প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 6

চাবকে চাপকান

চাবকে চাপকান

একটা মুখ সরু ফুলদানিতে একতাড়া রজনীগন্ধার স্টিক গুঁজলে যে অবস্থা হয় আমার ঠিক সেই অবস্থা। নড়াচড়ার উপায় নেই। একেবারে ঠাস হয়ে আছি। বাস চলেছে গুড়গুড় করে। মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। হিটলারসায়েব এখনও বেঁচে আছেন। আমরা হলুম গিয়ে পোলিশ জু। আমাদের কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ওয়াগনে গাদাই করে। বাস চলেছে ওঠা-পড়া প্রেমের তুফানের মতো। রাস্তা হল নানা মাপের গর্তের মালা। তাঁরা বললেন, মানে যাঁরা আমাদের জাতির কাণ্ডারি, তল আর অতল এই নিয়েই তো পৃথিবী! দিন আর রাত এই তো বিধির বিধান। তাহলে তো ভগবানকেই বলতে হয়, আপনার করপোরেশানে একি অব্যবস্থা, রাতকে হোয়াইটওয়াশ করে সাদা করে দিন, আমাদের অসুবিধে হচ্ছে। একজন বললে, বেশি ট্যাঁফোঁ করলে, পৃথিবীর বাইরে বেয়ারিং পার্সেল করে দেওয়া হবে। হাতে খেঁটে লাঠি, মাথায় হেলমেট, নজরে পড়েছে? চাবকে চাপকান করে দেবে। দেশে এখন একবাদ, তার পাশে প্রতিবাদ থাকতে পারে না। বাদ মানে মাইনাস। সব বাদ। সব বরবাদ।

তাই আমরা আর কিছু বলি না। কোঁতকা বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিস। যদি প্রশ্ন করেন, ‘কেমন আছ?’

এক গাল হেসে বলব, ‘ফাশক্লাস!’

রজনীগন্ধা ভেবে বেশ আনন্দ পাই। পায়ের দিকটা হল স্টিক। ডবল স্টিক। মাথার দিকটা ফুল। চলন্ত ফুলদানি। হঠাৎ পাশের ভদ্রলোক বললেন, ‘মাঝে মাঝে অমন ডিঙি মেরে তেউড়ে উঠছেন কেন? হলটা কী! ইস্প্রিং খেয়ে বেরিয়েছেন না কী?’

এক জেনারেশান পরের কেউ হলে বলত, ‘বেশ করেছি।’ পৃথিবীতে একটা করে যুগ এসেছে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি। এযুগটা হল, ‘বেশ করেছি’ যুগ। আমি বিনীতভাবে বললুম, ‘আজ্ঞে আমার জুতোর মধ্যে কী একটা ঢুকেছে।’

‘তা ঢুকেছে তো বের করে দিন। তিড়িংবিড়িং করার কী আছে? আমরা ডিস্টার্বড হচ্ছি। সিভিক সেনস নেই!’

‘আজ্ঞে ভীষণ আছে। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে হাঁচি। আবার সরি বলি। পাবলিক প্লেসে হিসি করি না। ফিতে বাঁধা জুতো তো, তাই বেকায়দা হয়ে গেছি।’

ওপাশ থেকে একজন প্রশ্ন করলেন, ‘কি ঢুকেছে বলে মনে হয়? নরম, নরম?’

‘বুঝতে পারছি না, তবে কুরকুর করছে।’

‘কুরকুর! তার মানে লেঙটি ইঁদুর।’

সঙ্গে-সঙ্গে আর একজন বললেন, ‘তেঁতুলে বিছাও হতে পারে। রোল হয়ে বসে আছে।’

তিনি খেঁচুনি খেলেন, ‘জুতো কি রোল কাউন্টার? মটন রোল হয়ে বসে আছে? জাতটাকে রোলে পেয়েছে। ডেফিনিটলি ওটা কাঁকড়াবিছে। কাঁকড়াবিছে ডিস্কো ড্যানস করতে ভালোবাসে। ওদের ডেরাই হল জুতো। আপ্রাণ চেষ্টা করছে হুলটাকে রিলিজ করিয়ে ছপাং করে এক ছোবল মারার।

এক ভদ্রলোক খুব ঘনিষ্ট গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘পায়ের মাপ কত?’

‘ছয়।’

‘জুতোর মাপ নিশ্চয় সাত।’

‘ঠিক ধরেছেন।’

‘লিভার খারাপ, পায়ে কড়া আছে। ওই এক সাইজ বড়, তার মধ্যেই বসে আছে ঘাপটি মেরে। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে তো? ওটা বোরা সাপ। কয়েল করে থাকে।’

আমার সামনেই এক ভদ্রলোক বসেছিলেন। তাঁর দয়া হল। তিনি বললেন, ‘আমার জায়গায় বসে জিনিসটা রিলিজ করুন।’ সঙ্গে-সঙ্গে সবাই হাঁহাঁ করে উঠলেন, ‘সে কী, আমাদের লাইফ অ্যাট রিস্ক। বেরিয়েই অ্যাটাক করবে।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘মানবতার প্রশ্ন। ‘এঁকে কামড়ালে কী হবে? আপনি খুলুন। দেখা যাক মালটা কী?’

ফিতে খুলে জুতোটা ঠুকতেই একটা প্রমাণ মাপের আরশোলা সামনের সুন্দরী এক মহিলার কপালে গিয়ে বসল ফড়াং করে। আরশোলাদের মহিলাসক্তি প্রায় চরিত্রহীনতার পর্যায়ে পড়ে। ভদ্রমহিলা ভয়ঙ্কররকমের এক চিৎকার করে সামনে দাঁড়ানো এক যুবককে সপাটে জড়িয়ে ধরলেন। প্রাথমিক আতঙ্ক কেটে যাওয়ার পর ভদ্রমহিলা বললেন, ‘অসভ্য, ইতর। বাড়ি থেকে আরশোলা এনে মেয়েদের গায়ে ছাড়েন। অ্যান্টিসোস্যাল।’

সঙ্গে-সঙ্গে একজন ফোড়ন কাটলেন, ‘শুধু আরশোলা নয়, জুতোর আরশোলা।’

যুবকটি নেমে আমার কানে-কানে বললেন, ‘কালও একটা আরশোলা আনবেন। পরপর তিনদিন হলেই আমি টার্গেট রিচ করে যাব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *