1 of 2

চোখের বালি ০৪


রাজলক্ষ্মী তখন হঠাৎ অপরিমিত উৎসাহে বধূকে ঘরকন্নার কাজ শিখাইতে প্রবৃত্ত হইলেন। ভাঁড়ার-ঘর রান্নাঘর ঠাকুরঘরেই আশায় দিনগুলি কাটিল, রাত্রে রাজলক্ষ্মী তাহাকে নিজের বিছানায় শোয়াইয়া তাহার আত্মীয়বিচ্ছেদের ক্ষতিপূরণ করিতে লাগিলেন।
অন্নপূর্ণা অনেক বিবেচনা করিয়া বোনঝির নিকট হইতে দূরেই থাকিতেন।
যখন কোনো প্রবল অভিভাবক একটা ইক্ষুদণ্ডের সমস্ত রস প্রায় নিঃশেষপূর্বক চর্বণ করিতে থাকে তখন হতাশ্বাস লুব্ধ বালকের ক্ষোভ উত্তরোত্তর যেমন অসহ্য বাড়িয়া উঠে, মহেন্দ্রের সেই দশা হইল। ঠিক তাহার চোখের সম্মুখেই নবযৌবনা নববধূর সমস্ত মিষ্টরস যে কেবল ঘরকন্নার দ্বারা পিষ্ট হইতে থাকিবে, ইহা কি সহ্য হয়।
মহেন্দ্র অন্নপূর্ণাকে গিয়া কহিল, “কাকী, মা বউকে যেরূপ খাটাইয়া মারিতেছেন, আমি তো তাহা দেখিতে পারি না।”
অন্নপূর্ণা জানিতেন রাজলক্ষ্মী বাড়াবাড়ি করিতেছেন, কিন্তু বলিলেন, “কেন মহিন, বউকে ঘরের কাজ শেখানো হইতেছে, ভালোই হইতেছে। এখনকার মেয়েদের মতো নভেল পড়িয়া, কার্পেট বুনিয়া, বাবু হইয়া থাকা কি ভালো।”
মহেন্দ্র উত্তেজিত হইয়া বলিল, “এখনকার মেয়ে এখনকার মেয়ের মতোই হইবে, তা ভালোই হউক আর মন্দই হউক। আমার স্ত্রী যদি আমারই মতো নভেল পড়িয়া রস গ্রহণ করিতে পারে, তবে তাহাতে পরিতাপ বা পরিহাসের বিষয় কিছুই দেখি না।”
অন্নপূর্ণার ঘরে পুত্রের কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইয়া রাজলক্ষ্মী সব কর্ম ফেলিয়া চলিয়া আসিলেন। তীব্রকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী! তোমাদের কিসের পরামর্শ চলিতেছে।”
মহেন্দ্র উত্তেজিতভাবেই বলিল, “পরামর্শ কিছু নয় মা, বউকে ঘরের কাজে আমি দাসীর মতো খাটিতে দিতে পারিব না।”
মা তাঁহার উদ্দীপ্ত জ্বালা দমন করিয়া অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ধীর ভাবে কহিলেন, “তাঁহাকে লইয়া কী করিতে হইবে!”
মহেন্দ্র কহিল, “তাহাকে আমি লেখাপড়া শিখাইব।”
রাজলক্ষ্মী কিছু না কহিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন ও মুহূর্তপরে বধূর হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া মহেন্দ্রের সম্মুখে স্থাপিত করিয়া কহিলেন, “এই লও, তোমার বধূকে তুমি লেখাপড়া শেখাও।”
এই বলিয়া অন্নপূর্ণার দিকে ফিরিয়া গলবস্ত্র-জোড়করে কহিলেন, “মাপ করো মেজোগিন্নি, মাপ করো।
তোমার বোনঝির মর্যাদা আমি বুঝিতে পারি নাই, উঁহার কোমল হাতে আমি হলুদের দাগ লাগাইয়াছি, এখন তুমি উঁহাকে ধুইয়া মুছিয়া বিবি সাজাইয়া মহিনের হাতে দাও–উনি পায়ের উপর পা দিয়া লেখাপড়া শিখুন, দাসীবৃত্তি আমি করিব।”
এই বলিয়া রাজলক্ষ্মী নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া সশব্দে অর্গল বন্ধ করিলেন।
অন্নপূর্ণা ক্ষোভে মাটির উপর বসিয়া পড়িলেন। আশা এই আকস্মিক গৃহবিপ্লবের কোনো তাৎপর্য না বুঝিয়া লজ্জায় ভয়ে দুঃখে বিবর্ণ হইয়া গেল। মহেন্দ্র অত্যন্ত রাগিয়া মনে মনে কহিল, “আর নয়, নিজের স্ত্রীর ভার নিজের হাতে লইতেই হইবে, নহিলে অন্যায় হইবে।”
ইচ্ছার সহিত কর্তব্যবুদ্ধি মিলিত হইতেই হাওয়ার সঙ্গে আগুন লাগিয়া গেল। কোথায় গেল কালেজ, এক্‌জামিন, বন্ধুকৃত্য, সামাজিকতা; স্ত্রীর উন্নতি সাধন করিতে মহেন্দ্র তাহাকে লইয়া ঘরে ঢুকিল-কাজের প্রতি দৃক্‌পাত বা লোকের প্রতি ভ্রূক্ষেপমাত্রও করিল না।
অভিমানিনী রাজলক্ষ্মী মনে মনে কহিলেন, “মহেন্দ্র যদি এখন তার বউকে লইয়া আমার দ্বারে হত্যা দিয়া পড়ে, তবু আমি তাকাইব না, দেখি সে তার মাকে বাদ দিয়া স্ত্রীকে লইয়া কেমন করিয়া কাটায়।”
দিন যায়-দ্বারের কাছে কোনো অনুতপ্তের পদশব্দ শুনা গেল না।
রাজলক্ষ্মী স্থির করিলেন, ক্ষমা চাহিতে আসিলে ক্ষমা করিবেন, নহিলে মহেন্দ্রকে অত্যন্ত ব্যথা দেওয়া হইবে।
ক্ষমার আবেদন আসিয়া পৌঁছিল না। তখন রাজলক্ষ্মী স্থির করিলেন, তিনি নিজে গিয়াই ক্ষমা করিয়া আসিবেন। ছেলে অভিমান করিয়া আছে বলিয়া কি মাও অভিমান করিয়া থাকিবে।
তেতলার ছাদের এক কোণে একটি ক্ষুদ্র গৃহে মহেন্দ্রের শয়ন এবং অধ্যয়নেরস্থান। এ কয়দিন মা তাহার কাপড় গোছানো, বিছানা তৈরি, ঘরদুয়ার পরিষ্কার করায় সম্পূর্ণ অবহেলা করিয়াছিলেন। কয়দিন মাতৃস্নেহের চিরাভ্যস্ত কর্তব্যগুলি পালন না করিয়া তাঁহার হৃদয় স্তন্যভারাতুর স্তনের ন্যায় অন্তরে অন্তরে ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছিল। সেদিন দ্বিপ্রহরে ভাবিলেন, “মহেন্দ্র এতক্ষণে কালেজে গেছে, এই অবকাশে তাহার ঘর ঠিক করিয়া আসি, কালেজ হইতে ফিরিয়া আসিলেই সে অবিলম্বে বুঝিতে পারিবে তাহার ঘরে মাতৃহস্ত পড়িয়াছে।”
রাজলক্ষ্মী সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিলেন। মহেন্দ্রের শয়নগৃহের একটা দ্বার খোলা ছিল, তাহার সম্মুখে আসিতেই যেন হঠাৎ কাঁটা বিঁধিল, চমকিয়া দাঁড়াইলেন। দেখিলেন, নীচের বিছানায় মহেন্দ্র নিদ্রিত এবং দ্বারের দিকে পশ্চাৎ করিয়া বধূ ধীরে ধীরে তাহার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছে। মধ্যাহ্নের প্রখর আলোকে উন্মুক্ত দ্বারে দাম্পত্যলীলার এই অভিনয় দেখিয়া রাজলক্ষ্মী লজ্জায় ধিক্‌কারে সংকুচিত হইয়া নিঃশব্দে নীচে নামিয়া আসিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *