জঙ্গলের অভিজ্ঞতা – দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী
শিকার মানুষের একটি আদিম বুনো প্রবৃত্তি। প্রাগৈতিহাসিক যুগে একান্তই বাঁচার প্রয়োজনে বন্য পশুকে বধ করা দরকার হয়েছিল। একদিকে ক্ষুন্নিবৃত্তির তাড়না, অপর দিকে ভয়ঙ্কর হিংস্র জন্তুর অতর্কিতে আক্রমণের আশঙ্কা সব সময় অরণ্যবাসী মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রাখত। তখনকার দিনে মানুষ গুহার আশ্রয় পেলেও বাঘ, সিংহ কিংবা অন্য কোনও হিংস্র মাংসভুক জানোয়ার গুহার ভেতর প্রবেশাধিকার পেলে পরিত্রাণ ছিল না।
সে-যুগকে পেছনে ফেলে মানুষ এগিয়ে এল সভ্যতার সামনে। পাহাড় ও জঙ্গলের ভীতিপ্রদ আবেষ্টনী ছেড়ে মানুষ সভ্যতার আওতায় গড়ে তুলল গ্রাম, শহর। বাঁচার ধারায় চলল নিরাপদ হওয়ার চেষ্টা এবং স্বাচ্ছন্দ্যকে পাওয়ার জন্যে চলল বিবিধ আয়োজন। চেষ্টা সত্ত্বেও ক্রমপরিবর্তিত জীবনধারায় বাঁচার জন্যে সংগ্রাম বহুদিকে থেকেই গেল। আহার-সংস্থানের জন্যে জঙ্গলে ঘোরার প্রয়োজন কেটে গেল বটে, কিন্তু বাঁচার দ্বন্দ্বে মানুষের ওপর মানুষের আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা এবং ভিন্ন প্রকারের হিংসা এমনভাবেই এল যে, মানুষ জানোয়ারকে মারা ছাড়াও শত্রুদমনের জন্যে নিত্যনতুন ভয়ঙ্কর অস্ত্রের আবিষ্কার করতে লাগল।
আজ যে-যুগে আমরা এসে পৌঁছেছি, সেখানে শিকার এসে দাঁড়াল শৌখিনতার পর্যায়ে। দল বেঁধে হাতি চড়ে শিকারের শৌখিনতাকে মানুষ হত্যার বিলাস করে তুলল, তার সঙ্গে গোপনে যোগ দিল Poachers-এর দল। তাদের অস্ত্রাঘাতে মরতে আরম্ভ করল এমন সব জানোয়ার, যাদের চামড়া ফ্যাশানমত্তা শৌখিন মেয়েদের গলাবন্ধের স্থান নিল অথবা ড্রইংরুমে পদদলিত করার জন্যে চামড়া শোভাবৃদ্ধির কাজে লাগতে লাগল। দু-দিক থেকেই ফ্যাশানের আশ্রয় নেওয়ায় মানুষ হিংস্র পশুকেও নৃশংসতায় হার মানিয়ে দিল। ঘটনার প্রতিক্রিয়া থেকে জঙ্গলবাসী পশুদের বাঁচাবার জন্যে অনেকেই সচেষ্ট হলেন, হওয়া প্রয়োজনও ছিল, কিন্তু চেষ্টা কতটা সাফল্য লাভ করেছে, তা এখনও জানা যায়নি।
উপস্থিত শিকারের কথায় আমার বক্তব্যের ঘটনাগুলি আমাকে জড়িয়েই। শিকারি আমি নিজে, সুতরাং আমার বুনো প্রবৃত্তিকে কোনও অছিলায় আড়াল দেওয়ার চেষ্টা ফলপ্রদ হবে বলে মনে করি না। তবে এই প্রবৃত্তির সূত্র খুঁজলে দেখা যাবে, আদিম যুগের মানুষের সঙ্গে আজকের মানুষের হিংস্র আচরণে যে-তফাত আছে, তা বহুক্ষেত্রে সাজিয়ে সত্যকে আড়াল দেওয়া। এইখানে আমার সমর্থনে যেটুকু দৃষ্টান্ত আদিম মানুষের জীবনধারার সঙ্গে মিল ঘটে, তা বলতে পারলে অন্তত সান্ত্বনা থাকে যে, আমি প্রয়োজনীয়তার খাতিরে হিংস্র জন্তু বধ করে অন্যায় কিছু করিনি। ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে আমার শিকারের শৌখিনতাকে সাত্ত্বিক ধর্মাবলম্বীরা নিন্দনীয় ভাবতে পারেন। এতবড় ন্যায্য অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত করার চেষ্টা আমি করব না। তথাপি বলব, ক্ষেত্র বিশেষে হিংসা-প্রবৃত্তিই মানুষের উপকারে লেগেছে। নরভুক বাঘ মেরে জঙ্গল-ঘেঁষা গ্রামের মানুষকে আতঙ্কের কবল থেকে শিকারি নিষ্কৃতি দিয়েছে। গ্রাম্য জীবনধারায় পল্লীবাসী সহজ চলাফেরার সুবিধা পেয়েছে। তা ছাড়া, এমন বাঘের সংস্পর্শে শিকারি এসেছে, যারা আহার সম্বন্ধে বিশেষ রুচির অনুগত। গোয়ালঘর থেকে পুষ্ট গাভিন গোরুকে মারতে পারলে, তারা প্রকৃতিদত্ত স্বাভাবিক আহার জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করতে চায় না। কয়েকটি ঘটনা থেকে জানতে পারা যাবে যে, শিকারি কীরকম বিপদ সঙ্গে নিয়ে সাহস দেখিয়ে বাহবা পেতে চায়।
অনেকের ধারণা যে, আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র এমনই শক্তিশালী যে, বাঘ, সিংহ, হাতি, ভালুক, গণ্ডার অথবা মহিষ কিংবা বাইসন এক গুলিতেই মরে, সুতরাং শিকারে বধ্য জীব যতই ভয়ঙ্কর হোক, যতই শক্তিশালী হোক, মানুষের আবিষ্কৃত আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে পাশবিক শক্তিকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনা চলে না। আনা তো চলেই না, বরং শিকারির তুলনায় শিকারকে নিরীহ বলতেও বাধে না। কথাটা হয়তো ঠিক। তবে যেখানে গুলি লাগলে জানোয়ার দুবার বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পায় না, সেই জায়গায় লক্ষ্যভেদ করতে হলে দীর্ঘকালের অভ্যাস দরকার, কারণ, মারের মারাত্মক স্থান নিতান্তই ক্ষুদ্রাকার। একটি পূর্ণকায় হাতির মারণস্থলের মাপ নিলে বার হবে, তার কর্ণগহ্বরই শ্রেষ্ঠ স্থান, মানে কয়েক ইঞ্চির ঘেরাও মাত্র। দ্বিতীয়, দুই চোখের ওপরের মধ্যস্থল। যতটা কাছ থেকে Vital Spot-এ নির্ভুল লক্ষ্যভেদের ওপর নির্ভর করা যায়, তাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অতি নিকট থেকেই সম্পন্ন করতে হয়। অর্থাৎ, গুলি ঠিক জায়গায় লাগাতে না পারলে শিকারিকেই শিকার হয়ে যেতে হয়। এরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নেই। তাগমারীর প্রশ্নে আরও একটা কথা আছে, যার সঙ্গে ধৈর্য ও আত্মসংযমের যোগ অবিচ্ছেদ্য। ভয়ে হোক, উত্তেজনায় হোক, যে-কোনও কারণে লক্ষ্যভেদের সময়ে অতি সামান্য হাত কেঁপে গেলেই, বন্দুকের নল থেকে বার হওয়া গুলি যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে তাতে সন্দেহ নেই এবং যেখানে গুলির মারে সামান্য ক্ষতের বেশি কিছু হবে না, সেখানে ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ জানোয়ার আততায়ীকে নিকটে পেলে কীভাবে আপ্যায়ন জানাবে, তা সহজেই অনুমেয়। এইরূপ অবস্থায় বহু শিকারি অসাবধানতাবশত মৃত্যুকে বরণ করেছেন। সুতরাং নিশ্চিন্ত মনে বলা চলে যে, অতি শক্তিশালী অস্ত্র সহায় থাকলেও শিকারির বিপদ থেকে নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই।
এই প্রসঙ্গে বিপদ সংক্রান্ত কয়েকটি ঘটনা আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, যা ইতিপূর্বে বিভিন্ন পত্রিকায় বিশদ বর্ণনার দ্বারা প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে, সুতরাং উপস্থিত ক্ষেত্রে প্রতিটি ঘটনা সংক্ষেপে বললেই হবে।
প্রথমেই বন্দুকের ব্যবহারে সতর্কতা সম্বন্ধে বলি। অনেকদিন আগের কথা। দীর্ঘকাল বন্দুক ব্যবহার না করার পর কিছু মোটা টাকা হাতে আসায় কয়েকটি High Velocity Rifle কিনে ফেললাম, তার সঙ্গে সাধারণ দোনলা Shot Gun ছাড়াও Pistol এবং Revolver-ও ছিল। বহুদিন আগে রংপুরে বন্যবরাহ ইত্যাদি মারায় ছেলেবেলা থেকেই রাইফেল চালনায় অভ্যস্ত ছিলাম। অনেকদিন পরে শিকারের অস্ত্রগুলি আবার হাতে আসায় জঙ্গলের ডাক অনুভব করতে লাগলাম। শিকারের নেশায় যারা উত্তেজনা জোগায়, তাদেরকে আমরা বলি খোবুরী, অর্থাৎ যারা খবর দেয় কোথায় বাঘ, লেপার্ড বা বুনো শুয়োর পাওয়া যাবে। খবর এল, মাদ্রাজের কাছেই পঁচিশ-তিরিশ মাইলের মধ্যে একটি গ্রামে দুটি লেপার্ড বেজায় উৎপাত শুরু করে দিয়েছে। একদিন দু-দিন অন্তর কুকুর অথবা ছাগল, ঘর থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে আহারের সুব্যবস্থায় রীতিমতো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
মাদ্রাজে তখন আমি আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ। খবর পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে শিকারে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। কালীকিঙ্কর ঘোষ দস্তিদার (চিত্রশিল্পী) তখন মাদ্রাজে আর্ট কলেজে আমার কাছে শিখতে এসেছিলেন। আমি যে শিক্ষাপীঠে শিক্ষাদানের কর্তব্য নিয়েছিলাম, সেখানে গুরুকুল-পদ্ধতি প্রচলনের চেষ্টায় একেবারে অসফল হইনি। এই কারণে বিদ্যাপীঠে হাজিরা দেওয়ার পর ক্লাসের শেষে গুরু-শিষ্যের সম্বন্ধ দাঁড়াত বন্ধুর মতো। সুবিধাটি কাজে লাগালেন কালীকিঙ্কর। জানালেন, ‘আমিও যাব আপনার সঙ্গে শিকার করতে।’ বন্দুকের অভাব ছিল না, কিন্তু বন্দুক চালনায় কালীকিঙ্করের অজ্ঞতা ছিল বিশ্বাসযোগ্য। কাজেই ভয় পেলাম, তার হাতে ভরা বন্দুক দিতে। কালীকিঙ্কর দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি বন্দুক না পাওয়ায় কসাই-এর মাংস-কাটা ছুরি হাতে পাওয়াতেই সন্তুষ্ট হলেন। ছুরিটি অতি বৃহৎ নেপালি কুকরির মতো। অস্ত্রটি নতুন এবং বেজায় চকচকে। বিঘ্নকারী ডালপালা কাটার জন্যে অস্ত্রটি সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল।
সন্ধ্যার আগেই ঘরোয়া মোটরগাড়ি করে একেবারে খোবুরীর দেওয়া ঠিকানায় এসে পৌঁছনো গেল। চারধারে অনেক ছোটখাটো পাহাড়, বড় রকমের টিলা ছাড়া আর কিছু নয়। এরই মাঝখানে একটি নোংরা ছোট্ট ডোবা, ডোবার চারপাশে ঘন বাঁশঝাড়, আশশেওড়ার ঝোপ এবং আরও কত কী অজানা গাছের ভিড়। জায়গাটা লাগল ভালো। মনে হল, খবরটা মিথ্যা নয়। দেখতে-দেখতে সন্ধ্যা এগিয়ে এল, অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসতে লাগল, বিভিন্ন গাছের এ-ডালে ও-ডালে খটখট করে কোনও অবাঞ্ছনীয় কীটের কর্মব্যস্ততার নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছিল। কালীকিঙ্কর আমার পাশেই বসে ছিলেন। দেখি, তিনি সেই উজ্জ্বল ধারালো অস্ত্রটি নিয়ে ওলটপালট করে কী দেখছেন।
ইস্পাতের উজ্জ্বলতার যে-ছটা এদিক-ওদিক ছড়াচ্ছিল, তা বিনা ক্লেশে ডোবার ওপার থেকেও দেখা যায়। কালীকিঙ্করের কানের কাছে গিয়ে চুপিচুপি বারণ করলাম, ‘নড়াচড়া কোরো না। চিতা কাছে এলেও পালাবে।’ কিছুক্ষণের জন্যে তিনি অস্ত্রটি নামিয়ে রাখলেও, স্থির হয়ে বসে থাকা কালীর ধাতে সয় না। তিনি থেকে-থেকে পিঠের দিকটা আচমকা চুলকাতে আরম্ভ করেছিলেন। শুধু কি চুলকানো? চুলকানি পাওয়ার একটা Signal-ও সঙ্গে থাকল। হাত নাড়ার আগেই বেশ জোরেই ‘উঃ’ শব্দের পর চুলকানির দ্বারা আরাম সংগ্রহ হতে লাগল। বুঝলাম, কালী শিকারের সব কিছু পণ্ড করে দেবেন।
শিকারে সহ্যশক্তি ও সংযম একটি প্রধান সহায়। এবং কালীকিঙ্কর সহ্য ও সংযম, কোনওটিকেই মানতে রাজি নন। এখানে বক্তৃতা দ্বারা চরিত্রশুদ্ধির চেষ্টা বৃথা। রাগ এসে গিয়েছিল, তার প্রকাশ হল সাবধানতার বাণী দিয়ে। বললাম, ‘উঃ, আঃ, এসব চলবে না।’ কালী বোধহয় আদেশটি মানলেন, কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। আবার শব্দ শুনলাম, ‘উঃ।’ নিশ্চিত হলাম, শিকার নিশ্চয়ই কাছে এসেছিল, কালীই তাকে তাড়ালেন। হতাশ হয়ে মাটিতে চাপড় মেরে তাঁকে বললাম, ‘কী করছ, কালী?’ কালী এবার করুণ স্বরে আমারই মতো চুপিচুপি বললেন, ‘স্যার, আমার জামার তলা দিয়ে একটা বড় এবং শক্ত পোকা ঢুকে গিয়েছে। সে কিলবিল করে চলছে, আর থেকে-থেকে কামড়াচ্ছে!’ এতটা বলার পরই সে আবার বলে উঠল, ‘উঃ!’
এতক্ষণ ব্যাঙের কোলাহল শুনিনি, এইবার দাদুরির ডাকে বাঘের বদলে কবিতা এল তেড়ে সব কিছু মোলায়েম করে দেওয়ার জন্যে। শিকারের আশা ছেড়ে মাটিতে পাতা শতরঞ্চির ওপর কোনওপ্রকারে হাঁটু মুড়ে শুয়ে পড়লাম। কালী স্বেচ্ছায় পাহারায় বসে রইলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, বাঘ যদি দাদার কাছে আসে, তাহলে এককোপেই ওই বৃহৎ ছুরির দ্বারা তার মুণ্ডচ্ছেদ করে দেবেন।
বাঘ, লেপার্ড, বনবিড়াল, এমনকী একটা নেউল পর্যন্ত আসেনি। সকালবেলা শিকারের সব আকর্ষণ বর্জন করে ওঠা গেল। Ready Trigger-এ ভরা Rifle পাশেই গাছের ডালে ঠেসান দিয়ে রাখা ছিল। যত রাগ গিয়ে পড়ল ওই বন্দুকটার ওপর। বন্দুক তুলে দাঁড়াবার সঙ্গে-সঙ্গে ‘দুৎ তোর’ বলে মাটিতে বন্দুকের বাঁটটা দিলাম ঠুকে। তারপরেই শুনলাম কানের পাশেই কামান দাগার বিকট আওয়াজ। ৫০০ বোরের High Velocity Rifle থেকে গুলি বেরিয়ে গেল ঠিক আমার কানের পাশ দিয়ে। Ready Trigger-এ আমার আঙুল লাগানোই ছিল, বন্দুকের বাঁট জোরে মাটিতে ঠুকে যাওয়ায় আমার অজ্ঞাতেই Trigger-এ টান পড়েছিল। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলাম এবং প্রতিজ্ঞা করলাম, ভবিষ্যতে প্রয়োজন না হলেও কখনও Ready Trigger-এ হাত রাখব না। অস্ত্রও যে শিকারীর কাছে মারাত্মক বিপদ হতে পারে, তা এই দৃষ্টান্ত থেকে পাওয়া যায়।
অস্ত্র সম্বন্ধেই আর-একটা ঘটনা শুনেছি। বন্দুকের নল দীর্ঘকাল পরিষ্কার না হওয়ায় নলের ভিতর এমনভাবেই মরচে পড়েছিল যে, সেগুলোকে ছোটখাটো লোহার দানা বলা যায়। এই বন্দুক নিয়েই শিকারির বাঘ মেরে সাহস দেখাবার প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু বন্দুকের নল ফেটে শিকারীর দুটি চোখ ও কপালের খুলি উড়িয়ে দিয়েছিল। ভদ্রলোকের কপাল ভালো যে, যন্ত্রণা ভোগের জন্য তিনি বেশিক্ষণ বাঁচেননি।
নতুন জায়গায় এলাম। এখানে ঘোর ঘটা করে পিকনিকের অছিলায় মেয়ে-পুরুষ মিলে শিকারে আসা হয়েছিল। স্থানীয় লোকেরা বাংলো থেকে বেশ খানিকটা দূরে আমাকে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘এইখানে পাঁঠা বাঁধলে পনেরো মিনিটের মধ্যে লেপার্ড এসে পাঁঠাকে নিয়ে যাবে এবং লেপার্ড এমনই জলদি কাজ সারবে যে, আপনি গুলি চালাবারও সময় পাবেন না। তাই বলি, এখানে পাঁঠা বাঁধার আগে ওখানে একটা পাঁঠার মাথার সাইজের পাথর রাখি, আমি ‘মারুন’ বললেই গুলি চালাবেন—এক সেকেন্ড যেন দেরি না হয়।’ তাগমারীর দম্ভে আমার ছিল নির্ভরশীল দাবি। কাজেই এই সামান্য শর্তকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই গ্রহণ করলাম। বললাম, ‘রাখো পাথরের নুড়ি, চেঁচাও ”মারুন” বলে, দেখবে, তোমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমার গুলি চলে গেছে।’ তাই শর্তানুসারে গুলি চলল, কিন্তু পাথরে-লাগা গুলি পিছলে গিয়ে পড়ল একটি চাষাব পায়ের সামনে। সে হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে ওঠাতে আমরা সকলে সেইদিকে গেলাম। লোকটা বেশ দূরেই ছিল। আমাদের ভাগ্য ভালো গুলি তার গায়ে লাগেনি। সে তেড়ে এল একটা কড়া অভিযোগ জানাবার জন্যে। সোজা কথায় সে বলতে চেয়েছিল, ‘আর-একটু হলেই যে মরেছিলাম!’ আমার ত্রুটি স্বীকার করার ওপরেও নালিশ থামানোর জন্যে কিছু ঘুষ দিতে হল। এইরূপটি ঘটত না, যদি আমি পাথরের ওপাশে কী আছে দেখে নিতাম।
এবারেও শিকারের জায়গা অন্ধ্রপ্রদেশেই স্থির হল, মানুষখেকো বাঘের খবরে। নরখাদকের সঙ্গে এর আগে আমার পরিচয় হয়নি। এই কারণেই জানতাম না যে, সাধারণ বাঘ ও নরমাংসভুক বাঘের আচরণে অনেক গরমিল থাকতে পারে। মানুষখেকো বাঘের চলাফেরা, শিকার ধরার প্রথা সবই সাধারণ বাঘের সঙ্গে বহুক্ষেত্রে তফাত। একে তার ভয়ডর অনেক কম, তার ওপর বেজায় চালাক। যাই হোক, শিকারের নেশায় তখন রং লেগে গিয়েছিল, ভয় বা বিপদের সম্বন্ধে খবর নেওয়ার ধৈর্য ছিল না।
এখানে পাহাড়ি পথে বাঘের পদচিহ্ন খোবুরীর দেওয়া ঠিকানা অনুসারে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি। দেখলাম, যে-জীব পদচিহ্ন রেখে গেছে, সে একটি বিরাট বাঘ। ছোটখাটো কুলোর মতো সামনের দুটো থাবা। নরম ধুলোর ওপর টাটকা দাগ দেখে কিছুমাত্র ভুল রইল না যে, জানোয়ারটি সুস্থ শরীরে ঘোরাফেরা করে না। ডানদিককার পায়ের থাবার পুরোপুরি চিহ্ন মাটিতে পড়েনি। অন্যত্র শিকারের অভিজ্ঞতা দিয়ে ধরেছিলাম, বাঘ কোন দিক থেকে আসবে। ছাউনি-দেওয়া গোরুর গাড়িতে এসেছিলাম, সঙ্গে একটি ছোট্ট মোষের বাচ্চাও ছিল। জন্তুটিকে Live Bait হিসেবে ব্যবহারের জন্যে আনা হয়েছিল। যেখানে ছোট্ট মোষটা বাঁধা হল, তার কাছাকাছি মাচান বাঁধার উপযুক্ত কোনও গাছ পাওয়া গেল না এবং মাটিতে গর্ত করে বসার জন্যে কোনও আয়োজনও সঙ্গে করে আনিনি। গত্যন্তরে ঠিক করলাম, গোরুর গাড়ির তলায় বসব। সামনে বিরাট চাকা। এত কাছ থেকে গুলি চালালে বাঘ এক গুলিতেই মরবে, তবু সাবধানতার জন্যে তিন ইঞ্চি ম্যাগনাম এল. জি. বন্দুকের নলে ভরে নিলাম। যদি গুলি খেয়েও বাঘ লাফ মারে, তাহলে চাকার কাছে এসে পৌঁছবার আগেই তিন ইঞ্চি ম্যাগনাম এল. জি. তার দফা শেষ করে দেবে। বেলা থাকতেই এদিকে এসেছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল আর-একটি ছাত্র। গাড়োয়ানও সঙ্গে এনেছিল তার একটি দেহরক্ষী। কারণ, শর্ত ছিল, আমাদের শিকারের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে গাড়োয়ান তার দুটো বলদ নিয়ে ফিরে চলে যাবে। এ-জঙ্গলে কোনও মানুষ একলা চলাফেরা করে না, এমনকী দিনেরবেলাতেও নয়। তাই তার সঙ্গীর প্রয়োজন হয়েছিল। আমার সঙ্গে যে-ছাত্রটি এসেছিল, তার মধ্যে শিকারের বাতিক কে এনেছিল জানি না, কিন্তু বন্দুক কাছে থাকা সত্ত্বেও সে কিছুতেই মাটিতে বসতে রাজি হল না, ছাউনি-ঢাকা গাড়ির ওপর উঠে পড়ল। গাড়ির সমভাবে ওঠানামার কোনও সম্ভাবনা ছিল না, দু-দিকেই বাঁশের ঠেকা দেওয়া হয়েছিল। আমি যে-চাকার তলায় বসেছিলাম, সে-জায়গাটি পাহাড়ি রাস্তার একটি মোড়ের কাছে। তার মানে, রাস্তাটি আমার বসার জায়গা থেকে মোড় ফেরার পথে আমি যেখানে বসে আছি তার ওপর দিকে উঠে গেছে। আরও সোজা করে বলতে গেলে দাঁড়ায়—যেখানে আমার ছাত্রটি ছাউনি দেওয়া গাড়ির ওপর বসেছিল, সে-জায়গাটি ওপর দিকে যাওয়ার পথ থেকে সামান্য উঁচু। এখান থেকে গাড়ির ওপরে বসে মোড়ের দিক থেকে ওপরে ওঠার পথে রাস্তার কিনারায় অনেক ঝোপঝাপ থাকা সত্ত্বেও সব কিছু দেখতে পাওয়া যায়, এবং ছেলেটি দেখেওছিল। দেখার বর্ণনা দিচ্ছি। গাড়ির ছাউনিকে ছোটখাটো ডালপালা দিয়ে আড়াল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু ক্যামোফ্লেজ (Camouflage) কাজে আসেনি। বিকালে লাগানো সবুজ পাতা কড়া রৌদ্রে প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল, একটু নড়াচড়াতেই খড়খড়ে আওয়াজ সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। আওয়াজের কথা গোড়ার দিকে ভাবিনি; কারণ, ঠিক ছিল, আমরা দুজনেই চাকার আড়ালে পিঠোপিঠি বিপরীতদিকে মুখ রেখে বসব। কিন্তু ছাত্র শিকারি আবেষ্টনীতে যা দেখল, তাতে মাটিতে বসা তার পোষাল না। তিনি গুরুভক্তি দেখালেন, ‘যা শত্রু পরে-পরে’ ভেবে।
ইতিমধ্যে জঙ্গলে সন্ধ্যার অন্ধকার এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। চতুর্দিকে কোনও শব্দ নেই। একটি পাখিও উড়ছে না। বাঘের জঙ্গলে আড়ালহীন জায়গায় মাটিতে বসলে এইরকম সময়ে কেমন একটা আতঙ্ক নিজের অজ্ঞাতেই কাছে আসতে থাকে। আমার মনের যখন এইরকম অবস্থা, তখন দেখলাম ছাউনির ওপরটা বেশ কাঁপছে, আর আমার ছাত্র ‘উঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ’ শব্দ শুরু করে দিয়েছে। কালীকিঙ্করকে যেভাবে ধমক দিয়েছিলাম, এবারেও সেইভাবে আস্তে ধমক দিয়ে বললাম, ‘আওয়াজ কোরো না, বাঘ আসার সময় হয়ে গেছে।’ ধমক কাজে এল। বেশ কিছুক্ষণ আবার সব চুপচাপ হয়ে গেল। কিন্তু বদভ্যাস যাবে কোথায়! আবার ‘উঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ’ শব্দ। এবার মাত্রাও যেমন বেশি, তেমনি ছাউনির দোলাও বেড়ে উঠল। মনে হল, ‘উঁ-হুঁ-হুঁ’ শব্দের সঙ্গে ছেলেটি বলছে, ‘বঃ-বঃ-বঃ-বাঘ!’ সন্দেহ রইল না যে, ছেলেটিকে ম্যালেরিয়ায় ধরেছে এবং ভুল বকছে। এখন করি কী? সে যেভাবে গোঙানির আওয়াজ শুরু করল, তাতে বাঘ যে এদিকে আর আসবে না, তাতে সন্দেহ নেই। কিছুক্ষণ বাদে গোঙানির শব্দ থেমে গেল, তার সঙ্গে ছাউনিতে বাঁধা ডালও গেল মাটিতে পড়ে, যা সরু পচা দড়ি দিয়ে কোনওপ্রকারে ছাউনির চাঁচারিতে বাঁধা হয়েছিল। ‘উঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ’ শব্দের সঙ্গে দেহের যে-কাঁপুনি এসেছিল, তারই ঝাঁকুনিতে ডালটা বেশ সশব্দেই মাটিতে পড়ল। ওপরে উঠে সান্ত্বনা দিয়ে ম্যালেরিয়া রোগ সারাবার চেষ্টা বৃথা ভেবে, ওই বাঁধা মোষটার দিকে তাকিয়েই বসে রইলাম। সময় এগিয়ে চলল গভীর রাতের দিকে, রাতও এগিয়ে চলল। এর মধ্যেই বেশ কয়েকবার ঝিমুনোর সময় মাথা গিয়েছিল চাকায় ঠুকে। চমকে উঠে বসেছি, অভ্যাসমতো বন্দুকের দিকে হাতও চলে গিয়েছিল। বাঘ আসেনি।
শেষ পর্যন্ত ভোর হয়ে গেল, চাকার তলা থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে এসে রাগকে শাসন করে রুগিকে দেখতে গেলাম। দেখলাম, সে চমৎকার সুস্থ শরীরে বসে আছে চোখ দুটো বড়-বড় করে মোড়ের ঝোপটার দিকে তাকিয়ে। প্রথম কথাতেই জিগ্যেস করলাম, ‘জ্বর কি খুব বেশি হয়েছিল?’ বললে, ‘না, স্যার, বাঘ।’ বলেই দেখিয়ে দিল কোন জায়গায় বাঘকে সে আসতে দেখেছে। জায়গাটি পরীক্ষা করার প্রয়োজন থাকায় বন্দুক নিয়ে মোড়ের দিকে চললাম, ছাত্রটিও আমার সঙ্গ নিল। সে এইটুকু ব্যবধানেও একলা থাকতে চায় না। মোড় ঘুরে দেখলাম, সত্যই আমার চেনা বাঘের থাবা পড়েছে রাস্তার ওপরে এবং এসে থেমেছে ঠিক আমার গাড়ির চাকার পেছনে। বাঘ এইখানেই বসেছিল এবং ল্যাজের নড়াচড়ায় খানিকটা জায়গা প্রায় ঝাঁট দেওয়ার মতো হয়ে গিয়েছিল। বসার ভঙ্গি দেখলে বেশ বোঝা যায় যে, আক্রমণের জন্যে সে প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু আমার ছাত্রটি আমাকে বাঁচিয়ে দিল। ‘উঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ’ শব্দ এবং ছাউনি থেকে ডাল যদি সশব্দে ছিঁড়ে মাটিতে না পড়ত, তাহলে বাঘ কত সহজে হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে নিতে পারত—তা অনুমান করা চলে। কারণ, পেছন থেকে থাবার একটি থাপ্পড়েই আমার মাথা ধড় থেকে বিচ্যুত হত। আত্মরক্ষার কোনওরকম উপায়ই পেতাম না। এখানে আমার সাহসের কোনও পরিচয়ই নেই। নিরবচ্ছিন্ন অজ্ঞতা এবং দৈবকৃপায় যদি ছাত্রটি রীতিমতো ভয় না পেত, তাহলে আজকে সত্য ঘটনার বিবৃতি দেওয়ার সুবিধে পেতাম না।
পরের ঘটনা কর্নুলের জঙ্গলে। বাঘ মারতে এসেছিলাম। বাঘের বসতি এখানেও কম নেই। যে-বাঘের খবর পেয়ে এখানে এসেছিলাম, শুনলাম, সে নাকি মন্ত্রপূত। এ-পর্যন্ত বহুবার তার ওপর গুলি চলেছে, কিন্তু কেউই তাকে মারতে পারেনি। ওই বাঘকে বিজলিবাতির আলো দিয়ে দেখবার চেষ্টা করলে সে নাকি সুইচ টেপার সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে অদৃশ্য করে দেয়।
বর্ণনাটি তেমন উৎসাহপূর্ণ বলে মনে হল না, তথাপি মন্ত্রকে মারার অস্ত্র আমার কাছে ছিল। একটি গোরু মারার খবর পেয়ে যথাস্থানে উপস্থিত হলাম। গোরুটি একটি শুকনো নালার তলায় পড়েছিল। চারধার একেবারে ফাঁকা। কিছু দূরে কয়েকটি বাঁশের ঝোপ থাকলেও তার ভেতরে বসে নালার তলায় লক্ষ্যভেদ অসম্ভব। বাঘ এলেও তাকে দেখা যাবে না। লক্ষ্যভেদে সুবিধের জন্যে শিকারের একটি নীতিবিরুদ্ধ কাজ করে বসলাম। আমরা ছিলাম দলে সাত-আটজন। গোরুর গলায় কোনওরকমে আলগোছে দড়ির ফাঁস লাগিয়ে তাকে টেনে পাড়ের ওপর তুলতে আমরা হিমশিম খেয়ে গেলাম। গলায় দড়ি পরাবার প্রথায় দুটি ডালের সাহায্যে মাথা তোলা হয়েছিল এবং এবারেও সেইভাবে মাথা তুলে গলার ফাঁস আলগোছে খোলা হল, যাতে মানুষের ছোঁয়া গোরুর ওপর না লাগে। বাঘকে সন্দিগ্ধ করার ইচ্ছা ছিল না। তবু এইটুকু সাবধানতা কোনও কাজে আসবে বলে মনে হল না। কারণ, মরা গোরু যে চলে না বাঘও জানে এবং সেই মরা গোরু খালের ওপর উঠে আসায় যে সন্দেহের কারণ হয়েছিল—তা বাঘ কাছে এলেই জানতে পারবে। তবে পথ চলতে বাঘ মানুষের গন্ধ প্রায়ই পেয়ে থাকে। কাজেই এ-বিষয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না। এখন কাছাকাছি বসার জন্যে কৃত্রিম বাঁশের ঝোপ যদি করা যায়, তবেই শিকারে বসা চলে।
শিকারে বহু ক্ষেত্রে মনকে দৃঢ় করায় অনভ্যস্ত ছিলাম না। লোকগুলিকে বললাম, ‘বেশ দূরে গিয়ে যতগুলো পারিস বাঁশ কেটে নিয়ে আয়।’ ডালপালাসমেত অনেকগুলো গোটা-গোটা বাঁশ যথাসময়ে এসে উপস্থিত হল। কিন্তু মাটিতে গর্ত করার জন্যে শাবল, কোদাল আনলেও সেগুলো কাজে লাগানো গেল না। এখানে মাটির বালাই নেই, সবই নুড়ি। কয়েক ইঞ্চি গর্ত করার চেষ্টা করলেই শাবলের মুখ ভোঁতা হয়ে যাবে, সুতরাং বাঁশগুলো একের ওপর আরেকটা ঠেকা দিয়ে সাজানো ছাড়া আর কোনও পথ পাওয়া গেল না। ব্যাপারটি দাঁড়াল, বাঘ যদি গুলি খেয়ে লাফ মারে, তাহলে বাঁশের কেল্লার মধ্যেই আমার গোর হয়ে যাবে। মাঝখানে ফাঁক রাখায় কোনওরকমে বসলাম। চলতি নিয়মানুসারে আমাকে ভেতরে বসিয়ে সঙ্গের লোকগুলো কথা বলতে-বলতে গ্রামের দিকে চলে গেল।
এখানেও এত কাছ থেকে Rifle-এর ব্যবহার অর্থহীন, তাই দোনলা Shot Gun নিয়ে বসেছিলাম। মাথার ওপর একটি ডালে মোটরগাড়ির Spot Light লাগিয়ে Switch রাখলাম আমার হাতে। বাঘ ঠিকই এল, কিন্তু যখন সুইচ টিপলাম, তখন আলো পড়ল আমার মুখের সামনে; কারণ ওপরের Spot Lightটা কীভাবে বেঁকে গিয়েছিল। বাঘ আমাকে দেখল জ্যোতির্ময় রূপে আর বাঘ নিজে রইল অন্ধকারে ডুবে। জন্তুটিকে দেখবার সুযোগও পেলাম না। এরপরই সে একটি হুঙ্কার দিয়ে স্থানটি পরিত্যাগ করল। আলো দেখে ভড়কানো অভ্যাস না থাকলে বাঘ ওইভাবে পালাত না।
সারারাত বসেই থাকলাম। ভোরের দিকে কয়েকটা ভালুক এসে ঠিক আমার পেছনেই উইয়ের ঢিপিতে জোরে শোষণকার্য শুরু করে দিল। উইয়ের গর্তে মনোমতো আহার পাওয়ায় আনন্দের উচ্ছ্বাসে এমনভাবেই রুখে উঠল যে, শোষণকালীন যে-যার নিজের অংশে ভাগ বাড়িয়ে নেওয়ার জন্যে হুড়োমুড়ি পড়ে গেল। আমার পাশেই ভাগ-বাটরার গোল বাধায় হুড়োমুড়ির ধাক্কা এসে পড়তে লাগল আড়াল দেওয়া বাঁশের ওপর। বাঁশগুলি একটার ওপর আরেকটা ঠেসান দিয়ে বাঁধা হয়েছিল। অনবরত ধাক্কা লাগায় বাঁশের ঘরেও দোলা শুরু হয়ে গেল। বেশিক্ষণ এইভাবে দোলা চললে ভালুক আমাকে ছেড়ে দিত না। কপাল ভালো যে, আহারের আকর্ষণ ওদের এমনভাবেই অন্যমনস্ক করে রেখেছিল যে, আমি ওদের অত কাছে থাকা সত্ত্বেও খোঁজ নেওয়ার অবসর পায়নি।
বেশ খানিকক্ষণ পরে ভালুকের দল চলে গেল। তখন প্রায় সকাল হয়ে গেছে। লোকদের অপেক্ষায় বসে থাকলাম, কারণ বাইরে থেকে ঠিক জায়গার বাঁধন না খুললে সবক’টি বাঁশ আমার ওপরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যাক, এবারেও বাঁচলাম।
অন্য ঘটনায় ফিরে আসি। মাচানেই বসেছিলাম, তবে মাচান বাঁধা হয়েছিল বাবলাগাছের সরু ডালে, মাটি থেকে আট-ন’ ফুটের বেশি হবে না। বাঘ উলটো পথে এসে আমার সঙ্গে শেকহ্যান্ড করতে চাইলে আপত্তি করার অবসর দেবে না। তবে মরা গোরুটার সামনেই ছিল কাঁটাঝোপ, বড় মোটা পেরেকের মতো কাঁটায় ভরা ঝোপ, বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে গোরু আর আমার মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি করেছিল। কাঁটাঝোপের ত্রিসীমানায় বাঘ আসতে চায় না, তাই সামনে থেকে আক্রমণের কোনও ভয় ছিল না।
চুপচাপ বসে আছি, হঠাৎ সামনে হাড়-ভাঙার শব্দ শুনলাম। বুঝলাম, বাঘ এসেছে। ক্ষিপ্র গুলি চালানোয় অভ্যস্ত থাকায় বাঘকে খেতে দিয়ে, রয়ে-সয়ে অঙ্ক কষে টিপ করার প্রয়োজন বোধ করিনি। তাই শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে Electric Torch টিপে দিলাম। দেখলাম, বাঘ আহারে বসেছিল আমারই দিকে মুখ করে। গুলি চলার সঙ্গে-সঙ্গে আহত জানোয়ার সোজা লাফিয়ে উঠল প্রায় আট-দশ ফুট ওপরে। তারপরই শূন্য থেকে ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। ভাবলাম, গুলি কাজ করেছে; কিন্তু ভাবা কাজে এল না। বাঘ আবার লাফ দিল এবং কাঁটাবন পার হয়ে আমার মাচানের ওপর এসে পড়ল। দুটো থাবাই তখন আমার পায়ের সামনে। সমস্ত মুখের গহ্বর দেখতে পাচ্ছিলাম। হয়তো তার হুঙ্কারের সঙ্গে কিছু লালাও আমার মুখে এসে পড়েছিল। আমি তখন হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। বন্দুকের নল ঘোরাবার উপায় ছিল না। বাঘ কিন্তু মাচানে বেশিক্ষণ ঝুলতে পারল না, কাঁটাবনের ওপরেই আছাড় খেল। তারপর সেখান থেকে লাফের পর লাফ মেরে দূরে চলে গেল এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মনে হল, কোনও শক্ত জিনিসের সঙ্গে তার জোরে মাথা ঠুকে গিয়েছে। এরপর পরিচিত গোঙানির শব্দ শুনলাম। নিশ্চিন্ত হলাম, বাঘ এখন চলৎশক্তিহীন, মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপড়া চালিয়েছে। কয়েক মুহূর্ত পরেই ঝড় উঠল বিকট শব্দ করে। কয়েকটি জোর ঝাঁকুনিতে আমি যে-মাচানে বসেছিলাম, তার একটি ডাল দোফালা হয়ে গেল। প্রতিটি দমকা হাওয়ায় নাগরদোলার অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করতে লাগলাম। একবার মাচানসমেত প্রায় মাটি ছুঁয়ে আবার ওপরে উঠে যাচ্ছি। এই অবস্থায় Ready Trigger সহ ভরা বন্দুক তলায় পড়ে গেল। বন্দুকটি আমায় নয়, আমার সঙ্গে যে-শিকারি এসেছিলেন তাঁর। ডাল দোফালা হওয়ার সঙ্গে শিকারি মাটিতে না পড়লেও আমার কাছ থেকে সরে গিয়েছিলেন। নলের মুখ ছিল ঠিক আমার নীচেই। বন্দুকের পতনকালীন একটি কাঁটা Triggeré-এ লাগলেই আমার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে হত, তবে সান্ত্বনা থাকত এইটুকু যে, বাঘ মেরে মরেছি। এমন কৃতিত্বকে কি বাজে বলা চলে?
শিকারে বিপদ কি কেবল বাঘ-ভালুকের সংস্পর্শে আসাতেই শেষ? সময়মতো সাবধান হতে পারলে ওদের কাছ থেকে পার আছে, কিন্তু সাপের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেষি হলে পরিত্রাণ নেই। বিশেষ করে রাজগোক্ষুর, কালকেউটে, করায়ত বা চিতি বোরা। মানুষ তাদের শান্তিভঙ্গ করলে আর রক্ষা নেই। রাজগোক্ষুর বা কালকেউটের কথা ছেড়ে দিই, ওদের অনেকসময় বড় আকৃতির জন্যে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু চিতি বোরা বা করায়তের বাচ্চা কয়েকটা নুড়ি পেলেই তার তলায় বেমালুম আত্মগোপন করে ফেলে।
এবারকার কাহিনি এই বিষাক্ত জীবদের নিয়ে। লেপার্ড শিকারে এসেছিলাম, সঙ্গে ছিলেন একজন নবদীক্ষিত শিকারি, ইতিপূর্বে কখনও তিনি বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে ঢোকেননি। আমি এদিকে আসছি শুনে বন্ধুবর একেবারে সাহেবি মল্লবেশে শিকারের তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন। দেহে জড়িয়ে থাকল গাঢ় সবুজ রঙের বুশশার্ট, নিম্নাঙ্গে হাফপ্যান্ট, তারও তলায় দেখা গেল ব্যান্ডেজের প্রথায় বাঁধা পট্টি। পট্টির তলায় জবরদস্ত মোটা চামড়ার বুট। প্রতি পদক্ষেপেই জুতোর মচমচ শব্দ যেন জঙ্গলের জানোয়ারদের জানিয়ে দিতে চায়, ‘তফাত যাও, তফাত যাও।’ শিকারির আগমন-বার্তা এইভাবে প্রচার হওয়ায় লেপার্ড আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা শুরু করে দিল। প্রথম দর্শনেই তার আকার আন্দাজে বুঝেছিলাম যে, তার প্রাপ্তবয়স্ক হতে এখনও অনেকদিন সময় আছে। শিশু বয়েসে হয়তো মা পরিত্যাগ করায় তার নিজের সাবধানতা সম্বন্ধে উপযুক্তভাবে চালাক হয়ে উঠতে পারেনি। তাই আমরা ওর পিছু নেওয়ায় চোখে চোখ পড়লেই একটু পালিয়ে কাছেই যে-কোনও ঝোপ পেলেই তার মধ্যে ঢুকে পড়ছিল। এই পালাবার ব্যাপারে বুঝলাম, বন্ধুর জুতোই যত সব গণ্ডগোল বাধিয়েছে।
সারা সকাল ঘুরতে-ঘুরতে দুপুর পার হয়ে গেল। দুজনের মধ্যে কেউই লেপার্ডকে জুতসইভাবে বন্দুকের সামনে পেলাম না। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। পা থেকে কেডস দুটো ফেলে দিয়ে বাবু হয়ে ছায়ার তলায় একটি বড় পাথরের ওপর দুজনে বসে পড়লাম। বসার সুবিধে পাওয়ায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম, কিন্তু সহজলব্ধ আরামটি বুট ও পট্টির বাঁধন থাকায় বন্ধুবর ভোগে লাগাতে পারলেন না। গত্যন্তরে পা ঝুলিয়েই বসতে হল। পায়ের চারধারে ডিমের আকারের ছোট-বড় পাথরের নুড়ি। কোনও কাজ না থাকায় বন্ধুবর ঝোলানো পা-টাকে ঠকঠক শব্দ করে আমরা যে-পাথরে বসেছিলাম সেইটায় ঠুকতে লাগলেন। তা ছাড়া, বুটের ঠোক্করে পায়ের তলার নুড়িগুলি চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়তে লাগল। বেশিক্ষণ এই অস্থিরতার আরাম বন্ধুবরকে ভোগ করতে হয়নি। আমি তাঁর পায়ের দিকে তাকাতে দেখি, ফুটখানেক লম্বা একটি সাপ বন্ধুর পায়ের দোলার সঙ্গে একটু দূরে মাথা তুলে দুলছে। হাঁ-করা মুখ। ছোট্ট হলে কী হয়, মুখের তুলনায় দাঁত দুটি বেজায় বড়। বন্ধু নিশ্চয়ই এ-দৃশ্যটি দেখেননি। সাপের নজর বুটের দিকে থাকায়, আমি ধীরে-ধীরে একটি বড় নুড়ি তুলে নিলাম, তারপর বেশ জোরেই নুড়িটি সাপের মাথা লক্ষ করে ছুঁড়লাম। কাজ হল, বিষধরের মাথা থেঁতলে গেল।
ইচ্ছে করেই ‘সাপ-সাপ’ করে চিৎকার করিনি। যদি এরূপ সাবধানতার বাণী ভদ্রলোক শুনতেন, তাহলে তাড়াহুড়োয় দাঁড়াবার চেষ্টা করলেই সাপ ছোবল মারায় কোনও অসুবিধে বোধ করত না। যে-সাপটি মারা পড়ল, সেটি করায়ত। এই জাতীয় সাপের প্রেম অতি সাঙ্ঘাতিক, সহজে এদের কেউ কখনও বেজোড় হতে দেখেনি। বন্ধুকে বললাম, ‘এখান থেকে উঠে পড়ো, আমার মনে হয়, জোড়ের সাপ তোমারই পায়ের তলায় কোথাও লুকিয়ে আছে।’ মরা সাপ এবং বাঁচা সাপের অস্তিত্ব অত নিকটে থাকায় আমার বন্ধুর মুখশ্রী ভয়ে কীরকম হয়েছিল, তার বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করব না। তবে এইটুকু বলতে পারি, তিনি কর্ণ ও নাসিকা মর্দনের পর তাঁর ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে ও আমাকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন এই বলে যে, ‘জীবনে আর কখনও শিকারে আসব না।’
এরপরেও বহু প্রকারের বিপদের কথা বলার ইচ্ছে ছিল। হয়তো ভবিষ্যতে কোনওদিন সুবিধে পেলে বলবও।*
* এই রচনার তিনটি স্কেচ লেখকের আঁকা।
মাসিক রোমাঞ্চ
পুজো সংখ্যা, ১৯৭৩