চুক্তি – হিমাংশু সরকার
একটা বিরাট বড় বিদেশি গাড়ি এসে থামল একটা বড় জেলখানার দরজায়। গাড়ি থেকে নামলেন দুজন দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ প্রৌঢ়। বয়স তাঁদের পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ। পরনে মূল্যবান পোশাক। হাতে ব্রিফকেস। জেল-ফটকে তাঁরা পরিচয়পত্র মেলে ধরতেই প্রহরী স্যালুট করে ছোট দরজাটা খুলে ধরল।
একজন ছুটল সুপারকে খবর দিতে, আর-একজন দৌড়ে গিয়ে অফিসে খবর দিল জেলারসাহেবকে। জেলারসাহেব দ্রুত বেরিয়ে এসে তাঁদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। তাঁদের সসম্মানে নিয়ে এসে অফিসে বসালেন। চা আনতে বললেন।
আসন গ্রহণ করে তাঁরা ব্রিফকেস থেকে ভারত সরকারের সিল দেওয়া কতকগুলো কাগজপত্র বের করে জেলার সাহেবের সামনে ধরলেন।
জেলারসাহেব সাগ্রহে কাগজগুলো হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন। তাঁর চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। তিনি কাগজ থেকে মুখ তুলে প্রশ্ন করলেন, ‘এর সঙ্গে আপনাদের কী দরকার? লোকটা কনভিক্টেড আসামি নয়। বিচারাধীন।’
একজন প্রৌঢ় পাকা রাজনীতিবিদের মতো মিষ্টি হেসে বললেন, ‘আলোচনাটা আমরা তার সঙ্গেই করব। ব্যাপারটা সিক্রেট।’
দ্বিতীয়জন বললেন, ‘আলোচনা ফলপ্রসূ হলে আমরা আপনাদের আরও কিছু কাগজপত্র দেখাব।’
চা এল।
তার পিছন-পিছন ঢুকলেন সুপারসাহেব।
পরিচয় হওয়ার পর কাগজপত্র পরীক্ষা করলেন। জেলের আরদালিকে ডেকে বললেন, ‘দীপক চোপরাকে ইন্টারভিউ রুমে নিয়ে এসো।’
প্রথম প্রৌঢ় বললেন, ‘আমরা যখন কথা বলব, তখন সেখানে আর কেউ না থাকলেই ভালো। একজনকে, দয়া করে, দরজা থেকে পঁচিশ-তিরিশ হাত দূরে পাহারায় রাখবেন, যেন কেউ দরজার কাছে আসতে না পারে।’
চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে তাঁরা উঠে দাঁড়ালেন। স্বয়ং সুপারসাহেব তাঁদের ইন্টারভিউ রুমের দিকে নিয়ে চললেন।
দীপক জেলের জিমনাশিয়ামে ব্যায়াম করছিল। আরদালি ওকে খবর দিতেই ও অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘আমার সঙ্গে? ইন্টারভিউ করবার মতো আমার কোনও বন্ধু বা আত্মীয় নেই। তোমার ভুল হয়নি তো?’
আরদালি বলল, ‘আমরা যারা ভেতরে আছি, তাদের প্রত্যেকের এক অকৃত্রিম বন্ধু আছে। সেটা হল পুলিশ।’
‘পুলিশ? পুলিশ এসেছে দেখা করতে?’
‘তারই ভায়রাভাই। চলো। দেরি কোরো না।’
দীপক গামছা দিয়ে ঘর্মাক্ত শরীর মুছতে-মুছতে বেরিয়ে এল জিম থেকে।
ইন্টারভিউ রুমের দরজায় থমকে দাঁড়াল সে—সামনে বসা লোক দুজনকে দেখল। এরা পুলিশ তো বটেই। এবং আরও কিছু।
প্রৌঢ় ভদ্রলোক দুজন তাকে মোলায়েম ভাষায় অভ্যর্থনা করলেন। তাঁদের সঙ্গে করমর্দন করার সময় দীপক খুব ভালো করে তাঁদের চোখের দিকে তাকাল। সে-চোখ দেখে কিছু ধারণা করা সম্ভব নয়।
দীপক তাঁদের সামনে বসল।
দুজনেই দুটো আই-ডি কার্ড বের করে দীপকের সামনে ধরলেন। দীপক তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে কার্ড দুটো ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে বলল, ‘আমি আপনাদের দেখেই সেটা আন্দাজ করেছিলাম। সি. বি. আই. আমাকে ভেতরে পুরেছে কতকগুলো মিথ্যা অভিযোগে, যেগুলো কোনওদিনই কোর্টে প্রমাণ হবে না। এবার আপনারা এসেছেন রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং থেকে। বলুন, আপনাদের জন্যে কী করতে পারি?’
প্রথম ব্যক্তি বললেন, ‘আমার নাম হরপ্রসাদ শেঠি। আমার এই বন্ধুর নাম অর্জুন সিং।’
কথা শেষ করে তিনি ব্রিফকেস থেকে একটা ফাইল বের করে খুললেন। দীপক দেখল, প্রথমেই আছে বারো বাই দশ ইঞ্চি একটা ছবি। ছবিটা তারই।
একটা পাতা উলটে শেঠি বললেন, ‘তোমার নাম দীপক চোপরা?’
‘কারেক্ট।’
‘জন্ম….সালে? বাবার নাম রাজেশ চোপরা?’
‘নির্ভুল।’
‘তোমার ডান ঊরুতে একটা ক্ষতচিহ্ন আছে?’
‘আছে।’
‘তুমি সৈন্যবাহিনীতে ছিলে?’
‘ছিলাম।’
‘সৈন্যবাহিনীতে তুমি ছিলে বেস্ট স্নাইপার শুটার?’
‘একটা মেডেলও পেয়েছি।’
‘এখন তুমি বিভিন্ন লোকের হয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে রোজগার করো?’
‘লোকে বিপদে পড়লে আমাকে ভাড়া করে। কিন্তু আমি বেআইনি কিছু করি না।’
‘তুমি অবিবাহিত?’
‘বলতে পারেন, আমাকে কেউ বিয়ে করতে রাজি হয়নি। আমার বিষয়ে সমস্ত তথ্যই দেখছি আপনাদের কাছে আছে। এবার মূল কথাটা বলুন।’
‘তোমাকে একটা কথা দিতে হবে। আমাদের মধ্যে যে-আলোচনা হবে, সেটা তুমি কোনওদিনই কাউকে প্রকাশ করতে পারবে না।’
‘আমি প্রফেশনাল। আমাদের একটা এথিকস আছে। আপনি বলুন কী বলতে চান?’
‘আমরা, মানে RAW, তোমার সাহায্য চায়।’
‘আমার সাহায্য? আমাকে আপনারা জেলে বন্ধ করে রেখে সাহায্য চাইছেন! গ্রেট!’
‘তোমার বিরুদ্ধে সমস্ত চার্জ সি. বি. আই. উইথড্র করে নেবে। তোমাকে মুক্তি দিয়ে দেওয়া হবে। এবং খুব ভালোভাবে পুরস্কৃত করা হবে, যদি তুমি ভারত সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করো।’
‘কী ধরনের সহযোগিতা?’
শেঠি এবার তাকালেন অর্জুন সিং-এর দিকে।
অর্জুন সিং একগাল ধোঁয়া ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘ভারত, তোমার মাতৃভূমি, খুব বিপদে পড়েছে!’
‘এটা কলেজের ক্লাসরুম নয়। আপনি সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলুন।’
অর্জুন সিং-এর চোয়াল দুটো মুহূর্তের জন্য শক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু অসামান্য দক্ষতায় নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, ‘একটি শক্তিশালী বিদেশি রাষ্ট্র, যারা কিনা আমাদের বন্ধুরাষ্ট্ররূপে পরিচিত, এখানে গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছে। বেশ বড় জাল বিছিয়েছে। আমাদের একটি শত্রুরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের আঁতাত আছে। খুব দহরম-মহরম। এখান থেকে গোপন সংবাদ ইত্যাদি সংগ্রহ করে এরা চালান করছে সেই শত্রুরাষ্ট্রকে। এতে ভারতের কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে, তা তুমি সহজেই অনুমান করতে পারো। যে-করেই হোক এটা বন্ধ করতে হবে এবং এই গুপ্তচর চক্রটা ভেঙে দিতে হবে। RAW এবং সি. বি. আই. সে-কাজটা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইতিমধ্যে যেসব তথ্য তাদের হাতে চলে গেছে, সেটার জন্যে ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। সবচেয়ে বড় বিপদ ঘটেছে গতকাল। এই শত্রুরাষ্ট্রের সঙ্গে যে-কোনওদিন আমাদের যুদ্ধ বাধতে পারে। কিন্তু গতকাল প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে একটা গোপন তথ্যের ফাইল চুরি গেছে।’
‘বাঃ! চমৎকার। এই না হলে প্রতিরক্ষা দপ্তর!’
‘কোনও একজন রাষ্ট্রদ্রোহী এ-কাজ করেছে। এ-দেশে অনেক লোক এবং অনেক বিরোধী নেতা আছে, যারা ওই শক্তিশালী রাষ্ট্রের দ্বারা প্রভাবিত এবং তার সমর্থক। যাই হোক, ফাইলটা চুরি যাওয়ায় ভারতের অপরিসীম ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা। বিশেষত, যুদ্ধ যদি বাধে, তাহলে ভারতের পরাজয় নিশ্চিত।’
‘একটা সিগারেট হবে?’ কথার মাঝখানে দীপক বলল।
‘অ্যাঁ? ও হ্যাঁ, সিগারেট আছে।’
শেঠি একটা সিগারেট বের করে দীপককে দিলেন। আগুন জ্বেলে ধরলেন দীপকের জন্য। দীপক সিগারেট ধরিয়ে ঘন-ঘন টানতে লাগল।
অর্জুন সিং খানিকক্ষণ দীপককে দেখলেন, তারপর ধীর স্বরে বললেন, ‘যে-করেই হোক, ফাইলটা আমাদের উদ্ধার করতে হবে।’
দীপক প্রশ্ন করল, ‘কোথা থেকে? এভারেস্টের শৃঙ্গ না ভারত মহাসাগরের তলা থেকে?’
‘আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সেটা আছে ওই রাষ্ট্রের দূতাবাসের ভেতর সেফ-ভল্টে। সেটাকে পাচার করার চেষ্টা হবে বা প্রতিটি জিনিসের মাইক্রোফিল্ম তৈরি করে সেটা পাচার করা হবে। তারপর ফাইলটা নষ্ট করে ফেলা হবে। এসব হওয়ার আগেই ফাইলটা উদ্ধার করতে হবে। এবং সি. বি. আই. ও RAW অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছে যে, এ-কাজ করতে পারে মাত্র একজন। সেই একজন হলে তুমি।’
‘আমি কেন?’
‘তুমি এ-ধরনের কাজে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছ। তুমি প্রফেশনাল।’
‘সি. বি. আই.-এর অফিসাররা কি প্রফেশনাল নয়? তাদের একজনকে পাঠাতে পারেন না?’
‘সে-ক্ষেত্রে রিস্ক আছে। ধরা পড়লে, অফিসারের পরিচয় প্রকাশ পাবেই। তাহলে শুধু ওই রাষ্ট্র নয়, আরও অনেক রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটবে এবং একটা আন্তর্জাতিক কেলেঙ্কারি হবে। বিশ্বের নজরে ভারত অনেক ছোট হয়ে যাবে। কারণ, তখন কথা উঠবে যে, ভারতই গুপ্তচর পাঠিয়েছিল ওই রাষ্ট্রদূত ভবনে।’
‘আমি যদি ধরা পড়ি?’
‘তোমার ব্যাপারটা আলাদা। তুমি যদি এ-কাজ করতে রাজি হও, তাহলে তোমাকে আমরা সঙ্গে করে নিয়ে যাব, এই ব্যাপারে আরও কিছু তথ্য সরবরাহ করার জন্যে। কিন্তু কাল সকালের সমস্ত কাগজে তোমার ছবিসমেত এই খবর ছাপানো হবে যে, তুমি জেল থেকে পালিয়েছ। তোমাকে ধরে দিতে পারলে, পুরস্কার দেওয়া হবে। পৃথিবী জানবে যে, তুমি একজন সমাজবিরোধী। কাজেই ধরা পড়লে, ভারত সরকার তোমার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক অস্বীকার করবে। এবং সারা জীবন তুমি জেলের ভেতর কাটাবে।’
দীপক বলল, ‘সুন্দর। খুব ভালো। কিন্তু ধরুন, ওপরওয়ালা আমার প্রতি অসীম দয়ালু হয়ে উঠলেন এবং আমি ধরা পড়লাম না। তাহলে?’
‘সেটাই আমরা চাইছি। আমাদের হাতে প্রমাণ আসবে। আমরা ওই রাষ্ট্রের মুখোশ খুলে দেব। দেশের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে। এবং…।’
‘আমার কী হবে?’
‘তুমি পাবে বীরের সম্মান। যথেষ্ট আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হবে তোমায়। দেশের সমস্ত বড়-বড় পত্রিকায় তোমার ছবিসমেত এই কাহিনি ছাপা হবে। তোমার লাভ হবে। তুমি অনেক খদ্দের পাবে। এবার বলো, তুমি রাজি আছ কি না।’
দীপক আর-একটা সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধরাল। ঘন-ঘন টান দিতে লাগল। ওর এখন উভয়সঙ্কট। এ-প্রস্তাব গ্রহণ করা ছাড়া ওর সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই। ও বলল, ‘আমি এ-কাজ করতে রাজি আছি। পুরস্কারের অর্ধেক টাকা আমায় অ্যাডভান্স দিতে হবে।’
তাঁরা রাজি হলেন। দীপক গাড়িতে উঠে বসল। ও জানতেই পারল না, ওর জেল থেকে পালানোর কাহিনি সেদিনের সকালের কাগজেই বেরিয়ে গেছে।
শেঠ বদ্রীপ্রসাদ এক বিরাট পয়সাওয়ালা লোক। থাকেন ছোট শহরে, কারণ তাতে তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। ছোট শহরের চারদিকে ছোট-ছোট গ্রাম। সেইসব গ্রামে তাঁর নিজের নামে এবং বেনামিতে আছে প্রচুর জমি। তাঁর অনেকরকমের ব্যবসা। কিন্তু তাঁর প্রধান ব্যবসা হল স্মাগলিং এবং সুদের ব্যবসা। সকলেই তাঁকে ভয় করে।
সেদিন সকালে তাঁকে দেখলেই বোঝা যেত যে, তিনি খুব চিন্তিত। তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ সামনে টেবিলের ওপর বিস্তৃত খবরের কাগজের ওপর। প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়েছে একজন তরুণের ছবি। নীচে ছাপা হয়েছে এক দুঃসাহসিক কাহিনি। কী করে এই যুবক দীপক চোপরা একটি বিদেশি রাষ্ট্রের কুকীর্তি উদঘাটিত করেছে। কী করে ভারতের প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে চুরি যাওয়া একটি খুব মূল্যবান ফাইল উদ্ধার করেছে।
যুবক বুদ্ধিমান, সাহসী এবং নিখুঁত প্রফেশনাল। এগুলো বুঝতে শেঠজির কোনও অসুবিধে হয় না। তিনি এই ধরনের একজনকে খুঁজছিলেন। এই যুবকই পারে তাঁকে সাহায্য করতে। তাঁর মান-সম্মান রক্ষা করতে।
তাঁর পাপ-কাজের সঙ্গী, তাঁর ডানহাত রাজু। রাজুকে তিনি ডাকলেন। এবং বললেন, ‘আজকের কাগজে এই ছবিটা দেখেছ?’
রাজু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘কাহিনিটাও পড়েছি। আমি নিজেই আসছিলাম আপনাকে এ-ব্যাপারে কিছু বলতে।’
বদ্রীপ্রসাদ বললেন, ‘তোমার কি মনে হয়, লোকটা পারবে এ-কাজ করতে?’
‘লোকটা প্রফেশনাল এবং একটা সাংঘাতিক কাজ করেছে।’
‘কিন্তু লোকটা যে-ঠিকানা কাগজে দিয়েছে, সত্যিই সেটা ওর ঠিকানা তো? নামটাও আসল নাম কি না কে জানে?’
‘তাতে আমাদের ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। আমাদের কাজ হলেই হল।’
‘তাহলে তুমি চলে যাও বোম্বাই। যে-করে হোক, লোকটাকে খুঁজে বের করে নিয়ে এসো। আমি ওকে আগে দেখতে চাই। যদি সন্তুষ্ট হই, তাহলে আমি নিজেই প্রস্তাব দেব।’
রাজু উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বলল, ‘আমার মনে হয়, আমাদের কাজ করার জন্যে এই লোকটাই উপযুক্ত। আমি ওকে নিয়ে আসব।’
শেঠজি বললেন, ‘যে-করে হোক তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমার মান-ইজ্জত বাঁচাতে হবে।’
রাজু বলল, ‘আমারও মান-ইজ্জত এতে জড়িত।’
একটু অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকালেন শেঠজি।
রাজু বলল, ‘আমি চিরদিন আপনার সঙ্গে থেকেছি, আপনার সমস্ত কথা শুনেছি, কারণ আপনি আমায় একটা কথা দিয়েছিলেন। আপনার নিশ্চয় মনে আছে সেটা?’
শেঠজি খানিকক্ষণ রাজুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বিদ্যার কথা বলছ? হ্যাঁ, আমি সে-কথা ভুলিনি। তুমিই আমার উপযুক্ত উত্তরাধিকারী। এবার যাও।’
বোম্বাইয়ের একটা পাঁচতারা হোটেলে এসে উঠল রাজু। সারাদিন ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজল। কিন্তু কোথাও দীপকের দেখা পেল না। শেষে হোটেলের রিসেপশান ডেস্কে গিয়ে খোঁজ করল। সেখানে জানতে পারল, দীপক চোপরা নামে কোনও লোক সেখানে ছিল না।
রাজু শেষে একটা বেয়ারাকে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে দীপকের ছবিটা দেখিয়ে প্রশ্ন করল যে, লোকটা এ-হোটেলে আছে কি না। কারণ, কাগজে সে এই হোটেলের ঠিকানাই দিয়েছে।
বেয়ারা বলল, ‘ওই লোকটা এ-হোটেলে ছিল। কিন্তু ওর নাম তো দীপক চোপরা নয়। ওর নাম তো কৃষ্ণস্বামী।’
ভ্রকুঞ্চিত হয়ে গেল রাজুর। একটু ভেবে বলল, ‘একে কোথায় পাব?’
‘সেটা বলা মুশকিল। গতকাল এ-হোটেলে ছিল। এতবড় বোম্বাই শহরে কাউকে কি খুঁজে পাওয়া যায়?’
রাজু আরও কতকগুলো বড়-বড় হোটেল ঘুরল। খাতায় ওই নাম পাওয়া গেল না। ছবিটা সকলেই চিনল, কিন্তু তাকে কোথাও দেখেছে বলে কেউ স্বীকার করল না। রাজু খানিকটা বিরক্ত এবং হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবল।
কিন্তু রাজু আমোদ-প্রমোদ পছন্দ করত। ঠিক করল, আরও দিন-তিনেক সে বোম্বাইয়ে থেকে জীবনটা ভোগ করবে।
বোম্বাইয়ে তাদের স্মাগলিংয়ের এজেন্ট ছিল। প্রকাশ মেহেরার সঙ্গে তার বেশ ভাব ছিল। সে মাঝে-মাঝে বোম্বাইয়ে এসে প্রকাশের সঙ্গে বোম্বাইয়ের রাতের জীবন উপভোগ করত।
আজও সে প্রকাশের কাছে এল। বলাই বাহুল্য, প্রকাশ খুশি হল তাকে দেখে। লম্বা গ্লাসে খানিকটা বিদেশি হুইস্কি দিয়ে প্রকাশ তাকে আপ্যায়ন করল।
দ্বিতীয়বার গ্লাসে হুইস্কি নিয়ে রাজু বলল, ‘আজ, কাল এবং পরশু আমি এখানে আছি। তুমি প্রোগ্রাম ঠিক করো।’
‘নো প্রবলেম। আজই চলো। একটা ভালো মায়ফিল বসছে আজ। লক্ষ্নৌ থেকে এসেছে বিখ্যাত বাঈজী সুর্মা বাঈ। খুব ভালো গায়। দিল খুশ করে দেবে।’
‘জিনিস কেমন?’
‘এ-ওয়ান। মাথা ঘুরে যাবে। অনেক রাজা-মহারাজার মাথা ঘুরিয়ে বোম্বাই এসেছে।’
‘পাওয়া যাবে?’
‘দাম দিলে সবই পাওয়া যায়।’
‘তাহলে চলো। যাওয়া যাক।’
দুজনে উঠে পড়ল।
যারা নৈশ জীবন উপভোগ করতে অভ্যস্ত, তারা সুর্মা বাঈয়ের নাম জানত। তাদের কেউ-কেউ গান-বাজনা ভালোবাসে। তাদের অনেকেই আজ একে-একে সুর্মা বাঈ যে-বাড়িতে আসর বসাচ্ছে, সেখানে এসে জমা হচ্ছে। বলাই বাহুল্য, খুব পয়সাওয়ালারাই এখানে আসতে পারে।
প্রকাশ মেহেরার প্রভাব-প্রতিপত্তি এ-অঞ্চলে কম নয়। সকলেই জানে, সে একজন পয়সাওয়ালা লোক।
রাজুকে নিয়ে সে আসরে আসতেই একটি মেয়ে তাদের দুজনকে কুর্নিশ করে বেশ ভালো জায়গায় বসিয়ে একটা ট্রেতে বোতল এবং গ্লাস সাজিয়ে তাদের সামনে রাখল। আসরে ইতিমধ্যে আরও দু-তিনজন এসে গেছেন।
একটু পরে আসর শুরু হল। আসরে প্রথমে এল একটি কমবয়েসি মেয়ে। যেন মুখপাত ধরিয়ে দেবে আসরের।
মেয়েটি মন্দ গাইল না।
তারপর ঢুকল সুর্মা বাঈ।
সমস্ত আসরটা ঝলমল করে উঠল। তার রূপের ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার অবস্থা। মাঝখানে অপরূপ ভঙ্গিতে বসল সে।
রাজু মদের গ্লাসটা হাতে তুলে নিল। চুমুক দিল ধীরে-ধীরে। দৃষ্টি নিবদ্ধ সুর্মা বাঈয়ের মুখের ওপর।
সুর্মা বাঈ সকলের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে কুর্নিশ করতে-করতে রাজুর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
রাজু খুশি হয়ে একটা লম্বা চুমুক দিল গ্লাসে। আর তখনই তার চোখ পড়ল দরজার দিকে। লম্বা মূর্তিটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভেতরের সকলের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিচ্ছে।
রাজু যাকে সারা শহরে খুঁজে বেড়াচ্ছে, সেই দীপক নিজেই এসেছে।
সেই মেয়েটি দীপককে একটি আসনে এনে বসাল। দীপকের সুদৃঢ় স্বাস্থ্যের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল সুর্মা বাঈ। তারপর ওকে কুর্নিশ করে মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে গান ধরল।
গানের সঙ্গে-সঙ্গে অসামান্য নাচ।
রাজু একবার দীপককে দেখছে এবং একবার নাচ দেখার ভান করছে। তার সব নেশা উবে গেছে।
ঘরে ঢুকল আর-একজন সঙ্গীতপিপাসু। তারও শরীর মজবুত এবং সুগঠিত। কিন্তু তাকে দেখলেই মনে হয়, সে যেন কেমন বেমানান এ-আসরে।
রাজু দেখল, দীপক এই আগন্তুককে বারকয়েক ভালো করে দেখল। আবার দীপক যখন মুখ ফিরিয়ে নাচ দেখছে, তখন আগন্তুক দীপককে ভালো করে দেখতে লাগল।
রাজু আর বসল না। গানের মাঝখানেই সে উঠে বেরিয়ে এল। রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই প্রকাশ এসে তার পাশে দাঁড়াল। রাজু তাকে বলল যে, তার একটা জরুরি কাজ আছে, সেটা মনে ছিল না। প্রকাশ মজলিশে ফিরে যাক, সে প্রকাশের গাড়িটা শুধু রাতের জন্য ধার নিতে চায়।
প্রকাশ আপত্তি না করে ফিরে গেল। রাজু গাড়িতে এসে বসল। পরপর কয়েকটি গান গাইবে সুর্মা বাঈ। তারপর হয়তো দীপক বেরোবে। তাকে অনুসরণ করে তার ডেরায় গিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় করতে হবে।
রাস্তা একেবারে ফাঁকা। জনপ্রাণী নেই। শুধু ওপরের ঘর থেকে সুর্মা বাঈয়ের গানের রেশ ভেসে আসছে।
গাড়িতে বসে রাজু অপেক্ষা করতে লাগল।
একটু পরেই অবাক হয়ে দেখল, গান শেষ হওয়ার আগেই দীপক দ্রুত বেরিয়ে এল এবং কোনও দিকে না তাকিয়ে ও পকেটে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে ফুটপাথ ধরে হনহন করে হাঁটতে লাগল।
রাজু পায়ে হেঁটে তাকে অনুসরণ করবে না গাড়ি চালিয়ে পিছন-পিছন যাবে, সেটা ঠিক করতে পারল না। শেষে ইগনিশান কি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়ে থমকে গেল।
সেই সর্বশেষ আগন্তুকও বেরিয়ে এসেছে। গলি থেকে বেরিয়ে এসে চারদিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে।
রাজু দ্রুত মাথাটা নিচু করে নিল। পরমুহূর্তেই দেখল, লোকটা ফুটপাথ ধরে দ্রুত হাঁটতে লাগল—যেদিকে দীপক গেছে সেই দিকে।
দীপককে দেখা গেল অনেক দূরে।
দীপক হঠাৎ রাস্তা পার হয়ে গেল বিপরীত ফুটপাথে। আগন্তুকও সঙ্গে-সঙ্গে রাস্তা পার হতে গেল এবং সে রাস্তার মাঝামাঝি আসতেই রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে শোনা গেল একটা পিস্তলের গর্জন।
লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ল রাস্তার ঠিক মাঝখানে এবং দীপক দ্রুত একটা গলির মধ্যে ঢুকে গেল।
হতভম্ব রাজু ব্যাপারটা প্রথমে বুঝতে পারল না। সম্ভবত নেশাটা তার ফিরে এসেছিল। সে বারকয়েক মাথাটা ঝাঁকাল। এবং বুঝতে পারল, তার পক্ষে সেখানে থাকা আর নিরাপদ নয়। লোকজন জড়ো হওয়ার আগেই তাকে সরে পড়তে হবে।
সে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে দিল। মৃতদেহের পাশ দিয়ে সে তিরবেগে চলে এল সেই গলির মুখে। গলিটা ডানদিকে বাঁক নিয়েছে। অর্থাৎ, সেটা আবার আর-একটি রাজপথে গিয়ে মিশেছে। রাজু সেইদিকে গাড়ি চালিয়ে দিল।
দীপক রাজপথে বেরিয়ে এসেই একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসল। ট্যাক্সি চলতে লাগল। দূর থেকে ওকে অনুসরণ করতে লাগল রাজু।
অনেক পথ ঘুরে ট্যাক্সিটা আবার একটা অন্ধকার গলির সামনে থামল।
দীপক ট্যাক্সি থেকে নেমে ধাঁ করে ঢুকে গেল গলির ভেতরে।
রাজু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে গাড়ি থেকে নামল। পকেট থেকে পিস্তল বের করে সাবধানে গলিতে ঢুকে দেওয়াল ঘেঁষে হাঁটতে লাগল দীপকের সন্ধানে।
কিন্তু সে বোধহয় সেই চৈনিক প্রবাদটা জানত না, রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হয়।
হঠাৎ অন্ধকারে একটা লৌহহস্ত তার গলাটা পিছন থেকে চেপে ধরল। সে পিস্তলটা তোলার আগেই তার কানের পাশে ঠেকল একটা ঠান্ডা পিস্তলের নল। কে যেন আদেশের সুরে তার কানে-কানে বলল, ‘পিস্তলটা ফেলে দাও, রাজু।’
লোকটা যে দীপক সে-বিষয়ে তার সন্দেহ রইল না। কিন্তু তার মুখে নিজের নাম শুনে সে অবাক হল। পিস্তলটা সে ফেলে দিল।
দীপক তাকে ছেড়ে পিস্তলটা কুড়িয়ে নিলে বলল, ‘এবার বলো, আমাকে তুমি খুঁজছ কেন? তুমি আবার কোন দেশের এজেন্ট?’
আবার রাজু অবাক হল। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বলল, ‘তোমার সঙ্গে দরকার আছে। আমি কোনও দেশের এজেন্ট নই। আমি শেঠ বদ্রীপ্রসাদের এজেন্ট।’
‘আমার সঙ্গে কী দরকার?’
‘সেটা কি এই অন্ধকার গলিতে দাঁড়িয়ে বলব?’
‘বেশ, চলো তোমার গাড়িতে। আমার সামনে-সামনে হাঁটতে শুরু করো। কিন্তু সাবধান। চালাকি করার চেষ্টা করলে, তুমিও ওই লোকটার মতো বলি হয়ে যাবে।’
রাজু কথা না বলে হাঁটতে শুরু করল। গাড়ির কাছে এসে রাজু সামনের দরজা খুলে আসনে বসল। দীপক বসল পিছনের আসনে।
‘এবার তোমার মিথ্যের ঝাঁপি খোলো।’
‘মিথ্যে বলার আমার দরকার নেই। আমি তোমাকে খুঁজতেই বোম্বাই এসেছি।’
‘কারণ?’
‘বলছি। তার আগে বলো, ওই লোকটা কে? কেন ওকে তুমি খুন করলে?’
‘শুনতে চাও? ও একটা বিদেশি রাষ্ট্রের এজেন্ট ছিল। আমি ওকে খুন না করলে, ও আমাকে খুন করত। আমি যে-রাষ্ট্রের মুখোশ খুলে দিয়েছি, তারা এবার আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইছে।’
‘কিন্তু তুমি আমায় চিনলে কী করে? কী করে জানলে, আমি তোমায় খুঁজছি?’
‘হোটেলের বেয়ারা আমায় বলেছে। হোটেলের খাতা থেকে আমি তোমার নাম জেনেছি। আমি প্রফেশনাল, এটা আমার পক্ষে কোনও শক্ত কাজ নয়। এ-ক’দিন আমি তোমাকে চোখে-চোখে রেখেছিলাম। আমি আজ ওই গানের আসরে গেছিলাম তোমার জন্যেই।’
‘তুমি কাগজে হোটেলের ঠিকানা দিয়েছ, অথচ হোটেলে থাকো না।’
‘সোজাসুজি দেখা করার মধ্যে বিপদ আছে। শত্রু তাহলে সহজেই আমায় খুন করতে পারবে। এমন ব্যবস্থা করা আছে যে, ওখানে এসে কেউ আমাকে খুঁজলেই আমি জানতে পারব। তখন আমিই তাকে খুঁজে নেব। আমি বদ্রীপ্রসাদের নাম জানি। এবার বলো, কী দরকার?’
রাজু বলল, ‘শেঠজি তোমাকে দিয়ে একটা কাজ করাতে চান। ভালো টাকা পাবে তুমি।’
‘কী কাজ?’
‘সেটা তিনি নিজেই তোমাকে বলবেন।’
‘বেশ, তাহলে তুমি তোমার নিজের গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। রাস্তায় আমি ঠিক জায়গায় তোমার গাড়িতে উঠে পড়ব। কিন্তু সাবধান। বৈঠকবাজির চেষ্টা করবে না।’
পরের দিন রাজুর সঙ্গে দীপক শেঠ বদ্রীপ্রসাদের সামনে হাজির হল।
বদ্রীপ্রসাদ অভিজ্ঞ লোক। এক্স-রে চোখ দিয়ে তিনি দীপককে দেখলেন। অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন দীপকের চোখ। খুশি হলেন তিনি। শিকারি বেড়ালের চোখ দেখলে বোঝা যায়।
দীপককে তিনি যথাযোগ্য আপ্যায়ন করে বসালেন। তারপর বললেন, ‘কাগজে তোমার বীরত্বের কাহিনি পড়েছি। আমার মনে হয়েছে, তুমি সত্যিকারের প্রফেশনাল।’
দীপক একটা সিগারেট ধরাল। বলল, ‘কাজটা কী ধরনের সেটা জানা দরকার। আমার প্রশংসা না করে সেটাই বলুন।’
বদ্রীপ্রসাদ একটু আহত হলেন। এভাবে কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলে না। সকলে তাঁর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে খুব মোলায়েম সুরে কথা বলে।
একটু থেমে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে তিনি আবার শুরু করলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমার বাড়িতে ডাকাতি হয়ে গেছে।’
দীপক চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘ডাকাত এখানে ঢুকল কী করে?’
‘ডাকাতরা সবই পারে। এ-ডাকাতদলটা খুব দুর্ধর্ষ। তাদের কাছে সমস্ত রকমের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আছে। এরা এসেছিল গভীর রাতে। আমরা জেগে ওঠার আগেই তারা ভেতরে ঢুকে পড়েছিল।’
‘অদ্ভুত!’
‘হ্যাঁ! এই অঞ্চলে অনেক জায়গায় তারা ডাকাতি করেছে। এখানে তারা বেশ লাভবান হয়েছে। প্রচুর টাকা-গয়নাসমেত তিনটে দামি রাইফেল তারা নিয়ে গেছে।’
দীপক বলল, ‘আপনি কি ওই টাকাকড়িগুলো আবার ফেরত পেতে চান?’
‘না।’
‘গয়নাগাটিগুলো?’
‘না।’
‘তাহলে? নিশ্চয় ওই বন্দুকগুলো ফেরত পাওয়ার জন্যে আমাকে ডেকে আনেননি, কারণ বন্দুকগুলোর দামের চেয়ে অনেক বেশি দাম আপনাকে দিতে হবে।’
‘আমি টাকা-পয়সা, ধনদৌলত খুব ভালোবাসি। ওগুলো চলে যাওয়ায় আমি খুবই দুঃখিত। কিন্তু ওগুলো ফেরত আনার জন্যে তোমাকে ডাকিনি। আমি ওসব চাই না। আমি ফেরত পেতে চাই আমার একমাত্র মেয়েকে।’
‘মেয়ে! আপনার মেয়ে! সে কোথায় আছে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল দীপক।
‘ডাকাতদল যাওয়ার সময় আমার একমাত্র মেয়ে বিদ্যাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। আমি কথাটা গোপন রেখেছি আমার মান-ইজ্জতের জন্যে। সবাই জানে, সে বোম্বাইয়ে তার মাসির বাড়ি বেড়াতে গেছে। আসলে সে এখন ওই ডাকাতদলের হাতে বন্দিনী। তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে হবে।’
দীপক নীরবে সিগারেট টানতে-টানতে ভাবতে লাগল। অনেকক্ষণ পর বলল, ‘কাজটা করতে পারি, কিন্তু তার জন্যে একলাখ টাকা লাগবে।’
‘তাই পাবে।’
‘আর কী করতে হবে?’
‘শুধু মেয়েকে নিয়ে এসো, ব্যস।’
দীপক আবার সিগারেট টানতে লাগল। খানিকক্ষণ পর বলল, ‘একটা কথা আপনার ভালো করে বোঝা দরকার, শেঠজি। আমি পেশাদার, প্রফেশনাল। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, পেশাদাররা কথার খেলাপ করে না, বা তারা কোনওদিনই খদ্দেরদের ঠকায় না। আমাদের কথার দাম মারাত্মক। আমরা চুক্তি করে কাজে নামি। প্রাণ গেলেও সে-চুক্তি ভাঙি না। কিন্তু চুক্তির বাইরে একটা কাজও আমরা করি না। কাজেই ওই কাজ—মানে আপনার মেয়েকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া আর কিছু যদি করতে হয়, তাহলে সেটা নিয়ে এখনই চুক্তি করুন। অবশ্য তার জন্যে আপনার খরচ লাগবে। কিন্তু একবার চুক্তি হয়ে গেলে, আর কোনও বাড়তি ফরমায়েশ পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।’
বদ্রীপ্রসাদ বললেন, ‘না, মেয়েকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই।’
‘বেশ। চুক্তি কমপ্লিট হতে আর-একটু বাকি আছে।’
‘কী?’
‘দুটি ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।’
‘সে-দুটো কী?’
‘এক : কোনও অবস্থাতেই আপনি পুলিশের কাছে যেতে পারবেন না। তাহলে চুক্তি ভঙ্গ হবে এবং আমার আর কোনও দায়িত্ব থাকবে না।’
‘পুলিশের কাছে যাওয়ার হলে আমি আগেই যেতাম। তাতে ব্যাপারটা জানাজানি হবে।’
‘দ্বিতীয় শর্ত হল, পারিশ্রমিকের অর্ধেক পঞ্চাশ হাজার টাকা এখন দিতে হবে এবং আপনার মেয়েকে এখানে নিয়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গে বাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে।’
‘তাই হবে। রাজু তোমাকে এখুনি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে দেবে। আর কিছু?’
‘না। শুধু যাওয়ার আগে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, চুক্তির বাইরে কোনও কাজ হবে না।’
শেঠ বদ্রীপ্রসাদ বললেন, ‘যাওয়ার আগে তোমার বোধহয় দু-একটি কথা জানার আছে। এই দলের যে নেতা, তার নাম বিজয়। দলটা তাড়া খেয়ে-খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। তারপর পুলিশ আর এদের কোনও হদিশ পায়নি। কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে আমি খবর পেয়েছি যে, দলটা বিহারের জদুগোড়ার গভীর জঙ্গলে শেলটার নিয়েছে। আমি পুলিশকে খবরটা দিতে পারতাম। কিন্তু সে-ক্ষেত্রে, ওরা সারেন্ডার না করলে, গুলি বিনিময় হবে এবং আমার মেয়ে মারা যেতে পারে। আমি আমার মেয়েকে হারাতে চাই না।’
দীপক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই মূল্যবান সংবাদটা দেওয়ার জন্যে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
রাজু পিছনে দাঁড়িয়েছিল। সে টাকার বান্ডিলগুলো তার হাতে দিয়ে বলল, ‘বিদ্যাকে এনে দিতে পারলে, আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে পুরস্কার দেব।’
দীপক টাকা গুনতে-গুনতে বলল, ‘একই ব্যাপারে দুজনের সঙ্গে চুক্তি করা চলে না।’
‘এটা চুক্তি নয়। বকশিশ।’
দীপক হেসে বলল, ‘তাহলে এ-ব্যাপারে তোমার স্বার্থও জড়িয়ে আছে।’
‘আমার জীবন জড়িয়ে আছে।’
দীপক বেরিয়ে এল বাইরে। হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিল। কিন্তু ওর মুখে হাসি নেই। ও তখন কাজের ছক তৈরি করছে। ওকে এক্ষুনি কাজ শুরু করতে হবে। এবং সেজন্য ওকে আগে যেতে হবে সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গলের আশেপাশে কোথাও।
মনে-মনে দীপক ভাবল, নিশ্চয় আশেপাশে একটা গ্রাম পাওয়া যাবে।
দীপক খোঁজখবর নিয়ে জানল, ওই জঙ্গলের পাশেই একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম আছে। সে ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে-হেঁটে চলল সেই গ্রামের দিকে।
গ্রামটা বর্ধিষ্ণু। দীপক এই গ্রামে এসে হাজির হল।
পায়ে হাঁটা আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। দীপক চলতে লাগল। হাতে একটা ছোট সুটকেস।
কিছুদূর আসার পর ও দেখল, রাস্তা প্রায় বন্ধ। রাস্তার মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা গর্ত। আর সেই গর্তে পড়েছে একটা গোরুর গাড়ির একটা চাকা। গোরুর গাড়িটা মালবোঝাই।
বিপরীত দিকে একটা মোটর গাড়ি। একনাগাড়ে হর্ন দিচ্ছে। আর একজন বৃদ্ধ এবং একজন তরুণী প্রাণপণ চেষ্টা করছে গোরুর গাড়ির চাকাটা গর্ত থেকে তুলতে। কিন্তু সে-চাকা তোলার জন্য যে-শক্তির প্রয়োজন, তা তাদের ছিল না।
হঠাৎ গাড়ির সামনের আসন থেকে ড্রাইভার বেরিয়ে এসে বৃদ্ধকে উদ্দেশ করে একটা অশ্লীল কথা বলল। বৃদ্ধ চোখ তুলে তাকাল। দীপক দেখল, সে-চোখে চাপা ক্রোধ।
ড্রাইভার আবার বলল, ‘কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি, এখনও গাড়ি সরানো হল না। জমিদারবাবুর খুব অসুবিধা হচ্ছে। খুব রেগে গেছেন।’
বৃদ্ধ উত্তর দিল, ‘চেষ্টা তো করছি। তুমি তো শুধু গাল পাড়ছ, একটু এগিয়ে এসে সাহায্য করতে পারছ না!’
ড্রাইভারের চোখে আগুন জ্বলে উঠল : ‘কী, আমি তোকে সাহায্য করব? আমি কি কুলি, না তোর চাকর?’ কথা শেষ করেই সে এক লাথি মারল বৃদ্ধের কোমরে। মেয়েটার তীক্ষ্ন চিৎকারের সঙ্গে বৃদ্ধ উঁচু রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে নীচে পড়ল।
দীপক এসব দেখছিল। সে একলাফে নীচে নেমে বৃদ্ধকে তুলে বসাল। বৃদ্ধের দু-চোখে জল। সে কোনও কথা বলতে পারল না।
দীপক বৃদ্ধকে বলল, ‘ওঠো। চলো, তোমাকে আমি সাহায্য করছি।’
তিনজন মিলে গাড়ির চাকাতে হাত দিল। গাড়িটা উঠে এল গর্ত থেকে। বৃদ্ধ গাড়িতে বসে গাড়িটা একধারে দাঁড় করাল।
জমিদারবাবুর গাড়ি এগিয়ে এল। গোরুর গাড়ির সমান্তরাল হতেই গাড়িটা থামল। গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বের করে প্রৌঢ় জমিদার লোলুপ দৃষ্টিতে যুবতীর দিকে তাকিয়ে হাসল।
যুবতী রাগে কাঁপছিল। সে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
জমিদারবাবু বললেন, ‘বাব্বা, তোর বড্ড রাগ, লতা।’
বাবা এবং মেয়ে কেউ জবাব দিল না। বৃদ্ধের হাতের চাবুকটা শূন্যে পাক খেয়ে তীব্র বেগে পরপর নেমে এল দুটো গোরুর ওপর : ‘এই হেট হেট হর র র র। হাঃ—হাঃ।’
গাড়িটা এগিয়ে চলল। মোটরটাও বেরিয়ে গেল তিরবেগে।
গোরুর গাড়িটা হাত-দশেক দূরে গিয়ে থামল। বৃদ্ধ নেমে এসে দীপকের হাতদুটো ধরে বলল, ‘আপনাকে তখন ধন্যবাদ দিতে পারি নাই, বাবু। আপনি না থাকলে, ও-গাড়ি আজ উঠতনি। আমায় আরও চাবুক খেতে হত।’
দীপক বলল, ‘ওটা এমন কোনও কাজ নয়। আমি পরদেশি। নয়তো ওই ড্রাইভার আর তার মালিককে এমন শায়েস্তা করতাম যে, সারা জীবন তারা ভুলত না।’
‘আপনি পরদেশি মানে! কোথায় থাকেন আপনি?’
‘বাড়ি আমার দূর বোম্বাইয়ে। এখানে এসেছি, এই জঙ্গলের আশেপাশে যদি কয়েকদিনের জন্যে থাকার জায়গা পাই।’
‘থাকবেন? আপনি এ-গ্রামে থাকতে চান?’
দীপক একটু হেসে বলল, ‘চিরকালের জন্যে নয়। আমি লেখক—গল্প লিখি। জঙ্গল নিয়ে একটা গল্প লিখছি। ঠিক এই ধরনের পাহাড় আর জঙ্গল আমার গল্পে আছে। কিছুদিনের জন্যে থাকতে পেলে, আমার গল্প লেখার সুবিধে হত।’
এবার মেয়েটা দু-পা এগিয়ে এসে বলল, ‘বাপু, আমাদের ওখানেই তো বাবুজিকে থাকতে দিতে পারো। এমন লোক গ্রামে থাকা ভালো।’
বৃদ্ধ বলল, ‘কিন্তু আমাদের ওখানে বাবুজির কষ্ট হতে পারে, মা। উনি শহরের শিক্ষিত লোক। আমরা চাষা মানুষ।’
দীপক তাড়াতাড়ি বলল, ‘না, আমার কোনও অসুবিধা হবে না। আমার বাবাও চাষি ছিলেন। আমিও চাষির ঘরের ছেলে।’
বৃদ্ধ উৎসাহিত হয়ে উঠল : ‘তাই নাকি? চাষির ঘরের ছেলে লেখাপড়া শিখে এতবড় হয়েছেন! বাঃ! খুব ভালো। খুব ভালো।’
দীপক বলল, ‘আপনারা যদি আমাকে কিছুদিন থাকতে দেন, তাহলে আমি সত্যিই খুব কৃতজ্ঞ হব।’
‘বেশ, আপনার যদি কোনও অসুবিধা না হয়, তা হলে এই গরিবের বাড়ি থাকতে পারেন।’
দীপক বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ। সত্যিই আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু একটা কথা আপনাদের বলা দরকার। আমি গরিব চাষির ছেলে হলেও এখন আমার রোজগার খুব ভালো। এখন আমি অনেক পয়সা পাই গল্প বিক্রি করে। কাজেই আমি যদি আপনাদের সংসারে থাকি, তাহলে সংসারের একজন হিসেবে আমারও উচিত কিছু দায়-দায়িত্ব নেওয়া।’
বৃদ্ধ হাসল : ‘পয়সার কথা বলছেন? ওটা কি না দিলেই নয়?’
দীপক বলল, ‘আমি আপনার ছেলের মতো, আমার একটা কর্তব্য আছে।’
বৃদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ছেলে?’
মেয়েটি তাড়াতাড়ি বলল, ‘যদি যেতে হয়, তাহলে আর দেরি করা ঠিক হবে না, বাপু।’
অতএব সকলে মিলে গাড়িতে উঠল। দীপক এবং বৃদ্ধ বসল সামনে। লতা গাড়ির ওপর খড়ের গাদায়।
গাড়ি গ্রামের পথ ধরে এগোতে লাগল।
গ্রামে আশ্রয় নেওয়ার পিছনে দীপকের কতকগুলো উদ্দেশ্য ছিল। এক দলটা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা। দুই : জঙ্গলটা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। জঙ্গলের বিভিন্ন পথ সম্পর্কে একটা প্রত্যক্ষ ধারণা পাওয়া। তিন : দলটা কী ধরনের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে, সে-সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া। চার : সুযোগ বুঝে কাজ হাসিল করা।
দীপকের কথা গ্রামের চারদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। দীপক গ্রামের সরল মানুষগুলোর ব্যবহারে অত্যন্ত খুশি হল। খুব সহজেই ও তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলল। ধীরে-ধীরে লতার সঙ্গে ওর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতে লাগল। লতার পরিচর্যা এবং সেবা ওকে অভিভূত করল।
জীবনে কোনওদিন ও কোনও মেয়ের সেবা পায়নি। লতার সেবা এবং পরিচর্যার মধ্যে যে-আন্তরিকতা ছিল, তা ওকে মুগ্ধ করল।
হোলির দিন গ্রামের যুবকরা দল বেঁধে এসে ওকে ধরে নিয়ে গেল। গ্রামের যুবক-যুবতীরা রং নিয়ে খেলল। সকলের মনের রঙের সঙ্গে নিজের মনের রং ও মিশিয়ে দিল।
সন্ধেবেলা গানের আসর বসল। আবার সকলে জোর করে ওকে ধরে নাচের আসরে নিয়ে এল। সকলের সঙ্গে নাচ-গান করতে ওর ভালোই লাগল।
দিন-কয়েক পরে পাশের গ্রামে মেলা। লতার সঙ্গে ও মেলায় গেল। এবং কিছু-কিছু উপহার ওকে কিনে দিল।
কিন্তু দীপক শুধু এই সামাজিক জীবনে নিজেকে আবদ্ধ রাখেনি। ও প্রতিদিন জঙ্গলে ঢুকত। কিছুদূর ঘুরে আসত। জঙ্গলে ঢোকার পথ, পাহাড়ের পথ ও চিনে রাখল।
লতা একদিন ওকে বলল, ‘তুমি তো একদিন চলে যাবে।’
দীপক বলল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু আবার ফিরব।’
‘আবার ফিরবে? কী জন্যে?’
‘তোমার জন্যে।’
লতা লজ্জায় মুখ নিচু করে নিল।
দীপক বলল, ‘হ্যাঁ, লতা। আমার এই কাজটা হয়ে গেলে, আমি চলে যাব। তারপর আসব বরের বেশে, বারাত নিয়ে।’
লতা আনন্দে আর থাকতে না পেরে চঞ্চলা হরিণীর মতো দ্রুত ছুটে চলে গেল।
এইসময় একটা ঘটনা ঘটল। গ্রামে ডাকাত পড়ল। কে একজন ওকে বলল, বিজয় দল নিয়ে এসেছে। দীপক পিস্তলটা কোমরে গুঁজে ছুটে বেরিয়ে এল বাইরে।
দলটা ঘোড়ায় চড়ে এসেছে।
তারা সোজা চলে গেল জমিদারবাড়ির দিকে। দীপক অন্ধকারে ছুটতে লাগল। যদি বিজয়কে দেখা যায়।
দলটা অতি দ্রুত জমিদারবাড়িতে তাদের কাজ সেরে চলে গেল। সাক্ষী রইল দীপক।
দীপক দেখল, তারা গ্রামের আর কারও বাড়িতে হানা দিল না। দরিদ্র কৃষকদের কোনও ক্ষতি করল না। দীপক শুনল যে, দলটা চলে যাওয়ার সময় প্রচুর টাকাপয়সা, কিছু খাদ্যশস্য এবং কয়েকটি বন্দুক নিয়ে গেছে।
তিনদিন পর খবর এল, পাশের গ্রামের এক জোতদারের বাড়ি থেকে তারা বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোনও গ্রামবাসীর কিছু ক্ষতি করেনি। শুধু পাশের গ্রাম কেন, অনেক দূর-দূর গ্রাম থেকেও তাদের ডাকাতির খবর আসতে লাগল।
দীপক খুব ভোরে উঠে জঙ্গলটা দেখত। নজর রাখত, কেউ ঢুকছে-বেরোচ্ছে কি না। সেদিন ভালো করে আলো ফোটেনি। দীপক জঙ্গলের দিকে তাকিয়েছিলে। হঠাৎ ওর চোখে পড়ল, জঙ্গল থেকে লতা বেরিয়ে আসছে। হাতে একটা কাগজের প্যাকেট।
দীপক অবাক হল। এত সকালে লতা জঙ্গলে গেছিল কেন? হাতের কাগজের প্যাকেটে কী আছে? লতার চালচলনে কেমন যেন একটা ভাব। সেটা বেশ সন্দেহজনক।
দীপক লতাকে এ-বিষয়ে কিছুই বলে না। কিন্তু দ্যাখে, লতা সেই কাগজের প্যাকেটটা নিয়ে যায় গোয়ালঘরে।
দীপক সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
দুপুরে লতা যায় সামনের নদীতে স্নান করতে। দীপক গোয়ালঘরে ঢুকে খুঁজতে থাকে প্যাকেটটা। এবং সেটা পেতে দেরি হয় না।
কিন্তু প্যাকেটটা খুলে ও বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। ভেতরে কয়েক বান্ডিল একশো টাকার নোট। দীপক প্যাকেটটা আবার যথাস্থানে রেখে বেরিয়ে আসে।
দু-দিন ধরে ও লতাকে দেখতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্য! ওর মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন চোখে পড়ে না। ও তেমনই সাবলীল। উচ্ছল।
কিন্তু দীপক সবসময় লতার ওপর চোখ রাখে। তৃতীয় দিনে লতা যখন গোয়ালঘরে কাজ করছে, তখন ওর কাছে এল একজন চাষি। কিন্তু দীপকের অভিজ্ঞ চোখ বলল, এ-লোক আসলে চাষি নয়।
দীপক একটা গাছের আড়াল থেকে দেখল, লোকটা একটা ঝোলা থেকে দশ বাই ছয় ইঞ্চি সাইজের খান ছয়-সাত বাক্স লতাকে দিল।
লতা সেগুলো তাড়াতাড়ি একটা টুকরিতে রেখে ওপরে ঘাসপাতা চাপা দিয়ে দিল।
লোকটা চলে যাওয়ার পর লতা নিজের কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
দীপক দুপুরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। দুপুরে লতা স্নান করতে গেলে দীপক এসে ঢুকল গোয়ালঘরে। টুকরির ঘাসপাতা সরিয়ে একটা বাক্স বের করল। কিন্তু বাক্সটা খুলেই দীপক চমকে উঠল। ভেতরে রাইফেলের কার্তুজ।
দীপক অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাথার মধ্যে অজস্র চিন্তা। গোটা ব্যাপারটা ওর কাছে বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল। এবং ও ঠিক করল যে, লতাকে কাজে লাগাতে হবে।
পরের দিন খুব সকালে উঠে দীপক জঙ্গলে ঢুকল। জঙ্গলের আঁকাবাঁকা পথের ধারে অপেক্ষা করতে লাগল।
খানিক পরেই দেখা গেল লতা মাথায় করে ঝুড়িটা নিয়ে আসছে।
দীপক হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে লতার সামনে দাঁড়াল।
লতা ভীষণভাবে চমকে উঠল এবং মাথা থেকে ঝুড়িটা পড়ে গেল। ছিটকে বেরিয়ে এল কয়েকটি বাক্স। দীপক কোনও কথা না বলে একটা বাক্স তুলে নিল। বাক্সটা খুলে ধরল লতার সামনে। লতার মুখ কাগজের মতো সাদা।
দীপক বলল, ‘তাহলে তোমার আর-একটা রূপ আছে? তুমিই এই ডাকাতদলকে গোলাগুলি সাপ্লাই করো?’
লতা কোনও উত্তর দিল না। মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
দীপক বলল, ‘তুমি কি জানো যে, ডাকাতদলকে এসব সাপ্লাই করার অর্থ, তুমিও আইনের চোখে অপরাধী?’
লতা মৃদুস্বরে বলল, ‘আমি জানি, কাজটা অন্যায়।’
‘তাহলে কেন এ-কাজ তুমি করো?’
হঠাৎ লতা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘করি, কারণ আমায় করতে হয়।’
‘করতে হয়! কেন? তুমি জানো না ওরা ডাকাত?’
‘ওরা কী আমি জানি না। আমার একমাত্র ভাই—মানে বড় ভাই, ওই দলে আছে।’
দীপকের বিস্ময়ের শেষ নেই। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘লতা, তোমাকে আমার কিছু বলার আছে। আমি তোমাকে বিয়ে করব। কাজেই আমার মনে হয়, তোমাকে সব খুলে বলা দরকার।’
ওরা পায়ে-পায়ে নদীর ধারে চলে এল। লতা বসল একটা পাথরে, নদীতে পা ডুবিয়ে।
দীপকও নদীতে নেমে গিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লতা, আমার সত্যিকারের পরিচয়টা তোমাকে দেওয়া দরকার। আমি লেখক নই।’
লতা ওকে আরও অবাক করে বলল, ‘জানি।’
‘জানো?’
‘হ্যাঁ। তুমি কী তা আমি জানি না, তবে তুমি যে লেখক নও তা আমি জানি।’
‘কী করে জানলে?’
‘আমি তোমার বাক্সে বন্দুক দেখেছি।’
দীপক স্তব্ধ হয়ে অনেকক্ষণ লতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ‘তোমার কোনও সন্দেহ হয়নি? কাউকে বললে না, পুলিশের কাছে গেলে না?’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি—তুমি যাই-ই হও, আমি তোমায় ভালোবাসি।’
দীপক দু-হাতে লতাকে জড়িয়ে ধরল। লতা দীপকের বুকে মাথা রেখে বলল, ‘তোমার কাছে বন্দুক কেন? তুমিও কি ডাকাত?’
দীপক বলল, ‘না। কিন্তু আমি এসেছি ওই ডাকাতদলেরই খোঁজে।’
‘কেন?’
‘তবে প্রথম থেকে শোনো।’
দীপক সমস্ত কিছু খুলে বলল লতাকে। লতা চুপ করে সব শুনল।
দীপক বলল, ‘ওই দলটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। পুলিশ বুঝবে ওদের ব্যাপার। আমি এসেছি ওই মেয়েটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ওকে বিজয় জোর করে ধরে এনেছে।’
‘যদি জোর করে ধরে এনে থাকে তাহলে খুবই অন্যায় করেছে।’
‘আমি তোমার সাহায্য চাই, লতা।’
‘সাহায্য করব, কিন্তু তুমি কথা দাও আমার দাদা বা ওই দলটার কোনও ক্ষতি হবে না।’
‘কথা দিচ্ছি, লতা।’
‘বলো কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’
‘আমাকে ওদের মধ্যে ঢুকতে হবে। তুমি তার ব্যবস্থা করে দেবে। তুমি ওদের বোঝাবে যে, আমি একজন ভালো মার্কসম্যান—মানে বন্দুকবাজ। মিলিটারিতে ছিলাম। যে-কোনও কারণে আমি সরকারের ওপর, বড়লোকদের ওপর, খাপ্পা। আমি বদলা নিতে চাই। যারা এই ধরনের কাজে লিপ্ত, আমি তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্যে ঘুরছি। ওই দলে আমাকে নিলে আমি তাদের গেরিলা যুদ্ধ শেখাতে পারি।’
লতা বলল, ‘পরিকল্পনাটা বেশ ভালো। ওদের বিশ্বাস করাতে হবে ব্যাপারটা। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব। কিন্তু দীপক, ব্যাপারটা খুব ভয়ের। বিপদ আছে এতে।’
দীপক হেসে বলল, ‘সারা জীবন আমি বিপদ নিয়েই খেলা করেছি, লতা। ওটাই আমার পেশা। আমি মেয়েটাকে নিয়ে পালানোর সুযোগ চাই। ওদের আমি বিন্দুমাত্র ক্ষতি করব না। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি। মেয়েটাকে ওর বাবার কাছে পৌঁছে দিতে পারলে অনেক টাকা পাব এবং আমি আবার আসব। এবার আসব বারাত নিয়ে, তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।’
লতা বলল, ‘সে-দিন কি সত্যিই আসবে?’
‘আসবে, লতা। তুমি শুধু আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। আমাকে সাহায্য করো, যেন আমি ওদের দলে ঢুকতে পারি।’
লতা বলল, ‘আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে দেখি।’
তিনদিন পর লতা খবর আনল যে, ওরা ওর সঙ্গে কথা বলতে চায়।
দীপককে সঙ্গে করে নিয়ে চলল লতা। জঙ্গলের দুর্গম পথ ধরে ওকে নিয়ে এল একটি নির্জন স্থানে।
মূল ঘাঁটি থেকে এ-জায়গা অনেক দূরে। তিনজন লোক ওদের ঘিরে ধরল। লতা ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ওদের মধ্যে যার নাম রতনলাল সে-ই দীপকের সঙ্গে বেশিরভাগ কথাবার্তা বলল। সরকার এবং জমিদার শ্রেণির ওপর, বড়লোকদের ওপর, প্রতিশোধ নেওয়ার গল্পটা দীপক তৈরি রেখেছিল। নিজের দক্ষতার প্রমাণ দেওয়ার জন্য চল্লিশ গজ দূরের গাছের ডালে বসে থাকা একটা ছোট্ট পাখিকে গুলি করে নামাল। পকেট থেকে একটা লোহার টাকা বের করে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে সেটাকে গুলি করে অব্যর্থ লক্ষ্যের প্রমাণ দিল।
রতনলাল এবং সহযোগীদের চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। ওরা জীবনে ঠিক এই ধরনের নিশানাবাজ দেখেনি।
রতনলাল বলল, ‘তোমাকে আমরা কিছুদিন আন্ডার ট্রায়ালে রাখব। অস্ত্রবিদ্যাটা তুমি ভালোই জানো। সেটা আমাদের কাজে লাগবে। আমরা তোমার কাছে ট্রেনিং নেব। কিন্তু এখন তুমি মূল ঘাঁটিতে যেতে পারবে না। তুমি এখন মূল ঘাঁটি থেকে কিছু দূরে আমাদের সঙ্গে থাকবে।’
দীপক বলল, ‘আমি তোমাদের নেতা বিজয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
‘তাঁর সঙ্গে এখনই দেখা হবে না। তবে তোমার বিষয়ে তাঁকে জানানো হয়েছে। সময় হলে তিনি নিজেই তোমাকে ডেকে পাঠাবেন।’
দীপক আর কৌতূহল দেখাল না।
ওরা দীপককে কতকগুলো বই পড়তে দিল। সেগুলো সমাজতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক এক্সপ্লয়টেশান সম্পর্কে।
দীপক সেগুলো পড়ে মাথামুন্ডু কিছুই বুঝল না। শুধু এই ভেবে অবাক হল যে, এরা এসব বই কেন পড়ে!
এইভাবে দিন-কয়েক কাটল। কিন্তু একটা বিরাট সত্য ওর কাছে উদঘাটিত হয়ে গেল।
একদিন রাতে বন্দুকের শব্দে ও উঠে বসল বিছানায়। দূরে বন্দুকের শব্দে আকাশ মাঝে-মাঝে ঝলসে উঠছে। জঙ্গলের একাংশে আগুন ধরে গেছে।
ওকে বলা হল যে, একদল কুখ্যাত ডাকাত ওদের মূল ঘাঁটি আক্রমণ করেছে। ওদের যেতে হবে সাহায্য করার জন্য। ওর হাতে একটা পিস্তল দেওয়া হল।
দীপক বুঝে নিল যে, এটা দু-দল ডাকাতের মধ্যে সংঘর্ষ ছাড়া আর কিছুই নয়।
দীপক বুঝল, এই হই-হট্টগোলের মধ্যেই ওকে কাজ সারতে হবে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিদ্যার কাছে পৌঁছতে হবে এবং ওকে নিয়ে চম্পট দিতে হবে।
দীপক ওদের সঙ্গে মূল ঘাঁটির দিকে চলল। ডাকাতদের সঙ্গে ওদের গুলি বিনিময় হল। দীপকের গুলিতে কয়েকজন ডাকাত ভূতলশায়ী হল।
কিন্তু মূল ঘাঁটিতে পৌঁছে দীপক দেখল যে, ওরা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। দীপক একা খুঁজতে লাগল বিদ্যাকে।
হঠাৎ দীপক বিদ্যাকে একটা ছোট পাহাড়ের ওপর দেখতে পেল। বিদ্যা একা আশ্রয়ের জন্যে দৌড়চ্ছে। সে-পাহাড়ে পৌঁছতে গেলে দীপককে প্রায় একশো গজ লম্বা এবং চল্লিশ গজ চওড়া একটা ফাঁকা জমি পার হতে হবে।
দীপক চারদিক দেখে নিয়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটতে শুরু করল। কিন্তু ফাঁকা জমিটার মাঝামাঝি আসতেই ও শুনতে পেল : ‘হল্ট!’
দীপক কিছু বোঝার আগেই দেখা গেল, ওর ডানদিকের বিশ গজ দূরে ঝোপ থেকে দুজন লোক পিস্তল উঁচিয়ে বেরিয়ে এসেছে। একজন ওকে লক্ষ্য করে পিস্তল তুলল গুলি করার জন্য।
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা পিস্তল গর্জন করে উঠল। পিস্তলধারী ভূপাতিত হল, কিন্তু দ্বিতীয়জন বিদ্যুৎবেগে যেখান থেকে গুলি এসেছিল, সেইদিকে গুলি ছুড়ল। সেইটুকু সময়ই যথেষ্ট ছিল দীপকের পক্ষে। ও বিদ্যুৎবেগে হাত তুলে দ্বিতীয় লোকটাকে ফেলে দিল মাটিতে।
মুখ ফিরিয়ে দেখল, কে তার জীবন রক্ষা করেছে। দেখল, কেউ একজন মাটিতে পড়ে আছে এবং বিদ্যা চেষ্টা করছে তাকে সাহায্য করতে—যেন সে দাঁড়াতে পারে।
দীপক এগিয়ে গেল ওদের দিকে। ও শুনল যে, আহত ব্যক্তি আর কেউ নয়, স্বয়ং বিজয়। ওদের দলপতি।
চারদিকে তখন দারুণ লড়াই চলছে। দীপক বলল, ‘সবচেয়ে আগে কোনও একটা নিরাপদ জায়গায় আপনাকে নিয়ে যাওয়া দরকার। গুলি লেগেছে আপনার বাঁ-দিকের ঊরুতে।’
দীপক এবং বিদ্যা কোনওরকম করে বিজয়কে নিয়ে এল একটা পাহাড়ের আড়ালে। সেখানে বিজয়ের ঊরুতে রুমাল দিয়ে পট্টি বাঁধল দীপক। তারপর ঘোষণা করল যে, ওরা দুজন দীপকের বন্দি।
বিজয়ের চোখে যুগপৎ ঘৃণা এবং বিস্ময় ফুটে উঠল। সে প্রশ্ন করল, ‘বন্দি? তার মানে, তুমি পুলিশের লোক?’
দীপক হেসে বলল, ‘ঠিক পুলিশের লোক নই। তবে সমাজবিরোধী এবং ডাকাতদের বন্দি করার অধিকার সকলেরই আছে।’
‘ডাকাত? তোমার মতো অকৃতজ্ঞ প্রাণী আমি জীবনে দেখিনি। আমি তোমার প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছি। আর তুমি আমাকে ডাকাত বলছ?’
দীপক দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, ‘আমার প্রাণরক্ষা করেছ, সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তুমি কি ডাকাত নও?’
‘না, আমি ডাকাত নই।’
‘আমি নিজের চোখে সেদিন তোমাকে এবং তোমার দলকে জমিদারবাড়িতে ডাকাতি করতে দেখেছি।’
‘আমি ডাকাতি করতে যাইনি—ট্যাক্স নিতে গেছিলাম।’
‘ট্যাক্স? কীসের ট্যাক্স?’
‘তুমি একটা ইডিয়ট, তাই এতদিনেও বুঝতে পারোনি। আমি একজন বিপ্লবী। আমরা সকলেই বিপ্লবী। আমাদের বিপ্লবী সরকার আছে। সেই বিপ্লব চালিয়ে যাওয়ার জন্যে, সরকারের কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার জন্যে, পার্টিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে, অনেক টাকার দরকার। এটা নিশ্চয় তুমি জানো।’
‘তোমার ওই যুক্তিতেই কি তুমি ডাকাতি কর?’
‘একশোবার বলছি, আমি ডাকাতি করি না। ডাকাতরা কোনও শ্রেণি বিচার করে না। ডাকাতদের কোনও আদর্শ নেই। তারা পলিটিক্যাল নয়। আজ যারা আমাদের আক্রমণ করেছিল, তারাই প্রকৃত অর্থে ডাকাত। তারাই সমাজবিরোধী।’
দীপক বলল, ‘তোমার এই গালভরা কথাগুলো শুনতে হয়তো ভালো, কিন্তু ব্যাপারটা তো সেই একই—ডাকাতি।’
‘ওটা ডাকাতি নয়। যুদ্ধক্ষেত্রেও তুমি মানুষ খুন করেছ, কিন্তু তুমি কি নিজেকে খুনি মনে কর?’
‘কিন্তু এটা কি যুদ্ধক্ষেত্র?’
‘তুমি কি জীবনে কিছুই পড়াশোনা করোনি? যুদ্ধক্ষেত্রে তুমি কাদের জন্যে যুদ্ধ কর? একটা জাতির জন্যে। কয়েক কোটি লোকের জন্যে। এটাও যুদ্ধ। এ-যুদ্ধ দুটো শ্রেণির মধ্যে। পৃথিবীতে দুটোমাত্র শ্রেণি। শোষক আর শোষিত। আমাদের যুদ্ধ শোষক-শ্রেণির বিরুদ্ধে। একে বলে ক্লাস স্ট্রাগল।’
বিজয় থামল। নিজের আহত ঊরুর ওপর হাত রেখে একটা যন্ত্রণার ঢেউ সামলে নিল।
দীপক কথা বলল না। চুপ করে শুনতে লাগল।
বিজয় আবার বলল, ‘আমার বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে টাকার দরকার। যারা দরিদ্র শ্রেণিকে শোষণ করছে, এক্সপ্লয়েট করছে, যারা কালোবাজারি করছে, চোরাচালান করছে, তাদের কাছ থেকে আমার সরকার ট্যাক্স আদায় করে। ওরা নিজের জন্যে নিজেদের মতো সরকার তৈরি করেছে, সেই সরকার চালানোর জন্যে তারা গরিব মানুষের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করে। গরিব মানুষদেরও অধিকার আছে নিজেদের মতো রাষ্ট্র তৈরি করার। নিজেদের সরকার তৈরি করে তারাও ওই ধনীদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করবে।’ বিজয় চুপ করল।
বিদ্যা প্রশ্ন করল, ‘তুমি বলছ, তুমি পুলিশের লোক নও, তাহলে তুমি কে? কে তোমাকে পাঠিয়েছে?’
‘তোমার বাবা বদ্রীপ্রসাদ।’
‘আমার বাবা!’
বিদ্যা এবং বিজয় পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। বিদ্যা আবার প্রশ্ন করল, ‘কেন?’
‘তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। তোমার বাবা আমায় বলেছেন যে, তোমাদের বাড়ি ডাকাতির দিনে বিজয় তোমাকে কিডন্যাপ করে এনেছে।’
বিদ্যা চিৎকার করে উঠল, ‘মিথ্যে কথা। সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা।’
‘চেঁচিও না, বিদ্যা! আমি পেশাদার লোক। আমি এই করে খাই। আমাকে…।’
বাধা দিয়ে বিজয় বলল, ‘দেখেছ! দ্যাখো। টাকার জোরে ওরা কী না করতে পারে! দিনকে রাত করতে ওদের এক মুহূর্ত সময় লাগে না। তোমার মতো একটা বুদ্ধিমান লোককেও সে বোকা বানিয়েছে।’
‘কীরকম? তুমি ওকে জোর করে ধরে আনোনি?’
‘ওর মুখ থেকেই শোনো।’
বিদ্যা বলল, ‘আমার বাবা চিরকাল মিথ্যার ব্যবসা করেছে। আমাকে কেউ জোর করে ধরে আনেনি। আমি আর বিজয় একসঙ্গে কলেজে পড়তাম। ও ছিল দু-বছরের সিনিয়ার। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। এবং আমরা আইনসম্মতভাবে বিবাহিত। আমার বাবা এটা জানেন না। তিনি চান আমি তাঁর সমস্ত পাপ-কাজের সহচর মদ্যপ লম্পট রাজুকে বিয়ে করি। তাই আমি সেদিন নিজের ইচ্ছেয় বিজয়ের সঙ্গে চলে এসেছি। এবং জেনে রাখুন, সেদিন আমিই এদের ঢোকার জন্যে দরজা খুলে দিয়েছিলাম। আমিই সিন্দুকের চাবিটা ওদের দিয়েছিলাম। আমি একজন সাবালিকা। ন্যায়-অন্যায় বোধ আমার আছে। স্বামী নির্বাচনের অধিকার আমার আছে। পৃথিবীর কারও, এমনকী আপনার মতো একজন নিকৃষ্ট জীবেরও, অধিকার নেই আমাকে বাধা দেওয়ার।’
বিদ্যা দু-হাতে বিজয়ের মাথাটা বুকের ওপর চেপে ধরে আবার বলল, ‘মৃত্যু ছাড়া আমাদের কেউ আলাদাও করতে পারবে না।’
দীপক পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল। মাথার মধ্যে সব যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
বিপ্লব, বিপ্লবী সরকার, শ্রেণি-সংঘর্ষ সম্পর্কে বিজয় অনেক কথাই বলল। এসব জিনিস কোনওদিনই ওর মাথায় ঢোকে না।
বিজয় প্রমাণ করতে চাইল যে, সে ডাকাত নয়। প্রচলিত অর্থে তো নয়ই।
দীপক ভাবল, বিজয় ডাকাত হলেই বা হবে কী? ও তো ডাকাত ধরতে আসেনি। কেউ ওকে ডাকাত ধরতে বলেনি। ডাকাত ধরার জন্য ও চুক্তিবদ্ধ নয়।
শেঠ বদ্রীপ্রসাদ ওকে বলেছে, বিদ্যাকে নিয়ে যেতে। বিদ্যাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই ও অগ্রিম পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছে। শেঠজি পরিষ্কার বলেছেন যে, ওকে আর কিছু করতে হবে না। শুধু বিদ্যাকে তাঁর কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
বিজয় যদি সমাজবিরোধী হয়ে থাকে, ডাকাত বা খুনি হয়ে থাকে, কিংবা বিপ্লবী হওয়াটা বেআইনি হয়ে থাকে, তার জন্য আছে পুলিশ। তার জন্য আছে দেশের আইন। দেশের আইন তার বিচার করবে। একজন পেশাদার হিসাবে নিজের লাইনের বাইরে ওর পা বাড়ানো ঠিক হবে না।
কিন্তু ও কথা দিয়েছে শেঠজিকে। চুক্তি করেছে যে, বিদ্যাকে ও ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। দীপক পেশাদার লোক। চুক্তিভঙ্গ করা ওর পক্ষে অসম্ভব। জীবন গেলেও ওকে কথা রাখতে হবে।
দীপক বিজয়কে বলল, ‘তোমার ওই সব তত্ত্ব আমার মাথায় ঢোকে না। তুমি ঠিক করছ না ভুল করছ, তা আমি জানি না। আমি শুধু জানি যে, ওটা আমার ব্যাপার নয়। কিন্তু আমি পেশাদার লোক। আমি আমার জীবিকার প্রতি অসৎ হতে পারি না। বিদ্যাকে আমি নিয়ে যাব বলে কথা দিয়েছি, অগ্রিম টাকা নিয়েছি।’
বিজয় বলল, ‘তার মানে, তুমি আমাদের ধরে নিয়ে যাবে তাঁর কাছে?’
‘উপায় নেই।’
সারা রাত তারা জঙ্গলে কাটাল। পরের দিন সকালে লতা এল। লতা ওকে বলল যে, বিজয়ের দলকে পুলিশ তাড়া করেছে, ওরা পালিয়েছে।
দীপক লতাকে বলল খানদুয়েক ঘোড়া বিজয়দের পরিত্যক্ত শিবির থেকে নিয়ে আসতে। এবং একজন বিশ্বস্ত যুবককে সংগ্রহ করতে।
লতা একজন যুবক এবং দুটো ঘোড়া নিয়ে এল।
দীপক যুবককে তার দূত হিসেবে বদ্রীপ্রসাদের কাছে যেতে বলল। হাতে দিল প্রচুর টাকা। বদ্রীপ্রসাদ যেন তাঁর বাড়ির তিন মাইল দূরে ফাঁকা ধানখেতে মেয়েকে নিতে আসেন। এবং চুক্তি অনুযায়ী তিনি যেন পুলিশকে কোনওরকম খবর না দেন। তাহলে তিনি মেয়েকে ফেরত পাবেন না। বাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা অবশ্যই আনতে হবে সঙ্গে করে।
যুবক চলে গেল বদ্রীপ্রসাদের কাছে।
দীপক একটা ঘোড়ায় বসল। অন্য ঘোড়ায় বসল বিদ্যা এবং বিজয়। সকলে চলল সেই বিস্তৃত ফাঁকা ধানখেতের দিকে।
পরের দৃশ্য ধানখেতের।
ধান কাটা হয়ে গেছে। ফাঁকা বিস্তৃত মাঠ দিগন্তের সঙ্গে মিশেছে।
একদিকে শেঠ বদ্রীপ্রসাদ তাঁর ডানহাত রাজু এবং কয়েকটি চেলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রায় দেড়শো গজ দূরে বিপরীত দিকে ঘোড়ার ওপর বসে আছে বিজয়।
ঠিক মাঝখানে দীপক এবং বিদ্যা। দীপক ডাকল শেঠ বদ্রীপ্রসাদকে। বদ্রীপ্রসাদ এগিয়ে এলেন।
দীপক বলল, ‘শেঠজি, আপনি আমাকে আপনার মেয়েকে আনতে বলেছিলেন। কিন্তু সঙ্গে করে এত লোক এনেছেন কেন?’
শেঠজি গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন, ‘আমি কী করব না করব, সেটা তোমাকে বলব না। তোমার সঙ্গে যা চুক্তি হয়েছিল, তুমি সেই অনুযায়ী কাজ করবে। চুক্তিতে এ-কথা বলা হয়নি যে, আমি মেয়েকে রিসিভ করার সময় সঙ্গে করে কাউকে আনতে পারব না।’
রাগে দীপকের চোখদুটো হঠাৎ লাল হয়ে উঠল। সে অনেকক্ষণ বদ্রীপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর নিজেকে কোনওরকমে সংযত করে বলল, ‘চুক্তি? বেশ, চুক্তি অনুযায়ী কাজই হবে। চুক্তির বাইরে একটা কাজও আমি করব না।’
বদ্রীপ্রসাদ বললেন, ‘না। সে তোমায় করতে হবে না।’
‘তাহলে বাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে আপনি মেয়েকে নিয়ে যান।’
শেঠজি ফিরে রাজুর দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন। রাজুর হাতে একটা ব্যাগ ছিল। সে এগিয়ে এসে ব্যাগটা দীপকের হাতে দিয়ে বলল, ‘শেঠজির তরফ থেকে পঞ্চাশ হাজার, আমার তরফ থেকে দশ হাজার, মোট ষাট হাজার আছে। আমি কথা দিয়েছিলুম।’
দীপক টাকাটা ঘোড়ার পিঠে রেখে বলল, ‘শেঠজি, চুক্তি ছিল আপনার মেয়েকে এনে দেব। আপনার মেয়েকে এনে দিয়েছি। চুক্তি শেষ—আমার দায়িত্ব শেষ। এবার আপনি ওকে রাখতে পারবেন কি না, সেটা আপনার ব্যাপার।’
দীপক কথা শেষ করে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।
বিদ্যার হাত ধরলেন শেঠজি, ‘চল।’
বিদ্যা এক ঝটকায় শেঠজির হাত ছাড়িয়ে, ‘না,’ বলেই ছুটল বিজয়ের দিকে।
শেঠজি দীপকের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘ওকে থামাও! ওকে ধরো।’
দীপক বাঁকা হাসি হেসে বলল, ‘চুক্তিতে এমন কথা তো ছিল না যে দুবার ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে।’
‘তার মানে? তুমি টাকা নাওনি ওকে ফিরিয়ে আনার জন্যে?’
‘ফিরিয়ে এনেছি।’
‘তুমি বিশ্বাসঘাতক!’
‘চুক্তি অমান্য করিনি। বিশ্বাসঘাতক নই।’
রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বদ্রীপ্রসাদ তাঁর দলকে আদেশ দিলেন, ‘যাও, ধরো ওকে। কিছুতেই পালাতে দিয়ো না। ওদের কিছুক্ষণ আটকে রাখো, এখুনি পুলিশ এসে পড়বে।’
বদ্রীপ্রসাদের দল এগিয়ে গেল।
সঙ্গে-সঙ্গে অশ্বারূঢ় বিজয়ের হাতে আবির্ভূত হল একটা পিস্তল। ও আগুয়ান দলকে লক্ষ করে একটা গুলি ছুড়ল।
দীপক পিস্তুল বের করে দলটার গতিরোধ করে দাঁড়াল।
রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বদ্রীপ্রসাদ বললেন, ‘একে বলে পেশাদার? যার টাকা নিয়েছ, তারই দিকে পিস্তল উঁচিয়ে ধরেছ?’
‘হ্যাঁ। এটাই প্রফেশনালের ধর্ম। তুমি আমায় ভাড়া করেছিলে, তখন আমি ওদের দিকে পিস্তল উঁচিয়ে ওদের ধরে নিয়ে এসেছি। তোমার আদেশ পালন করেছি। আমার দায়িত্ব শেষ। এখন ওরা আমায় ভাড়া করেছে, যেন তোমার খপ্পর থেকে ওদের বাঁচাই। ওরা পুরো পারিশ্রমিক আমায় দিয়ে দিয়েছে। বিজয় আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। তোমার মতো আমায় মিথ্যে কথা বলেনি। ধোঁকা দেয়নি। আমি প্রফেশনাল, আমি এখন ওদের কাছে চুক্তিবদ্ধ।’
‘বটে! রাজু, ওম, চালাও গুলি। ওদের তিনজনকেই উড়িয়ে দাও।’
হঠাৎ সেই নির্জন প্রান্তর ঝলসে উঠল আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে। চারদিক ছেয়ে গেল বারুদের গন্ধে। একদিকে বদ্রীপ্রসাদ আর তাঁর সশস্ত্র দল। আর-একদিকে দীপক, আহত বিজয় এবং বিদ্যা।
কিছুক্ষণের জন্য সেই নির্জন প্রান্তর হয়ে উঠল যুদ্ধক্ষেত্র।
কিন্তু একজন সশস্ত্র বিপ্লবী এবং একজন পেশাদার বন্দুকবাজের সামনে তারা দাঁড়াতেই পারে না। প্রথমে প্রাণ দিতে হয় রাজুকে। ক্ষিপ্ত বদ্রীপ্রসাদ দীপককে উদ্দেশ করে গুলি চালাতে যান। কিন্তু তার আগেই বিজয়ের একটা গুলি এসে লাগে বদ্রীপ্রসাদের বুকে।
বাকিরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালায়।
বিজয় নিজের ঘোড়ায় তুলে নেয় বিদ্যাকে। হাত তুলে দীপককে বিদায় জানায়।
দীপক বলল, ‘বিদায়। যদি কেউ আবার আমায় পাঠায় তোমাকে ধরে নিতে যেতে, তাহলে তোমার খোঁজে আবার আসব।’
বিদ্যা বলে, ‘তখন আমাদের আর ও-জঙ্গলে পাওয়া যাবে না। আমরা সেখানে ফিরছি না।’
বিজয় বলে, ‘তুমিও তৈরি থাকো, দীপক। সেদিন বোধহয় এগিয়ে আসছে, যেদিন আমার আদালতে তোমার বিচার হবে।’
দীপক হেসে বলল, ‘আমি তোমার কোনও ক্ষতি করিনি। কিন্তু দেশের আইন তোমার বিচার করবে। চলি।’
বিজয় আর বিদ্যা অজানা আস্তানার দিকে ছুটিয়ে দিল ওদের ঘোড়া। দীপক দেখল, ওরা দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়ার পর একটা পুলিশ জিপ ছুটেছে ওদের দিকে।
দীপক ফিরে চলল সেই গ্রামের দিকে, যেখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছে লতা।
মাসিক রোমাঞ্চ
পুজো সংখ্যা, ১৯৮৩