ছাতা আর গামছার মাল্টিপারপাস ব্যবহার
রবিবারের বিকেলে মিত্তির ডাক্তারের বাড়িতে একটা আড্ডা বসে। আজকাল নতুন নিয়ম হয়েছে, রবিবার চেম্বার বন্ধ। রুগি দেখা হবে না। রবিবার যে খাবি খাবে, সোমবার সে ডেথ সার্টিফিকেট পাবে। নাকি ডাক্তারবাবুরা শহরের বাইরে উদ্যানবাটী রচনা করেছেন। শনিবার বিকেলে শেষ রুগিকে বিদায় করে এ/ সি গাড়িতে ফুড়ুড় ফুড়ুড়। বাগানে গাড়ি ঢোকামাত্রই জেনারেটর। ভটভট। কুকুরও অক্সিজেন নিতে যায়।
সকালে সহস্তে পেঁপে গাছের পরিচর্যা। পুঁইশাকের পাতা চেক। করলার ভারমাটাইটিস। লাল নটের অ্যানিমিয়া। লাউগাছের মিসক্যারেজ। ফুল হচ্ছে ফল হচ্ছে না, উদ্যানচর্চার পর সাহিত্যচর্চা। উগ্র প্রেমের লতানে কবিতা। একটা বই ‘অলরেডি’ বেরিয়ে গিয়েছে। বত্রিশ পাতার বই। তিন ইঞ্চি পুরু মোটা দুটো মলাট।
দ্বিতীয়টি যন্ত্রস্থ। জীবন যন্ত্রণার কাব্যরূপ। একটি উদাহরণ,
প্রদাহের দাহ, ফুসফুসে ফাইমোসিস
হৃদয়ে এনজাইনাপেকটেরিস
ফুটো পাকস্থলী রক্তমুখী একডজন আলসার
অনুপম, খালি পেটে সাজাও অক্ষরের মালা
বিউটি পারলারে শুয়ে থাক অনুপমা।
মিত্তিরের এসব ব্যামো নেই। কলকাতার বাইরে প্রচুর সম্পত্তি ছিল। কেয়ারটেকারদের কেয়ারে চলে গিয়েছে। খেতে আর খাওয়াতে ভালোবাসে। ভুঁড়িতে বেল্ট বেঁধে বাইশটা ল্যাংড়া এক সিটিং-এ। মিত্তিরের থিওরি হল, বাড়তে না দিলেই বাড়বে না, যেমন ঝগড়া, তেমনই ভুঁড়ি। অনেকদিন পরে প্রমোদ এল। আমরা নাম রেখেছি, মিস্টার অ্যাংজাইটি। আশুকে জিগ্যেস করলে, ‘কাল ওটা কী কিনলে? ঘি?’
‘ঠিক দেখেছ। প্রথম পাতে গরম ভাতে দু-চামচে ঘি, সে যে কী স্বাদ!’
‘খাট আর কাঠ দুটোরই ব্যবস্থা রাখো। যে-কোনও দিন যে-কোনও সময় থেমে যাবে।’
‘কী থামবে?’
‘হার্ট। এ বয়সে ঘি, তেল, নুন, ঝাল, টক, মিষ্টি খাবে না, স্পর্শ করবে না। তাকাবে না।’
‘তা হলে খাব কী?’
‘কত কী খাওয়ার আছে?’
‘ভাই! গালাগাল ছাড়া কিছুই খাওয়ার নেই। ভালোবেসে যাকে বিয়ে করলুম, এনেছিলুম বাইশ কেজি। এখন সলিড বাহাত্তর কেজি। ডবল খাটে আগে হেসেখেলে একটা পাশবালিশ নিয়ে শুতে পারতুম। এখন তিনি শুয়েই বলেন, একটু সরে শোও। আমি সারারাত কার্নিসে ঝুলে থাকার মতো ঝুলে থাকি। পরের জন্মে সিওর রাজমিস্তিরি হব। হাত ধরে না তুললে উঠতে পারে না, আমাকে বলে বুড়ো ভাম।’
প্রমোদ কান্তিকে জিগ্যেস করলে, ‘সেফটিপিন দিয়ে দাঁত খোঁটবার অভ্যাসটা কবে থেকে হল?’
‘মানে! দাঁতই নেই তো দাঁত খোঁচানো। আমার তো ফলস টিথ।’
‘তা হলে সেফটিপিন কিনলে কেন?’
‘বাড়ির হুকুম।’
‘রেডি থাকো। সেপটিক হল বলে।’
‘আজকাল তো টুথপিক বেরিয়ে গিয়েছে। তা হলে সেফটিপিন দিয়ে খোঁচাবে কেন?’ প্রমোদ মুখভঙ্গি করে বললে, ‘মেয়েদের তুমি কতটুকু চেনো? হাতের ঠ্যালা দিলেই তো একটা লোক ঘুম থেকে উঠতে পারে, তা হলে আমার বউ কেন লম্বা একটা ছাতার বাঁট দিয়ে পিঠে গ্যাঁত করে গোঁত্তা মারে? কেন মারে?’
আমাদের সকলেরই সমবেত প্রশ্ন, ‘কেন মারেন?’
‘পুরোনো কালের লম্বা ছাতা, ওটা যাতে ব্যবহার থাকে। ওটার নতুন নাম হয়েছে, ‘জাগরণ দণ্ড। সেকালের পাওনাদারদের হাতে ওই ছাতারই নাম হত ‘আকর্ষণ দণ্ড। দেনাদার পালাচ্ছে, পেছন দিক থেকে গলায় বাঁকানো হাতলটি ফিট করে দাও। তারপর হিন্দি ভাষায়, খিঁচকে চিৎপাত। ছাতা আর গামছার মাল্টিপারপাস ব্যবহার।’
গামছা নিজের গলায় দিয়ে ঝুলে পড়ো। গামছা তখন গুরু, ভবসাগর তারণ কারণ হে। গামছা অন্যের গলায় দিয়ে মারো টান। গামছা গলায় দিয়ে পাওনা আদায়। পুরোহিত মশাইয়ের সঙ্গে থাকে পুরোহিত দর্পণ ও একটি গামছা। গামছা ইজ মোর ইম্পর্ট্যান্ট দ্যান দর্পণ। সব হয়ে যাওয়ার পর ওই গামছায় বাঁধা হবে যাবতীয় চাল, কলা নৈবেদ্য। পুরোহিত মশাইকে জিগ্যেস করলুম, একটু আগে পা মুছলেন, সেই গামছায় এইসব বাঁধলেন? উত্তর হল, ‘আরে এত সব ভগবানের উচ্ছিষ্ট। সারভাগ তো তিনি টেনে নিয়েছেন। এ হল ছিবড়ে।’ তুমি তোয়ালে কাঁধে পুরোহিত দেখতে পাবে না, পুজোয়-শ্রাদ্ধে তোয়ালে দিলে চলবে না। গামছা। সোনার ঘটেও ডাবের ওপর ভাঁজ করা লাল গামছা। গামছা হল আধ্যাত্মিক বস্তু। স্বর্গের দেবতারা আর আমাদের পূর্বপুরুষেরা সব গামছা পরে ঘুরে বেড়ান। হিন্দিতে কথা বলেন, আর খইনি খেয়ে পিচ পিচ থুতু ফেলেন, সেই থুতুই হল বৃষ্টি। সেকালের কর্তাদের দেখেছি। গামছা দিয়ে নিজের পা মুছতে মুছতে সোহাগ করে ঘোমটা তুলে বউয়ের চোখ মোছাতে মোছাতে বলছে, ‘ক্ষেমু কেঁদো না, কেঁদো না। বুড়িটাকে আমি পরের ডাকেই বেন্দাবন পাঠাছি।’ সেকালে সব নাম হত ক্ষেমঙ্করী, প্রলয়ঙ্করী, ভয়ঙ্করী। দেখো, দুটো পেটাই আছে, ঝাঁটা পেটা, ছাতা পেটা। আর জমিদারের জুতো পেটা। সে জুতোও নেই, সে ছাতাও নেই। এখন সব ‘লিপস্টিক ছাতা।’ ঠোঁটের রঙে রং মিলিয়ে ছাতার রং। শোনো, সেকালে মেয়েরা কাঁদতে আসত, একালে আসে কাঁদাতে।