1 of 2

চোখের বালি ৪৮

৪৮
বিহারী যখন পশ্চিমে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, তখন তাহার মনে হইল, একটা-কোনো কাজে নিজেকে আবদ্ধ না করিলে তাহার আর শান্তি নাই। সেই মনে করিয়া কলিকাতার দরিদ্র কেরানিদের চিকিৎসা ও শুশ্রূষার ভার সে গ্রহণ করিয়াছে। গ্রীষ্মকালের ডোবার মাছ যেমন অল্পজল পাঁকের মধ্যে কোনোমতে শীর্ণ হইয়া খাবি খাইয়া থাকে, গলি-নিবাসী অল্পাশী পরিবারভারগ্রস্ত কেরানির বঞ্চিত জীবন সেইরূপ–সেই বিবর্ণ কৃশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভদ্রমণ্ডলীর প্রতি বিহারীর অনেক দিন হইতে করুণাদৃষ্টি ছিল–তাহাদিগকে বিহারী বনের ছায়াটুকু ও গঙ্গার খোলা হাওয়া দান করিবার সংকল্প করিল।
বালিতে বাগান লইয়া চীনে মিসিত্রর সাহায্যে সে সুন্দর করিয়া ছোটো ছোটো কুটির তৈরি করাইতে আরম্ভ করিয়া দিল। কিন্তু তাহার মন শান্ত হইল না। কাজে প্রবৃত্ত হইবার দিন তাহার যতই কাছে আসিতে লাগিল, ততই তাহার চিত্ত আপন সংকল্প হইতে বিমুখ হইয়া উঠিল। তাহার মন কেবলই বলিতে লাগিল, “এ কাজে কোনো সুখ নাই, কোনো রস নাই, কোনো সৌন্দর্য নাই–ইহা কেবল শুষ্ক ভারমাত্র।” কাজের কল্পনা বিহারীকে কখনো ইতিপূর্বে এমন করিয়া ক্লিষ্ট করে নাই।
একদিন ছিল যখন বিহারীর বিশেষ কিছুই দরকার ছিল না; তাহার সম্মুখে যাহা-কিছু উপস্থিত হইত, তাহার প্রতিই অনায়াসে সে নিজেকে নিযুক্ত করিতে পারিত। এখন তাহার মনে একটা-কী ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছে, আগে তাহাকে নিবৃত্ত না করিয়া অন্য কিছুতেই তাহার আসক্তি হয় না। পূর্বেকার অভ্যাসমতে সে এটা-ওটা নাড়িয়া দেখে, পরক্ষণেই সে-সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া নিষ্কৃতি পাইতে চায়।
বিহারীর মধ্যে যে যৌবন নিশ্চলভাবে সুপ্ত হইয়া ছিল, যাহার কথা সে কখনো চিন্তাও করে নাই, বিনোদিনীর সোনার কাঠিতে সে আজ জাগিয়া উঠিয়াছে। সদ্যোজাত গরুরের মতো সে আপন খোরাকের জন্য সমস্ত জগৎটাকে ঘাঁটিয়া বেড়াইতেছে। এই ক্ষুধিত প্রাণীর সহিত বিহারীর পূর্বপরিচয় ছিল না, ইহাকে লইয়া সে ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে; এখন কলিকাতার ক্ষীণজীর্ণ স্বল্পায়ু কেরানিদের লইয়া সে কী করিবে।
আষাঢ়ের গঙ্গা বহিয়া চলিয়াছে। থাকিয়া থাকিয়া পরপারে নীলমেঘ ঘনশ্রেণী-গাছপালার উপরে ভারাবনত নিবিড়ভাবে আবিষ্ট হইয়া উঠে; সমস্ত নদীতল ইস্পাতের তরবারির মতো কোথাও বা উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে, কোথাও বা আগুনের মতো ঝকঝক করিতে থাকে। নববর্ষার এই সমারোহের মধ্যে যেমনি বিহারীর দৃষ্টি পড়ে, অমনি তাহার হৃদয়ের দ্বার উদ্‌ঘাটন করিয়া আকাশের এই নীলস্নিগ্ধ আলোকের মধ্যে কে একাকিনী বাহির হইয়া আসে, কে তাহার স্নানসিক্ত ঘনতরঙ্গায়িত কৃষ্ণকেশ উন্মুক্ত করিয়া দাঁড়ায়, বর্ষাকাশ হইতে বিদীর্ণমেঘচ্ছুরিত সমস্ত বিচ্ছিন্ন রশ্মিকে কুড়াইয়া লইয়া কে একমাত্র তাহারই মুখের উপরে অনিমেষ দৃষ্টির দীপ্ত কাতরতা প্রসারিত করে।
পূর্বের যে জীবনটা তাহার সুখে-সন্তোষে কাটিয়া গেছে, আজ বিহারী সেই জীবনটাকে পরম ক্ষতি বলিয়া মনে করিতেছে। এমন কত মেঘের সন্ধ্যা, এমন কত পূর্ণিমার রাত্রি আসিয়াছিল, তাহারা বিহারীর শূন্য হৃদয়ের দ্বারের কাছে আসিয়া সুধাপাত্রহস্তে নিঃশব্দে ফিরিয়া গেছে–সেই দুর্লভ শুভক্ষণে কত সংগীত অনারব্ধ, কত উৎসব অসম্পন্ন হইয়াছে, তাহার আর শেষ নাই। বিহারীর মনে যে-সকল পূর্বসমৃতি ছিল, বিনোদিনী সেদিনকার উদ্যত চুম্বনের রক্তিম আভার দ্বারা সেগুলিকে আজ এমন বিবর্ণ অকিঞ্চিৎকর করিয়া দিয়া গেল। মহেন্দ্রের ছায়ার মতো হইয়া জীবনের অধিকাংশ দিন কেমন করিয়া কাটিয়াছিল। তাহার মধ্যে কী চরিতার্থতা ছিল। প্রেমের বেদনায় সমস্ত জল-স্থল-আকাশের কেন্দ্রকুহর হইতে যে এমন রাগিনীতে এমন বাঁশি বাজে, তাহা তো অচেতন বিহারী পূর্বে কখনো অনুমান করিতেও পারে নাই। যে-বিনোদিনী দুই বাহুতে বেষ্টন করিয়া এক মুহূর্তে অকসমাৎ এই অপরূপ সৌন্দর্যলোকে বিহারীকে উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছে, তাহাকে সে আর কেমন করিয়া ভুলিবে। তাহার দৃষ্টি তাহার আকাঙ্ক্ষা আজ সর্বত্র ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, তাহার ব্যাকুল ঘননিশ্বাস বিহারীর রক্তস্রোতকে অহরহ তরঙ্গিত করিয়া তুলিতেছে এবং তাহার স্পর্শের সুকোমল উত্তাপ বিহারীকে বেষ্টন করিয়া পুলকাবিষ্ট হৃদয়কে ফুলের মতো ফুটাইয়া রাখিয়াছে।
কিন্তু তবু সেই বিনোদিনীর কাছ হইতে বিহারী আজ এমন দূরে রহিয়াছে কেন। তাহার কারণ এই, বিনোদিনী যে-সৌন্দর্যরসে বিহারীকে অভিষিক্ত করিয়া দিয়াছে, সংসারের মধ্যে বিনোদিনীর সহিত সেই সৌন্দর্যের উপযুক্ত কোনো সম্বন্ধ সে কল্পনা করিতে পারে না। পদ্মকে তুলিতে গেলে পঙ্ক উঠিয়া পড়ে। কী বলিয়া তাহাকে এমন-কোথায় স্থাপন করিতে পারে, যেখানে সুন্দর বীভৎস হইয়া না উঠে। তাহা ছাড়া মহেন্দ্রের সহিত যদি কাড়াকাড়ি বাধিয়া যায়, তবে সমস্ত ব্যাপারটা এতই কুৎসিত আকার ধারণ করিবে, যে, সে সম্ভাবনা বিহারী মনের প্রান্তেও স্থান দিতে পারে না। তাই বিহারী নিভৃত গঙ্গাতীরে বিশ্বসংগীতের মাঝখানে তাহার মানসী প্রতিমাকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া আপনার হৃদয়কে ধূপের মতো দগ্ধ করিতেছে। পাছে এমন কোনো সংবাদ পায়, যাহাতে তাহার সুখস্বপ্নজাল ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, তাই সে চিঠি লিখিয়া বিনোদিনীর কোনো খবরও লয় না।
তাহার বাগানের দক্ষিণ প্রান্তে ফলপূর্ণ জামগাছের তলায় মেঘাচ্ছন্ন প্রভাতে বিহারী চুপ করিয়া পড়িয়া ছিল, সম্মুখ দিয়া কুঠির পানসি যাতায়াত করিতেছিল, তা-ই সে অলসভাবে দেখিতেছিল; ক্রমে বেলা বাড়িয়া যাইতে লাগিল। চাকর আসিয়া আহারের আয়োজন করিবে কি না জিজ্ঞাসা করিল–বিহারী কহিল, “এখন থাক্‌।” মিস্ত্রির সর্দার আসিয়া বিশেষ পরামর্শের জন্য তাহাকে কাজ দেখিতে আহ্বান করিল–বিহারী কহিল, “আর-একটু পরে।”
এমন সময় বিহারী হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া দেখিল, সম্মুখে অন্নপূর্ণা। শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া পড়িল–দুই হাতে তাঁহার পা চাপিয়া ধরিয়া ভূতলে মাথা রাখিয়া প্রণাম করিল। অন্নপূর্ণা তাঁহার দক্ষিণ হস্ত দিয়া পরমস্নেহে বিহারীর মাথা ও গা স্পর্শ করিলেন। অশ্রুজড়িতস্বরে কহিলেন, “বিহারী, তুই এত রোগা হইয়া গেছিস কেন।”
বিহারী কহিল, “কাকীমা, তোমার স্নেহ ফিরিয়া পাইবার জন্য।” শুনিয়া অন্নপূর্ণার চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল।
বিহারী ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কাকীমা, তোমার এখনো খাওয়া হয় নাই?”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “না, এখনো আমার সময় হয় নাই।”
বিহারী কহিল, “চলো, আমি রাঁধিবার জোগাড় করিয়া দিই গে। আজ অনেক দিন পরে তোমার হাতের রান্না এবং তোমার পাতের প্রসাদ খাইয়া বাঁচিব।”
মহেন্দ্র-আশার সম্বন্ধে বিহারী কোনো কথাই উত্থাপন করিল না। অন্নপূর্ণা একদিন স্বহস্তে বিহারীর নিকটে
সেদিককার দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। অভিমানের সহিত সেই নিষ্ঠুর নিষেধ সে পালন করিল। আহারান্তে অন্নপূর্ণা কহিলেন, “নৌকা ঘাটেই প্রস্তুত আছে, বিহারী, এখন একবার কলিকাতায় চল্‌।” বিহারী কহিল, “কলিকাতায় আমার কোন্‌ প্রয়োজন।” অন্নপূর্ণা কহিলেন, “দিদির বড়ো অসুখ, তিনি তোকে দেখিতে চাহিয়াছেন।”
শুনিয়া বিহারী চকিত হইয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিল, “মহিনদা কোথায়।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কলিকাতায় নাই, পশ্চিমে চলিয়া গেছে।” শুনিয়া মুহূর্তে বিহারীর মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। সে চুপ করিয়া রহিল।
অন্নপূর্ণা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই কি সকল কথা জানিস নে।” বিহারী কহিল, “ কতকটা জানি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানি না।”
তখন অন্নপূর্ণা বিনোদিনীকে লইয়া মহেন্দ্রের পশ্চিমে পলায়ন-বার্তা বলিলেন। বিহারীর চক্ষে তৎক্ষণাৎ জলস্থল-আকাশের সমস্ত রঙ বদলাইয়া গেল, তাহার কল্পনা-ভাণ্ডারের সমস্ত সঞ্চিত রস মুহূর্তে তিক্ত হইয়া উঠিল। “মায়াবিনী বিনোদিনী কি সেদিনকার সন্ধ্যাবেলায় আমাকে লইয়া খেলা করিয়া গেল। তাহার ভালো-বাসার আত্মসমর্পণ সমস্তই ছলনা! সে তাহার গ্রাম ত্যাগ করিয়া নির্লজ্জভাবে মহেন্দ্রের সঙ্গে একাকিনী পশ্চিমে চলিয়া গেল! ধিক্‌ তাহাকে, এবং ধিক্‌ আমাকে যে আমি মূঢ়–তাহাকে এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস করিয়াছিলাম।”
হায় মেঘাচ্ছন্ন আষাঢ়ের সন্ধ্যা, হায় গতবৃষ্টি পূর্ণিমার রাত্রি, তোমাদের ইন্দ্রজাল কোথায় গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *