1 of 2

ছায়া, না কায়া?

ছায়া, না কায়া?

বেশিদিনের কথা নয়। এই গেল শ্রাবণ মাসের এগারোই তারিখ।

পূর্ণিমার রাত। দশটার সময়ে শয্যা নিয়েছি, এখন বারোটা বেজে গেছে। কিন্তু চোখে আর ঘুম আসে না।

ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম বারান্দায়। সামনেই গঙ্গা, চাঁদের আলো তাকে যেন রুপো দিয়ে মুড়ে দিয়েছে। ভাবলুম, খানিকটা বেড়িয়ে এলে হয়তো অনিদ্রার কবল থেকে মুক্তিলাভ করব।

বেরিয়ে পড়লুম। একদিকে চির-জাগন্ত গঙ্গা, আর এক দিকে ঘুমন্ত বাড়ির সারি, মাঝখানে পথিকহীন পথ। কোনো ঘাটে বিকটকণ্ঠ গায়করা পর্যন্ত পাড়া কাঁপানো চিৎকার করছে না। এই চমৎকার নির্জনতাটুকু উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চললুম।

কলকাতা শহরে গঙ্গার ধারে বেড়াবার আসল সময় হচ্ছে এই। এখন থেমেথুমে গেছে যত বাজে গোলমাল,—আকাশ আর বাতাস, কান আর প্রাণ ভরে জেগে আছে শুধু গঙ্গার জলতরঙ্গে হিমালয়ের গম্ভীর বাণী। কত কোটি কোটি যুগ আগে জন্ম হয়েছে এই পবিত্র বাণীর, কেউ তা কল্পনাও করতে পারে না। একে নিঃশেষে গ্রাস করতে পারেনি অনন্ত সমুদ্রও।

মস্তবড়ো একটা বটগাছ অনেকখানি জায়গা জুড়ে আবছা অন্ধকার সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে। তারই মধ্যে এখানে-ওখানে দপদপ করছে চার-পাঁচটে জোনাকি, কে যেন আগুনের ফিনকি নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে!

জায়গাটি ভালো লাগল। বটের ছায়ার তলায় নিদ্রিত ঘাটের কোলে এসে ছলাৎ ছলাৎ করে বেজে উঠছে গঙ্গাজল,—ছোটো ছোটো ঢেউ-শিশুরা যেন কৌতুকহাস্যধ্বনি তুলে পাষাণের ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করছে।

সেইখানেই বসে পড়লুম। গঙ্গা জুড়ে রুপোলি আলোর কারিকুরি দেখতে দেখতে নিজেরই অজান্তে কখন গুনগুন করে গান শুরু করে দিলুম।

হঠাৎ লজ্জিত হয়ে গান থামিয়ে ফেললুম। লজ্জার কারণ আছে। দৃঢ় পণ করে গঙ্গার ধারে যারা নিয়মিত ভাবে বেসুরো গান গেয়ে লোক জ্বালাতে আসে, আমি তাদের দু-চক্ষে দেখতে পারি না। অথচ আজ আমি নিজেই গঙ্গার ধারে বসে গান গাইবার চেষ্টা করছি।

গান থামিয়ে খানিকক্ষণ নীরবে চাঁদের আলোয় ধোঁওয়া ওপারের অস্পষ্ট গাছপালার দিকে তাকিয়ে রইলুম। ওখানে একটা আগুন জ্বলছে, বোধ হয় চিতার আগুন। স্তব্ধ রাত্রির বুক চিরে মেয়ে-গলার একটা কান্নার শব্দও শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে।

এমন সুন্দর রাত্রে মৃত্যুর স্মৃতি ভালো লাগল না।

আচমকা আমাকে চমকে দিয়ে গাছের উপর থেকে ডেকে উঠল একটা বাচ্চা প্যাঁচা। ঠিক যেন ভূতুড়ে শিশুর কান্না!

ভয়ের কারণ ছিল না, আমি ভিতু মানুষও নই। তবু কেন জানি না, বুকের কাছটা কেমন ছ্যাঁৎছ্যাঁৎ করতে লাগল।

অকারণেই মনে হল, প্যাঁচার বাচ্চাটা অকারণে কাঁদছে না। সে নিশ্চয় ভয় পেয়েছে। কিন্তু কীসের ভয়?

তারপরেই অনুভব করলুম, এখানে আমি যেন আর একলা নই। যেন কার হিঁসকুটে চোখের তীক্ষ্ণ, উত্তপ্ত দৃষ্টি আমার পিঠের উপরে এসে বিঁধছে বার বার।

নিজের অমূলক ভয়কে হেসেই উড়িয়ে দিতে চাইলুম। কিন্তু ভয় গেল না।

হঠাৎ শুনলুম পিছনে কে বিড় বিড় করে কথা কইছে!

তাড়াতাড়ি ফিরে দেখি বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক। যেন স্থির পাথরের মূর্তি।

মাথায় এলোমেলো ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া চুল; চোখ দুটো বিস্ফারিত নিস্পলক; বিষম লম্বা নাকটা বড়শির মতন বাঁকানো; অস্থিচর্মসার দীর্ঘ দেহ; রং কুচকুচে কালো; আদুর গা, খালি পা, কাপড় হাঁটু পর্যন্ত। ভদ্রলোক নয়।

তখন খেয়ালে আনিনি, কিন্তু পরে ভেবে বুঝেছিলুম, লোকটা দাঁড়িয়েছিল ঝুপসি বটগাছের তলার প্রায়-অন্ধকারে, তবু বিশ-পঁচিশ হাত দূর থেকেও আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলুম তার চোখ নাক মুখ—এমনকি হাত পায়ের নখ পর্যন্ত!

চেঁচিয়ে বললুম, ‘কে হে তুমি?’

লোকটা জবাব দিল না, একটুও নড়ল না, আপন মনেই বিড় বিড় করে বকতে লাগল।

আবার জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কী হে, এত রাতে এখানে কী করছ?’

জবাব নেই। কিন্তু বিড় বিড় করে বকুনি থামল না।

নিশ্চয় পাগল, নইলে বিড় বিড় করে বকে কেন?

তাকে নিয়ে আর মাথা ঘামানো দরকার মনে করলুম না।

প্যাঁচার বাচ্চাটা তখনও সমান চিৎকার করে মৌন রাত্রিকে বীভৎস করে তুলছিল। তার এ চ্যাঁচামেচির মানে খুঁজে পাওয়া যায় না। কোন ডালে তার বাসা? গাছের চারিদিকে চোখ বুলিয়েও আবিষ্কার করতে পারলুম না।

মনে এল বিরক্তি। নাঃ, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি কোথাও নেই। চাঁদের আলোয় গঙ্গার ধারে এলুম। নিরালায় বসে একটু রূপের স্বপন দেখব বলে। কিন্তু স্বপ্ন আমার ভেঙে দিলে ওপারের ওই জ্বলন্ত চিতা আর শোকার্ত নারীর আর্তনাদ এবং এপারের ওই প্যাঁচার কান্না—আর পাগলের বিড় বিড় বকুনি!

দরকার নেই আর কবিত্বে, আবার বাড়িতে ফিরে যাওয়া যাক।

উঠে দাঁড়ালুম। একবার গাছতলার দিকে তাকালুম। পাগলটা সেখানে নেই। কিন্তু তার বিড় বিড় বকুনি তখনও শোনা যাচ্ছে!

সে কথা কয় কোথা থেকে? এদিকে-ওদিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল গাছের উপর দিকে।

একটা মোড়া ডালের দুইদিকে দুই পা ঝুলিয়ে বসে পাগলটা নিজের গলায় পরেছে একটা দড়ির ফাঁস, বিড় বিড় করে বকতে বকতে!

কী সর্বনাশ! তবে কি ও পাগল নয়? ওকি এখানে এসেছে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে?

না, না, লোকটা পাগলই বটে। নইলে আমার সামনেই আত্মহত্যা করতে চায়? অন্তত উপস্থিত মুহূর্তে পাগলামির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ওর বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেছে!

চিৎকার করে বললুম, ওহে, করো কী—করো কী! শিগগির গলার দড়ি খোলো, গাছ থেকে নেমে পড়ো!

লোকটা ফিরেও তাকালে না, কিন্তু হা হা হা করে হেসে উঠল!

কী ভয়ানক অট্টহাসি, প্যাঁচার বাচ্চাটা পর্যন্ত ভয়ে চুপ মেরে গেল! কানের কাছেই শুনছি বটে, কিন্তু আমার মনে হল যেন, ও হাসি যে হাসছে সে আছে অনেক—অনেক—অনেক দূরে! ও যেন পৃথিবীর হাসি নয়!

পরমুহূর্তেই আড়ষ্ট চোখে দেখলুম, লোকটা ঝুপ করে নীচে লাফিয়ে পড়ে দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে হাত-পা ছুড়তে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে শিউরে উঠে লক্ষ করলুম, তার দুটো পাকানো কপালে ওঠা চোখ জ্বলছে ফসফরাসের মতো!

দু-এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলুম মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিষ্পন্দ হয়ে। চোখের সামনে এমন আত্মহত্যার চেষ্টা দেখে কে না স্তম্ভিত হয়? তার জিভখানা মুখের বাইরে বেরিয়ে পড়ে লকলক করে ঝুলছে, আর তার পা দুটো ক্রমাগত করছে শূন্যকে পদাঘাত!

তারপরেই হুঁশ হল। তার দেহটা ঝুলছিল মাটি থেকে মাত্র তিন হাত উপরে। দ্রুতপদে দৌড়ে গিয়ে দুইহাত দিয়ে তার দেহটাকে উপর দিকে তুলে ধরবার চেষ্টা করলুম—সঙ্গে সঙ্গে সে-ও তার দু’খানা দীর্ঘ কঙ্কালসার পা দিয়ে আমার বুক-পিঠ জড়িয়ে ধরে শক্ত বাঁধনে বেঁধে ফেললে—

…এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার নাকে এল একটা অত্যন্ত পচা ও ধসা মড়ার ভয়াবহ দুর্গন্ধ!

আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘ছাড়ো, ছাড়ো—আমি তোমাকে বাঁচাতে চাই—এমন করে চেপে ধরলে আমি তোমাকে বাঁচাতে পারব না!’

সে হি হি করে হাসতে ও হেঁচকি তুলতে লাগল! গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে ঝুলতে কেউ কখনও হাসতে পারে? মনে হতেই আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিলে!

অনুভব করলুম, যে দেহের স্পর্শ আমি পাচ্ছি সেটা অস্বাভাবিক রকম ঠান্ডা! এ জ্যান্ত মানুষের দেহ নয়!

মনের ভিতর দিয়ে বিদ্যুতের মতন খেলে গেল একটা সম্ভাবনার ইঙ্গিত!

এদিকে পায়ের বাঁধন ক্রমেই ভীষণ হয়ে উঠছে, আমার বুক-পিঠের হাড়গুলো এইবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে!

প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলুম, বাঁচাও! বাঁচাও! কে কোথায় আছ, বাঁচাও!

পায়ের চাপ আরও বাড়তে লাগল এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই জীবন্ত মৃতদেহটা হাসতে ও হেঁচকি তুলতে লাগল ক্রমাগত!

আবার চ্যাঁচালুম, বাঁচাও! আমাকে মেরে ফেললে, বাঁচাও! দেখতে দেখতে পায়ের চাপে আমার দম বন্ধ হয়ে এল—দুই হাত দিয়ে টেনে সেই সাংঘাতিক পায়ের বাঁধন খোলবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু বৃথা চেষ্টা!…

অনেক লোকের দ্রুত পদশব্দ শুনলুম—শব্দ কাছে এসে পড়ল।

কে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কী হয়েছে, কী হয়েছে? অমন চিৎকার করছেন কেন?’

পা দুটো তখনও আমাকে ছাড়েনি। হাঁপাতে হাঁপাতে অতি কষ্টে বললুম, এই লোকটা গলায় দড়ি দিয়ে মরতে যাচ্ছিল, আমি বাধা দেওয়াতে পা দিয়ে চেপে ধরে আমাকে মারবার চেষ্টা করছে।—আমাকে বাঁচাও!

বিস্মিত প্রশ্ন শুনলুম, কই, কে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে? কে আপনাকে মারবার চেষ্টা করছে? কেউ তো এখানে নেই!

দুই হাত দিয়ে সেই পচা মাংসের দুর্গন্ধ ভরা পা দু-খানা টানতে টানতে রুদ্ধশ্বাসে বললুম, দেখতে পাচ্ছ না? এই দ্যাখো—এই দ্যাখো—এই দ্যাখো!

হঠাৎ পা-দুটো আমাকে ছেড়ে দিলে—আমি এলিয়ে ধপাস করে মাটির উপরে পড়ে গেলুম।…..

একটি লোক ‘টর্চ’ টিপে গাছের এদিকে-ওদিকে আলো ফেলে বললে, চেয়ে দেখুন, কেউ কোথাও নেই! মাসখানেক আগে একটা লোক এই গাছে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল বটে, কিন্তু আজ আবার কে এখানে মরতে আসবে? আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুঝি? স্বপ্ন দেখছিলেন?

পাছে ওরা আমায় পাগল ভাবে সেই ভয়ে বললুম, তাই হবে!

* এই গল্পটি ‘ভূত-পেত্নীর কথা’ নামেও প্রকাশিত হয়েছিল।

___

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *