2 of 3

ছোট ছোট ভাবনা

ছোট ছোট ভাবনা

১. মাহমুদুর রহমান মান্নাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ১৯৭৯ সালে ময়মনসিংহ, মেডিক্যাল কলেজের নবীন বরণ উৎসবে। আমি তখন নবীন। সবে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছি। গান কবিতা বক্তৃতা শুনিয়ে নবীনদের বরণ করে নিচ্ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন। জাসদের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে এসেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। ঢাকা থেকে যত নেতা এসেছিলেন, সবচেয়ে ভালো বক্তৃতা করেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। কী যে মুগ্ধ হয়েছিলাম মান্নার বক্তৃতা শুনে। সবার জন্য শিক্ষা স্বাস্থ্য, সবার জন্য অন্ন বস্ত্র, সবার জন্য নিরাপত্তার দাবি সবচেয়ে বেশি ছিল মান্নার কণ্ঠে। আমার সতেরো আঠারো বছর বয়সের মুগ্ধতা সত্যি বলতে কী, কখনও ফিকে হয়নি। কিছু জিনিস চিরকাল রয়ে যায় স্মৃতিতে। বড় হয়ে খবরের কাগজে পড়েছি মাহমুদুর রহমান মান্নার নিয়মিত কলাম। একই কাগজে আমিও তখন লিখতাম। খুব গর্ব হত, যে পত্রিকায় মান্নার মতো আদর্শ রাজনীতিক লেখেন, সেই পত্রিকায় আমিও লিখি।

কিন্তু কাল শুনলাম তিনি নাকি দেশে কিছু লাশ ফেলে দেওয়ার কথা বলেছেন। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে পড়ছিল এককালের সেই প্রচণ্ড আদর্শবাদী মান্নাকে, যার আহবানে যুব সমাজ দেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছিল। কোথায় গেল দেশ গড়া! আজ মান্না দেশের লোককে গুলি করে মেরে ফেলা হলে আপত্তি করবেন না বলে জানিয়েছেন। কবে থেকে যে তিনিও দেশের নোংরা রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছেন জানি না। খুব বেশি কিছু না জানাও হয়তো ভালো। ও-ই ভালো ছিল, জানতাম যে, দেশে এখনও কিছু আদর্শবান মানুষ আছেন, যাঁরা দেশের জন্য, দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন। রাজনীতিকদের সবকিছু হয়তো জানতে নেই। তাঁরা যেটুকু জানান, শুধু সেটুকু জানাই হয়তো ভালো। শুধু সেটুকু জানলে আমাদের মনে আশা ভরসা, সুখ স্বপ্ন, সবকিছু অক্ষত অবস্থায় থাকে। তাঁদের লাশ ফেলে দেওয়ার ইচ্ছের কথা জানলে আমাদের পায়ের তলার মাটি সরে যায়। কেবল কি মান্নাই, সন্ত্রাস, নাশকতা আর লাশ ফেলে দেওয়ার ইচ্ছে নিশ্চয়ই আরও অনেক রাজনীতিকের। দেশটা ক্ষমতাবান,ষড়যন্ত্রবাজ,ধান্দাবাজ রাজনীতিকদের হাতে বন্দি।

২. এরই নাম বুঝি জাত্যাভিমান! বাঙালির বাঙালিত্ব কতটুকু অবশিষ্ট আছে বাংলাদেশে? আরবীয় সংস্কৃতি দিয়ে বাংলা সংস্কৃতিকে কি যথেচ্ছ ধর্ষণ করানো হয়নি? জাতীয় সঙ্গীতটা কেউ আগা থেকে গাইলো নাকি গোড়া থেকে গাইলো, তা বিরাট এক ব্যাপার বটে! কেউ মাঝখান থেকে গাইলে নাকি জনতার জাত্যানুভূতিতে আঘাত লাগে! জাতের নামে বজ্জাতি আর কাকে বলে। যাদের সভ্যতা সংস্কৃতি, শিক্ষা সচেতনতা বলতে প্রায় কিছুই নেই, যারা দারিদ্র, দুর্নীতি, অন্ধতা, হিংসা, ঘৃণা, লোভ, সন্ত্রাস ইত্যাদি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারে না, তাদের আর কিছু না থাকুক, একটা জাতীয় সীমানা আছে, একটা জাতীয় সঙ্গীত আছে, আর একটা জাতীয় পতাকা আছে! ব্যর্থ সরকাররা ওগুলোই জনতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাকে লুকোয়! আর নির্বোধ জনতা ওগুলোই আঁকড়ে ধরে বড় সন্তুষ্ট, তৃপ্ত আর গর্বিত।

৩. আচ্ছা, বাংলাদেশের নব্বই বা নিরানব্বই ভাগ লোক তো মুসলমান। তারা তো কোরান-হাদিসে, আল্লাহ মোহাম্মদে একশ ভাগ বিশ্বাস করে। তারা নামাজ পড়ে, রোজা করে, শবেবরাত করে, শবেকদর করে, মিলাদুন্নবি করে, ইদুল ফেতর করে, ইদুল আজহা করে। ঠিক কি না? আল্লাহ নিয়ে কেউ কোনওরকম সন্দেহ প্রকাশ করলে তাকে জবাই করতে প্রায় কারওরই আপত্তি নেই, মোহাম্মদের কার্টুনিস্টদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে বলে প্রায় কেউই মনে করে না। বোরখা আর হিজাবের হিড়িক পড়েছে। টুপিদাড়ির সংখ্যা হাউমাউ করে বাড়ছে। এই সময়, আমার একটিই জরুরি প্রশ্ন, এত কিছু আনা হচ্ছে দেশে, গার্মেন্টসের সুতো, ইংলিশ এডুকেশন, মধ্যপ্রাচ্যের টাকা– শরিয়া আইন কেন আনা হচ্ছে না। আল্লাহ বিশ্বাসী লোকদের তো আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোনও আইন মানা উচিত নয়। আল্লাহ বলেই দিয়েছেন কোরানে, আল্লাহর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অক্ষর কোনও রকম প্রশ্ন, সংকোচ ও দ্বিধা ছাড়া বিশ্বাস করতে হবে।

জারি হয়ে যাক না কোরান হাদিসের আইন আই মীন শরিয়া আইন! চুরি করলে হাত কাটা যাবে। ইসলাম নিয়ে কটাক্ষ করো তো জনসমক্ষে মুণ্ডু উড়িয়ে দেওয়া হবে। স্বামী শারীরিক নির্যাতন করবে। তালাক তালাক তালাক বললেই তালাক হয়ে যাবে। স্বামী চার বিয়ে করবে। ধর্ষিতারা চাবুকের মার খাবে। প্রেম করার অপরাধে মেয়েদের পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হবে। এই ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা আর নির্যাতন কিন্তু শরিয়া আইনের চোখে বৈধ।

আল্লাহকে মানবো, আল্লাহর কোরান মানবো, কিন্তু আল্লাহর আইন মানবো না– এ আবার কেমন দাবি? এ ধরনের হিপোক্রেট-বান্দাদের আল্লাহ দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।

দেশে অতি শীঘ্র শরিয়া আইন আনুন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। যে রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম, যে রাষ্ট্রের মানুষ খাঁটি মুসলমান, সে রাষ্ট্রের আইন ইসলাম ছাড়া অর্থাৎ শরিয়া ছাড়া অন্য কিছু হয় না, হতে পারে না।

৪. শামিমা বেগম আর খাদিজা সুলতানা, দুজনারই ১৫ বছর বয়স, লগুন থেকে ইস্তানবুল হয়ে সিরিয়া গিয়েছে ইসলামিক স্টেট বা আইসিসে যোগ দিতে। এদের দেশ বাংলাদেশ। থাকছিল লন্ডনে। কিন্তু পাশ্চাত্যের শিক্ষা, সচেতনতা, সমতা, সমানাধিকার তাদের পছন্দ হয় না। তারা দূরের এক মরুভূমিতে ইসলামের নামে বর্বরতা চালাচ্ছে যে আইসিস নামের দল, সেই দলের প্রতি আকৃষ্ট। আইসিসের জঙ্গিরা ধরে ধরে মানুষ জবাই করছে, মানুষের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করছে–এসব বর্বরতা মেয়েদুটোকে ভীষণই উত্তেজিত করেছে। তারা বাড়ি ঘর আত্মীয় স্বজন শহর বন্দর বন্ধু বান্ধব ছেড়ে দিয়ে আইসিসে যোগ দেওয়ার পণ করে বেরিয়ে পড়েছে। আইসিসের জঙ্গীদের কাছে যাওয়া মানে ধর্ষিতা হওয়া। জেনেবুঝেই মেয়েদুটো ধর্ষিতা হতে গেছে। জেহাদি পুরুষের যৌনইচ্ছে মেটানোই হয়তো জেহাদি নারীর কাজ। এই মেয়েদুটোকে নিয়ে কী করবে আইসিসের জঙ্গীরা, আমরা অনুমান করতে পারি। এদের ধর্ষণ করে, টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে রাখবে। নয়তো এদের বিক্রি করে দেবে, বা এদের সেবাদাসী বানাবে।

এতে নিশ্চয়ই শামিমা বেগম বা খাদিজা সুলতানার আপত্তি নেই। নিশ্চয়ই বাংলাদেশের আরও অনেক ছেলে মেয়েই আইসিসে যোগ দিতে আগ্রহী। আইসিসের সেবা করলে তাদের বিশ্বাস, তারা আল্লাহকে খুশি করতে পারবে। আল্লাহ তাদের বেহেস্ত নসিব করবেন।

জরিপে দেখা গেছে, পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি ধর্মবিশ্বাসী। কোনও ধর্ম কি সত্যিকার অর্থে নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান আর সমানাধিকার দিয়েছে? নারীর এই ধর্মে সমর্পণটা তবে ঠিক কেন? কেবল নরক থেকে বাঁচার জন্য? বেহেসতে পুরুষকে যে আরাম আয়েশে রাখবেন আল্লাহ তায়ালা, একই আরাম আয়েশ নারীর জন্য নেই কেন? এই প্রশ্নটি নারীরা করে না, অথবা করতে ভয় পায়। পুরুষ ধর্মান্ধ হলে বা ধর্মপ্রাণ হলে মানায়। নারীকে ধর্মপ্রাণ হওয়া ঠিক মানায় না। নারীর জন্য ইহজীবন যেমন দুর্বিষহ, পরজীবনও তেমন দুর্বিষহ। এত বড় বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা কি নারী পুরুষের মধ্যে এত বড় বৈষম্য করতে পারে? আমার তো মনে হয় না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, হয় সৃষ্টিকর্তা নেই, নয় বৈষম্য নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *