‘তোমার রঞ্জু পড়ি রইলো কোন বিদেশ বিভূঁয়ে, একবার চোখের দ্যাখাটাও দেখতি পাল্লে না গো!’
কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে ওসমান একটার পর একটা লেবুপাতা ছেঁড়ে আর মায়ের বিলাম শোনে। ৩টে আঙুলে লেবুপাতা চটকাটে চটকাতে উঠানের দিকে এগিয়ে গেলে কে যেন তাকে দেখে ফেলে, ‘ওরে! রঞ্জুকে এট্টু কাঁধ দিতি দে!’ লোকটা কে? সেই লোকটাই ফের আফসোস করে, ‘আহা হাজার হলেও বড়ো ছেলে, জ্যেষ্ঠ সন্তান! কুথায় পড়ি রইলো সে, বাপের মুখে এক ফোঁটা পানি দিতি পাল্লো না। আহারে, বাপ হয়ে ছেলের হাতের এক মুঠি মাটি পেলো না গো!’
ওসমানের সামনেই কথাবার্তা চলে। ভুলটা কারো চোখে পড়ে না। বাপের লাশ-বিছানো খাটিয়ার একদিকে কাঁধ দিয়ে সে-ও পশ্চিমপাড়ার দিকে চলে। পশ্চিমপাড়ায় জুমার ঘর, জুমার ঘরের পেছনে কাজীদের জোড়শিমুলতলা, তারপর ছোটো ছোটো ঝোপঝাড় ও খেজুর কাঁটায় ভর উঁচুনিচু গোরস্থান। গোলাপপাশ থেকে শবযাত্রীদের ওপর গোলাপজন ছিটিয়ে দিলে মনে হয় শিমুলগাছ থেকে টুপটাপ শিশির ঝড়ে পড়ছে। ওসমানের পায়ের কয়েক ফোঁটা পড়লে তার ঘুম ভেঙে যায়। পায়ের ওপর চাদর অনেকটা ভিজে গেছে, ওদিকের জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে।
ওসমানের উঠে বসতে হলো। শিকের ফাঁকে থুথু ফেলে জানলাটা বন্ধ করে ফের শুয়ে পড়লো। কিন্তু পাশের জানলা খোলাই রইলো। ঐ জানলা দিয়ে পানির ছাঁট এসে পড়ছে চেয়ারে। চেয়ারে কিংস্টর্কের প্যাকেট, দেশলাই, চাবি ও কয়েকদিন আগেকার ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’। প্রথম পৃষ্ঠায় ৪ কলাম জুড়ে এই বছরের বিশ্বসুন্দরীদের ছবি। রাতে ব্যবহার করবে বলে আনোয়ারের বাড়ি থেকে কাল দুপুরবেলা নিয়ে এসেছে। শালার শওকত ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে রাতে বাঙলার মাত্রাটা বেশি হয়ে গিয়েছিলো, এসে কখন যে প্যান্টট্যান্টসুদ্ধ শুয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। সিসিলিরূপসীদের পুরুষ্টু উরুতে শীতল বৃষ্টিপাত ঘটছে। ঐটা সামনে রেখে কম্বলের নিচে নিজের উরুসন্ধি থেকে দিব্যি ঘন প্রস্রবণ বইয়ে দেওয়া চলে। কিন্তু হয় না। প্যান্টের বোতাম খুলতে খুলতে বোঝা যায় যে, বাপের লাশের স্পর্শে তার সারা শরীর একদম ঠাণ্ডা মেরে গেছে। ভোরবেলার স্বপ্ন নাকি ঠিক ঠিক ফলে, বাপ তার সত্যি সত্যি মরে গেলো কিনা কে জান? একটু আগে দ্যাখা স্বপ্ন, সহজে কি ছাড়তে চায়? শীতের দিনেও ঘামের মত সেঁটে থাকে। তবে স্বপ্নে নিজের কাউকে মরতে দেখলে অন্য লোক মরে। নাঃ! আব্বা নিশ্চয়ই ভালো আছে। বাপের বেঁচে থাকা সম্বন্ধে একটু নিশ্চিন্ত হলে বাপের ওপর ওসমানের রাগ হয়। একবার বাস করবে বলে পাকিস্তানে এলো তো আবার ফিরে গেলো কেন? এখানে বাড়িঘর কিছুই করলো না। বছর ছয়েক চাকরি করে একবার ছুটি নিয়ে সেই যে দেশে গেলো, ফেরার নামও করলো না আর। গ্রামে না থাকলে মোড়লগিরিটা ফলাবে কোথায়!
বাপের ওপর রাগ ভালো করে জমে ওঠবার আগে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে ওসমান দারুণ উৎকণ্ঠিত হয়ে এক লাফে মেঝেতে নামলো, আব্বা কি এসেই পড়লো নাকি? প্যান্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে হাতের এক ধাক্কায় মিস ইউনিভার্সের ছবি মেঝেতে ফেলে দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ‘কে’ বলে দরজার ছিটকিনি খুললো। দূর! আব্বা আসবে কোত্থেকে? ইন্ডিয়া থেকে আসা কি চাট্টিখানি কথা?
দরজা খুললেই নিচে নামবার খাড়া ঝাপসা সিঁড়ি। সিঁড়ির সবচেয়ে ওপরের ধাপে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১৪/১৫ বছরের একটি ছেলে। ওসমানের ঘরের খোলা জানলা দিয়ে লাও এসে পড়েছে ছেলেটির শরীরের ওপরের ভাগে। গায়ে নীল রঙের হাফ হাতা হাওয়াই শার্ট, ফ্ল্যাপের নিচে দুটো বুকপকেট, ডান পকেটের ওপর ঘন খয়েরি সুতার এমব্রয়ডারি করা প্যাগোডার মাথা।
দরজার চৌকাঠে চোখ রেখে ছেলেটি বলে, ‘আপনি একটু নিচে আসেন।’
ওসমান ছেলেটির মুখের দিকে সোজাসুজি তাকায়, ‘কি ব্যাপার?’
নিচু গলায় ছেলেটি জবাব দেয়, ‘আমরা দোতলায় থাকি।’
‘আমি কি করবো?’ ওসমান একটু হাসে।
ছেলেটি হাসে না, বিরক্ত হয় না। পাশে সিঁড়ির রেলিঙে হাত রেখে বিড়বিড় করে, ‘আপনে একটু আসেন। আমার ভাই মারা গেছে।’ একটু থেমে সে হঠাৎ জোরে বলে ওঠে, ‘কাল পুলিসের গুলি খাইয়া মারা গেছে।’
গুলি কোথায় লেগেছিলো? এই প্রশ্ন না করলেও ওসমান চট করে মাথাটা নিচু করে সঙ্গে সঙ্গে ফের সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায়?’
‘আমাদের বাসায় আসেন। বাড়িআলা সবাইরে ডাকতে বললো।’
‘চলো।’
ছেলেটির পেছন পেছন কয়েকটা ধাপ নেমে ওসমান হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘরের জানলা-দিয়ে-আসা আলো এখন ছেলেটির এলোমেলো চুলে বিলি কেটে গড়িয়ে পড়েছে তার ঘাড় পর্যন্ত। ওসমানের পায়ের আওয়াজ থেমে যাওয়ায় ছেলেটি দাঁড়িয়ে পেছনের দিকে তাকালো। এখন তার চিবুক পর্যন্ত আলো। তার চোখের লাল চিকন রেখাগুলো ছটফট করছে। প্রায় ৭/৮ ধাপ ওপর থেকে ওসমানের দিকে তাকালে আলো-পড়া লাল চোখ জোড়া অনেক বড়ো মনে হয়।
ওসমান বলে, ‘তুমি যাও। আমি একটু পরে আসছি।’
ছেলেটি একটু দাঁড়ায়, জানলার আলো এখন তার ঘাড়ের ওপর, শার্টের কলারে। এবার পেছনে না তাকিয়ে সে নিচে নেমে গেলো। ওসমান ভেবেছিলো যে, ছেলেটির দুঃখী চোখজোড়া আরেকবার দ্যাখা যাবে।
টুথব্রাশে অনেকখানি পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ছাদের এক কোণে গিয়ে ওসমান পেচ্ছাব করে। ঘরে এসে কলসি থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ছাদের আরেক দিকে বসে সে মুখ ধোয়। মুখ ধোয়ার কাজটা তাকে একটু ধীরে সুস্থে করতে হয়, তাড়াতাড়ি কুলকুচো করতে গেলে বমি হওয়ার চান্স থাকে। পেচ্ছাব করা ও মুখ ধোয়াটা ওসমান ছাদের সেরে নেয়। কোনোটাতেই বাড়িওয়ার সম্মতি নেই। গোসল করতে হলে অবশ্য নিচে নামতেই হয়। নিচতলায় বাড়িওয়ালার ‘গওসল আজম সু ফ্যাক্টরি’। কারখানার প্রায় ৮/১০ জন লোক। সারি বাঁধা খাটা পায়খানার ৩টে প্রায় তাদের দখলেই থাকে। ওসমান তাই অফিসে কি সিনেমা হলে কি মসজিদে পায়খানা করে। গোসলের জন্য পাকা স্যাঁতসেঁতে উঠানের একদিক জুড়ে মস্ত বড়ো চৌবাচ্চা, এটাকে বলা হয় হাউস। কিন্তু ওটার দিকে চোখ পড়লেই তার শীতশীত করে, গোসল করাটা প্রায় হয়েই ওঠে না।
এই ঘরের গণির বসবাস প্রায় আড়াই বছর। বাড়িটা হোপলেস। সামনে খোলা জায়গা নাই, ড্রেনের পরেই বাড়ি শুরু হয়ে গেলো। রাস্তার ওপরে চাওড়া দরজা, দরজাটা একটু নিচু। বাড়ির বাসিন্দারা, এমনকি বেঁটে লোকজনও মাথা একটু নিচু করে ঐ দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢোকে। যারা ওপরে যাবার তারা বাঁদিকে এক পা গিয়ে সিঁড়িতে ওঠে, আর একতলার গওসল আজম স্যু ফ্যাক্টরির কর্মচারী বা কর্মিগণ সরু প্যাসেজ পার হয়ে স্যাঁতসেঁতে উঠান অতিক্রম করে। রাস্তার ওপরে এই একটিমাত্র দরজা বন্ধ করে দিলে এই বিশাল ও বেঢপ দালালে ঢোকা অসম্ভব। দোতলা ও তিনতলার সামনে বারান্দায় বাঙালিদের পেট সমান উঁচু লোহার রেলিঙ। ঘরগুলো ছোটো, এর মধ্যে হার্ডবোর্ড, কাঠের পার্টিশন ও বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘরের সংখ্যা আরো বাড়ানো হয়েছে। ঘরের মূল দেওয়াল খুব পুরু, থামগুলো মোটা। বাড়ি তৈরীর সময় মনে হয় শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে একটি প্রবলরকম ইচ্ছা খুব তৎপর ছিলো। সেই শত্রু কে? কোনো শত্রু না থাকলে বাড়িটাকে এরকম না-দুর্গ না-বাড়ি বানাবার মানে কি? মানে যারা জানতো সেই সাহা কি বসাক কি পোদ্দার মশাইরা ১৯৫০ সালে রহমতউল্লার কাছে বাড়ি বেচে ইন্ডিয়া চলে গেছে। ইপিআইডিসিতে কাজ পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওর আগের অফিসের এক সহকর্মীর কল্যাণে ওসমান এই ঘরের খোঁজ পায়।
ঘর মানে বাড়ির চিলেকোঠা। ছাদের ওপর একটিমাত্র ঘর, রান্নাঘর নাই, বাথরুম নাই, পায়খানা কি গোসল করতে হলে দাঁড়াতে হয় একতলার কিউতে। তবে ওসমানের ঘরে আলো বাতাস খুব। দরজা ২টো, সিঁড়ির মুখে ১টা, আরেকটা ছাদের দিকে। ছাদটা বেশ বড়ো, চারদিকে রেলিঙ, সামনের রেলিঙ একটু উঁচু। একদিকে এসে দাঁড়ালে সামনের রাস্তা চমৎকার দ্যাখা যায়। রাস্তার ঠিক ওপারে ১টা দোতলা বাড়ি, বেশ বড়ো এবং একই রকম বেঢপ। ঐ বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া মসজিদ, মসজিদের বারান্দায় একটি সাইনবোর্ডে বাঙলা ও আরবি হরফে হক্কেনূর মক্তবের নাম লেখা। মাঝে মাঝে ওসমান ছাদে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই চারদিকের ঘিঞ্জি সব বাড়িঘরের মাঝখানে পায়ের নিচের ছাদটাকে বড়ো ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে, সুড়ুৎ করে তখন ঢুকে পড়ে নিজের ঘরে। আজ অবশ্য ফাঁকা ফাঁকা ভাবতার জন্যে অপেক্ষা করতে হলো না। নিচে রাস্তার ওপর পুলিসের জিপ।
নিচে নামবা সময় দোতলার ডানদিকে মহিলা কণ্ঠের ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার আওয়াজে বোঝা যায় যে, এই ঘরেরই কেউ নিহত হয়েছে। মৃত মানুষের বাড়িতে যেমন হাউমাউ কান্নাকাটি থাকে, এখানে কিন্তু তেমন কিছু নাই। কান্নার ধ্বনি ঘরের চাপা কোলাহল থেকে বাইরে আসছে, ধ্বনির সঙ্গে সংগে ওসমান নিচে নামে।
জিপের পেছনে আরেকটি গাড়ি—পিক-আপ, এটাও পুলিশের গাড়ি। রাস্তার ওপর থেকে রহমতউল্লার সঙ্গে ৭/৮ জন লোক রাস্তা ক্রস করছে। তাদের ৪ জনই পুলিস। বাড়িওয়ালার মাথায় কালো জিন্না টুপি। গভর্ণর গতবার এখানকার কম্যুনিটি সেন্টার উদ্বোধন করতে এলে মহল্লার একজন শ্রেষ্ঠ মৌলিক গণতন্ত্রী হিসাবে রহমতউল্লা টুপিটি উপহার পায়। তবে সবসময় সে সাদা কিস্তি টুপিই পরে। কেবল নিজের দাপট দ্যাখাবার দরকার হলে জিন্না টুপিটাকে সে ব্যবহার করে মুকুটের মতো।
না, টুপির জন্য নয়, বাড়িওয়ালাকে সেখে ওসমান গনির ঠোঁটে আপনি-আপনি একটি হাসিহাসি ভঙ্গি ফোটে। জবাবে গম্ভীর ও কোঁচকানো চোখমুখ করে বাড়িওয়ালা বলে, ‘আমার বাসায় যাইতেছিলেন? লন, উপরে যাই।’
রহমতউল্লার অনুমান ঠিক নয়। ওসমান যাচ্ছিলো ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের দিকে। ভোরবেলা হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে গেলো, ঠাণ্ডাটা বেশ জমেছে, নানরুটি পায়াতে রবিবারের সকালবেলাটা চমৎকার জমতো। এ্যাবাউট টার্ণ করে বাড়িওয়ালার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে সে জিজ্ঞেস করে, ‘ব্যাপার কি? কিভাবে হলো?’
‘আপনে আছিলেন কৈ? নিচের তলার পড়শি মরে গুলি খাইয়া, আপনে জানেন না?’
ওসমান চুপচাপ তার সঙ্গে হাঁটে। জবাব দেওয়াটা রিস্কি, কিন্তু জিগ্যেস করলেই তো তার অজ্ঞতা আরো স্পষ্ট হবে। রহমতউল্লা কথা বলে একাই, ‘রাইত ভইরা থানা-হাসপাতাল, হাসপাতাল-থানা না করলে লাশ পাইতাম?’ সিঁড়ির গোড়ায় এসে দারোগাকে দেখিয়ে বলে, ‘সামাদ সাহেব না থাকলের লাশ অহন কৈ পইড়া থাকতো!’
দোতলায় ও তিনতলার সরু বারান্দায় রেকিঙ ধরে দাঁড়িয়ে লোকজন ওদের দেখছে। দোতলায় উঠে ডানদিকে বারান্দার পাশে দরজার সামনে এসে সবাই দাঁড়ালো। ২টো ঘরের জন্যে পাশাপাশি দুটো দরজা। ১টি পরিবার এই ঘর ২টো ও সামনের বারান্দা ব্যবহারের অধিকারী। বারান্দা ধরে এগিয়ে গেলে হার্ডবোর্ডের পার্টিশন। এখান থেকে অন্য ১টি পরিবারের সীমানা শুরু হলো। ফের পাশাপাশি ২টো দরজা, শেষ দরজার পর একই রকম পার্টিশন, তবে ক্যানভাসের। ক্যানভাসের সঙ্গে লাগানো দরজা বন্ধ। খাকি ক্যানভাসে সাদা চকখড়িতে আঁকা ১টি ল্যান্ডস্কেপ। রোগা ১টি নদীর তীরে লম্বা তালগাছের মাথায় সূর্য। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত যে কোনো দৃশ্য হতে পারে। সূর্যের অনেকটা ওপর দিয়ে ৫/৬টা সাহসী পাখির ঝাঁক। দুঃসাহসী পাখিদের ওপর এবং নদীর নিচে চুন ও কানির দাগ এবং কয়েকটা বাঙলা ও ইংরেজি অক্ষর। স্পষ্ট ও গোটাগোটা ইংরেজি হরফে লেখা একটি নাম ওসমানের মাথায় খচখচ করে বেঁধে, নামটি এবং খচখচ ভাবটি তার মাথায়া দানা বাঁধে, তার চুল একটু খাড়া হয় এবং সে পড়ে, ‘রঞ্জু’। ওটা ওসমানের নিজেরই ডাকনাম। অস্পষ্ট একটি উদ্বেগ তার গলায় আটকে থাকে। তবে বেশিক্ষণ নয়। কারণ নতুন ঝামেলা মাথায় খামচাতে শুরু করে; যে লোক বাড়ির সামনে এতো বড়ো করে নিজের নাম লিখে রাখে সেই কিনা নিহত হয় পুলিসের হাতে!
বাড়িওয়ালা ডাকে, ‘রঞ্জু।’ ওসমানের বুকে এই ডাক ভুতুড়ে প্রতিধ্বনি তোলে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে সকালবেলার সেই ছেলেটি। ওর চোখের লাল চিকন রেখাগুলো সব একাকার হয়ে গেছে। নাকের ডগা তার ভিজে ভিজে এবং ঠোঁটজোড়া শুকনা ও বেগুনী। তাহলে রঞ্জু ও নিহত ব্যক্তি এক নয়, নিহত ব্যক্তির ছোট ভাই হলো রঞ্জু এবং রঞ্জু এখনো জীবিত—এই বুঝতে পেরে ওসমান আরাম পায়। এখন রঞ্জুর ভালো নাম জানতে ইচ্ছা করে। ও কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ে, কি খেলতে ভালোবাসে? কিন্তু এখন এসব জানবার উপায় নাই। তাই সে সোজা ঘরের ভেতর দেখতে শুরু করলো।
ঘরে কি?—দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে ২জন পুলিস। দারোগাকে দেখে তারা হাত তুলে স্যালুট করে। বড্ডো আঁটোসাঁটো ঘর, স্যালুট করতে গিয়ে ১জনের হাতের কনুই দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খায়, বেচারার স্যালুটরত হাতের পাতা একটু একটু কাঁপে। ঘরে আর কি?—তক্তপোষ এলোমেলো বিছানা। ২জন লোক সেখানে বসে ছিলো। এবার উঠে দাঁড়ালো। এদের ১জন, বয়স ৫০ এর ওপর, ৫৫ বোধ হয় হয়নি, তার পরনে সবুজ চেক লুঙ্গি, তার খয়েরি এণ্ডির চাদরের নিচে কোথাও কোথাও সাদা পাঞ্জাবির আভাস। এক পা তুলে ফের মেঝেতে রেখে সে বলে, ‘স্লামালেকুম। ওসি সায়েব ভালো আছেন?’
দারোগার মুখে থেকে বিড়বিড় ধ্বনি যা বেরোয় তা থেকে নানা ধরনের বাক্য গঠিত হতে পারে, যেমন, ‘আর ভাই থাকা!’ অথবা ‘আমাদের আবার ভালো!’ অথবা ‘আল্লা রেখেছে ভাই!’
রহমতউল্লা লোকটিকে জিগ্যেস করে, ‘রিয়াজউদ্দিন সায়েব, সব হইছে?’
রিয়াজউদ্দিনের জবাবের জন্যে কিছুমাত্র অপেক্ষা না করে রঞ্জুর ডান হাত ধরে রহমতউল্লা ভেতরের ঘরে ঢোকে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এই ঘরে ফিরে এসে বলে, ‘দারোগা সায়েব, আসতে পারেন। আসেন।’
‘কমপ্লিট? মুর্দাকে গোসল করানো হয়েছে?’ দারোগার প্রশ্নের জবাব দিয়ে রিয়াজউদ্দিন ফিসফিস করে মাত্র কয়েকটি শব্দ বলে। তারপর কন্যাকর্তার বিনয় ও আতিথ্য গলায় তুলে নিয়ে সবাইকে নেমন্তন্ন করে, ‘আসেন, আপনেরা আসেন!’
এই ঘরটি আবার বাঁশের বেড়া দিয়ে বিভক্ত। ঘরের এপারে মেঝেতে একটি মাদুরে কয়েকজন মেয়েমানুষ। নেকাব পর্যন্ত ঝোলানো বোরখাপরা ১ মহিলা কাঁদো কাঁদো গলায় কোরান শরীফ পড়ছে। জড়সড় হয়ে শুয়ে রয়েছে ১ মহিলা; ১ তরুণী তালপাতার পাখা এবং ১ প্রৌঢ়া গামছ দিয়ে তার মাথায় হাওয়া করছে। শুয়ে থাকা মহিলার গলা থেকে একটানা আওয়াজ বেরোয়। কখনো কখনো তার স্বর অস্পষ্ট হয়ে গেলে অনেক দূরে এবড়োথেবড়ো মাঠে গরুর গাড়ি চলার রেশ আসে। আরেকজন কিশোরীকে জড়িয়ে ধরে ১৬/১৭ বছরের ১টি মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। লোকজন ঢুকলে তার ফোঁপানি মৃদু হয়ে আসে। মাদুরের প্রান্তে ১ বছরের ১শিশু অঘোরে ঘুমায়। তার পরনের জাঙ্গিয়া পেচ্ছাবে ভিজে গেছে। শিশুর হাতের মুঠোয় ধরে রাখা ১টি চাবি। তার মুখের কাছে দুটো মাছি ওড়ে। শিশুটির পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছে হলুদ, সাদা ও খয়েরি ছোপ-লাগা বিবর্ণ সবুজ পর্দা।
দারোগার নেতৃত্বে সমবেত জনতা পর্দা অতিক্রম করে। এটাই ফাইনাল জায়গা, এরপর নিরেট দেওয়াল। গুলিবিদ্ধ নিহত যুবক ঠিক এখানেই অবস্থান করে। ওসমানের শরীরের রক্তপ্রবাহ তার করোটির ছাদে উদ্বন্ধন তোলে, তার চোখের ঘন খয়েরি রঙের মণি ও ভেতরকার রেটিনাসমূহ এখন খুব তৎপর। এমনি জিনিসপত্র দ্যাখার জন্যে চোখের এই বাড়াবাড়ি রকম তৎপরতার দরকার হয় না। একনিষ্ঠ মনোযোগী হলে ওসমান দ্যাখে যে, ছাদের ঠিক নিচেই গুলিবিদ্ধ ১টি যুবক দেওয়ালের সঙ্গে গাঁথা। যুবক অল্পবয়েসী, শরীরের চামড়া কাঁচা ও টাটকা। .৩০৩ রাইফেলের একটি গুলি তার বুককে গেঁথে রেখেছে দেওয়ালের সঙ্গে। মাথাটা বাঁ দিকে ঝুলছে। বুকের নিচে তার দীর্ঘ শরীর রেলিঙে মেলে দেওয়া শাড়ির মতো আস্তে আস্তে কাঁপে। শীতেও কাঁপতে পারে, বাতাসেও কাঁপতে পারে। যুবকের মুখ হাঁ করা, মনে হয় প্রচণ্ড ১টি চিৎকার সেখানে জমে রয়েছে; বলা যায় না, যে কোনো-সময় এই পুরনো দালান ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। কোটর থেকে ছিটকে-পড়া কালো মণিজোড়া বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রয়েছে, তারা যেন গোগ্রাসে সব দেখছে! তার কালো ২টো হাত ডানদিকে ও বামদিকে শক্ত ১ জোড়া রডের মতো ঝোলানো। সেই ২ হাতের প্রতিটির সঙ্গে গুলি দিয়ে গাঁথা আরো ২জন যুবক। যুবক ২জন যমজ, ২জনেই অল্পবয়সী, ২জনেরই চামড়া কাঁচা ও টাটকা। এদেরও একেক জোড়া চোখ বেরিয়ে এসেছে কোটরের ভেতর থেকে, বেরিয়ে-আসা মণিগুলো যেন পরিচিত ও অপরিচিত যাবতীয় দৃশ্য দ্যাখার জন্য অস্থির। ২জনেরই হাঁ করা মুখে সুপ্ত চিৎকার যে কোনো সময় বেরিয়ে ছাদ ফাটিয়ে ফেলতে পারে। তাদের ২জনের লোহার রডের মতো ২ জোড়া হাতে নিচের দিকে বাড়ানো। আবার দ্যাখো, রডের মতো সেই ২জোড়া হাতের সঙ্গে .৩০৩ রাইফেলের গুলি গাঁথা আরো ৪ জন যুবকের লাশ। কে বলবে এরা আলাদা লোক? অবিকল একরকম দেখতে ৪ জন যুবকের কোমরে থেকে নিচের দিক শীতে কি বাতাসে একটু একটু কাঁপে। গ্রোগ্রাসে সব কিছু দেখে নেওয়ার জন্য কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে ৪ জনের ৪জোড়া চোখের ৮টা মণি। একই রকম দেখতে ৪টে মুখে স্থগিত রয়েছে ৪টে দারুণ চিৎকার। এই ৪ জন আর আগের ৩ জন—মোট ৭ জনের চিৎকারে ঘরবাড়ি দালানকোঠা রাস্তাঘাট ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে না? এখানেই শেষ নয়। এই শেষ ৪ জনের লোহার রডের মতো হাতে গাঁথা রয়েছে গুলিবিদ্ধ আরো ৮ জনের মৃতদেহ। ঘরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এরা মেঝে ফুঁড়ে নিচে নেমেছে। নিচে-নেমে-যাওয়া গুলিবিদ্ধ মানুষের দীর্ঘ সিঁড়ির শেষ দেখবে বলে নিচের দিকে তাকালে ওসমানের চোখে পড়ে সাদা ও খয়েরি চুন-সুরকির মেঝেতে কালচে-নীল কালিতে ছড়ানো মানচিত্র, ছোপ ছোপ কালো দাগ, দেশলাইয়ের পোড়াকাঠি, দাঁত দিয়ে কামড়ানো পেন্সিলের টুকরা এবং ১ পাটি স্যাণ্ডেল ও ১ পাটি জুতো। বুলেট-সাঁটা মৃতদেহের সিঁড়ি দ্যাখার ভয় ও উদ্বেগ এক মুহূর্তে উবে যাওয়ায় ওসমানের শরীর একেবারে তলিয়ে পড়তে চায়। তার শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। ভাবে, যাই নিজের ঘরে গিয়ে আধ ঘণ্টা একটু শুয়ে থাকি। কিন্তু ঘর ভরা মানুষ। এদের এড়িয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার জো নাই; না, ফিরে কাজ নাই। সকাল বেলার দৈনন্দিন এ্যাসিডিটি বা বুলেট-বেঁধা মানুষ দ্যাখার জন্যে অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া যে-কোনো কারণে তার পেটের বাদিকটা ব্যাথায় চিনচিন করে ওঠে। ব্যথায় একটুখানি নুয়ে পড়লে চোখে পড়ে সামনের তক্তোপোষে ঢেউ খেলানো উঁচু-নিচু চাদর। তক্তপোষের চারদিকে সবাই দাঁড়াচ্ছে। একটু নেতৃস্থানীয়েরা দাঁড়ায় শিয়রের দিকে। এই রকম নিজ নিজ পজিশন ঠিক করছে, এমন সময় ঘরে ঢোকে আলাউদ্দিন। ৩০-এর ওপর বয়স, লোকটাকে ওসমান ভালো করে চেনে, বাড়িওয়ালা রহমতউল্লাহর ভাগ্নে সে, একবার ওসমানের কাছে এসেছিলো মামার হয়ে বাড়ি ভাড়া নিতে। এরপর এসেছে ‘মিথ্যা আগরতলা মামলায় অভিযুক্তদের সহায়তাকারী নাগরিক কমিটি’র চাঁদা নিতে। আলাউদ্দিনের পেছনে ঢুকলো হাড্ডি খিজির। আলাউদ্দিনের কয়েকটি রিকশা ও ২টি স্কুটারের দ্যাখাশোনা করার ভাগ খিরিজের ওপরে। এই লোকটি খুব লম্বা, তবে তার নামের আগে উপাধিটি অর্জন করেছে তার অস্থিসর্বস্ব দেহের জন্য। তার হাতে সবসময় স্ক্রু ড্রাইভার ও প্লায়ার থাকে। কিন্তু এখন ১ হাতে আগরবাতি ও অন্য হাতে ১টি ঠোঙা। সবাইকে ওভারটেক করে খিজির সামনে আসে এবং তক্তপোষের ৪দিকে এ-ফাঁকে ও-ফোকরে কয়েকটি করে আগরবাতির কাঠি গুঁজে দেয়। ‘বেটা আগে জ্বালাইয়া লইবি তো!’ বলে আলাউদ্দিন দেশলাই ঠুকে আগরবারিগুলো ধরিয়ে দিয়ে হাল্কা ছাই রঙের ধোঁয়া ও গন্ধে ঘরের শূন্যতা এবং প্রাণী ও অপ্রাণিবাচক সমস্ত বস্তু মৃতের প্রতি নিবেদিতচিত্ত হয়। দারোগার ইঙ্গিতে রহমতউল্লা ঢেউ খেলানো চাদর তুলে ধরলো। চাদরের নিচে সাদা কাফনে জড়ানো মৃতদেহের মুখের কাপড়টিও আস্তে করে ওঠানো হয়।