জলাঞ্জলি
এই রচনার নাম জলাঞ্জলি।
জলাঞ্জলি শব্দটির অর্থ মোটামুটিভাবে সকলের কাছেই বোধগম্য। জলাঞ্জলি মানে বিসর্জন দেওয়া, সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করা।
আমরা আশা জলাঞ্জলি দিই, লজ্জা জলাঞ্জলি দিই, লেখাপড়ায় জলাঞ্জলি দিই। টাকাকড়ি জলাঞ্জলি দিই।
অভিধানগতভাবে জলাঞ্জলি শব্দের সরাসরি অর্থ, সুবলচন্দ্রের বাঙ্গালা অভিধানমতে, জলপূর্ণ অঞ্জলি, এক অঞ্জলি জল। দাহের পর প্রেতাত্মার উদ্দেশে প্রদত্ত আঁজলাপূর্ণ জল হল জলাঞ্জলি। এই অঞ্জলির মাধ্যমেই মৃতের সঙ্গে সব সম্পর্ক বিসর্জন।
জলাঞ্জলি সন্ধিবদ্ধ শব্দ, জল+অঞ্জলি= জলাঞ্জলি, সরল স্বরসন্ধি। সপ্তম শ্রেণীর পড়ুয়াও জানে।
সমাসবদ্ধ জলাঞ্জলি কিন্তু দ্বন্দ্ব সমাস নয়। জল ও অঞ্জলি, দুই শব্দ মিলে সরাসরি জলাঞ্জলি নয়। জলাঞ্জলি হল মধ্যপদলোপী কর্মধারয়, ব্যাসবাক্য হল জলপূর্ণ অঞ্জলি।
সে যা হোক, ব্যাকরণঘটিত কচকচি ছেড়ে এবার সরাসরি জলে যাই। সেই যে একটা গান ছিল না—
‘সখি বেলা যে পড়ে এল জলকে চল।’
নদী কিংবা দিঘি থেকে কলসি কাঁখে যে মেয়েরা সকাল-সন্ধ্যায় জল নিয়ে আসত কবির মোহিত দৃষ্টির সামনে থেকে তারা বহুকালই অন্তর্হিত হয়েছে। তাদের পৌত্রী দৌহিত্রীরা এখন রাস্তার মোড়ে নোংরা কলতলায় রঙিন প্লাস্টিকের বালতি হাতে ঝগড়া করে। পড়ন্ত সূর্যের সোনালি আলোয় গান গাইতে গাইতে তাদের জল নিয়ে ঘরে ফেরার ছবি চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে।
জলই জীবন। মানুষ অনশন করে দু’-তিন মাস পর্যন্ত বাঁচতে পারে, গান্ধীজি থেকে শুরু করে অনেক রাজনৈতিক নেতাই দীর্ঘদিন ধরে টানা অনশন করেছেন। কিন্তু জলগ্রহণ না করে মানুষের পক্ষে কয়েকদিন বাঁচাও কঠিন। একদা হিন্দু বিধবারা নির্জলা একাদশীর উপবাস করতেন, সে ছিল ভয়াবহ কষ্টের ব্যাপার, বিশেষ করে এই দীর্ঘ গ্রীষ্মের দেশে। ডুবে ডুবে জল খাওয়া কথাটার উৎপত্তি এখানেই। এমনিতে জল পান না করে স্নানের সময় লোকচক্ষুর অগোচরে ডুব দিয়ে জল খাওয়ার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে এই গ্রাম্য প্রবাদে।
সব ধর্মেই জল অতি পবিত্র জিনিস। গঙ্গার জল কিংবা ফোরাতের পানি ধর্মপিপাসুদের কণ্ঠের তৃষ্ণা না মেটালেও ভক্তিতৃষ্ণা মেটায়। তার শাস্ত্রীয় আচরণকে পবিত্র করে।
অতঃপর জলের আসল গল্পে যাই। জলের আসল মজা সেখানেই।
যাঁরা মদ্যপান করেন, নিজেদের মধ্যে সাংকেতিক ভাষায় তাঁরা পরস্পরের কাছে জানতে চান, ‘কী আজ সন্ধ্যায় একটু জলপথে ভ্রমণ হবে নাকি?’
জলাদেশে, এমনকী কলকাতা শহরেও জলপুলিশ আছে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, এরা আবগারি পুলিশ, মদ ও মাতাল নিয়ে এদের কারবার। তা নয়। স্থল এলাকায় যেমন সাধারণ পুলিশ আছে, তেমনি জল এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য জলপুলিশ।
গোপাল ভাঁড়ের হেঁয়ালির বইয়ে এ ব্যাপারে একটি মজার গল্প আছে।
এক ভদ্রলোক অত্যধিক মদ্যপান করে রাস্তা থেকে গড়িয়ে রাস্তার ধারে একটা খালের জলের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। রাজপথে কর্তব্যরত এক পুলিশকর্মী তাঁকে ওই অবস্থায় দেখে বলে, ‘আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল।’ ভদ্রলোক নেশায় চুরচুর হয়ে থাকলেও তাঁর জ্ঞান যথেষ্টই ছিল এবং তিনি যথেষ্টই সেয়ানা, পুলিশের ধমক খেয়েও তিনি খালের জল থেকে উঠে এলেন না, বরং ওই পুলিশকেই বললেন, ‘হুঁহুঁ বাবা। আমি তো জলে আছি, তুমি আমাকে গ্রেপ্তার করবে কী করে? যাও, এখন গিয়ে জলপুলিশ ডেকে নিয়ে এসো।’
প্রবাদ আছে, শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল। মদ বেচা একটা সুপ্রাচীন ব্যবসা। মদ্য ব্যবসায়ীকে সংস্কৃতে বলে শৌণ্ডিক। শৌণ্ডিক মানে শুঁড়ি।
এই রকম এক শুঁড়ি শুধু মদ বেচতেন তাই নয়, নিজেও প্রচুর মদ্যপান করতেন। বলতে গেলে সমস্ত জীবনে, সাবালক হওয়ার পরে, একমাত্র কারণবারি ছাড়া আর কোনও পানীয়ই গ্রহণ করেননি।
মৃত্যুকালে তাঁর বড় ছেলে তাঁর মুখে জল দিয়েছিলেন। তিনি সেই জল ‘ওয়াক, থুঃ’ করে ফেলে দেন। তারপর শেষ নিশ্বাস পরিত্যাগ করার আগে ছেলেকে উপদেশ দিলেন, ‘বাবা, এইমাত্র আমার মুখে যে জিনিসটা দিয়েছিলে সেটা কিন্তু অতি জঘন্য জিনিস। এটা কেউ খাবে না। এ জিনিস বেচতে যেয়ো না। ব্যবসা লাটে উঠবে।’
এর প্রায় বিপরীত একটি ঘটনার আমি নিজে সাক্ষী। আমার এক তরুণ বন্ধু নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিল। তার বুকে জল জমে গিয়েছিল।
আমার সেই বন্ধুটা কড়া মদ্যপায়ী। নির্জলা মদ সে সরাসরি টকটক করে গিলে খায়।
আমি তাকে নার্সিংহোমে দেখতে গিয়েছিলাম। সে আমাকে দেখে অভিযোগ করল, ‘তারাপদদা আমার এই শোচনীয় অবস্থার জন্য আপনি দায়ি।’ তার এই অভিযোগ শুনে আমি বিস্মিত বোধ করায় সে বলল, ‘যখনই মদ খাই, আপনি জোর করেন জল মিশিয়ে খাও, জোর করে গেলাসে জল ঢেলে দেন। মদটা শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে। আপনার সেই জলটা বুকে জমে আছে।’
অবশেষে, নিবন্ধ প্রান্তে একটি আপ্তবাক্য স্মরণ করি, ‘আমরা জলের মূল্য কখনওই বুঝতে পারি, যতক্ষণ না কুয়ো শুকিয়ে যায়।’