দিল।

ননসেন্স! বলে হনহন করে হোটেলে ঢুকে গেছিল গজানন। নিশ্চিন্ত হয়েছিল অবশ্য পুঁতিবালার ব্যাপারে। আমিনুল তার টিকি ধরতে পারেনি নিশ্চয়। স্রেফ হুমকি দিয়েছিল গজাননকে।

পুঁতিবালা এই মুহূর্তে স্বাধীন। ও মেয়ে সব করতে পারে। ওর কাছে বিদেশের মাটি আর স্বদেশের মাটির মধ্যে কোনও তফাত নেই। ও জানে শুধু পুরুষ মানুষ আর নিজের বডির যাদুশক্তি। ভক্তি-শ্রদ্ধা, এমনকী একটু ভয়ও করে বটে–এই দাদাটিকে। গজাননদার অকল্যাণ হবে জানবে তা রুখতে দুনিয়ার হেন অপকর্ম নেই–যা ওর অসাধ্য।

মমতাজ চালিত টয়োটায় বসে এইসব কথাগুলোই আর একবার ভেবে নিল গজানন। অ্যাসিস্ট্যান্ট একটা বানিয়েছিল বটে। গুরুকেও বোকা বানায়। বেপারীটোলা লেনে যদি জান নিয়ে ফিরতে পারে, কান ধরে এমন একটা চড় লাগাবে…।

ব্যাকভিউ আয়নায় দেখা গেল একটি গাড়ির সাইডলাইট। বেশ দূরত্ব বজায় রেখে আসছে গাড়িটা। ফলো করছে কে? আমিনুল না পুঁতিবালা? গেমরুমে আজকে ব্রোঞ্জমূর্তিটাকে দেখা যায়নি। তাই বলে গজাননকেও নিশ্চয় নজর ছাড়া করেনি। হেরোইন কিঙের ঠিকানার লোভে হয়তো আসছে। পেছন-পেছন।

গজানন যদি দুরদর্শনের শক্তি লাভ করত সেই মুহূর্তে, তাহলে অবশ্য দেখতে পেত অন্য দৃশ্য।

চুপি-চুপি গাড়ি চালিয়ে আসছে তারই সাকরেদ পুঁতিবালা!

আমিনুল হক ওঁৎ পেতে আছে বনানীর মধ্যে সেই নিভৃত আলয়ে–যেখানে বৃন্দাবনলীলা চলেছে প্রতি রাতে। মমতাজ সুন্দরী যেখানকার অকথ্য নায়িকা।

গাড়ি চালাচ্ছে এই অতৃপ্ত কামনাময়ী। শ্যাম্পু করা ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুল উড়ছে হাওয়ায়। সারি-সারি মিটার থেকে বিচ্ছুরিত আলো পড়েছে তার চিবুকের নিচ থেকে ওপরের দিকে। আলো আর ছায়ায় নিখুঁত কালো মুখটা অপরূপ শুধু নয়, আশ্চর্য লাবণ্যে ভরা বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু পাতলা কাজল ছাওয়া চোখে সে যখন মদির কটাক্ষ হানছে, ঈষৎ স্ফীত নাসারন্ধ্র আর উত্তাল বুকে অবদমিত বাসনাকে জাগ্রত করছে–তখন আর শুধু তাকিয়ে দেখা যায় না তাকে…ইচ্ছে যায়…

ইচ্ছে যায়…

এই প্রবল ইচ্ছেটাকেই প্রবলতম সংযম দিয়ে রুখতে রুখতে চলেছে বেচারা গজানন। খাই খাই মেয়েমানুষদের সামাল দেওয়া যে কঠিন হাড়ে হাড়ে তা মালুম হচ্ছে। একে তো ব্যাচেলার তার ওপর লেডি কিলারদের পাঠশালাতেই পড়েনি। সুতরাং নিজেকে সামলে রাখতে গিয়ে মাথা গরম করে ফেলছে। মাথা গরম হয়ে গেলেই ভায়োলেন্ট হতে ইচ্ছে যাচ্ছে। তাতেও তো সুস্থ বোধ করে গজানন। ভগবান কেন যে মেয়েমানুষ জাতটাকে সৃষ্টি করেছিল। দূর। দূর!

বনের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে গাড়িটা চলেছে কোথায়? সতর্ক হয় গজানন।

ভুজঙ্গিনী ভঙ্গিমায় ঘাড় বেঁকায় মমতাজভয় করছে, মিঃ ওয়ান্ডারম্যান?

না। ভাবছি, এতটা পথ আপনিই আবার ড্রাইভ করে হোটেলে ছেড়ে দিয়ে আসবেন তো?

অসুবিধে নেই। রাত জাগার অভ্যেস আছে আমার।

আমার নেই।

একরাশ কাঁচের বাসন ভেঙে গেল যেন। বাব্বা। কি হাসি। বুক ছলাৎ করে ওঠে।

গাড়িটাও ব্রেক কষল সঙ্গে-সঙ্গে–আসুন মিঃ ওয়ান্ডারম্যান, এই আমার কুটির।

গাড়ি থেকে নেমে তাকিয়ে দেখল গজানন। চারপাশে বড়-বড় গাছ। মাঝে একটু ফাঁকা জায়গা। তার মাঝে একতলা বাড়ি। একদম সাদা। ঠিক যেন ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবি।

অন্ধকার যে, মৃদুস্বরে বলে গজানন ইলেকট্রিসিটি নেই?

জেনারেটর আছে। চলুন।

নুড়ি মাড়িয়ে গেট খুলে মমতাজ সুন্দরী গেল আগে-আগে-পেছনে অতি হুঁশিয়ার গজানন। চোখ ঘুরছে ডাইনে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে। যে-কোনও মুহূর্তে একটা বুলেট উড়ে আসতে পারে– গজাননের ভবলীলা সাঙ্গ হতে পারে। বনেবাদাড়ে কে আসছে খোঁজ করতে?

গজানন না জানলেও যে আসবার সে ঠিক এসে গেছিল।

পুঁতিবালা। দূরে গাড়ি রেখে বনের মধ্যে দিয়ে নিঃশব্দ সঞ্চারে ছুটেও এসেছিল। আর…

সতর্ক চাহনি মেলেও গ্রেট গজানন যাকে দেখতে পায়নি তাকে ও দেখেছিল।

আমিনুল হক। সেই ব্রোঞ্জ মূর্তি। অন্ধকারেই চিনেছে পুঁতিবালা। অন্ধকারেই তো চিনবে। অন্ধকারেই তো মানুষ চেনা যায়। অন্তত পুঁতিবালারা চিনতে পারে।

তাই আমিনুল হকের পেটাই মুখাবয়ব দেখেই গা শিরশির করে উঠেছিল পুঁতিবালার। ভয়ে নয়,–রোমাঞ্চে। সুখকর স্মৃতির রোমাঞ্চে!

দূর থেকে চোখ রাখল দুই পুরুষের ওপর। গজানন আর আমিনুল। কালো কষ্টিপাথরটাকে অত না দেখলেও চলবে। হারামজাদী ভুলিয়ে ভালিয়ে ঠিক নিয়ে এসেছে জিরো জিরোকে। শয়তানি ঢলানি! ফুলে-ফুলে মধু খাও বলে গজাননদাকে ধরে পার পেয়ে যাবে ভেবেছ?

আর গজাননদা, তোমাকেও বলিহারি যাই। হেরোইন অন্বেষণে এসে মানবী-হেরোইনের ফাঁদে ধরা পড়লে। ও রাক্ষসী তোমাকে যে গিলে ফেলবে।

তবে হ্যাঁ, পুঁতিবালা যখন এসে গেছে–

আলো জ্বলে উঠেছে বাংলোবাড়িটায়। জেনারেটরের আওয়াজ হচ্ছে। আলো জ্বলছে শুধু একতলার ঘরটায়। আমিনুল হক গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছে আলোকিত জানলার দিকে।

মরণ আর কী! উঁকি মেরে দেখার শখ হয়েছে। কাল রাতেও কি শখ মেটেনি। মুখে ঝাড় তোমার…

গজানন আর মমতাজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। হেরোইনের নেশা বেশ চেপে বসেছে সুন্দরীর মগজে। চোখের আবেশ অতন্দ্র সমুদ্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কালো সমুদ্র।

হুঁশিয়ার হয়েছে গজানন। এ মেয়ে এই মুহূর্তে সব করতে পারে।

স্খলিত শাড়ির দিকে নজর নেই মমতাজের। কাঁধের ওপর থেকে কোনওকালে আঁচল খসে পড়ে লুটোচ্ছে পায়ের কাছে। পীবর বুক মিশিয়ে দিয়েছে গজাননের কপাট বুকে। দুই হাত তার গজাননের দুই কাঁধে। ঠোঁট উঁচিয়ে ধরেছে গজাননের ঠোঁটের কাছে। চোখের তারায় আকুল আমন্ত্রণ।

কিস মি, ওয়ান্ডারম্যান, কিস মি। গলার মধ্যে ঝোড়ো হাওয়ার চাপা হাহাকার।

গজাননকে এখন একটু অ্যাকটিং করতে হবে। উপায় নেই। এই একটি সূত্র ধরেই তাকে এগোতে হচ্ছে। এখানে না হলে অন্যত্র চেষ্টা চালাবে।

মমতাজ, উত্তমকুমার ঢঙে বললে গজানন। কণ্ঠস্বরটা বেশ গুরুগম্ভীর শোনাচ্ছে। বটে।

হোসেন সাব।

জানি। সাদা গুঁড়ো চাখবে।

আছে–সামান্য।

সামান্য কেন?

আমার কাছে তো থাকে না।

তবে কার কাছে থাকে?

সোজা জবাব দিতে গিয়েও কথা ঘুরিয়ে নিল মমতাজ–

তার কাছ থেকে নিয়ে আসতে হয়। না গিয়েও পারি না। নেশা ধরিয়েছে সে–চালান দেবেও সে–বিনিময়ে নেবে আমার সর্বস্ব।

সে কে?

সে কে? অদ্ভুত হাসি ফুটে ওঠে–সে আমার সব।

নাটক রাখো মমতাজ, সামান্য কড়া হয় গজানন–আমি যদি নেশায় পড়ি–পড়তেই তো চাই-ব্যাচেলারের একটা নেশা তো চাই। তখন কে জোগান দেবে আমাকে?

আমি, নিবিড় হয় মমতাজের বাহুবন্ধন। আমি তো জানি। আমার মধ্যে থেকেই তুমি পাবে সব সুখ, সব শান্তি, সব নেশা।

যদি সে চালান বন্ধ করে দেয়?

তোমাকে দিলেও আমাকে না দিয়ে পারবে না। মমতাজের গলার স্বর ক্রমশ আরও মথিত হচ্ছে। চোখের তারায় অমানিশা গাঢ়তর হচ্ছে!

স্বর তীব্র করে গজানন–কেন, তুমি কি তার হাতের পুতুল?

একরকম তাই। নাও, স্টার্ট।…

হাত দিয়ে মমতাজের চিবুক ঠেলে সরিয়ে দিল গজানন–তোমার মতো ব্ল্যাক বিউটিকে হাতের পুতুল করতে পারে–সে কে?

সে যে আমার গড, এক হাত গজাননের কাঁধ থেকে নামিয়ে নিজের শাড়ি ধরে মমতাজ। শক্ত মুঠিতে হাতের কবজি চেপে ধরে গ্রেট গজানন।

তোমার গড তো একজনই–তোমার স্বামী।

গডফাদার…গডফাদার–

ঠিক এই সময়ে ঝপ করে নিভে গেল ঘরের আলো। স্তব্ধ হল জেনারেটরের শব্দ। সবলে গজাননকে জাপটে ধরে জড়িত ভয়ার্ত স্বরে মমতাজ বলে উঠল–নুরুল হাসান এসে গেছে। ও গড।…

সে কী আলিঙ্গন। অন্ধকারে ঝটাপটি। নাগিনীর বাহুপাশ থেকে মুক্তি পাওয়ার আপ্রাণ প্রয়াস। এরই মাঝে ঘটে গেল অঘটন।

মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল গজাননের। জ্ঞান হারাল সঙ্গে-সঙ্গে।

জ্ঞান ফিরে পেয়ে গজানন দেখল, আমিনুল হকের ব্রোঞ্জ মূর্তি ঝুঁকে রয়েছে তার ওপর। গজানন চোখ মেলতেই সরে গিয়ে বসল একটা চেয়ারে। হাতে রিভলভার।

গজানন পড়ে মেঝেতে। মাথার ওপর জ্বলছে আলো, আওয়াজ শোনা যাচ্ছে জেনারেটরের।

গজানন বললে, কী ইয়ার্কি হচ্ছে? মাথায় মারল কে? আপনি?

হাতের রিভলভারের কুঁদো দেখাল আমিনুল-মুখে কিছু বলল না।

গজানন বললে, ভারি চোয়াড়ে লোক তো আপনি। অমনি করে মাথায় মারে? ভাগ্যিস একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেছিলামনইলে দেখতেন খেলাটা।

মাথায় চোট পড়লেই বুঝি আপনি খেলেন ভালো? ত্রুর হেসে বলল ব্রোঞ্জ মূর্তি।

লোকে তাই বলে। তখন আমার আর কিছু মনেই থাকে না।

বটে! বটে! মাথায় চোট পড়লে আর কিছু মনে থাকে না। তাই না?

তাই তো বললাম, মিঃ ফোর টোয়েন্টি।

ফোর টোয়েন্টি। আমি?

তা ছাড়া আর কে?

মমতাজ মাথায় চোট মেরেছিল নাকি?

না তো…।

নিশ্চয় মেরেছিল। তারপর আর কী করেছেন, মনে নেই।

কী করেছি? কী মনে নেই? শঙ্কিত হয় গজানন। মেন্টাল ক্লিনিক থেকে বেরোনোর পর ইস্তক এমন অঘটন তো আকছার ঘটছে। না জানি কী করে ফেলল এখানে। অন্ধকারে ঝটাপটির সময়ে অবশ্য হাত চালিয়েছিল গজানন–মমতাজও কী হাত চালিয়েছিল? মাথায় কি মেরেছিল?

গুলগুল চোখে তাকায় গজানন–কী হয়েছে বলুন তো?

জানেন না?

এক্কেবারে না?

লায়ার! মিথ্যুক! উঠে পড়ুন। বেচাল দেখলেই গুলি চালাব। ক্র্যাকশট আমিনুল হক নটা মেডেল পেয়েছে গুলি চালানোয়–খেয়াল থাকে যেন।

থাকবে, থাকবে, ভূমিশয্যা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললে গজানন কী করে ফেলেছি, আগে দেখান।

পাশের ঘরের দরজা খোলা আছে। চৌকাঠ থেকে দেখুন, ভেতরে ঢুকবেন না।

তিন পা যেতেই পাশের ঘরের দরজা। উঁকি মারবারও দরকার হল না। বীভৎস দৃশ্যটা অতিশয় প্রকট দরজার বাইরে থেকেই।

মেঝে থেকে ইঞ্চি ছয়েক উঁচু একটা লাল রঙের ডিভান জাতীয় মখমল শয্যা। তার ওপর চিৎপাত হয়ে শুয়ে মমতাজ। দু-পা দু-পাশে ছড়ানো। চোখের তারা ভোলা।

ডিপ ব্লু শাড়িটা দিয়ে তার দেহটাকে ঢাকা দেওয়া হয়েছে। স্পষ্টত ওই আবরণ ছাড়া তার দেহে আর কোনও আবরণ নেই।

শিউরে ওঠে গজাননের মতো মানুষও। এই তো কিছুক্ষণ আগে প্রাণস্পন্দনে স্পন্দিত ছিল ছন্দমাধুরীতে ভরা ওই দেহটা।

এইটুকু সময়ের মধ্যে প্রাণপাখি উড়ে গেল দেহপিঞ্জর ছেড়ে। কীভাবে? কেন?

অনুক্ত প্রশ্নের জবাবটা এল পেছন থেকে ধর্ষণ এবং মৃত্যু। জিরো জিরো গজানন, এই একটা চার্জেই আপনাকে আমি ফাসাব।

আস্তে-আস্তে ঘুরে দাঁড়াল গজানন। চোখমুখ হাত-পা সব প্রশান্ত।

আমি করেছি?

প্রত্যক্ষ প্রমাণ আদালতে হাজির করব।

তেত্রিশ পাউন্ড পেলেও?

পথে আসুন। কিঙ-এর ঠিকানা?

জানি না।

নির্নিমেষে চেয়ে রইল ব্রোঞ্জ মূর্তি ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখেছি মানিব্যাগের মধ্যে।

মানিব্যাগ পেয়েছেন?

কথার জবাব দিল না ব্রোঞ্জ মূর্তি–গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে চলুন।

টয়োটা?

হ্যাঁ।

চলুন।

জেনারেটর নিভিয়ে দিয়ে গজাননের পেছন-পেছন বেরিয়ে এল আমিনুল হক। জিরো জিরো বোকা নয়। ক্র্যাকশট এবং নটা মেডেল পাওয়া বন্দুকবাজের সঙ্গে চ্যাংড়ামি করতে যাওয়া হঠকারিতা, তা কি সে জানে না!

তা ছাড়া, টয়োটার সিটের তলায় আছে তার পয়েন্ট থ্রি এইট। সিটটায় আগে বসতে হবে, তারপর…

বাড়ি এখন অন্ধকার। টয়োটার পেছনের সিটে আগে উঠে বসল আমিনুল হক। তারপর রিভলভার নির্দেশে সামনের সিটে ওঠাল গজাননকে। দুহাত মাথার ওপর তুলে বসল স্টিয়ারিং হুইলের সামনে। কলের পুতুলের মতো আমিনুলের হুকুম তামিল করে গাড়ি বের করে আনল বনের মধ্যে থেকে। হাইওয়েতে উঠে গাড়ি যখন স্পিড় নিয়েছে, তখন পেছন থেকে বললে আমিনুল-মমতাজের লাশের কাছাকাছি আপনার লাশ ফেলাটা ঠিক হত না। ঘরের মধ্যে রক্ত ছড়াতেও চাইনি। এবার তৈরি হতে পারেন।

আমার অপরাধ। তৈরি হয়েই বললে গজানন। তবে সে তৈরিটা কী ধরনের, আমিনুল যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারত…

কুকর্মের সঙ্গী রাখতে নেই, জানেন তো?

ভালো করেই জানি। আমিও একা অপারেট করি।

এবার একাই বেহেস্তে যান। জাহান্নমেও যেতে পারেন।

আমার অপরাধ?

মমতাজকে ধর্ষণ এবং হত্যা।

মিথ্যে কথা।

হেরোইন স্মাগলিংয়ে আপনিও অংশীদার। কিংয়ের ঠিকানা জেনেই আপনি এসেছেন—

মিথ্যে কথা।

মমতাজও সে ঠিকানা জানত বলে আপনি তাকে খুন করেছেন।

এবার এক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে প্রশ্ন করল গজানন–মমতাজ জানত ঠিকানাটা?

আলবত জানত।

আপনিই তাকে ধর্ষণ করেছেন এবং খুন করেছেন–পেট থেকে ঠিকানাটা জেনে নিয়েই–

এতগুলো কথা লিখতে যতটা সময় গেল, তার চাইতে অনেক কম সময়ে ঘটে গেল অনেকগুলো ঘটনা।

আচমকা ছোট্ট ব্রেক কষল গজানন। আমিনুলের রিভলভারের নলচে ঠেকানো ছিল তার মাথার পেছনে। সামান্য হুমড়ি খেল আমিনুল। নলচে সরে গেল লক্ষ্য থেকে। গজানন এক হাত দিয়ে রিভলভারসুদ্ধ কবজি চেপে ধরল অমানুষিক শক্তি দিয়ে (মাথায় চোট বৃথা যায়নি)–আর এক হাত দিয়ে সিটের তলা থেকে পয়েন্ট থ্রি এইট বের করে সটান গুলি করল আমিনুলের রগ লক্ষ্য করে।

স্টিয়ারিং হুইল ছাড়া গাড়ি তখন এলোমেলোভাবে ছুটছে, পথ থেকে নেমে পড়ছে। একটা গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা মেরে উলটে গেছে।

হাঁচোড়-পাঁচোড় করে জিরো জিরো বেরিয়ে এল ভাঙা দরজার প্রচণ্ড লাথি কষিয়ে। ভাঙা কাঁচে কপাল কেটে রক্ত পড়ছে। স্টিয়ারিং হুইল বুকে চেপে বসে পাঁজরা গুঁড়িয়ে দেয়নি, এই রক্ষে।

কাঁচ করে একটা গাড়ি ব্রেক কষল পাশে।

থাক, থাক, রিভলভার আর লুকোতে হবে না! এই তো মুরোদ! আমি না থাকলে এতটা পথ যেতে কী করে! নাও, উঠে বসো।

পুঁতিবালা! ডিসিপ্লিন ব্রেক করেছিস। কে তোকে এখানে আসতে বলেছে? তোর চাকরি আর নেই।

নেই তো নেই। ঝটপট উঠে বসো। কে কোন দিক দিয়ে এসে পড়বে। এটা হাইওয়ে।

সুবোধ বালক হয়ে গেল গ্রেট গজানন। গাড়ি উড়ে চলল ফাঁকা রাস্তা বেয়ে। পুঁতিবালার এলো চুল লেপটে যাচ্ছে চোখেমুখে। আজ সে এসেছে রণরঙ্গিনী মূর্তিতে। পরনে টাইট জিনস প্যান্ট আর শার্ট।

বল, কেন এসেছিস? গর্জে ওঠে গজানন।

তোমার মুরোদ দেখতে, মিটিমিটি হাসছে পুঁতিবালা–ঠিকানা পেয়েছ?

কার?

কিঙের।

না।

হ্যাঁ।

বলছি না।

আমি বলছি হ্যাঁ। আলো নেভবার সঙ্গে-সঙ্গে মমতাজ কী বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল?

তুই সব দেখেছিস?

পেছনের জানলা থেকে।

দ্যাখ পুঁতিবালা, মেয়েটা এত বজ্জাত–

সাফাই গাইতে হবে না, গজানো। তোমার সব খেলাই আমি দেখছি। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। কী নাম বলেছিল মমতাজ?

নাম? নাম?

বলো, বলো, মনে করবার চেষ্টা করো—

মাথায় এমন মারল—

ঠিক তার আগে কী যেন বলে চেঁচিয়ে উঠল?

নু…নু…মনে পড়েছে। পুঁতিবালা, মনে পড়েছে।

নামটা কী?

নুরুল হাসান। বলেছিল, নুরুল হাসান এসে গেছে, ও গড!

নুরুল হাসানই তাহলে মমতাজের গড?

তাই তো দেখছি। ওর স্বামীর নাম—

নুরুল হাসান নয়।

তবে কার নাম?

গজানো, তোমার সাগরেদি করে ব্রেনটাকে কীরকম পাকিয়েছি এবার দ্যাখো। এটা কী দেখছ?

টেলিফোন গাইড।

এই শহরের টেলিফোন গাইড। মমতাজের ওপর যখন ধর্ষণ আর মারধর চালাচ্ছে আমিনুল, আমি তখন–

আমিনুল!

আবার কে? ভারি পাজি লোক। কাল রাতেই আমি বুঝেছি।

কী…কী বুঝেছিস তুই?

সে অন্য কথা। মমতাজকে জঘন্য ভাবে ধর্ষণ করে ওর মুখ থেকেই নুরুল হাসান নামটা বের করে নেয় আমিনুল। হেরোইন মানুষের আগল আলগা করে দেয় বিশেষ করে আন্নাকালীর মতো মেয়েদের

আন্নাকালী!

ওই হল গিয়ে! মমতাজ মানেই আন্নাকালী। গায়ের যা রং–ম্যাগো। যাক যা বলছিলাম, মমতাজের কাছ থেকে নামটা জেনে নিয়ে তাকে অমানুষিক ভাবে পিটিয়ে মেয়ে ফেলে আমিনুল। আমি বাধা দিইনি। অমন মেয়ের ওই দশাই হয়। আমি তখন খুঁজছিলাম টেলিফোন গাইডটা। তারপর পাহারা দিচ্ছিলাম তোমাকে। আমিনুল ট্রিগার টেপবার আগেই টাইট সার্টের বক্ষদেশ থেকে খুদে রিভলভারটা বের করে দেখাল পুঁতিবালা–পৌরুষ উড়িয়ে দিতাম আমিনুলের।

স্যাডিস্ট!

যা খুশি বলো। আমি গাড়ি চালাচ্ছি–দেখতেই পাচ্ছ। তুমি গাইডখানা দ্যাখো। নুরুল হাসান নিশ্চয় বড় দরের লোক। কিঙ-য়ের আসল নাম যদি নুরুল হাসান হয়–টেলিফোন তার নামে থাকবেই। দ্যাখো।

ভালো ছেলের মতো ছুটন্ত গাড়িতে গাইডের পাতা উলটে গেল গজানন। পাওয়া গেল নুরুল হাসানের নাম আর ঠিকানা।

হাসল পুঁতিবালা আমিনুল জানত তুমিও ঠিক এইভাবে পেয়ে যাবে ঠিকানা। তাই বধ করতে চেয়েছিল তোমাকে। দাদা গো, এখন বলো কী করতে চাও।

বধ করব।

কাকে?

কিঙকে।

তবে চলো–এখুনি।

.

হাইওয়ে থেকে একটু ভেতরে বাড়িটা। দোতলা। পেট্রল পাম্পে জিগ্যেস করতেই পাওয়া গেল পথনির্দেশ।

গাড়ি দূরে রেখে ভাইবোন এগিয়ে গেল মরণের টঙ্কার বাজাতে।

দুজনেই এগোল বাড়ির সামনের দরজার দিকে। পেছনে পাহারা থাকতে পারে। সেখানে অন্ধকার। সামনে কেউ থাকবে না। এখানে আলো।

দরজা খোলাই রয়েছে। কোনও গোপনতা নেই। আর পাঁচটা গেরস্থ বাড়ির মতোই। করিডরে জ্বলছে আলো।

চৌকাঠ পেরিয়েছে গজানন, এমন সময়ে পাশের দেওয়ালের খুপরি থেকে একটা ষণ্ডামার্কা লোক বেরিয়ে এসে দাঁড়াল সামনে।

কী যেন বলতেও গেল। কিন্তু বলবার অবকাশ ছিল না গ্রেট গজাননের। মাথার চোট পেয়ে তখন তার কোষগুলো নিদারুণ টনটনে–

ফলে, এক হাতে তার মুখ চেপে ধরল গজানন, আর এক হাতের ছোট্ট ছুরিটা বসিয়ে দিল তার বুকে।

নিষ্প্রাণ দেহটাকে আস্তে-আস্তে শুইয়ে দিল মেঝেতে।

এবার তার চোখ জ্বলছে। গজানন রক্ত দেখেছে। গজানন রেগেছে।

খুশি হল পুঁতিবালা।

করিডরের শেষে একটা ঘরে কারা যেন কথা কইছে।

পা টিপে টিপে দুজনে এগিয়ে গেল দরজার পাশে।

ভারি গলায় একজন বলছে–মমতাজের ওপর হুকুম আছে গজাননকে পটাসিয়াম সায়ানাইড দিয়ে চলে আসবে এখানে।

শুনেই মাথার চুল খাড়া হয়ে যায় গজাননের। কী নৃশংস মেয়েছেলে রে বাবা! হেরোইনের নাম করে পটাসিয়াম সায়ানাইড খাওয়ানোর প্ল্যান করেছিল তাকে। পুঁতিবালা কি সাধে বলে আন্নাকালী! ভগবান বাঁচিয়েছেন।

ভারি গলায় আবার বললে-দরজা ভোলাই আছে–মমতাজের এত দেরি হচ্ছে কেন বুঝছি না। কী হে কেমিস্ট, তুমি আর দেরি কোরো না। মাল খাঁটি আছে কিনা টেস্ট করে বলে দাও, ওজন করে ভাগ করে দাও।

ভাঙা গলায় একজন বললে–তাই হোক বস্। দেনাপাওনা এখানেই মিটে যাক। যে যার মাল ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাক। পেছনে ফেউ যখন লেগেছে।

ভারি গলায় বললেকভাগ হবে তাহলে?

সরু গলায় একজন বললে–চার ভাগ। আপনি রাখবেন?

ভারি গলা–না।

সরু গলা–তাহলে তিনভাগ হোক। আমার বাইশ পাউন্ড।

ভাঙা গলা–আমার বাইশ পাউন্ড।

হেঁড়ে গলা–হেঁ-হেঁ, আমারও বাইশ পাউন্ড।

দোরগোড়ায় শোনা গেল বজ্রগর্জন–আমার ছেষট্টি পাউন্ড।

সবেগে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পাঁচটা লোক। প্রত্যেকেই ভীষণ চমকে উঠে তাকিয়ে দরজার ফ্রেম জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কালান্তক যমদূতের মতো মানুষটার দিকে। কে রে বাবা? মানুষ না অসুর? আঁকাল চুল ফুলেফেঁপে বিচ্ছিরি কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে আছে মাথার চারপাশে। চোখ দুটো দু-টুকরো জ্বলন্ত কয়লার মতো গনগনে রাঙা। চাহনিও পৈশাচিক…অমানুষিক।

সবার আগে কিঙ সামলে নিল। দীর্ঘদেহী যে পুরুষ মূর্তি ভারি গলাটা তারই। মাথার সামনে টাক, পেছনে লম্বা চুল। টিকোলো নাক। জমিদারি গোঁফ। রীতিমতো কর্তৃত্বব্যঞ্জক খানদানি চেহারা।

বললে ভারি গলায়–গজানন?

জিরো জিরো গজানন। বলতে-বলতে টেবিলে স্কুপাকার ছেষট্টিটা পলিথিন প্যাকেট দেখে নিল গ্রেট গজানন। সাদা মিহি গুঁড়ো প্রতিটি প্যাকেটে। নিক্তি হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে উঠেছে যে চশমাধারী ভদ্রলোক-ভদ্রলোক মানুষটা, ওই নিশ্চয় কেমিস্ট। না। ওকেও বাদ দেওয়া যাবে না। এ ঘরের সবাই পাজি। তাই এ ঘর ছেড়ে কেউ জীবন্ত বেরোতে পারবে না। এ ঘরের এক কণা সাদা গুঁড়োও ভারতের মাটিতে পৌঁছবে না।

মৃত্যুর দ্রিমি-দ্রিমি ডম্বরুধ্বনি বোধহয় আগেই শুনতে পেয়েছিল ভারি গলার অধিকারী লম্বা লোকটা। একটুও না নড়ে বললে–ওয়েলকাম, মাই ফ্রেন্ড। তিন ভাগ নয়, চার ভাগই হোক।

মহাশয়ের নাম?–গজাননের গলায় কি করাত বসানো? কথাগুলো কানের মধ্যে দিয়ে কেটে কেটে বসে যাচ্ছে কেন?

নুরুল হাসান।

ওরফে কিঙ।

ইয়েস।

এরপর আর কোনও কথাই হল না ঘরের মধ্যে। শুধু শোনা গেল গুলির শব্দ।

বাইরের হাইওয়েতে সে আওয়াজ পৌঁছেছিল। আতশবাজি পোড়ানো হচ্ছে মনে করেই কেউ কান দেয়নি।

মাত্র পাঁচটা বুলেট খরচ করেছিল গজানন আর পুঁতিবালা। তিনটে জিরো জিরো দুটো তার সাগরেদের।

প্রথম বুলেটটা অবশ্য জিরো জিরোর। কিঙ-য়ের দুই ভুরুর ঠিক মাঝখান দিয়ে করোটিতে প্রবেশ করেছিল গরম সীসের টুকরোটা।

টেবিলের ওপরেই ছিল ব্যাগ। ছেষট্টিটা প্যাকেট তার মধ্যে ভরে বেরিয়ে এসেছিল ভাইবোন স্পাই কোম্পানি।

দিন কয়েক পরেই ত্রিশূল দপ্তরের রামভেটকি সুরকিওয়ালার টেবিলে প্যাকেটগুলো সাজিয়ে রেখে শুধু বলেছিল গজাননসরি, লাশ সাতটা আনতে পারলাম না।

* ঘরোয়া পত্রিকায় প্রকাশিত। (শারদীয় সংখ্যা।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *