চিলেকোঠার সেপাই – ৫২
ওসমানের এইসব তৎপরতা আনোয়ারের কানে নিশ্চয়ই ধাক্কা দিচ্ছিলো। কিন্তু সে তখন আমূল ঘুমে বিদ্ধ।
ওসমান উঠে গেলে তার ঘুম ভাঙেনি। বরং হাঁটুজোড়ার ভেতর ভাঁজ করে রাখা হাত ২টো ছড়িয়ে সে শুয়েছে আরাম করে। রোগা ও পুরনো তক্তপোষে চারকোনা মশারির ভেতর পাতলা কাঁথার নিচে মাঝারি সাইজের ফর্সা তনুখানি পরিপাটি করে বিছিয়ে ঘুমে ঘুমে আনোয়ার তলিয়ে গেছে অনেক ভেতরে। নিরিবিলি এই ঘর তার নিশ্বাসে প্রশ্বাসে নিভৃত হয়। ওসমান সুইচ অফ করে যাওয়ার পর পাতলা অন্ধকার ১টি কাথা হয়ে তার চোখমুখ ঢেকে দিয়েছে। ওপরে এই অন্ধকার একটু পাতলা, কিন্তু তার চোখের ভেতরকার অন্ধকারকে এটা বেশ ঘন করে তোলে। অন্ধকার ক্রমে পুরুষ্ট্রও হয়। অন্ধকারে পড়ে অন্ধকারের ছায়া এবং ছায়া-অন্ধকার ঘনিয়ে আসে বৈরাগী ভিটায়। চেংটুকে খুঁজতে গিয়ে সেখানে দ্যাখা মেলে জালাল মাস্টারের। বটগাছের পুরু শিকড়ে বসে জালালউদ্দিন বৈরাগীর ভিটার নতুন মহিমা কীর্তন করে, এতদঅঞ্চলের ব্যামাক মানুষ, আবালবৃদ্ধবণিতা এই বটবৃক্ষের তলা দিয়া যাতায়াত করে। হাটবাজার যাবার পথ এখন কতো সংক্ষিপ্ত হছে আন্দাজ করবার পারে? আগে দুপুরবেলাতেও এদিক আসতে মানুষ আতঙ্কিত হছে, আর এখন? জালালউদ্দিন উৎসাহ ও উত্তেজনায় নড়েচড়ে বসে, এখন বিকাল হলে স্থানীয় চ্যাংড়া প্যাংড়া, যুবক ও তরুণদের বেড়াবার জায়গা হছে এটা। আবার ধরে ধর্মসভা কও, ওয়াজ মহফিল কও আর সভাসমিতি কও-এই কয়ট ইউনিয়নের মধ্যে এরকম জুতের জায়গা আর কোথায় পাবা? বগুড়া থাকা, নেতৃবৃন্দ আসেন, এই বটবৃক্ষের তলায় গ্রামবাসী তেনাদের ভাষণ শোনে, বুঝলা না?-আনোয়ার বোঝে বৈ কি কতো মানুষের সঙ্গে বসে সে নিজেও বক্তৃতা শুনছে, জাতীয় পর্যায়ের কোনো এক নেতার জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনতে শুনতে ঝিমায়। বাতাস বইলে বক্তৃতার সঙ্গে সঙ্গত করে বাজতে-থাকা বটপাতার মর্মরধ্বনিতে তার বড়ো ঘুম পায়।
স্বপ্লের এই ঘুম আনোয়ারের সত্যিকারের ঘুমকে মস্ত বড়ো কড়াইতে ধিক ধিক তাপে জ্বাল হতে থাকা দুধের মতো আওটায়। তার গালের ভেতর টাকরায় জিভ লেগে আওয়াজ হয়। আনোয়ার তারিয়ে তারিয়ে সুস্বাদু ঘুম পাড়ে। আওটানো ঘুমে সর পড়ে, ঘুমে ঘুমে সর পুরু হয়। বাইরের যাবতীয় শব্দ, গন্ধ ও রঙ সেই ঘরের ওপর আটকে থাকে, আনোয়ারকে ছুঁতেও পারে না।