চুরি – সমরজিৎ কর
এ মন ঘটনাও যে কখনও ঘটতে পারে এ যেন ভাবা যায় না।
একেবারে কেঁচো খুঁড়তে সাপ!
সেদিন কলকাতার আকাশে যেন সমুদ্রের বান ডেকেছিল। সকাল থেকে সারাদিন অবিরাম বৃষ্টি। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। সারা শহরের পথ যেন এক-একটি ঢল নামা নদীর মতো। পথে কোনও লোক ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে কেই-বা আর ঘরের বাইরে পা দিতে চায়, বলুন?
রাত নামার সঙ্গে-সঙ্গে মনে হল যেন কোন অচিন দেশ। একটা শ্মশানের নিস্তব্ধতা। সর্বত্র।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী সদাশিব বসু তাঁর পড়ার ঘরে বসে গভীর মনে পড়াশুনো করছিলেন। আর মাঝে-মাঝে তাঁর সামনে বিছানো একটি ম্যাপের ওপর চোখ বোলাচ্ছিলেন। দক্ষিণ মেরুর ম্যাপ। দিন-পনেরো আগে আন্তর্জাতিক যে-বিশেষজ্ঞ দলটি দক্ষিণ মেরু থেকে ফিরে এল, সদাশিবও ওই দলের একজন সদস্য ছিলেন। ওঁরা অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন দক্ষিণ মেরুর বায়ার্ড অঞ্চলের বরফের পাহাড়ের নীচে। অদ্ভুত সে-পাহাড়। প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচু। আর তার নীচে প্রায় একশো ফুট চওড়া একটি সুড়ঙ্গ দিয়ে বয়ে চলেছে গরম জলের স্রোত।
সদাশিবের চোখেই ব্যাপারটা ধরা পড়েছিল প্রথম। তারপর সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন সবাই। আর অবাক হয়েছিলেন। এমন একটি পরিবেশে, যেখানে শুধু বরফ আর বরফ, শূন্যের একশো ডিগ্রি নীচে যে-বরফের তাপমাত্রা, সেখানেই এই গরম জলের উৎসটি কীভাবে এল, এ যেন কারও মাথার মধ্যেই ঢুকছিল না।
তাহলে এ-অঞ্চলের আশেপাশে, বরফের নীচে কি কোনও আগ্নেয়গিরি আছে, যে-আগ্নেয়গিরি এখনও জীবন্ত! যার গহ্বরের মধ্যে পুড়ে চলেছে লাভার স্তূপ আর সমুদ্রের জল! সেই জলই এইভাবে বেরিয়ে আসছে!
না, যথেষ্ট সন্ধান করেও বিশেষজ্ঞ দলটি সেখানকার আশেপাশে তেমন কোনও আগ্নেয়গিরির সন্ধান পাননি।
বলতে কী, ব্যাপারটা সদাশিবের সমস্ত চিন্তা-ভাবনাকে যেন গুলিয়ে দিয়েছে। কলকাতায় ফেরার পর গত পনেরো দিন একনাগাড়ে এ-বিষয়টি নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছেন তিনি। বইপত্র, দক্ষিণ মেরুর ম্যাপ এবং কাগজের ওপর আঁক কষা—এদের মধ্যেই ডুবে রয়েছেন।
রাত তখন এগারোটা।
আর-একবার ঝেঁপে বৃষ্টি এল।
এমন সময় গোকুল এসে বলল, ‘বাবু, কে এক উটকো সাহেব এয়েছেন। বলছেন, খুব জরুরি কাজ। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।’
‘এত রাতে সাহেব?’ কতকটা আত্মগতভাবেই যেন কথা বললেন সদাশিব। আচমকা এমন সময়ে এমন একটি খবর শুনে কে না বিরক্ত হয়, বলুন?
বললেন, ‘এত রাতে সাহেব? বললি না কেন, আমি এখন ব্যস্ত। এত রাতে কারও সঙ্গে দেখা করি না?’
গোকুল ভয়ে-ভয়ে বলল, ‘বলেছি তো। উনি শুনতে চান না। তেনার সঙ্গে আর-একজন সাহেব এয়েছেন। নাম জিগ্যেস করলাম। বললেন না।’
কী আর করা। এত রাতে দুজন যখন দেখা করতে এসেছেন, না দেখা করে উপায় বা কী?
সদাশিববাবু বললেন, ‘যা, নিয়ে আয়।’ খানিকটা বিরক্তই হলেন যেন। কিন্তু তখনও কি তিনি জানতেন, কী দারুণ কাণ্ড ঘটতে পারে এরপর?
একটু পরেই গোকুলের কথা শোনা গেল, ‘এই যে, ইদিকে আসুন আপনারা। বাবু পড়ার ঘরে রয়েছেন।’
আর তারপর পড়ার ঘরে যাঁরা ঢুকলেন, তাঁদের দেখে সদাশিববাবু তো রীতিমতো থ।
‘কী ব্যাপার? ডক্টর মেনন, ডক্টর সুখারিয়া, আপনারা হঠাৎ এমন সময়? বোম্বাই থেকে কখন এলেন আপনারা? কাল বিকেলেই তো ট্রম্বেতে বসে কথা বললাম আপনাদের সঙ্গে! কলকাতায় আসবেন, কই, তখন তো বলেননি? বসুন, বসুন।’
ওঁদের দেখে যেন লাফিয়ে উঠলেন সদাশিববাবু।
কিন্তু ওঁরা নির্বাক। সারা মুখে থমথমে ভাব। সদাশিববাবুর কথায় পুতুলের মতো চেয়ার টেনে বসলেন শুধু। বলতে কী, তখনও ওঁরা হাঁপাচ্ছেন।
ওঁদের অবস্থা দেখে সদাশিববাবুও প্রথমে খানিকটা ভড়কে গেলেন। তবে চিরদিনই তিনি শক্ত মানুষ। নানান ঝক্কি মাথায় করে কাজ করা তাঁর অভ্যেস। তাঁর এই পঞ্চাশ বছর বয়েসের মধ্যে বিপদেও পড়েছেন কয়েকবার। তাই পরিস্থিতি সামলে নিতে তাঁর কয়েক সেকেন্ড লাগল।
তবু ডক্টর মেনন এবং ডক্টর সুখারিয়ার মুখের চেহারা দেখে বুঝতে পারলেন, নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে। নইলে তাঁরা অমন পুতুলের মতো বসে পড়বেন কেন? কারণ, মেনন এবং সুখারিয়ার মতো তরুণ এবং বেপরোয়া বিজ্ঞানী খুব কমই দেখা যায়। সত্যি কথা বলতে কী, গত তিন বছর ধরে আরব সাগরের নীচে নেমে যেসব ভয়ঙ্কর-ভয়ঙ্কর গবেষণা তাঁরা করেছেন, সে যেন ভাবা যায় না। গতকাল ট্রম্বেতে তা নিয়ে কত কথা হল। বিশেষ করে সমুদ্রের নীচে থেকে তেল আবিষ্কার করতে গিয়ে মেনন তো একবার ডুবেই মরছিলেন আর কী।
আবহাওয়াটা একটু হালকা করার জন্যই বুঝি সদাশিববাবু বললেন, ‘কী খাবেন বলুন, চা না কফি?’
মেনন বললেন, ‘ওসব এখন থাক, ডক্টর বাসু। আজ দুপুরে একটি সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটে গেছে। আমাদের হাতে সময় কম। দয়া করে এই কাগজটা একটু দেখুন।’
বলেই মেনন ছোট্ট একটুকরো কাগজ সদাশিববাবুর সামনে মেলে ধরলেন।
একটি ম্যাপ। ম্যাপের একপাশে আঁকা কাম্বে উপসাগর থেকে বোম্বাই পর্যন্ত ভারতের পশ্চিম উপকূল। আর-একপাশে আরব সাগরের কিছু অংশ। আরব সাগরের মাঝে ছোটখাটো কয়েকটা দ্বীপ। আর কচ্ছ থেকে পশ্চিমে প্রায় একশো মাইল দূরে কয়েকটি কালো ফুটকি।
সদাশিববাবু সেই ফুটকিগুলির ওপর চোখ বোলাতে গিয়েই এক জায়গায় এসে যেন চমকে উঠলেন।
‘কেমন হল? কাল যখন এই ম্যাপটি আমায় দেখিয়েছিলেন, তখন তিনটি ফুটকির ওপর সাদা কালি দিয়ে ঢ্যারা কেটে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন তো দেখছি আরও একটি ফুটকির ওপর ঢ্যারা কাটা হয়েছে। এর মানে?’
‘মানে? মানে পরিষ্কার। আরও একটি কুয়ো শুকিয়ে গেল।’ বললেন মেনন।
‘এ যে রীতিমতো ভুতুড়ে কাণ্ড দেখছি! এত কষ্ট করে, এত টাকা খরচ করে আরব সাগরের নীচে আমরা নলকূপ বসালাম তেল পাব বলে। এর মধ্যে তিনটে কুয়োর কাজ পণ্ড হল। এখন দেখছি আবার একটা খতম। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, মশায়।’
ডক্টর সুখারিয়া এতক্ষণ চুপ করেই বসেছিলেন। সদাশিববাবুর কথা শুনে এবার তিনি যেন ফেটে পড়লেন, ‘বুঝতে কি আমরাই পারছি? অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, এবার সবাই আমরা ডুবব। আমাদের মান-সম্মান তো গেলই, সেইসঙ্গে কয়েকশো কোটি টাকা একবারে বরবাদ।’
বোঝা গেল, সুখারিয়া এসব দেখে রীতিমতো বসে পড়েছেন যেন।
বসে পড়ারই কথা। নিজের পরিকল্পনামতো তিনিই তো ওই গভীর নলকূপগুলি সমুদ্রের নীচে বসিয়েছিলেন। তখন কত আশাই না করেছিলেন তিনি! দেশে এখন আকাল চলছে। খরচ করতে-করতে কয়লা কমে যাচ্ছে। পেট্রল নেই। যেটুকু আছে, তাতে কতদিন আর চলবে! বিদেশ থেকে চড়া দামে তেল কেনা যেন এক সাংঘাতিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাগ্য ভালো। আরব সাগরের নীচে মাটির গভীরে পাওয়া গেল প্রচুর তেলের সন্ধান। সবাই ভেবেছিল, যাক, এ-যাত্রা তাহলে বাঁচা গেল। কয়েকটা কুয়োও খুঁড়লেন বিজ্ঞানীরা। সেই সব কুয়ো থেকে তেল তোলা হতে লাগল। চলছিল মন্দ না। কিন্তু তারপর কী যে হল, হঠাৎ একদিন দেখা গেল গবগব করে তেল বের হতে-হতে একটা কুয়ো চুপ মেরে গেল। তা থেকে কোনও তেলই আর বেরোল না। সবাই ভাবলেন, হয়তো সেখানকার তেল সব তোলা হয়ে গেছে। কিন্তু না! প্রথমে একটা, পরে আরও দুটো। এবার আরও একটা। পরপর চারটে কুয়ো একেবারে বন্ধ। ক্ষতি কম হল এতে?
এসব কথা ভাবতে গিয়েই তো সুখারিয়ার মাথা প্রায় খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা।
সদাশিব চিরদিনই শান্ত প্রকৃতির মানুষ। ডক্টর সুখারিয়ার কথা শুনে তিনি যে মোটেই বিচলিত হননি, বোঝা গেল। আসলে ব্যাপারটা যে কী ঘটছে তিনি বুঝতে পারছেন না।
ডক্টর মেনন বললেন, ‘আপনি একজন বিচক্ষণ মানুষ। আমাদের মনে হয়েছে, এ-ব্যাপারে আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারবেন, ডক্টর বাসু।’
সদাশিব বললেন, ‘কী বলতে চান আপনি?’
মেনন আর-একটুকরো কাগজ সদাশিবের দিকে এগিয়ে দিলেন।
কাগজটার ওপর কয়েক সেকেন্ড চোখ বুলিয়ে সদাশিব বললেন, ‘এ তো দেখছি একটা ভূমিকম্পের চার্ট। গত কয়েক মাসে কতবার ভূমিকম্প হয়েছে সেসব কথাই তো লেখা আছে এর ওপর?’
‘ঠিক। আপনি ঠিকই দেখেছেন, ডক্টর বাসু। এবার একটু ভালো করে লক্ষ করুন। শেষবারে যে-ভূমিকম্প হয়েছে তার তারিখটা একবার ভালো করে দেখুন তো!’ মেনন কথা বললেন।
সদাশিব কাগজটিকে আর-একবার ভালো করে দেখে বললেন, ‘এ তো আজকের তারিখ দেখছি!’
‘আপনি ঠিকই দেখেছেন। আজ, ঠিক বিকেল তিনটে তখন। আমাদের যন্ত্রে ওই কম্পন ধরা পড়ল। আর কী বলব আপনাকে, তার মিনিট-পনেরো পরেই এল সেই দুঃসংবাদ। ঠিক সোয়া তিনটের সময় আমরা খবর পেয়েছি, ওই যে ফুটকিটির ওপর ঢ্যারা দেখে আপনি চমকে উঠেছেন—মানে আরও একটি কুয়ো—সেটা থেকে নাকি তেল ওঠা বন্ধ হয়েছে।’
‘ভূমিকম্প! তারপর তেল ওঠা বন্ধ! কীসব বলছেন আপনি, ডক্টর মেনন?’
‘এখন আপনাকে নতুন কিছুই বলব না, ডক্টর বাসু। আমাদের ধারণা, কেউ একটা গোলমাল করছে। হয়তো আমাদেরই ভুল সেটা। দয়া করে এই চিঠিটা পড়ুন।’ বলেই মেনন আর-একখণ্ড কাগজ এগিয়ে দিলেন সদাশিবের দিকে।
এবার সদাশিববাবুরই তালগোল পাকানোর মতো অবস্থা। চিঠির ওপর একপলক চোখ বুলিয়েই তিনি দারুণ গম্ভীর হয়ে গেলেন।
‘তাহলে গোলমালটা বুঝলেন তো?’ কথা বললেন সুখারিয়া।
‘আমাকে কখন যেতে হবে?’ সদাশিব কথা বললেন যেন একমাসের দুর্বল রোগীর মতো।
‘এখনই।’ বললেন মেনন, ‘মেজর ইয়াসিন গাড়ি নিয়ে নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।’
‘চলুন।’
মাত্র পাঁচ মিনিট। হুট করে যখন-তখন বিদেশে যাওয়াটা সদাশিববাবুর কাছে জল-ভাত। ভৃত্য গোকুলও তা জানে।
সদাশিবের সংসারে গোকুল ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি বিয়েও করেননি। বলতে গেলে গোকুলই তাঁর কর্তা। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তিনি প্রস্তুত হয়ে নিলেন। গোকুল একটি ছোট্ট ব্যাগে টুকিটাকি জিনিসপত্র গুছিয়ে দিল। এ-সময়ে সদাশিব কথা বলেন কম। তবে আজ যেন পুরোপুরি তিনি বোবা হয়ে গেছেন।
এরপর দমদম বিমানবন্দর। ছোট্ট একটা মিলিটারি জেট প্লেন সেখানে অপেক্ষা করছিল। মেজর ইয়াসিনের সঙ্গে পুতুলের মতো গিয়ে উঠলেন প্লেনে—সদাশিব প্রথমে। পরে সুখারিয়া এবং মেনন। প্লেন ছাড়ল ঠিক রাত বারোটায়।
প্লেন ছাড়ার পর ইয়াসিন বললেন, ‘আপনাকে এখনও বলা হয়নি, ডক্টর বাসু। আমরা এখন পাঞ্জিম চলেছি। রাত দুটো নাগাদ পৌঁছব সেখানে।’
এ-পর্যন্ত কারও পেটে কিছু পড়েনি। একজন সেবক এসে সবাইকে খাবার দিয়ে গেল।
খাওয়ার পর মেননের দেওয়া কাগজগুলি নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন সদাশিব। মাঝে-মাঝে কীসব আঁক কষতে লাগলেন। সেইসঙ্গে মেননের দেওয়া ম্যাপটির ওপর চলল নানা ধরনের ছক আঁকার কাজ। সুখারিয়া, মেনন এবং মেজর ইয়াসিন চুপ করে বসে দেখতে লাগলেন শুধু।
হ্যাঁ, ঠিক রাত দুটোয় প্লেন এসে নামল পাঞ্জিমের বিমানবন্দরে। আর তারপরই শুরু হয়ে গেল রীতিমতো তোড়জোড়।
বিমানবন্দরে সবাইকে অভ্যর্থনা জানালেন কমোডোর সারথি। অভ্যর্থনা কী বলব? ‘কেমন আছেন?’ বলতে হয়, তাই বললেন। মুখখানি তাঁরও যেন ফ্যাকাসে মেরে গেছে। কারও মুখে কোনও কথা নেই।
‘আসুন আমার সঙ্গে।’ বলেই কমোডোর সারথি হনহন করে একটি ঢাকা গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
গাড়ি ছুটল জাহাজঘাটের দিকে।
তারপর জাহাজঘাট থেকে মোটরলঞ্চে মাঝদরিয়ায় দাঁড় করানো জাহাজ ঈগলে।
না। এতটুকু অবসর নেই। এরপর শুরু হল দারুণ ব্যস্ততা।
সদাশিব শুধু একবার বললেন, ‘এ যে দেখছি একেবারে যুদ্ধ করার মতো অবস্থা?’
‘দরকার হলে আমাদের তা-ও করতে হবে, ডক্টর বাসু।’ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন কমোডোর সারথি।
আর সত্যিই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল এরপর!
মাথার ওপর তারা ছড়ানো আকাশ। নীচে অন্ধকার পিচের মতো সমুদ্র। আরব সাগরের বুক চিরে ঈগল রওনা হল সোজা উত্তর-পশ্চিম বরাবর। পশ্চিম থেকে জাহাজে উঠল আরও প্রায় পঞ্চাশজন লোক। কয়েকজন ডুবুরি।
ডক্টর মেননকে একপাশে ডেকে জিগ্যেস করলেন সদাশিববাবু, ‘কোথায় যাচ্ছি তাহলে আমরা?’
ডক্টর মেনন বললেন, ‘দাঁড়ান, একটু পরেই আপনাকে সব বলব, ডক্টর বাসু। এ-জাহাজেরও কান আছে, একটু বেফাঁস হলেই সব পণ্ড। তার আগে ডেভিডের সঙ্গে আপনার একবার কথা বলা দরকার।’
‘ডেভিড? সে আবার কে?’ সদাশিব এবার অবাক হলেন।
‘একজন নাবিক।’ আস্তে করে কথা বললেন ডক্টর মেনন।
কিছুক্ষণ পর ছোট একটি কেবিনে এসে বসলেন মেনন, সুখারিয়া, কমোডোর সারথি এবং আর-একজন।
মেনন পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘এই হল ডেভিড, গোয়ায় বাড়ি।’
চমকে উঠলেন সদাশিব। এ কি মানুষ, না দানব? বয়েস কত হবে? বছর চল্লিশ? যেন একটা পাহাড়। তবে চোখ-মুখ দেখে মনে হল, এ-পাহাড়ের ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ই বয়ে গেছে।
মেনন বললেন, ‘বলো ডেভিড, ঠিক কী ঘটেছিল গতকাল, পরিষ্কার করে বলো দিকিনি।’
ডেভিড সঙ্গে-সঙ্গে কলের পুতুলের মতো কথা বলতে লাগল, ‘কী বলব, স্যার! দুঃখ, আমি একা বেঁচে আছি।’ বলেই অতবড় পাহাড়-মানুষটি হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।
মেনন তার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘একটু শান্ত হও, ডেভিডভাই, ডক্টর বাসু এসেছেন। তাঁকে পরিষ্কার করে বলো সব। কী করে কাজ করব আমরা?’
‘বলছি, হুজুর। তবে শুনুন।’ ডেভিড বলতে লাগল, ‘কী বলব আপনাদের, স্যার। মাছ। শুধু মাছ। আমি হলুম গিয়ে মাঝির ছেলে। আমার বাপ-ঠাকুদ্দা সবাই মাঝি। বলতে পারেন, ডাঙার থেকে সারা জীবনটা জলেই কাটিয়ে দিলাম বেশি। কিন্তু একসঙ্গে অত মাছ জীবনে কখনও দেখিনি। গতকাল, তা ধরুন, কত আর বেলা হবে তখন? এগারোটা। আমাদের মাছ ধরার খুদে জাহাজটা সেই মাছের ঝাঁক ঘিরে ধরল। হ্যাঁ, ওখানটায়।’
বলেই ডেভিড টেবিলের ওপর বিছানো ম্যাপটির ওপর হাত রাখল এক জায়গায়।
সদাশিববাবু জায়গাটি দেখে নিলেন।
‘দেখলেন তো, সাহেব? এইখানে রাজ্যের স্যামন, শার্ক, কতরকমের মাছের তখন জটলা। ফুর্তিতে আমাদের কী লাফানি। ভাবলাম, এবার ব্যবসাটা জমবে ভালো। অত মাছ বোম্বাই নিয়ে যাওয়ার পর টাকার ফোয়ারা ঝরবে। এইখানটায়—আমাদের সাধের জাহাজের ক্যাপ্টেন হল গিয়ে আমার বাবা, তার কথামতো মাল্লারা জাল ফেলতে লাগল। আর সেই জাল বয়ে নিয়ে আমরা তিন ভাই—আমি, জোসেফ আর বব—লোকলস্কর নিয়ে বিরাট সেই মাছের ঝাঁকটি ঘিরে ফেললাম। এসব করতে প্রায় ঘণ্টা-দুই লেগেছিল বোধহয়। তারপর ঠিক জালে টান দিয়েছি, অমনি বিশ্বাস করুন, স্যার, বাপের বয়েসে আরব সাগরে অতবড় ঢেউ আর কখনও দেখিনি। হ্যাঁ, সবকিছু নিমেষের মধ্যে ঘটে গেল। মনে হল, বাপের জাহাজটা কে যেন আকাশপানে ছুড়ে দিয়েছে। আর আমরা তিন ভাই মাল্লাদের নিয়ে তিনটে লঞ্চসমেত ছিটকে ছড়িয়ে পড়লাম। না, তখন কোনও কিছু দেখব কি, নিজের প্রাণ বাঁচাই আগে। কতক্ষণ এভাবে কেটেছিল জানি না। শুধু এটুকু মনে পড়ে, জাহাজটা টুপ করে সবাইকে নিয়ে দরিয়ার জলে ডুবে গেল। ভাইদেরও আশপাশে আর দেখতে পেলাম না। আর আমি? আমার লঞ্চের মাস্তুল বুকে জড়িয়ে আরবের জলে আমি ভাসছি।’
কমোডোর বললেন, ‘আর বেশি কথা নয়। এখন তুমি বিশ্রাম করো, ডেভিড।’
ডেভিডকে নিয়ে একজন নাবিক পাশের কেবিনে চলে গেল।
সুখারিয়া বললেন, ‘লোকটার মাথা খারাপই হয়ে গেল। বিরাট বড়লোকের ছেলে। কিন্তু কী হাল হয়েছে, দেখুন।’
কমোডোর বললেন, ‘লোকটার ভাগ্য ভালো। ওই সময় একটি হেলিকপ্টার নিয়ে সমুদ্রের ওই অঞ্চলে টহল দিতে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল কে যেন ভাসছে সাগরের জলে। অমনি হেলিকপ্টারকে নীচে নামিয়ে দেখলাম ডেভিড। ওকে উদ্ধার করে আমরা আমাদের এক গুপ্ত ঘাঁটিতে নিয়ে আসি। তবে হ্যাঁ, শক্ত বটে লোকটা। আধঘণ্টার মধ্যেই ওর জ্ঞান ফিরল। আর ওর মুখেই ঘটনাটা শুনে আমরা চমকে উঠলাম।…সঙ্গে-সঙ্গে ব্যাপারটা বাঙ্গালোরে জানিয়ে দিলাম। জানি না কেন, তার আধঘণ্টা পর পশ্চিম থেকে আমাদের বড়কর্তা জানালেন : ডেভিডকে নিয়ে একটি জেটে করে এখনই চলে আসুন। একটা মারাত্মক রকমের কিছু ঘটেছে বলেই আমাদের মনে হচ্ছে। খবর পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ডেভিডকে নিয়ে পশ্চিমে চলে এলাম।’
সদাশিব বসুর এবার তালগোল পাকানোর মতো অবস্থা। এতক্ষণ ধরে কী যে আবোল-তাবোল ঘটছে, তিনি বুঝতে পারছেন যেন।
মেনন বললেন, ‘এর পরের খবর আপনার বাড়িতে যে-চিঠিটি পড়তে দিয়েছিলাম তার মধ্যেই ছিল সব, তাই না, ডক্টর বাসু?’
সদাশিব ঘাড় নাড়লেন। তাঁর মনে পড়ল, চিঠিতে বলা হয়েছে, আরব সাগরে একটি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটেছে। এখনই আপনার সাহায্য চাই। চিঠি লিখেছেন প্রতিরক্ষা দপ্তরের একেবারে খোদ কর্তা। কিন্তু তাতে করে একবারও কি তাঁর মনে হয়েছিল, কী দারুণ ঝক্কি মাথায় নিয়ে তিনি মেনন আর সুখারিয়ার সঙ্গে এতটা পথ চলে এসেছেন?
একটু থেমে সদাশিববাবু বললেন, ‘আপনি যে-ম্যাপটি দেখিয়েছেন, ডক্টর মেনন, আর তার সঙ্গে কতকগুলি সংকেত, সেসব দেখে খানিকটা গোলমালে পড়েছি, বলতে পারেন। বিশেষ করে, এখনও কিন্তু আপনি আমাকে কিছু বলেননি, কী করতে হবে আমাকে।’
‘এক্ষুনি বলছি, ডক্টর বাসু।’
বলেই ডক্টর মেনন একটি সাদা কাগজের ওপর ছক টানলেন কয়েকটা : ‘শুনুন তাহলে। আরব সাগরের নাড়ি-নক্ষত্র আপনার জানা। বাকি কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আর তিন ঘণ্টা পর থেকেই অনেক কিছু আমরা জানতে পারব। আমরা আজ ম্যাপের ওই চার নম্বর ঢ্যারা কাটা ফুটকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আপনি শুধু ওই জায়গাটার নীচে সাগরের স্রোতটি কখন কোন দিকে চলছে এবং কীভাবে তাকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি—এসব জানিয়ে আমাদের একটু সাহায্য করবেন।’
মেমনের কথা শুনে সদাশিববাবুর চোখ তো একেবারে ছানাবড়া। তিনি আঁতকে উঠে বললেন, ‘বলেন কী, মশায়? ওখানে যে একটি ডুবোপাহাড় আছে। আর ওই পাহাড়ের তিন মাইলের মধ্যে যাওয়ার কথা মানে তো প্রাণ নিয়ে খেলা!’
‘জানি, আমাদের নৌ-বিভাগের দুখানি সাবমেরিন এরই মধ্যে খতম হয়ে গেছে। আপনারা আসার কিছুক্ষণ আগে আমরা খবর পেয়েছি।’ বললেন কমোডোর সারথি।
‘ঠিক কথা, এটাই হওয়া উচিত। কারণ, ডুবো ওই পাহাড়ের চারপাশে বনবন করে ঘুরছে একটা বিরাট ঘূর্ণি। তাকে ফুঁড়ে ভেতরে ঢোকা তো রীতিমতো শক্ত কাজ।’ বললেন সদাশিববাবু।
‘কিন্তু এতবড় একটা ঝক্কি নেওয়ার মানে কী, বলুন তো?’
‘আপনি তিন ঘণ্টা শুধু অপেক্ষা করুন, স্যার। ব্যাপারটা আর-একটু পরিষ্কার হোক আমাদের কাছে, তখন বলব।’
সারারাত কারও ঘুম হয়নি। ধকল গেছে অনেক। কমোডোর সৈনিক মানুষ। এসবে তাঁর অভ্যাস আছে। কিন্তু ওই ভদ্রলোকদের তো একটু বিশ্রাম দরকার। তাই বললেন, ‘এখন রাত প্রায় চারটে। আপনারা বিশ্রাম করে নিন কিছুক্ষণ। পরে কথা হবে।’
চার ঘণ্টা নয়। প্রায় আট ঘণ্টা পর আসল খবর এল ঈগল-এর রেডিও-যন্ত্রে। একে-একে খবর এল এইরকম : চার নম্বর দ্বীপের ডগাটি এবার স্পষ্ট দেখা গেছে। রেডারে ধরা পড়ছে, ওই দ্বীপের ডগা কে যেন উড়িয়ে দিয়েছে। আর তার আশপাশে যেসব বেগুনি রঙের আলোর ঝাঁকের কথা ডুবে-যাওয়া সাবমেরিন থেকে জানানো হয়েছিল, তারা ওই ডগার ওপর ভিড় করেছে। এখন মনে হচ্ছে অনেক আলো। আর শুধু বেগুনি নয়। লাল, হলুদ, এমনকী সূর্যের মতো উজ্জ্বল আলোও দেখা যাচ্ছে।
এসব খবর শুনে মেনন এবং সুখারিয়া লাফিয়ে উঠলেন। মেনন বললেন, ‘তাহলে বুঝুন, কমোডোর? কাল সন্ধেয় বাঙ্গালোরে বসে যখন ওইসব আলোর কথা শুনলাম, আমি অবাক হয়েছিলাম, মশায়। প্রাণিবিজ্ঞানী কবীর বলেছিলেন, ওরা নাকি এক ধরনের মাছের ঝাঁক! অমন আলো ওদের শরীর থেকে বেরোয়। সাধারণত ঘূর্ণির আবরণে ঢাকা ওই ধরনের জায়গায় ওরা নাকি ভিড় করে ডিম পাড়ার সময়। কথাটা শুনে তখন আমার যেন খটকা লেগেছিল।’
সুখারিয়া এবার কথা বললেন, ‘আলো-ফালো আমি বুঝি না, মশায়। দুটি জিনিস আমি দেখতে চাই। আমি জানি, আমি দেখতে পাব। আমার মনে হয়, এর আগেও ওই ধরনের ভূমিকম্প ঘটেছে তিনবার। তবে এবারকার এই জাহাজডুবির মতো কেলেঙ্কারি না ঘটায় কারও চোখে তেমন পড়েনি। তা ছাড়া, এবারকার কাঁপুনিটাও যেন জোরে হয়েছিল। আগের তিনটি কম্পনের পর যখন আমাদের তিনটি তেলের কুয়ো শুকিয়ে গেল, ব্যাপারটা নিয়ে খোঁজ করার জন্যে আমি দলবল নিয়ে সমুদ্রের নীচে নেমেছিলাম। গিয়ে কেমন সন্দেহ হল আমার। আমরা কি তাহলে ভুল করেছি? তিনটি কুয়োর নল যেখানে সাগরের নীচে মাটির কাছে গিয়ে মিশেছে সেখানে মাটির বুকে সরু একফালি করে ফাটল। মনে হল, চিড় ধরেছে সেখানে। আর সেসব চিড় সোজা চলে গেছে পশ্চিম দিক বরাবর। তা মাইল-পঞ্চাশ তো হবেই! আমরা আর এগোতে পারিনি। কারণ এক-একটা চিড় যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই দেখলাম ছোট-ছোট দু-তিনটি ডুবোপাহাড়। আর সেই পাহাড় ঘিরে বনবন করে ঘুরছে বড়-বড় এক-একটি ঘূর্ণি। মশায়, কার সাধ্য তার মধ্যে ঢোকে।’
অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী সদাশিববাবু সারা জীবন সমুদ্র নিয়েই গবেষণা করেছেন। বলতে কী, এ-তল্লাটের সাগরের নীচের গলিঘুঁজি তাঁর নখদর্পণে। কিন্তু এমন ধরনের ঘটনা আগে তো কখনও শোনেননি।
সুখারিয়াকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘ডক্টর সুখারিয়া, তাহলে বলুন, চার নম্বর কুয়োর কাছেও এবার একটি চিড় দেখা যাবে?’
‘আমার তো তাই মনে হয়, ডক্টর বাসু।’ সুখারিয়ার চটপট উত্তর।
‘তাহলে এ-কথাও বলবেন, সেই চিড় ওই আলোওয়ালা ডুবোপাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেছে?’
‘তাই তো মনে হয় আমার।’
‘আলোর রহস্য তাহলে কী হবে?’
এবার জবাব দিলেন ডক্টর মেনন, ‘ওরা মাছ নয়। তবে একটা জিনিস হতে পারে। এতদিন আমাদের ধারণা ছিল, আরব সাগরের নীচে কোনও আগ্নেয়গিরি নেই। এবার এতসব দেখে মনে হচ্ছে, আছে। সূর্যের মতো ওই আলো জ্বলন্ত লাভা নয় তো? কিংবা কিছু-কিছু রাসায়নিক পদার্থ আছে যাদের গা থেকে আলো বের হয়, যাকে আমরা বলি প্রতিপ্রভা। হয়তো তেমন সব পদার্থ ঘূর্ণির টানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সেইসঙ্গে দিচ্ছে নানারকম রঙের আলো?’
মিলিটারি মানুষ কমোডোর সারথি এতক্ষণ চুপ করে বসে বিজ্ঞানীদের তত্ত্ব শুনছিলেন। কিন্তু এবার যেন তাঁরও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল।
‘থামুন তো মশায়, আপনারা। জানি আপনারা বিজ্ঞানী। আপনাদের বুদ্ধি অনেক। তার তোড়ে যে আমার মাথা গুলিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা!’
বলেই কমোডোর একটা ছোট্ট কাগজ মেলে ধরলেন টেবিলের ওপর। কাগজের ওপর কয়েকটি ছক।
মেননের কথা শুনে সদাশিব খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন। লোকটা বলে কী! পাগল না মাথা খারাপ! আরব সাগরের নীচে আগ্নেয়গিরি আসবে কী করে! তারপর সেই আলোর চটকদার গল্প! এ-ও হয় নাকি? ডুবোজাহাজে চড়ে কতবার তিনি আরব সাগরের গভীরে গিয়ে ডুব দিয়েছেন। এমন কিছু কখনও তো তাঁর চোখে পড়েনি?
আর সেই ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটতে-না-কাটতেই যেন বোমা ফাটালেন কমোডোর সারথি।
কী বলতে চান তিনি?
‘হ্যাঁ, এই তো। ভালো করে দেখুন একবার।’ সারথি বলতে লাগলেন, ‘স্যার, গতকালের ঘটনার পর সমুদ্রের গভীরে গিয়ে বেতার তরঙ্গ ছুড়ে জায়গাটার হদিশ করেছেন আমার নৌ-বিভাগের অফিসাররা। ওঁরা জানিয়েছেন, যে-সমস্ত বেতার সংকেত ওই ভেঙে পড়া দ্বীপটির দিকে পাঠানো হচ্ছে—তাদের অনেকেই আর ফিরে আসছে না। যা আসছে, তাদের সবটুকু এলোপাথাড়ি অবস্থায় আসছে। এতে সন্দেহ হচ্ছে, কারা যেন সেখানে শক্তিশালী বেতার-যন্ত্র নিয়ে বসে আছে। সেই যন্ত্রের সাহায্যে আমাদের সংকেত নষ্ট করে দিচ্ছে।’
‘বলেন কী, কমোডোর?’ আঁতকে উঠলেন সুখারিয়া : ‘তাহলে কি—?’
সুখরিয়ার কথা শেষ না হতেই নতুন খবর এল আবার। নতুন যে-দলটি দ্বীপটির কাছে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছিল, এইমাত্র তারা খবর পাঠাল—অদ্ভুত কতকগুলি প্রাণীর মতো কী যেন সেই দ্বীপের চারপাশের ঘূর্ণি ভেদ করে কোথায় চলে গেল। অনুসন্ধানকারীরা ধাওয়া করেছিল ওদের ধরার জন্য। কিন্তু ধরতে পারেনি। এবং আরও একটা খবর : সেই আলোগুলি আর দেখা যাচ্ছে না। তবে টর্পেডোর সাহায্যে একটি প্রাণীকে ঘায়েল করা গেছে।
সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয়ে গেল রীতিমতো তোড়জোড়।
কমোডোর সারথি বললেন, ‘তাহলে আর দেরি করা নয়। চলুন, এখুনি আমরা রওনা হই।’
যুদ্ধজাহাজ ঈগলের ওপর জেট প্লেন প্রস্তুত ছিল। তাতে গিয়ে উঠলেন সদাশিব, সুখারিয়া, মেনন এবং কমোডোর। আর চার নম্বর সেই ফুটকির কাছে পৌঁছলেন তাঁরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই।
কমোডোর বললেন, ‘ভয় পাবেন না আপনারা। আমরা প্যারাশ্যুটে সমুদ্রে নামব। সেখানে একটি ডুবোজাহাজ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।’
বিশেষ ধরনের প্যারাশ্যুটে ওঁরা সমুদ্রে নামলেন। কাছেই ভাসছিল ডুবোজাহাজ। ওঁরা গিয়ে তাতে উঠলেন।
সমস্ত কিছুই এরপর চলতে লাগল দ্রুত লয়ে।
ডুবোজাহাজের ক্যাপ্টেন রামন বললেন, ‘অবাক কাণ্ড। কী সাংঘাতিক সেই প্রাণী আর কী জোরেই না তারা ছুটে পালাল! অমন প্রাণী আমরা কখনও দেখিনি। তবে একটিকে ঘায়েল করেছি আমরা। হয়তো তার দেহ ডুবোপাহাড়ের কাছেই পাওয়া যাবে।’
ডুবোজাহাজে করে তাঁরা ছুটলেন সেই দ্বীপের কাছে।
কিন্তু কোথায় ঘূর্ণি? সাধারণ সমুদ্রের স্রোত ছাড়া আর কিছুই তো চোখে পড়ল না!
ডুবোজাহাজের উজ্জ্বল আলো ফেলে তাঁরা তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলেন জায়গাটা। হ্যাঁ। ওই তো পাহাড়! পাহাড়ের ওপরটা ন্যাড়া কেন? মনে হল, কে যেন তার ডগাটা খাবলে তুলে নিয়েছে। আরে, আরে! এ কী! বড়-বড় লোহার চাঁই এল কোত্থেকে এখানে?
এমন সময় চিৎকার করে উঠলেন রামন, ‘ওই তো সেই প্রাণী!’
সঙ্গে-সঙ্গে ডুবোজাহাজ নিয়ে ছুটে গেলেন তাঁরা সেই প্রাণীটির কাছে।
‘প্রাণীর মতোই বটে!’ বললেন সদাশিববাবু।
‘দেখুন, দেখুন! এখানকার মাটির ওপর কেমন একটা চিড় বলে মনে হচ্ছে না?’ এবার সুখারিয়ার কণ্ঠে চিৎকার।
‘তাই তো!’
মেনন বললেন, ‘প্রাণীটিকে শেকল দিয়ে বেঁধে নিন। তারপর চলুন পাহাড়টার ডগায়।’
তাঁর কথামতো প্রাণীটিকে বেঁধে নেওয়া হল। কিন্তু পাহাড়ের ডগায় এসে সবাই যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।
কী ব্যাপার! এতবড় গর্ত এর ভেতরে! আর সেই পাহাড়ের গোড়ার চিড়-ধরা অংশটা গর্তের মধ্যে এসে মিশেছে কেন?
এবার ছবির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা।
সদাশিববাবু খানিকটা চুপ মেরে থেকে বললেন, ‘ডুবোজাহাজটাকে একবার চিড়ের কাছে নিয়ে চলুন তো।’
তাই করা হল।
এবার ডুবুরির পোশাক পরে নিয়ে মেনন এবং সুখারিয়াকে নিয়ে ডুবোজাহাজের বাইরে গিয়ে চিড় খাওয়া জায়গাটা পরীক্ষা করতে গিয়েই পরিষ্কার হল সব কিছু।
একটা নল। পুরু পলিথিনের নল। হ্যাঁ। ওই চিড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে এসেছে। এসে ঢুকেছে পাহাড়ের গহ্বরে।
সবাই যেন হাঁ হয়ে গেছেন। ওঁরা ফিরে এসে ডুবোজাহাজে উঠলেন।
কিন্তু ওই প্রাণীটা?
প্রাণী কোথায়? প্রাণীর মতো কিম্ভূত কিছু হয়তো দেখতে। আসলে সেটা শক্ত ইস্পাতের চাদরে তৈরি বিশেষ ধরনের একটি ডুবোজাহাজ। জাহাজটিকে পলিথিনের চাদর মুড়ে বিচিত্র রং করা হয়েছে।
ঘণ্টা-তিনেক পরিশ্রম করার পর ডুবোজাহাজটিকে নিয়ে তাঁরা হাজির হলেন একটি জাহাজে। খবর দেওয়াই ছিল। খবরমতো নৌ-বিভাগের একটি জাহাজ সেখানে এসে হাজিরই ছিল। টর্পেডোর ঘায়ে ডুবোজাহাজটির হাল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
জাহাজে সেই ডুবোজাহাজটি তোলার পর তার ভেতর থেকেই যেন বেরোল কেঁচো খুড়তে সাপ।
মেটা! এ যে বিরাট শিল্পপতি মেটার দেহ! মরে পড়ে আছে!
হ্যাঁ, বিখ্যাত তরুণ শিল্পপতি শিবশঙ্কর মেটার মৃতদেহই তাঁরা আবিষ্কার করলেন। আর তাঁর পকেট থেকে যে-একটুকরো কাগজ পাওয়া গেল, তার মধ্যেই সন্ধান মিলল আসল রহস্যের। সেই কাগজের লেখাগুলি ধরে অনুসন্ধান চালানোর পর সমস্ত কিছুই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।
তাহলে শেষপর্যন্ত কী দাঁড়াল?
‘চুরি। পুকুরচুরি নয়, মশায়। একেবারে যাকে বলে খনি চুরি।’ বললেন সদাশিব, ‘বুঝলেন না কী করেছে এই মেটা? বড়-বড় ডুবোপাহাড়ের মধ্যে গর্ত করেছে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। সেই গর্তকে সে ব্যবহার করতে চায় ট্যাঙ্ক হিসেবে। সেই বিস্ফোরণের জন্যেই আপনারা ভূমিকম্পন অনুভব করেছিলেন। আর ওই যে চিড়? দেখলেনই তো ওর নীচে আছে পলিথিনের মোটা-মোটা নল। ওই নল গিয়ে মিশেছে আমাদের সমুদ্রের নীচের তেলের খনির মধ্যে। ঠিক সেখানে, যেখানে তেল তোলার জন্যে আমরা কুয়ো খুঁড়েছি। আর পলিথিনের নল দিয়ে খনির তেল চুরি করে সে চাইছিল ডুবোপাহাড়গুলির মধ্যে জমিয়ে রাখতে। তারপর কত বড় ব্যবসা, বুঝুন একবার!’
‘কিন্তু ওই আলোর সারি?’ কথা বললেন ডক্টর মেনন।
‘ভাঁওতা, মশাই, ভাঁওতা। ওই সব দেখিয়েই তো শিবশঙ্কর আমাদের চোখে ধুলো দিতে চেয়েছিল।’
‘কিন্তু জলের ঘূর্ণি?’
‘এ-রহস্য বের করতে আমাদের সময় লাগবে। ওরা এমন কিছু যন্ত্র আবিষ্কার করেছে যা দিয়ে ওইরকম ঘূর্ণি সৃষ্টি করে বাইরের শত্রুকে বাধা দেওয়া যায়। মুশকিল হল, শিবশঙ্করকে আমরা পেলাম বটে, কিন্তু তার শাগরেদরা তো পালিয়ে গেল। কারা তারা? কী তাদের পরিচয়? এটা খুঁজে বের করাই হবে এখন আমাদের কাজ।
সদাশিববাবুর কথা শুনে সবাই চুপ।
কমোডোর সারথি শুধু বললেন, ‘সমুদ্রের তলা থেকে এমন বিপদও আসতে পারে! আমি ভাবতে পারছি না, মশায়।’
‘কিন্তু বুঝতে পারছি না শিবশঙ্করের সঙ্গীরা কেন পালিয়ে গেল?’ সুখারিয়ার প্রশ্ন।
সদাশিব বললেন, ‘শিবশঙ্করের পকেট থেকে পাওয়া কাগজটি পড়লেই বোঝা যাবে।’ বলেই কাগজটি পড়তে লাগলেন তিনি :
জলের ঘূর্ণির যন্ত্রটা বিগড়ে গেল। কেন বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে ভারতীয় নৌ-সেনাবিভাগ পেছনে লেগেছে। এখন এখান থেকে পালানোই উচিত।
ক্রাইম
পুজো সংখ্যা, ১৯৭৫