চিলেকোঠার সেপাই – ৩১
সকাল বেলা আনোয়ার মন্তাজ কানার কাছে প্রতিদিন খবর পায়, খয়বার গাজী বহাল তবিয়তে আছে। তবে পরশু থেকে বিকালবেলা বৈঠকখানার উঁচু বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে সূর্যাস্ত দ্যাখা স্থগিত রেখেছে। আজ সন্ধ্যায় করমালির ঘরের সামনে মন্তাজ কানার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আনোয়ারের একটু দেরি হয়ে গিয়েছিলো, বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা বাজলো। এসে দ্যাখে ভেতর-বাড়ির চওড়া বারান্দায় বসে খয়বার গাজী ও জালালউদ্দিন সেমাই খাচ্ছে। আনোয়ারকে দেখে খয়বার গাজী মুখ ভরে হাসে, বাবাজী, আমার ওদিক আর গেলা না তো চরের মধ্যে গেছিলা শুনলাম। আমি জানলে আফসারকে সাথে দিতাম, এখন হাসের মৌসুম, আফসারের হাতের টিপ খুব ভালো। চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সে তোলে আনোয়ারদের চর এলাকার জমিজমার কথা, জমাজমির তদবির করা আসলা? নিজে না দেখলে জমি বেহাত হয়ে যায় বাবা। আকবর ভায়েক কত কছি, চরের মধ্যে আপনাদের জমি উঠতিছে, দাখিলা দ্যাখেন, খতিয়ান দ্যাখেন। আকবর ভাই গাও করে নাই। তা তুমি জমি দ্যাখাশোনা করতিছ, জালাল মিয়া কলো। ভালো। করাই লাগবো। দিন কি সবসময় একরকম যায়?
সম্পত্তির প্রতি আনোয়ারের আকর্ষণের দিকে লোকটা বিশ্রী ইঙ্গিত দিলো। ব্যক্তিমালিকানার প্রতি মোহ আনোয়ারের কাছে অরুচিকর ও নিচু ধরনের প্রবৃত্তি বলে মনে হয়। তবে রুচির চেয়েও জরুরি দরকার থাকে। আনোয়ারের কোনো কথা কি আচরণে খয়বার যেন সন্দেহ করতে না পারে। এখন তার কোনো কথার প্রতিবাদ করা ঠিক নয়। মন্তাজ কাল খবর দিলো যে চেন্টু, বান্দু শেখ, করমালিরা চালুয়াবাড়ি হয়ে ধারাবর্ষা ও ডাকাত-মারা চর পৌঁছতে পৌঁছতে শখানেকের বেশি লোক তাদের সঙ্গী জুটে গেছে।
আবার বড়োচাচীর সঙ্গে দ্যাখা করার জন্য খয়বার ভেতরের ঘরে গেলে জালাল মাস্টার আনোয়ারের কানের কাছে মুখ এনে তার ভয়ের কথা জানায়, সমাচার খুব খারাপ। ডাকাতমারার চরের বাথান শুনলাম লুটপাট হছে। হোসেন আলির বাড়িত নাকি আগুন ধরায়া দিছে। কও তো বাপু, এটা কি মনুষ্যত্ব?
‘হোসেন আলিও শুনি লুটপাট চুরিচামারি করেই গোরুর বাথান করেছে। আস্তে বাবা, আস্তে। খয়বার ভাই শুনবো। এতো বড়ো নামী মানুষটা। কাল থাকা চিন্তায় চিন্তায় শরীরখান অর্ধেক করা ফালালো!
জালালউদিনের কাছেও আনোয়ার সাবধান হওয়ার চেষ্টা করে, খয়বার চাচার ভয় কি? আমিও তো সেই কথা কলাম। জালাল মাস্টার হাই তোলে, হাই তুলতে তুলতে কথা বলায় তার শব্দ বাঁকা হয়ে যায়, তবে ধরে বিষয় সম্পত্তিআলা মানুষ তো, ওদিককার চরের দশ আনার মালিক তাই নিজে, দুশ্চিন্তা একটু হবোই।
ঘুমে তার চোখ দুলে আসছিলো, এমন সময় খয়বার গাজী জালাল মিয়া, শুনছেন? বলে এই ঘরে ঢুকলে জালালউদ্দিন সোজা হয়ে বসে।
ধারাবর্ষার দুই পাশেই নদীর মধ্যে ঘোড়ার ডাক শোনা গেছে। কন তো কি বিপদের কথা!
আনোয়ার জিগ্যেস করে, আপনি কোনোদিন ঘোড়ার ডাক শুনেছেন? না বাবা। চরের দিকে আমরা যাইই না, আগে যখন বয়স আছিলো তখন শিকার টিকার করবার গেছি। তাও বছরের মধ্যে ঐ একবারই। গত দশ বছর ওদিক যাওয়া হয় নাই। সে বেশ দুশ্চিন্তগ্রস্ত, কি মুসিবতের কথা কন তো? তা এখন কি বান হবার পারে?
তাকে সান্তুনা দেওয়ার চেষ্টা করে জালালউদ্দিন, বান কোনো কথা নয়। বড়ো ধরনের বালা মুসিবত, সংকট, বিপদ, আপদ, দুর্যোগ, বিপর্যয় সামনে থাকলে যমুনার মধ্যে দেড়শো দুইশো ঘোড়া সংকেত দেয়। আনোয়ারের আস্থা অর্জনের জন্যে জালালউদ্দিন প্রস্তুতি নেয়, ইতিহাসে আছে– ‘
ইতিহাস ভূগোলের চর্চা আঁচ করে খয়বার গাজী ফের বড়োচাচার ঘরে চলে গেলে আনোয়ার বলে, নদীর ভেতর ঘোড়া চরে বেড়ায়, এ কথা ইতিহাসে থাকবে কেন?
‘আরে নদী ছিলো কোথায়? ইতিহাস চর্চার উৎসাহে জালালউদিনের চোখ থেকে ঘুম চলে যায় কোথায়, দেড়শো পোনে দুইশো বছর আগে ওখানে গভীর অরণ্য। যমুনা তখন একটা খাল, কোম্পানীর ম্যাপে পাবা যমুনা ক্যানেল।
বেশ তো, ভূমিকম্পে ব্ৰহ্মপুত্রের কোর্স চেঞ্জ হলে যমুনা নদী বড়ো হলো। কিন্তু এর সঙ্গে ঘোড়ার ডাকের সম্পর্ক কি? আনোয়ারের সংশয় জালালউদ্দিনকে অনুপ্রেরিত করে তোলে। সে তখন যমুনা নদীর ভেতরকার হেষাধ্বনির ঐতিহাসিক সূত্র বিশ্লেষণ করে। কিরকম?—ফকির বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে মজনু শাহের অনুসারীদের অনেকেই আশ্রয় নেয় যমুনা খালের পশ্চিমে। আহত মজনু শাহ গঙ্গা পার হয়ে পালাবার সময় মারা যায় বিহারের কোনো গ্রামে। তার মৃত্যুর মুহুর্তে সমস্ত ঘোড়া একসঙ্গে চিৎকার করে চরম অশুভ সংবাদটি তার অনুসারীদের জানাবার চেষ্টা করেছিলো।
‘কোথায় বিহার, কোথায় মজনু শাহ্, আর এখানে তার অশ্ববাহিনী তা আঁচ করে কিভাবে? আনোয়ারের সংশয়ে জালালউদ্দিন আরো মরিয়া হয়ে উঠে, আরে বাবা, সায়েন্সেই তো বলে, ইতর প্রাণীর কোনো কোনো বোধ মানুষের অপেক্ষা বহুগুণ প্রবল।’ শক্ত শক্ত কথায় যমুনার ভেতর হেষাধ্বনির ঐতিহাসিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করতে জালালউদিনের উৎসাহ দেখে আনোয়ারের চোখের পলক পড়ে না।
খয়বার গাজী খাবে বলে মুরগি জবাই করা হয়েছিলো। রান্নাবান্না শেষ হলে খেতে খেতে রাত ১১টা। জালালউদ্দিন অবশ্য বিদায় হয়েছে আগেই। খাওয়ার পর খয়বার গাজী বেরিয়ে তার বাড়ির দিকে না গিয়ে উল্টোদিকে যাত্রা করায় আনোয়ারের খটকা লাগে; লোকটা কি পালাবার তালে আছে? খয়বার গাজীর পাশে লাঠি হাতে ২ জন লম্বা চওড়া কিষাণ। পেছনে জবুথবু নাদু পরমাণিক।
‘চাচা, কোথায় যাচ্ছেন? আনোয়ারের ডাকে খয়বার চমকে উঠে। মাথার ওপর কাঁঠালগাছের প্রসারিত ডাল। বঁদিকে ভাঙা দালানের স্তৃপ। দালানের পাশে খড়ের গাদার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১টা সাদা গোরু। তার ল্যাজ নাড়ার আওয়াজ ঝাপশা হয়ে কানে আসে, সেই মৃদু আওয়াজে নীরবতা আরো গাঢ় হয়। আবার কাঁঠালগাছে কোনো দোয়েলের ছোট্টো ডানার ঝাপটানি প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিটি কাঁঠাল পাতায়। ঝটপট ও শিরশির ধ্বনিতে জায়গাটির পরিধি কমে।
তুমি? খয়বার গাজী তার দিকে ভালো করে তাকায়, যাই বাবা, একটু হাটাইটি করা আসি।
গ্রামের প্রান্তে গাবগাছতলায় পাহারা দিচ্ছে বান্দু শেখ। তবে এই বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালাতে পারলে সে পৌঁছে যাবে পদুমশহরে তার ছেলের খালু-শ্বশুরের বাড়ি। ভোরবেলা উঠে ভাগবে বগুড়ায়। না, তাকে পালাবার সুযোগ দেওয়া হবে না। কাল পরশুর মধ্যে চেন্টু, আলিবক্স, করমালি, বান্দু শেখ ফিরে না আসা পর্যন্ত এই দায়িত্ব থেকে আনোয়ারের মুক্তি নাই।
ইঙ্গিতে খয়বার গাজীকে একটু আড়ালে নিয়ে আনোয়ার নিচু গলায় বলে, আপনি আজ কোথাও যাবেন না। আমাদের বাড়িতেই থাকেন।’
কেন? ১টি মাত্র শব্দে খয়বার গাজী সারা জীবনের আতঙ্ক শতকরা ১০০ ভাগ প্রকাশিত হয়। তার মুখ রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে কাগজের মতো। তার চোখ থেকে প্রাণ উধাও হয়, নিশ্বাসের জরদার গন্ধ পরিণত হয় কপূরের গন্ধে।
আপনি যাবেন না, এখানেই থাকেন। অবস্থা ভালো না। তুমি জানো? আনোয়ার কিছুই না বললে হঠাৎ করে খয়বার তার হাত ধরে ফেলে, বাবা, এই বেন্ন্যার বাচ্চারা গায়ের মধ্যে ভদরলোক থাকবার দিবো না। আজ লাগছে আমরা পিছনে, কাল ধরবো তোমার চাচাক, পরশুদিন তোমাকেও ছাড়বো না।
খয়বার গাজীর সঙ্গে ঘরে ফিরে দ্যাখা গেলো বড়োচাচা আনোয়ারের ঘরেই আরেকটি পালঙ এনে বিছানা করার জন্যে মন্টুকে নির্দেশ দিচ্ছে। তার মানে খয়বার যে রাতটা এখানেই কাটাবে তা আগেই ঠিক করা হয়েছে। কাঁঠালতলায় কিন্তু লোকটা এমন একটা ভাব করলো যে আনোয়ারের পরামর্শেই সে এই বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। এর মানে কি? আনোয়ার আরো সতর্ক হয়। খয়বার আলাদা বিছানা করতে দেবে না, নানা ভাইজান এতো রাতে ঝামেলা করবেন না। এতো বড়ো পালঙ, আমি এর এক কিনারে পড়া থাকমু। আমার আবার শোয়ার সাথে সাথে ঘুম, এক ঘুমে ফজর।’
বড়োচাচা, আনোয়ার, এমনকি মন্টুও বুঝতে পারে, খয়বার গাজী একা এক বিছানায় শুতে সাহস পাচ্ছে না। এমন হতে পারে যে, আনোয়ারের ওপর তার ভরসা হয়েছে, দরকার হলে তাকে জড়িয়ে ঘুমাবে। আবার আনোয়ারকে যদি প্রতিপক্ষের লোক বলে ধরে নিয়ে থাকে তাহলেও অনোয়ারের আড়ালে থেকে শক্রর হাত থেকে বাঁচতে পারবে।
ইজি চেয়ারে বসে বড়োচাচা হাই তোলে। মন্টু এসে পরিষ্কার অড় লাগানো বালিস ও লেপ নিয়ে এলে বড়োচাচা উঠে দাঁড়ায়, রাত মেলা হছে। শুয়া পড়ো।’