ছত্র বর্ধন
জ্ঞান বর্ধন
এ গল্প পাঠ করে নায়কের নাম কেউ যদি দেন ছত্র বর্ধন, আপত্তি করা যাবে না। জ্ঞান বর্ধন তাঁর আসল নাম, এরকম একটা নাম অবশ্য সচরাচর দেখা যায় না।
ভদ্রলোকের নামের প্রথমাংশের পুরোটা যে কী জ্ঞানব্রত না জ্ঞানেন্দ্রনাথ, নাকি অন্য কিছু, সে বিষয়ে কোনও খোঁজখবর নিইনি। কারণ এখন তাকে ছত্র বর্ধন বলাই উচিত।
সে যা হোক, জ্ঞান বর্ধন এক ভদ্রলোকের পুরো নাম। ভদ্রলোক আবার জীবন যাপন করেন ছাতা সংগ্রহ করে। তিনি তার জীবনের প্রথম ছাতাটি উপহার পেয়েছিলেন। তার বিদায় সংবর্ধনা সভায়। এবং দুঃখের বিষয়, সেই ছাতাটি তিনি সেই দিনই বাড়ি ফেরার পথে বাসে হারিয়ে ফেলেন।
তারপর থেকে জ্ঞানবাবু সর্বত্র তার সেই হারানো ছাতাটিকে খুঁজে যাচ্ছেন এবং এই কাজেই তার অবসর জীবন ব্যয় করছেন।
অবশ্য হারানো ছাতাটি না পাওয়ায় সে স্থানে অন্য যে কোনও ছাতাই, সম্ভব হলে, সংগ্রহ করা তার এখন একমাত্র কাজ।
একটু পেছন থেকে বলি। জ্ঞান বর্ধন লেখাপড়া জানা লোক। কলকাতায় কলেজে অধ্যাপনা করতেন তিনি, তার বিষয় ছিল দর্শন শাস্ত্র। কিন্তু তার ছাত্র সংখ্যা যখন কমতে কমতে প্রায় শূন্যে গিয়ে দাঁড়াল, তিনি অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে দিলেন, নেহাতই আত্মসম্মান বোধ থেকে।
এই ছাত্র কমতির ব্যাপারে জ্ঞানবাবুর ব্যক্তিগত কোনও ত্রুটি ছিল না। বরং তিনি খুব মনোযোগী এবং ছাত্রপ্রিয় অধ্যাপক ছিলেন। ফাঁকি-টাকি দেওয়া তিনি মোটে জানতেন না। ছাত্রদের ভালবেসে তিনি পড়াতেন, ছাত্ররা তাকে ভালবাসত।
কিন্তু দেশ থেকে দর্শন পড়ার চল উঠে গেল। খারাপ-ভাল সব ছাত্র-ছাত্রীই এখন বিজ্ঞান পড়তে চায়। বিজ্ঞান, এঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি নিদেন পক্ষে অর্থনীতি, পরিসংখ্যান বা রাষ্ট্রনীতি।
আগে তবু দু-চারজন করে ছাত্র হচ্ছিল ক্লাসে, কিন্তু শেষে একেবারে কমে গেল। জ্ঞানবাবুর অবশ্য পাকা চাকরি, ছাত্র না থাকলেও তার চাকরি যেত না। কিন্তু জ্ঞানবাবু একটু খামখেয়ালি মানুষ। দর্শনের অধ্যাপকেরা এমন হয়। তিনি বিনা কাজের, বিনা পরিশ্রমের এই চাকরি একদিন ধুত্তোরি বলে ছেড়ে দিলেন। তখন তাঁর সাতচল্লিশ বছর বয়েস।
এটা পাঁচ বছর আগের কথা। এখন জ্ঞানবাবুর বয়েস বাহান্ন। জ্ঞানবাবু বলেন, তিপান্ন, যা বাহান্ন তাহা তিপান্ন।
তা, অবসর গ্রহণ করার পরে, বিশেষত জীবনের প্রথম ছাতাটি প্রথম দিনেই হস্তচ্যুত হয়ে যাওয়ার পর থেকে, যেন-তেন প্রকারে ছাতা সংগ্রহ করা প্রাক্তন অধ্যাপক জ্ঞান বর্ধনের জীবনের ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
০২. খেপিপিসি
জ্ঞানবাবুর অবশ্য চাকরি ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে কোনও ঝুঁকি ছিল না। তিনি সংসারী মানুষ নন, বিয়ে-থা করেননি। তিন কুলে তার একমাত্র বুড়ি পিসিমা ছাড়া কেউ নেই।
বুড়ি পিসির নাম খেপি। ছোটবেলা থেকেই তিনি খ্যাপাখ্যাপা। কবে নাবালিকা বয়েসে বিয়ে হয়েছিল, কবে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিধবা হয়ে পিত্রালয়ে, মানে জ্ঞানবাবুদের এই কঁকুড়গাছির পুরনো বাড়িতে, চলে এসেছিলেন সেসব ইতিহাসের বিষয়। তারপর একটা মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে। মন্বন্তর, দেশভাগ কত কী।
খেপিপিসি চার ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন অগ্রজা। জ্ঞানবাবুর বাবা নগেন্দ্র বর্ধন খেপিপিসির থেকে মাত্র এক বছর ছোট ছিলেন। খেপিপিসি ছাড়া এখন আর কেউ বেঁচে নেই।
বছর তিরিশের আগে নগেনবাবু একবার কী একটা কাজে দিল্লি গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি এক পথ-দুর্ঘটনায় মারা যান।
এর অনেক আগেই অবশ্য জ্ঞানবাবুর মা মারা গিয়েছেন। বাবা-মা দুজনেই মারা যাওয়ার পরে একমাত্র ওই খেপিপিসি ছাড়া জ্ঞানবাবুর নিজের বলতে কেউ রইল না।
এদিকে হয়েছে কী, নগেনবাবু যে মারা গেছেন, এ কথা খেপিপিসি কোনও দিনই বিশ্বাস করেননি। তিনি মনে করেন তার ভাই নগেন এখনও বেঁচে আছেন।
সম্প্রতি বছর দশেক খেপিপিসি ভাইপো জ্ঞানকেই তাঁর ভাই নগেন বলে ভাবেন। জ্ঞানবাবুর সঙ্গে কথা বলতে হলে পিসি তাঁকে নগেন নামেই সম্বোধন করেন।
প্রথম প্রথম জ্ঞানবাবু পিসিকে অনেক রকম বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, পিসি আমি কিন্তু বাবা নই। আমি হলাম জ্ঞান, তোমার ভাইপো। বাবা ছিল নো জ্ঞান, অর্থাৎ জ্ঞান নয়, নগেন।
তারপর একটু থেমে পিসিকে বলেছেন, পিসি, তুমি ইংরেজি জানো তো? নো মানে জানো তো?
খেপিপিসি হেসে ফেলেছেন, বলেছেন, তুই কী যে বলিস নগেন, আমি আর তুই এক সঙ্গে লিচুতলার ইস্কুলে পড়েছি, তোর মনে নেই? সেই যে শ্যাম মাস্টার, ইয়া গোঁফ, নাক ভরতি নস্যি, মুখ ভরতি দোক্তাপান।
জ্ঞানবাবু প্রতিবাদ করেছেন, আমি তোমার ভাই নগেন নই। আমি কোনও শ্যাম মাস্টারের কাছে। কখনও পড়িনি। আমি প্রথম থেকে হেয়ার স্কুলে পড়েছি।
খেপিপিসি বলেছেন, তোর কিছুই মনে নেই নগেন। এই তো সেই সেদিনের কথা আমি, তুই, বিন্দু, মধু সবাই মিলে শেলেটবই নিয়ে লিচুতলায় শ্যাম মাস্টারের ইস্কুলে যেতাম। ওই যে ইয়েস-নো কী বললি, তার চেয়ে অনেক বেশি–বি-এল-এ ব্লে, সি-এল-এ ক্লে, তারপর বি-আই-টি-ই বাইট, সি-আই-টি-ই সাইট, কে-আই-টি-ই কাইট কত কঠিন কঠিন ইংরেজি পড়েছি।
এবার একটু ভেবে নিয়ে খেপিপিসি বললেন, সত্যি তোর কিছু মনে নেই নগেন? সব কিছু ভুলে গেছিস, আচ্ছা বল তো, রাস্তায় একটি খোঁড়া লোকের সঙ্গে আমার দেখা হইয়াছিল, ইংরেজি কী?
জ্ঞানবাবু রেগে গেলেন, এসব আমি ঢের জানি। প্যারীচরণ সরকারের ফাস্ট বুক, সেকেন্ড বুক আমিও পড়েছি। কিন্তু একটা কথা আমি শেষবারের মতো তোমাকে বলছি, আমি তোমার ভাই নগেন নই। আমি জ্ঞান, তোমার ভাইপো।
এ কথা শুনে খেপিপিসি হেসে ফেললেন, জ্ঞান আসবে কোথা থেকে? সে তো বিলেত গেছে মেম বিয়ে করার জন্যে।
জ্ঞানবাবু রাগ করতে পারেন না। খেপিপিসির এ কথাটা অর্ধেক সত্যি। এম.এ. পাশ করার পরে ভাল স্কলারশিপ পেয়ে চার বছর বিলেতে গবেষণা করেছেন তিনি, কিন্তু মেম বিয়ে করেননি।
জ্ঞানবাবুর মনে আছে, তিনি যখন বিলেত থেকে ফিরেছিলেন, তখন খেপিপিসি সানিপাতিক জ্বরে প্রলাপ বকছেন। তার ফিরে আসার কথা খেপিপিসির স্মৃতিতে কোনও রকম দাগ কাটেনি।
সে যাই হোক, জ্ঞান-নগেনের অসম লড়াইতে বহুবার রণে ভঙ্গ দিয়ে জ্ঞানবাবু খেপিপিসির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। আজকাল আর পিসি তাঁকে নগেন বলে ডাকলে তিনি বিশেষ প্রতিবাদ করেন না।
০৩. ছত্র বর্ধন
হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দিতে গেলে অনেকে অসুবিধেয় পড়ে, আর্থিক টানাটানি দেখা দেয়। কিন্তু জ্ঞানবাবুর কোনও অসুবিধেই হয়নি। প্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদিতে কলেজ থেকে কিছু নগদ টাকা। পেয়েছিলেন। পেনশন পাননি, শুনেছেন পাবেন, অবশ্য তা নিয়ে জ্ঞানবাবু মোটেই মাথা ঘামান না।
কাঁকুড়গাছিতে পুরনো বাংলা ইটের ভাঙা দেয়াল দিয়ে ঘেরা তাদের প্রাচীন বসতবাটি। সে। বাড়িতে একতলা, দোতলায় সামনের দিকে ঘরে ঘরে ভাড়াটে। পেছনের দিকে দোতলায় জ্ঞানবাবু থাকেন, একতলায় থাকেন খেপিপিসি। সামনের দিকের আট-দশ ঘর ভাড়াটে কম-বেশি যা ভাড়া দেয় তাতেই পিসি-ভাইপোর মোটামুটি চলে যায়।
বাড়িটা পুরনোকালের। খাট পালঙ্ক, চেয়ার-আলমারি, কাঁসা পিতলের বাসন-কোসন, বেলজিয়াম গ্লাসের দামি আয়না, এসবও অনেক। কিন্তু সেসব ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে, চুরি হয়ে গেছে।
এ বাড়ির সামনে আর পিছনে কয়েকটা থাম বাঁধানো গাছ আছে। কয়েকটা সুপুরি গাছ, দুটো নারকেল গাছ। পুরনোকালের একটা আমলকী গাছ আকাশ ছাড়িয়ে উঠে গেছে।
এসব ছাড়াও চিলেকোঠা ঘরে আছে খারাপ-ভাল, আস্ত-ভাঙা চৌত্রিশটা ছাতা। এর মধ্যে তেইশটা ছাতা পুরুষদের, যাকে বলে জেন্টস ছাতা। আটটা লেডিস ছাতা। আর তিনটে কমন ছাতা, পুরুষ-মহিলা যে কারও হতে পারে। এসব ছাড়াও আরও গোটা পাঁচেক বেবি ছাতা আছে, রং-বেরঙের, যেগুলো এই হিসেবে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি।
এত সব ছাতার মধ্যে একটা রয়েছে ট্রাফিক কনস্টেবলের ছাতা, উপরে সাদা, নীচে কালো, দুরকম কাপড় লাগানো আছে। এ ছাতাটি যখন সংগ্রহ করেন সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে জ্ঞানবাবুর। মাত্র দুবছর আগের কথা।
চৈত্রের শেষ৷ গনগনে গরমে কলকাতা জ্বলছে। বাতাসে পিচ গলার গন্ধ। তখন বিকেল প্রায় পাঁচটা।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন জ্ঞানবাবু। পড়াশুনো করা যতটা উদ্দেশ্য তার চেয়ে বেশি উদ্দেশ্য হল ছাতা হাতানো।
ছাতা হাতানোর পক্ষে পাঠাগার, সভাকক্ষ, চায়ের দোকান খুব সুন্দর জায়গা। বৃষ্টির দিনে বিয়েবাড়ি বা শ্রাদ্ধবাসরেও উটকো ছাতা পাওয়া যায়।
কিন্তু আজ ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরি ঘর থেকে বিফল মনমরা হয়ে জ্ঞান বর্ধন বেরিয়ে এলেন। কী রকম সাংঘাতিক বুদ্ধি করেছে লাইব্রেরি, এখন আর ছাতা, ব্যাগ ইত্যাদি পাঠাগারের ভেতর নিয়ে যাওয়া যায় না। গেটের পাশে দারোয়ানের ছোট কাঠের ঘরে জমা রেখে যেতে হয়, তার বদলে টোকেন দেয়, ফিরে যাওয়ার সময়ে টোকেন দিয়ে জিনিসপত্র ফেরত নিতে হয়।
অনেকক্ষণ লোলুপ দৃষ্টিতে দারোয়ানের ঘরের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন অধ্যাপক জ্ঞান বর্ধন। কত সুন্দর, কত বাহারি সব ছাতা। কিন্তু তার নিজের কোনও টোকেন নেই, এই একটি ছাতাও তার নয়।
রগচটা গরম ছিল সারাদিন। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে থিয়েটার রোডে তিনি দেখলেন আকাশ কেমন যেন আধা কালো৷ সূর্য কিংবা রোদ স্পষ্ট নয়, কিন্তু উত্তাপ এখনও খুব চড়া, কেমন ধোঁয়াটে চারধার, শীতের সকালের মতো।
জ্ঞানবাবু অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি জানেন, এ হল ঝড়ের পূর্বাভাস। তিনি দ্রুতপদে পশ্চিম মুখে হাঁটতে লাগলেন। চৌরঙ্গি আর থিয়েটার রোডের মোড় পেরোলে বিড়লা তারাঘরের সামনে বাস স্টপ, সেখান থেকে কাঁকুড়গাছির মিনিবাস পাওয়া যাবে। বাড়ি ফিরতে দেরি করলে চলবে না, সন্ধ্যা হয়ে গেলে খেপিপিসি উথাল পাতাল করেন।
বাসস্টপে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে ঝড়টা হইহই করে এসে গেল। প্রচণ্ড বেগে দমকা হাওয়া আর সেই সঙ্গে ধুলোবালি, ঝরা পাতা। ফুটপাথের পাশে পর পর কয়েকটা বাদাম গাছ আছে, তারই আড়ালে আশ্রয় নিলেন জ্ঞানবাবু।
ঠিক এই সময়েই তিনি দেখলেন বিড়লা তারাঘরের সামনে ট্র্যাফিক স্ট্যান্ডের কনস্টেবলের ছাতাটা তার হাত থেকে ছিটকিয়ে হাওয়ায় উড়ে মধ্য ময়দানের দিকে ভো-কাটা-ভো ঘুড়ির মতো চলে গেল।
বাতাসের তোড় দেখে কনস্টেবল ভদ্রলোক ছাতাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন, সেই সময়েই এই দুর্ঘটনা। প্রথমে তিনি টের পেলেন না ছাতাটা ঠিক কোন দিকে উড়ে গেল। ভ্যা বাঁচাকা খেয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন।
বাদাম গাছের আশ্রয় থেকে জ্ঞানবাবু ছাতাটাকে লক্ষ রাখছিলেন। কোনাকুনি ভাবে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে ছাতাটা উড়ে যাচ্ছে।
আর দেরি করলেন না তিনি। ঝড়ের বেগ একটু কমে এসেছে। সামনে নালাটা এক লাফে পার হয়ে, এ বয়েসে ঝোড়ো হাওয়ায় যতটা জোরে ছোটা যায় ঠিক ততটা জোরে ছাতাটার পশ্চাদ্ধাবন করলেন। খুব বেশি দূর যেতে হল না, দেখা গেল কিছু দূরে ছাতাটা মাঠের মধ্যে মুখ থুবড়িয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে ছুটতে অসুবিধে হচ্ছিল, দুয়েকবার হুমড়ি খেয়ে পড়েও গিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাতাটা ধরতে পেরেছিলেন।
একটু পরে ঝরঝর করে বৃষ্টি এল, ছাতাটা পেয়ে জ্ঞানবাবুর খুবই উপকার হয়েছিল। ছাতাটা মাথায় দিয়ে রেড রোডে একবার হাত তুলতেই পর পর তিনটে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে গেল, সবাই ভেবেছে তিনি কোনও ট্রাফিক কনস্টেবল।
সে যা হোক, প্রথম ট্যাক্সিতে চড়ে তিনি যখন কাঁকুড়গাছি পৌঁছালেন সে বেচারি ট্যাক্সিওলা কিছুতেই ভাড়া নিতে চায় না।
০৪. বিবরণী
জ্ঞানবাবুর সংগৃহীত প্রতিটি ছাতার পেছনে এই রকম রোমাঞ্চকর ইতিহাস আছে।
তিনি ছাতা সংগ্রহ করেননি এমন জায়গা এই শহরে বিরল। তিনি বৃষ্টি ভেজা বড়দিনের মধ্যরাতে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালের উপাসনাগৃহ থেকে ছাতা সরিয়েছেন। মহামান্য হাইকোর্টের বিচারকদের প্রবেশপথ থেকে, রাজভবনের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান থেকে, এমনকী লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কর্তার চেম্বারের সামনের অফিস ঘর থেকে ছাতা সংগ্রহ করেছেন।
প্রতিটি ছাতার গায়ে আলপিন দিয়ে ছোট ছোট কাগজের স্লিপ লাগানো আছে। সেই সব স্লিপগুলিতে কবে, কীভাবে ছাতাগুলি সংগৃহীত হয়েছে এবং সম্ভব হলে পূর্বতন মালিকের নাম ঠিকানা ইত্যাদি লেখা আছে।
দুয়েকটি উদাহরণ হিসেবে দেখা যাক,
(এক) তালিকা নং লেডিস-৭
লেডিস ছাতা। পুরনো বিলিতি জিনিস। ২৪ শে ডিসেম্বর ১৯৯৬, রাত বারোটা, সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল থেকে সংগৃহীত। সম্ভবত কোনও বুড়ি মেমসাহেবের ছাতা।
(দুই) তালিকা নং জেন্টস-২০
জেন্টস ছাতা, প্রায় নতুন, মাঝারি মানের। ২৭শে মার্চ ১৯৯৬, দুপুরবেলা লালবাজার গোয়েন্দা দপ্তর থেকে সংগৃহীত। মালিক পিক-পকেট সেকশনের বড়বাবু।
এই রকম সব বিবরণ। এত সংক্ষেপে সব কিছু জানা যায় না, যেমন লালবাজার থেকে চুরি করে আনা ছাতাটি।
সেবার এক মাসের মধ্যে পর পর তিন বার পকেটমার গেল জ্ঞানবাবুর। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন, ট্রামে, বাসে সারা শহরে চক্কর দেন। উদ্দেশ্য একটাই, যদি কেউ কখনও ভুলে গাড়ির মধ্যে ছাতা ফেলে নেমে যায় তবে তখনই সেটা হস্তগত করে পরের স্টপেজে নেমে যাওয়া।
কিন্তু সে বার ওই এক মাসে একটিও ছাতা সংগ্রহ করতে পারলেন না, অথচ তিন বার পকেট মারা গেল। শেষ বার যখন পকেট মারা গেল ঠিক লালবাজারের সামনে বাস থেকে নামার সময়, জ্ঞানবাবু সরাসরি লালাবাজারের মধ্যে ঢুকে গেলেন।
তারপর একে ওকে জিজ্ঞাসা করে, দুয়েকটা বাধা পেরিয়ে সরাসরি গোয়েন্দা প্রধানের ঘরে।
গোয়েন্দা প্রধান যখন শুনলেন যে জ্ঞানবাবু একজন প্রাক্তন অধ্যাপক, তিনি তাকে যথেষ্ট খাতির। করলেন। এবং যখন শুনলেন যে এক মাসের মধ্যে তিনবার পকেটমারি হয়েছে যথেষ্ট সহানুভূতি জানালেন, তারপর বেল বাজিয়ে সেপাইকে ডেকে বললেন, ওই যিনি পিকপকেট করেন, তাঁকে একটু ডাকো।
পিকপকেট করার লোক লালবাজারের মধ্যেই রয়েছে এটা জেনে জ্ঞানবাবু স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কী অবস্থা হয়েছে দেশের!
একটু পরে প্যান্ট হাওয়াই শার্ট পরা এক মধ্যবয়েসি ভদ্রলোক এলেন। তিনি পিকপকেট করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য পরিষ্কার হল ব্যাপারটা, ইনি পিকপকেট করেন মানে ইনি পিকপকেট শাখায় ভারপ্রাপ্ত অফিসার।
গোয়েন্দা প্রধান অফিসারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতেই জ্ঞানবাবু বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে, তাকে বলা হল পিকপকেট সেকশনে অপেক্ষা করতে। সামনেই বড় ঘরের একপাশে পিকপকেট সেকশন। ঘর প্রায় খালি, শুধু দরজার পাশে দুজন রোগা, কালো, সন্দেহজনক চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আর সামনের টেবিলের পাশে কাঠের আলমারির গায় একটা ছাতা দাঁড় করানো রয়েছে।
বিন্দুমাত্র বিচার বিবেচনা না করে ছাতাটি শক্ত করে বাগিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন জ্ঞানবাবু।
চুলোয় যাক পকেটমার ধরা। সস্তার প্লাস্টিকের মানিব্যাগে ছিল তো মোট পাঁচ টাকা ষাট পয়সা। তার চেয়ে এই ছাতা ঢের ভাল।
০৫. সমাধান
এই রকম সব ঘটনার ফিরিস্তি লম্বা করে লাভ নেই। সে খুব একঘেয়ে হয়ে যাবে।
আসল কথা এই যে ছাতা সংগ্রহের রোমাঞ্চকর কাজটা ভালই উপভোগ করছিলেন জ্ঞানবাবু। অবসরের দিনগুলি শুয়ে বসে না কাটিয়ে মোটামুটি উত্তেজনার মধ্যে কাটিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি।
মাসে-দুমাসে একটা ছাতা সংগ্রহ করতে পারলেই হল। সব দিনেই ছাতা পাওয়া যাবে এমন কোনও কথা নেই। চাকরিতেও তাই, মাসে একদিন মাইনা হয়, কিন্তু কাজ করতে হয় সবদিনই।
সে যা হোক আজ বছর দুয়েক হল খুব মন্দা চলছে ছাতা সংগ্রহে।
লোকজন খুব সেয়ানা হয়ে গেছে। ছাতা ব্যাগের মধ্যে পুরে বাসে-মিনিবাসে যাতায়াত করে। শিশুরা বর্ষাতি পরে। তাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে চকলেট দিয়ে ছাতা হাতাবার সুযোগ নেই।
আজকাল প্রাণপণ প্রয়াস করেও একটা ছাতা দখলে আনা যায় না।
এই তো সেদিন হাতের মধ্য থেকে একটা ছাতা ফসকিয়ে গেল। সে আফসোস জ্ঞানবাবুর এখনও যায়নি।
ছাতার সন্ধানে সেদিন ফুলবাগানের মোড়ে ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে চতুর্দিকে খেয়াল রাখছিলেন। এই সময়ে একটা প্রাইভেট বাস থেকে নামতে গিয়ে একটা ভীষণ মোটামতন লোক চিৎপটাং হয়ে রাস্তায় পড়ে গেল। তাঁর হাতে ধরা একটা ছাতা ছিটকিয়ে কয়েক হাত দূরে চলে গেল।
মুহূর্তের মধ্যে তীব্র ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ছাতাটি তুলে নিয়ে জ্ঞানবাবু সামনের দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন।
কিন্তু কোনও লাভ হল না। ওই রকম মোটা মানুষ যে অমন দ্রুত ছুটতে পারেন সেটা ভাবা কঠিন। জনারণ্য ভেদ করে পর্বত প্রমাণ শরীর নিয়ে ভদ্রলোক ছুটে এসে জ্ঞানবাবুর পথ রোধ করে দাঁড়ালেন এবং বিনা বাক্যব্যয়ে এক ঝটকায় ছাতাটি কেড়ে নিলেন।
জ্ঞানবাবুর সেই প্রথম ধরা পড়া। এর পর থেকে তিনি মনমরা হয়ে আছেন। ছাতা সংগ্রহে উৎসাহ পাচ্ছেন না।
এদিকে কী করে অবসর জীবনের নিষ্কর্মা দিনগুলি কাটাবেন সেটা যেমন একটা বড় সমস্যা, তেমনিই আবার এই কয় বছরে ছাতা হাতানো একটা নেশার মতো হয়ে গেছে। অবশেষে অনেক ভেবে একটা সমাধান বের করেছেন জ্ঞানবাবু।
ছাতা সংগ্রহের কাজ এখনও চলবে। তবে বাড়ির বাইরে নয়। তাই বলে ভাড়াটেদের ছাতায় হাত দেবেন না। ধরা পড়লে, সে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।
এখন সম্বল খেপিপিসি। জ্ঞানবাবু খেপিপিসিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার ছাতা ছাড়া কষ্ট হয়।
পিসি অবাক, আমি তো বাড়ির মধ্যে থাকি। আমি ছাতা দিয়ে কী করব?
জ্ঞানবাবু বললেন, আজকালকার লোকে বাড়ির মধ্যেও ছাতা ব্যবহার করে, অনেক বাড়ির ছাদ দিয়ে এত জল পড়ে। আমাদেরও তো পুরনো বাড়ি। আমি তোমাকে একটা ছাতা কিনে দেব।
পিসি বললেন, তোর দোতলায় জল পড়তে পারে, আমার একতলায় তো জল পড়বে না। তা তুই যখন বলছিস, দিস। একটা ছাতা কিনে দিস।
বাজার থেকে ছাতা কিনে এনে পিসিকে দিয়ে জ্ঞানবাবু বললেন, খুব সাবধান। আজকাল চারদিকে খুব ছাতা চোর হঠাৎ নিয়ে না চলে যায়।
ছাতা পেয়ে খেপিপিসি খুব খুশি। বললেন, আমার কাছ থেকে ছাতা চুরি করবে এমন চোর এখনও জন্মায়নি। তারপর ছাতাটা খুলে জ্ঞানবাবু পিসির হাতে দিতে তিনি সেটা মাথায় দিয়ে বললেন, কী ভাল লাগছে ছাতা মাথায় দিয়ে, মনে হচ্ছে শ্যামামাস্টারের ইস্কুলে যাচ্ছি। আচ্ছা নগেন, তুই বলতো ছাতার ইংরেজি কী?
জ্ঞানবাবু যথারীতি প্রতিবাদ করলেন, আমি নগেন নই। আমি শ্যামামাস্টারের কাছে পড়িনি। আমি পড়েছি হেয়ার স্কুলে।
.
খেপিপিসি এখন আনন্দে ছাতা মাথায় দিয়ে উঠোনে পাক খাচ্ছেন, আর সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে জ্ঞান বর্ধন মনে মনে কৌশল করতে লাগলেন কত তাড়াতাড়ি পিসির ছাতা হস্তগত করা যায়। অবশ্য জ্ঞানবাবু ভাল লোক। পিসিকে বঞ্চিত রাখবেন না। একটা ছাতা সরাতে পারলেই, তাকে আরেকটা ছাতা কিনে দেবেন।