চিলেকোঠার সেপাই – ৪৫
তক্তপোষে খিজিরের প্লায়ার ও স্ক্রু-ড্রাইভার। ২টোর ছোঁয়া বাঁচিয়ে শুয়ে পড়লে জুম্মনের মায়ের গা শিরশির করে। বড়ো শীত করে, স্যাঁতসেঁতে শীত; ঠাণ্ডা লোহার টুকরা যেন এগিয়ে আসছে তার তলপেটের দিকে। সারা শরীর কাপে, কিন্তু যন্ত্রগুলো ঠেলে ফেলে দেওয়ার মতো বল সে হারিয়ে ফেলেছে।–নাঃ! মহাজনের বাড়ি কাজে যাওয়াটা আজ ঠিক হয়নি। কিন্তু সিতারার পান-চিনি, আজ না গিয়ে পারে? আর শনিবারের ঘটনা, আজ ৫/৬ দিন হতে চললো, শরীর তবু সেরে ওঠে না কেন?
শনিবার কি? হ্যাঁ, শনিবারেই তো!-ঠাণ্ডায়, দুর্বলতায় এবং প্লাস ও ক্ষু-ড্রাইভারের ধাতব হাজিরায় জুম্মনের মায়ের মাথার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে পড়ে, দিন তারিখ সব গুলিয়ে যায়। তাহলে কামরুদিন এসেছিলো কবে? এসে খুব শাসিয়ে গেলো, তুই তাইলে থাক! তুই প্যাট খসাইবি না, তে আমার কি গরজ পড়ছে ঐ জাউরাটারে লইয়া তরে ঘরে তুলুম? কিন্তু জুম্মনের মা কি করতে পারে? ঐ রাতে, হ্যাঁ শুক্রবার রাতে এসেছিলো খিজির। ঠিক এই তক্তপোষে বসে তার তলপেটে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। সেই সাড়াশি-মার্ক আঙুলগুলোর চাপে জুম্মনের মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। চিটচিটে অন্ধকারে মরা মানুষটাকে স্বপ্নে দাখার ফলে ভয়ে পেটের ব্যথা ঠিক ততোটা ঠাহর করতে পারেনি। টের পেলে দুপুরবেলা, মহাজনের বাড়িতে বাসন মাজতে মাজতে, উরুসন্ধিতে ভিজে ভিজে ঠেকেছিলো। বিবিসায়েবকে বলে তাড়াতাড়ি চলে আসে বস্তিতে। তক্তপোষে শুতে না শুতে মনে হয় পেটের বাসিন্দা আগুন হয়ে জ্বলে উঠছে। তাহলে রাত্রিবেলা হাড্ডি খিজির কি হাতের ঘষায় ঘষায় আগুন জ্বলিয়ে দিয়ে গেলো? জুম্মনের মা কি নাপাক হয়ে ঘোরাঘুরি করেছে? রাত্রে একা ঘরে ফেরার সময় নন্দলাল দত্ত লেনের গলা-কাটা মাহাক্কাল কি তার দিকে নজর দিলো?-এতোসব ভাবনার সুযোগ পাওয়া যায় না। প্রবল যন্ত্রণার মধ্যে জুম্মনের মা টের পায় যে ওসব কিছু না, হাড্ডি চোদাই মইরা অহন তার গুড়াটারে চেতাইয়া দিছে! —যে মানুষ এখন পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করেনি, তার মস্তানিটা দ্যাখো আগুনের পা দিয়ে জুম্মনের মায়ের পেটে সে অবিরাম লাথি মারতে শুরু করলে আর সহ্য হয় না। বজলুর বৌ ভাগ্যিস সেই সময় বস্তিতেই ছিলো, জুম্মনের মায়ের গোঙানি শুনে সে-ই সব ব্যবস্থা করে। সব কথা জুম্মনের মা খেয়াল করতে পারে না। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসার মুহুর্তে সে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছিলো, মনে হলো খিজিরের লম্বা শরীর গুলি খেয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। খিজিরকে ধরার জন্যে সে কি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো? ১বার মনে হলো রক্তাক্ত শরীর নিয়ে খিজির বোধহয় উঠে চেপে বসেছে তার তলপেটের ওপর। খিজিরের রক্তে তার কোমরের নিচে থেকে উরু, হাঁটু, পা—সব ভিজে যাচ্ছে। গাঢ় লাল রক্ত ফোয়ারার মতো উঠছে জুম্মনের মায়ের শরীর থেকে, সমস্ত ঘর কালচে লাল রঙে অন্ধকার হলো। তারপর আর কিছু দ্যাখা যায়নি। বজলুর বৌ এবং আরো কয়েকটি মেয়েলি গলার স্বর ভেসে আসে অনেক দূর থেকে। সেইসব কথা দেখতে দেখতে ঝাপশা ধ্বনি হয়ে উড়াল দেয় গলির ভেতর, গলি দিয়ে হারিয়ে যায় বড়ো রাস্তায়। এদিকে তার নিঃশব্দ ও অন্ধকার শরীর থেকে তরল আগুন বেরিয়ে যাচ্ছে, এতো আগুন বেরোবার জন্যে উরুসন্ধির পথ তার বড়ডো সরু, গতর পুড়ে যায়, গতর ছিঁড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর গনগনে জ্বলন্ত কয়লার তাল বেরিয়ে যাওয়ার স্পর্শ টের পায় এবং আগুনের শিখা তখন মাথা নোয়ায়। তারপর সব অন্ধকার। ভোরের দিকে জ্ঞান ফিরলে মনে হয়েছিলো সারা জীবনে সে আর উঠতে পারবে না।
কিন্তু তারিয়ে তারিয়ে কতোদিন কষ্ট পাবে জুম্মনের মা মহাজনের বাড়িতে উৎসব, বস্তির ঘরে শুয়ে বসে থাকা কি তার পোষায়? আবার ঐ বাড়িতে গেলে কাজকাম না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকাটাও যন্ত্রণা। আজ বিকাল হতে বিবিসায়েব নিজেই তাকে ছুটি দিলো। জুম্মনের মা কি এসব বোঝে না? কাজে কামে যতোই সচল হোক, শুভ-অনুষ্ঠানে অপয়া মেয়েমানুষ ঘরে থাকলেই কুফা। তা সে না হয় একটু দূরে বসে বসে দেখতো, তাতে সিতারার জীবনটা কি নষ্ট হয়ে যেতো? কতো লোক আজ মহাজনের বাড়িতে বজলুর বৌ পর্যন্ত নিজের মহাজনের বাড়ি থেকে ছুটি নিয়ে ঐ বাড়িতে ১বার এটা বাটে, ১বার ওটা এগিয়ে দেয়। আবার জুম্মনের মায়ের দিকে তাকিয়ে বিবিসায়েবের সঙ্গে কিসব ফুসুরফাসুর করে আল্লাই জানে। মাগী সেদিন এতো যত্ন-আত্তি করলো, ৫/৬ দিন যেতে না যেতে তার বিবিসায়েবের কাছে গিয়ে তার নামে কিসব গিবত করে!-জুম্মনের মায়ের মনে হয়, এই বজলুর বৌ-ই শয়তানি করে তার বাচ্চা নষ্ট করলো না তো? মাসখানেক হলো শাহ সায়েবের বাড়িতে মাগী ঠিক কাজ করে, কামরুদিনের টাকা খেয়ে শাহ সায়েবের দোয়া-পড়া তাৰিজ হয়তো পুঁতে রেখেছে জুম্মনের মায়ের ঘরের সামনে। একবার উঠে দেখবে?-নাঃ দাঁড়াবার মতো বল নাই বলে মাটি খুঁড়ে তাবিজ খোজার কাজ স্থগিত রাখে -এখন তাকে বিয়ে করতে কামরুদিনের তো কোনো অসুবিধা হবে না। বিয়ের দিনই সে জিগ্যেস করবে, জুম্মনের বাপ, ঈমানে কওতো, আমার প্যাট খসাইবার লাইগা বজলুর বৌরে দিয়া তুমি আমার ঘরের বগলে তাবিজ পোতাইয়া রাখছিলা না?
কিন্তু রাগ বা সংকল্প-তার মাথায় কিছুই দানা বাধে না। সব ছাপিয়ে ওঠে খিজিরের প্লায়ার ও ক্ষু-ড্রাইভার। শেষ বিকালবেলা দেখতে দেখতে গর্তে গড়ায়, বস্তির পাশের নর্দমা থেকে উঠে আসে সন্ধ্যাবেলা,-ভাপসা ঘিনঘিনে অন্ধকার। জুম্মনের মায়ের শরীরের রুগ্ন হিম তাকে এতোটুকু ঝকঝকে করতে পারে না। সেই অন্ধকার বরং তক্তপোষের ওপরকার প্লায়ার ও ভূ-ভ্ৰাইভারের দীর্ঘদিন ব্যবহারজনিত মসৃণতা মুছে ফেলে এবং আদিম কালের কোনো লোহার আস্ত্রের মতো সেগুলো হয়ে ওঠে খসখসে। খিজির কি ২ হাতে ২টে ধরে তার দিকে এগিয়ে আসবে? এগুলো নেওয়ার জন্যেই কি মৃত্যুর পরও আসাযাওয়া অব্যাহত রেখেছে? এসব দিয়ে তার তলপেটে সরাসরি খোঁচা দিয়ে জিগ্যেস করতে পারে, ফালাইয়া দিছস? ওস্তগররে দিয়া মারাইবার লালচে পোলাটারে দুনিয়াটা দ্যাখবার দিলি না?–তার কথা স্পষ্ট নয়, গুলিবিদ্ধ শরীর থেকে আসা ঘড়ঘড় নিশ্বাসে ঘরের অন্ধকার আরো পাকে। হঠাৎ শোনা গেলো, বত্তি জ্বালাও নাই?-হোক মরা মানুষের গলা, স্পষ্ট বাক্য শুনে জন্মনের মা বুকে বল পায়। এই ছোট্রো শক্তির সাহায্যে সে আরো শোনে, তোমার বলে কঠিন বিমারী ? কি হইছে মা?
জুম্মনের উপস্থিতি টের পেয়ে জুম্মনের মা জোরে জোরে নিশ্বাসে ফেলে। এই নিশ্বাস একটু নোনা বলে তার চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। মনে পড়ে বেশ কয়েকদিন আগে এইসব যন্ত্রপাতি নিয়ে জুম্মন কোথায় চলে গিয়েছিলো। ৭/৮ দিন তার পাত্তা নাই। এখন বিকালবেলা ঘরে এসে তক্তপোষের ওপর যন্ত্রগুলো দেখেই তো তার বোঝা উচিত ছিলো যে জুম্মন ফিরে এসেছে। বুঝতে পারলো না কেন?
জুম্মন কুপি জ্বালালে কালচে লাল আলোয় ছেলের মুখ দেখে জুম্মনের মা জড়সড় হয়ে বসে। হয়তো এই ভাবটা সামলাবার জন্য ছেলেকে সে ধমকায়, ঐগুলি লইয়াকৈ গেছিলি হারামজাদা? চুরি কইরা ভাগছিলি কৈ?
চুরি করুম ক্যালায়? আমারে দিয়া গেছে।
তর বাপের সামান? ক্যাঠায় দিছে?
খিজিরে। একটা চেন ভি দিয়া গেছে। দেখবা? কি সোন্দর!
পিচ্চি পোলাটার মুখে বয়স্ক মানুষের নাম উচ্চারণ জুম্মনের মায়ের কানে খরখর করে। কি কম? বলতে বলতে জুম্মনের মা তার উদ্যত হাত গুটিয়ে নেয়। নাঃ পোলার দোষ কি? খিজিরকে কিছু বলে ডাকতে সে তো ছেলেকে কখনো শেখায়নি। একবার ইচ্ছা হয় যে বলে, তারে তুই চাচামিয়া কইবাব পারস না? এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে খিজিরের স্থায়ী অনুপস্থিতি বড়ো প্রকট হয়ে ওঠে। লোকটার জন্যে একটু কাদার লোভে জুম্মনের মায়ের গলা, জিভ ও ঠোঁট আকুপাকু করে। মায়ের এইসব লোভলালসা সম্পর্কে উদাসীন জুম্মন ঘোষণা করে, আঞ্চায় না আবার বিয়া করতাছে। মাকে তরু অন্যমনস্ক দেখে জুম্মন গলা চড়ায়, আব্বায় বিয়া করতাছে। ফুফু আমারে কইছে। কয় মাইয়া খুব সোন্দর। তোমার লাহান কালা পাতিলার তলা না। মাইয়ার বাপে মতিঝিলের কোন বিলাতি অফিসের পিয়ন। আব্বারে চাকরি দিবো। আব্বায় ওস্তাগরি ছাইড়া দিবো। ঐ অফিসের সায়েবে আব্বারে থাকনের জায়গা ভি দিবো। ধানমণ্ডির মইদ্যে থাকে।
আমি ধানমণ্ডি উনমণ্ডি যাইবার পারুম না! জুম্মনের মায়ের মুখ থেকে এই কথা বেরিয়ে পড়লে খিজির খিলখিল করে হাসে, তোমারে লইলে তো? আব্বায় থাকবো নয়া বৌ লইয়া। আমি আব্বার লগে থাকুম না!
জুম্মনের মা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। জুম্মন বুঝতে পারে না, কামরুদিনের জন্যে ওর মায়ের এতোটা টান কেন? যে লোকের ঘর ছেড়ে সে বেরিয়ে এসেছে কতোদিন আগে, যে এখন তার কেউ নয়, তার ৩ নম্বর বিয়ের খবরে মা এতোটা ভেঙে পড়বে জানলে খবরটা না হয় সে চেপেই যেতো।
রাত বাড়ে। মায়ের কান্না আর থামে না। এদিকে জুম্মনের খিদে পেয়েছে। মহাজনের বাড়ি থেকে মায়ের নিয়ে আসা মিষ্টি ও ফিরনির সবটাই মেরে দিয়ে শুয়ে শুয়ে সে হাই তোলে। মায়ের কান্নার বিরতি নাই। কাঁদতে কাঁদতে জুম্মনের মা বলে, তুই থাকবি আমার লগে।
না। আমারে লগে থাকতে কইছে ওসমান সাবে। ওসমানের সঙ্গে থাকবার সংকল্প জানাতে জানাতে জুম্মনের চোখ থেকে ঘুম চলে যায়। এই মহাজন বলো আর আলাউদ্দিন মিয়া বলো,-এদের দেখলেই ভয় লাগে। খিজিরকে এরা ঘর থেকে বার করে দেয়নি? ওসমান সায়েবের ঘরেই খিজির এখনো রোজ আসে, ওসমান সায়েব তার সঙ্গে কতো কথাবার্তা বলে। খিজিরের ক্রু-ড্রাইভার আর প্লায়ার আর সাইকেলের চেনটা নিয়ে জুম্মন রেখে দেবে ওসমান সায়েবের ঘরে। খিজির তাহলে ঐসব রোজ দেখতে পাৰে।
আরে, ঐ সাবের না মাথা খারাপ হইছে! উই কি কয় না কয়- জুম্মনের মা ছেলেকে ধমক দেয় বটে, কিন্তু তার গা ছমছম করে। জুম্মন ঘুমিয়ে পড়লে তার ভয় আরো বাড়ে। জুম্মনের মুখ বড়ো শান্ত ও নিশ্চিন্ত। এই মুখে কার ছায়া? জুম্মনের জন্মের আগে খিজিরের সঙ্গে জুম্মনের মায়ের তো দাখাই হয়নি। তবে?-ঘুমের মধ্যে এরকম একটানা নিশ্বাস নিতে শুনেছে সে কোথায়? জুম্মনের নিশ্বাসে ভর করে খিজির আলি কি তাকে শাসন করতে এসেছে? অপঘাতে মরলে মানুষের কতো কষ্ট হয়—কাল পরশু বিবি সায়েবের কাছে কিছু টাকা চেয়ে নিয়ে শাহ সায়েবের মসজিদে শিরনি পাঠিয়ে দেবে। জুম্মনের একটানা নিশ্বাস-প্রশ্বাস শুনতে শুনতে জুম্মমের মায়ের চোখে নতুন পানির ঢল নামে। একটু ফোপাবার পর গলা খুলে কাঁদতে শুরু করে। কামরুদিনের নতুন বিয়ে করার খবর খিজিরের জন্যে এভাবে হামলে কাদবার পথ খুলে দিয়েছে। কান্নায় এতোটুকু বিরতি না দিয়ে জুম্মনের মা ছেলেকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে।