ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

জলছাত

জলছাত

‘মাখনবাবুর বাড়িতে একটা ভালো খেস আছে। গতবছর পাঞ্জাব থেকে কিনেছিলেন।’

‘কে চাইতে যাবে?’

‘কেন তুমি? তোমার সঙ্গে তো ওঁর স্ত্রীর ছাতে-ছাতে প্রায়ই আলাপ হয়। প্রাণের কথায় এতই মশগুল থাকো, নীচে থেকে ডেকে-ডেকে গলা চিরে যায়, তবু উত্তর পাওয়া যায় না।’

‘তোমার যা মিনমিনে মেয়েলি গলা, পাশের ঘর থেকেই শোনা যায় না, তা ছাত থেকে।’

‘সংস্কৃতিমান লোকের গলা একটু মোলায়েমই হয়। তোমার মতো অমন পান দোক্তা খাওয়া লহরজান, গহরজান টাইপ হয় না। মেয়েদের গলা কেমন হবে? যেন ঝাড়লন্ঠনে বসন্তের বাতাস লেগেছে! তোমার মেয়েকেও একটু সাবধান করে দিও। তোমারই তো কাউন্টার পার্ট! ছেলের বাবা কিছু জিগ্যেস করলেই ষন্ড-কণ্ঠে কী বললেন বলে, সব যেন ভন্ডুল করে না দেয়! বলবে বাতাসের সুরে, ঝাউয়ের ঝিরিঝিরি নিশ্বাসে যেন কথা বলে। তালে লয়ে মিলিয়ে।’

‘আজ্ঞে না, সে যুগ আর নেই। মেয়েলি ন্যাকাপনা এখন অচল। একটু পুরুষালি গলাই ভালো। ছেলেরা পছন্দ করে বেশি। তুমি সব জানো। আমিও একটা ছেলে! আমি যা বলব, সেইটাই জানবে ঠিক।’

‘তুমি ছেলে নও।’

‘তার মানে?’

‘তার মানে তুমি আর এখন ছেলে নও। আধবুড়ো।’ বিনয় বললে, ‘আধবুড়ো হলেও ছেলে তো?’

‘আধবুড়ো, না ছেলে, না মেয়ে, একটি ভ্যাবাগঙ্গারাম।’

‘তাই না কি? তা হলে অত বড় একটা অফিস সামলাচ্ছি কী করে?’

‘আজকালকার অফিস আর সামলাতে হয় না। চলছে চলবের যুগ।’

‘এরপর তা হলে বলবে, মেয়েদের ঠোঁটে একটু গোঁফের রেখা থাকলে আকর্ষণ বাড়ে।’

‘বাড়েই তো। আমি যা যা বলছি সব সত্যি। তার প্রমাণ আমি আর তুমি?’

‘তার মানে?’

‘মনে আছে বাহান্ন সালের কথা? যখন তুমি আমার প্রেমে লাট খাচ্ছ।’

‘প্রেমে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়।’

‘তাই বুঝি বলতে, যত দেখছি তত চমকে উঠছি। তুমি আমাকে এক হাটে কিনে, এক হাটে বেচে দিতে পারো।’

‘বলেছিলুম?’

‘হ্যাঁ বুড়ো। মনে করে দ্যাখো। তখনও আমার এই রকমই গলা, ঠোঁটের ওপর হালকা গোঁফের রেখা। তখন আবার এও বলেছিলে, কটা-সুন্দরীর চেয়ে শ্যামলা দীর্ঘাঙ্গী আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। সাধে আমি ম্যাড হয়ে তোমার পেছন-পেছন ঘুরছি?’

‘আমি তোমার পেছনে ঘুরেছি, না তুমি আমার পেছনে ঘুরেছ!’

‘আহা, তাই না কি? কি বা শুনি আজ মন্থরার মুখে! কার্সিয়াং-এ মামার বাড়ি গেছি, তোমার জ্বালায় কলকাতায় টেঁকতে না পেরে। দ্বিতীয় দিন সকালে বাজারে গেছি। মাফলার জড়ানো এ মূর্তি কে। এক গাল হাসি, হে হে এই মাত্র নামলুম শ্যামা। প্রাণ অমনি জল হয়ে গেল আমার। এত বড় নির্লজ্জ, আমাকেই আবার জিগ্যেস করা হচ্ছে, কোথায় উঠব শ্যামা? মনে পড়ছে?’

‘হ্যাঁ, তা একটু-একটু পড়ছে বই কি!’

‘তা হলে, কে ঘুরেছিল? তুমি না আমি?’

‘তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না।’

‘খুব ঠিক ছিল। একেবারে শ্যাম পাগল। বুঁচকিটিকে ঠিকই চিনতে।’

‘যাক গে, সে সব পুরোনো কথা ছেড়ে কাজের কথায় এসো। খেসটা পারব আনতে?’

‘চেষ্টা করে দেখি। আমি পারব না এমন কাজ অবশ্য খুব কমই আছে।’

শ্যামার মেয়ে রেখাকে আজ দেখতে আসবেন পাত্র পক্ষ। মাসখানেক হল কথাবার্তা চলছে। চিঠি চাপাটি। ছবি দেখাদেখি প্রাথমিক নির্বাচন শেষ। এইবার মুখোমুখি। অনেকটা লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষার মতো। শ্যামার চেয়ে বিনয়ের দুর্ভাবনাই বেশি। ছবিতে কেরামতি চলে, চেহারায় তো চলে না। মেক আপে তো সব হয় না। তবে ভরসা এই রেখাকে পুরোপুরি তার মায়ের মতো দেখতে নয়। শ্যামাকে অনেকটা ডেকাথেলন চ্যাম্পিয়ানের মতো দেখতে। আট আনা বারো আনা ছাঁটে চুল কেটে দিলে বোঝে কার সাধ্য পুরুষ কি মহিলা। ভাগ্য ভালো, রেখা অনেকটাই বাপের চেহারা পেয়েছে গলাটাই যা ভয়ের! ভলুম কনট্রোল নেই। আর মেজাজটাও মায়ের দিকেই গেছে। এপাশ ওপাশ সহ্য করতে পারে না, মিলিটারি মেজাজ। অস্ত্রোপচারের ডাক্তারও হতে পারত। ভাবটা এইরকম ঝামেলা করছে কেটে ফেলে দাও। বোতাম ঘরে বোতাম আটকে গেছে! বুকের কাছের জামাটা ফ্যাঁড়াস করে ছিঁড়ে পা গলিয়ে খুলে ফেল। ড্রয়ারের চাবি আটকে গেছে। মারো টান। হুড়দুড় করে সব পড়ে গেল। শ্যামার মতোই চরিত্রে ধৈর্যের ‘ধ’ও নেই। এই তো সে দিন। পায়ের বুড়ো আঙুল চটির স্ট্র্যাপে কীভাবে যেন আটকে গিয়েছিল। চটির বেয়াদপিতে এমনই অধৈর্য হয়ে পড়ল, মার ঝটকা, চটি ছিটকে গিয়ে দুধের চেকচিতে। বুড়বুড়ি কেটে ডুবে গেল। আঙুলে একবার একটা চোঁচ ফুটেছিল। প্রথমে পাখি ছুঁচ দিয়ে একটু চেষ্টা হল, শেষে ধ্যাত তেরিকা, ব্লেড দিয়ে খানিকটা মাংস উপড়ে, মাস খানেক ব্যান্ডেজ বেঁধে অচল হয়ে বসে রইল। রেখার জন্যে বিনয়ের ঘুম গেছে। এ মেয়ে একমাত্র ডিকটেটারেরই স্ত্রী হতে পারে! পাত্র খুঁজতে হবে জাম্বিয়ায় নামবিয়ায় ঘানায় কিংবা লিবিয়ায়।

বিনয়দের ফ্যামিলির একটা ট্র্যাডিশান আছে। সেটা হল কেউ এলেই তাকে এমন খাওয়ানো, যেন তিন দিন হাঁ করতে না পারে। ফুলকো লুচি, বেগুন ভাজা, পাশে টাকনা দেবার জন্যে একটি কাঁচা লংকা। ঝুরো ঝুরো আলু ভাজা। দু-পিশ পাকা রুই মাছ ভাজা, অন্তত চার রকমের মিষ্টি, বিগসাইজের। এক প্লেট রাবড়ি খাও, এবং খেয়ে সামলাও। আজকে সেই ধরনের ব্যবস্থাই হবে। কিঞ্চিৎ বেশি। কারণ যাঁরা দেখতে আসছেন তাঁরা অত্যন্ত বনেদি পরিবারের মানুষ। গাড়ি আছে, বাড়ি আছে। বাড়ি মেঝে মার্বেল পাথরের। পেট্রোলের দাম বাড়ায় গাড়ি অধিকাংশ সময়েই গ্যারেজে থাকে। কর্তার হুকুম, নেহাত প্রয়োজনে না পড়লে তেল পোড়ানো চলবে না। কর্তা রিটায়ার্ড ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। কর্তা আর গিন্নি দুজনেই বেশ গতরওয়ালা মানুষ। দু-ছেলে তিন মেয়ে, তিন মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। তিন জামাইই গাড়িধারী। একজন ডাক্তার। তিনি প্রাোফেশান নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। শ্বশুরবাড়িতে কালেভদ্রে আসেন। আর একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি প্রায়ই আসেন। শ্বশুর শাশুড়িকে গাড়ি চাপিয়ে এখানে ওখানে বেড়াতে নিয়ে যান। সংসারের প্রিয় জামাই। তৃতীয়টি প্রবাসী। হাওয়াই কোম্পানিতে চাকরি। এই মাদ্রাজে তো কাল বোম্বাইতে।

বিনয় এ সব খবর সংগ্রহ করেছে তার বন্ধুর কাছ থেকে, যিনি এই যোগাযোগের কর্মকর্তা। বিনয় খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সব জেনেছে। কারণ শ্বশুর আর শাশুড়ি বস্তু দুটিতে তার ভীষণ ভয়। মেয়েটিকে যদি নেয়ও কেমন ব্যবহার করবে কে জানে? আজকালকার ছেলে মেয়েদের বিশ্বাস করা যায় না। বিয়ের পর নিজ মূর্তি ধরতে মাস তিনেক সময় লাগে। বরাতের কথা ফেলে-রাখা যায় না ঠিকই, তবু যতটা পারা যায় দেখে শুনে, খোঁজ খবর নিয়েই এগোনো উচিত।

বাড়ি ঘর বেশ মনের মতোই সেজে গুজে উঠেছে। শ্যামা খেসটা শেষ পর্যন্ত জোগাড় করে এনেছে। কথায় আছে চিল পড়লে কুটোটা অন্তত নিয়ে যাবেই। শ্যামা হল সেই চিল। সোফাসেট, ডিভান সরে গেছে। মেঝেতেই সব আয়োজন পাকা। বসেও আরাম। জানলার পরদা টরদা, দরজার পেলমেট সব নতুন করে লাগানো হয়েছে। পুরো ঘরটাই যেন স্টিম লন্ড্রি থেকে কেচে বেরিয়ে এসেছে। আয়োজন দেখে বিনয় নিজে নিজেই বা: বা: করে উঠল।

চারটে প্রায় বাজে। আসার সময় হয়ে এল। কথা আছে চার জন আসবেন। ছেলের মা বাবা। একজন পারিবারিক বন্ধু। ছেলের বড় মামা। তিনজন পুরুষ একজন মাত্র মহিলা। মহিলার সংখ্যা কম থাকাই ভালো। মেয়েরা বড় নাকতোলা হয়। শ্যামার সঙ্গে হয়তো শেষে ঝটাপটিই বেঁধে গেল! কিস্যু বলা যায় না। মেয়ের মাকে যে প্রথমটায় কেঁচো হয়ে মেয়ে পার করতে হয়, তারপর ফোঁস-ফোঁস চলতে পারে, এই কূটনৈতিক চালটা বিনয় এত করেও বউকে শিখিয়ে উঠতে পারল না। বললেই বলবে, মেয়ের মা হয়েছি বলে চোরের মতো থাকব কেন। সব ফ্যামিলিতেই মেয়ে আছে। বউরাই পরে গিন্নি হয়, গিন্নিরাই শাশুড়ি হয়। আমার দাপট আমি ছাড়ব না। মেয়ে আমার কিছু কম যায় না। তুমিও এমন কিছু ফেলনা নও। শেষের কথায় বিনয়ের অহংকারে বেশ সুড়সুড়ি লাগে। বিনা প্রতিবাদে শ্যামার যুক্তি মেনে নেয়।

দরজার সামনে রাস্তার ধারে বিনয় সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন ব্লেডে দাড়ি চেঁচেছে। গালে মেখেছে আফটার শেভ লোশান। দিশি ধুতিতে যত্নের কোঁচ। আধুনিক বাপেদের জিওগ্রাফি বেশ পাল্টে যাচ্ছে। পাল্টাবে না কেন? বাজেট যেখানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার, মেয়ের বাপ জুতো মশমশিয়ে হবু বেয়াইয়ের জন্য মুখে সিগারেট গুঁজে, চোখে রিমলেস ঝুলিয়ে রাস্তায় পায়চারি করতে পারে। মেয়ে শিক্ষিতা সুরূপা। দেঁতো হাতি নয়, ট্যাঁরা পেঁচা নয়। বংশোচিত বিনয়ে আপ্যায়ন, আসুন, বসুন, দেখুন। পছন্দ হয় ভালো, না হয় ছেলের অভাব নেই। ম্যানম্যানে, প্যানপ্যানের যুগ চলে গেছে।

রাস্তায় একটা ঘোড়ার গাড়ি ঢুকছে। বিনয় অবাক। শতাব্দীর গোড়ার দিকে এমন গাড়ি দেখা যেত। এখনও মাঝে মধ্যে দেখা যায়। চৌরঙ্গির দিকে। গঙ্গার ধারে রাতের বাবুরা হাওয়া খেয়ে বেড়ান। মাঝে মধ্যে দুধের ক্যান নিয়ে এক ঘোড়ার একটা গাড়ি এদিক থেকে কোন দিকে যেন যায়? এ ঘোড়াটা তত মড়া খেকো নয়। মাড়োয়ারিদের বিয়ের ঘোড়ার মতো। পড়তি জমিদারের মতো। চেকনাই এখনও কিছুটা লেগে আছে। কচোয়ান হাঁকল,

‘বিনয়বাবুকা কোঠি।’

‘হ্যাঁ, এ হি কোঠি।’

‘নমস্তে সাহাব।’ রাশ টেনে গাড়ি থামাল। জানলা দিয়ে বুলডগের মতো লাল মুখ বেরিয়ে এল, ‘মনে হয় আপনিই বিনয়বাবু?’

বিনয় হাত জোড় করে বললে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ?’

‘রোককে, রোককে।’

গাড়ি রুখেই আছে। বাঙালির স্বভাব, বাস থেমে থাকলেও যাত্রীরা, রোককে বলে হুড়মুড় করে নামেন। কচোয়ান তিড়িং করে কোচবকস থেকে লাফিয়ে পড়েই, গাড়ির দরজা এক হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলল। চার জোড়া হাঁটু দেখা গেল। লোকে সিটি মারবে। আশেপাশের বাড়ির জানলায় মুখ বেরোতে শুরু করেছে। পুলিশই বা এমন একটা গাড়ি ছেড়ে দিল কী করে।

বহুত কসরত করে বিশাল এক মোটা মানুষ গাড়ি থেকে প্রথমে নেমে এলেন। ভারমুক্ত হয়ে গাড়ি প্রায় এক হাত ওপর দিকে উঠে পড়ল। ঘোড়াটা ভোঁস করে একটা নি:শ্বাস ছেড়ে একটু যেন সুস্থ হল। গাড়ি থেকে অন্যান্য সকলে নেমে পড়লেন। ক্যামেরা থাকলে বিনয় একটা ছবি তুলে রাখত। পর্বতের পাশে যেন তিন টুকরো টিলা। একজনকে ছাড়া বিনয় আর কাউকেই চেনে না। যাকে চেনে তাঁর নাম হিমাংশু আচার্য। হিমাংশুর যোগাযোগেই এই দেখাশোনা। না চিনলেও স্বাস্থ্যবান ভদ্রলোকের হাবভাব দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না, তিনিই পুত্রের পিতা। জেলা শহরে আসামি ঠেঙানো মানুষ। অবসর নিলেও সারা দুনিয়াটাকে এখনও যেন এজলাস থেকেই দেখছেন। যে মহিলাকে এরই মধ্যে বার দুয়েক ধমকধামক লাগানো হয়ে গেল, তিনি নিশ্চয়ই স্ত্রী। স্ত্রী ছাড়া আর কার সঙ্গে অমন ব্যবহার করা যায়।

হিমাংশু হাসতে-হাসতে বললে, ‘কত্তা ঘোড়ায় চেপে তেল বাঁচাচ্ছেন।’

বিনয় বললে, ‘এ জিনিস এখনও আছে?’

‘যত্ন করে রাখলে সবই থাকে ভাই। কত্তার বাবা সিভিল সার্জেন ছিলেন। তাঁর আমলের জিনিস। ঘোড়াকে বাতে না ধরলে যৌবন সিল্কের কাপড়ের মতো দু-তিন পুরুষ থেকে যায়।’

কথা বলতে-বলতে সকলে ঘরে এসে পড়েছেন। মেঝেতে বসার আয়োজন হয়েছে দেখে কর্তা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন,

‘ও হিমাংশু চিরটাকালই তো সিংহাসনে বসে এলে, আজ আবার এ কী হল? জানোই তো আমার মধ্য-প্রদেশ সব প্রদেশের বড়।’

বিনয় বললে, ‘ভাববেন না আমি সোফা প্লেস করে দিচ্ছি এখুনি।’

যতটা তটস্থ হলে ভালো দেখায় ঠিক ততটা তটস্থ হয়েই বললে। মন কিন্তু গজগজ করছে, সিংহাসনে বসে এসেছেন। কত বড় কাজি ছিলেন। জেলা সদরের ম্যাজিসট্রেট। রঙচটা কাঠের চেয়ার। সে চেয়ার আমি যেন দেখিনি। পেছন দিকের ঠেসান দেবার অংশটা সাধারণ চেয়ারের চেয়ে উঁচু হয়। মাথা ছাড়িয়ে ওঠে। সিংহাসনে বসি। ওরে আমার চিফ জাস্টিসরে।

শোবার ঘর থেকে সোফা বেরোবে। সেই সকাল থেকে রাজেনের সঙ্গে সমানে লেগে থেকে-থেকে বসার ঘরের দিশি অঙ্গসজ্জা হয়েছিল। নাও এবার বোঝো ঠ্যালা। নাইনটিনথ সোফার গতরটি তো নেহাত কম নয়। এ মাল একমাত্র পবননন্দনই একা বহন করতে পারে। তার মতো ফিনফিনে বাবুর কম্ম নয়। আয়নায় নিজের চেহারার প্রতিফলন দেখে ঘেন্না ধরে গেল নিজের ওপর। ছেলের বাপের এক কিকে পেনাল্টি সীমানার বাইরে গিয়ে পড়বে। দেহ ছোট হলে মনও ছোট হয়ে যায়। বড় খোলে বড় জিনিস থাকবে, ছোট খোলে ছোট জিনিস। এই তো নিয়ম।

হিমাংশু, রাজেন আর বিনয়ের চেষ্টায় সেই গায়েগতরে সোফা মেঝের ওপর দিয়ে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে যথাস্থানে রাজসিংহাসন হল। পাত্রের পিতা হারানিধি বসে ছাড়লেন। অতখানি ওজন দুটো পায়ের ওপর এতক্ষণ ধরে রাখার একটা ক্লান্তি আছে। বসে সুস্থ হয়ে ঘরের চারপাশ ভালো করে এক নজর দেখে নিয়ে বিনয়কে জিগ্যেস করলেন—

‘দরজা জানলা কি বার্মা টিকের?’

‘আজ্ঞে না, সত্তর শালের বাড়ি, এমনি সিপি টিকেই দশ হাত জিভ বের করে ছেড়ে দিয়েছে, বার্মা পাব কোথায়?’

‘শুনলে শশাঙ্ক?’ শ্যালককে উদ্দেশ্য করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘বার্মা কোথায় পাব? সন্ধান রাখতে হয় মশাই, সন্ধান রাখতে হয়। সন্ধান করলে ঈশ্বর মেলে, বার্মাটিক মিলবে না? আমরা কি করে পেলুম শশাঙ্ক?’

ত্যারছা চোখে হারানিধি বিনয়ের দিকে তাকালেন। বিনয়ের মনে হল খুব বুড়ি, মোটা এক বাইজি তাকে চোখের ভঙ্গি করছে। তিরছি নজরিয়াকে বান।

‘জলছাত করেছেন?’

‘আজ্ঞে না।’

‘সে এ কীই। দশ বছর বাড়ি হয়ে গেল জলছাত হয়নি। কী বলে শশাঙ্ক। ঢালাইয়ের লোহা বেরিয়ে পড়বে। করেছেন কী।’

বিনয়ের ভীষণ অবাক লাগছিল। ভদ্রলোক মেয়ে দেখতে এসেছেন না বাড়ি। মিউ মিউ করে বললে,

‘এই করব করব করে আর ঠিক সুবিধে করে উঠতে পারিনি।’

‘ওই হয়, করব না, করব না করে বুড়ো বয়েসে বিয়ের মতো হবে আর কি? সব কিছুরই বয়েস আছে মশাই। টাকে তেল ঢাললে কি আর চুল গজাবে। তেলের পয়সাটাই রববাদ হবে। কি বলো শশাঙ্ক?’

শশাঙ্ক যেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রিয় বয়স্য গোপাল ভাঁড়। হয় হেসে, না হয় তাল দিয়ে ভগ্নীগতিকে ঠেকা দিয়ে চলেছে।

‘টোট্যাল কস্ট কত পড়েছিল?’ হারানিধি আরও গভীরে যেতে চান।

বিনয়ের এবার বিশ্রি লাগছে। এত কৌতূহল তো অভদ্রতারই শামিল। বিনয় তবু ভদ্রভাবেই বললে,

‘ঠিক মনে নেই, সত্তর হাজারের মতো হবে।’

‘জমি ধরে?’

‘না জমি আলাদা।’

‘ক’ কাঠা আছে?

‘পাঁচ কাঠার মতো।’

ভদ্রলোক শ্যালকের দিকে তাকিয়ে হাঁটুতে তাল ঠুকে বললেন, ‘চলো, উঠি তা হলে?’

বিনয় অবাক হয়ে বললে, ‘কেন? সে কী কথা? উঠবেন কেন?’

শ্যালকও ধরতে পারেনি, ‘মেয়ে দেখবেন না?’

‘আর দেখে কী হবে?’

বিনয় হঠাৎ বলে ফেলল, ‘কেন জলছাত নেই বলে?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ ধরেছেন ঠিক।’

বিনয় কী ধরেছে নিজেই জানে না। ধরাটা হঠাৎ মিলে গেছে দেখে অবাক হয়ে বললে,

‘জলছাতের সঙ্গে মেয়ে পছন্দ অপছন্দের কী সম্পর্ক?’

‘ও, ধরেও ধরতে পারেননি দেখছি। আচ্ছা, ছাত কত বর্গ ফুট আছে?’

‘মাপিনি, তবে মনে হয়, ছশো কি সাতশো স্কোয়ার ফুট, হবে।’

‘জলছাতের খরচ কত হবে বলে মনে করেন?’

‘আজ্ঞে ধারণা নেই।’

‘পাঁচ সাত হাজার। কি বলো শশাঙ্ক? পাঁচ সাত হবে না?’

‘বড় জোর আট।’ শশাঙ্ক আর একহাজার ওপরে উঠে জ্ঞান জাহির করল।

‘তাহলে একবার বুঝে দ্যাখো, হিমাংশু আমাদের এমন জায়গায় এনেছে যিনি গত দশ বছরে আট হাজার টাকার মুখ দেখেননি। দেখলে জলছাত হয়ে যেত। বিনয়বাবু আমার ছেলে ছ-ফুট লম্বা, গৌরবর্ণ। আপনার বাজেট কত টাকা?’

বিনয় আর একটু হলেই বলে ফেলছিল পঞ্চাশ হাজার। সামলে নিল। ভেতরটা ঘৃণায় কুঁকড়ে যাবার মতো হচ্ছে। আর যাই হোক এমন মহামানবের পুত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে স্বপ্নেও সম্ভব নয়। সে বললে,

‘আমার মতো লোক আর কত খরচ করতে পারে? আপনি নিজেই অনুমান করে নিন।’

‘সেই অনুমান করতে পেরেছি বলেই আর সময় নষ্ট করতে চাইছি না। আমাদের আত্মীয়তা, কুটুম্বিতা সবই বড়-বড় ঘরে। ছেলের বিয়ে দিয়ে মাথা হেঁট করে থাকতে পারব না। আপনারও অস্বস্তি, আমারও অস্বস্তি, আপনার মেয়েও মাথা উঁচু করে চলতে পারবে না। আমাদের বংশে বউরা এসেছে বড় বড় বংশ থেকে। সোনার কাজ করা জামদানি পরে। শরীরের এক ইঞ্চিও খালি থাকত না, সব সোনায় মোড়া। চলো হে শশাঙ্ক।’

‘একেবারে শুধু মুখে চলে যাবেন। একটু জলযোগ করে গেলে সুখী হতুম।’

‘জলযোগ? যেখানে সেখানে যোগ করার বয়েস কি আর আছে মশাই? চলো হিমাংশু। আমার তিন কেজি ছোলাই লস হল তোমার জন্যে।’

হিমাংশু আসন ছেড়ে উঠতে উঠতে বললে, ‘আজ্ঞে পেট্রোল হলে লোকসানের পরিমাণটা আরও বেশি হত।’

‘হ্যাঁ, তা অবশ্য হত। আমার গাড়ি আবার একটু বেশি তেল খায়।’

ঘোড়া ন্যাজ নেড়ে খড় খাচ্ছিল। কচোয়ান বাবুকে দেখে কোচ বক্সের ঢাকনা খুলে খড় তুলে রাখল। হারানিধি ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি আবার দেবে গেল এক হাত। মাথার ওপর বাতাস কেটে ছপটি ঘুরল। ঘোড়া ছুটল কদম কদম তালে। হঠাৎ বিনয়ের ভীষণ হাসি পেয়ে গেল। ঘরের একমাত্র সোফায় পা ছড়িয়ে বসে বিনয় হো-হো করে হেসে উঠল। সোফাটা তখনও দেবে আছে। বিনয় হাসছে আর বলছে, ‘উরে বাপরে মানুষ, মানুষ।’ শ্যামা ঘরে এসে অবাক। বিনয় কোনও রকমে বললে, ‘কী জিনিস এসেছিল গো। মেয়ের বিয়ের আগে জলছাতের ব্যবস্থা করো।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *