চার বৃদ্ধ
চার বৃদ্ধ রোজ বিকেলে পার্কের বেঞ্চে এসে পাশাপাশি বসতেন। সামনে একটা জলাশয়। চারপাশে বিশাল-বিশাল গাছ। গাছগুলিও প্রাচীন। শহরের বিচিত্র ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। বৃদ্ধদের ত্বকও কুঞ্চিত, কুঞ্চিত বৃক্ষের কাণ্ড। অনেক বয়েস হয়েছে সব। তবে মানুষ কখনওই গাছের বয়সকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। বৃদ্ধরা যেদিকে মুখ করে বসে আছেন, সেইদিকটি পশ্চিম। গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায়। সূর্য নামে পাটে। আকশে রক্ত ছড়াতে ছড়াতে। রক্তাভ আকাশ ক্রমে ম্লান হয়ে আসে। শেষ আলোয় আকাশের গায়ে ঘরে-ফেরা ক্লান্ত পাখির কালো ছায়া। সেই দিকে তাকিয়ে জনৈক বৃদ্ধ আক্ষেপের গলায় বলে উঠলেন, ‘যা:, দিন চলে গেল।’ বৃদ্ধদেব তহবিলে দিনের পুঁজি কমে আসে। একটা দিন যাওয়া মানে অনেক যাওয়া। সঙ্গে-সঙ্গে আর এক বৃদ্ধ বললেন, ‘রাত এলেই ভয় করে ভাই। সারা রাত জেগে বসে থাকা। সেই রিটায়ার করার পর থেকেই আমার ঘুম চলে গেছে। বালিশে মাথা রেখে পড়ে আছি তো পড়েই আছি। সারা সংসার ঘুমোচ্ছে। আমি একা জেগে। রাত আর যেন ভোর হতেই চায় না।’
‘কীসের এত চিন্তা?’ প্রশ্ন করলেন আর এক বৃদ্ধ।
‘ছেলে দুটো বেকার। এখনও মেয়েটার বিয়ে দিতে পারলুম না। বুড়িটাকে প্রায় পঙ্গু করে ফেলেছে বাতে। ওদিকে রেস্ত আর নেই বললেই হয়।’
‘আমার তো আবার সব থেকেও নেই। সব খুইয়ে ছেলেটাকে বিলেত ফিরিয়ে আনলুম, এখন তো দেখি আর চিনতেই পারে না। বড় কোম্পানির বড় চাকুরে। তার আলাদা ফ্ল্যাট। বিলিতি গাড়ি। বিদূষী স্ত্রী। কখনওসখনও এলে রাত কাটায় না। বলে সব সহ্য হয়, সহ্য হয় না তোমাদের বাথরুম। নরকেরই নামান্তর।’ বললেন আর এক বৃদ্ধ।
চতুর্থ বৃদ্ধ বুকভরা শ্বাস নিয়ে বললেন, ‘আমার অভিযোগ করার মতো কেউই আর নেই সংসারে। যে দিকে তাকাই শূন্যতা। পড়ে আছি একা। অসুবিধে নেই কিছু, কেবল রাতে যদি একটু শ্বাস নিতে পারতুম। যত রাত বাড়ে ততই বাড়ে হাঁপানি। সারারাত সামনে ঝুঁকে বসে থাকি। পৃথিবীতে এত কিছু হল, এই রোগটার কোনও ওষুধ বেরোল না।’
‘তুমি সমুদ্রের ধারের কোনও শহরে গিয়ে থাকো না। পুরী অথবা গোপালপুর।’ পরামর্শ দিলেন প্রথম বৃদ্ধ।
‘আমার রেস্তোয় আর এক-দেড় বছরের মতো বেঁচে থাকার পুঁজি আছে ভাই। এর মধ্যে যেতে পারি ভালো, নয়তো হরি কো সাথ হরি-মটর খানা।
জলাশয়ে ডুবে গেল দিনের শেষ আলোর আভাটুকু। গাছের আশ্রয়ে অজস্র পাখির উত্তেজিত কথোপকথন ক্ষীণ হয়ে আসছে। দিন এবার ঘুমোবে। প্রকৃতি খুঁজতে শুরু করেছে অন্ধকারের বিছানা। চার বৃদ্ধ উঠে পড়লেন। পার্কের বাইরে এসে ফুটপাথ ধরে চারজনে পাশাপাশি হেঁটে চলেছেন মন্থরগতিতে মাথা নিচু করে পা মেপে মেপে। তাঁদের ছেড়ে যাওয়া আসনে বসে পড়ল এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা। এই শহরে প্রেম এখন একটা খাতেই বইছে, বিবাহ-পূর্ব মানব-মানবীর প্রেম। সংসারের অন্য ক্ষেত্রে প্রেম আর তেমন নেই। স্বার্থের ডালকুত্তা প্রেমের পেলব শরীর চিবিয়ে চচ্চড়ি করে ফেলছে।
চার বৃদ্ধের এক বৃদ্ধ যাঁর কেউ কোথাও নেই তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিন বৃদ্ধ পার্কের বেঞ্চে বহুক্ষণ বসে রইলেন। বসে-বসে একজন সন্দেহ প্রকাশ করলেন, ‘ওর আবার কী হল! এমন তো কখনও হয় না। অসুখ-বিসুখ করল না তো!’
আর একজন বললেন, ‘অসম্ভব নয়। আমরা তো এখন ওয়েদার কক। এই ভালো, এই খারাপ। সকালে একরকম, বিকেলে একরকম।’ তিনজন উঠে পড়লেন আসন ছেড়ে। গুটিগুটি চললেন চতুর্থজনকে দেখতে। ঘিঞ্জি গলি। কলকাতার যেমন ছিরি! ভাগাভাগা ময়লার ঢিপি এ-পাশে ও-পাশে। স্যাঁতসেঁতে। বিশ্রী দুর্গন্ধ। বয়স যখন কম থাকে তখন মানুষ এসব গ্রাহ্য করে না। খাবার সময়ে এই ধরনের বিষণ্ণ গলি মনের ওপর বিশ্রি এক প্রভাব ফেলে। তিন বৃদ্ধ যেতে-যেতে দেখছিলেন ভাঙা রকে দুটি শিশু বসে আছে। একজনের কোলে একটা ন্যাকড়ার ভাল্লুক। আর একজনের হাতে কিছু নেই। সে একটু আগে কেঁদেছিল। চোখের কোলে জলের দাগ। ঘুপচি একটি ঘরের অন্ধকার জানলায়, এক বৃদ্ধার মুখ। এক সময় ফরসা, সুন্দরী ছিলেন। এখন বিবর্ণ, কৃশ। কিছুই দেখার নেই অথচ দেখছেন। পাশের ঘরে আলো জ্বলছে। এইসব গলিতে দিনের বেলাতেও আলো জ্বালাতে হয়। আলোর তলায় দেয়াল আয়না। স্বাস্থ্যবতী এক রমণী দু-হাত মাথার পিছন দিকে ঘুরিয়ে বিশাল খোঁপা ঠিক করছেন। পরনে বেশ চটকদার একটি শাড়ি। আঁচল খসে পড়ে গেছে। সাজসজ্জায় ব্যস্ত মহিলা খুশিতে গান গাইছেন আপন মনে। তিন বৃদ্ধের তিন জোড়া চোখ চলে গেল সেদিকে। তিনজনেই বুঝলেন মেয়েটির বেশি বয়সে সবে বিয়ে হয়েছে। লাল শাড়ি, এল খোঁপা। গুনগুন গান। একটা নায়িকা নায়িকা ভাব। পৃথিবীতে শুরুটা এইভাবেই হয়। জীবনের নেশায় মানুষের টলোটলো ধরোধরো অবস্থা। এক বৃদ্ধ আপনমনে গাইলেন—তোমার হল শুরু, আমার হল সারা। এক পলকের চলতে-চলতে দেখা। দৃশ্য সরে গেল। তিন বৃদ্ধের মনেই খেলে গেল অপরাধবোধ। ব্যাটা ঘাপটি মেরে এখনও তাহলে বসে আছে ভেতরে, বৃদ্ধের জরাজীর্ণ শরীরে। মনে হল, সেই চিরকালের প্রশ্নের জবাব বুঝি পাওয়া গেল—মানুষ কেন বাঁচে, মানুষ কেন আসে। নারী, সংসার, আয়না, আলো, চুল, খোঁপা, চিরুনি, লাল শাড়ি। একটু গান। গালগল্প। পান। রাঙা ঠোঁট।
তিন বৃদ্ধ যখন চতুর্থ বৃদ্ধের বাড়িতে গেলেন, ছোটখাটো একটি ভিড় জমে গেছে। চতুর্থ বৃদ্ধ ঘণ্টাখানেক আগেই চলে গেছেন বেড়াতে। যে বেড়ানো থেকে মানুষ আর ফেরে না। তিন বৃদ্ধ পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অপরাধীর মতো। একজন হঠাৎ বলে ফেললেন, ‘যা:, না বলেই চলে গেল।’
তিন বৃদ্ধ পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকেন। মাঝে একটা ফাঁক। রোজই এই ঘটনাটা ঘটে। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর খেয়াল হয়। তখন একজন বলেন, ‘আরে, কী আশ্চর্য! সরে-সরে বোসো। সে তো আর আসবে না।’ তিনজন তখন সেই ফাঁকটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বসে থাকেন। কিন্তু সরে গিয়ে ফাঁকটা ভরাট করার সাহস হয় না।
BORO SOTTI KOTHA. SE AR ASBE NA.