জয়ন্তী নদীর কাছে, পরির আশায়
প্রথমবার গিয়েছিলাম ট্রেনে। দ্বিতীয়বার গাড়িতে। বলাইবাহুল্য, প্রথমবারের রোমাঞ্চ অনেক বেশি ছিল।
বিচিত্র নামের জায়গা রাজা-ভাত-খাওয়া। সেখান থেকে ট্রেন। রাজাদের স্মৃতিবিজড়িত হলেও জায়গাটি অকিঞ্চিৎকর, কিছুই নেই বলতে গেলে। জায়গাটি আমার বিশেষ কারণে মনে আছে। ওখানেই আমি তক্ষক নামে প্রাণীটি প্রথম দেখি। ছোটবেলা থেকে তক্ষকের ডাক অনেকবার শুনেছি। কিন্তু সচরাচর প্রাণীটিকে চোখে দেখা যায় না। অনেক পুরোনো বাড়িতে তক্ষক লুকিয়ে থাকে। ওদের ডাকও নির্দিষ্ট থাকে, কোনওটা প্রত্যেকবার পাঁচবার ডাকে, কোনওটা সাতবার। বেশ জোরে, তক্ষো তক্ষো করে ডাকে, সেই থেকেই নামটা এসেছে। লোকের ধারণা, তক্ষক একটা সাপ, মহাভারতে অতি বিষধর তক্ষক রাজা পরীক্ষিৎকে দংশন করেছিল। রাজা-ভাত-খাওয়া স্টেশনের বাইরে খুব কাছেই সেই ডাক শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি, একটা শালগাছের গায়ে উলটোদিকে মুখ করে আছে, সাপ মোটেই না, একটা গিরগিটির মতন প্রাণী আরও একটু লম্বাটে ধূসর। আমরা কাছে যেতেই সড়াৎ করে ডালপাতার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। তক্ষক কারুকে কামড়েছে বা তক্ষকের কামড়ে কেউ মারা গেছে, এমন কখনও শুনিনি। মনে হয়, টিকটিকির মতনই নিরীহ প্রাণী।
রাজা-ভাত-খাওয়া থেকে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ট্রেন চলেছিল। ছোট ট্রেন, প্রধানত মাল বহনের জন্য। কাঠ ও ডলোমাইট নিয়ে যায়। যাত্রীর সংখ্যা সামান্য। বৃষ্টি পড়েছিল বলে যাত্রাটা আরও উপভোগ্য হয়েছিল। জঙ্গলে বৃষ্টি, আঃ তার চেয়ে মাদকতাময় আর কী হতে পারে! মাত্র ষোলো কিলেমিটার পথ, কু ঝিক ঝিক করে ট্রেনটি চলছিল, ঠিক ছেলেবেলার মতন, এখন ট্রেনের শব্দ বদলে গেছে।
সেই ট্রেন এখনও চলে কি না জানি না। দ্বিতীয়বার যখন যাই, তখন সেই ট্রেন বন্ধ ছিল সাময়িকভাবে, যেতে হয়েছিল গাড়িতে, গাড়িটা পাওয়া গিয়েছিল পর্যটন দপ্তরের সৌজন্যে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গাড়ির পথও মনোরম। কিন্তু বৃষ্টি পড়েনি। গাড়িতে শুধু স্বাতী আর আমি, যেহেতু আমার দ্বিতীয়বার, তাই আমি প্রথমবারের সঙ্গে তুলনা করছিলাম। কিন্তু স্বাতীর প্রথম দর্শনের জন্য মুগ্ধতা বেশি।
জয়ন্তী-তে পৌঁছলাম দুপুরের আগেই। পি ডব্লু ডি বাংলোটি আগে থেকেই আমাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। পুরোনো আমলের বাড়ি… দোতলায় দুটি ঘর, সামনে বারান্দা। এবং সেখান থেকে দৃশ্যটি প্রথাসিদ্ধ সুন্দর। সামনেই নদী, ওপারে নিবিড় জঙ্গল, পটভূমিকায় পাহাড়। এরকম দৃশ্য কখনও পুরোনো হয় না।
নদীর নামও জয়ন্তী। জঙ্গলের ওপাশেই ভুটান, সেখানকার কোনও পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। কিছু দূর বয়ে মিশে গেছে রাইডাক নদীতে। জয়ন্তীর মতন ছোট নদী সারাদেশে কত যে ছড়িয়ে আছে। ছোট হলেও নগণ্য নয়। লিটল ম্যাগাজিনের মতন, তেজ আছে। আগেরবার বর্ষার সময় এসে দেখেছি, বেশ লাফিয়ে-লাফিয়ে ছুটছিল। নৃত্যপরাও বলা যায়। মনে হয়েছিল, যখন তখন গতি পালটে ফেলতে পার। এখন অবশ্য শরৎকাল, জল অনেক কম, মাঝে-মাঝে পাথর জেগে আছে, তবে ধারাটি ঠিক প্রবাহিত।
জয়ন্তীতে এসে একটা ব্যাপারে খটকা লাগল। কেমন যেন নিঃশব্দ। জনশূন্য ভাব। আগেরবার ডিনামাইটের কোয়ারির জন্য অনেক লোকজন দেখেছি। মাঝেমাঝে ডিনামাইটের বিস্ফোরণের শব্দও শোনা যেত। এখন এত শুনশান কেন?
চৌকিদারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পরিবেশ দূষণ সংক্রান্তকী-একটা মামলায় ডলোমাইট খোঁড়া সাময়িকভাবে বন্ধ আছে। ট্রেনও চলছে না। লোকজন আসবে কোথা থেকে?
নির্জনতাই তো বেশি পছন্দ হওয়ার কথা। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আজকাল তো প্রসিদ্ধ সুন্দর জায়গাগুলিতে একেবারেই যেতে ইচ্ছে করে না, সেখানে লোকজন গিসগিস করে, আর বাঙালিদের এমনই সঙ্গীত-প্রীতি যে জঙ্গলে গিয়েও ট্রানজিস্টার বাজাতে হয়। তবে জায়গাটা এত ফাঁকা ফাঁকা দেখে স্বাতীর মুখে-চোখে যেন খানিকটা অস্বস্তির ভাব। তার কারণ, আলিপুরদুয়ারে এতজন স্বাতীর কানেকানে বলে দিয়েছে, জয়ন্তীর পুরোনো বাংলোটায় ভূত আছে।
দুপুরটা আর বেরুনো হল না। বিকেলবেলা চা-পানের পর আমরা ভ্রমণের জন্য তৈরি হয়েছিলাম। সঙ্গে গাড়ি থাকলে একটা মুশকিল এই যে, পায়ে হেঁটে ঘোরাঘুরির সুখ পাওয়া যায় না, গাড়ির ড্রাইভার সঙ্গে-সঙ্গে এগিয়ে আসে। আমরা গাড়ি নিতে না চাইলে সে মনে করে, তার ডিউটিতে বুঝি কিছু গাফিলতি হচ্ছে।
জয়ন্তী নদী হেঁটেই পার হওয়া যায়, গাড়ি চলার জন্যও একটা ফেয়ার ওয়েদার ব্রিজ মতন করা আছে, ওপারের জঙ্গলের মধ্যেও প্রশস্ত রাস্তা! আগেরবার লরি চলাচল করতে দেখেছি। এখন সব বন্ধ।
কিছুদূর গিয়ে ভুটানে ঢুকলে মহাকালের মন্দির দেখা যেতে পারে। মন্দির মানে কয়েকটি গুহা। সেখানে স্ট্যালাগটাইট ও স্ট্যালাগমাইটের কিছু-কিছু আকৃতি আছে, সেগুলি প্রকৃতির সৃষ্টি, ভক্তরা মনে করে ঠাকুর-দেবতা। কাশ্মীরে অমরনাথের বরফের পিণ্ডটাকে যেমন অনেকে মনে করে শিবলিঙ্গ।
আমাদের সে পর্যন্ত যাওয়া হল না। হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এল। এখনই সন্ধে হওয়ার কথা নয়, কিন্তু আকাশে ঘনিয়ে এসেছে মোষের গায়ের রঙের মেঘ। হেডলাইট জ্বালাতে হল গাড়িতে। ড্রাইভারটি গম্ভীর ধরনের, কিছু জিগ্যেস করলে শুধু হ্যাঁ বা না উত্তর দেয়, এক সময় সে বলে উঠল, স্যার হঠাৎ হাতির পাল এসে পড়লে মুশকিল হবে। আগে একবার এরকম হয়েছিল, তখন গাড়ি ঘোরাতে এমন অসুবিধে হয়–
এখানে হাতির সংখ্যা প্রচুর। ছুটকো-ছাটকা দু-একটা বাঘও থাকতে পারে। উত্তরবঙ্গের বাঘদের ভয় পাওয়ার বিশেষ কারণই নেই, সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতন তারা অত চতুরও নয়। হিংস্রও নয়। চা বাগানের আশেপাশে যেসব লেপার্ডগুলো ঘুরে বেড়ায়, তারাও গাড়ি দেখলে ভয়ে পালিয়ে যায়। আসল সমস্যা হাতির পাল নিয়ে। তারাও যে তেড়ে এসে আক্রমণ করে তা নয়, কিন্তু জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় তারা কোনও বিঘ্ন পছন্দ করে না, কাছাকাছি গাড়ি দেখলে খেলাচ্ছলে উলটে দিতেও পারে। আগেরবার আমি হাতির পালের গতি ফেরাতে জঙ্গল কর্মীদের পটকা ফাটাতে দেখেছি।
ঝুঁকি না-নিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
সন্ধে সন্ধে হয়েছে। এখনই ঘরের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। অত মেঘ, কিন্তু বৃষ্টি এল না। কিছুক্ষণ বসে রইলাম নদীর ধারে। দূরের পাহাড়ের রেখা আস্তে-আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশে। অন্ধকার হলে সব জঙ্গলকেই গম্ভীর আর রহস্যময় মনে হয়।
যে-কোনও নদীর কাছে গেলে স্বাতী তার জল ছোঁবেই। বালিকার মতন লঘুপায়ে পাথরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে-লাফিয়ে সে জলধারার কাছে গিয়ে আঁজলা করে জল মাথায় ছোঁয়াল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। কাছাকাছি সর-সর শব্দ হচ্ছে মাঝে-মাঝে। এখনে সাপ থাকা বিচিত্র কিছু নয়।
এইসব বাংলোয় তাড়াতড়ি খেয়ে নিতেই হয়। খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে দিতে পারলেই চৌকিদারের ছুটি। ভাত, ডাল, ঢ্যাঁড়শের তরকারি আর মুরগির ঝোল, এ ছাড়া অন্য কিছু আশা করাই যায় না।
খেতে-খেতে স্বাতী ফস করে চৌকিদারকে জিগ্যেস করল, এই বাংলোয় ভূত আছে?
চৌকিদার উত্তর না দিয়ে আমাদের দিয়ে চেয়ে রইল। তার এই নৈঃশব্দ্যই রহস্যময়।
আরও একবার জিগ্যেস করায় সে বলল, কী জানি। আমি তো কখনও ওপরের ঘরে থাকিনি। তবে, দু’একজন বাবু বলেছে–
চৌকিদারকে আরও জেরা করে জানা গেল, ইংরেজ আমলে নাকি এখানে এক মেমসাহেব খুন হয়েছিল, সে অনেককাল আগের কথা, সেই মেমসাহেবকে নাকি এখনও কেউ-কেউ দেখে।
এরকম গল্প থাকলে স্থানটি আরও রোমাঞ্চকর হয়। ভূত নয়, পেতনি, মেম পেতনি।
স্বাতী যে ভূতে ঠিক বিশ্বাস করে তা নয়, কিন্তু ভূতের ভয় পেতে খুব ভালোবাসে। গা ছমছমানিটাই উপভোগ করে মনে হয়।
ভূতের কাহিনি যেখানে জড়িয়ে আছে, সেখানে ও রাত্তিরে বাথরুমে যেতেও ভয় পায় রীতিমতন। সত্যিসত্যি কোনও ভূতের সামনে পড়লে ও মূৰ্ছা যাবে নিশ্চিত, আমার কোনও একদিন একটা ভূত দেখে ফেলার ইচ্ছেও আছে পুরোপুরি।
আমি অবশ্য ভূত বা ভগবানের দেখা কখনওই পাব না, তা জেনে গেছি অনেক কম বয়সেই।
রাত্তির বেলা দূরের শব্দও খুব কাছের মনে হয়। হঠাৎ একটা জানলা যেন দড়াম করে অকারণেই বন্ধ হয়ে যায়। এইসব নিয়ে খানিকটা রোমহর্ষকভাবে কেটে গেল অনেকটা সময়, কিন্তু কোনও মেমসাহেবের ছায়া বা কায়া উঁকিঝুঁকি মারল না।
স্বাতী ঘুমিয়ে পড়ার পরও আমার ঘুম এল না। আমি বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরালাম। এর মধ্যে সব মেঘে অদৃশ্য হয়ে গেছে, পুটুস করে একটা চাঁদও উঠেছে। বেশ ঝলমলে জ্যোৎস্না।
নদীটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। এখানে-সেখানে জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছে জল। পাথরগুলো দেখা যায় না। জয়ন্তী নদীর এ-রূপ দিনের বেলার চেয়ে একেবারে অন্যরকম। যেন, এ এক মায়ানদী। দিনের বেলা শব্দ শুনিনি। এখন শুনতে পাচ্ছি কলকল ধ্বনি। জলের মধ্যে যেন চাপা আলো জ্বলছে, এক-একবার এক জায়গার জল সরে যাচ্ছে অন্যখানে।
হঠাৎ মনে হল, এই নদীতে বোধহয় রাত-দুপুরে পরি নামে।
আমি ভূতে বিশ্বাস করি না বটে, তবে পরি বা অল্পরিদের সম্পর্কে বেশ বিশ্বাস আছে। কোনও না কোনওদিন অকস্মাৎ তাদের দেখা পেয়ে যাব। এরকম আশা করে আছি।