চুরিবিদ্যা
নাবালক বয়সে এ বিষয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। সম্ভবত সেটাই ছিল আমার প্রথম রম্যরচনা। এত বিষয় থাকতে ওই নিষ্পাপ বয়সে আমি কেন চুরিবিদ্যার উপরে আমার প্রথম গদ্যটি লিখেছিলাম সেটা যাঁর যেমন ইচ্ছে অনুমান করতে পারেন।
কিন্তু আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ওই লেখাটি লিখতে গিয়ে আমি প্রভূত আনন্দ পেয়েছিলাম। লিখতে লিখতে টের পেয়েছিলাম তস্করবৃত্তির প্রতি আমার একটা সহজাত টান রয়েছে। আজ এতদিন পরে ওই একই বিষয়ে আবার লিখতে বসে বুঝতে পারছি, টান যতটাই থাকুক, তখন আমি এ বিষয়ে প্রায় কিছুই জানতাম না। ইতিমধ্যে দীর্ঘ পঁচিশ বছরে সঙ্গদোষে এবং কালদোষে বহু বিখ্যাত তস্করের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে; অপর দিকে তস্করেরা এবং তস্করবান্ধব বহু কোতোয়াল সাহেবও আমার খুবই ঘনিষ্ঠ।
আমি আমার এই চুরিবিদ্যায় আপাতত শুধু খাঁটি চোরেদের কথা বলব, আসল ও আদি চোরের দুঃখের কথা। এর মধ্যে ঠগ-জোচ্চোর-প্রতারকদের টেনে আনব না, তার জন্য পরে কখনও সময় পেলে চেষ্টা করব।
চোর দুই রকম। একপুরুষের নতুন চোর অথবা বংশানুক্রমে বনেদি চোর-বংশের সন্তান।
এই একপরুষের নতুন চোরদেরই কষ্ট বেশি। আজকাল সিঁদকাঠি দুর্লভ যা দু’-একটা গভীর রাতের অন্ধকারে কামারশালার পিছনের ঝোপে লুকিয়ে থেকে মশার কামড় খেয়ে কিনতে হয় তারও দাম সাংঘাতিক। কিন্তু যাঁদের বাপ-ঠাকুরদা চোর ছিলেন, তাঁরা নিশ্চয় উত্তরাধিকারসূত্রে জার্মান স্টিলের সিঁদকাঠি পেয়েছেন, সে রকম আজকাল আর কোথায় পাওয়া যাবে? আর তা ছাড়া, এখনকার কাঁচালোহার সিঁদকাঠির উপর ঠিক নির্ভর করা যায় না। তিন ইটের গাঁথুনি দেয়ালের দুটো ইট মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খুলে ফেলেছেন এমন সময় সিঁদকাঠিটি গেল ভেঙে, তখন সব পরিশ্রমই মাটি। তবে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে আজ কিছুদিন হল এক দক্ষিণী চোর এসেছেন, তাঁর কাছে জানা গেছে মাদ্রাজ-মুম্বাইতে নাকি এখন স্টেনলেস স্টিলের সিঁদকাঠি পাওয়া যায়, সে যেমন সুন্দর দেখতে তেমনই মজবুত, দাম সামান্য বেশি। নতুন চোরেদের হয়তো এরপর থেকে সিঁদকাঠির সমস্যা থাকবে না।
কিন্তু অন্যান্য সমস্যা?
কালো হাফ প্যান্ট আর কালো স্যান্ডো গেঞ্জি পরে চুরি করতে যাওয়াই বহু পুরনো বিধি। কিন্তু কালো রংয়ের স্যান্ডো গেঞ্জি আজকাল একেবারেই পাওয়া যায় না, কেন যে গেঞ্জির কলগুলি এরকম গেঞ্জি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে পুলিশের কোনও যোগসাজস আছে কি না, বলা যায় না। অনেকে বাধ্য হয়ে সাদা গেঞ্জি কিনে দ্বিগুণ খরচ করে শালকরের কাছ থেকে কালো রং করিয়ে নিচ্ছেন। এতে শুধু পয়সা বেশি লাগছে তাই নয়, যে শালকরের কাছেই সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি কালো রং করতে দেওয়া হোক সে এমন মর্মভেদী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যে, সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় যে সে সবই অনুমান করতে পারছে।
তবে কালো হাফপ্যান্টের ব্যাপারটা একটু কম জটিল। কালো হাফপ্যান্ট চেষ্টা করলে বাজারে অল্পবিস্তর পাওয়া যায়। কিছু কিছু বিদ্যালয়ে সাদা হাফশার্ট আর কালো হাফপ্যান্ট ইউনিফর্ম রয়েছে। আর নতুন যুগের অতিরিক্ত ভিটামিন ও প্রোটিনে এবং সচ্ছল জনকজননীর ব্যাপক স্নেহে আজকাল বহু বালকই অতি নাদুসনুদুস, তাদের ইউনিফর্মের প্যান্ট যে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক তস্করকেই চমৎকার ফিট করে। একটা ছোট অসুবিধা রয়েছে যে প্যান্টের সঙ্গে ওই ইউনিফর্মের দোকান থেকে একটা সাদা হাফশার্ট এবং একজোড়া সাদা মোজাও কিনতে হয়।
এত খরচ না বাড়িয়ে হরিষা মার্কেটে অথবা কোনও মঙ্গলবার সময় করে হাওড়া হাটে গেলে শুধু কালো হাফপ্যান্টই সংগ্রহ করা যেতে পারে। একটা দুশ্চিন্তা থেকে যায়, অনেক সময় এসব প্যান্টের রং খুব কাঁচা থাকে। একবার ধুতে গেলে আর কালোত্ব থাকে না, কালো খড়ির গুঁড়োর মতো রং বেরয়, এমনিতে কাঁচা কিন্তু অন্য কোনও কাপড়-চোপড়ে লেগে গেলে সেখানে খুব পাকা, আর কিছুতেই উঠবে না।
চুরি করার তো সময়-অসময় নেই, স্থান-অস্থান নেই। একবার নতুন কালো হাফপ্যান্ট পরে একটা বাড়ির পিছনের রেনপাইপ ধরে ঝুলতে ঝুলতে একজন চোর গৃহস্থদের ঘুমানোর জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। এমন সময় প্রচণ্ড বৃষ্টি এল, বৃষ্টিতে ভিজে তার নতুন প্যান্ট থেকে কালো পিচ্ছিল এক তরল পদার্থ বেরতে লাগল। পিছল হয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর হাঁটু স্লিপ করতে লাগল, তিনি আর রেনপাইপ আঁকড়ে ধরে রাখতে পারলেন না, হড়কে নীচে পড়ে গেলেন।
আরেকবার আরেকজন ওইরকম একটা নতুন প্যান্ট একবার পরার পর কাচতে গিয়ে একপুকুর জল কালো করে ফেলেছিলেন। পাড়ার লোকেরা যেই বুঝতে পারল এটা তাঁরই কীর্তি, এই মারে কী সেই মারে!
আসলে এ ভাবে চলে না, চলতে পারে না। এই বত্তি থেকে ক্রমশ লোক সরে যাচ্ছে, নানা বাধা ও অসুবিধার জন্য এই প্রাচীন বিদ্যা ক্রমশ অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ধরা পড়া, মার খাওয়া অথবা জেলখাটা এগুলো সনাতন সমস্যা, যাকে ইংরেজিতে বলে নর্মাল প্রফেশনাল হ্যাজার্ড— এ তো থাকবেই, এ নিয়ে কোনও প্রকৃত চোর মাথা ঘামায় না।
কিন্তু চুরি করার পোশাক, সিঁদকাঠি— এগুলি হল আসল সমস্যা। তা ছাড়া, যেটা এখনও বলা হয়নি, গায়ে মাখা তেলের ব্যাপারটা আছে।
চুরি করতে গেলে গায়ে তেল মাখতেই হবে। এটা বহু পরীক্ষিত এবং সর্বসম্মত অতি পুরনো রীতি। দেহ তৈলাক্ত থাকার জন্য কত চোর যে আজ পর্যন্ত শেষমুহুর্তে রক্ষা পেয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।
তেল যে খুব বেশি লাগে তা নয়। সারা শরীরে তেল মাখতে নেই, সেটা অনেক সময় ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তেল মাখতে হয় ঊর্ধ্বাঙ্গে, দুই হাতে কবজি পর্যন্ত, বিশেষ করে ঘাড়ে, গলায় ও পিঠে। আর আজকালকার নতুন যুগের চোরেরা যারা পুরনোদের মতো কদমছাঁট দেন না, মাথায় মজা করে বড় চুল রেখেছেন, তাঁদের মাথার চুলেও তেল মাখাতে হবে।
আগেকার দিনে পাওয়া যেত ক্রিম রঙের বিলিতি গ্রিজ। কী ভাল জিনিস ছিল সেটা, আর কী চমৎকার মৌচাক-মৌচাক গন্ধ বেরত গ্রিজটা দিয়ে। আর দামও ছিল বেশ ন্যায্য। যাঁরা পুরনো চোর তাঁদের মনে আছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে পর্যন্ত নিউমার্কেটে ম্যাকফারলন সাহেবের দোকানে ক্রিমরঙা গ্রিজের এক পাইন্ডের কৌটো পাওয়া যেত ঠিক দেড় টাকায়। প্যাঁচপ্যাঁচে ছিল না, গা কুটকুট করত না। খুব সুবিধা ছিল এই গ্রিজটায়।
আর আজকাল ওইরকম গ্রিজ কোথায় পাওয়া যাবে! একালের চোরেরা ওসব জিনিস জন্মেও চোখে দেখেননি। তাঁরা গায়ে মাখেন পোড়া মবিল-অয়েল, তারও দাম এক বাটি তিন টাকা। সাংঘাতিক কুটকুটে এবং বিষাক্ত দ্রব্য এটি। এই পোড়া মবিলের কল্যাণে শত সহস্র নিরপরাধ তস্করের টাকায় চর্মরোগের ডাক্তারদের বিশাল রমরমাও চলছে। প্রায় সব চোরের গায়ে ঘা-পাঁচড়া, কিছুতেই সারতে চায় না। আর চুরির পরে ওই তেল শরীর থেকে তোলা কম কঠিন নাকি!
এর মধ্যে যাঁরা শৌখিন কিংবা বড়লোক চোর আছেন, তাঁরা কেউ কেউ গায়ে হোয়াইট ভেসলিন মাখতে শুরু করেছেন, কিন্তু তারও দাম চড়তে চড়তে এক ছোট কৌটো চার টাকা-সাড়ে চার টাকায় পৌঁছেছে!
অবস্থা ক্রমশ এমন জায়গায় পৌছাচ্ছে যে চৌর্যবৃত্তির দিকে এখন নতুন লোককে আকর্ষণ করানো রীতিমতো অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে আর পুরনো যাঁরা আছেন, জেলের বাইরে আছেন, তাঁরাও ক্রমশ এই রোমাঞ্চকর কাজে তাঁদের উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। যে উদ্দীপনা নিয়ে একদিন তাঁরা একটি সফল চুরির জন্য রাতের পর রাত অধীর প্রতীক্ষা করতেন এই দুর্দিনের বাজারে সেই উত্তেজনা আজ কোথায়!