1 of 2

ছানি

ছানি

আজ মহাষ্টমী। এবারে রবিবার পড়ে গিয়ে সপ্তমীর ছুটিটাই মারা গেল। কাল রাতে মা বললেন, বড়ো মাসিমা মেসোমশায়রা দিল্লি থেকে এসেছেন। আমার মাসতুতো ভাই স্টেট ব্যাঙ্কের বড়ো অফিসার। মাসিমার একই ছেলে। ওঁর কাছেই উঠেছেন ওঁরা। ওঁদের ফোন থাকলেও আমাদের নেই বলে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি। একবার যেন যাই, খোঁজ করে আসি।

বাড়ি থেকে যখন বেরুচ্ছি ঠিক তখনই, আমার ছ-বছরের মেয়ে শ্রী বলল, বাবা! আমিও যাব।

বললাম, পুজোর দিন বাসে-ট্রামে ওঠা যাবে না, ভিড় ভীষণ। তুমি কি অতদূরে হেঁটে যেতে পারবে?

মেয়ে বলল, বাঃ রে! সেই তোমার সঙ্গে সেবারে তারা দেখতে গেছিলাম না, সেখান থেকে ট্রাম বাস কিছুই না পেয়ে সেদিন হেঁটে আসিনি বুঝি?

আমার মনে পড়ল, সত্যিই তো! প্ল্যানেটোরিয়াম থেকে একবার হাঁটতে-হাঁটতে ল্যান্সডাউন রোড অবধি এসেছিলই তো শ্রী।

বললাম, বেশ–চলো তাহলে।

রুণা বলল, রোদ উঠেছে কড়া, পুজোর দিনে রোদে হেঁটে অসুখে-বিসুখে পড়বে। না, তুমি যাবে না শ্রী।

মেয়ের মুখ করুণ হয়ে এল।

তবু বললাম, চলুকইনা। পথে অনেক ঠাকুরও দেখা হবে! আর তেমন মনে করলে রিকশা করে চলে আসবে।

রুণা বিরক্ত গলায় বলল, বিকেলে আমি বাপের বাড়ি যাব। দাদারা গাড়ি পাঠাবে। তখন যদি পড়ে পড়ে ঘুমোয় তাহলে পিটুনি খাবে আমার কাছে।

নিস্পৃহ গলায় বললাম, ঘুমোলে ঘুমোবে। আমি তো যাব না। না-হয়, আমার সঙ্গেই অন্য কোথাও যাবে ও। হেঁটে হেঁটে, কাছাকাছিই যাব।

রুণা বলল, যা ভালো মনে করো, করো।

আর দেরি না করাই ভালো মনে করে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়লাম।

এদিকে মেয়ে হাঁটতেই পারছে না। কী একটা জগঝম্প পরেছে। দু-হাতে দু-দিক উঁচু করে ধরে নতুন জুতো পায়ে আমার পাশে পাশে হাঁটছিল শ্রী।

বললাম, এটা কী পরেছ তুমি?

শ্রী তার বোকা বাবার চোখে তাকিয়ে বলল, তুমি তাও জান না? এটাকে ম্যাক্সি বলে।

বললাম, যে-জামা পরে হাঁটা যায় না সেটা পরার দরকার কী?

দ্যাখো না। শ্রী অনুযোগের সুরে বলল, মা এমন বড়ো করে বানাল, যাতে সারা শীতে পরতে পারি, ছোটো না হয়ে যায়।

বললাম, কটা জামা হল এবারে পুজোয়?

শ্রী চোখ নাচিয়ে বলল, তা অনেক। তারপর বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও, গুনে বলি। মা বানিয়েছে। একটা! চার মামা চারটে। দু-মাসি দুটো। মামা-দাদুও একটা দিয়েছে।

ক-টা হল সবসুন্ধু?

ছ-টা। গুনেটুনে শ্রী বলল।

আমি বললাম, ভুল হল। আটটা।

শ্রী যোগের ভুলের পাপ স্খলন করে বলল, কী মজা। না?

আমি ভাবছিলাম, এতগুলো জামার কি দরকার ছিল কোনো? একজন শিশুর, পুজোর আনন্দের পরিপ্রেক্ষিতেও? এতগুলো জামা কি বাড়াবাড়ি নয়? বিশেষ করে এ-বছরের প্রলয়কারী বন্যা ও বৃষ্টির পর? বড়োলোক মামাবাড়ির ব্যাপার! গরিব জামাই-এর চুপ করে থাকাই শোভন! মেয়ের ভালো মন্দ ঠিক করার আমি কে?

শ্রী হঠাৎ আমার হাত ধরে টানল।

ওর দিকে চাইতেই স্টেশনারি দোকানের দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করল।

শুধোলাম, কী?

আহা! তুমি যেন জানো না।

শ্রী পাকামি করে বলল।

যা শোনে, তাই শেখে ও। বলল, বড়োমামা সবসময় কিনে দেয়!

আমি একটা বড়ো চকোলেটের বার কিনে দিলাম। বাবা হিসেবে কোনো কর্তব্যই প্রায় করি না মেয়ের প্রতি। সামর্থ্যের অভাবও যে নেই এমনও নয়। আমার মাধ্যমে আনন্দ, ভালো লাগা, কিছুরই স্বাদ পায় না মেয়েটা। পুজোর দিনে ওকে নিজে হাতে ওর অনুরোধে একটা চকোলেট কিনে দিয়ে ভারি খুশি হলাম। বাবা হওয়ার যেন ঝক্কি অনেক, তেমন আনন্দও অনেক। যে বাবা না হয়েছে, সে বুঝবে না এর দুঃখ। এবং আনন্দও। আমার সঙ্গে একা থাকলে মেয়েও বেশ স্বাধীনতার স্বাদ পায়। মায়ের কড়া শাসনের হাত থেকে তখন ওর ছুটি।

বড়ো প্যান্ডেলে পুজো হচ্ছে সামনে। দামড়া দামড়া বয়স্ক ছেলেগুলো হিন্দি ছবির নায়কদের মতো দামি ও অন্য গ্রহের পোশাক পরে প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ে দেখছে। পুজোর আসল মজাই তো ওটাই। এ বছরও এদের সাজ-সজ্জা আমাকে আশ্চর্য করছে। এদের দেখে কে বলবে যে, কলকাতায় ও বাংলায় অল্প কদিন আগেও এত বড়োবিপর্যয় ঘটে গেছে। পুরুষরাও কি এমন মেয়েদের মতো পোশাক সচেতন হতে পারে? অন্তঃসারশূন্য শরীর ও ষাঁড়ের গোবরময় মস্তিষ্কের জন্যে পুরুষদেরও বাহারি জামাকাপড় এবং হাই-হিল জুতোর দরকার হয় এ ভিখিরিদের শহরে, তা ভাবলেও অবাক লাগে। এই হচ্ছে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র। এর নাম সাউথ ক্যালকাটা। তার মধ্যে এপাড়া হচ্ছে জাত পাড়া। এইসব পাড়ার পুজো দেখতে দূর দূর জায়গা থেকে মানুষে আসে। রাত জেগে পায়ে হেঁটে পুজো দেখে। হাঁ করে বড়োলোকি দেখে। বড়োলোকের সুন্দরী মেয়েদের কৃত্রিম মুখ দেখে। ছেলেদের চুল আর পোশাক দেখার পর গ্রাম গঞ্জে গিয়ে সেখানের নির্মল ও সুস্থ পরিবেশকে বিকৃত ও দূষিত করে তোলে।

ভিড়ের মধ্যে থেকে পটল দৌড়ে এল। এসেই আমাকে বলল, তোমার ভাই ডুবিয়ে দিলে এক্কেবারে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কী?

আমাদের পুজো কমিটির চাঁদা থেকে পাঁচ-শো সাঁইত্রিশ টাকা যে বন্যাত্রাণে দিলাম হাবুদা সে খবরটা একটু কাগজে ছাপিয়েও দিতে পারলে না নিউজ আইটেম হিসেবে! এত বড়ো একটা দান!

পটলের বাবা, অর্থাৎ আমার প্রতিবেশীর সর্ষের তেলের কল আছে। কীসের সঙ্গে কী মিশিয়ে তাঁর কলের ঘানি চলে তা ভগবানই জানেন। কিন্তু অর্থের অভাব নেই কোনো! এও আমার জানা যে, কোনো অপ্রাকৃত কৌশলে এ পর্যন্ত জীবনে তিনি ঠেকাননি সরকারকে একটি পয়সাও। পটলের নিজের সিগারেটের খরচই মাসে চার-শো। পুজো কমিটির পাঁচ-শো সাঁইত্রিশ টাকা! পটল এবং পটলের সমগোত্রীয়রা কলকাতার এই বড়োলোকতম পাড়ার পুজো কমিটির মোট তহবিল থেকে ওই টাকা দিয়েছে এবং সে জন্যেই কাগজে সেটা ফলাও করে প্রচার করতে হবে এই দাবিতে আমার রক্ত চড়ে গেল। সীমাহীন লজ্জাহীনতা।

হাবু আমার ভাই। একটা খবরের কাগজের একজন সামান্য কর্মচারী সে। কাগজটা তার বাবার নয় যে, পটলের মতো দাতাকর্ণদের অকিঞ্চিৎকর দানের খবর নিউজ আইটেম হিসেবে ছাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা হাবু রাখে।

যাই-হোক, পটল বড়োলোকের ছেলে। বড়ো বড়ো ব্যাপার। বড়ো বড়ো বন্ধুবান্ধব। ওকে চটিয়ে আমার মতো চুনোপুঁটির ক্ষতি ছাড়া ভালো হবার নয়।

তাই, কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, হাবু চেষ্টা করেছিল, পারেনি।

পটল বলল, বুলশিট।

এমন সময় রমেন, আমাদের পাড়ায় সবচেয়ে অবস্থাপন্ন মানুষ হরেন ঘোষের ছেলের সঙ্গে দেখা। শুধোলাম, মা-বাবা কি এখানে?

রমেন পকেট থেকে ইন্ডিয়া কিংসের প্যাকেট বের করে ধরিয়ে, কায়দা করে বলল, দূর! মা-বাবা কখনো এখানে থাকে না পুজোয়। গত বার ফরেন ট্যুরে গেছিল, এবার কাশ্মীরে।

আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম, এ বছরেও?

তারপর বললাম, কাশ্মীরে আগে একবার গেছিলেন না?

রমেন বলল, আগে চারবার গেছে। এই নিয়ে ফিফথবার।

বললাম, বাঃ!

রমেন বলল, তুমি গেছ নাকি কালুদা, কাশ্মীরে?

আমি বললাম, নাঃ আমি কোথায়ই বা গেছি? মধুপুর গেছিলাম একবার অনেকদিন আগে।

রমেন সিগারেটটা বিলিতি লাইটারের উপর ঠুকে বলল, যাও ঘুরে এস। লাইফটা এনজয় করো। তুমি কেমন ম্যাদামারা হয়ে যাচ্ছ।

আমি পা বাড়ালাম। ভাবলাম, বলি, এনজয়মেন্টের সংজ্ঞা সকলের কাছে সমান নয়। আর্থিক সামর্থ্য আমার নেই বলেই শুধু নয়, ছুটিতে বাড়ি বসে বই পড়েই আমি সবচেয়ে বেশি এনজয় করি। শিক্ষিত এবং অশিক্ষিতদের এনজয়মেন্টের মধ্যে তফাত আছে। রমেনের নিজের বা তার মা-বাবার বিবেক-রুচি আমার উপর জোর করে রমেন চাপাতে চাইছে কেন জানি না। আমি। এগোলাম।

পঠল পিছন থেকে বলল, হাবুদাকে বোলো যে, হাবুদা নিজেকে যত ইম্পর্ট্যান্ট মনে করে ততটা সে নয়। আমরা অন্য লোক ধরে অন্য কাগজে খবরটা ছেপেছি। আমাদের নিজেদেরও সোর্স কিছু আছে।

আমি হাবুর জন্যে দুঃখিত হলাম। খবরের কাগজে কাজ করা বা তার সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত। থাকা যে কতবড়ো বিড়ম্বনার ব্যাপার তা হাবুর দাদা হয়েই আমি হাড়ে হাড়ে বুঝি। বেচারা হাবু!

গড়িয়াহাটের মোড়ে পৌঁছে, এক খিলি জর্দা-পান খেলাম।

শ্রীকে বললাম, তুমি চকোলেটটা খেলে না শ্রী?

ও বলল, দু-হাতে ম্যাক্সি ধরে আছি দেখছনা? পরে খাব!

গড়িয়াহাটার মোড় ছাড়িয়ে বালিগঞ্জ নিউ মার্কেট পেরিয়ে বাঁ-দিকের ফুটপাথ ধরে ফাঁড়ির দিকে হাঁটছি। একটা মাল্টিস্টোরিড বাড়ি। তারপরেই রাস্তা এবং তারপরই একটা তেকোণা পার্ক। পার্কটার সামনের স্টপেজে একটা সিমেন্টের শেড। দেখা যাচ্ছে দূর থেকে।

কত গাড়ি, কত শাড়ি, কত আনন্দ, কত অপচয় চারিদিকে। এমনকী আমার মতো সাধারণ অবস্থার মানুষের মেয়েও সব মিলিয়ে আটটা জামা পায় এবং পরেও পুজোতে। ভাবতে ভাবতেই চোখ পড়ল সেই শেডের নীচে। তখন পৌঁছেই গেছি সেখানে।

একটি লোক, পরনে শতচ্ছিন্ন খাটো ধুতি। মালকোঁচা মারা। শুয়ে, অঘোরে ঘুমোচ্ছে সকাল এগারোটায়, মহাষ্টমীর দিনে। গড়িয়াহাট মোড়ের দু-শো গজের মধ্যে। তার পাশে তার স্ত্রী। ভীষণ নোংরা ও ছেড়া একটা সায়াবিহীন লালপেড়ে মোটা শাড়ি তার পরনে। হাঁটু অবধি ওঠা। গায়ে একটা জামা আছে বটে কিন্তু বুকের বোতাম নেই। মেয়েটির একটি স্তন আঢাকা। স্তনের বৃন্তটি ফুটপাথের ধুলোয় মাখা। আর সেই বৃন্ত এক চুল দূরে একটি ক্ষুধার্ত, বড়ো ক্লান্ত, ঘুমন্ত শিশুর হাঁ-করা মুখ।

কেন জানি না, আমার পা আটকে গেল সেখানে। মেয়েটির উন্মুক্ত বুকের জন্যে নয়। আমি একজন সাধারণ মানুষ বলে। মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করি বলে। পুজোর সব আনন্দ, এই। সুন্দর শরৎ সকালে হঠাৎই লোডশেডিং-এর মতো নিভে গেল।

শ্ৰী হাত ধরে ঝাঁকি দিল। বলল, বাবা, ঠাকুর দেখাবে বললে, কী হল? মোটে-তো চারটে দেখলাম।

আমার সম্বিৎ ফিরে এল। ম্যাক্সি-পরা চকচকে-চামড়ার নতুন জুতো পরা আমার ছোট্ট অবোধ মেয়েকে বললাম, ঠাকুর দেখাব মা। তোমায় ঠাকুর দেখাব।

ভাবছিলাম, এই পরিবারটি কি বন্যাপীড়িত? এরা কোত্থেকে এসেছে? গোসাবা, মেদিনীপুর? না ডুয়ার্স? এরা কি অনেকই দূর থেকে হেঁটে এসেছে? কতখানি ক্লান্তি ও কতখানি ক্ষুধার্ত এরা যে, মহাষ্টমীর দিনের রবরবাময় গড়িয়াহাট মোড়ের দু-শোগজের মধ্যে থেকেও এরা সমস্ত পরিবার এমন মরণ ঘুম ঘুমোচ্ছে? এমন সকালে!

শ্রী বলল, কী দেখছ বাবা?

আমি বললাম, দেখেছ?

কী? শ্রী বলল, অবাক হয়ে।

শ্রী দেখার মতো কিছুই দেখেনি। ওর দেখার কথাও নয়।

যে লক্ষ-লক্ষ লোক গাড়ি চড়ে, বাসে-ট্রামে মিনিবাসে, পায়ে হেঁটে ওদের পাশ দিয়ে আজ ভোর থেকে হেঁটে গেছে, তারা কেউই ওদের দেখেনি। শ্রীর দোষ কী? ও তো একটা ছোটো মেয়ে।

হঠাৎ একটা কালো অ্যাম্বাসাডার এসে দাঁড়াল শেডটার সামনে। কে যেন বলল, কীরে কালু? কোথায় যাবি? চল নামিয়ে দিচ্ছি।

তাকিয়ে দেখলাম, আমার কলেজের বন্ধু রাজীব। অ্যালয় স্টিলের কারবার করে খুব বড়োলোক হয়েছে। নিউ আলিপুরে বিরাট বাড়ি করেছে। ফার্স্ট ইয়ারেই বকামি করে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল। এ দেশে পড়াশুনা করে এই রাজীবদেরই চাকর হতে হয়!

আমি বললাম, থ্যাঙ্ক ট্য। দরকার নেই। কাছেই যাব।

রাজীব বলল, চল না আমার সঙ্গে। মহাষ্টমীর ভোগ খাবি আমাদের পাড়ায়। বিয়ার সেশান চলেছে সকাল থেকে। জমবে ভালো। চল।

ওকে বললাম, না রে। তুই যা। আমি তো কাছেই যাব এক আত্মীয়ের বাড়ি।

হঠাৎ রাজীবের চোখ গেল ওই পরিবারটির দিকে।

চোখ বড়ো বড়ো করে আমাকে বলল, তুই কি দেশের কাজ করছিস নাকি? আরে! কটা লোককে দেখবি তুই এ পোড়াদেশে? এসব সরকারের ডিউটি। আমি নিজে যা ট্যাক্স দিই, তাতে। বন্যাত্রাণে নিজেই একটা লঙরখানা খুলতে পারতাম। কিন্তু করব কেন বল? সরকার কি দেয়। বদলে? হার্ড-আনৰ্ড মানির ট্যাক্সের বদলে?

তারপর ভালোবেসে বলল, পুজোর দিনে, একটু আনন্দ কর। এই তো তিনটে দিন বছরে। নিজেকে রাস্তার লোকের সঙ্গে ইনভলভ করিস না। কতজনের দুঃখ নিজের করবি? এর শেষ নেই। বোকার মতো বিহেভ করিস না। ফালতু!

এত কথা জোরে জোরে বলে রাজীব চলে গেল।

আশ্চর্য! পরিবারটি তবুও অসাড়ে ঘুমোচ্ছিল। কী মরণ ঘুমই না ঘুমোচ্ছে!

রাজীব না হয় অনেক ট্যাক্স দেয় কিন্তু পটলের বাবা? আমার মামা শ্বশুর? তিনি তো এক পয়সাও দেন না। তাঁরও কি কোনো কর্তব্য নেই? ছিল না? আজ অথবা গতকাল? অথবা থাকবে না আগামী কালও। দেশের প্রতি, এদের প্রতি?

এতক্ষণে শ্রী কথা বলল।

বলল, বাবা, বাচ্চাটার খুব খিদে পেয়েছে, না? আমি আমার চকোলেটটা একে দিয়ে দিই?

আমি শ্রীর মুখের দিকে তাকালাম। আমার বুকের মধ্যেটা যেন কীরকম করে উঠল। বললাম, তুমি খাবে না?

শ্রী বলল, আমি তো খাই, প্রায়ই খাই, কত্ত খাই। ও যে কিছুই খেতে পায় না।

বললাম, দাও।

কী নোংরা জায়গাটা, কী নোংরা ওদের কাপড়-চোপড়, শরীর। রুণা থাকলে মুখে আঁচল দিত, শ্রীকে কিছুতেই কাছে যেতে দিত না। কিন্তু শ্রী যখন এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে হাত দিয়ে ওঠাল তখন আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

বাচ্চাটা চোখ খুলেই অবাক হল। শ্রী চকোলেটটা ওর হাতে দিল। বাচ্চাটা জীবনে ক্যাডবারি দেখেনি। ও ওটা নিয়ে কী করতে হয় বুঝতে পারল না। ভাবল, খেলনা বুঝি।

আমি ডাকলাম মানুষটাকে, এই যে শুনছ! শুনছ গো।

আমার ডাকেও উঠল না মানুষটা। বাচ্চাটা তার মায়ের বুকে আঁচড়াতে মেয়েটি চোখ খুলল। চোখ খুলে আমাকে দেখেও বুক ঢাকার চেষ্টা করল না। আমার মনে হল, ওদের খিদেরই মতো লজ্জাও অপেক্ষা করে করে মরে গেছে বহুদিন আগে। এসব লজ্জাটজ্জার বায়ুয়ানি ওদরে জন্যে নয়।

মেয়েটি কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল আমার আর শ্রীর দিকে। তারপর কনুই দিয়ে ঠেলা মারল প্রায় মৃত মানুষটাকে।

মানুষটা উঠে বসল। মুখে একটা আতঙ্কের ভাব ফুটে উঠল।

বলল, বাবু কিছু বলছেন?

তারপরই বলল, আমরা একটু পরই এখান থেকে সরে যাব, আপনাদের দাঁড়াতে অসুবিধা হবে না। দোষ করেছি বাবু?

মনে মনে বললাম, দোষ তো করেইছ। অনেক দোষ। অনেকরকম দোষ।

মুখে বললাম, বন্যায় কী সবই ভেসে গেছে তোমাদের?

লোকটা অবাক চোখে চেয়ে বলল, বন্যা?

মেয়েটি বলল, না তো!

শুধোলাম তোমার বাড়ি কোথায়?

লোকটা বলল, নীকান্তপুর।

অবাক হলাম। লক্ষ্মীকান্তপুর? সে তো কাছেই। সেখানে আবার বন্যা কীসের?

লোকটা আরো ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে রইল। বলল, আমি তো বন্যার কথা বলিনি। বাবু।

আমি আবার শুধোলাম, তুমি কলকাতায় কতদিন?

তা বছরখানেক।

বছরখানেক? কী করো তুমি?

কাগজ কুড়োই।

কোথায় থাক?

এখানেই। রাতে বৃষ্টি বাদলের জন্যে এখানে শুই। দিনে কাগজ কুড়োই।

খাও-দাও কোথায়?

মানুষটা বলল, ওই পার্কের মধ্যেই সন্ধ্যের পর মাটির হাঁড়িতে কিছু ফুটিয়ে নিয়ে খাই।

এক বেলাই খাও?

এক বেলা জুটলেই কত!

মাসিমা মেসোমশায়ের জন্যে একটু মিষ্টি কিনে নিয়ে যাব বলে দশটা টাকা বেশি এনেছিলাম। ওদের দিয়ে বললাম, তোমরা আজ ভালো করে খাও। আজ পুজোর দিন।

আমার অবস্থানুযায়ী এই বড়োলোকি বেমানান হল, বুঝলাম। কিন্তু না ভেবেই, টাকাটা দিয়ে দিলাম।

মেয়েটাও উঠে বসল। এমনকী বাচ্চাটাও। ওরা তিনজনে এমন করে আমার ও শ্রীর মুখের দিকে চেয়ে রইল যে, কী বলব। লজ্জায়, দুঃখে হতাশায় আমার মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছা করল।

শ্ৰী উত্তেজিত গলায় বলল, তোমরা আমার বাবাকে কী দেখছ? অমন করে?

মানুষটা আমাকে বলল, তোমার মুখটা দেকতিছি বাবু। আজ পুজোর দিনে ভগবানের দর্শন পেনু। মুখটা চিনে রাতিচি। যদি পারি তো কোনোদিন এই ঋণ শুধব। ঠাকুর তোমার মঙ্গল…।

লজ্জায় দাঁড়ালাম না।

কী বলব, ভেবে না পেয়ে বললাম, চলি।

শ্রী বলল, আমার দেখাদেখি, চলি।

মানুষটার কথা শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এ তবে বন্যার্ত নয়? বন্যার্তরা আসেনি এখনও কেউ? পৌছোতে পারেনি? এ যে কলকাতারই বাসিন্দা। এরই এই দশা। এ তো মাত্র একজন। কত আছে এ রকম! ফুটপাথের মানুষ-এ। এইই এর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। বড়োলোক। কলকাতার গর্ব গড়িয়াহাটের মোড়ের দু-শো গজের মধ্যে এমন করেই ওরা বেঁচে থাকে। ভিক্ষা চায় না, দয়া চায় না কারোর। পটল, পটলের বাবা অথবা রাজীবের, এমনকী আমার মতো নগণ্যজনেরও করুণা চায় না। ওরা শুধু বেঁচে থাকতে চায়, পরিশ্রমের বিনিময়ে।

চলতে চলতে ভাবছিলাম, এই দারুণ শহরে আটাত্তরের বন্যাপীড়িত, ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়া আপনজন হারানো মানুষগুলো এসে পড়লে তাদের অবস্থাটা কী হবে?

বড়ো মাসিমা আমাকে আর শ্রীকে দেখে খুব খুশি হলেন। দিল্লি থেকে অনেকদিন পর এবারে এসেছেন আমার মাসতুতো দাদার ওখানে।

বড়ো মেলোমশাই বললেন, ও কেরে কালু? রানির মেয়ে?

আমি বললাম, না। ও আমার মেয়ে!

ওঃ। তোর মেয়ে? কী যেন নাম? শ্রী না?

তারপর বললেন, চোখে কিছু দেখি না আজকাল। ক্যাটারাকট ফর্ম করছে।

বড়োমাসিমা বললেন, এ পাড়াতে খুব জাঁকজমকের পুজো। সুন্দর ঠাকুর। দেখে যা।

নাঃ থাক। পথেই দেখলাম ঠাকুর।

মাসিমা মিষ্টি খাওয়ালেন জোর করে। বললেন, তোর মাকে বলিস, নবমীর দিন সারাদিন তোদের ওখানে গিয়ে থাকব।

খুব ভালো হবে। মা সবসময়ই আপনাদের কথা বলছেন।

মাসিমা বললেন, অনুকে বলিস যে, বড়ো বড়ো কই আনাতে। তেই-কই খাব।

বললাম, আচ্ছা।

ভাবলাম, বড়ো কই কতদিন আমরা নিজেরাই চোখে দেখিনি। তবে মায়ের আনন্দের জন্যে যে করে হোক মাসিমা মেলোমশায়ের জন্যে অন্তত জোগাড় করতে হবেই।

একটু পর উঠলাম শ্রীকে নিয়ে। বেলা বাড়ছে। রোদ কড়া হচ্ছে ক্রমশ।

পথে নেমেই শ্রী বলল, ক্যাটারাকট মানে কী বাবা?

ছানি।

ছানি কী বাবা?

বললাম, চোখের উপরে সরের মতো পর্দা পড়ে যায়, চোখে আর দেখা যায় না।

শ্রী বলল কই? মেসো-দাদুর চোখ তো ঠিকই আছে দেখলাম।

আমি একটু চুপ করে রইলাম।

তারপর বললাম, বাইরে থেকে দেখে তাই-ই মনে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *