জাদুঘর – সন্তোষকুমার ঘোষ
ছয় ঋতুর মধ্যে ট্যুরিস্ট হামলা শুরু হয় ঠিক এই সময়ে, পড়-পড় শীতে। ইস্টিশানটা এমনিতে হট্টমন্দির, যেমন খুশি, যখন খুশি আসা-যাওয়া, কিন্তু এখন বড় কড়াকড়ি। দরোজাদারবাবু সিগন্যাল হেঁট হতে না হতেই এসে হাজির : চিচিং বাঁধ। বিন্টিকিট মাছিটাকেও গলতে দেবেন না।
সাইকেল-রিকশালার দল ঘন ঘন ট্রিং ট্রিং ট্রিপ মারছে। একজোড়া মোটে তেরপলঘোমটা ট্যাক্সি, পাম্প থেকে ফাঁকে ফাঁকে চোঁ-চুমুক পেট্রল টেনেই স্টেশনে ছুট।
হোটেলে হোটেলে জোড়াকবাট মানা। রিসেপ্শনিস্ট প্লাকার্ড উল্টে বসে আছে : সিঙ্গল সিটেড্? ও ক্রাইস্ট, নো। ডবল? ই-ইয়েস, অন গ্রাউণ্ড ফ্লোর।
এগুলো কুলীন, কলকাতা থেকে বন্দোবস্ত করে তবে আসতে হয়। তবে খানাআস্তানা মেলে এমন জায়গা আছে আরও দু’একটা, এখনও সিট মিলতে পারে।
টিপ্টা দিলে ব্রাইটন হোটেলের পোর্টার। অন্নপূর্ণা আশ্রমে যান বাবু; বাঙালীর হোটেল। ওখানেই আপনার সুবিধে হবে।
খবর মিলল তো ঠিকানা মেলে না। গলদ্ঘর্ম হতে হতে, রিকশালাকে উপরি বকশিশ কবুল করে করে, অনন্ত যখন অন্নপূর্ণা আশ্রমের দরজায় টোকা দিলে, তখন ছোট হেমন্তদিন প্রায় শেষ।
পাকা বাড়ি, কিন্তু পুরনো, মুখের চুন ধুয়ে এখন কালি পরেছে। ফ্রেমে আঁটা টিনের চাকতিটার লেখা অস্পষ্ট, লুপ্তাবশেষ কতগুলো অক্ষর দেখেই ঠাহর করতে হল, এই হবে।
দরজায় টোকা দেবার পর দু-মিনিটও বোধ হয় দাঁড়াতে হয়নি, কিন্তু অনন্তর মনে হয়েছিল ঢের বেশি। কবাট আলগা হল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অভ্যর্থনা শোনা গেল, ‘আসুন।’
স্ত্রীকণ্ঠ। পায়ে পায়ে অনুসরণ করে, একটা উঠোন পার হয়ে অনন্ত যে ঘরে পৌঁছল, সেটা পরিসরে বেশি না। রিকশালাকে ভাড়া চুকিয়ে, মোট রেখে তবে স্ত্রীলোকটির দিকে ভাল করে তাকাবার ফুরসত হল।
‘আমি এখানে কিছুদিন থাকব বলে এসেছি।’
‘বেশ তো।’
অন্ধকারে গলা শুনে যা মনে হয়েছিল, অনন্ত এখন দেখল, স্ত্রীলোকটির বয়স তার চেয়ে কিছু বেশি। ঠিক কত, অনুমান করতে পারল না ; ফোতো বাবুদের ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের মত ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে মেয়েদের বয়সটা অনিশ্চিত, আন্দাজ করা মুশকিল। রূপ তখন আর উচ্ছল তটিনী-নটিনী নয়, টলটল দিঘি!
রূপ হয়ত এ মেয়েটির ছিল, এখনও একটু আছে। রাত পুইয়ে যাবার পরও পাতায় পাতায় কুয়াশা লেগে থাকার মত। এখনও ভ্রূযুগে একটু ভঙ্গিমার অবশেষ, চিবুকের গঠনে ব্যঞ্জনার লেশ।
চোখ নামিয়ে নিল অনন্ত, ব্যাগ বার করল।— ‘কত দিতে হবে?’
হঠাৎ যেন লাল হল মেয়েটি। এক নিঃশ্বাসে বলল, ‘আমাকে না, আমাকে না।’ অনন্তকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবার সুযোগ না দিয়েই এস্ত পায়ে অন্তর্হিত হল।
বিছানা খুলতে খুলতে অনন্ত ঘরটার চারধারে নজর বুলিয়ে নিল। আসবাব বলতে কিছু নেই ; একটা ঢিলেদড়ি চারপাই, ছোট একটা টুল, দেয়ালে একটা তাক। ওখানে দাড়ি কামানর সরঞ্জাম আর খান দুই বই, যা সঙ্গে এনেছে, ঠাসাঠাসি রাখা যাবে।
‘আপনি?’
চমকে অনন্ত পিছনে তাকাল। রোগা, মাঝবয়সী একটা লোক, ঘরের ঠিক মাঝখানটাতে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘ও, গেস্ট? বসুন, বসুন। বিকেলের গাড়িতে এলেন বুঝি। দুপুরের? তবে এতক্ষণ—ও, বুঝেছি মশাই, অন্য কোথাও ঠাঁই মেলেনি, তাই জগদিন্দু গাঙ্গুলির হোটেলেই—’
যত প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক, তত জবাব চান না ; কতকটা সেকালের বথীদের মত, নিজের বাণ নিজেই সম্বরণ করেন। ‘কতদিন থাকা হবে, মাস তিনেক? রেট? আমাদের বেট মশাই দিন তিন টাকা আট আনা, এখনো সেই সত্যযুগেই আছি। তা আপনি তো পারমানেন্ট মেম্বরের রিবেট পাবেন, নীট পঁচানব্বই, পনেরো দিনেরটা অ্যাডভান্স, হল গিয়ে সাড়ে সাত চল্লিশ, তা মেথরখর্চা, কেরোসিন তেল বাবদ পুরো পঞ্চাশ টাকাই দেবেন।’
পাঁচখানা নোট ট্যাঁকে গুঁজলেন, কষির দাগ দেখা গেল, সাদা লাল ঘায়ের মত। ‘তা মহাশয়ের এখানে আসার উদ্দেশ্য?’
অনন্ত সংক্ষেপে বললে, ‘চেঞ্জ। পুজোর আগে নিউমোনিয়ায় ভুগেছিলুম।’
‘বেশ, বেশ।’গলা নামিয়ে জগদিন্দু বললেন, ‘অবিশ্যি স্বদেশী লোক হলেও আমার আপত্তি নেই। আমার এখানে, মশাই, নাম ভাঁড়িয়ে সেদিনও এক ফেরারী আসামী কাটিয়ে গেল। ধরিয়ে দিইচি? কাকপক্ষীতেও টের পায়নি। সদর রাস্তার ওপরে হোটেল না হওয়ায় ওই সুবিধে, এক্কেবারে পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস। সেদিনও বাপ-মার মত না নিয়ে বিয়ে করার মতলবে একজোড়া এসেছিল।’
চোখ মিটমিট করে গাঙ্গুলিমশাই বললেন, ‘এসব ব্যাপার বেশি প্রশ্রয় দিইনে মশাই, তবু—বয়সধর্ম জানি তো—যে সাতদিন ওরা ছিল, এক ঘরে শুতে দিইচি। ওরা ধরা পড়ল, তাও এখানে নয়, ইস্টিশানে গিয়ে।’
অনন্ত বললে, ‘ও।’
‘ছেলেটাকে পুলিস কী মারটাই মারলে, মশাই! মেয়েটাকে কিছু বললে না। ওর বাপটাও পুলিসের সঙ্গে এসেছিল কিনা। ওকে বোধ হয় মারলে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে।’
অনন্তর বিন্দুমাত্র ঔৎসুক্য নেই দেখে গাঙ্গুলি প্রসঙ্গ বদল করলেন।—‘তা বেশ, এসেছেন, থাকুন। এখানে খাবেন ভাল, থাকবেন ভাল। ভিড়ের ঝামেলা নেই। সন্ধে হয়ে গেছে, টের পাচ্ছেন না, নইলে আলোও যথেষ্ট আছে। জানালার বাইরেই নিমগাছ। হাওয়াও একটু পাবেন। বেশি হওয়ায় কাজ কী মশাই, আপনি এই নিমুনিয়া থেকে উঠেছেন, বুকে ঠাণ্ডা লাগবে।’
তা লাগুক, অনন্তর এখন একটা আলো চাই। অন্ধকার ঘন হয়ে নেমেছে ঘরের ভেতর,—দু’একটা মশাও বুঝি পায়ে কামড়ালে, দরজার ওপরে ঝটপট করছে, কে জানে, বোধ হয় কানা চামচিকে।
ইঙ্গিত বুঝে গাঙ্গুলি হাঁক দিলেন, ‘কই হে, একটা আলো দিয়ে যাও।’
একটু পরেই লণ্ঠন নিয়ে এসে দাঁড়াল, সেই মেয়েটি। ফিতে দপ্দপ্, চিমনিটা ভাঙা, মাথায় কালি। তবু, দু’ ফোঁটা নেবুর রসে দুধের মত, অন্ধকার তাতেই কেটে গেল। এরই মধ্যে মেয়েটি বুঝি সামান্য সাজবদল করে এসেছে, চুলটাও বেঁধে থাকবে। তাতে রূপ বাড়েনি, বয়স একটু বা কমেছে। লণ্ঠনটা নামিয়ে মেয়েটি দাঁড়াল না। সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল। অনন্ত লক্ষ করলে, সেই কেমন বিব্রত, কুণ্ঠিত ভাব।
জগদিন্দু গাঙ্গুলির নামটা স্বমুখেই জেনেছিল, অনন্ত এবার জিজ্ঞাসা করল, ‘এঁর নামেই হোটেল বুঝি।’
‘অন্নপূর্ণা আশ্রমের কথা বলছেন? ওর নামে হতে যাবে কেন। মায়ের নামে।’
‘আপনার মা?’
খদ্দেরের কাছে যতটা যায়, ততটাই বিরক্তি প্রকাশ করে জগদিন্দু বললে, ‘আপনি নাস্তিক নাকি মশাই। আমার মা হবে কেন! বিশ্বজননী, যিনি সকলকে অন্ন যোগাচ্ছেন। বারাণসীর অন্নপূর্ণা, শোনেননি? ইনি সেই।’ দু’ হাত এক করে মাথায় ঠেকাল জগদিন্দু, গলা ঈষৎ নামিয়ে বলল, ‘তা ছাড়া, আপনি যা মনে করেছেন, ও তা নয়। ও হল, এই, ইয়ে, মানে ঝি ক্লাসের।’
সারা রাত নিমগাছের ডালে সর্সর্ ডানা ঝাপটানি ; জানালার আলগা পাল্লায় ঠকঠক শব্দ। শ্রান্ত শরীর, তবু ভাল ঘুম হল না। একবার মনে হল, কোথায় যেন ফিসফিস শুনছে। উঠে গেল, দরজায় রাখল কান। কিচ্ছু না। ফিরে এল বিছানায়। চোখ বুজে তবু দেখা বন্ধ করা যায় ; কানেরও যদি একটা পাতা থাকত।
শ্রান্ত স্নায়ুর সুতো ক’টিকে একাগ্র করে যতবার ঘুমের সূচে পরাতে গেল, ততবার পিছলে গেল। জানালা খুলে দিল সাহস করে।
হু-হু হিম হাওয়ায় ঘর ভরে গেল, যাক, দমবন্ধ অস্বস্তির চেয়ে এ বরং ভাল। এতক্ষণ অনন্ত টের পায়নি চাঁদ উঠেছে, আকাশের রঙ দুধকুয়াশা। আবার শুয়ে পড়ল যখন, বালিশের নিচে রাখা হাতঘড়িতে সময় দেড়টা। একটু তন্দ্রার মত এসেছিল, হঠাৎ ভেঙে গেল! কে কাঁদছে। মেয়েলি গলা, ফোঁপানি গোঙানি মিশিয়ে কেমন একটু বিকৃত। কিন্তু খুব কাছেই ; হয়ত দরজা খুলেই অনন্ত দেখতে পাবে একটি বিকীর্ণকবরী, অবিন্যস্তবেশ নারীদেহ চৌকাঠের ওপর উপুড় হয়ে আছে। লোভ গেল, তবু অনন্ত দরজা খুলল না ; খুললেই ভেঙে যাবে এই স্বপ্নমায়ামতিভ্রম ; হয়ত অশ্রুরক্ত দুটি চোখ তুলে যে তাকাবে, সে যৌবনোত্তীর্ণা। জগদিন্দু গাঙ্গুলির ভাষায় ঝি-ক্লাসের।
একেবারে শেষ রাতের ঘুম, ভাঙল দেরিতে। দরজা খুলে অনন্ত যখন বারান্দায় এল, তখন রকে রোদ এসে গেছে। একটা চটের বস্তা হাতে জগদিন্দু কোথায় বেরুচ্ছিলেন।—‘এই উঠলেন? তা হলে গাঢ় ঘুম হয়েছিল বলুন। বলেছি না, অন্নপূর্ণা আশ্রমে কোন অসুবিধে নেই, খালি খাবেন, ঘুমোবেন।’
চটের থলেটার দিকে আঙুল দেখিয়ে অনন্ত বলল, ‘এটা?’
‘বেড়াল। পার করতে যাচ্ছি। কাল সারারাত বাইরে কেঁদেছে। বেড়ালের কান্না বড় অমঙ্গল।’
গাঙ্গুলি বেরিয়ে যেতেই কী মনে হল অনন্তর, হাঁটু ভেঙে বসল মাটিতে। সন্দেহ নেই, ওর চোখে ধুলো দিতে সাজানো একটা কথা বলে গেছে গাঙ্গুলি। এই চালাকিটা ধরে ফেলতে হবে। ভিজে শানে দু’-এক গাছি দীর্ঘ চুল এখনও চৌকাঠের কাছে লেগে আছে, অনন্তর বিশ্বাস।
কিচ্ছু পাওয়া গেল না। আজ খুব ভোরেই কে যেন সন্তর্পণ হাতে কালকের অশুপাতের চিহ্নটুকু মুছে নিয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনন্ত উঠে দাঁড়াল।
‘চা আনব?’ প্রশ্নটা এল দরজার বাইরে থেকে, ভঙ্গি তেমনি কুণ্ঠিত।
‘আন।’ কালকে আপনি বলেছে, আজ হঠাৎ ‘তুমি’টা একটু শ্রুতিকটু শোনাল।
শোনাক। ইচ্ছে করেই একটু রূঢ় হল অনন্ত। অকুলজা, হয়ত কুলটা, একটি অস্তরূপা রমণীকে সম্মান দেখিয়ে যে ভুল করেছে, তার প্রায়শ্চিত্ত না করা পর্যন্ত ওর ভদ্র মনের শান্তি নেই।
তাই একটু পরেই চায়ের কাপটাও ঠেলে দিল অনন্ত। প্রায় চেঁচিয়ে বলল, ‘এত কম চিনি দিয়েছ কেন, এটা কি চা হয়েছে?’
বলেই বুঝল, বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। কম চিনি চায়ে কি জিভ এতটা তিতো হয়, হতে পারে? নাকি, কালকের ঘুম-না-হওয়া অবসাদটুকু বিষ হয়ে জড়ো হয়েছে চিত্তে—অনন্ত আর মাত্রা ঠিক রেখে মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারছে না।
মাথা নিচু করে মেয়েটি চায়ে চিনি মেশাচ্ছে ; সেই অবসরে অনন্ত ওকে খুঁটিয়ে দেখল। ঝি ক্লাসের বলে জগদিন্দু কী বোঝাতে চেয়েছে সেই জানে, অনন্তর মন কিন্তু এই বর্ণনায় সায় দিল না। একটু আগেই আঘাত করেছিল ; আবার এখন, এই পরমুহূর্তেই, শান্ত, ত্রস্ত, বিব্রত এই মেয়েটির প্রতি মন করুণাপ্লুত হয়ে গেল।
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে অনন্ত আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম কী।’
পশুপতি মজুমদার নিজেই আলাপ করে গেলেন।
ফিতে-বাঁধা জুতো, ধুতির ওপর গলাবন্ধ কোট, চেনঘড়ি। ব্যাকরণ মিলিয়ে বাবু।’চেঞ্জার? কাল এসেছেন? নমস্কার মশাই। আমি এখানকার একজন বোর্ডার। বেশ, ভাল, এখন আফিসে যাচ্ছি, বিকেলে আলাপ হবে। বেড়িয়ে আসা যাবে পাহাড় পর্যন্ত।’
একটু পরেই এসে তাড়া দিলেন জগদিন্দু। ‘স্নান সেরে নিন।’
অনন্ত সবে একটা চিঠি লিখতে শুরু করেছিল, বলল, ‘এখন না। একটু পরে।’
‘দেরিতে খাওয়া অভ্যেস? তা বেশ। আমি তা হলে খেয়ে নিই মশাই? দোষ নেবেন না। আমার আবার অফিসের বেলা হল।’
আস্তে আস্তে কেমন নিঝুম হয়ে গেল বাড়িটা! একটি মানুষের পায়ে চলার শব্দটুকু নেই। দরজা ভেজান, জানালা বন্ধ, ঘর কেমন ছায়া-ছায়া, স্তিমিত। গোটা কয়েক চড়ুইপাখি এতক্ষণ মেজেয় চাল খাচ্ছিল খুঁটে খুঁটে, তারাও কখন দেয়ালের ফোকরে বাঁধা বাসায় আশ্রয় নিয়েছে।
ভেজান দরজা একটু আলগা হল, কবাটে কব্জায় আওয়াজ হল, অনন্ত মাথা না ফিরিয়েই বুঝতে পেরেছিল।
‘স্নান করুন।’
মুখ ফেরাতেই চোখে চোখ পড়ে গেল। অনন্ত বলল, ‘এস সুরমা।’
সঙ্গে সঙ্গে সুরমা দু পা পিছিয়ে গেল। সেই সঙ্কোচ, নিষ্প্রভদ্যুতি চোখে আতঙ্ক। তীব্র দ্রুতস্বরে বলে উঠল, ‘না, না, না। ভেতরে না,’ আর, অনন্তকে কিছু বলবার অবসর না দিয়েই অন্তর্হিত হল।
স্নান সেরে ঘরে ফিরে অনন্ত দেখল, টুলের ওপর খাবার ঢাকা আছে। খেতে শুরু করেও বারবার দরজার দিকে তাকাল, হয়ত সুরমা এসে জিজ্ঞাসা করবে আর কিছু চাই কি না। কিন্তু কেউ এল না। আর কিছু যাতে না লাগে, সুরমা পরিমাণটা সেই রকম হিসাব করেই দিয়েছে। থালাতেই হাত ধুয়ে অনন্ত শুয়ে পড়ল।
ঘুম হল না। নিমগাছের ডালে ক’টা কাক চিৎকার করছে ক্রমাগত, সমুখের রাস্তাটা দিয়ে সময় বুঝে ঠিক এখুনি কতগুলো বয়েল গাড়ি হাঁকাচ্ছে গাড়োয়ান ; অনন্ত চোখ বুজে পড়ে রইল।
কতক্ষণ ছিল, হিসাব নেই, হঠাৎ ঠুনঠুন শব্দ হতেই চোখ মেলল। চুপিচুপি এসে সুরমা এঁটো বাসন নিয়ে যাচ্ছে।
‘এই, শোন।’
সুরমার পা দুটি থরথর কাঁপল, কিন্তু পালাল না। ফিরে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বলল, ‘বলুন।’
আদেশ, শাসন, ব্যাকুলতা সব মিশিয়ে অনন্ত ঝোঁকের মাথায় ডেকে বসেছিল। কী বলবে, ঠিক ছিল না। কোন কথা ভেবে রাখেনি। কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে চেয়ে রইল।
সুরমা একটু অপেক্ষা করে আবার বললে, ‘কী বলবেন, বলুন।’
এতক্ষণে অনন্তর বুঝি খেয়াল হয়েছে, কিছুই বলবার নেই ; তাই অনেক ভেবেচিন্তে একটা নিরর্থক, ছেলেমানুষি প্রশ্ন করে বসল, ‘এ হোটেলে আর কোন কাজ করবার লোক নেই, না?’
ঘাড় নেড়ে সুরমা জানালে, না।
‘হোটেল কত দিনের?’
‘বিশ বছরের।’
কী মতিভ্রম হল অনন্তর, একটা কাণ্ড করে বসল।
খপ করে সুরমার দু’টি হাত ধরে বলল, ‘এই বিশ বছর ধরেই তুমি এখানে ঝিগিরি করছ সুরমা?’
ছিটকে সরে গেল সুরমা। ‘না, না, না।’ ঝনঝন শব্দ। একটা কাঁচের ডিশ চুরমার হয়ে গেছে মাটিতে পড়ে। সুরমা তীরের মত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
না, না, না। কী বলতে চাইল সুরমা? ও ঝি না, না ওকে ছুঁতে মানা?
আশ্চর্য, এর পরেও সুরমা ফিরে এল কিন্তু। অনন্ত কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু টের পেল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেজে থেকে কাঁচের টুকরোগুলো সুরমা কুড়িয়ে নিচ্ছে।
স্নায়ুর সব শ্রান্তি ফোঁটা ফোঁটা ঘাম হয়ে ফুটল অনন্তর কপালে। এ কী খেলা, কিছু বোঝা যায় না। কেন পালায় বারবার। পালায় যদি ফিরে ফিরে আসে কেন।
ধড়মড় করে অনন্ত উঠে বসল, দরজা আগলে দাঁড়াল। সুরমার বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, ‘তোমাকে একটা শুধু কথা বলব সুরমা। আমার কোন মন্দ অভিপ্রায় নেই, বিশ্বাস করো। তোমাকে দেখে একটা খটকা লেগেছে, তুমি সেটা শুধু মিটিয়ে দাও।’
‘বলুন।’
অনন্ত বলল, ‘কিসের এত ভয় তোমার। কাকে। কেন।’ মুখ তুলে তাকাল সুরমা। বোধ হয় বিশ্বাস করা যায় কি না ভাবল। তারপর চোখ নামিয়ে বলল, ‘বলব। আপনাকে সব কথাই বলব। পরে। এখন পথ ছাড়ুন। এগুলো ফেলে দিয়ে আসি।’
॥ ২ ॥
পশুপতি মজুমদার বললেন, ‘বড় সাংঘাতিক মেয়ে এই সুরমা। শতহস্ত দূরে রাখবেন।’
চড়াইয়ের পর চড়াই, দু’পাশে গভীর খাদ, পাহাড়ের গা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠেছে উপবীত পথ। অনন্তর অভ্যাস নেই, দেহ দুর্বল, রীতিমত কষ্ট হচ্ছিল। পশুপতি গলা ঢেকেছেন কম্ফর্টারে, কান টুপিতে, কিন্তু পাথরের ধাপগুলো টপকে যাচ্ছেন অনায়াসে।
‘আসুন এখানটাতে বসা যাক। এটার নাম প্লেনভিউ পয়েন্ট।’
‘সুরমার কথা বলছিলেন।’ অনন্ত মনে করিয়ে দিলে।
একটা পাথরের নুড়ি গড়িয়ে দিলেন পশুপতি। ‘হ্যাঁ, বড় সাংঘাতিক মেয়ে। জানেন, ও একবার জগদিন্দুকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করেছিল?’
‘মেরে ফেলতে?’
‘হ্যাঁ, খাবারে বিষ মিশিয়ে।’
অনন্তর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা শিহরন বয়ে গেল। একটি নম্র, ত্রস্ত, ভীরু মেয়েকে প্রাণহরূপে কিছুতেই কল্পনা করতে পারলে না।
পশুপতি ওর মনের কথা আন্দাজ করে নিলেন। ‘ভাবছেন, সে কী করে হয়, না? কিন্তু মনে রাখবেন, সুরমার এমন দিন বরাবর ছিল না। ওর রূপ ছিল, তেজ ছিল। মনের জোর ছিল। সেই জোরে একদিন ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল।’
‘কার সঙ্গে?’
‘জগদিন্দুর।’
‘আবার তাকেই বিষ খাওয়াতে গিয়েছিল?’
বিজ্ঞের মত হাসলেন পশুপতি। সিগারেটে কড়া টান দিলেন। ‘স্ত্রী-চরিত্র, মশায়, এমনি। ভালবাসার লোকের জন্যে প্রাণ দিতে পারে ; আবার সে ভালবাসা ছুটলে প্রাণ নিতেও পারে।’
‘ওদের ভালবাসা ছুটল কেন।’
পশুপতি একটু যেন বিরক্ত হলেন। ‘এত কথা জানতে হলে তো মশাই অন্তর্যামী হতে হয়। তবে অনুমান করতে পারি। যার জন্যে সব কিছু পরিত্যাগ করে এল, ভাল ঘর, বর, দু’দিন বাদেই হয়ত দেখল, সে মানুষ নয়।’
‘মানুষ নয়?’
‘মানুষ বইকি, পুরুষমানুষ, অত্যন্ত স্থূল, দৈহিক অর্থে। নইলে জগদিন্দুর আছে কী। না শিক্ষা, না রুচি, না চবিত্র।’
‘তবে কী দেখে সুরমা ভুলেছিল!’
পশুপতি বললেন, ‘কী দেখে মেয়েমানুষ ভোলে, তারা নিজেরাও জানে না। হিংস্র হয়ে ওঠে সেই ভুল ভাঙলে। সুরমার তখনকার মনের অবস্থা ভাবুন। নৌকো ডুবিয়ে দিয়ে পাড়ে উঠেছে, অথচ সামনের পথে কাঁটা। কলসি ঝাঁঝরা হয়ে সব সুধা ঝরে গেছে, যেটুকু লেগে আছে, সেটুকু বাসি, বিষ। সেই বিষই সুরমা জগদিন্দুকে খাওয়াতে গেল। নিজে খেলেই ভাল করত। কিন্তু তাতে আরও মনের জোর দরকার।’
অল্প অল্প হিম পড়ছে, কনকনে হাওয়া। অনেক নিচে, মসৃণ সমতল পথে সন্ধ্যার বিজলী আলো জ্বলে উঠেছে, অসংখ্য ছোট ছোট জোনাকিফোঁটা ; আকাশের নীল আয়নায় তার ছায়া।
পশুপতি বললেন, ‘কী ভাবছেন।’
অনন্ত উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘বিশেষ কিছু না। ভাবছি এর পরেও ওরা এক সঙ্গে থাকল কী করে। জগদিন্দু কি জানত, কে বিষ মিশিয়েছিল ওর থালায়?’
‘জানত না? যন্ত্রণায় গোঁ-গোঁ করেছে, ছটফট করেছে মেজেয় পড়ে, সুরমা তখনও সামনে দাঁড়িয়ে ; এক গ্লাস জল পর্যন্ত দেয়নি। তারপর পাড়াপড়শি এল, ডাক্তার এল, জগদিন্দুর শরীর ততক্ষণ নিথর হয়ে এসেছে, কিন্তু চোখ দুটো তখনও খোলা। যমেমানুষে টানাটানি চলল।’
‘সুরমা?’
‘তখনো পাথরের পুতুলের মত সামনে দাঁড়িয়ে। কী শীতল, নিশ্চলমণি চোখে এ ওর দিকে তাকিয়েছিল, যদি দেখতেন। ঘৃণার কোন বস্তুরূপ থাকলে দু’জনেই সেদিন অন্ধ হয়ে যেত।’
মাঝে মাঝে পথ ভাঙা ; সাবধানে নামতে নামতে অনন্ত বলল, ‘এসব কতদিন আগেকার কথা?’
পশুপতি মনে মনে হিসেব করে বললেন, ‘তা প্রায় বছর কুড়ি হবে বইকি।’ একটু থেমে বললেন, ‘অবাক লাগছে?’
অনন্ত বলল, ‘একটু। সব জেনে-শুনেও জগদিন্দু সুরমাকে তাড়িয়ে দিল না? অনায়াসে বিশ বছর ঘর করল?’
পশুপতি হাসলেন। ‘জগদিন্দুর চরিত্র তবে আপনি কিছু বোঝেননি।’
বাকিটা পশুপতি ধীরে ধীরে ব্যক্ত করলেন।
বিষটা বোধ হয় তেমন মারাত্মক ছিল না, জগদিন্দু সে-যাত্রা বেঁচে গেল। সেরে উঠেই ডেকে পাঠাল সুরমাকে। চোয়াল বসে গেছে একদিনের ধকলে, কিন্তু চোখ দুটো ধকধক জ্বলছে। বলল, ‘তৈরি হয়ে নাও সুরমা, তোমাকে যেতে হবে।’
যেতে হবে সুরমাও জানে, ‘কিন্তু কোথায়?’ ‘কলকাতায়, তোমার স্বামীর কাছে।’
সঙ্গে একজন বিশ্বাসী লোক দেবে জগদিন্দু, সে সুরমাকে তার স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে আসবে।
সুরমার মুখ পলকে বিবর্ণ হয়ে গেল। এ দু’ দিন চোখে জল ছিল না, শুকিয়ে আগুন হয়ে গিয়েছিল ; কিন্তু সেই মুহূর্তে কোথা থেকে মেঘ ছেয়ে এল। সুরমা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে, জগদিন্দুর পা দুটির ওপর মুখ রেখে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, ‘আমাকে পুলিসে দাও আর যা খুশি শাস্তি দাও, শুধু কলকাতা পাঠিও না।’
জগদিন্দু টেনে নিল না পা দু’খানা। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকল। তারপর কঠিন সুরে বলল, ‘বেশ, তোমাকে অন্য শাস্তিই দেব আমি। না না, পুলিসে নয়। তোমাকে ক্ষমা করলাম।’
সেই ক্ষমা যে শাস্তিরই রকমফের, সুরমা তখন যদি জানত। দিন-দুই পরে, একটু সুস্থ হয়েই জগদিন্দু বাড়ি থেকে বেরুল। ফিরে এল, কোলে একটা মিউমিউ বেড়ালের বাচ্ছা।
সুরমা ভেবেছিল মেঘ কেটে গেছে ; ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ আবার কী!’
জগদিন্দু এখনো গম্ভীর। বললে, ‘এমনি।’
রাত্রে খেতে বসে জগদিন্দু ডাকলে ‘পুসি, পুসি, আয়।’
খাটের নিচে না কোথায় ছিল বেড়ালটা লাফিয়ে এল পাতের কাছে, লুব্ধ কটা চোখে চেয়ে রইল। জগদিন্দু করল কি, এক গ্রাস ভাত মেখে ছড়িয়ে দিল ওর সামনে। বেড়ালটা চুকচুক চাটতে শুরু করেছে, জগদিন্দু মিটমিট হেসে বললে, ‘যাও, মাছ তরকারি আর কী কী আছে নিয়ে এস।’
সুরমার মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল। রুদ্ধ গলায় বললে, ‘এ আবার কী!’
জগদিন্দু বললে, ‘এমনি। পরীক্ষাটা ওর ওপর দিয়েই হয়ে যাক।’
এমনি ধারা প্রতিদিন। খেতে বসেই জগদিন্দু ডাকে ‘পুসি, পুসি, আয়।’ ভাত মাখে, ছড়ায়। বড় বড় চোখে লক্ষ করে, কোন ছটফট অস্বস্তি আছে কি না। তারপর নেই দেখে, মুখে নিশ্চিন্ত গ্রাস তোলে।
আজ বিশ বছর ধরে এই চলছে। একদিনও জগদিন্দু নিয়ম ভঙ্গ করেনি।
অনন্ত নির্বাক হয়ে শুনছিল। বলল, ‘অদ্ভুত প্রতিশোধ তো!’
পশুপতি বললেন, ‘অদ্ভুত বৈকি। ভেবে দেখুন, আজ বিশ বছর ধরে দুটো মুন এক ছাতের নিচে বাস করছে, অথচ একফোঁটা ভালবাসা নেই, বিশ্বাস নেই। শুধু একের অপরের ওপর অপরিসীম ঘৃণা।’
অনন্ত বললে, ‘কিন্তু সুরমা তো আত্মহত্যা করতে পারত।’
পশুপতি হাসলেন। ‘তাতে আরও বেশি সাহসের দরকার। মনের কতখানি জোর একটা মেয়েমানুষের থাকতে পারে, অনন্তবাবু? ঘর থেকে ঝোঁকের মাথায় বেরিয়ে আসতেই অনেকটা ফুরিয়ে গিয়েছিল। যেটুকু বাকি ছিল, সেটুকুও সুরমার খরচ হয়ে গিয়েছিল জগদিন্দুকে বিষ দিতে গিয়ে। তারপর থেকেই ওর ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। সব সময় একটা অপরাধবোধ, হাত কাঁপে, পা কাঁপে, চোখের পাতা কাঁপে। কোন রকমে আজকের অস্থিহীন অস্তিত্বকে টেনে নিয়ে কালকের খাতায় জমা দিচ্ছে। ডাক্তারি ভাষায় একেই বোধ হয় স্নায়ুভঙ্গ বলে। সেই সুযোগে—’
‘সেই সুযোগে কী।’
পশুপতি বললেন, ‘সেটা জগদিন্দুর প্রতিহিংসার স্থূলতার দিক। এই যে হোটেল দেখছেন, এর সবই সুরমার টাকায়। ওর মানসিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে জগদিন্দু ধীরে ধীরে ওর গহনার বাক্স গ্রাস করেছিল। আর—’
‘আর কী!’
পশুপতি বিচিত্র হাসলেন। ‘জগদিন্দুর ক্ষমা করার আরও একটা শর্ত ছিল। সেটা আরও স্হূল। কিন্তু সেটা আমার মুখে নাইবা শুনলেন। একদিন মাত্র এসেছেন, নিজেই টের পাবেন।’
হোটেলে নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে অনন্ত আলো জ্বালল। সঙ্গে সঙ্গে একটা বেড়াল ওর বিছানা থেকে এক লাফে উঠে গিয়ে বসল জানালায়।
আশ্চর্য কিছু নয়, তবু সারা গায় কাঁটা দিল অনন্তর। চিনতে পেরেছে। এটাকেই জগদিন্দু রোজ ডেকে ডেকে ভাত খাওয়ায়, কে জানে, এটাই হয়ত কাল সারারাত ওর দরজার বাইরে কেঁদেছে। ঘৃণায়, আক্রোশে, আতঙ্কে মুহূর্তের জন্যে যেন বুদ্ধিভ্রংশ ঘটল অনন্তর। হাতের কাছে কিছু নেই। কিন্তু পায়ের জুতো আছে। সেটাই খুলে নিয়ে অনন্ত প্রাণপণ শক্তিতে ছুঁড়ে মারল।
‘পারলেন না, ফসকে গেল।’
চমকে ফিরে তাকাল অনন্ত। জগদিন্দু গাঙ্গুলি। মৃদু মৃদু হাসছে। ‘ফসকে গেল তো। ওটাকে মারা অত সোজা নয়, ওটা আসল শয়তানী। আজ সকালে পার করে দিয়ে এসেছিলুম। আবার এসেছে।’
অনন্ত তখনো হাঁপাচ্ছে। চোখের পাতা দুটোর দপদপ উত্তেজনা কমেনি। কোনমতে চারপাইটার দিকে আঙুল দেখিয়ে জগদিন্দুকে বলল, ‘বসুন।’
জগদিন্দু বললেন, ‘আজ এই হোটলের এমন হাল দেখছেন, বরাবর এমন ছিল না। অন্নপূর্ণা হোটেল এক সময় লোকে গিসগিস করেছে। দু’ তিনজন ঠাকুর বাবাজী রেঁধে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। সাত-আটটা চাকর অহোরাত্র ফরমাশ খেটেছে।
‘তখন থাকবার আস্তানা বলতে ছিল ওই বলদেওদাস ধরমশালা, তাও চামচিকে আর ইদুঁরের ভয়ে ওখানে বেশি লোক যেত না। আর হোটেল বলতে এই অন্নপূর্ণা আশ্রম। ভিড় হত শিবরাত্রির সময়ে সবচেয়ে বেশি, লোকে মঙ্গলায় স্নান সেরে মহাকালেশ্বরের মন্দিরে গিয়ে বিগ্রহ দর্শন করত। মঙ্গলা কি আর নদী, পাহাড়ের ঘাম, ডুবগোড়ালি জল। তাতেই লোকের ভক্তি কত।
‘সাধু-সন্ন্যাসীরা বেশিরভাগই উঠত ধরমশালায়, অনেকে আবার মন্দিরের বাইরের অশথ গাছটার নিচেই ধুনি জ্বেলে শীতের রাত ফর্সা করে দিত। অন্যান্য যারা, ধরুন পুত্রকামনায় এসেছে, কিংবা কোন মানত রক্ষা করতে, তারা আর যাবে কোথায়, উঠত এখানে, এই অন্নপূর্ণা আশ্রমে।
‘ভনভন মাছির মত ট্যুরিস্টের ঝাঁক পড়তে শুরু হয়েছে মাত্র এই বছর দশেক। এদের ধর্ম নেই, ভক্তি নেই, ক্যামেরার চামড়ার ফিতেটাকেই পৈতে করে নিয়েছে। বছর পনেরো আগে এখানে এসেছিল, সরকারি পেত্নীতত্ত্ব বিভাগের লোক ; তারা কবর খুঁড়ে খুঁড়ে বার করতে লাগল ক’ হাজার বছর আগেকার মানুষের কঙ্কাল, ঘরদোর। খবরের কাগজে সে কী লেখালেখি! বাস, আর যাবে কোথায়। গন্ধে গন্ধে এল কলকাতা না বোম্বায়ের এক সাহেব হোটেল, ব্রাঞ্চ খুললে। তাদের দেখাদেখি আরও দুটো।
‘তাদের সঙ্গে পারবে কেন অন্নপূর্ণা আশ্রম! এখানে কি লালজল খাওয়ানোর বন্দোবস্ত আছে, না এখানে নাচের সঙ্গে বাদ্যি বাজে। খদ্দের গেল, ঠাকুর গেল, চাকর গেল, পাহাড় বেয়ে নুড়ি গড়ানোর মত পড়তে থাকল জগদিন্দু গাঙ্গুলির ভাগ্য।’
অনন্ত চুপ করে শুনছিল। বলল, ‘ক’জন বোডার আছে এখন।’
জগদিন্দু বললেন, ‘ক’জন আর, আপনাকে নিয়ে তিনজন। মজুমদার মশায়ের সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছে। উনি আছেন গোড়া থেকেই। সরকারি অফিসে কাজ করেন, হাড়কেপ্পন মশাই, বিশ বছর হোটেলে কাটালেন, তবু বাসা করলেন না, ন’মাস ছ’মাসে দেশে গিয়ে পরিবার-পরিজন দেখে আসেন। আরেক জনকে আপনি দেখেননি, তিনি ছ’ মাস হল এসেছেন। কী এক কোম্পানির এজেন্ট, ঘোরাঘুরির কাজ, এই হোটেলে, বুড়ি ছুঁয়ে থাকার মত, বিছানাটা শুধু পাতা থাকে, নইলে মাসের পঁচিশ দিনই উনি কাটান ট্রেনে ট্রেনে।’
‘এই দু’জন মাত্র লোক নিয়ে আপনার চলে?’
‘চলে আর কই। দায়ে ঠেকে জগদিন্দুকে চাকরি নিতে হয়েছে! ঠিক চাকরি নয়, নিম-স্বাধীন, পোস্ট অফিসে স্ট্যাম্প ভেণ্ডার। সামান্য কমিশন, মনি অর্ডার আর লেফাফায় পাত্তা লিখে লিখে আর কটা পয়সা হয়।’
উঠে যেতে যেতে জগদিন্দু বললেন, ‘আমি তা হলে চলি এবার। আপনি বিশ্রাম করুন। যদি—যদি রাত্রে কোন অসুবিধে হয় তবে একটা খবর দেবেন। নিজে যদি না যেতে পারেন, সুরমাকে দিয়ে ডেকে পাঠাবেন! সে এই দু’খানা ঘর পরেই থাকে।’
কথায় কথায় মনটা হাল্কা হয়ে এসেছিল, জগদিন্দুর শেষ কথাটায় অনন্ত আবার চমকে উঠল। যত ভয় সব যেন এক সঙ্গে গ্রাস করেছে ওকে। নিমগাছের ডালে সরসর শব্দ, চৌকাঠের বাইরে সারারাত কান্না। আর নিঃশব্দ চপল পায়ে একটা বেড়ালের ঘরময় ঘোরাঘুরি। দরজা বন্ধ করে শুতে সাহস নেই, আবার খুলতেও ভয়। বেড়ালটাকে তাড়াতে চায়, হাত ওঠে না। বিছানায় পড়ে রইল ঝিম ধরে, ঘামল, আর মনে হল ওর নাক, চোখ-গলার ভেতরটা পর্যন্ত সাদা সাদা রোঁয়ায় ঢেকে গেছে।
সেই রাত্রে অনন্তর প্রবল জ্বর এল।
॥ ৩ ॥
শ্রান্ত চোখ দুটি মেলল, কত পরে, কতদিন পরে, হিসেব নেই, তখনো চেতনা আবিল, স্বপ্নাচ্ছন্ন। দেখল, শিয়রে সুরমা দাঁড়িয়ে।
অনন্ত বলল, ‘এ কী।’
‘ওষুধ। উঠে বসতে পারবেন?’
‘পারব,’ অনন্ত বলল, ‘তুমি শুধু আমার হাত দুটো ধরো।’
উঠে বসেও অনন্ত অন্য দুটি হাত ছাড়ল না। চোখে রাখল, কপালে, বলল, ‘আঃ কী ঠাণ্ডা। আমার কত জ্বর হয়েছিল সুরমা?’
ততক্ষণ আবার সেই বিহুল ভয়-ভয় দৃষ্টি ফিরে এসেছে সুরমার চোখে। বলল, ‘একশো চার, পাঁচ। আমি এবারে যাই।’ হাত ছাড়িয়ে সুরমা দরজার দিকে দু’চার পা এগিয়ে গেল।
অনন্ত সঙ্গে সঙ্গে ঠেলে দিল ওষুধের গ্লাস। ‘খাব না, খাব না আমি।’ ওষুধ গড়িয়ে পড়ল বিছানায়, চাদর ভিজে উঠল।
সুরমা ফিরে এল, আঁচল দিয়ে মুছে নিল ওষুধটুকু। বলল, ‘আপনি ভারি ছেলেমানুষ তো! কী করতে হবে বলুন।’
ঘালাটে চোখের চাউনি ততক্ষণ অনেকটা স্বচ্ছ হয়ে এসেছে অনন্তর। ভাল ছেলের মত শুয়ে পড়ল, চোখ বুজে আবদারের গলায় বলল, ‘কিছু না, শুধু এখানে বসে থাক তুমি।’
নিঝুম ঘুম-ঘুম কয়েক মিনিট কাটল। আবার সিরসিরে ভয় নামল অনন্তর দুর্বল মগ্নচৈতন্যে। একবার মনে হল সে একা শুয়ে আছে, সুরমা কখন উঠে গেছে পা টিপে টিপে। ভয়ে ভয়ে চোখ মেলল। না যায়নি তো! যেমন ছিল, তেমনি বসে আছে শিয়রে, সন্ত্রস্ত, আড়ষ্ট। আবার অনন্ত একখানা শীর্ণ রুগ্ণ হাত টেনে নিল মুঠিতে। ধীরে ধীরে বলল, ‘আমি এখান থেকে চলে যাব সুরমা।’
সুরমা সাড়া দিল না।
অনন্ত আবার বলল, ‘কাল সকালেই। কলকাতা না গেলে এ জ্বর আমার ছাড়বে না।’
‘ক ল কা তা’ সুরমা উচ্চারণ করল ধীরে ধীরে, প্রতিটি বর্ণ স্বতন্ত্র করে।
অনন্ত বলল, ‘কলকাতা তোমার মনে আছে সুরমা?’
‘আছে,’ সুরমা বলল প্রথমে, তারপরই তাড়াতাড়ি জুড়ে দিল, ‘কি জানি, হয়ত নেই।’
অস্থিরভাবে অনন্ত বলেল উঠল, ‘আমি তোমার কথা সব শুনেছি সুরমা।’
সুরমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল, ওর মুঠিতে বন্দী হাতখানা ছুঁয়ে থেকেই অনন্ত সেটা অনুভব করল। সেই হাতখানা একবার রাখল কপালে, একবার চোখের পাতায়, টেনে আনল নাকের ডগায়, তারপর ঠোঁটে ছোঁয়াতে গিয়েই অনন্ত বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মত চমকে উঠল। এই হাতেই কি, সুরমা বিষ তুলে দিয়েছিল জগদিন্দুকে? দপদপ করে উঠল কপালের শিরা, গলা শুকিয়ে গেল, প্রবল বিতৃষ্ণায় হাতটা সরিয়ে দিয়ে অনন্ত শুধু বলতে পারল, ‘একটু জল।’
আগ্রহে ছিনিয়ে নিয়ে গ্লাসের ওপর ঝুঁকে পড়ল অনন্ত, সঙ্গে সঙ্গে হাত থরথরে কেঁপে উঠল। দেখতে পেয়েছে। অসহায় শিশুর মত অনন্ত আর্তনাদ করে উঠল, ‘ফেলে দাও, ফেলে দাও, বেড়ালের রোঁয়া গ্লাসে কিলবিল করছে, এ জল আমি খাব কী করে।’
দু’হাতে মুখ ঢেকে অনন্ত শুয়ে পড়ল, গোঙাতে থাকল, জল গড়িয়ে মেজে ভেসে যাচ্ছে, যাক। ক্ষিপ্র হাতে সুরমা সেই জলে ভিজিয়ে নিল আঁচল, অনন্তর তপ্ত কপাল, নিমীলিত চোখের পাতা দুটি মুছে দিতে থাকল।
ঠিক তখনই বাইরে কী একটা শব্দ হল। চকিতে মুখ ফেরাল সুরমা। কেউ না। একবার মাত্র গলা খাঁকারি দিয়েই পশুপতি মজুমদার অদৃশ্য হয়ে গেছেন।
পশুপতি মজুমদার বিকেলের দিকে সরকারিভাবে দেখতে এলেন। অনন্ত ততক্ষণ অনেকটা সামলে উঠেছে।
পশুপতি বললেন, ‘খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন মশাই। মাঝে মাঝে এমন অসুখ হয় নাকি আপনার।’
অনন্ত একটু লজ্জিত হাসল। ‘সেবার অসুখের পর থেকেই⋯মাঝে মাঝে⋯মানে একটু অনিয়ম হয়েছিল কিনা।’ বালিশগুলো জড়ো করে আনল পিঠের কাছে, ঠেস দিয়ে বসে ফের বলল, ‘আমি কালই চলে যেতে যাই পশুপতিবাবু। আপনি একটু বন্দোবস্ত করে দেবেন, এই টিকিট কাটা, গাড়িতে তুলে দেওয়া-টেওয়া আর কী।’
পশুপতি বললেন, ‘এ আর বেশি কথা কী। কিন্তু হঠাৎ কী হল বললেন না তো।’
অনন্ত ম্লান হেসে বলল, ‘কিছু না। আচ্ছা, আপনাকে তিনটে প্রশ্ন করব পশুপতিবাবু. জবাব দেবেন?’
‘প্রশ্ন না শুনে বলতে পারছিনে।’
সেদিন আপনি জগদিন্দু যে যে শর্তে সুরমাকে ক্ষমা করেছিল, ‘তার কিছু আভাস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আরও একটা শর্ত ছিল, কিন্তু সেটা ভাঙেন নি। সেটা কী, পশুপতিবাবু?’
পশুপতিবাবু বিচিত্র হাসলেন।—‘আজও জানেন না? আপনি অবাক করলেন মশাই। এ হোটেলে তেরাত্তির না পেরোতেই সব বোর্ডার কথাটা টের পেয়ে যায় যে। আপনিও পেয়ে গেছেন ভেবেছিলুম। বিশেষ—পশুপতি এখানে একটু অর্থপূর্ণ কাসলেন, ‘আজ তাড়াতাড়ি অফিস ছুটি হয়েছিল, তাড়াতাড়ি ফিরলুম। তখনই আপনাকে দেখে যাব ভাবলুম, কিন্তু ঘরে ঢুকতে পারলাম না।’
‘কেন?’
পশুপতি আবার একটু হাসলেন। ‘দেখলুম, আপনার মাথাটা কোলের মধ্যে নিয়ে একজন আঁচল নিংড়ে নিংড়ে—’
অসহিষ্ণু কণ্ঠে বাধা দিলে অনন্ত—‘হ্যাঁ, সুরমা। কিন্তু তার সঙ্গে শর্তের সম্পর্ক কী, পশুপতিবাবু! আপনি আসল কথাটা কেবলই এড়িয়ে যাচ্ছেন।’
একটু ভ্রূকুটি করলেন পশুপতিবাবু, একটু বা রুষ্ট হলেন। —‘ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা আমার স্বভাব নয়, অনন্তবাবু। শুধু একটা কদর্য কথা আভাসে বলতে চেয়েছিলুম। শুনুন তবে।’ মুখের পেশী কঠিন হয়ে এল পশুপতির, খাদগলায় ধীরে ধীরে বললেন, ‘গত বিশ বছর ধরে যতজন এই হোটলে বাস করে গেছে অনন্তবাবু, তাদের প্রায় কাউকেই একলা রাত কাটাতে হয়নি।’
অনন্তর পাণ্ডুর মুখ ভরে গেছে রক্তোচ্ছ্বাসে। দীর্ঘ, রুক্ষ, অবিন্যস্ত চুলগুলো ধরেছে মুঠি করে। একটি ভ্রমর যেন এতক্ষণ মগজের মধ্যে চক্রাকারে গুনগুন করছিল, এবারে হঠাৎ দংশন করেছে কোরকের মর্মমূলে। যন্ত্রণায় মুখপেশী বিকৃত হয়ে গেছে, প্রাণপণে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরেছে অনন্ত।
কখন উঠে ঘরময় পায়চারি করতে শুরু করেছিল, একবার থেমে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই শর্ত?’ পশুপতি বললেন, ‘এই।’
‘এতে জগদিন্দুর লাভ?’
ভয়ঙ্কর একটা কথা বলে পশুপতি ভারমুক্ত হয়ে গেছেন, এখন আর সঙ্কোচ নেই। অনায়াসে বললেন, ‘দ্বিবিধ। এক, সুরমাকে শাস্তি দেওয়া। দুই—’
অনন্ত বললে, ‘বুঝেছি, হোটেলের স্বার্থ। কিন্তু এতে কি সত্যিই কোন লাভ হয়?’
‘আগে হত। এখন আর হয় না। সুরমার বয়স হয়েছে। তা ছাড়া এখনকার লোকের রুচি বদলেছে। অন্যান্য হোটেলেও, এখানকার মত এতটা খোলাখুলি, স্হূল, না হলেও এন্টারটেনমেন্টের আয়োজন আছে। সেখানে গান আছে, বাজনা আছে, নাচ আছে। সুরমার কতটুকু পুঁজি বলুন!’
কিছুক্ষণ পরে অনন্ত বললে, ‘আমার আর একটা সংশয় আছে। আপনি যা বলছেন তা যদি ঠিক হয়, তবে—তবে, প্রথম দিকে সুরমা কেন আমার ঘরে আসতে চায়নি। সব সময় কী একটা সঙ্কোচ, ভয় দেখেছি ওর চোখে।’
সর্বজ্ঞের মত হাসলেন পশুপতি।—‘তারও ব্যাখ্যা আছে। যত লোক আসে, তাদের সবাই তো সমান হয় না অনন্তবাবু। তাদের একজন সুরমাকে একবার সন্তান দিয়েছিল, আরেকজন রোগ। সেই থেকেই আগন্তুক এলেই সুরমার আতঙ্ক।’
রুদ্ধ, দ্রুত, চাপা স্বরে অনন্ত বলে উঠল, ‘কী হল সেই ছেলে?’
‘জগদিন্দু জাতমাত্র নষ্ট করেছে।’
‘আর রোগ?’
‘সেরেছে কি না ঠিক বলতে পারি না।’
পশুপতি উঠবেন-উঠবেন করছিলেন, অনন্ত শিশুর মত তাঁকে আঁকড়ে ধরল।—‘আরেকটা কথার জবাব দিয়ে যান পশুপতিবাবু।’ গলাটা একবার পরিষ্কার করে নিল অনন্ত, যেন কথাটা কীভাবে বলবে স্থির করতে পারছে না।—‘আজ বিশ বছর ধরে যতজন এই হোটেলে এসেছে, তাদের সবাইকে সুরমা কি শুধু ঘৃণাই করে গেছে, একজনের ওপরও মায়া পড়েনি?’
পড়েছিল বৈকি। পশুপতি আবার পুরনো দিনের পাতা ওলটালেন।
তখন সবে এখানে এক্সকাভেশান শুরু হয়েছে। সামান্য কিছু কিছু পাওয়া গেছে, তার ঐতিহাসিক মূল্য অনিশ্চিত। সরকারি গ্রান্ট নিয়ে এখানে রিসার্চ করতে এল নীলাম্বুজ মৈত্র। বয়স বেশি না, তেইশ কি চব্বিশ। ভাসা-ভাসা বড় বড় দুটি স্বপ্ন দেখা চোখ ; শুধু অতীতের প্রস্তরমূর্তিতেই দিব্যরূপ দেখে না, রক্তমাংসের নারীদেহও দেখে। সুরমা যথারীতি ওকে আত্মদান করল, কাঁচামন নীলাম্বুজ ভাবল প্রেম। রিসার্চ মাথায় থাকল, দিনরাত রুদ্ধদ্বার ঘরে দু’জনের গল্প। প্রথমে নীলাম্বুজ লাজুক ছিল, ভাল করে গুছিয়ে কথা বলতে জানত না, সুরমা ওকে সাহস দিয়েছে। মনের মত শ্রোতা পেয়ে নীলাম্বুজ মহাখুশি। আলাপের পাল তুলে ওরা ইতিহাসের উজানে চলে যায়। আসিরিয়া, বাবিলন, মেম্ফিস, মহেঞ্জোদাড়ো। সুরমা শোনে, বোঝে, বোঝে না, বোঝার ভান করে।
ওরা বুঝি এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার সংকল্পও করেছিল। কিন্তু কোথায় একটা অঘটন ঘটল, দু মাসের মাথায় নীলাম্বুজের নামে সরকারি চিঠি এল : তোমার রিসার্চের কোন প্রোগ্রেস দেখা যাচ্ছে না, পত্রপাঠ চলে এস।
এর আগে বুঝি ঠিক ছিল, এখানকার কাজ শেষ হলেই নীলাম্বুজের পাকা চাকরি হবে, নালন্দা মিউজিয়মে। স্বপ্নসৌধ ধসে পড়ল নিমেষে। বিরস মুখে নীলাম্বুজ যখন ঘোড়াগাড়িতে গিয়ে উঠল, তখন ওর মুখের চেহারা যদি দেখতেন!
‘এখানেই শেষ?’ অনন্ত জিজ্ঞাসা করল।
‘এখানেই।’ পশুপতি বললেন, ‘নীলাম্বুজ সুরমাকে কী ভরসা দিয়ে গিয়েছিল জানি না। তারপর মাসখানেক ধরে প্রতিদিন পিওন আসবার সময় সুরমা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। নীলাম্বুজের একটা ফোটো বুঝি ওর কাছে ছিল, লুকিয়ে লুকিয়ে সেটা দেখেছে।’
‘চিঠি আর আসেনি?’
‘মনে তো হয় না। তা ছাড়া নীলাম্বুজের সরকারি চাকুরিও আর হয়নি। যতদূর শুনেছি ও আজকাল একটা বেসরকারি কলেজে মাস্টারি করছে, আর এনসেন্ট ইণ্ডিয়ান হিস্ট্রির কোচিং ক্লাস খুলেছে ছাত্রদের নিয়ে।’
‘আর কেউ?’
‘আরো একজন এসেছিল, প্রায় বছর পাঁচেক পরে। ফেরারী পলিটিক্যাল আসামী গা-ঢাকা দিয়েছিল। তার আসল নাম জানা যায়নি, এখানে যে নাম লিখিয়েছিল, সেটা পশুপতির ঠিক মনে নেই, সুধন্য কিংবা ওই রকম কিছু হবে।
‘সেই সুধন্য সান্যালকেও ভালবেসেছিল সুরমা। আকৃতিতে সুধন্য নীলাম্বুজের ঠিক বিপরীত ; ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল, একজোড়া কর্কশ গোঁফ, নিরঙ্কুর দাড়ি কামানো, অমিশুক। মোটা মোটা বইয়ের মধ্যে ডুব দিয়ে থাকত। কিন্তু সেই আপাত-উদাসীনতার পর্দাও সুরমা সরিয়েছিল। পুঁথিপত্র থেকে পড়ে পড়ে সুধন্য নানা রাজনৈতিক মতবাদ ব্যাখা করে শোনাত, সুরমা শুনত। সুধন্যও ওকে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কি না জানা যায়নি।
‘বাড়াবাড়ি শুরু হতেই জগদিন্দু রাশ টানলে। এতটা সে চায় না, খদ্দের লক্ষ্মী, তাদের খুশি রাখতে হবে বইকি। একটু মাখামাখি, একটু শরীরের প্রয়োজন মেটান, কিন্তু তার সঙ্গে আবার মনের আপদ জোটে কেন।
‘সুতরাং দিনকত পরেই হোটেলের আশেপাশে পুলিসের চর ঘোরাঘুরি শুরু করল। বেগতিক দেখে সুধন্য একদিন সরে পড়ল শেষ রাতে।’
‘জগদিন্দুই পুলিসকে খবর দিয়েছিল?’
‘দিতে পারে,’ পশুপতি হাই তুলে বললেন, ‘আবার নাও পারে। হয়ত পুলিস এমনিই গন্ধে গন্ধে এসেছিল।’
‘সুধন্য আর কোন খবর নেয়নি?’
‘সম্ভব না। ওর খান-দুই বই ফেলে গিয়েছিল, তাতে ঠিকানা লেখা ছিল। সেই বই থেকে সুরমাকে দু’ বেলা ধুলো ঝাড়তে দেখেছি, লুকিয়ে সুরমা দু-একটা চিঠিও লিখে থাকবে। জবাব আসেনি।’
‘আর সুরমা?’
‘সুধন্যর সন্তান তখন ওর গর্ভে।’ পশুপতি উঠে দাঁড়ালেন, ‘সেই সন্তানটির কী হল, আপনাকে আগেই বলেছি।’
অনন্তও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। ‘আর একটা শুধু প্রশ্ন পশুপতিবাবু। আপনি এত খবর রাখতেন কী করে। এ গল্পে আপনার তো কোন ভূমিকা নেই।’
মৃদু হাসলেন পশুপতি।—‘নেই বলেই তো রাখা সহজ হয়েছে অনন্তবাবু। একটা জিনিস ভুলবেন না, আমি আপনাদের চেয়ে ঢের বড়। শুধু অনুভব দিয়েই অনেক কিছু বুঝতে পারি। বয়সই মানুষের তৃতীয়, দিব্য নয়ন।’
ব্যাখ্যাটা অনন্তর ঠিক মনঃপূত হল না, কিন্তু আর প্রশ্ন করবার সময় ছিল না। পশুপতি অকস্মাৎ অন্তর্হিত হয়ে গেছেন।
বাক্স বলতে একটা সুটকেস, বিছানাও সামান্যই। গুছিয়ে নিতে বেশি সময় লাগল না। জগদিন্দুর সঙ্গে অনন্ত ইতিমধ্যে দেখা করে এসেছে। হিসাবপত্র নিয়ে বোঝাপড়াও সারা।
যতক্ষণ মন স্থির হয়নি অনন্তর ততক্ষণ, এই ঘর, এই শ্বাসরোধকারী পরিবেশ যেন পাষাণ হয়েছিল বুকের ওপরে। তবু আশ্চর্য, এই যাবার প্রাক্মুহূর্তটিতে একটা অদ্ভুত বেদনাক্ত শূন্যতা বোধ হচ্ছে। ফেলে যাচ্ছে না কিছু, চশমা, রুমাল, চাবি, হাতঘড়ি সব ঠিক ঠিক জায়গাতেই আছে, এমনকি পুরনো চপ্পল জোড়াও কাগজে মুড়ে নিতে ভোলেনি। তবু! কী যেন নিতে চেয়েছিল, কিন্তু থুয়ে যেতে হল, মনের কৌটোয় ধরা না দেওয়া একটা ছটফট মৌমাছি।
‘ঘোড়াগাড়ি এসে গেছে।’
অনন্ত জানালার শিক ধরে বাইরে নিমগাছটার দিকে চেয়ে ছিল, পিছন ফিরতেই দেখল সুরমাকে। বিব্রত, কুষ্ঠিত, নতনেত্র। সঙ্গে সঙ্গে শনাক্ত হয়ে গেল অস্বস্তিটুকু।
‘গাড়ি এসে গেছে।’ সুরমা আবার বলল।
‘এই যে যাই।’ সুটকেস হাতে নিয়ে অনন্ত উঠে দাঁড়াল। ঠিক সেই মুহূর্তে নিমগাছের ডালে সরসর ডানাঝাপটানি শোনা গেল, জ্যোৎস্না-অন্ধ দুটো পেঁচা বুঝি আশ্রয় খুঁজছে পাতার অন্ধকারে, অনেক দূরে কেঁদে উঠল শীতার্ত একটা কুকুর, এক দমক হিম হাওয়ায় দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে হাঁ হল ফের, মেজেয় চুনবালি খসে পড়ল, আর, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চারপাইয়ের তলা থেকে লাফ দিয়ে একটা বেড়াল গিয়ে জানালার ওপর বসল। স্থির, হিংস্র, পিঙ্গলাক্ষী।
আর কিছু ভাবনার প্রয়োজন হল না, নেশালস সম্মোহিত কণ্ঠে অনন্ত বলে উঠল, ‘তোমাকেও আমি নিয়ে যাব সুরমা।’
কৃশকর্কশ একখানা হাত থরথর কাঁপছে অনন্তর মুঠিতে, কিন্তু সুরমার মুখভঙ্গির লেশমাত্র পরিবর্তন হয়নি। বলল, ‘কোথায়।’
‘কলকাতা। সব ব্যবস্থা ঠিক করে সপ্তাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসব। তুমি এর মধ্যে তৈরি হয়ে নিও। তোমাকে এখানে ফেলে রাখতে পারব না।’
‘কেন।’
নির্বিকার, নিরুৎসাহ প্রশ্ন। অনন্তর একবার মনে হল কঠিন কিছু দিয়ে আঘাত করে করে এই অবোধ হিমরক্ত মেয়েটির দেহে প্রাণ এনে দেয়। পরমুহূর্তেই আবার স্নিগ্ধ ঘন আবেগের মেঘে ওর মন ছায়াচ্ছন্ন হয়ে এল। সুরমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে অনুনয়গাঢ় সুরে অনন্ত বলল, ‘তুমি বুঝতে পারছ না, এখানে থাকলে তুমি মরে যাবে?’
সুরমা স্পষ্ট, অবিচল স্বরে বলল, ‘মরে তো আমি কবেই গেছি অনন্তবাবু।’
ওর কাঁধ ধরে প্রবল, অসহিষ্ণুর ঝাঁকুনি দিয়ে অনন্ত বলল, ‘না, না, মরোনি। চলো একবার সেখানে, দেখবে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার কত পথ আছে মেয়েদের। একটি কি দুটি ভুল করলেই সে পথ একেবারে বন্ধ হয়ে যায় না। তোমার জীবনের এখনও অনেকখানি বাকি আছে।’
‘আছে?’ এতক্ষণে বুঝি একটু দীপ্তি দেখা গেল সুরমার মুখে, কণ্ঠস্বর একটু বুঝি ব্যগ্র শোনাল।
অনন্ত বলল, ‘আছে।’
ঘোড়ার খুরের শব্দ টিকটিকির ডাকের মত ক্ষীণ হয়ে শেষে একেবারে মিলিয়ে গেছে। দরজা বন্ধ করে সুরমা ফিরে এসেছে ঘরে। পুরনো কাপড়ের পুঁটলির মধ্যে বেতের একটা ঝাঁপি, তার ভেতরে আবার ওর নিজস্ব কয়েকটা টুকিটাকি।
অনন্তর নাম ঠিকানা লেখা একটা কার্ড তখনো আছে মুঠিতে। এই সাতদিনের মধ্যে হঠাৎ কিছুর দরকার হলে, অনন্ত বলে গেছে, চিঠি লিখতে। সাবধানে রাখতে হবে এটা।
ঝাঁপির ওপরের দিকে কতদিনের পুরনো রেশমি রুমাল, পাথরের মালা একছড়া—আজও যা হাতছাড়া হয়নি—সেকালের ঝালরহাতা কয়েকটা জামা, ছোট হয়ে গেছে, কিন্তু বিশ বছর আগেকার গন্ধ লেগে আছে। দরকারি-অদরকারি জিনিসের স্তুপ সরিয়ে কার্ডটাকে নিরাপদ নিচে রাখতে যাবে, চোখে পড়ল আরও দুটো কাগজ ; বিবর্ণ, হলদে, তবু চেনা যায়। একজন ওকে দিয়ে গিয়েছিল সই করা ফোটো, আরেকজন নিজে হাতে লিখে দিয়েছিল নাম-ঠিকানা। ফোটো আর চিরকুট, ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি। দশ-পনেরো বছর ধরে এখানে একভাবে চাপা পড়ে আছে। পাশাপাশি দুটি কবর।
অনন্তর কার্ডখানাও ওদের পাশে শুইয়ে দিল সুরমা। আরও একটি।
একটু পরেই সদরে কড়কড় কড়া নড়ে উঠল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ ছায়া পড়ল ঘরে। চমকে ফিরে তাকাল সুরমা। জগদিন্দু। দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। নতুন কোন গেস্ট এসেছে হয়ত। নির্বাক জগদিন্দু কঠিন তর্জনীর ইশারায় ওকে বলছে দরজা খুলে দিতে।
ঝাঁপি বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল সুরমা। ভীত দুটি চোখ নামিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ‘যাই।’
১৩৫৯(১৯৫২)