চিলেকোঠার সেপাই – ০৮
বস্তিতে ঢোকার মুখে একটুর জন্যে গুয়ের ওপর খিজিরের পা পড়েনি। তার রাগ হয়, ‘এইগুলি জানোয়ারের পয়দা না কিয়ের বাচ্চা বুঝি না! এতো বড়ো একখান নর্দমা পইড়া রইছে, পোলাপানের হাত ধরাইয়া বহাইয়া দিলে কি হয়?
বস্তির প্রথম ঘরের দরজায় চার বছরের ন্যাংটা ছেলের পাছা ধুয়ে দিচ্ছিলো বজলুর বৌ। সিনেমার টিকেট ব্ল্যাক করা হলো বজলুর পেশা, ঈদের দিন স্বামীর মোট রোজগারের সম্ভাবনায় বজলুর বৌয়ের আজ দাপটই আলাদা, সে সঙ্গে কিচকিচ করে ওঠে, আটকুইড়া, হিজড়া মরদ, পোলাপানের তকলিফ বুজবো ক্যামনে? নর্দমার মইদ্যে পোলায় পইড়া গেলে তুলবো ক্যাঠায়?
জবাব না দিয়ে ঘরে ঢোকার জন্যে খিজির মাথা নিচু করেছে, এমন সময় ভেতর থেকে বাইরে উকি দিলো জুম্মনের মা। এক পলকের জন্যে বৌয়ের মুখ টাটকা দাখায়, মনে হয় কষে সাবান ঘষে মুখ ধুয়ে স্নো পাউডার মেখেছে। তার ভাঙা গালের নকশাই পাল্টে গেছে, তার কালো রঙের ওপর পাতলা ছাই রঙের আভা, কিন্তু জুম্মনের মায়ের তীক্ষ ও ছুচলো কণ্ঠস্বরে এই মুগ্ধতা আড়ালে পড়ে যায়, চোট্টার খানকিটার চাপার খাউজানি মনে লয় বাড়ছে। বাড়বে না? বাড়বে না ক্যালয়? তারপর ফজলুর বৌয়ের বাকশূহ বৃদ্ধির কারণ নির্ণয় করে সে নিজেই, চোট্টাগুলির আউজকা বেলাক করনের দিন! চান্দে চান্দে পুলিসের চোদন না খাইলে চোট্টাগো গতরের মইদ্যে ফোসকা পড়বো না? হাজত না চোদাইয়া বৌ পোলাপানের ভাত দিবার পারে না,-হেই চোট্ট মরদের মুখের মইদ্যে আমি প্যাসাব করি। তার ইজ্জত রাখার জন্যেই বৌ রুখে দাঁড়িয়েছে, বৌয়ের প্রতি খিজির তাই একটু গদগদ হয়, তক্তপোষে এলোমেলো করে পাতা কাঁথার ওপর একটু একটু করে শুয়ে পড়ে। পাশে বসতে বসতে জুম্মনের মা বলে, আঃ! সইরা শোও। খিজির একটি হাত রাখে বৌয়ের কোমরে। জুম্মনের মাকে নিয়ে ম্যাটিনিতে আজ সিনেমা দেখলে কেমন হয়? খিজির এতো সিনেমা দ্যাখে, জুম্মনের মাকে কোনোদিন সঙ্গে নেয়নি। স্টারে হীরা আওর পাথর খেলে মোহাম্মদ আলী-জেবার ছবি, চাল্লি হলো নিরালা। বৌকে এখন কথাটা বলে কি করে? এতো সিনেমা দেখেও কায়দা করে কথা বলাটা খিজির এ পর্যন্ত রপ্ত করতে পারলো না। তার শক্ত ও লম্বা আঙুলগুলো আনাড়ি বাদকের মতো বৌয়ের পিঠে বারবার ওঠানামা করে, ছেমরিটাকে যদি এভাবেই বাজিয়ে তোলা যায়। কিন্তু এর আগেই ঝনঝন করে ওঠে বজলুর বৌয়ের গলা, চোটাও হইতে পারে, বেলাক ভি করবার পারে। মগর ভাতার আমাগো একটাই একখান ভাউরারে গলার মইদ্যে সাইনবোর্ড বাইন্দা আমরা দুনিয়া ভইরা মানুষরে মারা দিয়া বেড়াই না। বজলুর বৌ কাজে যাচ্ছে, বিকালবেলা ২টো বাড়িতে তাকে বাসন মাজতে হয়, একটা বাড়িতে পানি দেয়। ছেলেটা এখন তার কোলে, খিজির তাকে জানোয়ারের বাচ্চা বলায় আজ মায়ের কোলে উঠতে পারলো।
বেড়ার সঙ্গে লটকানো ছোটো আয়নার সামনে জুম্মনের মায়ের কেশবিন্যাস অব্যাহত থাকে, ঠোঁটে চেপে ধরা রঙ-জ্বলা ফিতা হাতে নিতে নিতে সে বজলুর বৌয়ের শেষ বাক্যটি শোনে, আমরা আর মাইনষের বাড়ি কাম করি না, না? কৈ আমরা ইসনে পাউডার মাইখা খানকিটা হইয়া মাহাজনের বাড়ি যাই?
খিজিরের কান কুঁকড়ে আসে আবার হালার মাহাজন রহমতউল্লা মহাজনের বাড়ির কাজ থেকে জুম্মনের মাকে ছাড়িয়ে আনাটা খুব জরুরি। বজলুর বৌয়ের এই সব কথা শুনতে শুনতে তার একেকবার ইচ্ছা করে, ইচ্ছা করে,–কিন্তু কি ইচ্ছা করে সে সম্বন্ধে স্পষ্ট কিছু ভাবতে পারে না। শুয়ে শুয়েই শক্ত হাতে তার বাহুমূল ধরলে জুম্মনের মা বলে, ছাড়ো কিন্তু হাতটা সে ছাড়িয়ে নেয় না। শুধু বলে, জোয়ান মরদটা দুপুরবেলা ঘরের মইদ্যে হুইয়া থাকো, শরম করে না?
এবার তার কথা একটু নরম। খিজির আরেকটু কাছে ঘেঁষে, তরে হুইতে মানা করছে ক্যাঠায়?
আল্লাদ! কাম আছে না? কতোগুলি মানুষ আউজকা খাইতাছে। আল্লারে আল্লা। মাহাজনের বাড়ি কতো মেহমান আহে। মহাজনের বাড়িতে অতিথি সমাগমের একটি দীর্ঘ তালিকা দিতে দিতে জুম্মনের মা উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। বেশির ভাগই শরীফ লোক, তসতরির সেমাই ছোয় কি ছোয় না, প্লেটের পোলাও আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়াই করে, জিভ পর্যন্ত তোলে না। কিন্তু বাসন তো মাজতে হয়। ঈদের দিন দামী দামী সব বাসন বার করা হয়েছে, জুম্মনের মা ছাড়া সেসব মাজবে কে? বিবিসায়েব ভরসা করবে আর কার ওপর? কড়ি কড়ি বাসন মাজার কথা বলতে বলতে জুম্মনের মায়ের বুক ফুলে ওঠে, না যাই গিয়া।
বৌয়ের ফুলে-ওঠা সিনা দেখে খিজিরের চোখে ঘোর লাগে, একটু জড়িয়ে ধরে, ‘আউজকা সায়েবে আমারে ছুটি দিছে। সায়েবের থন বেবি ট্যাক্সি লইয়া বারামু, যাইবি? এক্কেরে নিউ মার্কেট, শাহবাগ, রমনার মাঠ ঘুরাইয়া আনুম, যাইবি? এয়ারপোর্ট ভি যাইবার পারি। ক্যামনে পেলেন উঠে দেখবি? যাইবি? আলাউদ্দিন মিয়া অবশ্য স্কুটার দেবে না, তবে রিকশা একটা পাওয়া যাবে। বৌকে বেবি ট্যাকসির কথাই বলা ভালো। যাইবি?
ঢাঙা রোগা স্বামীর এই আহ্লাদ বচনে জুম্মনের মায়ের শরীর একটু শিরশির করে বৈ কি! সে চুপ করে থাকে। এমনকি কাপড় জামা ভেদ করে খিজিরের একটি হাত তার স্তন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করলে সে বরং একটু এলিয়েই পড়ে। কিন্তু নাঃ। মহাজনকে চটানো ঠিক হবে না। মহাজনের ভারি হাতের চাপে তার দমবন্ধ হবার জোগাড় হলে কি হয়, জুম্মনকে তো তার কাছে এনে দিতে পারে মহাজনই। ছেলে তখন তার কাছে থাকবে; মহাজনের বাড়িতে, গ্যারেজে কতো কাজ, ঢুকিয়ে দেবে কোথাও। তারপর? তারপর, বড়ো হলে মহাজন একটা রিকশা কিনে দেবে।–রিকশার ভাড়া দিতে হবে না, এমনকি লাইসেন্সের পয়সাও দেবে মহাজন।-গতকাল চাদের রাতে মহাজন নিজে তাকে কথা দিলো, হাজার হলেও নামী দামী মানী লোক, সে কি ফালতু কথা বলবে?
রাত তখন অনেক। রাত পোহলেই ঈদ। জোগাড়যন্ত্র করতে করতে জুম্মনের মায়ের বলে হাসফাস উঠে গেছে। ঠিকা ঝি আবুলের মা ছেলের এ্যাঁকসিডেন্টের খবর পেয়ে চলে গেছে রাত ১০টার আগেই। আস্ত একটা খাসির নানারকম তরকারি, দশ সের গরুর গোশতের ভুনা, কাবাবের কিমা, কয়েকটা মুরগি!-মশলা বাটা চলছে তো চলছেই। সকালবেলার জন্যে সেমাই ভাঁজছে জুম্মনের মা, নামাজে যাবার আগেই সবাই সেমাই খাবে -এটা সেটা করতে করতে রাত্রি হলো ১টা কি দেড়টা। বসার ঘরের দরজার কোণে টেলিভিশন দেখতে দেখতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে আবদুল, একটু রাত হয়ে গেলে জুম্মনের মাকে এগিয়ে দিয়ে আসে সে-ই। সব গুছিয়ে আবদুলকে ডাকতে জুম্মনের মা বসার ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সিঁড়ির গোড়া পার হবার সময় মহাজন ডাকলো, ‘যাস?
তার কণ্ঠ শুকনা ও কাপাকাপা। রহমতউল্লা ফের বলে, যাস গিয়া? তারপর গায়ের শালের নিচে থেকে কাগজের একটা প্যাকেট তার দিকে এগিয়ে ধরে, ‘ল। মহাজন তার একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে, হঠাৎ তার ঘাড়ে হাত রেখে বলে, বহুত মেহনত হইছে, না? তার গলা এত কাপছিলো যে, এই কথায় কোনো দরদ ফোটে না। ফের বলে, ‘ল। তরে দিলাম। সেতারার মায়ে জানলে হাউকাউ লাগাইয়া দিবো। ব্রেসিয়ারের প্যাকেট হাতে নিতে নিতেই জুম্মনের মা টের পায় জিনিসটা কি? সেতারা তাকে একবার একটা দিয়েছিলো; সেতারার ব্যবহৃত, তবে তেমন পুরনো হয়নি। কিন্তু এইসব ছেমরি রঙঢঙ যতোই করুক, এদের সিনা দেখলে মনে হয় পুরুষ মানুষের সিনাও এদের চেয়ে উঁচু। আজ মহাজন তাকে ঐ জিনিস দিলো একেবারে নতুন। লোকটা তার পিঠে হাত দিয়ে নিজের শরীর ঘেঁষে টেনে নেয়, ঘাড়ের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে বলে, কাউলকাতর পোলারে একবার দেখবি না? খিজিররে কইস নিমতলা না কৈ থাকে কামরুদ্দিন, খিজিরে গিয়া আর ঘর থাইকা লইয়া আইবো’ মহাজনের ভারি হাতের তলায় তার ঘাড়ের ভেঙে পড়ার দশা ঘটে। সেই ঘাড়ে মহাজন একটা চুমু খায়, তার বুকে হাত রেখে বলে, সিনা তর ফাস্ট কেলাশ। ঐটা পিন্দলে দেখবি কেমুন লাগে। তারপর ফের জুম্মনের প্রসঙ্গ তোলে, নিচু গলায় ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে মহাজন জুম্মনকে কোনো একটা কাজে লাগিয়ে দেওয়ার জবান দেয়। একটু বড়ো হলে তাকে রিকশা কিনে দেবে, ঘর দেবে।—মহাজনের নিশ্বাসের ভাপ লেগে তার গাল গরম হয়ে ওঠে। সে সিটকা মেরে দাঁড়িয়ে থাকে, নিশ্বাস ছাড়তে জুম্মনের মায়ের অসুবিধা হয় না, কিন্তু নাক দিয়ে বাতাস টেনে নেওয়ার কাজটা যেন কতো কঠিন এর মধ্যে একবার ভয় হয় দোতলা থেকে বিবিসায়েব যদি হঠাৎ এসে পড়ে। এখান থেকে দ্যাখা যাচ্ছে আবদুলকে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে ব্যাটা মহাসুখে ঘুমায়, তার মুখ ফাক হয়ে রয়েছে, আবার মহাজনের কাণ্ডকারখানায় চোখজোড়া ফাক না হয়! এই সময় রান্নাঘরের ভেতর থেকে বিড়ালের আওয়াজ পাওয়া যায়, ম্যাও।’ মহাজন হঠাৎ করে তাকে ছেড়ে একটু পিছিয়ে বসে এবং বিকট হাক ছাড়ে, আবদুল আবদুল! ওঠা এ্যাঁরে ঘরে দিয়া গ্যারেজে যা গিয়া গ্যারেজ খালি পইড়া রইছে!
মহাজনের সেই হাকে জুম্মনের মা যে দারুণ রকম চমকে উঠেছিলো আজ এই এখন পর্যন্ত তার রেশ যায়নি। খিজিরের দিকে একবার তাকিয়েই সে মাথা নিচু করে বলে, ‘আউজকা তুমি জুম্মনরে একবার আনতে পারব?
জুম্মনরো জুম্মনের কথা ওঠায় বৌকে নিয়ে প্রমোদ ভ্রমণের উৎসাহ খিজিরের প্রায় নিভে যায়। মাগীটা তার ছেলের কথা একেবারে ভুলতে পারে না। ছ্যামরা এসে তো খিজিরের ঘাড়েই পড়বে, ওটাকে সামলাবে কে? ছেলের জন্যে অতোই টান তো ঐ কামরুদিনের ঘর করলেই তো পারতো! আবার ৭/৮ বছরের এই পিচ্চির ওপর রাগ পুষে রাখতেও নিজেকে কেমন চোর চোর মনে হয়। গলায় একটু ঝাঁঝ এনে জিগ্যেস করে, জুম্মনে মালীবাগ থাকে না?
না। নিমতলীর কাছে রেল লাইনের লগে বস্তি আছে না? ঐ বস্তির মইদ্যে থাকে। ওস্তাগরে না মালীবাগে ঘর লইছিলো? ওস্তাগর বলে কামরুদিন সম্বন্ধে খিজির একটু টিটকিরি করলো। কামরুদিন আসলে জোগানদার, কিন্তু কথাবার্তা বলে শালা ওস্তাগরের স্টাইলে। দাদা পরদাদা নাকি কলতাবাজারের সেরা ওস্তাগর ছিলো, সেই দাপটে কামরুদিন যখন তখন বৌ পেটতো। মালীবাগ খিলগায়ের দিকে আজকাল খুব দালান তৈরি হচ্ছে, তার নাকি কাজের শেষ নাই, ঐদিকে ঘর ভাড়া না নিয়ে তার উপায় কি? ব্যাটা আবার নিমতলী গেলো কবে?
আগের স্বামীর প্রতি বর্তমান স্বামীর এই শ্লেষ গায়ে না মেখে জুম্মনের মা বলে, কাম করতে করতে ভারা থাইকা পইড়া গিয়া অহন জোগানদারি করবার পারে না, একখান পাও বলে ভাইঙ্গা গেছে।’
পাও ভাঙছে! কথার ভঙ্গিতে ঠাট্টা অব্যাহত রাখলেও খিজিরের খারাপ লাগে। কামরুদিন কিন্তু তার সঙ্গে কোনোদিন তেমন খারাপ ব্যবহার করেনি।
অহন কি করে?
কায়েতটুলির মইদ্যে হুনি ডাইলপুরি ভাইজা বেচে। জুম্মনের মা একটু হেসে বলে, যাইবা? জুম্মনেরে লইয়া একবার আমারে দ্যাখাইতে পারো? বছরকার একটা দিন, কি খাইবো, ক্যাঠায় দেখবো? বৌয়ের এই ভিজে ভিজে কণ্ঠস্বর খিজিরের ঠিক পরিচিত নয়, এতে সাড়া দেওয়ার নিয়মকানুনও তার অজানা। ছোটো চোখজোড়া যতোটা সম্ভব বড়ো করে জুম্মনের মা ফের বলে, পোলাটারে বাপে যা জুলুমটা করে! তুমি একবার আনব? মাহাজনে কইছে আরে কামে লাগাইয়া দিবো। গ্যারেজের মইদ্যে থাকবো, ডাঙর হইলে একখান গাড়ি কিন্যা দিবো। ভাড়া উড়া লাগবো না, যা কামাইবো অরই থাকবো।
মহাজনের কথা ওঠায় খিজির একেবারে উঠে বসলো। জুম্মনের ওপর ঠিকমতো রাগ করতে বাধো বাধো ঠেকেছিলো, মহজনের ওপর সেই রাগ দিব্যি দশ গুণ উস্কে ওঠে, আবার মাহাজনে আহে ক্যামনে? মাহাজনের কথা কইতে না পারলে খোমাখান খাউজায়, না? খিজিরের এই আক্রমণের পরও জুম্মনের মা আধ মিনিট চুপচাপ ছিলো। কিন্তু ছেলের দরদে বুদ হয়ে বসে থাকাটা তার পোষায় না, একটু সামলে নিয়ে সে ক্যাটক্যাট করে ওঠে, এইগুলি কি কও? তোমার মুরাদ হইবো? আমার পোলারে কাছে রাখবার মুরাদ হইবো তোমার? গোলামি করস মানুষের, চোপাখান বানাইছস নবাবের বাচ্চার।’
মাগী কি কইলি? আবার ক! খানকি মাগী সাইজা গুইজা মাহাজনের লগে রঙ করতে যাস, না? কিয়ের জোরে রোয়াবি মারস? কিন্তু জবাব না দিয়ে মাগী দুপদাপ করে বেরিয়ে যায়।
যতোই রাগ হোক, বৌকে খিজির মহাজনের বাড়ি থেকে ছাড়িয়ে আনে কি করে? কতোদিন আগে তার মা খিজিরকে নিয়ে এই বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলো। না হলে ফালু মিস্ত্রির কিল চড় খেতে খেতে এ্যাঁদিন কোথায় ভেসে যেতো কে জানে? তারপর ধরো, জুম্মনের মায়ের সঙ্গে তার বিয়েটা দিলো কে? জুম্মনের মা এ বাড়িতে আসে কাজ করতেই, তাতে কামরুদিনের সায় ছিলো ষোলো আনা। যতোই রোয়াবি করুক, রাজমিস্ত্রির সঙ্গে জোগানদারের কাজ করে বাঙলা মদ টানা আর কান্দুপট্টি মারা, তারপর বৌপোলা সামলানো অতো সোজা নয়। তবে জুম্মনের মা প্রথম প্রথম সারাদিন কাজ করে ঘরে ফিরে যেতো, কামরুদিন তখন কলতাবাজারে নিজেদের পৈতৃক বাড়ির ১টা অংশেই বাস করে। বড়োলোকের বাড়ি কাজ করে মাস তিনেকের মধ্যে জুম্মনের মায়ের গায়ে গোশত লাগে, এর মধ্যে তার ২টো শাড়ি জুটেছে, সেতারার স্নো পাউডার মাখে একটু সুযোগ পেলেই। তখন রাত্রে কান্দুপটি-ফেরত কামরুদিনের হাতে মার খেতে তার আর ভালো লাগতো না। রুগ্ন বিবিসায়েবের খেদমত করার কথা বলে বিবিসায়েবের ঘরের মেঝেতে সে রাত কাটাতে শুরু করলো। একদিন সন্ধ্যার পর কামরুদিন টলোমলো পায়ে মহাজনের বাড়ি এসে রান্নাঘর থেকে বৌয়ের চুল ধরে ছ্যাচরাতে ছ্যাচরাতে রাস্তায় নামায়। জুম্মনের মায়ের চ্যাচামেচিতে রাস্তায় ভিড় জমে যায় এবং বিবিসায়েব পর্যন্ত তার হাঁপানি ভুলে ‘কেয়া হইস রে? কেয়া হইস রে? বলতে বলতে নিচে নামে এবং তার প্রেরণা ও প্ররোচনায় বজলু, খিজির, আবদুল—এরা একজোট হয়ে কামরুদ্দিনকে বেশ ভালোরকম প্যাদানি দেয়। এরপর লোকটা অনেকদিন আর এমুখো হয়নি। পৈতৃক বাড়ির ভাগ কোন চাচাতো না মামাতো ভাইয়ের কাছে বেচে দিয়ে মহাসুখে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায়।
বেশ কিছুদিন পর এক বর্ষার রাতে, অনেক রাত্রি, মহাজনের গ্যারেজে এসে কামরুদ্দিন খিজিরকে ডেকে তোলে। খিজির সেদিন একা, তার একটু ভয় ভয় করছিলো, লোকটা সেদিনকার বদলা না নেয়। কিন্তু নাঃ জুম্মনের মাকে একটা খবর দেওয়ার জন্যে সে খিজিরকে নির্দেশ দেয়। কি খবর?-না, কামরুদিন গত রাতে যে মেয়েকে বিয়ে করেছে জুম্মনের মা তার বাদি হওয়ারও যোগ্য নয়। এই খবর দিয়ে সে চলেই যাচ্ছিল, ফের ঘুরে এসে বলে, তর মাহাজনেরে কইস আমি আইছিলাম। আমার নাম কামরুদিন ওস্তাগর, আমার বাপের নাম হাসমত আলি ওস্তাগর, দাদার নাম লাল মোহাম্মদ ওস্তাগর, পরদাদার নাম নায়ু ওস্তাগর। নবাব বাড়ির গম্বুজটা বানাইছিলো নায়ু ওস্তাগরে, বুঝলি?তর মহাজনে খুব বড়ো লোক হইছে, না। অর দাদার নাম জিগাইস তো, কইতে পারবো না!
জুম্মনের মাকে পাঠানো খবরটা খিজির যথারীতি পৌঁছে দেয়। কিন্তু রহমতউল্লাকে দাদার নাম আর জিগ্যেস করতে পারেনি। খিজির নিজের বাপের নাম জানে না, সে জিগ্যেস করবে মহাজনের দাদার নাম? তবে কামরুদিনের এই সব কথাবার্তা মহাজনের কানে ঠিকই পৌঁছে যায়। শুনে রহমতউল্লা প্রথম প্রথম খুব হাম্বিতাম্বি করছিলো, ইচ্ছা করলেই কামরুদিনকে সে জেলের ভাত খাওয়াতে পারে। এক বৌ থাকতে জোগানদার হালা আবার সাদী করে কোন সাহসে? আইয়ুব খান নতুন নিয়ম করেছে, দ্বিতীয় বিবাহ করার জন্যে প্রথম বৌয়ের অনুমতি দরকার। রহমতউল্লা হলো আইয়ুব খানের বিডি মেম্বর, সে নিজে যদি এসব বিষয়ে লক্ষ না করে তবে দেশের লোকের আইন অমান্য করার প্রবণতা তো বেড়েই যাবে। কিন্তু সমস্যা বাধায় মহাজনের বিবি জুম্মনের মাকে রাখাটা তার দরকার, খিজিরের সঙ্গে জুম্মনের মায়ের বিয়ের উদ্যোগ নেয় বিবিসায়েব।
খানদানি ঘরের মেয়ে এই বিবিসায়েব বারো মাসের রোগী। সতীনের সঙ্গে ঘর করবে না বলে বিয়ের ২বছর পর ৬ মাসের মেয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলো বাপের বাড়ি, সতীন মরার আগে আগে স্বামীর ঘরে আসে। সঙ্গে ৪০ ভরি সোনা, ১মাত্র মেয়ে এবং হাঁপানি। রোগে ও দুঃখে সে প্রায় সব সময় হাঁপায় এবং হাপানির সংক্ষিপ্ত বিরতিকালে সশব্দ নিশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গতে তার বেগমবাজারের খানদানি বাপের বাড়ির মোরগপোলাও এবং নবাব বাড়ির কুবলির সাদৃশ্য, তার বাপের বাড়ির খাস্তা ও লজিজ মোরগ কাবাবের সঙ্গে তার ননদের হাতের রাধা দড়ির মতো শক্ত চিকেন টিক্কার তুলনা, হঠাৎ-বড়োলোকদের জাফরানের বদল রঙ দিয়ে জরদ রান্না করার ছোটোলোকামি প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজস্ব মতামতসমৃদ্ধ আলোচনা করে এবং নিজের রোগ ও ভাগ্য নিয়ে তীব্র অসন্তোষ জানায়। ক্লাস নাইনে ২বার ফেল করার পর সেতারা পড়াশোনা চালিয়ে যাবার অসারতা বেশ বুঝে ফেলেছে। সকাল বিকাল প্রসাধন এবং যখন তখন রেডিও সিলোন ও বিবিধভারতী শোনা ও উদৃত্ত সময়ে মন ভার করে থাকার পর সে কোন কাজটা করার সময় পায়? জুম্মনের মাকে ছাড়া মা-মেয়ের একদণ্ড চলে না। বুকটা একটু বেশিরকম উঁচু হলেও এবং যখন তখন তার বুকের কাপড় পড়ে গেলেও বিবিসায়েব তাই তাকে সহ্য করে। মাতারটা এমনি খুব কাজের, একটা কাজের কথা একদিন বলে দিলেই চলে। আবার এমনিতে বেশ সাফসুতরো। খিজিরের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার সময় বিবিসায়েব মহাজনকে দিয়ে খরচও করালো, গ্যারেজের কর্মচারী ও রিকশাওয়ালদের বাকেরখানি ও অমৃতি খাইয়ে দিলো। বিবিসায়েবের জন্যে এসব কিছু না। তাদের বেগমবাজারের বাড়িতে এককালে বিড়ালের বিয়ে দিতেও তার বাপ ৫০০০ টাকা খরচ করেছে।
এতো খরচ করে তার বিয়ে দিলো, বড়োলোকের মতি, ১০টা দিনও যায়নি, গ্যারেজে রিকশাওয়ালাদের সামনে মহাজন খিজিরকে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসলো। কি ব্যাপার? চুতমারানি, আমারই খাইবি আমারই পরবি, আমি ঘর না দিলে জায়গা নাই, আর আমার লগে নিমকহারামি করস?
কিভাবে? মহাজন তাকে জিগ্যেস করে, মহল্লার মইদ্যে দেওয়ালে পোস্টার লাগাইছে ক্যাঠায়? খুব বাইড়া গেছস, না?
পোস্টার লাগাতে দিয়েছিলো তাকে আলাউদ্দিন মিয়া। সঙ্গে দুজন ছাত্র ছিলো, আলাউদ্দিন খুব সাবধান করে দিয়েছিলো, পুলিস যেন না দেখে। খিজিরের ইচ্ছা ছিলো লক্ষ্মীবাজার এলাকায় সবগুলো দেওয়ালে পোস্টার সেটে ভিক্টোরিয়া পার্কের নতুন শহীদ মিনারের উঁচু গম্বুজে উঠে চারদিকে বেশ সাজিয়ে বাকি পোস্টার সব লাগবে। কিন্তু ছাত্র ২জনের তাতে আপত্তি, অতো উঁচুতে তাকিয়ে পোস্টার পড়বে কে? এদিকে মোসলেম হাই স্কুলের দেওয়াল পর্যন্ত আসতেই পার্কের ওপারে কয়েকজন পুলিস দ্যাখা গেলো, ওরা সঙ্গে সঙ্গে চম্পট। বাকি পোস্টারগুলো খিজির রেখে দিয়েছে গ্যারেজের ভেতর, রিকশার বাতিল গদির নিচে, সুযোগমতো পুরনো কাগজওয়ালার কাছে বেচবে। মহাজন এতো চেতবে-এটা কিন্তু খিজির ধারণা করতে পারেনি। মহাজন বলে, তরে অক্ষণ ধরাইয়া দেই তো কয় বছরের জেল খাটতে হইবো, জনিস? পুলিসের অভাবে মহাজন নিজেই এই সব তৎপরতার বিরুদ্ধে বক্তৃতা ঝাড়ে, মানষে বোঝে না। এইগুলি ইন্ডিয়ার মতলব ওয়ারে ডিফিট খাইয়া ইন্ডিয়া অহন এই ট্যাকটিস ধরছে। ছয় দফার পোস্টার মারস, আরে ছয় দফা হইলে পাকিস্তান থাকবো? আমরা পাকিস্তানের লাইগা ফাইট করছি, পাকিস্তান হইছে, মোসলমানের ইজ্জত হইছে! আবার দ্যাহো, কতো মানুষ চাকরি পাইলো, ব্যবসা বাণিজ্য তেজরতি কইরা কতো মালপানি বানাইলো পাকিস্তান না আইলে ফকুরনির বাচ্চাগুলি হিন্দুগো গোলামী করতো। আমরা মালপানি বানাইবার পারি নাই, ক্যান? সে সমবেত রিকশাওয়ালাদের প্রশ্ন করে, পারলাম না ক্যান? উত্তরদাতাও সে নিজেই, মিয়ারা, ব্যাক দিবার পারি, মগর ঈমানটা? এবারও সে নিজেই উত্তর দেয়, না, এইটা দিবার পারুম না। এইটা আমার! ধন দৌলত বড়ো কথা না, বুঝলা? ট্যাহাপসা প্যাসাবের ফ্যানা, এই আছে এই নাই। নানারকম অপ্রাসঙ্গিক কথার পর সে নিজের বক্তব্য সংক্ষেপে জানায়, বহুত লিডার দেখছি! মালপানি কেউগায় কম কামায় নাই। আহন লাগছে পাকিস্তানটারে মিসমার করনের তালে। ইন্ডিয়ায় মাল ছাড়ে, আর এইগুলি গাদ্দারের পয়দা খালি ফাল পাড়ে।’
মহাজনের এই চাপাবাজির সপ্তাহ দেড়েকের মধ্যে আলাউদিনের বাড়ি সার্চ করে পুলিস তাকে ধরে নিয়ে গেলো। তখন তার গ্যারেজের দায়িত্ব নিলো রহমতউল্লা। রহমতউয়ার হুকুমে আলাউদিনের গ্যারেজ দ্যাখাশোনা করতে হলো খিজিরকেই। ৭ মাস পর ফুলের মালা গলায় জেল থেকে বেরিয়ে এসে আলাউদ্দিন খিজিরকে আর ছাড়ে না, তার অনুপস্থিতিতে লোকটা চমৎকার ম্যানেজ করেছে। রহমতউল্লার অনুমতি নিয়ে খিজিরকে সে নিজের গ্যারেজে নিযুক্ত করে, মামার বস্তিতে তার জন্য একটা ঘর ভাড়ারও ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু জুম্মনের মাকে মহাজন ছাড়বে না। জুম্মনের মা না হলে তার বিবিসায়েবের ঘর সংসার চালানো কঠিন। এর মধ্যে কতো কি ঘটলো, আলাউদ্দিন মিয়া স্কুটার কিনলো, তিন মাসের মধ্যে তার দুটো স্কুটার হলো। খিজির কখনো রিকশা চালায়, কখনো স্কুটার। তা খিজিরেরও উন্নতি হয়েছে বৈকি। রিকশা বা স্কুটার চালাবার ফাঁকে ফাঁকে আলাউদ্দিন মিয়ার গ্যারেজের সামগ্রিক দ্যাখাশোনাটা তার দায়িত্বে। কিন্তু জুম্মনের মা মহাজনের বাড়ির কাজ আর ছাড়তে পারে না। খালি খালি মহাজনকে দোষ দিয়ে লাভ কি? ঘরের বৌ-সে কি-না তড়পায় খালি মহাজনের বাড়ি যাবার জন্যে। ঈদের দিন স্বামী কি খাবে না খাবে সেদিকে তার কোনো নজর আছে?–বৌয়ের ওপর রাগে খিজির বিছানায় উঠে বসে, তখন তার চোখ পড়ে ঘরের কোণে রাখা গামছায় জড়ানো গামলার দিকে। থালার নিচে গামলায় পোলাও ও মুরগির ১টা আস্ত রান। মাগী রানটা সরালো কিভাবে?-রান খেতে খেতেও বৌয়ের ওপর খিজিরের রাগ কমে না। আরে সে তো স্বামী, নিজের পেটের ছেলের দিকেও কি মাগীর কোনো খেয়াল আছে? ছেলে পড়ে আছে কোথায়, আজ তার জন্যে বার দুয়েক ফ্যাচফাচ করে কেঁদে মা তার ডিউটি শেষ করলো। জুম্মনটা থাকলেও কাজ হতো, মহাজনের কজা থেকে বৌকে বার করে আনার জন্যে ছামরাটাকে লাগিয়ে দিলে হয়।
হাপুশ ছপুশ করে খাওয়া শেষ করে খিজির গেলো আলাউদ্দিন মিয়ার বাড়ি। সায়েব তখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে একপাল ছেলে। খিজিরকে দেখে সায়েব ধমক দেয়, ‘তুই থাকস কই? ২৪ নম্বরে তাজুদিন সাবে আইছে, আমারে খবর দিছে, আমার ফিরতে দেরি হইতে পারে। বড়ো আপা পোলাপান লইয়া আইছে, মামুগো বাড়ি থাইকা অগো সাত রওজা পৌছাইয়া দিস, নয়া বেবিটা বাইর করবি!’
সায়েবের বোনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নাজিমুদিন রোডের মাথায় রেলগেটের কাছে স্কুটার রেখে খিজির জুম্মনের খোজে বস্তিতে ঢুকলো। কোথায় জুম্মন? এই বস্তিতে কামরুদ্দিনকে কেউ চেনে না।
আলিমুদ্দিন আছে একজন, আলিমুদিনের কথা কন না তো? আলিমুদিনে তো তরকারি বেচে, সিগন্যালের লগে ঘর তুলছে। এই সব কথোপকথন চলে, কিন্তু জুম্মনের খবর পাওয়া যায় না। রেললাইনের ২দিকে লম্বা বস্তি, লাইনের মাঝে মাঝে ৩/৪ জন করে লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে, কোথাও কয়লা ভরা কড়াইয়ের আগুনের সামনে বসে হাত সেকে কয়েকটি মেয়ে। কোনো কোনো ঘর থেকে ধোয় ওঠে; ধোঁয়ায়, কুয়াশায় ও অন্ধকারে মোড়ানো সারিসারি বেড়ার ঘর, ঘরের ওপর ইট-চাপা ভাঙাচোরা টিনের কিংবা বাঁশের চাল। ধোঁয়ার সঙ্গে কুয়াশার সঙ্গে স্থায়ী একটি দুর্গন্ধ বস্তির সীমানা নির্দেশ করে। খিজির এর মধ্যে হাঁটে এবং প্রায় সবাইকে কামরুদিনের কথা জিগ্যেস করে। লোকজন তার সামনে আসে, এমনকি নাজিমুদ্দিন রোডের আলোকিত রাস্তা ভুলে শিশুরা রেল লাইনে দাঁড়িয়ে খিজিরকে দ্যাখে।
না, কামরুদিনরে না আইলেও চলে। অর বৌ, বাড়ি বাড়ি কাম করে।’ লোকজনের উৎসাহ থাকে না। বাড়ি বাড়ি কাজ করার মাতারির অতিথি এসেছে, তাকে অতো খাতির না দ্যাখালেও চলে। তাদের নিজেদের বৌরাই তো এই কাজ করে। ঘুরতে ঘুরতে রাত্রি বাড়ে, খিজিরের পায়ের নিচে কখনো রেলের কাঠের স্লিপার, কখনো পাথর। আকাশে চাদ নাই, রেললাইনের ধারে ল্যাম্পোস্ট নাই। বড়ো রাস্তার একদিকের ল্যাম্পোস্ট থেকে আলো আসে, আলোর তলানি, তাতে বস্তির জবুথরুঘরগুলোকে ট্রাকে ওল্টানো রিকশা বলে ভুল হতে পারে। শহরের মাঝখানে ঘোলা আলোর ভেতর, পথহীন ও যানবাহনশূন্য এরকম ১টি জায়গায় ২রেলের মাঝখানে কাঠের স্লিপার বা পাথর-মেশানো মাটিতে হাটতে হাটতে খিজির আলি প্রতিটি ঝুপড়ির দিকে তীব্র চোখে তাকায়, জুম্মনকে দেখতে পেলেই ছো মেরে তুলে নেবে। বস্তির এ-মাথা ও-মাথা করতে করতে সে ঘোরের মধ্যে পড়ে এবং এরকম কতোক্ষণ যে তাকে ঘুরতে হতো কে জানে? কিন্তু লুঙি-পরা, ঈদের দিনেও দাড়িনা-কামানো, ভাঙাগাল ১টি লোক তাকে জিগ্যেস করে, লাগবো সাব?
খিজিরের ঘোর কেটে যায়, ভয়ও কাটে। লোকটি ফের বলে, ‘খালি খালি ঘুরাঘুরি করতাছেন। আমার লগে আসেন। গেরস্থ ভালো মাল আছে!’ লোকটি তাকে ভদ্রলোকের মর্যাদা দেওয়ায় খিজির খুশি হয়, অবাকও হয়, বিচলিত হয় আরো বেশি। গৃহস্থ ঘরের এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে শোৰে কি-না খিজির এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই লোকটি ভালো করে তার চেহারা দেখে কেটে পড়ে।