2 of 2

ছোট্ট পাখি চন্দনা – দেবাশীষ সেনগুপ্ত

ছোট্ট পাখি চন্দনা – দেবাশীষ সেনগুপ্ত

লম্বা বারান্দার এক কোনায় খাঁচায় ঝোলানো চন্দনা পাখিটা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার চারদিক দেখে নিল। তারপর গলা ফুলিয়ে বলে উঠল, ‘এই টুকটুক।’

পড়ার টেবিলে বসে থেকে বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে ভুরু কোঁচকাল রুনা। পাখিটা তো ভীষণ বদমাশ! মনে-মনে ভাবল রুনা। গত চারদিন ধরে পাখিটা খালি পাশের বাড়ির টুকটুকের নাম ধরে ডেকে যাচ্ছে। অথচ আজ চারদিন হল টুকটুকের সঙ্গে রুনার আড়ি হয়ে গেছে। রুনার একমাত্র খেলার সাথী ওই টুকটুক। টুকটুকের সঙ্গে আড়ি হয়ে যাওয়াতে রুনা এখন একদম একলা। এখন ওর নেই কোনও অরণ্যদেব পড়ার সাথী অথবা পুতুল খেলার। ওর খেলার মাঝে-মধ্যে এমন খারাপ লাগে যে, ও লুকিয়ে-লুকিয়ে কেঁদেই ফেলে।

রুনা একবার ভেবেছিল, নিজে যেচে গিয়েই টুকটুকের সঙ্গে ভাবটা করে নেবে। কিন্তু পরক্ষণেই ওর মনে পড়ে গিয়েছিল যে, টুকটুক ওর সবচেয়ে প্রিয় পুতুল চিনের রাজপুত্রের একটা হাত ইচ্ছে করে ভেঙে দিয়েছে। রুনার বাবা অনেক কষ্টে ফেভিকল দিয়ে পুতুলের হাতটা জুড়ে দিয়েছেন বটে, কিন্তু তবুও রুনা যখনই পুতুলটার দিকে তাকায় ঠিক তখনই ওর মনে হয় যন্ত্রণাকাতর মুখে চিনের রাজপুত্র ওকে যেন কিছু বলতে চাইছে। ইস, কী সুন্দর দেখতে ছিল পুতুলটা! রুনার ছোটমাসি পুতুলটা দিল্লির একটা মেলা থেকে কিনে এনে রুনাকে দিয়েছিলেন। চোখদুটো সামান্য জ্বালা করে উঠল রুনার। দু-হাতে চোখ কচলে নিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ রাখল। হঠাৎ ওর চোখের সামনে বইয়ের পাতায় সারিবদ্ধ পিঁপড়ের লাইনের মতো কালো অক্ষরগুলো অদৃশ্য হয়ে গিয়ে চিনের রাজপুত্রের সুন্দর মুখটা ভেসে উঠল।

‘কী ভাবছ, রুনা?’ রাজপুত্রের ঠোঁটদুটো সামান্য নড়ে উঠল।

‘তোমার কথা।’ বইয়ের পাতায় ঝুঁকে পড়ল রুনা।

‘আমার কথা।’ বিষণ্ণ হাসি হাসল রাজপুত্র : ‘তোমার বন্ধু খুব নিষ্ঠুর, রুনা।’

‘না, ও আমার বন্ধু নয়। কক্ষনও নয়।’ দু-হাত দিয়ে টেবিল-ক্লথ খামচে ধরল রুনা।

‘কিন্তু ও একদিন তোমার বন্ধু ছিল।’ রাজপুত্রের চোখের পাতাদুটো তিরতির করে কেঁপে উঠল।

‘আগে ছিল। তোমার হাত ভেঙে দেওয়ার পর ওর সঙ্গে আমার আড়ি হয়ে গেছে।’

‘সত্যি?’ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাজপুত্রের সুন্দর মুখটা।

ঠিক তখুনি খাঁচায় ঝোলানো চন্দনা পাখিটা ঘাড় বেঁকিয়ে ডেকে উঠল, ‘এই টুকটুক।’

‘উফ!’ আতঙ্কে কানে হাত চাপল রাজপুত্র : ‘পাখিটা নিশ্চয়ই টুকটুককে পছন্দ করে?’

‘না।’ আর্তনাদ করে উঠল রুনা : ‘ও টুকটুককে মোটেই পছন্দ করে না।’

‘কিন্তু ও যে টুকটুকের নাম ধরেই ডাকছে।’ রাজপুত্র বিষাদ মাখা গলায় বলল, ‘পাখিটা হয়তো টুকটুকের মতোই নিষ্ঠুর। সত্যিই খুব নিষ্ঠুর।’ রুনার চোখের সামনে থেকে ধীরে-ধীরে রাজপুত্রের সুন্দর মুখটা অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকল।

‘শোনো, যেয়ো না।’ আর্তনাদ করে উঠল রুনা।

‘পাখিটা মোটেই আমাদের বন্ধু নয়।’ ফিসফিস করে বলল রাজপুত্র, ‘ও শুধুমাত্র টুকটুকের বন্ধু।’ চোখ-ভরা টলটলে জল নিয়ে বইয়ের পাতা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল চিনের রাজপুত্র।

‘টুক টু-উ-উক।’ চন্দনাটা দু-বার ডানা ঝাপটাল।

ঝটিতি পড়ার টেবিল ছেড়ে বারান্দায় চলে এল রুনা। রান্নাঘর থেকে চমৎকার মাছ ভাজার গন্ধ ভেসে আসছে। মা রান্নাঘরে। বাবা বাড়ি নেই, বাবার ছ’টা-দুটো ডিউটি। কাজের লোক সনাতন বাজারে। এই সুযোগ। রুনা মনে-মনে ভেবে নিয়েছে ও এখন কী করবে। বারান্দার রডে ঝোলানো খাঁচাটা খুলে নিয়ে ও একদৌড়ে নীচে নেমে এল। বাড়ির পিছন দিকে বেশ বড় গভীর পুকুর। পাখিটা হয়তো বুঝতে পেরেছিল কী ঘটতে চলেছে—ওটা তারস্বরে চিৎকার করে ডানা ঝাপটাতে শুরু করল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রুনা শক্ত হাতে খাঁচাটাকে পুকুরের জলে ডুবিয়ে ধরল।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে রুনা খাঁচাটাকে জল থেকে টেনে তুলে দেখল, চন্দনা পাখিটা খাঁচার এককোনায় ডানা বিছিয়ে মরে পড়ে আছে। কিন্তু আশ্চর্য, ওর চোখদুটো সম্পূর্ণ খোলা। আর সেই খোলা চোখের দৃষ্টিতে ঘৃণা আর প্রতিহিংসা একসঙ্গে ধিকধিক করে জ্বলছে। খাঁচা খুলে মরা পাখিটাকে বের করে নিল রুনা। তারপর ওটাকে ছুড়ে ফেলে দিল পুকুরের এককোনায় জমে থাকা খানিকটা কচুরিপানা আর জলজ উদ্ভিদের মাঝখানে।

এক নিশ্বাসে দৌড়ে ওপরে উঠে এল রুনা। খাঁচাটা ঠিক জায়গায় ঝুলিয়ে রেখে চিৎকার করে উঠল, ‘মা, খাঁচার দরজা খোলা। পাখিটা উড়ে গেছে।’

আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে দ্রুতপায়ে বারান্দায় দৌড়ে এলেন মা।

‘কী আশ্চর্য! খাঁচার দরজা কে খুলল?’

‘কী জানি। আমি হঠাৎ তাকিয়ে দেখলাম…।’

মা একবার সন্দেহের চোখে রুনার দিকে তাকিয়ে শূন্য খাঁচাটার দিকে এগিয়ে গেলেন।

‘এ কী, খাঁচাটার গায়ে জল কেন?’ মা চিন্তাগ্রস্ত গলায় বললেন, ‘আর তা ছাড়া খাবারের বাটিতেই বা খাবার নেই কেন! আমি সকালবেলাই বাটি ভরতি করে ছোলা দিয়েছি।’ কথা শেষ করেই মা রুনার দিকে ঘুরে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই খাঁচার দরজা খুলেছিলে?’

‘সত্যি বলছি, মা, আমি কিচ্ছু জানি না,’ রুনার গলার স্বর সামান্য কেঁপে উঠল।

‘আশ্চর্য! তাহলে পাখিটা গেল কোথায়!’ মা আঁচল দিয়ে মুখটা মুছলেন।

‘আমার মনে হয়, পাখিটা কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে, মা,’ আস্তে করে কথা ক’টা বলল রুনা।

‘জানি না বাপু কী হয়েছে,’ মা ঘুরে দাঁড়ালেন : ‘পাখিটা তোমার কাকা শখ করে কিনেছিলেন, তিনি এসে যা ভালো বুঝবেন তাই করবেন।’ রাগে গজগজ করতে-করতে মা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।

আকাশে ছেঁড়া মেঘের ভেলায় চড়ে মস্ত চাঁদ ভাসছে, লোহার জাফরি-কাটা জানলার ফাঁক দিয়ে রুপোলি চাঁদের স্বপ্নিল আলো ঘরের মেঝেয় সুন্দর নকশা তৈরি করেছে। ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে শুল রুনা, সামান্য বিড়বিড় করে কী যেন বলল, আর ঠিক তখুনি একটা অতি পরিচিত গলার স্বর ওর কানের কাছে বেজে উঠল, ‘এই টুকটুক।’

ঝটিতি চোখ খুলল রুনা। প্রথমে ও ভাবল ও হয়তো স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু চোখের দৃষ্টি সামান্য ঘোরাতেই ও দেখল, জানলার গ্রিলে নখ আঁকড়ে বসে আছে চন্দনা পাখিটা। পাখিটা একবার শিস দিল। ওর ভেলভেট সবুজ দেহের ওপর চাঁদের আলো সুন্দরভাবে পিছলে যাচ্ছিল। ঘোর-লাগাভাবে হাত বাড়িয়ে পাখিটাকে ধরতে গেল রুনা, কিন্তু হাত বাড়াতেই ওটা উড়ে গিয়ে বারান্দার রেলিঙে বসল। ওটাকে ধরতেই হবে, মনে-মনে ভাবল রুনা। পাখিটা মোটেই মরেনি, ওটা শুধু অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, জ্ঞান ফিরতেই কচুরিপানার মধ্যে থেকে…মেঝেয় নামল রুনা। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এল ও। সামান্য দৌড়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে পাখিটাকে ধরতে গেল রুনা, পারল না। দু-হাতের ফাঁক দিয়ে মসৃণভাবে চন্দনাটা গলে গেল। সুন্দরভাবে ওটা উড়ে চলে গেছে পুকুরের ঠিক পাশেই বেঁটে আকন্দ গাছটার ডালে।

বেড়াল-পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল রুনা।

শান্ত কালো পুকুরের জলে রুপোলি চাঁদ সাঁতার কাটছে। আকন্দ গাছের সরু একটা ডালে বসে চন্দনাটা দোল খাচ্ছে। এক-পা পাখিটার দিকে এগিয়ে গেল রুনা, পাখিটা বাতাসের বুকে ডানা মেলল। পুকুরের শান্ত জলের ওপর তিরতির করে ডানা কাঁপিয়ে ভেসে রইল চন্দনাটা। ঘাটের প্রথম ধাপিতে পা রাখল রুনা। ঠান্ডা জল ওর পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিল। আর-একটু, হাত বাড়ালেই বোধহয় পাখিটাকে ধরা যাবে, আর-একটু। ঠান্ডা জল রুনার হাঁটুকে আদর করল। ইস, আর-একটু। দু-হাত সামনের দিকে এগিয়ে একটা পা বাড়িয়ে দিল রুনা।

অপরাধ

ডিসেম্বর, ১৯৮১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *