1 of 2

ছৌ

ছৌ

শ্যামবাজার কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন থেকে গতশনিবার শিশির মঞ্চে আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘পণরক্ষা’ ছোটোগল্পটি নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করলাম। সকলে বললেন, ভালো। খুবই ভালো। দু-একটা বড়ো কাগজেও প্রশংসা বেরোল। বাংলা ছাপার অক্ষরে জীবনে এই প্রথমবার আমার নাম ছাপা হতে দেখে, বাসিমুখে সেই কাগজ হাতে নিয়ে শরীরে বড়ো রোমাঞ্চ বোধ করলাম।

নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার পর থেকেই মাথাটা বড়োই হালকা লাগতে লাগল। মনোসংযোগ, উত্তেজনা, টেনশানের নিরসন হল। পরীক্ষা শেষ হলে যেমন হয়। নাটককে মঞ্চে উপস্থিত করাটা সর্বশেষ পর্ব। তার আগে দীর্ঘ একমাস ধরে উইকডেইজ-এ রাতে এবং রবিবার দুপুর থেকে রাত অবধি আমাদের মহড়া চলত। এই মহড়ার মধ্যে রোজই ছোটো-বড়ো নাটক ঘটতে থাকত। সেই টুকরো-টাকরা নাটকগুলি আমাকে অভিভূত করে রাখত। বিভিন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীর কথা বলার ঢং, তাঁদের নিয়মানুবর্তিতাজ্ঞান এবং জ্ঞানহীনতা, তাঁদের রসবোধ বা রসবোধের অভাব এসবের মধ্যে দিয়ে তাঁদের প্রত্যেকের সামগ্রিক চরিত্র উপস্থাপিত হত।

আমি অভিনয়-টভিনয় জীবনে করিনি। তবে এই নাটকের একটি চরিত্রে কয়েকটি গান ছিল। সাদামাটা গান। চরিত্রটিকে অভিনবত্ব দেওয়ার জন্যে এবং সাধারণ দর্শকদের ভালো লাগানোর জন্যে নাট্যরূপদাতা গান ক-টি সংযোজিত করেছিলেন। সুরও তিনিই দিয়েছিলেন।

ইদানীং শ্যাম্পু করার দিন ছাড়া গান গাই না আমি। আমার গান বাইরের লোককে শোনাবার মতোও নয়। তবে গান আমি ভালোবাসি। ছেলেবেলায় আমাদের বাড়িতে সামুকাকা গান শেখাতে আসতেন আমাকে। পশ্চিমের ঘরে সন্ধের পর আমরা বসতাম। চাঁদের আলোয় ভরা বারান্দায় জাফরির নকশা-কাটা ছায়া পড়ত। দিলরুবা বাজিয়ে সামুকাকা শেখাতেন, আমি তানপুরা বাজিয়ে গাইতাম।

অভিনয়ের মহড়ায় অনেক মানুষের সঙ্গে আলাপ হল। রোজ দেখা হতে হতে ঘনিষ্ঠতা জন্মাল। কাউকে ‘দাদা’, কাউকে ‘বউদি’, কাউকে নাম ধরেই ডাকতে লাগলাম।

আমি মূলত অসামাজিক। নিজের ঘরে আমার বইপত্রর মধ্যেই একা একা সময় কাটাতে ভালোবাসি, বা গান শুনতে, যখনই জীবিকার নিরুপায় প্রহর-গোনা শেষ হয় আমার। কিন্তু সমাজের মধ্যে আমাকে কেউ হাত ধরে এনে ফেললে সত্যি সত্যিই আনন্দিত হই। মানুষকে, সব মানুষকেই আমি আন্তরিকভাবে ভালোবাসি। কতখানি যে ভালোবাসি, তা ঘরের বাইরে এলেই বুঝি। ভালোবাসার একটা সহজ ক্ষমতা আছে আমার মধ্যে। প্রত্যেককে ভালোবাসার। এবং সকলেই যে আমাকে অনুরূপ ভালোবাসে এমন একটা বিশ্বাসে অকপটে ও গভীরভাবে বিশ্বাস করার ক্ষমতাও আমার আছে। ভালো না বেসে বা ভালোবাসা না পেয়ে আমি থাকতে পারি না, বাঁচতে পারি না। একথা প্রতিবারই সমাজে এসে আবিষ্কার করে নিজেই চমৎকৃত হই।

অভিনয় শেষ হওয়ার পরই এখন আরম্ভ হয়েছে নিমন্ত্রণের পালা। দলের মধ্যে আমি শুধু বয়ঃকনিষ্ঠই নই, সব দিক দিয়ে নিকৃষ্ট। সকলেই হোমরা-চোমরা লোক। কেউ বা ডাকসাইটে উকিল, দু-একজন বড়ো ব্যাবসাদার। তাঁদের পরিপ্রেক্ষিতে আমা-হেন সামান্যজনের কোনো ভূমিকাই নেই। কিন্তু বড়োলোক না হতে পারি, বড়ো না হতে পারি, সকলকে আপন মনে করে বুকের কাছে অনুভব করতে তো পারি।

তাই কয়েকবাড়ি নেমন্তন্ন খাওয়ার পর রাণুকে আমি ধরে পড়লাম যে, একদিন আমিও এঁদের খাওয়াব। রাণু বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অত বড়ো বড়ো লোককে তুমি কী খাওয়াবে? তা ছাড়া সবসুদ্ধু তো প্রায় তিরিশজন হবেন ওঁরা।

আমি বললাম, ভালোবেসে নুন-ভাত দিলেও লোকে ভালোবেসে খাবে। খাওয়াটাই কী বড়ো? আন্তরকিতার কি কোনোই দাম নেই?

এবছরের গরমের ছুটিতে পুরীতে যাওয়ার কথা বলেছিল রাণু। পুরী হোটেলে চিঠিও লিখেছিলাম।

রাণু বলল, এই খাওয়া-দাওয়া করতে গেলে কিন্তু পুরী যাওয়া হবে না।

আমি বললাম, লক্ষ্মীটি। পরের বছর তোমাকে নিশ্চয়ই নিয়ে যাব।

রাণুর দাদা উকিল, তাঁর এক মাছের ব্যবসায়ী মক্কেল আছেন। তাঁকে ধরে কই আর ইলিশমাছ জোগাড় করলাম একটু সস্তায়। একটু ভালো চাল। বিশেষ বন্দোবস্ত করে রাবড়ি। আমাদের সাদামাটা অবস্থানুযায়ী মেনুটা পছন্দই হল। মুরগির বন্দোবস্তও হল। কিন্তু রাণুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল এই চিন্তায় যে, আমাদের পাখির বাসায় এতসব গণ্যমান্য মানুষদের কোথায় বসাবে, কী করে যত্ন করবে? আমি আবারও বললাম, খেতেই তো মানুষ মানুষের বাড়ি আসে না। আসল কথা হচ্ছে হৃদয়ের উত্তাপ।

আমাদের নাটকের দলের একজন ছিলেন মাধবদা। তিনি বড়ো ব্যাবসাদার। স্মিতহাস্য, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান এবং রসিক ভদ্রলোক। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেছিলাম আমি। তাঁর সঙ্গে কারোরই কোনো ব্যাপারে মতানৈক্য ছিল না। আমার অসামাজিকতাজনিত অমার্জিত ব্যবহার ও চাপল্য উনি নিজগুণে মার্জনা করে আমাকে এক বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। মাধবদাকে বলেছিলাম, সবচেয়ে আগে। বউদির শরীর ভালো নয়। কোথাও যান না তিনি। তবু আমার বাড়িতে তিনি যখন আসতে রাজি হলেন তখন আনন্দের সীমা রইল না।

মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে চেয়ার ও মোড়া ধার করে রজনিগন্ধার ডাঁটি এনে ধূপ জ্বালিয়ে যখন রাণু আমাদের একটুকু বাসাকে অতিথিদের জন্যে সাজাল, তখন আমার দারুণ আনন্দ হচ্ছিল।

বেচারির সারাদিন খুব পরিশ্রম গেছে। ও কোনো কিছুই খারাপ করে করতে পারে না। বড়ো খুঁতখুঁতে ও। এই ওর মস্ত দোষ। এবং মস্ত গুণও।

অভিনয়ের দল ছাড়া একমাত্র একজনকে বলেছিলাম। তিনি আমার অফিসের বস। বিবেকদা। অবিবাহিত। প্রগাঢ় পন্ডিত লোক। উনি বলতেন, পড়াশুনো যাতে বিঘ্নিত না হয় সেই কারণেই সরকারি চাকরির হালকা কাজ, অনিয়মানুবর্তিততা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা উনি নিজেই বেছে নিয়েছিলেন। ওঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল নিজের দাদার মতো।

একে একে সকলেই এলেন। আমার মতো সাধারণ লোকের বাড়িতে এতসব মান্যগণ্য সুদর্শন সুবেশ-সুবেশা নর-নারীর ভিড় এবং মোটরগাড়ির লাইন দেখে প্রতিবেশীরা জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলেন। একজনকে বলেই ফেললাম আমি যে, উত্তরপ্রদেশের লটারি জিতেছি, মাত্র তেরো লাখ টাকা।

ওঁরা আসাতে আমার আনন্দের যে পরিমাপ তা টাকায় প্রকাশ করা গেলে তার দাম তেরো লাখেরও বেশি হত। রাণু আমপোড়া শরবত বানিয়েছিল লেবু পাতা দিয়ে। সকলে তা খেয়ে আহা! আহা! করতে লাগলেন। রাণু আমাকে আড়ালে পেয়ে বলল, বেশি বেশি! ওঁরা বিলিতি হুইস্কি-টুইস্কি খান তা আমাদের খাওয়াবার সামর্থ্য নেই বলেই ওঁরা এত বেশি খুশি হয়েছেন বলে দেখাচ্ছেন। আমি বললাম, ওরকম ভেবো না। ওঁরা সকলেই যে বড়ো ভালো লোক। তা ছাড়া আমাকে যে সকলেই ভীষণ ভালোবাসেন।

আড্ডা যখন বেশ জমে উঠেছে, রাণু আমার পড়ার ঘরের মেঝেতে ও আমাদের শোয়ার ঘরের মেঝেতে আসন করতে ব্যস্ত। রাম হ্যাজাকটাকে ঠিকঠাক করছে হঠাৎ বাতি চলে যাবে বলে। এমন সময় হরেনদা শ্যামাবউদিকে ধরলেন গান গাইবার জন্যে। সকলে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ করে উঠলেন। শ্যামাবউদি গান ধরলেন। মাধবদা শ্যামা বউদির একটু সামনে মেঝেতে বসে শ্যামলদার স্ত্রীর সঙ্গে গুজগুজ ফুসফুস করে নীরবে কীসব রসিকতা করছিলেন।

শ্যামাবউদির পর শ্যামলদা গান গাইলেন। সেইসময়ও মাধবদা সমানে কথা বলে চললেন। তার পর রমাবউদি গাইলেন। তখনও মাধবদা….।

প্রত্যেক মানুষের কতগুলো হাস্যকর দুর্বলতা থাকে। কোনো মানুষের থুতনিতে হাত দিলে সে মারতে আসে। কাউকে ‘ইউ আর টকিং ননসেন্স’ বললে সে ইংরেজি জ্ঞানের অপ্রতুলতাহেতু প্রচন্ড অপমানিত বোধ করে। আমারও সেইরকম একটা দুর্বলতা ছিল। গানের মধ্যে কেউ কথা বললে আমার সমস্ত শরীর চিড়বিড় করে ওঠে। ছোটোবেলা থেকেই।

হঠাৎ, কখন বললাম, কী বললাম— আমি নিজেই জানি না, হয়তো খুশির আধিক্যে আমি সাহসী হয়ে গেছিলাম, হয়তো বেহিসেবি কিন্তু আমারই বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আনা এবং আমার বাড়িতে এসে আমাকে কৃতার্থ-করা মাননীয় অতিথি মাধবদাকে আমি হঠাৎ বলে বসলাম যে, আপনি মানুষ খুন করতে পারেন। যিনি গানের মধ্যে কথা বলেন, যিনি গান ভালোবাসেন না, যিনি গায়ককে অপমান করেন, তিনি খুনও করতে পারেন।

একথা ক-টি বলার সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং হওয়ার অনেক আগেই আমার ছোট্ট বাড়িতে লোডশেডিং নেমে এল। সমস্ত ঘর নিস্তব্ধ। মাধবদা মুখ নামিয়ে নিলেন। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বললেন না। রাণু ওঘর থেকে দৌড়ে এসে আমার দিকে একবার তাকাল।

ওর মুখ দেখে মনে হল ও এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে।

ওই দুর্ঘটনার পর আড্ডার ভোল্টেজ একেবারে কমে গেল। এক সময় রাণু খেতে ডাকল সবাইকে। কে যেন বললেন, কইমাছটা ভালো। কেউ বললেন, রাণু তোমার রান্না চমৎকার। কেউ বললেন, কোথা থেকে এত ভালো রাবড়ি পেলে? আমি কারো মুখের দিকেই তাকাতে পাচ্ছিলাম না। রাণুর দিকে চেয়ে আমার কান্না পাচ্ছিল। আমার ইচ্ছে করছিল বাথরুমে গিয়ে আমি ফিনাইল খেয়ে মরে যাই। মাধবদার মনে আমি দুঃখ দিলাম, আমারই বাড়িতে তাঁকে ডেকে এনে? ছি:? ছি:? অভদ্র আমি!

খেয়ে-দেয়ে পান মুখে দিয়ে এক এক করে ওঁরা চলে গেলেন। অনেক ভালো ভালো কথা বললেন পান খেতে খেতে রাণুকে। আমি চোরের মতো একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।

শেষ অতিথি যখন চলে গেলেন, এক বিবেকদা ছাড়া তখন রাণু দরজাটা বন্ধ করে আমার দিকে ফিরে দাঁড়িয়েই বলল, তুমি একটি জন্তু।

আমি মুখ নীচু করে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার মন বলছিল, আমি তাই-ই। কিন্তু আমি এই ইট-কাঠ সিমেন্টের জঙ্গলে থাকতে চাই না। আমি আসল জঙ্গলেই থাকতে চাই। কিন্তু পেটের জন্যে, রুজির জন্যে, বিয়ে করে এ জীবনের মতো ফেঁসে গিয়ে এক জঙ্গলের জন্তুকে অন্য জঙ্গলে দমবন্ধ হয়ে মরতে হচ্ছে।

বিবেকদা রাণুকে বললেন, রাণু এবার আমাদের খেতে দাও। আমরা তিনজনে একসঙ্গে বসব।

রাণু বলল, আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। আপনাদের জায়গা করে দিচ্ছি।

বিবেকদা আমার সামনে এসে বসলেন। বললেন, তুই একটা ইডিয়ট।

আমি মাথা নামিয়ে দোষ স্বীকার করলাম। বিবেকদা বললেন, অতিথি, এমন করে বলা অত্যন্ত অন্যায়।

আমি বললাম, মাধবদা যে কিছু মনে করবেন আমি বুঝতে পারিনি। আমি ওঁকে আপন ভেবেই বলেছিলাম। নইলে তো চুপ করেই থাকতাম।

চুপ করে তুই থাকতে পারতিস না। কারণ তুই সমাজের খেলা শিখিসনি, হয়তো শিখবিও না কখনো।

আমি ব্যথিত হয়ে বললাম, আমার অন্তরের, হৃদয়ের উত্তাপটা ওঁরা দেখলেন না, আমার মুখের একটা ফসকানো কথাই বড়ো হল? কিন্তু খেলাটা কী? বিবেকদা বললেন, খেলাটা খেলা। দাবার মতো, পাশার মতো। এখানে সকলকেই খিলাড়ি হতে হয়। ওঁরা গেলে, দরজা বন্ধ করে তুই যদি রাণুর সঙ্গে খেতে বসে মাধবদাকে নিয়ে আলোচনা করতিস, তাহলে তুই যথার্থ ‘সামাজিক ভদ্রলোক’ হতিস।

আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, আমি তো কিছু খারাপ ভেবে বলিনি। আমি যাঁকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, তাঁকে সরলভাবে একটা কথা বলা কি অন্যায়?

অন্যায়! ঘোরতর অন্যায়! আজকের সন্ধের সামাজিক নাটকে তোমার ভূমিকা ছিল হোস্টের ভূমিকা। এই খেলার নিয়মে বলে যে, অতিথি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে তুমি অতিথির আদ্যশ্রাদ্ধ নির্বিঘ্নে এবং পরমানন্দে সম্পন্ন কোরো। কিন্তু অতিথির সামনে এই অসভ্যতার ক্ষমা নেই।

বললাম, আপন যাকে ভাবি তাকেও একটা কথা বলা এত বড়ো অপরাধ? আড়ালে কিছু বলার কথা আমি ভাবতে পারি না। উনি কি আমার আপনজন নন?

আপন কাকে ভাবিস?

মাধবদাকে। আমি তাঁকে ভালাবাসি, সত্যি সত্যি শ্রদ্ধা করি। আমাকেও তিনি ভালোবাসেন।

তুই একটা ক্লাস ওয়ান, গ্রেড ওয়ান ইডিয়ট বলেই মনে করিস সকলেই তোকে ভালোবাসে।

ভালোবাসে না?

আমি গুলি-খাওয়া জানোয়ারের মতো কঁকিয়ে উঠলাম যন্ত্রণায়।

না! বিবেকদা নিষ্ঠুর গলায় বললেন।

উনি আমার আপন নন? আমাকে উনি কাছের ভাবেন না?

উনি কেন? কেউই তোর আপন নন। আমিও নই। এমনকী রাণুও নয়।

তবে? আমার আপন কে?

তুই। তুই একা। এই সংসারে তুই নিজে ছাড়া তোর আপন আর কেউই নেই। আর একজন অবশ্য আছে। জড় পদার্থ। তোর বাথরুমের আয়না। যে তোর সত্যিকারের মুখটিকে তোর সামনে বিনা অভিমানে, বিনা অভিনয়ে, বিনা স্বার্থে প্রতিবিম্বিত করে।

স্তম্ভিত হয়ে আমি বললাম, আর তোমার?

আমারও নেই।

অন্যদের?

ওদেরও নেই।

একটু চুপ করে থেকে বিবেকদা বললেন, শিশির মঞ্চে উঠে পরচুলা পরে অভিনয় করতে গেলি কেন? সমস্ত জীবনটাই তো এক মস্ত মঞ্চ। যেখানে শহর, যেখানে শিক্ষা নামক বিকৃতি, যেখানে সভ্যতা নামক নোংরামি, সেইখানেই অভিনয়। তোর বাবা যে-তোকে চান, তুই সেই-তুই না হলেই তুই খারাপ। তাই অভিনয় কর যে, তুই তাঁর সেই-তুই। রাণু তার ছোটোবেলার কল্পনা দিয়ে যে-স্বামীকে মনে মনে গড়ে রেখেছিল, তুই সেই-স্বামী না হতে পারলেই আহত করবি ওকে। তাই অভিনয় কর যে তুই সেই স্বামী। ভদ্রলোকেরা সামাজিক নিয়মে কতগুলো তোতাপাখির মতো ব্যাবহারিক সৌজন্য মেনে চলেন। তুই সেইগুলো মেনে না চললেই তাঁদের আহত করবি। নিজেও আহত হবি। বাঁচতে চাস তো জীবনের নাটকে অনুক্ষণ অভিনয় কর। বুঝলি?

আমি চুপ করে বসে রইলাম। বললাম, কিন্তু আমি যে সকলকে সহজভাবে যে-কথা সহজে মনে আসে তা বলতে ভালোবাসি। বিবেকদা, আমি তো কোনো পরচুলা-পরা, মুখে রং-মাখা অভিনেতা নই। আমি যে আমিই!

বিবেকদা আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন।

তার পর এক অদ্ভুত হাসি হেসে বললেন, তোর জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্যাজেডি হচ্ছে এই যে, তোর একটাও মুখোশ নেই, তুই, তুই-ই। হোপলেস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *