চান্দ্রায়ণ – সুব্রত মুখোপাধ্যায়
সিঁড়ি ভেঙে গঙ্গার দিকে নামার মুখেই মেজাজটা টং করে বেড়ে উঠেছিল।
সবার আগে পুরোহিত। তার পিছনে পঞ্চানন প্রামাণিক। আর শেষকালে পার্বতী। পার্বতীর হাতে একটি কাঁসার হাতঘটি। জগন্নাথ সবার পিছনে পোঁটলা গুটলি এমনকী পাটকাঠির বাণ্ডিল সমেত বগলদাবা করে সামাল বেসামাল অবস্থায় আলগোছে সিঁড়ি ভাঙছিল। ঠিক তখনই সিঁড়ির ধারে সার দিয়ে বসা ভিখারির দল থেকে লোকটা উঠে এসে সামনে দাঁড়ায় পথ আগলে। প্রথমটা মুখের দিকে তাকাবার উপায় ছিল না, মনও না। কেননা স্কুলের প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে পাঁচশো আর হাতে আছে মেরে কেটে সাড়ে তিনশো। এই দিয়ে তিলকাঞ্চন, দ্বাদশ ব্রাহ্মণ ভোজন কোনওমতে হতে পারে। কিন্তু আত্মীয় কুটুম্ব আর ঘাটন্ধুদের নিয়ে মৎস্যমুখ? শ্বশুরবাড়ির পালেই তো নয় নয় করে আঠারোজন। ছিয়াত্তুরে শ্বশুর মশাই রিটায়ার্ড হেডমাস্টার। এখনও মাছের মুড়ো মাংসের হাড় গুঁড়িয়ে পাউডার করে ছেড়ে দেন। বড় শ্যালকটি তো বকরাক্ষস। পার্বতীকে বললে বলবে—আমাদের ছেলেপুলে নেই। তোমারও তো বাপ মা নেই। আমার বুড়ো বাপ মা তো আমাদের ছেলে মেয়ের মতন। কত আর ধসাবে তোমার। এই পর্যন্ত এসে জগন্নাথ চমকে ওঠে ডাক শুনে—বাবা।
বগলদাবা পাটকাঠির বাণ্ডিল থেকে কনুই টপকে গোটাকতক মাটিতে পড়ে যায়। কুশের গুছি দু-চার সিঁড়ি গড়িয়ে পড়ে। লোকটা আবার ডাকে—বাবা গো।
কামানো মাথায় সদ্য উঠি উঠি শাদা কুচি, তোবড়ানো ঝুলে গাল আর সুড়ঙ্গ চোখ। খালি গা, কোমরে ছেঁড়া লুঙ্গি। প্রসারিত কাঠি-হাতটি কি সত্যি অমন কাঁপছে? পায়ের বুড়ো আঙুলের রাগ ব্রহ্মতালুতে গিয়ে ধাক্কা মারে জগন্নাথের। তাকিয়ে দেখে লোকটার পায়ে দগদগে একজিমা—রসানি কাটছে, মাছি বসছে। জগন্নাথ ঝাঁঝি মেরে বলে—কি কি?
—দুটি চাল দেন বাবা। কদিন ভাত খাইনি।
ইচ্ছে করে নড়া ধরে সরিয়ে দেয়। লোকটা জাত শিকারি। কার কাছে কি পাওয়া যাবে সব রপ্ত করে বসে আছে। হাত ধরবার কথাটা মনে হতেই বুকটা ছাঁত করে ওঠে। মরবার দিন পনেরো আগে বাবার ইচ্ছে মতন চান্দ্রায়ণ-প্রায়শ্চিত্ত করানো হয়েছিল, হয় সারবে না হয় সারবে না এই বাসনায়। তিতিবিরক্ত জগন্নাথ মনে মনে বুঝি শেষেরটি কামনা করেছিল। স্কুল টিউশনি সামলে আর রাতের পর রাত জেগে সে একেবারে আলা। কিন্তু প্রায়শ্চিত্ত-সারা বাবা যেন নতুন করে জ্বলে উঠেছিল। বার্ধক্যজনিত নানা রোগের সঙ্গে একটি নতুন উপসর্গ এসে যোগ দিয়েছিল। সারা গায়ে দগদগে একজিমা আর বেডসোর বোঝাই যে পোড়া কাঠামোটি এতদিন প্রায় বিছানাতে মিশে ছিল সেই মানুষ আস্তে আস্তে উঠে বসল। কামানো মাথায় বিন বিন চুল গজাল। চিন চিন গলায় নাকি সুর ফুটল। দিবারাত্র কেবল খাবো খাবো। না দিলেই মুখ খারাপ, লুঙ্গি খুলে ফেলে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি। সে আমলের দারোগা তো, তাই পুরনো অভ্যাস যায়নি। দারোগার সামনে চোরের মতন—দাঁড়িয়ে জগন্নাথ আস্ফালন দেখত আর ভাবত বাবা একালের খিস্তি খেউড় কি ভাবে অনায়াসে রপ্ত করল। প্রায়ই ঘসটে ঘসটে ওদের শোবার ঘরে চলে যায়। প্রস্রাব পায়খানা করে রেখে আসে। সেদিন মাঝরাতে রান্নাঘরে কিসের শব্দে চমকে ওঠে জগন্নাথ। পার্বতীর পিছনে ছুটে গিয়ে দেখে দেয়াল ধরে কোনওমতে আধখানা উঠে দাঁড়িয়েছে বাবা। পরনের লুঙ্গি পায়ে নেমেছে। অন্ধকারে পোড়া কাঠামোর চোখ জ্বলছে। সুইচে হাত দিতে প্রেত ঝলসে ওঠে। জগন্নাথ দেখে উলঙ্গ ব্ৰহ্মদৈত্য ছন ছন প্রস্রাব করছে কালকের জন্য ঢেকে রাখা মাছের ঝোলে। কঙ্কালের বুকে লটকে থাকা যৎপরোনাস্তি মলিন যজ্ঞোপবীতটি গিয়ে মিশেছে জগন্নাথের জন্মগ্রহণের পিণ্ডপাকানো কুৎসিত উৎসমুখে। তিনি কিন্তু নির্বিকার। জগন্নাথ বাবার নড়া ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে বিছানায় এনে ফেলে। করোটির জোড়া চোখে অগ্নিবাণ ঝলসে ওঠে। বাবা সমানে খিস্তি আওড়ায়—শালা বাসটার্ড তোর মুখে মুতি, তোর—
লোকটার প্রসারিত হাত আর একটু এগিয়ে আসে। জগন্নাথ বলে, যাচ্ছি বাবার ঘাটকামানে। এখন তাহলে তোমাকে পিণ্ড দানের চাল থেকে দিতে হয়, কি বলল।
—তাই দেন না বাবা তেনার ভাগ কম পড়বে না।
জগন্নাথ মনে মনে বলে—কম পড়বে না। পেটে বলে দশ দিনের বিশ্ব খিদে। হেঁট হয়ে পাটকাঠি আর কুশের টুকরো গোছাতে গোছাতে জগন্নাথ নিচু স্বরে গজরায়—বাবা। হুঁঃ, ধম্মপুত্তুর এলেন আমার।
গভীর রাত্রে অথবা নির্জন দুপুরে প্রায়ই ঘুম চমকানো আর্তস্বর শুনে বিরক্তিতে জ্বলে উঠত জগন্নাথ। দারোগা বাপ মাঝে মাঝেই বাললীলা শুরু করত।—বাবা ও বাবা। আমার জগা বাবা কোথায় গেলি রে।
এ ঘর থেকে ধমক দিত জগন্নাথ—থামো থামো।
ও ঘরের অন্ধকার আর্তনাদ করুণতর হয়ে বাজত—ও বাবা, আমি যে বাহ্যে করে ফেলেছি বাপ।
পার্বতী গজরাত—ছেলের নামে ঘেন্না। উনি মরলে তবু যদি আমাদের কোনও কিছু একটা আসে।
চমকে ওঠে জগন্নাথ—সে কি!
পার্বতী শীর্ণ হাতে জগন্নাথকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে দমচাপা হাঁসফাঁস গলায় বলত—তার আসবার পথটা যে তোমার বাবা আগলে বসে আছেন।
জগন্নাথ মনে মনে বলত—প্রায়শ্চিত্ত তো করানো হল।
গঙ্গার দিকে মুখ করে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে জগন্নাথ। একটু দূরে চিবুকের কাছে দুখানি হাঁটু জড়ো করে পার্বতী। দশ দিনের আতেলা রুখু চুলের শীর্ণ গুছি বাতাসে খেলছে। শিরা জাগানো প্রায় চল্লিশ মুখে কয়দিনের হবিষ্যান্নজনিত উজ্জ্বল ক্লান্তি। বালিতে লুটানো কোরা শাড়ির আঁচলের আগায় একটি শুকনো বটপাতা জড়িয়ে আছে। অদুরে পঞ্চানন। বিড়ির ধোঁয়া মারছে। কার্তিকের দাগ নেই আকাশে। জলের কিনাবে ভেসে আসা প্রতিমার কাঠামোর পিঠে একজন উদাস বক—স্রোতের জলে বৃথাই নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজছে।
জগন্নাথ বসে বসে দেখছে পুরোহিত বেচু ভট্টাচার্যের কেরামতি। চৌকোনা গঙ্গামাটির বর্গক্ষেত্রের বুকে বুড়ো আঙুল টিপে টিপে গর্ত করা হয়েছে। তাতে কাঁচা দুধ ঢালা। দারোগা বাপের মৃত্যুকালীন উলটে আসা অগুনতি শাদা চোখ অপলকে জগন্নাথকে দেখছে। দারোগার খাঁই কম না। তাই বুঝি চোখ বলছে—খেতে দে বাপ, খেতে দে।
জগন্নাথ ধমক মারে—চোপ।
বাবার চোখ ভেঙচি কাটে—তবে তোর মাথা চিবিয়ে খাবো রে শালা।
কি আশ্চর্য, মরে কোথায় ভগবানের নাম করবে তা নয় খিস্তি! জগন্নাথ বলে—তাই খাও। খেয়ে আমায় বাঁচাও।
পুরোহিত বলেন—পঞ্চাননা।
পঞ্চানন বিড়ির মুখের আগুন আঙুলে টিপে উঠে আসে—আজ্ঞে।
—কুশগুলো সমান করে কেটে দে দিকি।
—দিচ্ছি। কিন্তু ঠাকুর মশাই আগুনটা একটু ছুড়ে দেবেন। আপনার ডাকে বিড়ি নিবে গেছে।
ভট্টাচার্য জ্বলে ওঠেন—মুখে আগুন।
জগন্নাথ দেখে রেগে আগুন ভট্টাচার্য মাটির সরার মুখে হেঁট হয়ে আতপ চাল থেকে একটি একটি করে সিদ্ধ চাল উৎখাত করছেন। বাবার গর্ত বোজাবার যোগাড়-যন্ত্র সারা হচ্ছে। মানবযোনির অন্ন-জল গিয়ে আছড়ে পড়বে প্রেতযোনির চৌকাঠে। কিলবিল প্রেতের পাল ঠেলে একটি মুখ তার ওপর থুবড়ে পড়বে। নেড়া মাথায় খোঁচা চুলের কুচি, খেউড় পোক্ত হাড়গিলে চোয়াল। বাস রাস্তায় তীব্র হর্নের শব্দে চমকে ওঠে জগন্নাথ। দেখে ভট্টাচার্যের লদলদে নাকের আগায় একটি দুধ-শাদা অন্ন বিন্দু জ্বলজ্বল করছে।
মাথায় পট করে একটি বটপাতা পড়তে ওপরে তাকায় জগন্নাথ। প্রাচীন গাছ। অসংখ্য ঝুরি নেমেছে যেখানে সেখানে। ওইদিকে একটি ঝুরি মাটি পেয়ে আস্তে আস্তে গাছ হতে চলেছে। যেদিন মূল গাছ থাকবে না সেদিন ওই ঝুরির গাছ হওয়া সার হবে। সেই দিন সে মাথার ওপর খোলা আকাশ দেখবে।
পুরোহিত গর্জে ওঠেন—আকাশস্থ বায়ুভূত নিরালম্ব নিরাশ্রয়…
গঙ্গার প্রশস্ত আকাশে মেঘ নেই কোথাও। জলের বুকে খেয়া নৌকায় যাত্রী পার হচ্ছে। এদিকে বাবা বৈতরণী পার হচ্ছেন মন্ত্রের ঠেলায় ঠেলায়। আকাশের কোনাকুনি একটি এরোপ্লেন উড়ে গেল। কত মানুষ ভেসে গেল আকাশপথে—একটি অবলম্বন সম্বল করে। বাবাও তো ভেসে চলেছেন, কিন্তু নাকি নিরালম্ব অবস্থায়। এই মহাজাগতিক আকাশ থেকে বুঝি তারও কোনও মহা আকাশে তাঁর নিরুদ্দেশ যাত্রা। তিনি মিশে আছেন এই মহাজগতের বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে। অশরীবী বায়ুম শরীর। মন্ত্রের সঙ্গে বেদিতে পিণ্ড পড়ছে, ছাতিফাটা তৃষ্ণায় হা-মুখে কুশের জল পড়ছে। ভট্টাচার্য বলেন— চোখ বুজে বাবার চরণ ধ্যান করো জগন্নাথ। বলো আপনি এই অন্নজল গ্রহণ করুন।
মনে মনে অঙ্কটা মাইনাস হয়ে যায় তখনই। ঘাটখরচ সব মিলিয়ে টেনে টুনে প্রায় দেড়শো টাকা। হাতে থাকল—নাঃ মৎস্যমুখে কেবল শশুরশাশুড়ি। আর সব বাদ। পঞ্চানন হাত পাথরে ক্ষুর শান দিতে বসেছে। জলের ছলাত ছল ছাপিয়ে শব্দ উঠছে খ্যাঁস খ্যাঁস । এক সাঁতারু ছেলে জল কেটে সাঁতরে চলেছে, কেবল মাথাটি জেগে আছে। সত্যি তো, জলও তবলম্বন। কিন্তু আকাশে তো সবই ফাঁকা। বাবা আবার আকাশ থেকে খসে পড়বেন না তো। পড়লেই বা মন্দ কি। পার্বতী তো তাই চায়। বাবার ফেলে যাওয়া তক্তপোশের হবু দখলদার এসে দাঁড়ালে তো বেশ হয়। প্রাচীন বটগাছের ঝুরি মাটি কামড়ে ধরবে। ঝুরি গাছ হবে। বাঃ। পুরোহিত আবার ধমক মারেন—কি হল, বাবার চরণ ধ্যান করো।
গঙ্গার বালিয়াড়ি ভেঙে একজোড়া শীর্ণ চরণ গুটি গুটি বেদির দিকে এগিয়ে আসছে। হাঁটুর কাছে বেসামাল লুঙ্গি। ফাটাচোরা পায়ে দগদগে একজিমা। পা এগোয়, পিছনের ভিজে বালিতে পদচিহ্ন এঁকে রেখে আসে। জগন্নাথ চোখ বুজে বাবার পা জোড়া মনে মনে ধ্যান করবার কসরত করতে থাকে।
মুণ্ডিতমস্তক জগন্নাথ ভুসভুস ডুব দেয়। অশৌচান্ত অবগাহন। পুরোহিত পাওনা বুঝে বিদায় নিয়েছেন। পঞ্চানন অপেক্ষা করছে সিঁড়িতে। জগন্নাথের ভিজে কাপড়টি যে তার প্রাপ্য। পার্বতী সিড়ির মাথায় ভিজে চুল ঝাড়ছে।
পরিত্যক্ত পিণ্ডবেদির দিকে চোখ পড়তে পরবর্তী ডুবের জন্য কানে-আঙুল জগন্নাথ স্থির হয়ে যায়। কান থেকে নেমে আসে হাত। বুকের মাঝখানে জড়ো হয়। নেড়া মাথায় খোঁচা চুলের কুচি, পাঁজরাসার আখাম্বা আড়া হুমড়ি খেয়ে পড়েছে প্রেত বেদির কাছে। কোমর থেকে লুঙ্গি খসে পড়েছে। কোথা থেকে যেন ওই প্রতিমার কাঠামোটি গঙ্গার পাড়ে এসে ঠেকেছে জোয়ার ভাঁটায়।
সে একটিবার মাত্র অন্যমনস্ক মুখ ফেরায়। জগন্নাথ দেখতে পায় সে চোখে অগ্নিবাণ নেই। তার বদলে একজোড়া ক্ষুধার্ত শঙ্কিত অথচ স্নিগ্ধ প্রদীপ জ্বলে উঠেছে। আকাশ থেকে কোমল স্নেহের আলো নেমে এসে ছুঁয়ে দিয়েছে মাটি, স্পর্শ করেছে জগন্নাথের আবক্ষ জলে ডোবা শরীর। অতি যত্নে সে তার হাতের ঝুলিতে পিণ্ডগুলি তুলে নিচ্ছে। মাটি থেকে তুলে নিচ্ছে একটি মাত্র দানা, বৈতরণী পারের কড়ি।
জগন্নাথ মুহুর্মুহু ডুব দেয় গঙ্গার জলে।
১৩ জানুয়ারি ১৯৮৯