ছিনতাই – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
যা ভাবা গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত টু দি পাই তাই ঘটে গেল। ছোঁড়া দুটো অনেকক্ষণ ধরে ছায়ার মতো পিছু লেগেছে। দাঁড়িয়ে দেখলেন ওরাও ঠিক দাঁড়াচ্ছে। আবার লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটাবার চেষ্টা করেও দেখলেন হাত দশেকের দূরত্ব রেখে ঠিক ওরা হাঁটছে। মহা দুশ্চিন্তাতেই পড়লেন ভাদুড়িমশাই। যেমন সব দিনকাল পড়েছে, বলা যায় না, কখন ওরা পিছন থেকে ছুটে এসে ক্যাঁক করে ছুরি বসিয়ে দেবে, ব্যাস হয়ে যাবে তখন।
কি কুক্ষণেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন আজ! আর যাও বা বেরিয়েছিলে রানীকে নিয়ে অমন করে লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমায় না গিয়ে পার্কের ধারেও কোথাও গিয়ে বসতে পারতেন। তাতে পয়সাও বাঁচত, সময়ও কিছুটা বেঁচে যেত। জলজ্যান্ত দশটা টাকার নোট নিয়ে বেরিয়েছিলেন, এখন বোধ করি খুচরো কয়েকটা মাত্র পয়সা পড়ে আছে পকেটে। অবশ্য একদিক থেকে যেন সৎকাজেই ব্যয় হয়েছে টাকাটা। করকরে নোটটা পকেটে থাকলে পিছনের ওই ছোঁড়া দুটোকেই হয়তো দিয়ে রেহাই পেতে হত ওঁকে। অদানে অব্রাহ্মণে যেত টাকাটা।
সাত পাঁচ অনেক কথাই ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলেন ভাদুড়িমশাই। ভাবছিলেন আর একটু একটু করে ঘেমে উঠছিলেন। প্রাণের মায়া বড় মায়া। অথচ ছোঁড়াদুটোকে যদি একবার চেঁচিয়ে বলে দেওয়া যেত, দেখ হে, মিছিমিছি তোমরা আমার পিছু নিয়েছ, আমি বাবা ছা-পোষা এক কেরানি, পকেটে কলম রাখি না, হাতের ঘড়িটাকে দিন দুয়েক হল দোকানে দিয়েছি, তাছাড়া আংটি বা বোতাম ওসব কি আমাকে মানায়। তবে হ্যাঁ, জামার হাতাটা যদি গুটোই তাহলে কনুইয়ের কাছে তামার মাদুলি পাবে। যখন পরেছিলাম তখন ওর দাম ছিল দু পয়সা আর এখন বড় জোর সাড়ে ছ’ আনা। ফলে, আমাকে তোমরা মিছিমিছি ফলো করে সময় নষ্ট করলে।
যেন এ রকম কিছু একটা বলে ফেলতে পারলেই বেঁচে যেতেন ভাদুড়ি মশাই। কিন্তু বলবে কে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠেছে ওঁর। তা ছাড়া পিছনে তাকিয়ে একবার ভাল করে যে ছোঁড়াদুটোকে দেখে নেবেন সে ক্ষমতাও যেন উনি হারিয়ে ফেলেছেন। আসলে ঘড়ি কলম টাকা পয়সা সোনা-দানা এসব যে মানুষের কত বড় সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে এই মুহূর্তেই যেন উনি তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিলেন। তবু ভাল, ওসব জিনিস সঙ্গে নেই ওঁর। সঙ্গে যা আছে তা ওঁর জীবন। জীবন বা জান। সমস্যাটা ওঁর জানের। যেমন সব দিন কাল পড়েছে জীবনের যে কোনও মূল্য নেই তা উনি সারাক্ষণই টের পান। এই যেমন ধরুন না, বলা নেই কওয়া নেই এখন যদি দুম করে একটা বোমা ফেটে পড়ে ওর ঘাড়ের ওপর তা হলেই তো হয়ে গেল সব।
শিরশির করে সারা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছিল ভাদুড়িমশাইয়ের। বেছে বেছে বাড়ি ফিরবার জন্য এ রাস্তাতেই বা এলেন কেন উনি। এমন অন্ধকার ঘুটঘুট্টি রাস্তা, বালবগুলি কি ইচ্ছে করেই নিভিয়ে রেখেছে নাকি! এতক্ষণ তো হাঁটলেন, দুটো একটা লোকও যদি দেখা যেত। নিদেন পক্ষে দুটো একটা রিকশাও ঠুন ঠুন করে ওঁর পাশ দিয়ে চলে যেত, না তারও কোনও লক্ষণ নেই।
আচ্ছা, লোক দুটো আমার কি করতে পারে! না হয়, দুপাশ থেকে দুজনে এগিয়ে এসে ওঁকে দাঁড়াতে বলল। উনি দাঁড়ালেন। বেশ, আমি দাঁড়ালাম।
—আচ্ছা, এবার আপনার ঘড়ি কলম টাকা-পয়সা কি কি আছে দিয়ে ফেলুন।
—কিচ্ছু নেই।
—কিচ্ছু নেই। আপনি হাত তুলে দাঁড়ান, আপনাকে আমরা সার্চ করব।
না হয় হাত তুলেই দাঁড়ালাম। করুন সার্চ।…দেখলেন তো কিছু নেই। থাকলে কি আর আপনাদের দিয়ে দিতুম না! কি যে ভাবছেন আপনারা!
ওরা তখন হতাশ হয়ে মুখ নিচু করে চলে যাবে।
যদি এইভাবে ওরা চলে যায়, বাঁচা যায়। অল্পের ওপর দিয়েই হয়ে যায় ব্যাপারটা। শুধু কিছুক্ষণ ধরে। ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করা, ব্যাস। আসলে সব কিছুর মূলেই হচ্ছে পয়সা। পয়সা না পেলে মানুষটাকে খুন করে মাটির মধ্যে পুঁতে রেখে কি এমন রাজ্য পাবে ওরা। তা ছাড়া আমি তো আর ওদের কোনও পাকা ধানে মই দিয়েও বেড়াইনি যে, আমাকে ওরা বদলা নেবার জন্য পিছু নিয়েছে।
আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে আমাকে ওরা রানীর সঙ্গে সিনেমায় যেতে দেখেছে! হয়তো ওরা রানীরই পাড়ার কেউ হয়ে থাকবে।
—কি মশাই, বে-পাড়ায় এসে খুব হাত সাফাই চালাচ্ছেন?
—অ্যাঁ, ছি ছি; কি যে বলছেন! দেখুন আমি হচ্ছি ইউ ভাদুড়ি, বি-এ। বয়স আমার চল্লিশ হল প্রায়। এখনও অবধি বিয়ে-থা কিচ্ছু করিনি। মেয়েদের ব্যাপারে এতটুকু যদি দোষ বার করতে পারেন তাহলে আমি আপনাদের সামনে নাকে খত দিয়ে চলে যেতে পারি, জানেন!
তবে রানীর কথা জানতে চান, রানী হচ্ছে আমাদেরই অফিসের মেয়ে, আমার কলিগ। সেই কোন বাচ্চা বয়সে বাপকে হারিয়ে বসে আছে বেচারি, কার কষ্ট না হয় বলুন। আমার একটু, সত্যি বলতে কী, একটু দুর্বলতাই জন্মে গেছে ওর ওপর। আপনারা কী জানেন, কত বড় সংসার টানে মেয়েটা? ওর মা, ওর ভাই বোন, একগাদা মানুষ—আর সিনেমার কথা বলছেন, ওটা নেহাতই গল্প করতে করতে একটু খেয়াল হল, অনেকদিন সিনেমা-টিনেমাও দেখি না, তাই। তাছাড়া সত্যি বলছি, সিনেমা দেখার ইচ্ছেটা আমার চেয়ে ওরই ছিল বেশি।
ভাদুড়িমশাই একটু দাঁড়ালেন। গা ছম ছম করছে বলে নয়, কেমন যেন মনে হল, এতক্ষণ উনি ছোঁড়া দুটোকে ভুল ভেবে আসেননি তো! এমনও তো হতে পারে লোক দুটো কোনও উদ্দেশ্য না নিয়েই ওঁর পিছু হাঁটছে। যেমন আর দশজন রাস্তা দিয়ে হাঁটে, ওরাও তেমনি।
কিন্তু না, টু দি পাই মিলে যাচ্ছে। লোক দুটোও দাঁড়িয়ে পড়েছে যে! সন্দেহটা আরও গভীরভাবে ছেঁকে ধরল ওঁকে।
তাহলে কি—আচ্ছা, ছুট লাগালে কেমন হয়!
ভাদুড়িমশাইয়ের পরনে পরিপাটি করা ধুতি। এক হাতে কোঁচা ধরে হাঁটছিলেন। কোঁচাটাকে টেনে নিয়ে পকেটে গুঁজলেন। ধুত, তাই বলে দৌড়! বরং আমি যেন টেরই পাইনি, এরা আমাকে ফলো করছে এমনিভাবে হাঁটি। খুব স্বাভাবিকভাবেই হাঁটবার চেষ্টা করলেন ভাদুড়ি মশাই।
কিন্তু দু পা না এগোতেই আবার ওঁকে থামতে হল। শুনতে পেলেন ওরা ডাকছে, এই যে দাদা, শুনুন।
দরদর করে গা দিয়ে ঘাম ছুটল ভাদুড়ি মশাইয়ের। লোক দুটো এখন ওরই দিকে এগিয়ে আসছে।
ঠক ঠক করে পা কেঁপে উঠল একবার। না জানি বেঘোরেই প্রাণ যায় আজ। চোখে মুখে আকুতি ফুটিয়ে ভাদুড়িমশাই তাকিয়ে রইলেন। ভাঙা ভাঙা স্বরে বলবার চেষ্টা করলেন, আমাকে ছেড়ে দিন দাদা, আমি আ—আ—আ—
—ধুত মশাই, থামুন দেখি। ধমকে উঠল একজন।
থতমত খেয়ে থেমে পড়লেন ভাদুড়ি।
ছোঁড়া দুটোর একজনের পরনে কালো কুচকুচে একটা জামা, বুক খোলা, আর একজনের পুরু রঙিন একটা গেঞ্জি। অন্ধকারে ভালো করে মুখ দেখা গেল না। তবে যেটুকু বোঝা গেল তাতে অমন কাউকে যে ইতিপূর্বে ভাদুড়িমশাই দেখেননি তাতে সন্দেহ নেই। কতই বা আর বয়স হবে। তিরিশের নীচেই হবে হয়ত। গায়ে বেশ শক্তিও রাখে বলে মনে হল ভাদুড়ির। দুজন যদি দু পাশ থেকে চেপে ধরে ওঁকে পালিয়ে যাবার সাধ্য থাকবে না।।
ছোঁড়াদুটো দুপাশেই এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল।
—বেশ তো সেজেগুজে বেরিয়েছেন দাদা! অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিলাম, আলাপ করি।
ওদের মধ্যে একজন চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলি বলে ফেলে একগাল হাসল। আর একজন একটা পেন্সিল কাটা ছুরি বার করে আঙুলের নখের ওপর বোলাতে শুরু করল।
ভাদুড়িমশাই আবার কি যেন বলবার চেষ্টা করলেন। গলা থেকে বেড়ালের ডাকের মতো ফ্যাস ফ্যাস করে কিছুটা শব্দ হল কেবল। শব্দটা নিজের কানেই কেমন যেন বেমানান ঠেকল। যেন ইঁদুর পড়েছে কলে।
—আপনি মশাই ভীষণ ঘাবড়ে গেছেন। ওদের মধ্যে একজন হঠাৎ ফস করে একটা দেশলাই জ্বালিয়ে জ্বলন্ত কাঠিটা তুলে ধরল ভাদুড়িমশাইয়ের মুখের কাছে।
—অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন বুঝি না! আমরা আপনাকে তুলে নিয়ে পালিয়ে যাব না মশাই, হেঁ হেঁ—
—আমি যাই তা হলে! ভাদুড়িমশাই উৎসাহ মিশিয়ে বললেন।
—যাবেন বইকী! কিন্তু আমাদের মজুরি? ঘড়িটা ছাড়ুন দেখি।
—ঘড়ি! ভাদুড়িমশাই আবার উৎসাহে হাতের কব্জি দুটো তুলে ধরে দেখালেন, এই দেখুন ঘড়ি পরি না আমি।
ফস করে আবার একটা কাঠি জ্বলল। বাঁ হাতের কব্জির কাছে জ্বলন্ত কাঠিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে হো হো করে হেসে উঠল একজন। তারপর কাঠিটাকে টোকা দিয়ে ছুড়ে ফেলে হঠাৎ ঠাস করে একটা চাটি কষিয়ে দিল ভাদুড়ি মশাইয়ের গালে।
—খুব চালাকি শিখেছেন দাদা। হাতে দাগ রয়েছে ঘড়ির।
ভাদুড়িমশাই চাঁটি খেয়ে ক্যাঁক করে লাফিয়ে উঠেছিলেন। গালের ওপর হাত বুলোতে শুরু করলেন।
—মিথ্যে কথা বললেন কেন? আমরা কি ভদ্রলোকের ছেলে নই? আপনার মতো অফিসে-টফিসে চাকরি করি না এই যা!
ভীষণ কাঁপুনি ধরেছিল ভাদুড়িমশাইয়ের। কাঁপতে কাঁপতেই বললেন, না, মানে, ঘড়ি আমি পরেই বেরুতাম, কিন্তু দোকানে দিয়েছি তাই।
ঠাস করে আর একটি চাঁটি কষিয়ে দিল আর একজন। মিথ্যে কথা বলেছিলেন বলে আগেরটা খেয়েছিলেন আর এটা হল ঘড়িটাকে দোকানে দিয়েছেন বলে।
ছেলেমানুষের মতো এবার ভাদুড়ি খানিকটা ডুকরে উঠলেন। দোহাই আপনাদের, আমাকে মারবেন না, আপনাদের পায়ে পড়ি।
—এই এই, আরে আরে—আপনি মাইরি কী যে করছেন। আচ্ছা, কলম-টলমও তো দেখছি না পকেটে। আংটি নেই বোতাম নেই আপনি মাইরি স্রেফ ন্যাংটো হয়ে বেরিয়েছেন। এবার কিছু পয়সাকড়ি ছাড়ুন দেখি দাদা। দশ টাকার কম হলে কিন্তু ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে হালুয়া বার করে দেব।
হিঁ হিঁ করে হেসে উঠল একজন।
ভাদুড়ি পকেটে যা ছিল ঝেড়ে বার করলেন। বেরুল সাঁইত্রিশটা পয়সা।
—ব্যাস! এই কটা?
পয়সা কটা এবার অঞ্জলি দেবার মতো করে এগিয়ে ধরলেন ভাদুড়িমশাই, বিশ্বাস করুন, আমি বামুনের ছেলে মিথ্যে বলিনি। তাছাড়া আপনাদের আমি ঠকাব কেন বলুন!
দু গালে ওর চামড়া ফেটে গেছে কিনা কে জানে। চিড়বিড় করে জ্বলুনি শুরু হয়েছিল। এই অন্ধকারে আর কেউ যখন এ ঘটনার সাক্ষী নয় অপমান বোধ করছিলেন না ভাদুড়ি, কেবল ভয়েই উনি কুঁকড়ে উঠেছিলেন। ছোঁড়াদুটোর মতিগতি কিছুই উনি বুঝতে পারছিলেন না।
হঠাৎ একজন চেঁচিয়ে উঠল, মামদোবাজি পেয়েছেন নাকি দাদা? ধোঁকা দেবার আর জায়গা পান না। বলেই ওর চুলের মুঠি চেপে ধরল। পয়সা নেই তো মিছিমিছি আমাদের সময় নষ্ট করলেন কেন? মগের মুল্লুক পেয়েছেন!
ভাদুড়িমশাই বাবাগো মাগো করে কঁকিয়ে উঠলেন।
—এই শালা, চেঁচালেই—চুলের মুঠি যে ধরেছিল সে জাপানি কায়দায় ওকে দুটো পাক দিয়ে তিন হাত দূরে ছিটকে ফেলল।
খানিকটা যেন ভুমিকম্পের মতো অনুভব করলেন ভাদুড়িমশাই। পেটের ভিতর ঘুলঘুলি কেটে কিছু একটা যেন পাক খেয়ে ওঠায় বমি পেল। বমির মতো একটা অনুভূতি। মুহূর্তেই আবার সেটাকে সামলে উঠে ঘোলাটে চোখে তাকালেন ভাদুড়িমশাই।
পরে পেল্লাই একটা চিৎকার দিয়ে ছুটবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিধি যার বাম সে কি আর অত সহজেই রেহাই পায়। কোঁচার ডগায় আটকে আবার পড়লেন হুমড়ি খেয়ে। আর এসময় হাঁটুটা খানিক ছাড় গেল।
ওদের মধ্যে একজন তখন বাঘের মতো লাফিয়ে পড়েছে ওঁর ঘাড়ে। আর একজন চেপে ধরেছে ওঁর পিছন দিককার জামা। পড়পড় করে জামাটা ছিঁড়ে গেল। ছিঁড়ুক গে, ভাদুড়িমশাই প্রাণের টানে লাফিয়ে উঠে আবার ছুটলেন।
কাপড় খুলে গেল। খুলে গেলেও কোমরে উনি গিঁট দিয়ে কাপড় পরেন বলে বিরাট একটা ল্যাজের মতো ওটা ওঁর পিছন পিছন রাস্তা ঝাঁট দিতে দিতে এগোতে লাগল। অনেকটা ঠিক ক্যাঙ্গারুদের মতো লাফিয়ে-লাফিয়ে ছুটলেন উনি। হাঁপাতে হাঁপাতে শেষ পর্যন্ত এসে পড়লেন আলোয় রাস্তায়। একবার এই ফাঁকে পিছন দিকে তাকালেন। হ্যাঁ ছোঁড়া দুটোকে অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে মজা লুটছে ওরা। যেন ভাদুড়ি মশাইয়ের মতো মজার বস্তু ওরা খুব কমই পেয়েছে এই রাস্তায়।
তা হোক, ভাদুড়িমশাই প্রাণে বাঁচলেন। বাপরে বাপ, এই কান মলছি, এই নাক মলছি আর কখনও যদি এত রাত করে এই রাস্তা দিয়ে ফিরি। ইস, জামাটা আমার ফরদাফাই করে দিয়েছে। হাঁটুটায় ভীষণ জ্বলুনি শুরু হয়েছে। হাত দিয়ে বুঝলেন চটচটে আঠার মতো রক্ত জমে উঠেছে হাঁটুতে। তবু ভাল, অল্পের উপর দিয়ে গেছে আজ। যেভাবে ওরা ছুরি বার করেছিল নেহাত ওঁর বাপের ভাগ্যি ছুরিটা ওঁর পেটের মধ্যেই গুঁজে দেয়নি। দিলেই হত। একজনও শালা ছুটে এসে সাহায্য করত না ওঁকে।
ভাদুড়ির পক্ষে ভাল রকমেরই শিক্ষা হল আজ। এতদিন কেবল খবরের কাগজে আর লোকমুখেই ছিনতাই পার্টির কথা শুনে এসেছেন উনি। আজ নিজেই ওদের খপ্পরে পড়লেন। শুধু খপ্পরে পড়া নয়, একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলেই ওঁর ডেড বডি পোস্ট মর্টেমের জন্য পুলিশ হাসপাতালে চলে যেত। বডি সনাক্তকরণের জন্য ওঁর আত্মীয়-স্বজনদের ডাকা হত তখন। তারপর—
আসলে রানীর জন্যই যত রাজ্যের ঝামেলা পোহাতে হল আজ। সকাল বেলা খবরের কাগজে রাশিফল দেখতে দেখতেই মাথায় কেমন দুর্বুদ্ধি চেপেছিল ওঁর। প্রেমের ব্যাপারে এ সপ্তাহটা যে প্রশস্ত এই বুঝি তার নমুনা, বাপস।
জামাটার জন্য কষ্ট হল ওঁর। সদা পাট ভাঙা জামা, একদম ফতে করে দিয়েছে। এমনিতেই ওঁর তিনখানা মাত্র জামা, একটা আবার, ঘাড় ছেঁড়া , শীতকালে জাম্পার চড়িয়ে পরবেন বলে রেখে দিয়েছিলেন ভাদুড়ি। এখন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে পড়লেন।
ঝুঁকে হাঁটুর ওপর হাত বুলিয়ে আবার উনি হাঁটতে শুরু করলেন। একটু দ্রুতই হাঁটলেন এবার। এ গলিটায় আলো জ্বলছে, দুজন একজন মানুষ- টানুষও দেখতে পাচ্ছেন ভাদুড়ি। অথচ কাউকেই উনি মুখ ফুটে বলতে পারলেন না ওঁর কথা। যেন এরকম কোনও ঘটনার কথা বলতে যাওয়া মানেই নিজের গায়ে অপমান মাখা। সাধ করে আর নিজেকে অপমানিত করতে চাইলেন না ভাদুড়ি। আপাতত ভালয় ভালয় বাড়ি গিয়ে পৌঁছতে পারলেই যেন বাঁচা যায়।
বার দুয়েক বাঁক খেয়ে এবার নিজের বাড়ির গলির ভিতর ঢুকে পড়লেন। এপাশ ওপাশ তাকালেন। না কেউ দেখছে না ওঁকে। এখন যদি চেনা লোকের পাল্লায় পড়েন ভাদুড়ি অমনি তাকে শুনতে হবে, এই যে ভাদুড়িমশাই, আরে আরে, জামাটা ও কি করেছেন?
—এই একটু পড়ে গিয়ে—হাসতে হবে ভাদুড়িকে।
—আহা, পড়ে গিয়েছিলেন নাকি! তা চোট টোট লাগেনি তো? যেমন সব দিনকাল পড়েছে, ভালয় ভালয় বাড়ি ফিরতে না পারলে আর বিশ্বাস নেই।
ভাদুড়িমশাইকে আবার হাসতে হবে, হেঁ হেঁ—
ফলে খানিকটা সতর্কভাবেই উনি হাঁটছিলেন। কিন্তু সারা গায়ে আবার বমি বমি করে কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে হল আবার কে যেন ওঁর পিছু নিয়েছে। ভাদুড়িমশাই নিজের বাড়ির কাছাকাছিই চলে এসেছিলেন। হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটাকে দেখতে পাচ্ছিলেন উনি। বড় জোর পঞ্চাশ কি একশো হাত দূর। কিন্তু কে হাঁটছে আবার পিছনে পিছনে! তবে কি এখনও ওরা সঙ্গ ছাড়েনি। হায় কপাল, আবার!
যেন দু-তিন হাত পিছনেই কেউ সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে ওঁর। না থেমে পারলেন না ভাদুড়ি। নাঃ, পিছনে যে, সে কিন্তু থামল বলে মনে হল না। সে যেন এগিয়ে আসতে আসতে সে ওঁর হাতের আঙুলে ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে কিছু যেন ছুঁইয়ে দিল।
তড়াক করে লাফিয়ে চমকে উঠলেন ভাদুড়ি। পিছন ফিরেই হিম হয়ে গেলেন। এই রে, কুকুর! এই এই, ভাগ ভাগ। ইস নাকের লালা-ফালা লাগিয়ে দিয়েছে হাতে। ছেঁড়া জামায় হাত মুছতে মুছতে কুকুরটাকে তাড়া করলেন ভাদুড়ি।
কিন্তু কৃষ্ণের জীবটি ততক্ষণে চিৎকার করে ওঁর জামা কামড়ে ধরেছে। ভয়ে হাত-পা আবার সিঁটিয়ে এল। কামড়ে দেবে নাকি! কুকুরে কামড়ালে নির্ঘাৎ জলাতঙ্ক। এই এই—
মুহূর্তের মধ্যেই সব কিছু কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেল। মরিয়া হয়ে চট করে একটা ইটের টুকরো কুড়িয়ে নিলেন ভাদুড়ি, তাক করে ছুড়ে মারলেন। যেন ভোজবাজির মতো ফল ফলল এবার। ভাদুড়ি দেখলেন, প্রাণের ভয়ে বিশ পঁচিশ হাত পিছিয়ে গেছে কুকুরটা। ঢিলটা বোধহয় মোক্ষম মতো গায়ে লেগেছে। বোঝ শালা, কেমন লাগে।
বুকে খানিকটা সাহস ফিরে পেলেন। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলেন আরও কিছু ইটের টুকরো। কুকুর তাড়াবার ভঙ্গি করতে করতে আরও একটা ছুঁচলো ইট কুড়িয়ে নিলেন ভাদুড়ি। বেড়ে মজা। কুকুরটা এবার প্রাণের ভয়ে দৌড়তে শুরু করেছে।
দেখতে দেখতে সমস্ত গা ঝরঝরে হয়ে এল ওঁর। উল্লাসে চকাৎ করে ইটের টুকরোটাকেই চুমু খেয়ে বসলেন। তারপর খানিকটা নাচতে নাচতেই বাড়ির দরজায় এসে পা দিলেন।
হ্যাঁ, অবিকল নাচার ভঙ্গিতে। যেন এতকাল পর ভীষণ একটা জটিল অঙ্কের উত্তর খুঁজে পেয়ে গেছেন উনি।
ইটের টুকরোটা মনের ভুলে পকেটেই পুরে রাখলেন। ইট না হলে চলে, বাপস।
১৯ এপ্রিল ১৯৭০