চিলেকোঠার সেপাই – ১২
বললাম না আছে! তুমি কি আমার থাইকা বেশি জানো?
‘তুই তো সব জানিস’
ওসমানের একটু ঘুম পাচ্ছিলো, রানু ও রঞ্জকে ঘরে দেখে বিছানা থেকে উঠে বসলো। রাত্রিটা বিশ্রী কেটেছে, ঘুম হতে পারে এই আশায় অনেকক্ষণ ধরে মাস্টারবেশন করে, কিন্তু একটু তন্দ্রায় গড়াতে না গড়াতে পানিটোলার চাপা গলিতে সারি সারি খাটা পায়খানার বালতির পাশ দিয়ে কার সঙ্গে হেঁটে যাবার স্বপ্ন দ্যাখে এবং স্বপ্লের মধ্যেই গুয়ের গন্ধে জেগে উঠে ছাদে গিয়ে বমি করে ফেললো। বমির পর আর ঘুম হলো না। সকাল থেকে এ পর্যন্ত ৪টে এ্যাঁন্টাসিড ট্যাবলেট এবং অফিস থেকে ফেরার পথে আনন্দময়ী হিন্দু হোটেলে বাট মাছের পাতলা ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে বেশ ভালো লাগছিলো। ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নিতে পারলে সন্ধ্যাটা চমৎকার কাটতো।
আপনে কখন আসছেন? রানুর এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই রঞ্জু বলে, ‘নেন, আমারে কয়টা ট্রানশেন দ্যাখাইয়া দেন। ইস্কুল টিস্কুল হয় না, আব্বা অস্থির হইয়া থাকে। আপারে বললাম, চলো খাতাপত্র নিয়ে চলো। না। যদি না থাকে?—এখন যাও, খাতা বই নিয়া আবার আসো খালি আপ-ডাউন মারো৷’
রানু জিগ্যেস করে, খাওয়া দাওয়া করবেন না?
‘খেয়ে এসেছি।
‘এখন বিশ্রাম করবেন?
আরে না না! দুপুরে আমি কখনো ঘুমাই না। একেবারেই না। নেভার ওসমান এতোটা তাড়াহুড়া করে বলে যে, মনে হয় এই বিবৃতির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। কথার এই দ্রুত ও অস্থিরগতি নিজের কানেই মাত্রাছাড়ানো মনে হলে তাকে ফের বলতে হয়, গত বৎসর দুপুরে ঘুমিয়েছিলাম মাত্র একদিন। তাও ছুটির দিন ছিলো, দুপুরবেলা ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিলো, না ঘুমিয়ে উপায় ছিলো না।
রঞ্জু হাসতে হাসতে জিগ্যেস করে, তারিখ মনে আছে?
খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে সায়েবি উচ্চারণে ওসমান বলার চেষ্টা করে, জানুয়ারি দ্য টুয়েন্টি সেকেন্ড, নাইনটিন হান্ড্রেড এ্যাঁন্ড সিক্সটি এইট এডি।
জানুয়ারি মাসে বৃষ্টি হয়? রঞ্জুর এই সংশোধনী বাক্যে হাসির হল্লা ওঠে, ওসমানের মাথার ভেতর ঘুমের যে প্রস্তুতি চলছিলো তার আর লেশমাত্র বাকি থাকে না। ভাইবোনকে বসতে বলে সে ১টা সিগ্রেট ধরায়। রন্ধুকে বলে, তোমার ট্রানশেন দেখি।’
রানুর সঙ্গে কথা বলার আগে সিগ্রেটে খুব জোরে টান দেয়, কিছুক্ষণ কাশে, তারপর টোক গেলে বার কয়েক। বলে, তোমার ঐকিক নিয়ম না আজ?
ভাইবোন। গায়ের রঙ দুজনের প্রায় একই রকমের শ্যামলা।
সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো ঢেউ তোলানো ২ জোড়া নীলচে ঠোঁট। নাকের নিচে ঠোঁটের ওপর ছোটো ভাঁজও দুজনের একরকম। দুজনের নাকও বোধ হয় এক মাপের, স্কেল দিয়ে মেপে দ্যাখা যায়। তবে রানুর নাকের ডগায় ও নাকের নিচে ছোটো ভাঁজটিতে বিন্দু বিন্দু কয়েক ফোটা ঘাম। কিন্তু রঞ্জুর মুখের কোথাও ঘামের চিহ্নমাত্র নাই। ওসমান নিজের নাকের ডগা ও নাকের নিচে আঙুল বুলিয়ে নিলো, নাঃ। একবারে শুকনা খ খ করছে। রানুর ও রঞ্জুর দুজনেরই হাসি হাসি মুখ, কিন্তু রানুর নাক ও ঠোঁটের ওপরকার একক ঢেউটির নাতিশীতোষ্ণ নোনতা শিশিরবিন্দু তাকে একেবারে আলাদা করে রেখেছে। সিলেটের ধোঁয়ার পাতলা পর্দা ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মতো রানুর ঘামের বিন্দুগুলোকে অনেক বড়ো করে দাখায়। মনে হয় তার নাকের ডগায় ও ঠোঁটের ওপরকার ঢেউয়ে শিশিরবিন্দু সব বৃষ্টির ফোটা হয়ে টলটল করছে। ওসমানের পিপাসা পায়, রানুর নাকের ডগায় ও ঠোঁটের ওপরকার ঢেউতে মুখ রেখে সমস্ত জলবিন্দু শুষে নেওয়ার জন্য সে ছটফট কর। ১টা চুমুক দিলে হয়তো সারাদিন আর পানি খেতে হবে না। সিগ্রেটে টান দিতে ভুলে গিয়ে ওসমান নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। রঞ্জ বলে, ‘ছোটপা, তুমি থাকো। আমি তোমার বইখাতা নিয়া আসি।
আমার বই খুঁজতে গিয়া আমার সব বইপত্র তুই ওলটপালট কবি। আমি যাই।’ ওসমান বলে, রানু, তুমি বই খাতা আনোনি কেন? রানু, কথাটা বলতে ওসমানের জিভ শিরশির করে, এই শব্দটি বলতে তার স্বেদবিন্দু পানের পিপাসা শতগুণে বেড়ে গেলো। নামটির উচ্চারণে তার ঠোঁট ও জিভ ছাড়িয়ে সেই পিপাসা যেন দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। ওসমান তখন তক্তপোষের সামনে টেবিলে টেনে এনে টেবিলের এপারে ঘরের একমাত্র চেয়ারটিতে বসে। রঞ্জ ও রানু এখন ওর মুখোমুখি। পিপাসা নিভিয়ে দেওয়ার কিছুমাত্র ইচ্ছা ওর নাই, চোখ জোড়া দিয়ে যতোটা পারা যায় রানুর ঘামের বিন্দু শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছে। পিপাসার তীব্রতা ক্রমে বাড়ে, তা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে ওসমান হুকুম দেয়, রানু এখন আবার নিচে যাবে কেন? রঞ্জ যাও, ওর অঙ্ক বই খাতা নিয়ে এসো।
রানু বলে, দাখ, বইপত্র ওলটপালট করিস না। জবাব না দিয়ে লাফাতে লাফাতে রঞ্জ নিচে নামে। ওসমানের মুখোমুখি একা বসে রয়েছে রানু। ওসমান কি এখনই অঙ্কের কথা বলবে? নাকি আগে রানুর নাকের ডগা ও তার নিচেকার ঘামের ফোটা শুষে নেওয়ার পিপাসার কথা জানাবে? কথাটা শুরু করে কিভাবে? সে এই নিয়ে একটু প্রবলেমে পড়ে। রানু বলে, অনেক রাত্রে ফিরছেন, না?
হ্যাঁ, তুমি জানলে কি করে? সিঁড়ি দিয়া আপনার ওঠার আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙছে। রানুর সেকেন্ড ব্র্যাকেট মার্কা ঠোঁটজোড়ার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে-আসা এই সব শব্দ তার নকের ডগা ও তার নিচেকার বিন্দু বিন্দুলিকার পানের জন্য ওসমানের পিপাসায় ইন্ধন জোগায়।
আপনে এতো রাত্রে আসেন, ভয় লাগে না? ভয় কিসের? ওসমান বলে বটে, কিন্তু তার তীব্র স্বেদতৃষ্ণা তার ধ্বনিপ্রবাহের স্বাচ্ছদ্য নষ্ট করে, বাক্য কাপে। রানু কিন্তু অনায়াসে বলে, রাস্তাঘাটে আজকাল কতোরকম গোলামাল। কোনদিন কি হইতে পারে আপনে জানেন?
কোনো উদ্বেগ বা ভয় বা আবেগে নয়, রানুর গলার স্বর হয়তো সর্দিতে একটু ভারি। ওসমানের সবগুলো আঙুল সেই ভারিস্বরে একটু একটু কাপে। সে নিজের হাত মুঠি করে, ফের খোলে। এতে আঙুলের ব্যায়াম হয়, কিন্তু কাপুনি থামে না। আঙুল বেয়ে এই কাপুনি শেষ পর্যন্ত শালার মাথায় চড়ে না বসে। এটার প্রতিবিধান খুব জরুরি। সে করে কি তার ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা এগিয়ে রানুর নাকের ডগায় ছুয়ে আস্তে আস্তে ঘামের বিন্দুগুলো মুছে ফেলে, তারপর ব্লটিং পেপার চেপে রাখার ভঙ্গিতে তর্জনীটাও আস্তে করে ঠেসে ধরে রানুর নাকের নিচেকার ছোটো ভাজের ওপর। রঞ্জুর ভাঁজটাও অবিকল এই রকম। ওসমানের নিজের নাকের নিচেও এরকম নিশ্চয়ই একটা ভাঁজ আছে। তার মতো গোঁফের আগাছা উঠে রঞ্জুর ভাঁজটাজগুলো আড়ালে পড়ে যাবে, রানুরটা এমনি স্থির ঢেউ হয়ে সারাজীবন সকালে বিকালে একটি দুটি করে ঘামের বিন্দু ফুটিয়ে তুলবে।
হাত সরিয়ে নিতে নিতে ওসমান বলে, রাত্রিবেলা ভয় পেয়ে আজ বিকালবেলা পর্যন্ত ঘামছো, না?
১টি পলকের জন্য রানু তার চোখজোড়া যতোটা পারে ফাক করে ওসমানকে দ্যাখে, তারপর মাথা নিচু করে জড়সড় হয়ে বসে। এভাবে বসেই তার কালো ও সরু আঙুল দিয়ে সে তার নাক ও নাকের নিচে, এমনকি ঠোঁট ও চিবুক পর্যন্ত ভালো করে মোছে। ওসমানের ছোঁয়ায় কি তার সুড়সুড়ি লাগছিলো?
ওসমান হঠাৎ কথা বলতে শুরু করে। খুব সিরিয়াস গোছের কথা। যেমন, ঐকিক নিয়মটা রানুর ভালো করে রপ্ত করা দরকার। যেমন, ঐকিক নিয়ম একবার রপ্ত করতে পারলে এই সব অঙ্ক একেবারে জলবৎ। যেমন, অঙ্কে ভালো করতে না পারলে পরীক্ষায় কেউ ভালো ফল করতে পারে না। যেমন, অঙ্কে নম্বর ওঠে সলিড এবং নম্বর মানে ভালো নম্বর। অঙ্কে বেশি না, সত্তর পচাত্তর তুলতে পারলে রানু এমন কি ফাস্ট ডিভিশনও পেতে পারে। ফাস্ট ডিভিশন পাওয়া এমন কিছু নয়।
রানুর বই খাতা নিয়ে রঞ্জু এসে পড়ে, বলে, ছোটাপা, তুমি পড়ো, আমারে বাইরে যাইতে হইবো।
‘এখন আবার বাইরে কি রে? বিকাল হইতে না হইতে খেলা? ওর ঘামের বিন্দু নিশ্চিহ্ন হবার পর এটাই রানুর প্রথম কথা। রানুর কণ্ঠ থেকে ভিজে ভিজে ধ্বনিও কি কেউ শুষে নিলো? রানু যদি এই কাঠকাঠ গলায় হঠাৎ বলে, রঙ্গু, তুই যাবি তো আমি কি এখানে একলা থাকবো? কিংবা রানু যদি তার পুত্ৰশোককাতর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, আম্মা, আমারে তোমরা পড়াইতে পাঠাও কার কাছে? সে আমার শরীরে হাত দিতে চায়! কিংবা ওসমানের চোখে চোখ রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘খালি লেখাপড়াই শিখছেন, বাপমা ভদ্রতা শেখায় নাই? ভদ্রলোকের মেয়েদের গায়ে হাত দেবেন না। কথাটা মনে রাখবেন!’ —তাহলে কি হবে?—এরকম কিছু হলে তার প্রতিক্রিয়া কি হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে কিছু ধারণা করতে না পেরে ওসমান গনি চোখে মুখে এক ধরনের বেপরোয়া ভঙ্গি তৈরি করে এবং বুক চিতিয়ে বসে ওদের কথাবার্তা শোনে।
রঞ্জু বলে, ‘জী না! এখন আবার খেলতে যাবো নাকি? আম্মা বলছে দোকানে যাইতে আদা আর তেল আনতে বলছে।
রঙ্গু চলে যায়। রানুও চলে যাওয়ার সম্ভাবনায় ওসমান প্রস্তুত হয়ে থাকে। এই দৃশ্য দ্যাখা থেকে রেহাই পাবার জন্যে সিগ্রেট ধরালে ভালো হয়। কিন্তু কিংস্টকের প্যাকেট খুঁজে পাওয়া যায় না। লাভের মধ্যে খোঁজবার কাজটি জুটে গেলো। সিগ্রেট খুঁজতে খুঁজতে রানুর ক্রুদ্ধ অন্তর্ধান ঘটলেও বরং বাচোয়া।
শেষ পর্যন্ত সিগ্রেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে ওসমান যখন ওর দিকে তাকালে রানু তখন নিবিষ্টচিত্তে পাটিগণিতের পাতা ওল্টাচ্ছে। একটু অন্যদিকে তাকিয়ে ওসমান বলে, ’দেখি।’ কয়েক মিনিটের মধ্যে ওসমান ঐকিক নিয়মের মধ্যে দারুণভাবে ডুবে গেলো। রানুকে কতোভাবে বোঝাবার চেষ্টাই সে যে করে। নিয়ম সম্বন্ধে অনেকক্ষণ ধরে বলে ১টার পর ১টা অঙ্ক কষে দ্যাখায়। ওসমান ১টি পলকও থামে না। ১টি অঙ্কের উত্তর লিখতে না লিখতে আরেকটিতে হাত দেয় এবং রানু বুঝলো কি বুঝলো না জিগ্যেস করার অবসর পর্যন্ত তার হয় না। রানুই শেষ পর্যন্ত বলে , দ্যান। বুঝলাম তো, দ্যান’
রানুর এই অতিরিক্ত সপ্রতিভ ভঙ্গির সঙ্গে তার ঠোঁটের কোণে খুব ছোট্রো ১টি হাসির বাঁকা আভাস সম্পূর্ণ খাপ খেয়ে গেছে। সেই আভাস অবিচলিত রেখে রানু বলে, আমারে অতো বুঝাইতে লাগে না। দ্যান!
হ্যাঁ হ্যাঁ। সে তো বটেই। ওসমান এমনভাবে বলে যেন এতোক্ষণ ধরে অঙ্ক বোঝানোটা তার অপরাধ হয়ে গেছে।
রানু অঙ্ক কষে আর ক্র একটুখানি তুলে ওসমানের দিকে দ্যাখে। ওসমানও আড়চোখে তাকায় বটে, তবে তার মনোযোগের ১০০ ভাগই রানুর অঙ্কের দিকে। রানু ১টার পর ১টা অঙ্ক ভুল করে যাচ্ছে। এতো ভুল দেখেও ওসমান বিরক্ত হয় না বা হতাশ হয় না। তার আফসোস এই যে, তার ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য আঙুল থেকে কায়দা করে ২টোকে সে আলাদা করে রেখেছিলো। কিন্তু অঙ্ক কষার জন্যে কলম ধরার ফলে ২টো আঙুল থেকে সমস্ত শিশিরবিন্দু কি একেবারে উৰে গেলো? আড়চোখে একবার দাখা গেলো যে রানুর নকের ডগায় কি তার নিচে ছোট্রো ভাজের ওপর ঘামের ফোটার আর চিহ্নমাত্র নাই। এদিকে রানুর ভুল অঙ্ক কষারও বিরাম নাই। রঙ্কুটার একটু বোকামির জন্য-কি দরকার ছিলো তার নিচে যাওয়ার-মেয়েটার নাকের ডগা খটখটে খা খা হয়ে গেলো। ঐ শ্যামবর্ণের মুখে আর রইলোটা কি? একটু আগে ওসমানের ছিলো ভয়, রানুর প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার ভয়। সেটা বরং ভালো, এখন ক্লান্ত ও ভোতা ধরনের অনুভূতি সমস্ত শরীর জুড়ে দাপট মারে। কিছুক্ষণের মধ্যে এই অনুভূতির কারণ বা উৎস সে ভুলে যায়, ফলে অকারণ হতাশা চেপে বসে আরো জোরেসোরে। তার বুক থেকে ছড়াতে ছড়াতে ওপরের দিকে মাথার শীর্ষভাগ এবং নিচে পেটের ডানদিক পর্যন্ত তার ডালপালা পৌঁছে যায়। পেটের চিনচিনে ব্যথা ফের জেগে ওঠে। ব্যথা আস্তে আস্তে বাড়ে এবং ১টা পর্যায়ে এসে আর বাড়ে না, সেখানেই থেকে যায়। তবে এতে লাভ হয় বৈকি! একটু আগেকার ভয় বা ভোতা অবসাদ-সবই এই ব্যথায় একদেহে হয় লীন এবং তাদের আলাদা করে টের পেতে হয় না। এই ব্যথাটা ডাক্তারদের বুঝিয়ে বলাও মুশকিল। এর নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নাই। বুকের মাঝখানটা এই ছটফট করলো, ভালো করে বোঝাবার আগেই সরে পড়লো নিচের দিকে, বুক ও পেটের মাঝখানকার কোনো ফাঁকে-ফোকরে। সেখানে ভালো করে জানান দিতে না দিতেই একটুখানি ঢেউ খেলিয়ে নেমে গেলো আরো নিচে পেটের নিভৃত কোনো কোণে। আসন পেতে বসে শালার ব্যথা সেখানে জিরিয়ে নেয়, একটু মনোযোগ দিলে ওসমান নিজের এ্যাঁবডোমেনের দেওয়ালে তার ঝিমুনি টের পায়। মাথা নিচু করে অন্ধ করতে থাকা রানুর চিবুক মাঝে মাঝে আলাদা করে দাখা যাচ্ছে। একবার মনে হলো রঙু বোধহয় একমনে ট্রানস্লেশন করে যাচ্ছে। একটু পর এই চিবুকের খানিকটা নিচে একটু বাঁদিকে দাখা যাবে তার শার্টের পকেটে আঁকা রয়েছে খয়েরি সুতার প্যাগোড়া। সঙ্গে সঙ্গে এ্যাঁবডোমেনের ব্যথা আরো নিচে নামে, শিরশির করতে করতে রক্তস্রোতকে ওভারটেক করে পৌঁছে যায় তার উরু জোড়ার মাঝখানে, রঞ্জকে ভালো করে দ্যাখার জন্য ওসমান সামনে তাকায়। কোথায় রঞ্জু? রঞ্জু তো এখন গেছে দোকানে, আদা, রওন, তেল কেনার নাম করে রাস্তায় দুটো তিনটে চক্কর না দিয়ে সে কি আর ফিরবে?
রানু মুখ তুলে বলে, দ্যাখেন, কতোগুলি করলাম। আরো করি?
করো। ওসমানের পেটের ব্যথা ফিরে আসে যথাস্থানে। অফিসে কামালের কাছ থেকে এই ব্যথাটা সম্বন্ধে জেনে নেওয়া দরকার। প্রেমের মতো রোগেও ওর খুব আগ্রহ। এর আগে ক্যান্সার ছিলো কামালের ফেভারিট। কিন্তু বছর দেড়েক আগে ওর বাবা ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পর কামাল ক্যান্সার-চর্চায় ক্ষান্ত দিয়েছে। আজকাল ওর প্রিয় প্রসঙ্গ হলো প্রেমিকা এবং ডিউওডিনাল আলসার। তার নিজের হাঁপানি, কিন্তু হাঁপানি সম্বন্ধে সে কখনো কিছু বলে না। আবার ডিউওডিনাল আলসারের ব্যাপারে এতো উৎসাহ যে, কথাটার উচ্চারণ ব্যাপারেও কামাল খুব শুচিবায়ুগ্ৰস্ত, কখনো ডিউভীনাল বা ডুইডিনাল বলবে না। ওসমানের পেটের এই অনিয়মিত ব্যাথা, তার এ্যাঁসিডিটি কি শেষ পর্যন্ত ঐ রোগ বলে সনাক্ত হবে? নামটা গালভরা, কিন্তু কামালের মুখে এই রোগের বর্ণনা শুনে শুনে এর ওপর ওসমানের অরুচি ধরে গেছে। পেটের ছোটো অন্ত্র ফুলে গিয়ে নাকি ফুটো হয়ে এমন ব্যথা শুরু হয়ে যে রোগী ব্যথা ছাড়া শরীরকে আর কোনোভাবেই অনুভব করতে পারে না। আচ্ছা, দীপচাদের কি এই রোগই হয়েছিলো? হঠাৎ করে গতরাত্রিতে দাখা স্বপ্লের মধ্যে পানিটোলার চাপা গলির ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য ওসমানের বুকে খচ করে ওঠে, স্বপ্নের ভেতর সঙ্গেকার লোকটিকে তখন চিনতে পারেনি, এক্ষুনি চিনলো, আরে সে তো দীপচাদ! মরার এতোদিন পর দীপচাদ মুচি স্বপ্লের মধ্যে এসে ওসমানকে নিয়ে কোথায় যাত্রা করেছিলো?
দীপচাদ মরেছে সে কি আজকের কথা? অন্ত্রের ব্যাথায় নিংড়ে যেতে যেতে দীপচাদ প্রথমে স্টেশনের পাশে তার বসবার জায়গাটা ছাড়লো, কাজকাম সব বন্ধ হলো, কিছুদিন পর মেল ট্রেন পাস করার সময় হলে নিজেই কষ্ট করে গিয়ে শুয়ে রইলো রেল লাইনের ওপর। বর্ধমান মেল বেগুনবাড়ি স্টেশন ক্রস করে রাত ৩টের দিকে, সকালে খবর পেয়ে ওসমানের বাবা ছেলের হাত ধরে চললো রেল লাইনের দিকে। বাপ বেটাকে একসঙ্গে যেতে দেখে পেছন থেকে ডাকে ওসমানের মা, আবার রঞ্জকে সাথে নিচ্ছে দ্যাখো।’
কেন? যাক না ‘ রাত পোয়াতি না পোয়াতি দুধের ছেলেটাকে মুচির মড়া দাখাতি নে যাচ্ছে? মুচি হয়েছে তো হলোটা কি? গোলমালের সময় লাইনের ওপারে সব শয়তানি আয়োজনের খবর দিতো কে? এই দীপচাঁদ মুচির মুখে খবর না এলে আমরা সাবধান হতি পারতাম?
আহা! সে কি না করিছি? রাতে ঘুম ভাঙলি পর যে ছেলে ভয়ে ঠকঠক করি কাপে সাত সকালে তাকে তুমি নে যাও রেলে-কাটা মড়া দাখাতি?
পুরুষ মানুষের অতো ভয় পেতি হবে না। ইব্রাহিম শেখের কাছে বেটাছেলে মাত্রেই পুরুষমানুষ। পুরুষমানুষের ভয় পাওয়া, লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখা, মাথায় বড়ো চুল রাখা–এসব তার অসহ্য। তা লোকটার নামডাকও ছিলো গোয়াতুমির জন্যেই। লাইনের ওপারে বেগুনবাড়ি গ্রামের বোসদের খুব দাপট, এই বোসরা তাজহাট, রাবড়া—এই গ্রামগুলোতে কয়েকবার খোঁচা দিলেও গোয়ালঘূর্ণিতে হামলা করার সাহস পায়নি। গোয়ালঘূর্ণির কয়েক ঘর মুচি কি এর আশেপাশের জেলেদের পটাবার চেষ্টা করেও বাবুরা সুবিধা করতে পারলো না। শেখেরা কি কম দাপটে ছিলো? দেশভাগের পরেও ২ বছর ১৪ই আগস্ট এলে পাকিস্তানের নিশান ওড়াবার জন্য ইব্রাহিম শেখের হাত নিসপিস করতো। গ্রামের ছেলেছোকরাদের প্রথম প্রথম কী উৎসাহ ইব্রাহিম ভাই, ঝাণ্ডা ওড়ান দিনি, বেগুনবাড়ির মালাউনরা কিছু করতি আসে তো বাছাধনদের রেললাইন পার হয়ে আর বাড়ি ফিরি যেতি হবে না।
পরে সে উৎসাহ আর ছিলো না। গ্রামের খন্দকারদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাজ নিয়ে ইব্রাহিম শেখ সপরিবারে গেলো ঢাকায়, এসে বছর তিনেক যেতে না যেতেই পাকিস্তান বা পাকিস্তানের পতাকা কোনো ব্যাপারেই তার একটুও আগ্রহ রইলো না, ফের গ্রামেই ফিরে গেলো। শুরু হলো উঠতে বসতে নাজিমুদ্দিন-নূরুল আমিনকে মোনাফেক আর বেঈমান বলে গাল দেওয়া।
তো ওসমানের হাত ধরে নিয়ে চললো ইব্রাহিম। বাইরে উঠান পেরিয়ে বড়ো তরফের বাধানো ঘটওয়ালা পুকুর। ঘাটের ইটগুলো তখন বড়োমিয়ার দাঁতের মতো খসে খসে পড়ছে। পুকুর পাড়ের রাস্তা ধরে ২০০/২৫০ গজ গেলে বুড়োবটতলা। এই বটতলা ছিলো ওসমানের খেলার জায়গা। এখান থেকে বাকনিলে ছিপছিপে ১টা পথ, সেই পথে খানিকটা গেলে ইটখোলা বিলের শুরু। বিলের পারে দীপচাদের মাটির ঘর। ঘরের আশেপাশে কি বিলের ধারে মুখ দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে চরে বেড়ায় দীপচাঁদের এক পাল শুওর। দীপচাদের বৌ মুনিয়া ঘরের দাওয়ায় বসে বাঁশের ধামা বোনে আর দুর্বোধ্য ভাষায় স্বামীকে কি দেবতাদের কি নিজের অদৃষ্টকে যা তা বকাকি করে। কখনো কখনো মুনিয়া বিলের পানিতে বাসন মাজে, গা ধোয়। বর্ষাকালে পদ্মফুলে বুক উঁচু করে ইটখোলার বিল আকাশের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য অনেকটা ওপরে উঠে আসে। তখন মেজাজ ভালো থাকলে মুনিয়া পদ্মবীজ খেতে দেবে বলে ওসমানকে বটতলা থেকে ডেকে আনে। সেদিন দীপচাদের শুওরগুলো আপন মনে মাটি খুঁড়ছিলো, বাড়ির ভেতর থেকে আসছিলো মুনিয়ার একটানা কান্নার শব্দ।
ইব্রাহিমের ডাকাডাকি শুনে বেরিয়ে আসে সুখনলাল। এ লোকটিকেও ওসমান চেনে, স্টেশনের জায়গা থেকে দীপচাঁদ সরে আসার পর ওখানে বসে জুতো সেলাই করে। দীপচাদ অসুখে পড়বর পর থেকে সুখনলাল ও মুনিয়াকে নিয়ে নানারকম মুখরোচক কথা চলে আসছে। সুখনলালকে দেখে ওসমানের তৎকালীন কচি হাড়গুলো সিটকে এসেছিলো; দীপচাঁদের রেলেকাটা মুণ্ডু যদি তার সঙ্গে গড়িয়ে বাইরে চলে আসে!—কিন্তু না, সুখনলাল জানায় শবদেহ এখনো রেললাইনের ধারে; দারোগাবাবুর হুকুম, পুলিসের লোক না পৌছা পর্যন্ত সরানো চলবে না। আশেপাশের গ্রামে জাতভাইদের খবর দেওয়া হয়েছে, তারা এসে লাশ ঘিরে বসে রয়েছে। দীপচাদের এক ভাগ্নে বুলবুলিয়া আজ সকালে পাইটখানেক পচানি টেনে সুখনলালের গায়ে অকারণে হাত তুলেছে, আর মুখ খারাপ যা করেছে মিয়াদের সামনে উচ্চারণ করলেও সুখনলালের পাপ হবে। মিয়াদের গ্রামে, মিয়াদের জমিতেই তো বুলবুলিয়ার বাস, সুখনলালও মিয়াদের জমিতেই জীবন কাটালো, ইব্রাহিম শেখ কি এর কোনো বিহিত করবে না?
ওদিকে দীপচাদের ঘরের ভিতর কয়েক মিনিট বিরতির পর মুনিয়া ফের কাঁদেতে শুরু করে। ইব্রাহিম শেখ ওসমানকে বলে, ‘তুই বাড়ি যা রঞ্জু। ওসমান তবু তার সঙ্গে হাঁটলে ইব্রাহিম ধমক দেয়, বললাম না, বাড়ি যা!
‘না আমি যাবো তোমার সঙ্গে। ওসমান জেদ ধরে, আমাকে মরামানুষ দ্যাখাতি হবে।’ আবার কথা বলে!’ ইব্রাহিম ধমক দেওয়ার পর লোভ দ্যাখায়, যা। আমি ফেরার সময় স্টেশনের বাজার থেকে সন্দেশ আনবো’খন। যা!’
‘না আমি সন্দেশ খাবো না। রেলে-কাটা মানুষ দেখবো! আমি কোনোদিন দেখিনি, আজ দেখবো, এ্যাঁ! ইব্রাহিম শেখ কিন্তু চটে ওঠেনি, বরং আরো নরম হয়ে বলে,তুই যা বাবা! কাল তাজহাট থেকে টিয়া এনে দেবো, কেমন? এখন যা!
ট্রেনের তলায় আত্মহত্যাকারী দীপচাদকে দ্যাখানো থেকে বিরত করার জন্য ইব্রাহিম শেখ শেষ পর্যন্ত ওসমানের অনেক দিনের আবদার পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। জ্যান্ত পাখি পাবার আশায় ওসমানের রেলে-কাটা মড়া দ্যাখার লোভ ছাড়তে হয়। আজ দ্যাখা, এতোদিন পর দীপচাদ নিজেই তার স্বপ্লের মধ্যে এসে হাজির হলো। সেদিন তাকে কেমন দ্যাখাচ্ছিলো?-লুঙি গিরের ওপর তোলা, গায়ে টুইলের হাফহাতা শার্ট, হাতে জুলছে কাচি সিগ্রেট—ইব্রাহিম শেখ দীর্ঘ পা ফেলে চলে যায় রেললাইনের দিকে; রোগা প্যাকাটি সুখনলাল যাচ্ছে পেছন পেছন, নালিশ করে, মাঝে মাঝ থুথু ফেলে, ফের নালিশ করে। কিছু দূর যাবার পর হাবু মল্লিকের ডাঙা-জমির বাবলা ঝোপের আড়ালে চলে গেলে ওদের আর দ্যাখা যায় না। আর এদিকে বিলের তীরে দাঁড়িয়ে ওসমান তার সর্বাঙ্গে শোনে মুনিয়ার একটানা কান্নার ধ্বনি। এই জায়গাটায় মুনিয়া বাসন মাজে আর গোসল করে বলে এখানে কোনো পদ্মফুল নাই। পানিতে ওসমানের ছায়া পড়ে, পানির পাতলা ঢেউতে তার সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো ঠোঁটজোড়া বারবার স্থানচু্যত হয়, শার্টের বুকপকেটে এস্ত্রয়ডারি-করা প্যাগোড়া পানির অস্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণে এলোমেলো ছড়িয়ে পড়ে। দীপচাদের বাড়ির পেছনের আউশের খেত থেকে কালচে হলুদ রঙের গন্ধ এসে দীপচাদের বৌয়ের কান্নার সঙ্গে মিশে ধ্বনি, গন্ধ ও রঙের বিন্যাস নষ্ট করে দেয়। বিলের পানিতে শ্রীমান রঞ্জু তখন ওসমানের মুখোমুখি শুয়ে একটু ভয়ে ও একটু কামনায় কাপে। ওসমান নয়ন ভরে পানির সেই রঞ্জকে দেখছে, রঞ্জু পানি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে তার সামনে, সে খেয়াল করেনি।
হঠাৎ রঞ্জুর কথা শুনে সে মাথা উঁচু করে তাকালো। আপনার ঘুম পাইতাছে। আপনি ঘুমান, আমি যাই।’ না, রঞ্জু নয়, কথা বলছে রানু ওসমান বিব্রত হয়, হঠাৎ ঘুম পাচ্ছে কেন, বুঝতে পাচ্ছি না।
রাত্রে ঘুমাইবেন না কতো রাত্রে বাসায় ফেরেন, ঠিকমতো ঘুমান না কেন? এই অতি অল্প সময়ের তন্দ্রা কেটে যাওয়ায় ওসমানের চোখের ভেতরটা করকর করে, ভ্রজোড়া থেকে শুরু করে গোটা কপাল পর্যন্ত মাথার অর্ধেকটা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। তোষকের নিচে থেকে ২টো নোভালজিন ট্যাবলেট মুখে দিয়ে সে পানি খায়।
টেবিলের ওপরকার শূন্যতায় রানুর খোলা চুলের হান্ধা গন্ধ। ওসমান এখন সোজা হয়ে বসেছে, ২টো নোভালজিনে তার কাজ হচ্ছে, মাথা ব্যথা আস্তে আস্তে সেরে যাচ্ছে। ওসমান বলে, কৈ তোমার খাতাটা দেখি!
আজ থাক! আপনার শরীর বোধ হয় খারাপ। ওষুধ খাইবেন!’ না। একটু মাথা ব্যথা করছিলো, পাঁচ মিনিটে সেরে যাবে।’ নাঃ! ঐকিক নিয়ম রানুর মাথায় একেবারে ঢোকেনি। বছর ধরে পড়লেও ওর খুলি ভেদ করা অসম্ভব। আনোয়ারের সঙ্গে বরং ওদের গ্রামে গেলে হতো। গ্রামে গ্রামে মানুষ সংঘবদ্ধ হচ্ছে, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে রুখে দাঁড়াচ্ছে। এই সব দ্যাখা ছেড়ে সে কি-না পড়ে রইলো এই রান্ট মেয়েটাকে অঙ্ক কষাবার মতলবে? ওসমানের পেটের ব্যথাটা চিনচিন চিনচিন করে ওঠে। নাঃ খেলেই হতো এ্যাঁসিড হচ্ছে, রাত্রে ঘুম হলো না, এর ওপর এ্যাঁনালজেসিক ট্যাবলেট না খেলেই হতো। রানুর অঙ্কের ভুল শোধরাতে পেট ও বুক জুড়ে টক-তেতো স্রোতের উজান-ভাটা শুরু হলো। এখন একটু শুতে পারলে ভালো হয়। ওসমানকে বলতেই হলো, ‘আজ বরং থাক। কাল এসো, কেমন?
রানু জিগ্যেস করে, খুব খারাপ লাগতাছে, না? গলার কাছে টক-তেতো স্রোতের একটা দমক সামলাতে সামলাতে হাসে, না হঠাৎ খুব ঘুম পাচ্ছে। নাইনটিন সিক্সটি নাইনের গোড়াতেই দিবানিদ্রা, বছরটা মনে হয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটবে।
রানু কিন্তু একটুও না হেসে উঠে দাঁড়ায়। ওসমান দাঁড়িয়েছে তার গা ঘেঁষে। রানুর শ্যামবর্ণ নাকের শীর্ষে ঘামের অনেকগুলো টাটকা বিন্দু জমেছে, তার নাকের নিচে ঠোঁটের ওপরকার ছোটো নিখুঁত ঢেউতে বড়ো বড়ো ঘামের ফোটা টলটল করে। ওসমান ইচ্ছা করলে একটু ঝুঁকে রানুর নাকের ডগায় এবং তার নিচে মুখ লাগিয়ে এক চুমুকে সমস্ত স্বেদবিন্দু টেনে নিতে পারে। তার বদলে সে তার নিজের হাতের তর্জনী চোষে। রানু একটু অবাক হয়ে তাকালে ওসমান পানি-ওঠা মুখে তরল স্বরে বলে, কাল এসো, কেমন? এই সময় এসো, কেমন?
বইপত্র নিয়ে রানু সিঁড়িতে নামবার সঙ্গে সঙ্গে ওসমান দরজা বন্ধ করে দেয়। ডান হাতের তর্জনী তার মুখেই রয়ে গেছে। কোনো নোনতা স্বাদ না পেয়ে সে তর্জনীটা আরো ভালো করে চোষে। টক-তেতো স্বাদের তর্জনী চুষতে চুষতে অন্য দরজা দিয়ে ওসমান বেরিয়ে যায় ছাদে। ছাদের রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে ওসমান একটু উপুড় হতে না হতে তার হড়হড় করে বমি হয়ে গেলো।