চোর চাই – শংকর
কথাসাহিত্যিক সুধাময় সেনের আজ একষট্টিতম জন্মদিবস। কয়েকদিন আগেই তাঁর আসন্ন ষাট বছর পূর্তির শুভসংবাদ খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে যাঁরা সংবাদ ও সাহিত্য সমালোচনা স্তম্ভে তাঁকে বঞ্চিত করেছেন, ষাট বছর বয়সে তাঁরাই অপ্রত্যাশিত বোনাস দিয়েছেন অসামান্য সাহিত্যজীবনের সাফল্য স্বীকার করে, তাঁরা সুধাময়ের দীর্ঘজীবন কামনা করেছেন।
জনপ্রিয় সংবাদপত্রের শক্তি যে-সুধাময় এতদিন অস্বীকার করে এসেছেন সে-সুধাময়ই বুঝতে পাবছেন তার বিপুল প্রভাবের কথা। সকাল থেকে বেশ কয়েকজন পরিচিত এবং অপরিচিত ব্যক্তি তাঁকে জন্মদিনের অভিনন্দন জানিয়ে গিয়েছেন এবং উল্লেখ করেছেন তাঁর আজন্ম সাহিত্যসাধনার। জীবনে কোনওদিন এত ফুল সুধাময়ের সামনে জড়ো হয়নি। তবু আনন্দিত হতে পারছেন না সুধাময়। মনটা মাঝে মাঝে ছটফট করে উঠেছে।
অশান্তির কারণটা তাঁর বুক পকেটেই রয়েছে। বেশ কিছু চিঠি এসেছে—তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রশংসার সেসব মুখর। কিন্তু ওই চিঠিটাই সকালের মেজাজটা নষ্ট করে দিল। অন্য চিঠিগুলো তক্তপোষে ছড়ানো রয়েছে, শুধু ওই চিঠিটা সুধাময় পাঞ্জাবির পকেটে তুলে রেখেছেন। বেশ কয়েকবার পড়েও ফেলেছেন—তবু সমস্যা মিটছে না, আবার পড়তে হচ্ছে মাঝে-মাঝে।
খামের মধ্যে পুরে কেউ চিঠিটা বেয়ারিঙে পাঠিয়েছে—গাঁটের কড়ি খরচ করে তাঁকে চিঠি নিতে হয়েছে। চিঠিতে সোজাসুজি লেখা: ‘ষাট তো পেরোলেন, কিন্তু হল কী? দিস্তে দিস্তে কাগজ এবং বোতল বোতল কালি খরচ করে সমাজের কী কাজে লাগলেন?’
এইখানেই শেষ নয়। চিঠির লেখক একটু আগেই টেলিফোন করে সুধাময়কে আরও বিষণ্ণ করে তুলেছে। লোকটা জিজ্ঞেস করলে, ‘বেয়ারিং চিঠি পেয়েছেন? ওটা সিম্বলিক।’
‘মানে?’
‘সমাজের মাসুল না-দিয়ে কেবল যারা লিখে যায় তাদের বেয়ারিং চিঠি পাওয়া উচিত।’
জন্মদিনে আজ রূঢ় হলেন না সুধাময়। শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘আমার মতো গল্প লেখকের কাছে কী মাসুল প্রত্যাশা করেন আপনারা?’
‘কিছু মনে করবেন না—আজ আপনি যত ফুল এবং প্রশংসাপত্র পাবেন সব মিথ্যা। আপনি বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আমাদের জন্যে কী করেছেন আপনি?’
দুঃখ পেলেও সুধাময় বিরক্ত হলেন না। শান্তভাবে তিনি বললেন, ‘সারা জীবন ধরে আমি মানুষের ভালবাসার জয়গান গেয়েছি—মানুষকে বলেছি, ভালবাসো, ভালবাসো’।
লোকটা হেসে উঠল। ‘খুব সস্তায় বাজিমাতের পথটা বেছে নিয়েছেন আপনি। বলুন তো এদেশের দুর্গতির কারণটা কী?’
হঠাৎ এই সময়ে লাইনটা কেটে গেল। টেলিফোনের আজকাল যা অবস্থা।
এরপর যারা-যারা তাঁর ঘরে এসেছে তাদের ফুল ও মিষ্টিতে কোনওরকম আগ্রহ প্রকাশ না-করে সুধাময় জিজ্ঞেস করেছেন, ‘বলো তো এদেশের দুর্গতির কারণটা কী?’
এরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চায়ি করতে লাগল—কোনও উত্তর দিল না। জন্মদিনের অতিথি, শুধু-শুধু উত্ত্যক্ত করা যায় না। সুধাময় তাই চুপ করে রইলেন।
চিন্তা আরও বাড়ত—কোনও প্রশ্ন উঠলে তার উত্তর না-পাওয়া পর্যন্ত সুধাময়ের মাথার মধ্যে খচখচ করতে থাকে, রাত্রে ঘুম হয় না। আজও হয়তো এই অবস্থা হত, কিন্তু টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল। ‘হ্যালো, লাইনটা তখন কেটে গিয়েছিল। এদেশের সর্বনাশ করেছে শোষকরা। নির্লজ্জ শোষকদের আপনি কি ক্ষমা করেছেন?’
ক্ষমা তো দূরের কথা—সুধাময় তো তাঁদের তেমনভাবে চেনেন না। সুধাময় আর যাই হোন মিথ্যাচারী নন—এই শোষণের দিকটা কখনও তিনি তেমন খুঁটিয়ে দেখেননি। সমস্ত সাহিত্য জীবনে দুর্নীতি এবং ভালবাসাকে তিনি যথাক্রমে তিরস্কৃত ও পুরস্কৃত করে এসেছেন।
লোকটা টেলিফোন নামাবার আগে বলেছে, ‘শুধু ধনীর শোষণ নয়—আরও নানারকম নির্লজ্জ সামাজিক শোষণ আছে—যার ফলে দেশটার বারটা বেজেছে। তাদের খুঁজে বার করুন’।
সুধাময় এবার বেশ ভাবিত হয়ে উঠেছেন। ভালবাসার বাণীটিই শাশ্বত, মানুষের মধ্যেই দেবতা আছেন, তিনি জেগে উঠলে আজও অসাধ্য সাধন হয়, এই বিশ্বাসের কোনও মূল্য নেই তাহলে বর্তমান সমাজে। সুধাময় তাহলে সত্যিই ষাট বছরের সেকেলে বুড়ো হয়ে গেলেন। না, সুধাময় ছাড়বেন না— সামাজিক শোষণের হিসেব-নিকেশ এই একষট্টিতম জন্মদিবসেই শুরু হবে! সুধাময় দেখিয়ে দেবেন জাত লেখকরা বনস্পতিব মতে, তাঁরা বৃদ্ধ হন না—নবীন চিন্তার বসন্ত ঋতু বারবার ফিরে আসে তাঁদের জীবনে।
লেখিকা নবীনা আচার্য এক চিলতে শুভেচ্ছাপত্র পাঠিয়েছিলেন। ওপরে টেলিফোন নম্বর লেখা ছিল। সুধাময় তাঁকেই ফোন করলেন। ধন্যবাদ জানালেন চিঠির জন্যে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কারা সবচেয়ে নির্লজ্জ শোষক বলো তো?’
হা-হা করে হেসে উঠলেন নবীনা আচার্য। ‘আমার তিনখানা লেটেস্ট নবেল তাহলে আপনি পড়েননি। শোষকরা আইডেন্টিফায়েড হয়েছে—পাবলিক তাদের চিনে নিয়েছে। এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি—বছরের পর বছর ধরে এরা এদেশের উপজাতিদের রক্ত শুষছে। নাইনটিনথ সেঞ্চুরির রেকর্ড ঘেঁটে-ঘেঁটে বহু কষ্টে আমি ইনফরমেশন যোগাড় করেছি। পড়েননি পেপারে আমার ইন্টারভিউ?’
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে সুধাময় বুঝলেন ক্ষমার অযোগ্য এই সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষকরা। নিজেদের পেট মোটা করবার জন্যে এরা যা-করেছে তার তুলনা ইতিহাসে মেলে না।
সুধাময় এবার কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন, মনে মনে ধন্যবাদ জানালেন নবীনা আচার্যকে। আরও দু’ একজনকে বোধ হয় প্রশ্ন করা উচিত। মাস কয়েক আগে এক মিটিঙে লন্ডন ইস্কুল অফ ইকন-এর ডক্টরেট সদানন্দ সেনগুপ্তর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মস্ত-মস্ত বিদেশি কলেজে অধ্যাপনা ও গবেষণা শেষ করে ডঃ সেনগুপ্ত এখন শহরের নতুন এক ইনস্টিটিউটে ডিরেক্টর হয়েছেন।
ফোনে সদানন্দ চিনতে পারলেন সুধাময়কে। সুধাময়ের সেই একই প্রশ্ন: ‘কারা নির্লজ্জ শোষক বলুন তো?’
হা-হা করে হেসে উঠলেন ডঃ সদানন্দ সেনগুপ্ত। ‘আপনি নিশ্চয় মন দিয়ে ইংরেজি খবরের কাগজ বা জার্নাল পড়ে না। বম্বে দিল্লি বাঙালোর হায়দ্রাবাদ চণ্ডীগড় আমেদাবাদ এবং ক্যালকাটায় পর পর এগারটা সেমিনারে আমি পুরোপুরি এক্সপোজ করে দিয়েছি শিক্ষিত সমাজকে। নির্লজ্জ শোষণের বলি হয়েছে শ্রমজীবীরা—ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়েছে বুদ্ধিজীবীরা, যারা বহু প্রজন্ম ধরে ফাউন্টেন পেনের থেকে ভারী কোনও জিনিস নিজের হাতে তোলেনি। এই বাবুরা যে ওয়ারস দ্যান কুসীদজীবী তা নিশ্চয় আপনাকে বলতে হবে না, মিস্টার সেন। নাইনটিনথ সেঞ্চুরির এই পরগাছাদের মূলে আমি বোতল-বোতল অ্যাসিড ঢেলে যাচ্ছি এবং যাব।’
খুব শ্রদ্ধা হল ডঃ সদানন্দ সেনগুপ্তর ওপর—আর সমপরিমাণ বিরক্তি জন্মাচ্ছে তাদের ওপর যারা দুই শতাব্দী ধরে নির্লজ্জ শোষণ করে নিজেদের আখের গুছিয়ে যাচ্ছে।
বোম্বাইয়ের বিখ্যাত এক কলেজের প্রধান এবং সুধাময়ের দূর সম্পর্কের ভাগ্নে প্রভাতকিরণ রায় ঠিক সেই সময় ফোন করলেন। ‘হ্যালো মামা। মেনি হ্যাপি রিটার্নস এটসেটরা’।
এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন সুধাময় এবং সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেয়ে গেলেন। ‘হোল ওয়ার্ল্ডকে সেই কথা বোঝাচ্ছি।—বেঙ্গলের অধঃপতনের কারণ শহুরে লোকদের নির্লজ্জ শোষণ— গ্রামগুলো সব ছিবড়ে করে দিয়েছে, নাইনটিনথ এবং টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির হিসট্রির প্রত্যেকটা লাইন তাই বলছে। এই শোষণের কোনও জুড়ি নেই।’
সুধাময় শুনলেন, এই শোষণ করা সম্পদ সব কলকাতার মতো বড় বড় শহরে এনে ঢালা হয়েছে।
‘হ্যাঁরে, আর কোনও টাইপের শোষক আছে?’ জিজ্ঞেস করেন সুধাময়।
‘অবশ্যই আছে মামা—শহর ও গ্রামের এই খাদক খাদ্য সম্পর্কের আর একটা চ্যাপটার বলতে পারো—শিক্ষিত লোকের হৃদয়হীন শোষণ। অশিক্ষিত লোকের মাথায় এরা ওই এক সময় থেকে বেল ভেঙে চলেছে।’
কথাটা মিথ্যে বলেনি প্রভাত। সুধাময়ের ষাট বছরের পুরনো রক্তও গরম হয়ে উঠছে। রাগ হয়তো আরও বেড়ে উঠত, কিন্তু দিল্লি থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিখ্যাত সরকারি অফিসার অবনীকান্ত তালুকদার জন্মদিনের অভিনন্দন জানাতে এলেন। সুধাময়ের প্রশ্নের উত্তরে মুখ বেঁকিয়ে মিস্টার তালুকদার বললেন, ‘বচ্ছরকার দিনে অপ্রিয় সত্য কথাটা বলব?’।
‘কেন বলবেন না? নিশ্চয় বলবেন, যা সত্য তাকে এড়িয়ে-এড়িয়ে থেকেও তো আমাদের জাতের এই অবস্থা।’
‘তা হলে শুনুন, মিস্টার সেন, ভারতবর্ষে যত জাত আছে তার মধ্যে শোষক হিসেবে বাঙালিদের তুলনা নেই। পঙ্গপালের মতো যেখানে বাঙালি গেছে সেখানে কী অবস্থা হয়েছে তা কারও জানতে বাকি নেই। পলিটিকালি যাই বলি, আপনার কাছে স্বীকার করছি—বাঙালি বাবু ইজ এ ‘মেনাস’। নাইনটিনথ সেঞ্চুরি থেকে ইংরেজের ধামাধরা হয়ে বাঙালিরা যেখানে যেখানে গিয়েছে…’ তারপর হিসট্রি থেকে গড়গড় করে বলতে লাগলেন অবনীকান্ত তালুকদার। ‘বিভিন্ন জায়গায় কেন বাঙালিরা ‘হেটেড’ তা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়—এক্সপ্লয়টেশন কথাটার বাংলা ‘শোষণ’ বললে কিছুই বলা হয় না।’
অনেকক্ষণ শোনার পর চোখ বুজলেন সুধাময়। যারা শোষণ করে লাল হয়েছে তাদের চিনে রাখতেই হবে। শুধু শোষিতের ছবি এঁকে সাহিত্যিকের দায়িত্ব তিনি ছাড়বেন না।
মিঃ তালুকদার বিদায় নেবার পরেই সুধাময়ের পড়শি মিস্টার ব্যানার্জির ছেলে অনল দেখা করতে এল। ‘অনল তুমি তো সবে ভারতদর্শন করে এলে। কারা নির্লজ্জ শোষক বলো তো?’
অনল ব্যানার্জি চটপট উত্তর দিল, ‘দক্ষিণভারতে নিজের কানে শুনে এলাম—শতশত বছর ধরে সাউথকে শোষণ করছে নর্থ।’
‘এই আমরা যারা পূর্বে আছি? আমরা তো নর্থ নয়?’
সুধাময়ের কথা শুনে অট্টহাস করল অনল। ‘ওখানে গেলে বুঝবেন, পূর্ব অথবা পশ্চিম বলে কিছু নেই। হয় উত্তর, না-হয় দক্ষিণ—আমরা অবশ্যই নর্থ।’
সুধাময় শোষণের এই নির্লজ্জ রূপটা মনের মধ্যে ধরে রাখলেন। মনটা এই জন্মদিনে অস্থির হয়ে উঠেছে। এমন সময় ঢাকার শিক্ষিত সাংবাদিক কানু গুপ্ত টেলিফোন করলেন। ‘হ্যালো, কানুবাবু, আপনারা তো ডিউটিব সময় দেশের কথা দশের কথা ভাবেন। এদেশের পয়লা নম্বর শোষক কারা?’
‘এর উত্তর কি মুখ খুলে দেবার প্রয়োজন আছে? আকাশে বাতাসে সর্বত্র তো লেখা রয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশ বিভাগ এসব ভুলে গেলেন? এর পিছনে রয়েছে শোষণ—হিন্দুরা নির্লজ্জভাবে বাংলার গ্রামে গ্রামে অন্যদের ওপর কী করেছে? বেশিরভাগ জমিদার হিন্দু, প্রজা অন্য ধর্মের— নাইনটিনথ সেঞ্চুরি থেকে…’
‘আর বলতে হবে না…উনবিংশ শতাব্দীতে যখন এসে গিয়েছেন তখন বাকিটা বুঝে ফেলেছি।’
কানু গুপ্ত বললেন, ‘হ্যালো, আমার পাশে সাব-এডিটর অনাদি দাস বসে আছে। ও বলছে, শোষণের মধ্যে সযঙ-শোষণ আছে। ফোনটা অনাদি দাসকেই দিচ্ছি।’
‘হ্যালো, সুধাময়বাবু, আমি আনন্দিত যে আপনার মতো লেখকরাও এই ব্যাপারে মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন। সমস্ত সাহিত্য ও সাংবাদিকতা উচ্চবর্ণের কুক্ষিগত, তাই নিম্নবর্ণের ওপর উচ্চবর্ণ হিন্দুর অবহেলা, অত্যাচার ও শোষণের কথা তেমন জানা যায় না। দেখবেন এর থেকে একদিন কী হয়! সেই নাইনটিনথ সেঞ্চুরির থেকে…’
টেলিফোন নামিয়ে গুম হয়ে বসে রইলেন সুধাময়। এই শোষকগুলো ফুলে ফেঁপে উঠছে অন্যের রক্তে—আর সমাজ তা নীরবে সহ্য করে চলেছে।
ডায়রিতে দ্রুত শোষকদের তালিকা লিপিবদ্ধ করে চলেছেন সুখময়। —এমন সময় হেতমপুর ইস্কুলের হেডমাস্টার বিনয় হালদার হাজির হলেন। ‘বিনয়, সকাল থেকে আমি একটা কথাই ভাবছি, বলো তো…’
‘সুধাময়বাবু, ডক্টর চামেলি চ্যাটার্জির অধীনে ওইটাই তো আমার থিসিসের বিষয়। এদেশে সবচেয়ে নির্লজ্জ এবং প্রতিকারহীন শোষণ চলেছে নারীসমাজের ওপর। সমাজের অর্ধাংশকে পুরুষরা বন্দিনী করে রেখেছে। সেনসাস রিপোর্ট দেখেছেন নিশ্চয়, পুরুষের অনুপাতে মেয়েদের সংখ্যা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। আপনি অবলা দেবীর উপন্যাস ‘নারীর কথা’ পড়ে দেখুন। সেই নাইনটিনথ সেঞ্চুরি থেকে…’
‘আর বলতে হবে না। সব বুঝে গিয়েছি।’ ঘৃণায় এবং বিরক্তিতে সুধাময়ের সমস্ত শরীর জ্বলছে। বিনয়বাবু বিদায় নেবার পর সুধাময় হিসেব করতে লাগলেন ন’ রকম শোষকের কথা তিনি পর পর শুনে গেলেন। পৃথিবীর সমস্ত সুখ এরাই পরমানন্দে উপভোগ করে চলেছে—ভাগ্যহীন বঞ্চিতের কথা এদের একবারও মনে পড়েনি। এদের চিনিয়ে দিতে হবে—এদের সঙ্গে আপসের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
সুধাময় চোখ বুজছেন এবং মানস নেত্রে এক একটি শোষকের মুখ দেখতে পাচ্ছেন। তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।
বিশ্রামের জন্য সুধাময় ভিতরে যাচ্ছেন এমন সময় আর একজন অচেনা লোক সাহিত্যিক সুধাময়ের দর্শনপ্রার্থী হল। না, অচেনা লোকের সঙ্গে আর অযথা সময় নষ্ট করবেন না সুধাময়। নিশ্চয় অভিনন্দন জানাতে এসেছেন—বলা যায় না, লোকটা শোষকও হতে পারে। শোষকের পঙ্কিল হাতের ফুল সুধাময় কিছুতেই গ্রহণ করবেন না।
মেয়েকে সুধাময় নির্দেশ দিলেন, ‘বলে দাও, আজ আর দেখা হবে না।’
লোকটা বোধ হয় নাছোড়বান্দা। মেয়ে এসে বলল, ‘অনেক দূর থেকে এসেছেন, দু’মিনিটের জন্যে দেখা করতে চাইছেন।’ ভদ্রলোকের নাম লেখা স্লিপটা বাবার দিকে এগিয়ে দিল সুধাময়ের ছোট মেয়ে।
লোকটা ততক্ষণে বিনা অনুমতিতে ভিতরে এসে পড়েছে। স্লিপটার দিকে তাকিয়ে সুধাময় মুখ কুঞ্চিত করলেন।
‘আমি রাখহরি গাঙ্গুলি, বি এ, এই শহরেই থাকি। খবরের কাগজে আপনার ষাট বছর পূর্তির খবর দেখে ছুটে এলাম’।
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনি নিশ্চয় হিন্দু উচ্চবর্ণ?’
‘সে তো নাম থেকেই বুঝতে পারছেন, অস্বীকার করব কী করে?’
‘আপনি যখন বি এ পাশ তখন অবশ্যই শিক্ষিত এবং বুদ্ধিজীবী? এই শহরেই থাকেন তো আপনি?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘তাহলে আপনি শহরবাসী বাঙালি পুরুষ?’
‘হ্যাঁ।’
‘ইউরেকা! আমি ন’ জন শোষককে আলাদা আলাদা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি একের মধ্যেই নয় রয়েছেন। ইউ, রাখহরি গাঙ্গুলি, বি এ—আপনি হিন্দু হিসেবে মুসলমানের ওপর, শিক্ষিত হিসেবে অশিক্ষিতের ওপর, পুরুষ হিসেবে নারীর ওপর, শহুরে হিসেবে গ্রামবাসীর ওপর, বুদ্ধিজীবী হিসেবে শ্রমজীবীর ওপর, সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি হিসেবে উপজাতির ওপর, বর্ণহিন্দু হিসেবে নিম্নবর্ণের ওপর এবং বাঙালি হিসেবে অবাঙালির ওপর নির্লজ্জ শোষণ চালিয়ে যাচ্ছেন সেই নাইনটিনথ সেঞ্চুরি থেকে। আপনি নিশ্চয় ফুলে ফেঁপে জয়ঢাক হয়ে আছেন। সোনাদানায় আপনার ঘর ভরে আছে। নিশ্চয় গাড়ি চড়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আপনার মালা আমি নেব না।’
‘আমি মালা আনিনি, স্যার। আমি এসেছি অন্য কাজে। আমার কথা একটু শুনুন, আমি রাখহরি গাঙ্গুলি—ঢাকা থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলাম, বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জে। ওখানে সর্বস্ব খুইয়ে আসামে গিয়েছিলাম ইস্কুল মাস্টারি নিয়ে। সেখানে সর্বস্ব হারিয়ে এই কয়েকমাস আমি নৈহাটি বস্তিতে আছি—একটা প্রাইমারি ইস্কুলের চাকরি আমার ভরসা। আমার তিনটে মেয়ে। পোস্টাপিসে আমার পনেরো টাকা আছে। আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাতে আসিনি। আমি কাগজে পড়লাম আপনি দরদী সাহিত্যিক—সারাজীবন ধরে মানুষকে ভালবেসে ধন্য হয়েছেন আপনি। আপনি যদি আমার মেয়েকে কোনও একটা চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন তাহলে সারাজীবন আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।’ এই বলে হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগলেন হিন্দু, উচ্চবর্ণ, শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, শহরবাসী, বাঙালি পুরুষ শ্রী রাখহরি গাঙ্গুলি।
৫ এপ্রিল ১৯৮১