2 of 3

চৌকাঠে পা

চৌকাঠে পা

সুড়ঙ্গ দিয়ে ওপরে উঠে এল ওরা। ট্রাম থেকে নেমে হওড়া স্টেশনের ভেতরে ঢোকার রাস্তাটা জানত বনি। ওপাশ থেকে হুড়মুড়িয়ে লোক নামছে। নীপার বুকের ভেতরে এখন দমকলের ঘণ্টা। বাস থেকে নামার পরই এটা শুরু হয়ে গেছে। বনি বলল, তুই ওইরকম মুখ করেছিস কেন? যে দেখবে সেই বুঝবে। নীপা চেষ্টা করল অন্যরকম মুখ করতে। কিন্তু কীভাবে করতে হয় বুঝতে পারছিল না। ওর কেবলই মনে হচ্ছিল আশেপাশের যে-কোনও মানুষ হঠাৎ বলে উঠবেন, এই নীপা, তুই এখানে?

হাঁটতে-হাঁটতে বনি বলল, আমাদের ইউনিফর্মগুলো ছাড়তে হবে। কোথায় ছাড়ি বল তো?

নীপা ওর দিকে তাকাল, কেন?

বাঃ। স্কুলের ইউনিফর্ম দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে আমরা চলে এসেছি। তারপর থেমে গিয়ে চারপাশে তাকাল, আরও ওপরে। আমি আর বাড়িতে যাব না। কখনও না। রেজাল্ট। দেখলে মা আমাকে ঠিক মেরে ফেলবে। নীপা কিছু বলল না। গতকালই মিস বলে দিয়েছিল। কারা-কারা প্রমোশন পায়নি।

আজ রেজাল্ট কার্ড হাতে পেয়েও সেটাই জেনেছে। ফিজিক্স আর অঙ্কে ফেল। বাবা এটা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। বাবার সামনে ওই কার্ড নিয়ে দাঁড়ানো যায় না। মা হয়তো বকবে, হয়তো কাঁদবেও কিন্তু বাবা!বনি বলল, এসে গেছি। ওই যে বড় ঘড়ি, ওর নিচে দাঁড়িয়ে থাকবে ওরা।

দুজনের হাতেই কাজ করা চটের ঝোলানো ব্যাগ। ওতেই বই নিয়ে স্কুলে যায় ওরা। আজ তার তলায় লুকিয়ে আনা হয়েছে দুটো স্কার্ট, একটা তোয়ালে, টুথপেস্ট, ব্রাশ, হলদে চিরুনি আর কয়েকটা রুমাল। ওপরে খাতাপত্তর।

গতকাল রেজাল্ট কী হয়েছে জানার পরই এই সিদ্ধান্ত। একটু-একটু করে জমানো একশো সত্তরটা টাকা সঙ্গে এনেছে নীপা। এতদিনে সেটাকে অনেক টাকা বলে মনে হত তার। বনি বড় ঘড়ির তলায় দাঁড়িয়ে বলল, স্বপনটা চিরকাল লেট লতিফ। সেই সরস্বতী পুজোর সময় মনে আছে? আমাদের পনেরো মিনিট দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। স্বপন হল বনির বয়ফ্রেন্ড। যাদবপুরে পড়ে। সরস্বতী পুজোর সময় প্রোগ্রাম করেছিল বনি। সেই সময় অতীনের সঙ্গে আলাপ। সারাদিন চারজনে টইটই করে শহরটা ঘুরেছিল। যেসব জায়গায় বাবার যাওয়ার সম্ভবনা নেই, সেইখানে গিয়ে বসেছিল। এই যেমন ভিক্টোরিয়ায়। আর সেইখানে গিয়েই অতীন তাকে। বলেছিল, আই লাভ ইউ নীপা। আই অ্যাম ডায়িং ফর ইউ।

স্বপন বনিকে নিয়ে বসেছিল দূরের একটা গাছের তলায়। অতীন তার পাশে। প্রথম আলাপ, সঙ্গে-সঙ্গে নাকের ডগায় ঘাম জমেছিল। মুখে রক্ত। কোনওরকমে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন?

ইউ আর সামথিং! তুমি কি তা নিজেই জানোনা।

যাঃ। তুমি আমাকে চেনোই না, কখনও দ্যাখোনি।

শুনেছি। স্বপন বনির কাছে শুনে সব বলেছে। তা ছাড়া কাউকে চিনতে এক মুহূর্তই যথেষ্ট। তুমি আমাকে প্রমিস করো আর কাউকে ভালোবাসবে না? ওর হাত ধরেছিল অতীন। আর সঙ্গে-সঙ্গে চমকে উঠেছিল নীপা। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ঠোঁট কামড়েছিল, ভেবে দেখি। কিন্তু চোখের সামনে তখন বাবার মুখ। দু-বছর আগে বাবা তাকে জাড়িয়ে ধরে বলত, মা গো, একবার বলো, আর কাউকে ভালোবাসি না তোমাকে ছাড়া।

সেই কোন ছেলেবেলা থেকে এই অভ্যেস। বাবার গায়ের গন্ধ খুব ভালো লাগত তখন। ইদানীং বাবা এইভাবে আর জড়িয়ে ধরে না। তার শরীর যখন পালটে গেল, সেই গোপন ব্যাপারটা মা যখন আরও গোপনে বুঝিয়ে দিল তখন থেকেই বাবা যেন কেমন দূরে-দূরে। তবু কখনও তার কাঁধ জড়িয়ে আদর করার চেষ্টা করতে সে নিজেই বিরক্ত হয়েছে, আঃ বিরক্ত করো না। বাবা তার দিকে প্রথম-প্রথম আবাক হয়ে তাকাত। সে যে বিরক্ত হয়, হতে পারে তা যেন বিশ্বাস করত না, এখন করে।

বনি বলল, এই, লেডিস ওয়েটিং রুমে ঢুকে জামা পালটে আসবি। নীপা কী বলবে বুঝতে পারছিল না বাঁ-দিকের একটা সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দুজন লোক তাদের দেখছে। সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল তার। বনিকে তো মোটেই নার্ভাস মনে হচ্ছে না। ক্লাসের সবাই বলে বনির মধ্যে কেমন ছেলে-ছেলে ভাব আছে। বনি ঘড়ি দেখল, কী ব্যাপার? ওরা তো আসছে না। তুই এখানে দাঁড়া, আমি ফোন করে আসি। ওই যে ওই কোণে ফোনের বুথ আছে।

দ্রুত মাথা নাড়ল নীপা, না, আমি একা দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।

বনি হাসল, তুই একটা কেবলি। চল।

বনি যে স্টেশনটা ভালো চেনে তা বোঝা যাচ্ছে। ও এমনভাবে হাঁটছে যেন বাড়ির লোকেরা সঙ্গে আছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই হইচই বেড়েছে।

বাবা বকছে মাকে, মা প্রতিবাদ করছে।

প্রতিবছর রেজাল্ট বের হওয়ার দিন মা-বাবা একসঙ্গে তাকে নিয়ে স্কুলে আসে, আজও এসেছিল। রাস্তার ওপাশে গার্জেনদের ভিড়ে দাঁড়িয়েছিল। ওরা সবাই চলে গেল অথচ নীপা আসছে না দেখে নিশ্চয়ই হেডমিসট্রেসের কাছে খোঁজ নিয়েছে। আর তখনই জানতে পেরেছে রেজাল্টের কথা। বনির সঙ্গে যে পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসবে ও তা কেউ ভাবতে। পারেনি। এখন কী করবে? নিশ্চয়ই বুয়ামামার বাড়িতে খোঁজ নেবে অথবা রীতামাসির ওখানে। পাড়ায় ওর কোনও বন্ধু নেই। মা কারও সঙ্গে মিশতে দেয় না। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির মেয়ে সুন্দরী বলে মায়ের অস্বস্তির শেষ নেই। এবার ক্লাস নাইন হলেও মা চাইত সবাই যেন তার দিকে চোখ বন্ধ করে থাকুক। তারপর বিকাশ জেঠুর কাছে নিশ্চয়ই ছুটে যাবে বাবা। বিকাশ জেঠু। লালবাজারের বড় অফিসার। সেটা কখন যাবে?

বুথের সামনে বেশ ভিড়। বনির পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল নীপা। সুযোগ আসা মাত্র বনি ভেতরে ঢুকে বলল, ব্যাগটা ধর।নীপাও বুথের ভেতরে পা রেখে স্বস্তি পেল। যেন এখন তিনদিকের মানুষ তার ওপর নজর রাখতে পারছে না। মিনিট দুয়েক অন্তত দশবার নাম্বার ঘোরাল বনি। প্রতিবারেই রিলে করার মতো বলে যাচ্ছে এনগেজড। এখন আরও দুজন অপেক্ষা করছে। টেলিফোন করবে বলে। তার একজন বেশ ছিমছাম চেহারা, মুখের ভঙ্গিটা অনেকটা জ্যাকি সুফের মতো, হেসে জিজ্ঞাসা করল, লাইন পাওয়া যাচ্ছে না? বনি আরও জোরে রিসিভার আঁকড়ে নাম্বার ঘোরাতে শুরু করল। কিন্তু তাতেও ফল পাওয়া যাচ্ছেনা। লোকটা বলল, অত জোরে ঘোরালে স্টেশনের টেলিফোন কথা বলবে না। হয় আমারটা আমাকে করতে দাও নইলে তোমাদের সাহায্য করতে পারি।

কী সাহায্য করবেন? বনি খিঁচিয়ে উঠল।

রাগ করছ কেন? এটা পাবলিক টেলিফোন। দাও, আমি লাইন ধরে দিচ্ছি। হাসিটা এমন যে বনিও রিসিভার হস্তান্তর করল। অতএব নীপা নেমে দাঁড়াল। লোকটা স্বচ্ছন্দে তুমি বলছে। বনিকে না হয় বড় দেখায় না কিন্তু রিসিভারটা কানে ঠেকিয়ে লোকটা জিজ্ঞাসা করল, নাম্বারটা? বনি ওকে একটা আধুলি আর নাম্বার দিল। শুনে নিয়ে নাম্বার ঘোরাল লোকটা। কিন্তু এবারেও কিছু হল না। বনি মন্তব্য করল, পারলেন না তো! লোকটা জবাব না দিয়ে আবার চেষ্টা করল। এবার ওর ঠোঁটে হাসি ফুটল। নরম গলায় জিজ্ঞাসা করল নাম্বারটা ঠিক কি না। তারপর রিসিভারটা বনিকে দিয়ে বলল, কথা বলো।

থ্যাঙ্কু। বনি স্মার্ট হল, হ্যালো, স্বপন আছে? নেই। কোথায় গেছে?কাল মালদায় গিয়েছে মায়ের সঙ্গে। কবে আসবে? ও। ঠিক আছে। না, আমার নাম বলতে হবে না। বনির মুখে এখন মেঘ, যেন কেঁদে ফেলবে ও।

কোনওরকমে রিসিভারটা নামিয়ে সে বেরিয়ে এসে বলল, স্বপন নেই, মালদায় গিয়েছে। এখন আমরা কী করব?

সেকী! ওরা আসবে না?নীপা হতভম্ব।

কাওয়ার্ড। ব্যাকবোন নেই। বনির চোখে এবার জল। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নিল সে, আমাকে বিট্রে করেছে। আমি কী করব এখন, আমি আত্মহত্যা করব। বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না নীপা।

কান্না পাচ্ছিল নীপারও। দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু তার একবারও অতীনের জন্যে মন খারাপ করছিল না। অতীন আসবে না ভেবে কষ্টের বদলে কেমন একটা স্বস্তি হচ্ছিল। এবং তার বদলে ভয় করছিল, বনি আত্মহত্যা করতে পারে। ওই তো ওপাশে ট্রেন, তার তলায় পড়ে গেলেই হল। সে বনির হাত ধরল, বনি, চল বাড়িতেই ফিরে যাই।

না। মাথা নাড়ল বনি। তারপর ছোট্ট রুমালে চোখ মুছল, আমি চিঠি লিখে এসেছি। নিজের জীবন নিজে ঠিক করে নিলাম। আমার খোঁজ করো না। এরপর আমি বাড়িতে ফিরতে পারব না। অসম্ভব। আমি আত্মহত্যা করব।

এই বনি, প্লিজ, তুই আত্মহত্যা করলে আমি কোথায় যাব।

তুই জানিস নানীপা, স্বপন আমাকে বউ বলত। বলত, কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে না। আর আজ এখানে আসতে বলে মাকে নিয়ে মালদায় চলে গেল। মা ঠিকই বলে, পুরুষজাতটাই। বেইমান। দ্বিতীয়বার চোখ উপচে জল এল।

তোমরা এইভাবে কান্নাকাটি করলে পুলিশ নির্ঘাত ধরে নিয়ে যাবে। একদম পেছনে দাঁড়িয়ে লোকটা কথা বলতেই ওরা চমকে ফিরে তাকাল। লোকটা মিষ্টি করে হাসল, টেলিফোনে বন্ধুকে পাওনি তাই কাঁদতে হবে?

বনি কথাটা শেষ হওয়ামাত্র নীপাকে বলল, চল। আর ঠিক সেই সময় একজন বয়স্ক ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়ালেন, কী ব্যাপার?কাঁদছ কেন খুকি?

সঙ্গে-সঙ্গে নীপা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

লোকটার চেহারা বিকাশজেঠুর মততা, নির্ঘাত পুলিশ। বনিও মাথা নামাল। আর সেই সময় পেছনের লোকটা বলে উঠল, ওই যা হয় রেজাল্ট বেরিয়েছে, কান্নাকাটি তাই।

পাশ করেনি?

হ্যাঁ। দাদা খুব রাগী তাই ভয় পাচ্ছে।

আপনার কে হয় এরা?

একজন ভাইঝি আর এ পাশের বাড়িতে থাকে।

বাড়ি নিয়ে যান।

লোকটি বলল, চলো। এখন কান্নাকাটি করে কী হবে? পড়াশুনা না করার সময় মনে ছিল না? চলো, ট্রেনের দেরি নেই।

কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ওরা কিছুটা দূরে হেঁটে এলে লোকটা বলল, আর একটু হলেই হয়েছিল আর কী! রেলওয়ে পুলিশের বড়কর্তা। আমি না থাকলে তোমাদের এতক্ষণে চালান। দিয়ে দিত। পুলিশের খাতায় একবার নাম উঠলে! কোথায় যাবে তোমরা?

নীপা বনির দিকে তাকাল। বনির মুখে এখন কান্না নেই। সে বড় ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে। সেখানে কেউ নেই। তারপর বনি বলল, আমরা একটু ঘুরতে বেরিয়েছি।

লোকটা বলল, শোনো, পাগলামি করো না। তোমরা স্কুল-ইউনিফর্মে ঘুরলে পুলিশ আবার ধরবে। কারও আসার কথা ছিল নিশ্চয়ই?

প্রশ্নটা নীপার দিকে তাকিয়ে। সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। লোকটা জিজ্ঞাসা করল, খিদে পায়নি? চললো, ওই রেস্টুরেন্টে বসে স্থির করি কী করা যায়। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। লোকটা আগে-আগে হাঁটছিল। কিছু না ভেবেই ওরা অনুসরণ করল। বনি ফিসফিস করে বলল, লোকটাকে কীরকম মনে হচ্ছে রে!

জ্যাকি শ্রফের মতন?

ভাগ। পঁচিশ-ছাব্বিশ বয়স হবে না? স্বপনদের থেকে অনেক বড়। খারাপ লোক মনে হয়?

কী জানি। আমার ভয় করছে। চল, বাড়ি ফিরে যাই।

তুই। আমি বাড়ি যাব না। বনি জেদি গলায় বলল।

ফিসফ্রাই খুব ফেবারিট বনির। নীপার আবার ফিস ফিংগার ভালো লাগে। লোকটার নাম জেনেছে ওরা। সুন্দর সেন। বনি বলল, আপনাকে প্রফেসর বলে মনেই হয় না। নীপা বলছিল আপনাকে জ্যাকি শ্রফের মতো দেখতে?

সে আবার কে।

সুন্দর এমন মিষ্টি হাসল যে বনি চোখ বড় করল, ওমা, আপনি হিন্দি সিনেমা দ্যাখেন না?

তোমরা খুব দ্যাখো বুঝি?

রবিবারে আর চিত্রহারে।

কিন্তু তা তো হল, তোমরা এখন কী করবে? কোনও আত্মীয়ের বাড়ি নেই?

নীপা বলল, আমার এক পিসি থাকেন আসানসোলে।

সেখানেও তো খবর যাবে। আসলে মালদা থেকে স্বপন না ফেরা পর্যন্ত তোমাদের একটা কোথাও থাকতে হবে। সুন্দরকে চিন্তিত মনে হল।

এই আধঘণ্টায় ওরা সুন্দরকে পছন্দ করে ফেলেছিল। খুব স্নেহপ্রবণ, মিষ্টি ব্যবহার এবং সবসময় ওদের সাহায্য করতে চাইছে। কথা বলছে যখন তখন মনে হচ্ছে সমানে-সমানে বেশ গুরত্ব দিচ্ছে। বাবা-মায়ের মতো তুচ্ছ করছেনা। সুন্দর বলল, এ-কাজ করতে পারো। আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলল। সেখানে বউদিরা আছেন। তাদের সঙ্গে কয়েকদিন থাকো। এর মধ্যে স্বপনকে নিয়ে ওখানে হাজির করছি। ভেবে দ্যাখো।

ওরা কিছু বলবেন না?

কে বউদিরা? ওঁরা আমাকে জানেন। একদম নিরাপদ তোমরা সেখানে।

বাসে যে এত ভিড় হয় কে জানত। হাওড়া থেকে ট্রেনে একটা জায়গায় নেমে বাসে উঠেছিল ওরা। গ্রামের মানুষগুলো বারংবার ওদের দিকে তাকাচ্ছিল। এ ধরনের বাসে ওরা আগে ওঠেনি। জানলা দিয়ে ধানের খেত, পুকুর, তালগাছ দেখতে কি ভালোই না লাগছিল। বাসটা যেখানে। নামিয়ে দিয়ে গেল সেখানে একটা বিরাট বট গাছ। তার তলায় কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। বিকেল হয়ে এসেছিল। সুন্দর বলল, তোমাদের হাঁটতে কষ্ট হবে এবার। চলো শর্টকাট করি, গাড়ির পথ ধরলে বেশি হাঁটতে হবে।

খুব মজা লাগছিল ওদের। মাথার ওপরে নীল আকাশটা কী নীল। দু-পাশে থাকা ধানের ঢেউ। ওরা আলের ওপর দিয়ে হাঁটছিল। সুন্দর হঠাৎ খোলা গলায় গান ধরল, আজ ধানের ক্ষেতে। রৌদ্রছায়ায়–। সঙ্গে-সঙ্গে সুন্দরকে আরও ভালোও লাগল নীপার। নিজের অজান্তেই সে গলা মেলাল। এই মুহূর্তে তার বুকে কোনও ভয় জমে ছিল না। মাঠের প্রান্তে একটি দোতলা বাড়ি। পেছনে পুকুর। অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগান। আশেপাশে কোনও বাড়ি নেই। ওরা ভেতরে ঢোকামাত্র কয়েকটি মহিলা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। সুন্দর বলল, এই হল আমার তিন বউদি। বউদি, এ হল বনি আর ওর নাম নীপা। খুব ভালো মেয়ে ওরা। এখানে কদিন থাকবে কিন্তু কেউ যেন না জানে ওরা এখানে আছে।

কেন গো, কী ব্যাপার? ছোটজন প্রশ্ন করল।

বড়জন বকে উঠল। আরে এখনও পায়ে ধুলো আর প্রশ্ন তুললি তুই। এসো তোমরা।

বড়বউদি ওদের ওপরের ঘরে নিয়ে গেলেন।

আমাদের এখানে অনেকগুলো ঘর। তোমাদের থাকতে মোটেই অসুবিধে হবে না। আঁচলে বাঁধা একটা চাবির তোড়া থেকে খুঁজে ওপাশের বন্ধ ঘরের তালা খুললেন তিনি। চমৎকার সাজানো ঘর। এরকম ফাঁকা মাঠের মধ্যে এমন ঘর ভাবা যায় না। বউদি বললেন, এখানেই তোমরা থাকবে, কেমন! এদিকের জানলায় দাঁড়ালে কেউ তোমাদের দেখতে পাবে না। ওপাশে জলা। বড় রাস্তা বাড়ির এপাশে। সেদিকে না গেলেই হল। ও হ্যাঁ, আমাদের কিন্তু ভাই সাহেবি বাথরুম নেই। পুকুরে স্নান করি ভোরবেলায়। তবে তোমাদের জন্যে হাত-মুখ ধোওয়ার জল দিচ্ছি। নিচে কলপায়খানা আছে। তা কী ব্যাপার, বাপমায়ের সঙ্গে ঝগড়া?

এবার মুখ নিচু করল নীপা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই মা-বাবা পাগল হয়ে গিয়েছে।

মুড়ির সঙ্গে নারকোল খেতে-খেতে বনি বলল, দারুণ, না?

নীপা মাথা নাড়ল। তার মুড়ি খেতে ভালো লাগে না। চোয়াল ব্যথা হয়ে যায়। কিন্তু এক প্লেট ফিশ ফিংগার সেই সকালে খাওয়ার পর এটা অমৃত লাগছে। ওদের সামনে ছোট দুই বউদি বসে আছে। হাঁটু মুড়ে। ছোটবউদি বলল, তোমাকে কী মিষ্টি দেখতে! ঠিক সিনেমার নায়িকার মতো। তা প্রেমিকরা এল না কেন ভাই?

বনি কিছু বলল না। মুখ নামাল। নীপা প্রতিবাদ করল, ওর বয়ফ্রেন্ড আছে।

বনি প্রতিবাদ করল, এই, অতীন তোকে বলেছে আই লাভ ইউ। আমি শুনেছি।

আমি তো বলিনি।

শুধুই কথাই বলেছে আর কিছু করেনি?বলোনা ভাই, আমাদের স্বামীরা তো শহরে থাকে, হপ্তার বার। পাঁচদিন একা-একা থাকি। চুমু-টুমু খায়নি ওরা? ছোট হেসে গড়িয়ে পড়ল।

মেজো ওকে চড় মারল আলতো করে, কী মুখ রে বাবা। খেলে তোকে বলবে কেন?

ছোট বলল, আমাদের সুন্দরবাবু তো মেয়েদের থেকে হাজার মাইল দূরে থাকেন, সেই ছেলে তোমাদের নিয়ে এল। পছন্দ আছে।

এখানে ইলেকট্রিক নেই। হ্যারিকেন জ্বলছে। ওরা দুজন জানলার পাশে বসে মাঠ দেখছিল। সেখানে অজস্র জোনাকি। বউদিরা নিচে রান্না করতে গিয়েছে। ওদের দেখার পর আর একটুও ভয় করছিল না। সুন্দর সেই যে গিয়েছে আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না তার। নীপা ফিসফিস করে বলল, এদের টয়লেট ভীষণ নোংরা।

গ্রামের দিকে এইরকম হয়।

তুই কখনও পুকুরে স্নান করেছিস?

না। মা সবসময় ঠান্ডা-গরম জলে স্নান করতে বলে।

আমাকেও।

তোর মন কেমন করছে?

হুঁ। নীপা বলল, একসাইটেড হলে মায়ের বুক ব্যথা করে, হাঁফ ধরে। বাবার জন্যে কষ্ট হচ্ছে। জানিস, বাবানা, আমি ঘুমিয়ে পড়লে আমার কপালে একবার হাম খেত।

হাম! হেসে ফেলল বনি, হাম তোবাচ্চাদের খায়। তুই কি বাচ্চা? কথাটা খারাপ লাগল নীপার। হঠাৎ তার মনে হল বাবাকে কোনওদিনও সে দেখতে পাবে না। টপটপ করে জল পড়তে লাগল। গাল বেয়ে। বুকের ভেতরটা খাঁ-খাঁ করতে লাগল।

হ্যারিকেনটা পেছনে থাকায় বনি কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। বনি বলল, স্বপন এলে আমি খুব বকব।

তারপর কী করবি?

কোথাও চলে যাব ওর সঙ্গে।

আমি কী করব?

আঃ, স্বপন একা আসবে নাকি? অতীনকে নিয়ে আসবে।

আমি অতীনের সঙ্গে যাব কেন?

বাঃ, তোকে ও ভালোবাসে না?

আমি তো ভালোবাসি না। নীপা মাথা নাড়ল, এমনি ভালো লাগে।

তাহলে তুই এলি কেন?

একা-একা বড় হব বলে। মা-বাবার সাহায্য ছাড়া বড় হয়ে ফিরে যাব। প্রায়ই বলে আমার ভবিষ্যৎ নাকি ঝরঝরে। সেটা যে মিথ্যে তা প্রমাণ করব।

কী করে?

জানি না। কেঁদে ফেলল নীপা।

কাঁদিস না। নীপার পিঠে হাত রাখল বনি, স্বপন অতীন এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

এত ঝাল রান্না কখনও খায়নি নীপা। আর কী সব তরকারি। বাড়িতে হলে ছুঁয়েও দেখত না সে। হাঁটু মুড়ে খেতে বসে কষ্টও হয়েছিল। রান্না কিন্তু ভালো। মা রোজ একই মেনু করে। মাছ অথবা। মাংস। ঝাল সত্বেও মাছের প্রিপারেশন দারুণ লেগেছিল। আর পায়েসটা?উঃ ফ্যানটাস্টিক! কিন্তু রাত্রে ঘুম হচ্ছিল না। বনিরও। এই প্রথম বাড়ির বাইরে রাত কাটাচ্ছে ওরা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ কিন্তু বাইরে শেয়াল ডাকছে। কয়েকবার মনে-মনে কেঁদেছে সে। একবার মনে হল বনিও কাঁদছে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেছিল মালদা থেকে আসতে কতক্ষণ সময় লাগে?নীপা জানে না, জবাবও দিতে পারেনি। ভোর হতেই দরজায় শব্দ। ওরা দুজনেই একসঙ্গে চিক্কার করে কে বলল। ছোট বউদির গলা ভেসে এল, চলে এসো, স্নান করতে হবে।

বাড়ির পেছনেই পুকুর। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ওরা ভোয়ালে নিয়ে ছোট বউদির সঙ্গে সেখানে। এল। আশেপাশে কেউ নেই। এখনও আলো ফোটেনি। ছোটবউদি বলল, তাড়াতাড়ি দুটো ডুব দিয়ে নাও। তোমাদের দেখলেই লোকে বুঝবে শহরের মেয়ে। খুব ভয় লাগছিল জলে নামতে। কিন্তু জল তত ঠান্ডা নয় কিন্তু কেমন ঘোলাটে। পায়ের তলায় কাদামাটি। নীপার মনে হল কয়েক পা গেলেই ডুবে যাবে। সে গায়ে জল ছিটিয়ে স্নানের চেষ্টা করতেই ছোটবউদি তার কাঁধ জলে চেপে ধরে ছেড়ে দিল। রাগ এবং ভয়টা কেটে যেতে খুব মজা লাগল তার। বনি এখন বারংবার ডুব দিচ্ছে। ছোটবউদি এবার তাগাদা দিচ্ছে ফেরার। নীপা বলল, আমাকে সাঁতার শিখিয়ে দিতে হবে।

ছোটবউদি বলল, শেখাতে হবে না, ঠিকই শিখে নেবে। গলার স্বরটা যেন কেমন!

সারাদিন ঘরে বসে থাকা আর লুডো খেলা। আর দারুণ-দারুণ খাবার। কচু দিয়ে মাছের প্রিপারেশন দারুণ। দুধপুলিটা অসাধারণ। ছোটবউদি আজ দুজনকেই শাড়ি পরিয়ে দিল।

সন্ধের পরেই বড়বউদি ছুটে এল, খবরদার কথা বলবে না তোমরা।

চোখমুখ দেখে চমকে উঠল ওরা, কেন?

পুলিশ এসেছে গ্রামে। বাড়ি-বাড়ি খুঁজে দেখছে।

বড়বউদি ওদের হাত ধরে টানতে-টানতে রাস্তার দিকের একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে অনেক জিনিসপত্র ঠাসা। দুই বউদিকেও সেখানে থাকতে বলল। তাকে হ্যারিকেনের আলোয় খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে। দরজা বন্ধ করে বড়বউদি চলে গেলে নীপা জানলার কাছে গেল। বাইরে অন্ধকার। এদিকটা ওরা দ্যাখেনি। বাড়ির গায়ে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। তাতে ত্রিপল ঢাকা। মেজোবউদি ওর হাত ধরে টানল, মরার ইচ্ছে হয়েছে, না? চলো এসো এদিকে। একটা কথা। বলেছ কি কেটে ফেলব। নীপা বিস্ফারিত চোখে দেখল মেজোবউদির হাতে বড় ছুরি। ওর মাথা ঘুরতে লাগল।

বনি অনেকটা শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ওরা এই গ্রামে এল কী করে?

তোমরা যখন বাস থেকে নেমেছিলে তখন একজন স্কুলমাস্টার দেখেছে। কাগজে খবর পড়ে সে ব্যাটা জানিয়েছে। পুলিশ চলে গেলে তোমরা নেমে একটা ট্রাকে উঠে পড়বে। আর ত্রিপলের তলায় চুপটি করে শুয়ে থাকবে। সুন্দর তোমাদের নিয়ে তোমাদের প্রেমিকের কাছে যাবে।

নিচে খুব হইচই হচ্ছে। ওরা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আওয়াজটা ওপরে উঠে এল। বড়বউদির গলা ভেসে এল, হাজারবার বলছি কেউ নেই তবু বিশ্বাস করছেন না। দেখলেন তো সব ঘর।

পুরুষ-কণ্ঠ শোনা গেল, ওই ঘরে কে আছে?

আমার জায়েরা। অল্পবয়সি। বাইরের পুরুষের সামনে বের হবে না।

তবু একবার দেখব। ওপরওয়ালার হুকুম।

টর্চের আলো পড়ল ঘরে। দুই বউদি ওদের আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। আলো নিভে যেতে বড়বউদি বলল, হল তো! আপনাদের জন্যে মা-বোনের ইজ্জত থাকবে না। চলুন নিচে।

দ্বিতীয় একটি গলা কথা বলল, আপনাদের বাড়ির বউরা কি বব ছাঁট চুল রাখে? স্যার, দেওয়ালে দুটো বব ছাঁটের ছায়া দেখলাম। আপনি ভেতরে ঢুকুন।

খাটের ওপর হাঁটুতে মুখ খুঁজে বসেছিল নীপা। পাশের ঘরে বাবা। লালবাজার থেকে নিয়ে আসার পথে এবং এখানে আনার পরে বাবা একটাও কথা বলেনি। ওঘরে এখন ভিড়। পাশের বাড়ির মাসিমা জিজ্ঞাসা করলেন, শুনলাম ট্রাক রেডি ছিল, রাত্রেই পাচার করে দিত লখনউ। খুব বেঁচে গেছে। যাই বলো দীপ্তি, তোমরা মেয়ে মানুষ করতে পারোনি।

সবাই চলে গেলে বাবা ঘরে ঢুকল, নীপু, বল তো, আমি তোকে কী দিতে পারিনি?

পেছন থেকে মা চিৎকার করে উঠল, কথা বলো না ওর সঙ্গে। ও রাক্ষুসি, মরে গেলি না কেন, কেন এই–! আমাদের মুখ পুড়িয়ে কেন এলি!

বাবা বলল, এতদিন মেয়ের জন্য অজ্ঞান হচ্ছিলে আর এখন মরে যেতে বলছ। এভাবে কথা। বলো না। ওকে খেতে দাও। তুমি আবার দয়া করে খাব না বলো না। আমি সহ্য করতে পারছি না।

ইচ্ছে ছিল না। কিছুই ভালো লাগছিল না। সুন্দর লোকটা অধ্যাপক নয়, মেয়ে ধরে চালান দেয় –কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু তিন বউদি আর সুন্দরকে কোমরে দড়ি বেঁধে এনেছে পুলিশ। ওরা যে মিষ্টি গল্প করত–সেসব?

খাওয়ার টেবিলের সামনে মা। ওপাশে বাবা চুপচাপ বসে। সেই এক মেনু। মাছের ঝোলটা মুখে দিয়ে সরিয়ে রাখল সে। সঙ্গে-সঙ্গে মা বলে উঠল, কী, মুখে উঠছে না? সেখানে কি রাজভোগ। খেতে?

মাথা নাড়ল নীপা, ওরা ফ্যানটাস্টিক রান্না করত। বাড়িতে কখনও এমন রান্না খাইনি!

সঙ্গে-সঙ্গে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল মা, কী, কী প্রশংসা হচ্ছে?যারা তোমাকে জন্মের মতন বিক্রি করে দিত তাদের প্রশংসা করছ?কালসাপ, কালসাপ– নীপা বাবার দিকে তাকাল। এঁটো হাতে টেবিলে রাখা বাবার হাতটা জড়িয়ে ধরল সে, আমি ওখানে খুব ভালো ছিলাম বাবা। ওরা খুব ভালো খাওয়াত, পুকুরে স্নান করতে দিত। পুকুরে ডুব দিতে আমার ভীষণ ভালো লাগত। কেমন হলুদ-হলুদ পৃথিবীটা, কেমন হলুদ-হলুদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *