চিলেকোঠার সেপাই – ০৬
রঞ্জুদের ঘর থেকে ওসমান বেশি হশিখুশি হয়ে বেরোচ্ছে, সিঁড়িতে হাড্ডি খিজিরকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। এই শীতের সকালে নিচতলায় শ্যাওলাপড়া চৌবাচ্চার ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে তার ওপর পরশু দুপুরে আলতাফের ফেলে-যাওয়া শাল চড়িয়ে ওসমান চুল আঁচড়াচ্ছিলো, রঞ্জ এসে একরকম জোর করে ওদের ঘরে নিয়ে গেলো। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে সেখানে চললো সেমাই খাওয়া। জর্দা-সেমাইটা জড়িয়ে দলা দলা হয়ে গিয়েছিলো, দুধ-সেমাইতে মিষ্টি কম। পর্দার ওপারে নিচু ও মিহি সুরে রঞ্জুর মায়ের বিরতিহীন বিলাপ। তালেব হত্যার পর এই প্রথম ঈদ, ওর মায়ের বিলাপে তালেবের ঈদ উদযাপনের নানারকম স্মৃতিচারণ। এতে ঘরদের একটু ভারি ভরি ঠেকলেও রানু ও রঞ্জুর ক্রমাগত পীড়াপীড়িতে সেমাই খেতে খেতে ২৫/৩০ মিনিট বেশ মিষ্টি রোদের মতো পিঠের ওপর পড়ে রইলো। এখন একটু আনোয়ারদের ওখানে যাবে, খিজির ঘরে ঢুকলে কি সহজে বেরোবে?
খিজিরের হাতে ট্রে। সবুজ ও লাল সুতায় নিষ্কণ্টক ডাল পাতা ও গোলাপ ফুল সেলাই করা হলুদ রুমালে ঢাকা। খিজির একটু দাঁড়ায়, কৈ যান? মাহাজনে নাশতা পাঠাইয়া দিছে, খাইয়া একেবারে বারানা’ বায়ে ঘুরে রঞ্জুদের ঘরে যেতে যেতে বলে, ‘আপনে উপরে গিয়া কামরায় বহেন। ব্যাকটি ভাড়াইটারে দিয়া আমি আইতাছি।
ওসমানের ঘরের দরজার চাবি রঞ্জুদের ঘরে। রানুর নতুন বিবাহিতা বন্ধু তার স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে এলে ওরা সবাই মিলে ছাদে উঠে ছবি তুলবে। ওসমান রঞ্জুদের দরজায় টোকা দিয়ে চাবি নিলো।
ট্রে থেকে সেমাই ও মোরগ পোলাওয়ের ডিশ তুলে নিতে নিতে ওসমান বলে, আমার তো প্লেট মোটে একটা। এতোসব রাখি কোথায়?’
রাখেন প্যাটের মইদ্যে। আমি এটু বহি, আপনে খান! এদিক ওদিক তাকিয়ে খিজির ছাদের দিকের দরজায় চৌকাঠে বসে পড়ে।
আরে আরে ওখানে বসছো কেন? বিছানায় বসো, বিছানায় বসে। ওসমানের ব্যস্ততাকে আমল না দিয়ে খিজির হাঁটু ভেঙে গুছিয়ে বসে।
মোরগ পোলাওয়ের স্বচ্ছ ও পাতলা ধোঁয়ার সুবাসে আত্মসমর্পণ করতে করতে ওসমান বলে, এতো রঞ্জুদের ওখানে হেভি হয়ে গেছে।’
‘আরে ঈদের দিন ভি মাইপা খাইবেন? ঈদ উদ মনে লয় মানেন না, না? নমাজ ভি পড়েন নাই?
‘ভোরবেলা ঠিকমতো ঘুম ভাঙলো না, ওসমান আমতা আমতা করে।
নাহাইছেন মালুম হয়।
হ্যাঁ। চৌবাচ্চার পানি যা ঠাণ্ডা!
ভালো করছেন। ঈদের দিন উইঠা নাহাইয়া উহাইয়া সাফসুতরা হইয়া নমাজ পড়তে যাইবেন। রিশতাগো লগে মিলবেন, পড়শিগো লগে মিলবেন! তয় না মোসলমানের পোলা!
ঈদের দিন খিজির আলি মুসলমানের সন্তান হওয়ার জন্যে নানাভাবে প্রচেষ্টা চালায়। আজ খুব ভোরে রাত থাকতে উঠে রাস্তার কলে ৫৭০ সাবান দিয়ে গা কচলে গোসল করেছে। গায়ে চড়িয়েছে আলাউদ্দিন মিয়ার দেওয়া বুকে সাদা সুতার মিহি কাজ করা আদির কল্লিদার পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ডান হাতে কজির কাছে একটু ছেঁড়া। তা হোক। হাতটা গুটিয়ে নিলেই হলো।
খিজিরের গেঞ্জিটা বড়ো ময়লা, ধোঁয়া হয়নি বলে ওটা পরেনি, পরলে পাঞ্জাবিও ময়লা দ্যাখায়। গেঞ্জির অভাবে তার অস্থিসর্বস্ব বুক প্রতিটি নিশ্বাসে প্রশ্বাসে তার নামকরণের সার্থকতা ঘোষণা করছে। সাদা লুঙিটা রাত্রিবেলা সে নিজেই ধুয়ে দিয়েছিলো, এখনো স্যাঁতসেঁতে রয়েছে। তাই কিছুক্ষণ পর পর তাকে খসখস করে উরু চুলকাতে হচ্ছে। সেই অতো ভোরবেলা মোড়ের পানির কল থেকে ঘরে ফিরে দ্যাখে জুম্মনের মা চলে গেছে মহাজনের বাড়ি, ঈদের দিন সকাল হবার আগেই না গেলে কাজ সামলানো যাবে না। বৌয়ের নারকেল তেল খুঁজে নিয়ে খিজির মাথায় মেখেছে, তা ছটাকখানেকের কম নয়, তার কপালে ও জুলফিতে তেল গড়িয়ে পড়ছে। গায়ে তার আতরের গন্ধ ভুরভুর করছে, কানে গোজা আতর মাখা তুলার টুকরা। আতরটাও আলাউদ্দিন মিয়ার কল্যাণে। তবে চোখে সুর্মা মাখার জন্যে তাকে একটু ছ্যাচরামো করতে হয়েছে। মামার সঙ্গে নামাজ পড়তে যাবে বলে মহাজনের বাড়িতে আলাউদ্দিন মিয়া সতরঞ্চি, জায়নামাজ, চাদর এসব খোঁজাখুঁজি করছে, সেই ফাঁকে বাইরের ঘরে টেবিলে রাখা সুর্মাদান থেকে সরু সুৰ্মা কাঠি দিয়ে খিজির দুই চোখে ইচ্ছামতো সুৰ্মা মেখে নিয়েছে। আলাউদ্দিন মিয়া নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। তা টের পেলেই বা কি? কাজের লোকের এই সব হাতটান দেখে চোখ ময়লা করার বান্দা তার
চাকরবাকরদের সে বরং একটু সুযোগ দেয়। আজ সকালবেলা মামাকে গ্যারেজে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করে রিকশাওয়ালদের রিকশা ভাড়া দেওয়ার দায়িত্বটা খিজিরকে জুটিয়ে দিলো, তাই বা কম কি?
বাড়ির চেয়ে রিকশার সংখ্যা বাড়িওয়ালার বেশি। রিকশার জন্যে রহমতউল্লার মায়ামোহাব্বতও বাড়ির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ফজরের নামাজ পড়ে প্রত্যেকদিন তসবি হাতে সে সরাসরি চলে আসে বাড়ির পেছনে রিকশার গ্যারেজে। অনেকের গ্যারেজ অবশ্য এর আগেই খোলা হয়, কিন্তু নামাজের আগে দিন শুরু করা তার ধাতে সয় না। তার গ্যারেজে পৌঁছবার আগেই রিকশাওয়ালাদের ভিড় জমে যায়। গম্ভীর মুখে কারো দিকে না তাকিয়ে রহমতউল্লা গ্যারেজে ঢোকে, ঢোকার পরপরই নরম গলায় প্রথম বাক্যটা ছাড়ে, ‘নবাবসাবরা তশরিফ লইছেন? তারপর মিনিটখানেক পরে শুরু হয় একটানা বিলাপ, ‘হায়রে, তিনটা গাড়ি এক্কেরে জখম কইরা ছাড়ছে, এ্যাঁ? প্রত্যেকটি রিকশার নম্বর তার মুখস্থ, আহারে, এই চাইরশ পাঁচচল্লিশটার হ্যাঁন্ডেলখান ছেইচা ভাতের চামিচ বানাইয়া দিছে। খানকির বাচ্চা ইসা দুইশ আটপঞ্চাশের মাড়গাড় আমান রাখে নাই। খানকির পুতে মাডগাডের উপরে খাড়াইয়া হোগা মারা দিছিলি তর কোন বাপেরে? কইলি না?
সারি সারি সাজানো ১৮টা রিকশার প্রত্যেকের হুডে, মাডগাড়ে, সিটে, সামনের সাইকেলে, রডে, এমনকি স্পোক বা চেসিসে হাত বুলাতে বুলাতে তার বাক্যবর্ষণে এক মুহুর্তের জন্য বিরতি দেয় না। এরই ফাঁকে ফাঁকে একেকজন ড্রাইভারকে রিকশা দেওয়া হয়। ১টি ও ২টি, ১টি ও ২টি-৩টে করে চাকা রাস্তায় গড়ায়। শেষ রিকশাটির প্যাডেল ঘুরতে শুরু করলে তসবিতে আল্লাকে গুণতে গুণতে রহমতউল্লা নাশতা করতে যায় ডানদিকের তেহারির দোকানে।
ঈদের দিন রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়ার নিয়ম নাই। তবে কোনো ঈদেই সবগুলো রিকশা সে ছাড়ে না। রিকশাওয়ালা যারা আসে সবাইকে ঠেসে খাওয়ায়, কিন্তু রিকশা দেয় মাত্র কয়েকজনকে। এমনিতে যাবতীয় রিকশাওয়ালার ওপর রহমতউল্লা খুব চটা, খানকির বাচ্চা না হইলে রিকশাচালাইবার কাম কেউ লয় না। মাহাজনরে ক্যামনে ঠকাইবো হালারা থাকে খালি হেই তালে। এদের মধ্যে একটু কম খানকির বাচ্চা কে, কে একটু কম ঠকায়,—এসব যাচাই করে নিতে খানিকটা সময় নেয়। আবার কারো কারো কাছে অনেকদিনের পাওনা টাকা-পয়সা আদায় করা যায় এই দিনেই, আব্বে জব্বইরা, মালীবাগের মোচড়ের মইদ্যে টেরাকের লগে রঙবাজি করবার গিয়া দুইশ বারোটারে উল্টাইয়া দিছিলি না? আমারে কতোটি পয়সা জরিমানা করাইলি খবর রাখস? জব্বারকে চুপ করে থাকতে দেখে তার মেজাজ চড়ে যায়, একটা পয়সা দিছিলি?
টায়ার টিউব জখম হইছিলো মাহাজন। জব্বারের এ কৈফিয়তে রহমতউল্লাহুঙ্কার ছাড়ে, টায়ারের মায়েরে বাপ ইস্পোকগুলার দাম দিবো তর কুন বাপে? নিয়ম অনুসারে স্পোক ছাড়া অন্য কিছু নষ্ট হলে মেরামতের দায়িত্ব মহাজনের। মালীবাগের মোড়ে জব্বার একটা রিকশা ওভারটেক করতে গিয়েছিলো, পেছনের ট্রাকের ধাক্কায় ২১২ নম্বর রিকশা একেবারে উল্টে যায়। চাকা ও মাডগার্ড সব পাল্টাতে হয়েছিলো মহাজনের সেই রাগ এখন পর্যন্ত যায়নি। কিন্তু নষ্ট ও বাতিল চাকার সবগুলো স্পোকের দাম দিতে হবে শুনে জব্বার একেবারে মিইয়ে যায়। লোকটা একবার শেষ চেষ্টা করে, মাহাজন, তহন তো কিছু কইলেন না!
তহন কইলে এতোগুলি পয়সা দিবার পারতি? তহন তরে ম্যাহেরবানি করছি। যা, তর পসা লইয়া আমার কাম নাই, ফকুরনির বাচ্চা, চোপা মারস, না? তর চোপার মায়েরে বাপ! এদিকে ঈদের জামাতের সময় হয়ে এসেছে, মহাজনের হাতে পায়ে ধরে সবগুলো স্পোকের দাম যা হয় তার একটা ভাগ দিয়ে জব্বার রিকশা পায়। মালপানিওয়ালা প্যাসেঞ্জার ধরে বায়তুল মোকাররমে ট্রপ দিতে পারলে এর দ্বিগুণ রোজগার। তাই রহমতউল্লাই বা ছাড়বে কেন? ঈদের দিন তার খরচ কি কম? পয়সা আসবে কোথেকে? তার এক ডিগচি সেমাই তো সাবাড় করবে এই ফকুরনির বাচ্চার দলই। ঈদের দিন সকালবেলাটা তাই রহমতউল্লাকে অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকতে হয়।
কিন্তু আজ ভোর হতে না হতে সরু গলিটা পার হয়ে মহাজনের বাড়ি এসে ঘাপলা বাধালো আলাউদ্দিন মিয়া, মামু, আউজকার দিনটা গ্যারেজে না গেলেন। কেউগারে পাঠায়৷ দেন, গাড়িগুলি ডেরাইভারগো দিয়া আইবো।
রহমতউল্লা রাজি না হলেও আলাউদ্দিন ছাড়ে না, আউজকা তো ভাড়াউড়ার কারবার নাই। কেউরে পাঠাইলেই হইলো। লন, জলদি নাহাইয়া লন, বায়তুল মোকাররম যামু। বহুত বড়ো জামাত, বহুত মানুষের লগে মিলবার পারুম। এতেও রহমতউল্লার সায় নাই, না মিয়া, ঐগুলি ছাড়ো। আমাগো পুলের উপরের মসজিদ কি আইয়ুব খানের মিলিটারি কজা করছে, না চৌচল্লিশ ধারা দিয়া মুসল্লিগে আটকাইয়া রাখছে? বাপ দাদা ময় মুরুব্বি চোদ পুরুষ নামাজ পড়ছে পুলের উপরের মসজিদে, আউজকা তুমি নয়া জায়গা বিচরাও? পুরনো প্রথার প্রতি মামার আনুগত্য আলাউদ্দিন মেনে নেয়। কিন্তু মামার গ্যারেজে যাবার ব্যাপারে তার আপত্তিতে সে একেবারে অটল। সে ১টি নতুন কৌশল প্রয়োগ করে, ঠিক আছে, কেউরে পাঠাইয়া কাম নাই। আমি যাইতেছি। আমারে বিশ্বাস করেন তো? আলাউদ্দিন মিয়া প্রায় চেচিয়ে কথা বলে। মামার জন্যে তার এই মাথাব্যথা যেন সকলের কানে লাগে। অন্তত মামার বৌটার কানে কথাগুলো পৌছানো দরকার। ঈদের দিন ভোরবেলা উঠেই রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে মুখ খারাপ করাটা তার মামীর পছন্দ নয়। হাজার হলেও মামী তার বেগমবাজারের খানদানি ঘরের আওরাত। তিন পুরুষ আগেই তাদের অবস্থা পড়ে গেলে কি হয়, -কথায় বার্তায়, চাকরবাকরদের ধরে এই মারধোর করায়, আবার এই গাদা গাদা খাবার দেওয়ায়, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে নাকউঁচু দ্যাখানোতে তার খানদানি ভাবটা সব সময় ঘ্যানঘান করে। মামীকে পটানো আলাউদ্দিন মিয়ার খুব দরকার। মামীর মেয়েটার আবার বাপের চেয়ে মায়ের দিকেই ঝোকটা বেশি। কিছুদিন থেকে মামীর ভাইয়ের আইএ ফেল ছেলেটা এই বাড়িতে আসা যাওয়া করছে। নাঃ মামীকে ভজাতে না পারলে কাজ হবে না। মামার গ্যারেজে যাওয়ার বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে পরম ধৈর্য ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে সে বিরক্তি ও ধৈর্যচ্যুতির নানারকম প্রকাশ দ্যাখাতে থাকে। লেগে থাকলে কি না করা যায়? শেষ পর্যন্ত মামী ও মামীর মেয়ে আলাউদিনের সমর্থনে এগিয়ে আসে এবং মহাজনের রিকশার গ্যারেজে যাওয়ার দায়িত্ব পায় খিজির।
মামাভাগ্লের গ্যারেজ ২টো পাশাপাশি। ঈদের দিন আলাউদ্দিন মিয়া অবশ্য সবগুলো গাড়িই বের করে। বেবি ট্যাকসি আজ তার নিজেরই কাজে লাগবে, রিকশাগুলো বাইরে গড়িয়ে দিয়ে খিজির ঢোকে মহাজনের গ্যারেজে।
খিজিরকে দেখে রিকশাওয়ালার ইচ্ছামতো রিকশায় হাত দিয়েই টানাটানি শুরু করে। সুর্মমাখা চোখ কুঁচকে খিজির ওদের কাণ্ড দ্যাখে আর চাচায়, আরে এইটা কি খানকিপটি পাইলি? গলায় রহমতউল্লার ঘর্ঘর টোনটি আনার চেষ্টা করে, আরে এইটা কি তোরা কান্দুপট্টি পাইলি? মনে লয় খানকিগো মাজা ধইরা সিনা ধইরা টান মারবার লাগছস! মহাজন না আসায় রিকশাওয়ালাদের তেজ বেড়ে গেছে, রিকশাগুলো যেন শালদের বাধা খানকি! একেকজনের বুক-চিতানো কথা শোনো, ঈদের দিন আবার পসাকিয়ের বে?
বাকি পসার খবর তুই রাখবি ক্যামতে? যা যা, বাড়ি গিয়া মহাজনরে দিয়া লাখাইয়া লইয়া আয়। তাহলে মহাজনে আহুক’ খিজিরের এই প্রস্তাবে রিকশাওয়ালাদের তেজ নিভে যায়। মহাজন আসা মানে প্রথম থেকে গ্যাঞ্জাম। তার মানে নামাজের খ্যাপ ১টাও পাওয়া যাবে না। তখন প্রত্যেকের কোমর থেকে ১ টাকার নোট, আধুলি, সিকি বের হতে থাকে। কয়েকজন শেষের ২/১টা টান বাকি রেখে বিড়িটা তুলে দেয় খিজিরের হাতে এবং এই বিড়ি দেওয়ার ক্ষোভ মেটায় এই বলে, কি ৰে, হাড্ডির বাচ্চা, মাহাজনের গতর উত্তর অহনও বানাইয়া দেস? না, মাহাজন অহন তরে ছাড়ান দিয়া আর কেউগ্যারে ধরছে? এসব কথার জবাব দেওয়ার সময় কৈ খিজিরের ১টা ১টা করে ৩টে বাদে সবগুলো রিকশা রাস্তায় নামে। নামাজের সময় প্রায় হয়ে গেলো। রহমতউল্লা ও আলাউদিনের বাড়ির সতরঞ্চি, চাদর ও জায়নামাজ মসজিদ পর্যন্ত বহন করে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব খিজিরের ওপর। তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। ক্রিং কিং -রিকশার ঘন্টার আওয়াজ, গ্যারেজের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে।-কোন হালা পোংটা পোলা গ্যারেজের মইদ্যে ঢুকছে –বিরক্ত হয়ে খিজির ভেতরে ভালো করে দাখে। না, কেউ না। বোধ হয় রাস্তায় রিকশার ঘণ্টা। গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে বাশের মোটা বাতায় তৈরি দরজা চেনের সঙ্গে তালা লাগিয়ে বন্ধ করছে, এমন সময় ফের শোনা যায়, ক্রিং ক্রিং ক্রিং’ খিজির দরজা খুলে আবার গ্যারেজে ঢোকে, সব চুপচাপ। তবে গ্যারেজে কেউ না কেউ আছে। খিজিরের গা ছমছম করে, এই গ্যারেজে ছেলেবেলায় বহু রাত্রি কেটেছে, মাঝে মাঝে নন্দলাল দত্ত লেনের গলা-কাটা মাহাক্কালটা এসে রিকশার বেল বাজাতো! সেই ব্যাটা কি আজ আবার এসে হাজির? গা ছমছম ভাবটা মুহুর্তে কেটে যায়, শালা বদ জিনটার সঙ্গে একটা বোঝাপড় করার জন্য সে গ্যারেজের এমাথা ও-মাথা ঘোরাঘুরি শুরু করে।
ইট সুরকির ১৫ ইঞ্চি দেওয়াল আসলে রহমতউল্লার বাড়ির সীমানা। একদিকে সেই দেওয়াল, সামনে ও ২ পাশে টিন ও বাঁশের মোটা বেড়া দিয়ে মহাজন এই গ্যারেজ শুরু করে প্রায় ১৯/২০ বছর আগে। তখন ২টো রিকশা রাখার মতো একটুখানি জায়গা ছিলো, সবটাই বেড়ায় ঘেরা। পরে এই বাড়ির মালিক হবার পর মাহাজন দেওয়াল ঘেঁষে গ্যারেজ বানায়। দিন যায়। গ্যারেজ এগিয়ে চলে সামনের দিকে। রাস্তার ড্রেন পেরিয়ে গ্যারেজ এগোয় রাস্তায়। এরপর বাড়াতে হয় পাশে। এখন ওদিককার ল্যাম্পোস্ট পার হয়ে গেছে, ফলে গ্যারেজের একটা সাইডে বা লাগাতে হয় না। পুরু দেওয়ালের ১দিকে দরজা কেটে বাড়ির ভেতরের সঙ্গে যোগাযোগের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। কিন্তু ছোটলোকের বাচ্চাগুলো যখন তখন ভেতরে ঢুকে চুরি চামারি করবে, অন্দরে পর্দা থাকবে না-কয়েকটা ইট সরাবার পর এই নিয়ে বিৰিসায়েব হাউকাউ করায় দরজা ফোটাবার কাজ বন্ধ থাকে। আলগা ইটগুলো কোথায় ছিটকে পড়েছে, সেখানে বিরাট ১টি ফাক। এছাড়াও এখানে ওখানে ইট খসে পড়ায় কিংবা ইট খসিয়ে নিয়ে এটা ওটা রাখবার জায়গা করা হয়েছে। খিজির যখন এখানে থাকতো, এগুলো কি এভাবেই ছিলো? অনেকগুলো মার্বেলের ঠোকাঠুকির আওয়াজে সে চমকে ওঠে, তার মার্বেল লুকিয়ে রাখতো একটা খোপে, সেটা কোনটা? সেই আওয়াজ অনুসরণ করে সে এদিক ওদিক হাতড়ায়। না, কোথায় মার্বেল? ১টা খোপে সাইকেলের অচল চেন। আরেকটা খোপে তেলের ছোটো একটা টিন। আচ্ছা, সন্ধ্যার পর রায়সায়েবের বাজারের পাশে চোরাবাজারে গ্যারেজের ১টা ক্ষু ড্ৰাইভার বেচতে গিয়েছিলো, হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলে অন্ধকারে হাতিয়ে নিয়েছিলো ১টা বল বেয়ারিং। ঘরে এসে দ্যাখে একেবারে নতুন, এতো সুন্দর চকচক করতো। এই দেওয়ালের কোন ফোকরে লুকিয়ে রেখেছিলো। বিক্রি করতে ইচ্ছা করতো না। তারপর বিক্রি করার ইচ্ছা ও সুযোগ যখন হলো তখন কিন্তু সেটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোন ফোকরে রেখেছিলো? নাঃ! কোথাও নাই। সিলেটের প্যাকেট-ছেঁড়া তাসের তাড়া কোথায় রাখতো ১টা খোপে হাত দিলে খসখস করে, কিন্তু না, সেখানে ব্যবহৃত শিরিষ কাগজের টুকরা। আরেকটাতে ক্ষুড্রাইভার, ১টিতে সাইকেলের চেন। নাঃ! তার বল-বেয়ারিং কি মার্বেল কি তাসের তাড়া পাওয়া যায় না। ওদিকে ঘরের ভেতর কানের পাশে রিকশার ঘণ্টা বিরতি দিয়ে দিয়ে বেজে চলে, খিজিরের হাতের তালে তালে সেই ঘণ্টা-বাজানো নিয়মিত বাজনায় রূপ নেয়। নাঃ! তাকে কিছুঁতেই ধরা যাচ্ছে না। হতাশ হয়ে খিজির দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে।
গলি দিয়ে নোঙর বাঁচিয়ে চলেছে ধোঁয়া পাজামা পাঞ্জাবি লুঙি পরা লোকজন। তাদের প্রত্যেকের মাথায় টুপি, অনেকের আঙুলে শিশুর হাত। কাউকে ভালো করে দ্যাখা যায় না, আস্তে আস্তে রাস্তা জনশূন্য হয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে রাস্তাও চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে যায়। খিজির ওর মাথা বারবার বাঁকালেও কোনো ফল হয় না। আজ চুলে এতোটা তেল দেওয়ায় কি তার মাথার ভেতরটা জমে বরফ হয়ে গেলো? চুল বেয়ে তেল চুয়ে চুয়ে তার করোটির ভেতর গড়িয়ে মগজের এ-চাকায় ও-চাকায় জট পাকিয়ে রেখেছে। কোনো চুতমারানি ট্রাফিক পুলিসের সাধ্য কি যে সেই জট খুলে? তার মগজে কি শুরু থেকেই এরকম জাম লেগেই থাকতো? তার মায়ের অবশ্য ধারণা ছিলো যে, খিজিরের করোটি একেবারে খ খ করে, সেখানে এক কাচ্চা মগজ যুদিল থাকে। তরে লইয়া আমি কি করি? তর কপাল তুই দেখবি, আমার কি? মা একবার বকতে শুরু করলে থামতে পারতো না, তরে কতোবার কইছিমিস্ত্রীর সামনে তুই পড়বি না। তরে দেখলে মিস্ত্রী এক্কেরে খাট্টা হইয়া উঠে, আর তুই বেলাহাজ বেশরম খাট্টাশের পয়দা একখান, তামামটা দিন ঘুইরা ফিইরা খালি তার সামনেই পড়বি!’
কিন্তু খিজির কি আর ইচ্ছা করে মিস্ত্রীর সামনে পড়তো? মিস্ত্রী শালা জোয়ান একখান মরদ, সে কি-না বৌয়ের পোলার রোজগার খাবার লোভে দিনের মধ্যে ২ বার ৩ বার এসে হাজির হতো লোহার পুলের গোড়ায়। কতোই বা রোজগার ছিলো? তখন ওর কাজ রিকশা ঠেলে ঠেলে লোহার পুলে উঠিয়ে দেওয়া। একবার সূত্রাপুরের ঢাল থেকে ওপরে উঠিয়ে দাও, তারপর ফিরে এসো একা একা। তারপর আরো সব পিচ্চিদের সঙ্গে আবার রিকশার পেছনে ছোটে, ধাক্কা দেই?—দে। আবার ঠেলো, আবার নেমে এসো। ২ পয়সা করে জমতে জমতে ২ আনা ৩ আনা না হওয়া পর্যন্ত একটানা ওঠানামা। তারপর চিনাবাদাম খাও, কি সোনপাপড়ি, কি ছোলার ঘুঘনি। অথবা পুলের ওপর এক ধারে নুলো বুড়ির কাছে বসে আধ-পচা আম কি পাখি-ঠোকরানো নোনাফল কি আধখানা কাটা মিষ্টি আলু। কিন্তু কি বলবো, ৩/৪ ঘণ্টা যেতে না যেতে ফরাসগঞ্জের আটার কলের কাজে বিরতি দিয়ে ফালুমিন্ত্রী শালা ঠিক হাজির, দেহি, কতো পাইছস? পয়সার পরিমাণ তার মনমতো না হলেই ঘাড়ে পিঠে সমানে কিলচড়, হারামির বাচ্চা, প্যাটখান বানাইছস কলতাবাজারের পানির টাঙ্কি, যহনই দেহি চুতমারানির মুখ চলতাছে। মিস্ত্রীর আড়ালে থাকার জন্যে চেষ্টা তো কম করতো না। একদিন পুলের ওপর ১টা সিকি কুড়িয়ে পায়, সেটা নিয়ে মইজার মায়ের পোলা মইজার সঙ্গে তার একচোট হাতাহাতিও হয়, সিকিটা নাকি মইজা আগে দেখেছিলো। শেষ পর্যন্ত রফা হয় এই শর্তে যে, ২জনেই সূত্রাপুরের ঢালে ১টা হোটেলে গরুর গোশত খাবে। ব্যাপারটা ফালু মিস্ত্রী টের পেয়ে গিয়েছিল, মনে হয় মইজা হালায় পুরো পয়সাটা না পাওয়ার ক্ষোভে তার কানে লাগায়। পুলের ঢালে ট্র্যাফিক পুলিস বক্সের পেছনে ফালু সেদিন তার গলা ধরে এমন চাপ দিয়েছিলো যে, গোশতের টুকরাগুলোর স্বাদ সে জিভে আরেকবার অনুভব করে। এদিক দিয়ে ধরলে ফালু মিস্ত্রী বরং তার উপকারই করেছিলো, তারই বেদম মারের চোটে ২ আনার গোশতের স্বাদ ১ ঘণ্টার মধ্যে ২ বার ভোগ করলো।
ফালু মিন্ত্রী লোক কিন্তু এমনিতে খুব খারাপ ছিলো না। অন্তত খিজিরের মায়ের গায়ে সহজে হাত তুলতো না, এটা ঠিক। খিজিরের মা, এমনকি খিজির পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকার সময় সবচেয়ে বেশি আরাম ভোগ করেছে। ফালুর বসবাস ফরাসগঞ্জের একটা বড়ো বাড়ির ঘোড়ার আস্তাবলে। বাড়ির মালিক তার দুই পুরুষের মনিব, ফালুর বাপ মনিবের ঘোড়ার গাড়ি চালাতো, ঘোড়ার গাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার পর আস্তাবলটাই সাফ সুতরো করে নিয়ে ফালু সেখানে বাস করতো। মনিবের আটার কলে সে মেশিন চালায় আর তার বৌ যেই হোক না ঐ বাড়িতে কাজ করতে হতো তাকে। ফালু এমনি হাসিখুশি মানুষ, কখন যে তার মেজাজ খিচড়ে যাবে কে বুঝবে? দ্যাখো না, মায়া সিনেমায় মোলাকাত দেখে ছবির কাহিনী বলার জন্যে বৌকে নিয়ে বসেছে,—এমনকি ঘুমিয়ে-পড়া খিজিরের মাথাটা বালিশে ঠিক করে বসিয়ে দিলো-কাহিনী বর্ণনার মাঝে হঠাৎ কি হলো, ঘুমন্ত বালকের পিঠে দমাদম শুরু করলো কিল মারতে। হাতের সঙ্গে সমানে চললো তার মুখ, এই জাউরাটারে কদর দিয়া খেজুর কাটা পুঁইতা ঘরে আইলে আমার দিলটা ঠাণ্ড হয়। বুইরা হারামজাদা,তর ইসে কইটা দিমু, এক্কেরে পোতাপুতা লইয়া কাটুম, জিন্দেগির মইদ্যে বিছনার মইদো তর প্যাশাপ করা বারাইবো দেহিস।
বিছানায় পেচ্ছাব করার ব্যাপারে খিজিরের কি করার ছিলো? ২/১ রাত পরপর ঘুমের ভেতর কারো উস্কানিতে সে সোজা চলে যেতো ফরিদাবাদ পেরিয়ে মিল ব্যারাকের পর আইজি গেটে। এই জায়গাটা তার এমনিতে চেনা, ফালুর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য মাঝে মাঝে এসে ডাংগুলি খেলতো। মাঠের এক কিনারে পেচ্ছাব করতে কি যে ভালো লাগতো। কিছুদিন পর রহমতউল্লার গ্যারেজে তোতামিয়া ওকে ন্যাংটা করে খুব জাপ্টাজাপ্টি করছিলো, তখন তার নুনু অনেকটা সেইভাবে শিউরে ওঠে। সে তো অনেক পরেকার কথা। বিছানায় পেচ্ছাব বন্ধ করার জন্য মা তার কম চেষ্টা করেনি। কতো তাবিজ, কতো পানি পড়া! শেষ পর্যন্ত সারলো রহমতউল্লার বাড়ির ঠিকা-ঝি মজির মায়ের জোগাড়-করা ফরিদাবাদ মাদ্রাসার মৌলবি সায়েবের পানি-পড়া খেয়ে। কিন্তু এতেও ফালু মিস্ত্রীর মারধোর কমে না। খিজির অনেকদিন থেকেই ঐ বাড়ি থেকে কেটে পড়ার তালে ছিলো। কিন্তু ওর মাও যে সরে পড়বে এটা কিন্তু খিজির কখনো কল্পনা করেনি। ফালুর ঐ প্রায়-পাকা আস্তাবল ঘর, ঘরের সামনে পাকা উঠানে সারা রাত ধরে ১০০ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে, সেই আলোতে রাত্রে নিশ্চিন্তে কাটা বেছে ফলি মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া চলে। একদিকে চাকরবাকরদের জন্য সারি সারি খাটা পায়খানা, পায়খানার সারির পাশে চৌবাচ্চায় দিনরাত পানি -সব ছেড়ে আহাম্মুকের মতো মা চলে এলো। তেমন কিছু আনতেও পারলো না। লুকিয়ে গোটা দুয়েক শাড়ি, সের চারেক চাল আর ১টা বিছানার চাদর পাঠিয়ে দিয়েছিলো খিজিরকে দিয়ে। কিন্তু মনিবের ভালো শাড়িটা সরাতে গিয়ে পারলো না। নতুন মাতার মাগীটা ভঙ্কে তঙ্কে ছিলো, ঠিক সময়ে ধরে ফেলে। শাড়ি লুকিয়ে নেওয়ার কথা শুনে ফালুর লাফালাফি কী ‘কাপড় দিয়া তুই করবি কি। খানকি মাগী গতরখান কাপাইলে তর ভাত কাপড়ের অভাব?
কথাটা মিস্ত্রী খুব ভুল বলেনি। কালোকিষ্টি মা মাতারির গতরখান না থাকলে মায়ে পোয়ে তারা কোথায় ভেসে যেতো!—তা সেই বারো ভাতারি মা মাগীটা কি এতোকাল পরও তাকে রেহাই দেবে না? কিসের জিন, কিসের মাহাক্কাল, খানকি মাগী মা-ই আজ এসে তার ঈদের নামাজ পড়তে দিলো না। দেওয়াল থেকে বলকানো মাথাটা তুলে খিজির দ্যাখে রাস্তায় লোকজন নাই। তার শরীর একেবারে এলিয়ে পড়ে। তবে এই সময় সুভাষ বোস এ্যাঁভেনু বা হৃষিকেশ দাস রোড কি নন্দলাল দত্ত লেনের মুখে কোনো ট্রাকের অসহিষ্ণু হর্নের আওয়াজে খিজিরের কান চোখ গাল ঠোঁট সব ছিঁড়ে খুঁড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সমস্ত গতরটা আপনা-আপনি গোছগাছ হলে খিজির সোজা উঠে দাঁড়াতে পারে।
মহাজনের বাড়ি গেলে মহাজন রহমতউল্লা বা সায়েব আলাউদ্দিন প্রায় কিছুই বকাবকি করে না। আলাউদিনের কথায় বরং একটু প্রশ্রয়, বছরকার একটা দিন, বলদটা গ্যারেজের মইদ্যে কাটাইয়া দিলি? নামাজটা ভি পড়লি না?
‘আরে রাখো’ রহমতউল্লা সোজাসুজি কাজের কথায় আসে, এ্যাঁগো আবার নামাজ কালাম!—গাড়ি দিলে কয়টা? বাকি পসা পাইছস?
রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে আদায়-করা বাকি পয়সা গুণে নিতে নিতে রহমতউল্লা তার ক্ষোভ প্রকাশ করে, এ্যাঁগো আবার নামাজ। ঈমান নাই, এ্যাঁগো আল্লা-রসুলের ডর আছে? এবার কিন্তু খিজিরের সত্যি ভয় হয়। আল্লা-রসুলকে সরাসরি ভয় করার সাধ্য তার নাই। কিন্তু তার ঈমানের অভাবের কথা বলতে বলতে মহাজন যেভাবে তার দিকে তাকাচ্ছিলো তাতে সে বড়ো বিচলিত হয়। এর ওপর মহাজন তাকে ৫টা টাকা বকশিস দিলে খিজিরের গলা শুকিয়ে আসে। আধ ঘণ্টা এদিক ওদিক ঘুরে রহমতউল্লার কাছে গিয়ে বলে, মাহাজন। এই পাঁচ সিকা পসা দিবার কথা মনে আছিলো না। দেলোয়ার ইস্পোকের দাম দিয়া গেছে!’
মহাজনের মাধ্যমে গেথে-যাওয়া ঈমানের ভয় তবু তার কাটে না। রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে আদায় করা পয়সা এখনও তার কাছে রয়ে গেছে, ১টা আস্ত টাকার নোট, ১টা আধুলি, ১টা সিকি। ভাড়াইটাদের ঘরে ঘরে বাড়িওয়ালার পাঠানো খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য বেরিয়ে রাস্তায় দ্যাখা প্রথম ভিখারির থালায় আস্ত আধুলিটা ফেলে দিলো। সকালবেলা রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে পাওয়া পয়সা থেকে হাতানে ৩টে টাকার বেশির ভাগই হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় খিজিরের মনটা খারাপ হয়ে গেলো।