1 of 2

জগদানন্দ রায়

আমরা প্রত্যেকেই একটি ছোটো ব্যক্তিগত সীমার মধ্যে নিজের বিশেষ পরিচয় দিয়ে থাকি। জীবনযাত্রার বিশেষ প্রয়োজন এবং অভ্যাস অনুসারে যাদের সঙ্গে আমাদের দৈনিক ব্যবহার তাদেরই পরিবেষ্টনের মধ্যে আমাদের প্রকাশ। সকলেই জানে সে প্রকাশের মধ্যে নিত্যতা নেই। এই রকমের ছোটো ছোটো সম্বন্ধসূত্র ছিন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জীবনের এই অকিঞ্চিৎকর ভূমিকা লুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু এই যদি আমাদের একমাত্র পরিচয় হয় তা হলে মৃত্যুর মতো শূন্যতা আর কী হতে পারে। প্রাণপণ চেষ্টায় প্রাণ-ধারণের দুঃখ স্বীকার কীজন্যে যদি মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সত্তার সমগ্র পরিচয় নিঃশেষিত হয়ে যায়। মানুষের মন থেকে এ সংস্কার কিছুতেই ঘোচে না যে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে বেঁচে থাকা, অথচ সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না, একদিন তাকে মরতেই হয়। মানুষ তবে কার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে? জীব-প্রকৃতির। সে উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, জীবপ্রবাহ রক্ষা করা চলা।

মরতে মরতেও আমরা নানা রকম তাগিদে তার সেই উদ্দেশ্য সাধন করি। প্রলোভনে, শাসনে ও মোহে প্রকৃতি ফাঁকি দিয়ে আপন কাজ করিয়ে নেয়। প্রতিদিন নগদ পাওনা দিয়ে খাটিয়ে নিয়ে কাজ শেষ হলেই এক নিমেষেই বিদায় দেয় শূন্যহাতে। বাইরে থেকে দেখলে ব্যক্তিগত জীবনের এই আরম্ভ এই শেষ। প্রকৃতির হাতে এই তার অবমাননা। কিন্তু তাই যদি একান্ত সত্য হয়, তা হলে প্রকৃতির প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাকেই শ্রেয় বলতুম। কিন্তু মন তো তাতে সায় দেয় না।

আছি এই উপলব্ধিটাও আমার কাছে অন্তরতম। এইজন্য নিরতিশয় নাস্তিত্বের কোনো লক্ষণকে চোখে দেখলেও মনে তাকে মানতে এত বেশি বাধে। মৃত্যুকে আমরা বাইরে দেখি অথচ নিজের অন্তরে তার সম্পূর্ণ ধারণা কিছুতেই হয় না। তার প্রধান কারণ নিজেকে দেখি সকলের সঙ্গে জড়িয়ে– আমার অস্তিত্ব সকলের অস্তিত্বের যোগে। উপনিষদ বলেছেন, নিজেকে যে অন্যের মধ্যে জানে সে-ই সত্যকে জানে। তার মৃত্যু নেই, মৃত্যু আছে স্বতন্ত্র আমির। অহমিকায় নিজেকে নিজের মধ্যেই রুদ্ধ করি, নিজেকে অন্যের মধ্যে বিস্তার করি প্রেমে। অহমিকায় নিজেকে আঁকড়ে থাকতে চাই, প্রেমে প্রাণকেও তুচ্ছ করতে পারি– কেননা, প্রেমে অমৃত।

মানুষ সাধনা করে ভূমার, বৃহতের। সে বলেছে যা বড়ো তাতেই সুখ, দুঃখ ছোটোকে নিয়ে। যা ছোটো তা সমগ্রের থেকে অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন বলেই অসত্য। তাই ছোটোখাটোর সঙ্গে জড়িত আমাদের যত দুঃখ। আমার ধন, আমার জন, আমার খ্যাতি,আমি-গণ্ডি দিয়ে স্বতন্ত্র-করা যা-কিছু, তাই মৃত্যুর অধিকারে; তাকে নিয়েই যত বিরোধ, যত উদ্‌বেগ, যত কান্না। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস তার অমর সম্পদ-সাধনার ইতিহাস। মানুষ মৃত্যুকে স্বীকার করে এই ইতিহাসকে রচনা করছে, সকল দিক থেকে সে আপন উপলব্ধির সীমাকে যুগে যুগে বিস্তার করে চলেছে বৃহতের মধ্যে। যা-কিছুতে সে চিরন্তনের স্বাদ পায় তাকে সেই পরিমাণেই সে বলে শ্রেষ্ঠ।

দুই শ্রেণীর বৃহৎ আছে। যশ্চায়মস্মিন্‌ আকাশে, আর যশ্চায়মস্মিন্‌ আত্মনি। এক হচ্ছে আকাশে ব্যাপ্ত বস্তুর বৃহত্ত্ব, আর হচ্ছে আত্মায় আত্মায় যুক্ত আত্মার মহত্ত্ব। বিষয়-রাজ্যে মানুষ স্বাধীনতা পায় জলে স্থলে আকাশে– যাকে সে বলে প্রগতি। এই বস্তুজ্ঞানের সীমাকে সে অগ্রসর করতে করতে চলে। এই চলায় সে কর্তৃত্ব লাভ করে, সিদ্ধি লাভ করে। মুক্তিলাভ করে আত্মার ভূমায়, সেইখানে তার অমরতা। বস্তুকে তার বৃহৎস্বরূপে গ্রহণ করার দ্বারা আমরা ঐশ্বর্য পাই, আত্মাকে তার বৃহৎ ঔদার্যে দান করার দ্বারাই আমরা সত্যকে লাভ করি।

বৌদ্ধধর্মে দেখি বলা হয়েছে, মুক্তির একাট প্রধান সোপান মৈত্রী। কর্তব্যের পথে আমরা আপনাকে দিতে পারি পরের জন্যে। সেটা নিছক দেওয়া, তার মধ্যে নিজের মধ্যে পরকে ও পরের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি নেই। মৈত্রীর পথে যে দেওয়া তা নিছক কর্তব্যের দান নয়; তার মধ্যে আছে সত্য উপলব্ধি।

সংসারে সকলের বড়ো সাধনা অন্যের জন্য আপনাকে দান করা, কর্তব্যবুদ্ধিতে নয়– মৈত্রীর আনন্দে অর্থাৎ ভালোবেসে। মৈত্রীতেই অহংকার যথার্থ লুপ্ত হয়, নিজেকে ভুলতে পারি। যে পরিমাণে সেই ভুলি সেই পরিমাণেই বেঁচে থেকে আমরা অমৃতের অধিকারী হই। আমাদের সেই আমি যায় মৃত্যুতে সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যা অহমিকা দ্বারা খণ্ডিত।

আজকে যা বলতে এসেছি এই তার ভূমিকা।

আজ আশ্রমের পরম সুহৃদ জগদানন্দ রায়ের শ্রাদ্ধ-উপলক্ষে তাঁকে স্মরণ করবার দিন। শ্রাদ্ধের দিনে মানুষের সেই প্রকাশকে উপলব্ধি করতে হবে যা তার মৃত্যুকে অতিক্রম ক’রে বিরাজ করে। জগদানন্দের সম্পূর্ণ পরিচয় হয়তো সকলে জানেন না। আমি ছিলেম তখন “সাধনা’র লেখক এবং পরে তার সম্পাদক। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত হয়। “সাধনা’য় পাঠকদের তরফ থেকে বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন থাকত। মাঝে মাঝে আমার কাছে তার এমন উত্তর এসেছে যার ভাষা স্বচ্ছ সরল– বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গে এমন প্রাঞ্জল বিবৃতি সর্বদা দেখতে পাওয়া যায় না। পরে জানতে পেরেছি এগুলি জগদানন্দের লেখা, তিনি তাঁর স্ত্রীর নাম দিয়ে পাঠাতেন। তখনকার দিনে বৈজ্ঞানিক সমস্যার এরূপ সুন্দর উত্তর কোনো স্ত্রীলোক এমন সহজ করে লিখতে পারেন ভেবে বিস্ময় বোধ করেছি। একদিন যখন জগদানন্দের সঙ্গে পরিচয় হল তখন তাঁর দুঃস্থ অবস্থা এবং শরীর রুগ্‌ণ। আমি তখন শিলাইদহে বিষয়কর্মে রত। সাহায্য করবার অভিপ্রায়ে তাঁকে জমিদারি কর্মে আহ্বান করলেম। সেদিকেও তাঁর অভিজ্ঞতা ও কৃতিত্ব ছিল। মনে আক্ষেপ হল– জমিদারি সেরেস্তা তাঁর উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র নয়, যদিও সেখানেও বড়ো কাজ করা যায় উদার হৃদয় নিয়ে। জগদানন্দ তার প্রমাণ দিয়েছেন। কিন্তু সেখানে তিনি বারংবার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লেন। তাঁর অবস্থা দেখে মনে হল তাঁকে বাঁচানো শক্ত হবে। তখন তাঁকে অধ্যাপনার ক্ষেত্রে আহ্বান করে নিলুম শান্তিনিকেতনের কাজে। আমার প্রয়োজন ছিল এমন সব লোক, যাঁরা সেবাধর্ম গ্রহণ করে এই কাজে নামতে পারবেন, ছাত্রদেরকে আত্মীয়জ্ঞানে নিজেদের শ্রেষ্ঠ দান দিতে পারবেন। বলা বাহুল্য, এরকম মানুষ সহজে মেলে না। জগদানন্দ ছিলেন সেই শ্রেণীর লোক। স্বল্পায়ু কবি সতীশ রায় তখন বালক, বয়স উনিশের বেশি নয়। সেও এসে এই আশ্রমগঠনের কাজে উৎসর্গ করলে আপনাকে। এঁর সহযোগী ছিলেন মনোরঞ্জন বাঁড়ুজ্যে, এখন ইনি সম্বলপুরের উকিল, সুবোধচন্দ্র মজুমদার, পরে ইনি জয়পুর স্টেটে কর্মগ্রহণ ক’রে মারা গিয়েছেন।

বিদ্যাবুদ্ধির সম্বল অনেকেরই থাকে,সাহিত্যে বিজ্ঞানে কীর্তিলাভ করতেও পারেন অনেকে, কিন্তু জগদানন্দের সেই দুর্লভ গুণ ছিল যাঁর প্রেরণায় কাজের মধ্যে তিনি হৃদয় দিয়েছেন। তাঁর কাজ আনন্দের কাজ ছিল, শুধু কেবল কর্তব্যের নয়। তার প্রধান কারণ, তাঁর হৃদয় ছিল সরস, তিনি ভালোবাসতে পারতেন। আশ্রমের বালকদের প্রতি তাঁর শাসন ছিল বাহ্যিক, স্নেহ ছিল আন্তরিক। অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা দূরত্ব রক্ষা করে ছেলেদের কাছে মান বাঁচিয়ে চলতে চান– নিকট পরিচয়ে ছেলেদের কাছে তাঁদের মান বজায় থাকবে না এই আশঙ্কা তাঁদের ছাড়তে চায় না। জগদানন্দ একই কালে ছেলেদের সুহৃদও ছিলেন সঙ্গী ছিলেন অথচ শিক্ষক ছিলেন অধিনায়ক ছিলেন– ছেলেরা আপনারাই তাঁর সম্মান রেখে চলত– নিয়মের অনুবর্তী হয়ে নয়, অন্তরের শ্রদ্ধা থেকে। সন্ধ্যার সময় ছাত্রদের নিয়ে তিনি গল্প বলতেন। মনোজ্ঞ করে গল্প বলবার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তিনি ছিলেন যথার্থ হাস্যরসিক, হাসতে জানতেন। তাঁর তর্জনের মধ্যেও লুকোনো থাকত হাসি। সমস্ত দিন কর্মের পর ছেলেদের ভার গ্রহণ করা সহজ নয়। কিন্তু তিনি তাঁর নির্দিষ্ট কর্তব্যের সীমানা অতিক্রম করে স্বেচ্ছায় স্নেহে নিজেকে সম্পূর্ণ দান করতেন।

অনেকেই জানেন ক্লাসের বাইরেও ছেলেদের ডেকে ডেকে তাদের লেখাপড়ায় সাহায্য করতে কখনোই তিনি আলস্য করতেন না। নিজের অবকাশ নষ্ট করে অকাতরে সময় দিতেন তাদের জন্যে।

কর্তব্যসাধনের দ্বারা দাবি চুকিয়ে দিয়ে প্রশংসা লাভ চলে। কর্তব্যনিষ্ঠতাকে মূল্যবান বলেই লোকে জানে। দাবির বেশি যে দান সেটা কর্তব্যের উপরে, সে ভালোবাসার দান। সে অমূল্য, মানুষের চরিত্রে যেখানে অকৃত্রিম ভালোবাসা সেইখানেই তার অমৃত। জগদানন্দের স্বভাবে দেখেছি সেই ভালোবাসার প্রকাশ, যা সংসারের সাধারণ সীমা ছাড়িয়ে তাকে চিরন্তনের সঙ্গে যোগযুক্ত করেছে। আশ্রমে এই ভালোবাসা-সাধনার আহ্বান আছে। নির্দিষ্ট কর্মসাধন করে তার পর ছুটি নিয়ে একটি ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে নিজেকে বদ্ধ রাখতে চান যাঁরা, সেরকম শিক্ষকের সত্তা এখানে ক্ষীণ অস্পষ্ট। এমন লোক এখানে অনেক এসেছেন গেছেন পথের পথিকের মতো। তাঁরা যখন থাকেন তখনো তাঁরা অপ্রকাশিত থাকেন, যখন যান তখনো কোনো চিহ্নই রেখে যান না।

এই যে আপনার প্রকাশ, এ ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন– এ প্রকাশ ভালোবাসায়, কেননা, ভালোবাসাতেই আত্মার পরিচয়। জগদানন্দের সে দান যে প্রাণবান, সে শুধু স্মৃতিপটে চিহ্ন রাখে না, তা একটি সক্রিয় শক্তি বা সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে যায়। আমরা জানি বা না-জানি বিশ্ব জুড়ে এই প্রেম নিয়তই সৃষ্টির কাজ করে চলেছে। কেবল শক্তি দান করে সৃষ্টি হয় না, আত্মা আপনাকে দান করার দ্বারাই সৃষ্টিকে চালনা করে। বেদে তাই ঈশ্বরকে বলেছেন, “আত্মদা বলদা’ যেখানে আত্মা নেই শুধু বল সেখানে প্রলয়।

আমি এই জানি আমাদের আশ্রমের কাজ পুনরাবৃত্তির কাজ নয়, নিরন্তর সৃষ্টির কাজ। এখানে তাই আত্মদানের দাবি রাখি। এই দানে সীমা নেই। এ দশটা-চারটের মধ্যে ঘের-দেওয়া কাজ নয়। এ যন্ত্রচালনা নয়, এ অনুপ্রাণন।

আজ শ্রাদ্ধের দিনে জগদানন্দের সেই আত্মদানের গৌরবকে স্বীকার করছি। এখানে তিনি তাঁর কর্মের মধ্যে কেবল সিদ্ধি লাভ করেন নি অমৃত লাভ করেছেন। কেননা তিনি ভালোবেসেছেন আনন্দ পেয়েছেন। আপনার দানের দ্বারা উপলব্ধি করেছেন আপনাকে। তাই আজ শ্রাদ্ধবাসরে যে পারলৌকিক কর্ম এটা তাঁর পারিবারিক কাজ নয় সমস্ত আশ্রমের কাজ। বেঁচে থেকে তিনি যে প্রীতি আকর্ষণ করছিলেন তাঁকে স্মরণ ক’রে তাঁর পরলোকগত আত্মার উদ্দেশে সেই প্রীতির অর্ঘ্য নিবেদন করি। আশ্রমে তাঁর আসন চিরস্থায়ী হয়ে রইল।

প্রবাসী, ভাদ্র, ১৩৪০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *