জাল
বাঁ-পাশে নদী! নদীটার সুন্দর একটা নাম! কে রেখেছিল, কবে রেখেছিল কেউ বলতে পারবে না। তারা নেই, নদীটা আছে! নদীর নাম ঝুমকি! ডান পাশ দিয়ে পথ চলে গেছে বরাবর। আর একটু পরেই সন্ধে হবে! আমি হাঁটছি! শীত শীত বাতাস! শীত আসতে আর দেরি নেই।
এদিকটায় লোকজনের তেমন বসতিও নেই। শহরের বাইরে। স্টেশান অনেক দূরে। দুপুর দুপুরেই আসার কথা ছিল। ট্রেনটা এত লেট করল, যে, বেলা শেষ হয়ে এল। শীতের বেলা ঝপ করে শেষ হয়ে যায়। ইচ্ছে করেই হাঁটছি, কারণ এই পথটা আমার স্মৃতির পথ! এই পথে ছোট ছোট নুড়ির মতো পড়ে আছে আমার অতীত জীবন। যে জীবন নিয়ে কেউ কোনওদিন ইতিহাস লিখবে না। স্ট্যাচু করে মালা পরাবে না গলায়।
এই শহরে আমার বাবা ছিলেন মস্ত এক মানুষ। মিশনারি স্কুলের নামকরা প্রিন্সিপাল। আমাদের সুন্দর একটা বাংলো ছিল। সুখের সংসার ছিল সুন্দর। আমার মা ছিলেন ভারী মিষ্টি। আমার বয়েস যখন ছয় কী সাত, তখন এক বছরের মধ্যেই বাবা আর মা দুজনেই মারা গেলেন।
এই নদীর নাম ঝুমকি। এই নদী বলতে পারবে, জীবন কেন চলে যায়। কেউ কেউ পৃথিবীতে এসে কেনই কেবল দু:খ পায়। আমি বলতে পারব না। মানুষের চোখ দুটো সামনে, সে কেবল আগতকেই দেখবে, বিগতকে দেখতে পাবে না। কেন এল, কী নিয়ে এল, কী পেতে এল, প্রশ্ন আছে, জবাব নেই। সন্ধান আছে, প্রাপ্তি নেই।
ঝুমকির একেবারে কিনারায় সেই কুঠিয়া। ওখানে একজন থাকে, যাকে আমি অনেকদিন থেকেই চিনি। তার সাধুর মতো জীবন, জীবিকা কিন্তু মাছ ধরা। তার কেউ নেই, কিন্তু আমার মতো ‘কেউ নেই, কেউ নেই’ বলে মন খারাপ করে জীবনটাকে বরবাদ করতে চায় না। সে বলে, আমার নদী আছে। সে আমার মেয়ে, ঝুমকি। সে বলে, আমার কত গাছ আছে, কত বড় বড় মাঠ আছে। আমার একটা ছোট্ট পাহাড় আছে। রাতে আমি তারাদের মালিক, পনেরো দিনের জন্যে আমার সঙ্গে গল্প করতে আসে আমার এই ছেলেবেলার চাঁদামামা। কী বলো তুমি, আমার কেউ নেই। এরা তো তোমারও। তুমি কেবল নেই নেই করেই গেলে।’
সে আমার ললিতদা।
কুঠিয়ার সামনেটা ফাঁকা। ঘুরে পেছন দিকে গেলুম। একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে আছে সে। জাল বুনছে একমনে আর গান গাইছে গুনগুন করে। যখন যা মনে আসে সেইটাকেই গানে ফেলে সুর চড়িয়ে দেয়।
আমার দিকে চোখ না তুলেই বললে, ‘অনেক দিন পরে এলে?’
—’অনেক চেষ্টায় একটা চাকরি পেয়েছি।’
‘কী চাকরি?’
‘রংকলে।’
‘বা:, খুব ভালো কথা! রং? সে তো খুব ভালো জিনিস! লাল, নীল, হলদে, সবুজ! তাহলে খুব আনন্দে আছ বলো?’
‘আট ঘণ্টা ডিউটি, আর রঙের গন্ধে বুকটা কেমন করে! রাতিরে মাথা ধরে!’
‘সে আর কী করবে, তুমি যদি সাধ করে শহরে যাও, শহর তোমাকে জ্বালা দেবে। আমার মতো মাছ ধরো, আরামে থাকবে। নদীর মিষ্টি গন্ধ! আমি যে রুপোর কারবারি, আর তুমি হলে রূপের?’
‘রুপোর কারবারি মানে?’
‘মাছ কী তুমি দ্যাখোনি! রুপোর তবক মোড়া মাছ!’
‘আমি কী মাছ ধরতে জানি?’
‘ওর আর আবার জানাজানি কী! কোমর জলে নামবে, জালখানি ঘুরিয়ে ফেলে দেবে জলে, তারপর টানবে। টানতে টানতে আনবে কোলের কাছে। তিন খেপ মারলেই একটা লোকের পেট চলে যাবে। তবে তুমি যদি খুব ভালো খেতে চাও, আবার যদি মদ খেতে চাও, কাপ্তেনি করতে চাও, আবার যদি মেয়েছেলে চাও, তাহলে তোমাকে যন্ত্রের কাছে যেতে হবে, তোমার বুক চেপে ধরবে, মাথা ধরবে, তুমি কত তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যাবে! চার দেওয়ালের খাঁচায় তুমি মরার আগেই মরে যাবে, ভূত হয়ে বেঁচে থাকবে। তা, সে তোমার ব্যাপার। কী মনে করে এলে! দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ ভালোই আছ হে!’
‘তুমি তো জানো, এখানে আমার নাড়ির টান। আমি যে এইবার বিয়ে করব। সংসার করব। একটা কপালে একটা সোনালি টিপ, একটা নাকে পাথর বসানো একটা নাকছাবি, দুচোখে কালোজলের টলটলে দিঘি, সেখানে তোমার চাঁদ সাঁতার কাটতে নামবে পূর্ণিমার রাত্তিরে।’
‘সে কে? শুনি তো সে কে?’
‘তাকে তুমি দেখেছ। সে এখানেই থাকে। ওই চার্চের অরফ্যানেজে।’
‘নাম কী তার?’
‘ডোনা।’
‘সে তো খুব ভালো মেয়ে। আমার কাছে আসে। এই তো সেদিন চাঁদের আলোয় আমাদের ফিস্ট হল। আমরা দুজনে। খুব ভালো রাঁধে তো। তবে তোমাকে বলে রাখি, আমার মতো কেউ রুটি তৈরি করতে পারবে না। একেবারে তুলো। আচ্ছা তুমিই বলো, আমি যদি ওকে মশলাটা ওইভাবে পিষে না দিতুম তাহলে মাংসটা কী অত ভালো হত। শোন, অহংকার মোটেই ভালো না। আমার মশলাটা যদি ভালো না হত তাহলে ডোনা কী করত! এ কথা আমি অস্বীকার করছি না যে ডোনা ভালো রাঁধে। তবে কী জানো, আমার মতো খিচুড়ি কেউ রাঁধতে পারবে না। ডোনাকে এ কথাটা তুমি বলতে পারো, তবে আগের কথাগুলো না বলাই ভালো, কী জানো, অহঙ্কার করা ভালো নয়। কীসের অহঙ্কার, তবে এ কথা ঠিক, ডোনার মতো টোম্যাটোর চাটনি কারও ক্ষমতা নেই করে। তুমি ডোনাকে এখন বিয়ে করতে যাচ্ছ? আমার কাছ থেকে মেয়েটাকে কেড়ে নেবে! ও তো মেয়ে নয়, ও নদী, ও পাখি, ও গাছ, আকাশ, বাতাস, তারা।’
‘ফাদার আমাকে বলেছিলেন, যেদিন তুমি একটা চাকরি পাবে, যেদিন তুমি প্রমাণ করতে পারবে, তুমি তোমার রোজগারে সংসার চালাতে পারবে, সেইদিন তোমার হাতে ডোনাকে তুলে দেব। আমি সেই প্রমাণ দাখিল করতে এসেছি।’
‘ফাদার ডেভিসের কাছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওই ফাদার তো ভগবান। সেবার আমার অসুখ করেছিল। করতেই পারে। শরীর থাকলেই করবে। এতে তো লজ্জার কিছু নেই। আমার কিন্তু খুব লজ্জা করেছিল, ফাদার তিন দিন, তিন রাত সমানে আমার সেবা করেছিলেন, ডোনাও ছিল। ডোনা তো থাকবেই, সে যে আমার বন্ধু। ফাদার শুধু তোমার ওই চার্চের ফাদার নন, আমার ফাদার। আমি যে এখন কী করি! মাঝে মাঝে মনে হয়, এই নদীটা ফাদারকে দিয়ে দি, ওই পাহাড়টাও, শালের জঙ্গলটাও। তুমি বিয়ে করে ডোনাকে কোথায় নিয়ে যাবে।’
‘কলকাতার কাছেই একটা জায়গায়।’
‘ও তো এখানে একটা চাকরি পেয়েছে।’
‘হ্যাঁ, চাকরি।’
‘তাহলে দেখি কী হয়!’
‘দেখি-টেখি নয়, তুমি বিয়েও করবে, চাকরিও ছাড়াবে, তা কী করে হয়, দোনো এক সাথ! যা:, আমি তোমার সঙ্গে ইয়ারকি করছি। সেই কোন ছেলেবেলা থেকে তোমাদের প্রেম।’
‘আমিও অরফ্যান, ও-ও অরফ্যান।’
‘বাজে কথা বলিসনি। শোন, এই কুঠিয়াটা আমি তোকে দান করে দিচ্ছি, এইখানে থাক। এই নতুন জালটা তোকে দিয়ে দেব। দেখ, মাছধরা আমার জীবিকা ছিল না, আমি শিখেছি নদীর কাছে থাকব বলে। কোথায় ছিল আমার দেশ! কেউ জানে না। হঠাৎ এসে গেছি, হঠাৎ পেয়ে গেছি জীবন। শহর কিন্তু ডোনার জন্য নয়। ডোনা হল নদীর মেয়ে! শহরে গেলে ও নষ্ট হয়ে যাবে। শুনেছি সেখানে লম্পট বড়লোক আর গুন্ডারা থাকে। সেখানে মানুষের হৃদয় নেই, মনে প্রেম নেই, চোখে জল নেই। শহর হল শয়তানের। গ্রামকে ফুসলে নিয়ে গেছে বেশ্যা শহর করবে বলে। ওখানে এমন একটা নদী পাবে।’
‘কেন, আমাদের অত বড় নদী, গঙ্গা!’
‘ওটা আর নদী নেই, কলকারখানা, আর তোমাদের শহরের নোংরা জলের নর্দমা।’
ললিতদা আবার জাল বুনতে লাগল। অন্ধকার নেমে গেছে। অভ্যাসে হাত চলছে! ঘরের ভেতর কাঠের টেবিলে সোনার জলে লেখা বাইবেল, তার ওপর একটা ক্রশ। ক্রশটা মাথায় আর বুকে ঠেকালুম। মনে মনে বললুম—Lord, I believe, help thou mine unbelief.
ললিতদা বললে, ‘লণ্ঠনটা জ্বেলে দে, পাশেই দেশলাই আছে।’
লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে টেবিলে রাখলুম। অন্ধকার ঘন হলে এই আলোটাই জোর হবে।
‘আমি তাহলে আসছি। ঘুরে আবার আসবে।’
‘রাতটা থাকবি?’
‘তা না হলে যাব কোথায়?’
‘তাহলে খিচুড়ি চাপাই।’
‘চাপাও। এতটা হেঁটে খুব খিদে পেয়েছে।’
বিশাল একটা গেট। পুরো খোলা। ও, আজ যে শুক্রবার। চার্চে প্রেয়ার হচ্ছে। আলো জ্বলছে। জেনারেটারের শব্দ। লাল সুরকির চওড়া পথ, দুপাশে বাগান রেখে সোজা এগিয়ে গেছে ভেতরে। অনেকটা দূরে সাদা ঝকঝকে একটা মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে। বিদেশ থেকে বড় কেউ এসেছেন। সবাই প্রেয়ারে। বাইরেটা একেবারে ফাঁকা। কোথাও চাঁপা ফুল ফুটেছে। ভীষণ গন্ধ। গন্ধের সঙ্গে ভালোবাসার খুব যোগ। ভালোবাসার সঙ্গে কোমল একটা শরীরের, পায়রার মতো নরম বুকের, ঝকঝকে কালো মণির মতো দুটো চোখের, ফুলফুল একটা স্কার্টের, ভরাট বুকে সাদা একটা ব্লাউজের।
হলে ঢুকতেই প্রেয়ারের সুরে ভেসে গেলুম। অরগ্যান বাজাচ্ছেন বৃদ্ধ ফাদার ডেভিস। নানেরা সব সাদা হুট পরে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা জানলায় টিন্টেড গ্লাস। সোনার জলে ছবি আঁকা। আলো পড়ে ঝকঝক করছে। চোখের অনুসন্ধান ডোনাকে। কোথায় সে! ওই তো পালপিটের সামনে। মনে হল, ছুটে যাই, উড়ে যাই! সে তো উপায় নেই।
‘মাস’ শেষ হল এক সময়। অরগ্যানের সুর, সমবেত প্রার্থনা, সমাবেশ, আলো, বাতি, খ্রিস্টের ত্রুশবিদ্ধ মূর্তি, সব মিলেমিশে মনটা বেশ ভরে গেল। মনে হল, এই সুন্দরের এলাকায় চিরকাল যদি থাকা যেত। শহরের গুপচি এলাকা, সদা ব্যস্ত মানুষের খণ্ডযুদ্ধ, রংকলের রোলার ড্রামের ভেতর পোর্সিলেন বলের অনরবত শব্দ, থিনারের গন্ধ, মাসের শেষে সামান্য ক’টা টাকার জন্যে হাত পেতে দাঁড়ানো। সুখের চেয়ে যন্ত্রণা বেশি। স্বপ্ন কোথায়, সবই তো দু:স্বপ্ন।
সিস্টারেরা একে একে বেরিয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যেকেই বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে আছেন বাইবেল আর ক্রশ। পোশাকের খশখশ শব্দ। পালপিটে অরগ্যানের সামনে বৃদ্ধ ফাদার ডেভিস। খুব আস্তে কথা বলেন, বাতাসের সুরে। আমাকে সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। প্রায় ছ’ফুট লম্বা। সামনে একটু ঝুঁকে আছেন।
‘ব্লেসিংস মাই সান! কেমন আছ তুমি?’
‘প্রভুর আশীর্বাদে ভালোই আছি ফাদার। আই হ্যাভ গট এ জব। ফাদার! আপনি কেমন আছেন?’
‘আই অ্যাম অলওয়েজ উইথ মাই লর্ড।’
‘ফাদার! আপনি বলেছিলেন…’
‘ইয়েস, আই নো, বাট শংকর, আই হ্যাভ সামথিং…না, এখানে নয়, আমার কটেজে চলো, তোমাকে আমি কিছু বলতে চাই।’
সুরকিঢালা পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে একেবারে পেছনের দিকে। শেষ হয়েছে ঝুমকি নদীর কিনারায়। চার্চ কম্পাউন্ডের পাঁচিল। পাঁচিলের পরেই ঢালু পাড়। পাড় ছুঁয়ে কুলুকুলু বইছে নদী। ওদিকে ছোট্ট একটা গেট আছে। সেই গেট খুলে নদীতে নামা যায়।
সাদা গাউন পরে ফাদার হাঁটছেন আগে আগে। আমি পেছনে। কেউ কোনও কথা বলছি না, নিস্তব্ধতা ভেঙে যাওয়ার ভয়ে। মাঝে মাঝে শুকনো পাতায় পা পড়লে সামান্য মচমচ শব্দ। পথ যেন আর ফুরোয় না।
ফাদারের কটেজের বাইরে একটা ঢাকা বারান্দা। গোটাকতক বেতের চেয়ার-টেবিল, নিখুঁত সাজানো! ঘরের দরজায় নেটের পরদা। ভেতরে মৃদু আলো। বাইরে থেকে ভেতরটা মনে হচ্ছে স্বপ্ন।
ফাদার বললেন, ‘বসো, আগে কফি খাওয়া যাক।’
‘আমি নিয়ে আসি!’
‘না, তুমি বোসো। সব আমার হাতের কাছে আছে।’
ফাদার ঘরের ভেতর থেকে একটা ফ্লাক্স আর দুটো কাপ নিয়ে এলেন। নি:শব্দে কফিপান হল কিছুক্ষণ। হঠাৎ খুব মৃদুস্বরে ফাদার বললেন, ‘আই হ্যাভ এ সিক্রেট ফর ইউ। একটা গোপন খবর! এতদিনে সেটা প্রকাশ পেল।’
‘কী খবর ফাদার!’
‘তুমি কী জানতে, তোমার বাবা আর মা দুজনেই আত্মহত্যা করেছিলেন!’
‘মারা গিয়েছিলেন! আত্মহত্যা করেছিলেন বলে জানতুম না।’
‘ইয়েস বোথ অফ দেম কমিটেড সুইসাইড, কেন জানো?’
‘না ফাদার।’
‘ডোনা, তোমার বোন।’
আমার বোন! তা কেমন করে হয়! আমিই তো একমাত্র ছেলে!’
‘ওয়েট, দেয়ার ইজ এ লেটার। আমার হাতে এসেছে।’
ফাদার উঠে ঘরের ভেতর গেলেন। সেখান থেকে ডাকলেন, ‘শংকর, ভেতরে এসো।’
আমার হাতে একটা কাগজ দিলেন। কাগজটা পুরোনো হয়েছে। কালির কালো রং কালচে হয়েছে। টেবিলল্যাম্পটা জ্বেলে দিয়ে বললেন, ‘এইখানে বসে পড়ো।’
আমার হাত কাঁপছে। বুকের কাছটা কেমন করছে। পড়তে অসুবিধে হলেও পড়া যাচ্ছে।
‘পাপ করেছি আমি।’
‘কেন করেছি, তার কোনও ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাইনি। হয়তো এই রাতে শয়তান আমার ওপর ভর করেছিল। যা করা উচিত নয়, মুহূর্তের ভুলে তাই করেছি। ভেবেছিলুম, পার পেয়ে যাব, তা হয়নি। সে গর্ভবতী হল। আমার সন্তান সে ধারণ করল। সে খুব ভালো ছিল। আমাকে ভালোবাসত। আমাকে ব্ল্যাকমেল করার ইচ্ছেও তার ছিল না। কিন্তু সে ছিল পাপী। মুহূর্তের ভুলের এই কলঙ্ক আমার স্ত্রী, আমার সন্তানকে যেন স্পর্শ না করে। আমার স্ত্রী আমার অবর্তমানে আমার সন্তানকে মানুষ করে তুলতে পারবে, এই বিশ্বাস আমার আছে। আমার পুত্রের কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। নৈতিক দিক থেকে আমি পতিত হলেও, শিক্ষায়, জ্ঞানে, আমার কিছু সুনাম ছিল। সেই উত্তরাধিকার আমি রেখে গেলুম। অর্থ, বিত্ত, এসব আমার কিছুই নেই।’
পড়া শেষ হল। ফাদারকে জিগ্যেস করলুম, ‘কে এই সে? কেমন করে বুঝলেন ডোনাই সেই মেয়ে?’
‘খুবই সঙ্গত প্রশ্ন তোমার। এই সে হল তোমার পিতার এক ছাত্রী। সম্প্রতি সে মারা গেছে। মৃত্যুর সময় আমি তার কাছে ছিলুম। সে আমাকে সব জানিয়ে গেছে। তোমার বাবার এই লেখাটা তার কাছেই ছিল, আমাকে দিয়ে গেছে। বলে গেছে, ডোনাকে যদি কেউ বিয়ে করে সে জানতে চাইবে, ডোনার বাবা কে, ডোনার মা কে!’
‘আমি তো জানতে চাইনি ফাদার! আমি তো না জেনেই ভালোবেসেছি, বিয়ে করে ঘর বাঁধতে চেয়েছি। আপনি বলেছিলেন, তুমি চাকরি পেলেই সব হবে।’
‘তুমি যাকে বউ হিসেবে চাও, সে এখন তোমার বোন। এই তথ্যটা তো আমার তখন জানা ছিল না শঙ্কর। তবে তোমার মা জানতেন।’
‘মা কেন আত্মহত্যা করলেন?’
‘এইটাকেই বলতে পারো প্রেম, ট্রু লাভ। তোমার বাবা নেই এটা তিনি সহ্য করতে পারলেন না।’
‘আমি তাহলে তাঁর কেউ ছিলুম না।’
‘মেডিকেল রিপোর্ট বলছে তোমার মা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।’
‘ডোনার মা তখন কোথায়?’
‘মেয়েটাকে আমাদের ক্রেডলে ফেলে দিয়ে সে এখান থেকে চলে গিয়েছিল। লেখাপড়ায় খুবই ভালো ছিল। শি বিকেম এ রাইটার!’
‘কী নাম?’
‘অনুপমা বোস।’
‘আমি তাঁর বই পড়েছি। তাঁর কাহিনি নিয়ে একটা সিনেমা হয়েছিল।’
‘হোয়াটস দ্যাট?’
‘দোলনা, সুপার হিট। সে তো তাহলে আমাদেরই কাহিনি।’
‘আই হ্যাভ গট দি ইংলিশ ট্র্যানস্লেশান, পাবলিশড ইন ব্রিটেন।’
‘আমার এই মা-ও তাহলে বিরাট লেখিকা ছিলেন।’
‘অফ কোর্স!’
‘কী ভাবে মারা গেলেন?’
‘অ্যাকসিডেন্ট।’
‘ফাদার! এঁরা এমন করলেন কেন? আমার বাবা বিয়ে করতে পারতেন।’
‘তাহলে তো সবই সোজা হয়ে যেত। নদী তো সোজাই চলতে পারে, কেন হঠাৎ বাঁক নেয়, কোর্স চেঞ্জ করে, কুল ভাঙে, কূল গড়ে। হোয়াই! দ্যাট ইজ ফেট। দ্যাট ইজ ডেসটিনি! শংকর! আমাদের প্রভু বলে গেছেন—Be sure your sin will find you out. তিনি আরও কী বলেছেন! আমাদের পিতারা খেয়েছেন টক আঙুর, তাই ছেলেদের দাঁত টকে আছে। The fathers have eaten sour grapes and the childrens teeth are set on edge. তোমার পিতা সাময়িক হলেও কামার্ত হয়েছিলেন, তিনি স্বভাবপাপী হলে এই পদস্খলনে কিছুই হত না, কিন্তু তিনি ছিলেন মানী, জ্ঞানী, কর্তব্যপরায়ণ। আর তোমার মা আর ডোনার মা দুজনেই সমান, দুজনেই সন্তানকে পরিত্যাগ করেছিল, তাই মৃত্যু তাদের তাড়া করল, পাপের বেতন মৃত্যু। তুমি কী ডোনার সঙ্গে দেখা করবে।’
‘না ফাদার, আমিও পাপ করেছি, I confess, তবে না জেনে। আমি জানতুম তার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে, তাই তিন বছর আগে এক্সমাসের সময় আমি তাকে স্পর্শ করেছিলুম, পাপ করেছিলুম পুণ্য করছি ভেবে। পিতার রক্ত আমারও শরীরে আছে। The wages of sin is death.’
‘যা হয়ে গেছে, গেছে। Past is past. নতুন বর্তমান তৈরি করো।’
‘ফাদার, বাইবেল আমার নিত্যসঙ্গী, জেরেমিআয় আছে—Can the Ethiopian change his skin, or the leopard his spots. ইথিওপিয়ার মানুষ চামড়ার রং পালটাতে পারবে? চিতাবাঘ মুছে ফেলতে পারবে তার গায়ের স্পট? আমি যাই ফাদার।’
‘এই রাতে যাবে কোথায়?’
‘আমার একটা জায়গা আছে কাছেই।’
‘The grace of our lord Jesus Christ be with you all. Amen.’
একটা কালো কুকুর আমার পেছন পেছন এল ললিতদার চালা পর্যন্ত। যেমন এল হঠাৎ দেখি নেই। গাটা ছমছম করে উঠল। স্পিরিট, আত্মা, কার আত্মা! ললিতদা গান গাইছে, আর খিচুড়ির হাঁড়িতে হাতা মারছে। আমাকে দেখে বললে, ‘ব্রাদার! আজ খুব কেয়ার নিয়ে রাঁধছি। গানটা শুনলে, বোম্বাইসে আয়া মেরা…’
এতক্ষণ শক্ত ছিলুম, এইবার হঠাৎ কেঁদে ফেললুম। ললিতদা উঠে এল, ‘কী হয়েছে দোস্ত!’
যে আমার বউ হবে, সে আমার বোন। এখন তার আর বোন হওয়ার উপায় নেই, আমি তাকে বউয়ের মতো আদর করে এসেছি এতদিন। একদিন চরম আদর করেছি।’
‘কিছুই বোঝা গেল না।’
খেতে খেতে সব কথা ললিতদাকে বলে ভেতরটা একটু হালকা হয়েছে। দুজনে বসেছি ঝুমকির ধারে। অন্ধকারে বইছে নদী। আকাশের গায়ে থেবড়ে আছে চুরালিয়া হিলস। চার্চের বিরাট চূড়া স্তব্ধ হয়ে আছে দিনের প্রতীক্ষায়। বিরাট ঘণ্টা যেন মৃত্যুর ঘোষণা।
ললিত অন্ধকারে হেসে উঠল, ‘আমি তোর চেয়ে অনেক অনেক বেশি চালাক শংকর। মানুষের সংসারের একপাশে আছি, ভেতরে ঢুকিনি। তোকে আমি বার-বার বলছি, এখনও সময় আছে নদীকে বন্ধু কর। ফিরে তাকায় না, থেমে থাকে না। চলেই যায়, চলেই যায়, সামনে, কেবল সামনে। একই জলে দুবার চান করা যায় না। নদী হল সময়। ধুয়ে ধুয়ে নিয়ে গেল আমার চল্লিশটা বছর, আমার যত সুখ, যত দু:খ। নদী আমার মা, নদী আমার মেয়ে, নদী আমার প্রেমিকা। জাল দিয়ে মাছ ধরি, কথা বলি, যাকে ভালো লাগে তাকে মুক্তি দি। যাদের ভালো লাগে না, পাঠিয়ে দি মানুষের ভোগে। আমি ভগবান, যদিও আমার নাম ললিত গোমেজ।’
খশ করে একটা শব্দ হল। ললিতদা বললে, ‘কে, কে ওখানে!’
অন্ধকার নড়ছে, অন্ধকার চলছে, এগিয়ে আসছে। কালো চাদর জড়ানো একটা মূর্তি, ‘চুপ, আমি ডোনা। পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে এসেছি।’
ডোনা ঝাঁপিয়ে আমার বুকে এসে পড়ল, ‘দাদা! তুই আমার দাদা। স্বামীর চেয়ে অনেক ভালো। আমাকে তোর সঙ্গে নিয়ে চলো।’
চার্চের বিরাট ঘণ্টাটা একবার টিং করে উঠল। বোধহয় বাদুড় ঢুকেছে ঘণ্টা ঘরে। তিন বছর আগের সেই রাত। ডোন আমার আলিঙ্গনে। সে রাতে প্রেমের সঙ্গে কাম ছিল, আজ শুধুই প্রেম। তাই এত ভালো লাগছে, চোখে জল আসছে। নিজের রক্ত খুঁজে পেয়েছি। দাদার মধ্যে তো বাবাও থাকে।