1 of 2

চাঁদের আলোয় তাজমহল দেখা – আশাপূর্ণা দেবী

চাঁদের আলোয় তাজমহল দেখা – আশাপূর্ণা দেবী

আগ্রা স্টেশনে নেমেই ঘনরামবাবু এদিক—ওদিক তাকিয়ে দূরে বসে থাকা একটা টাঙাওয়ালাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।

সাঁটু তো হাঁ।

এ কী মামা! এতো ট্যাক্সি থাকতে ওই বিচ্ছিরি গাড়িটাকে ডাকছ কেন?

ঘনরামবাবু ভাগ্নের দিকে একটু ঘনগভীর দৃষ্টি ফেলে বললেন, আগ্রায় এসে ট্যাক্সি? কেন? কলকাতায় ট্যাক্সি চড়ার অভাব আছে? গাড়িটা বিচ্ছিরি হল কিসে?

সাঁটু হাত ওলটালো, কিসে নয়? বডিটা ভাঙা ঝরঝরে, ঘোড়াটা মড়াখেকো, ঘোড়ার সাজগুলো ‘ভাঙা লোহা বিক্কিরিও’ ছোঁবে না, আর টাঙাওয়ালার গায়ে চিড়িয়াখানার বাঘের খাঁচার গন্ধ।

সাঁটুর কথা মিথ্যে নয়, টাঙাটা এসে পৌঁছবার আগেই টাঙাওয়ালার গন্ধ এসে পৌঁছে গেছে। ভাগ্যিস সাঁটুর পকেটে সেন্ট লাগানো রুমাল ছিল! তাই না খানিকটা রক্ষে পেল সাঁটু। রুমাল চাপা নাকে সাঁটু বলল, মামা, মনে হচ্ছে ওর গাড়ি ঘোড়া সাজসজ্জা সবকিছু সাজাহানের আমলের। জানি না, মানুষটাও তাই কিনা?

ঘনরামবাবু তাতে উৎসাহ বাড়ে বই কমে না। ঠিক! ঠিক এই দেখেই আমি ওকে চয়েস করলাম। হিস্টোরিক্যাল স্পট দেখতে হলে, তার অ্যাটমোসফিয়ারটাও পাওয়া দরকার। যতটা পাওয়া যায়। নে উঠে পড়।

উঠে পড়া ছাড়া গতিই বা কী? ইত্যবসরে টাঙাওয়ালা মামা—ভাগ্নের মালপত্র সব টাঙাজাত করে ফেলেছে। চেহারাটা তার নিজের ঘোড়ার মতোই মড়াখেকো হলেও গায়ে বিলক্ষণ জোর আছে। চটপট তুলে ফেলল সব।

অগত্যাই উঠে পড়ে সাঁটু বলে, ‘একঠো আচ্ছা বলা হোটল মে লে যাও গাড়োয়ান।’

সাঁটুদের ইস্কুলে হিন্দি ‘অবশ্যপাঠ্য’, অতএব ‘আচ্ছা বালা টালা’ বেশ শিখে ফেলেছে সাঁটু।

কিন্তু সাঁটু তার মামাকে এখনো পড়েশুনে শিখে ফেলতে পারে নি। ধারণাই করতে পারে নি মামা আরও উচ্চাঙ্গের হিন্দিতে বলে উঠবেন, হোটেল? আচ্ছাবালা? আ, ছি ছি! তাজমহল দেখনেসে আয়েগা হোটেল? নেহি নেহি টাঙাওয়ালা, তুম একঠো বহোৎ পুরানা বালা ধরমশালামে লে কে চলো। বহোৎ পুরানা! সমঝা?

জী!

টাঙাওয়ালা ছপাৎ করে ঘোড়ার পিঠে ছপটি লাগায়। ঘোড়া তড়বড়িয়ে ছুটতে শুরু করে।

সাঁটুর মনে হয় এক্ষুনি উলটে—পালটে তালগোল পাকিয়ে দুই মামা—ভাগ্নের আগ্রার মাটিতেই সমাধি রচিত হবে। কী সাংঘাতিক ঝাঁকুনি। হাড়গোড় গুঁড়ো হয়ে গেল।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর মামা যখন বলেছিল, ‘এখন তো লম্বা ছুটি, আর আমার অফিস থেকে চিরছুটি হয়ে গেল, চল কোথাও বেড়িয়ে—টেরিয়ে আসি।’ তখত আহ্লাদে প্রাণ নেচে উঠেছিল সাঁটুর। আহা, মামা না দেবতা। মামার মুখে তখন সাঁটু দিব্যজ্যোতি দেখতে পেয়েছিল, মাথার পিছনে আলোর চাকতি।

তা ছাড়া, সবে রিটায়ার করে অফিস থেকে টাকার বান্ডিল নিয়ে বেরিয়েছে মামা।

সেটাও রোমাঞ্চকর।

শুনে অবধি মনে মনে সাঁটু ফার্স্ট ক্লাস ট্রেনের কামরার গদি আঁটা সিটে বসে হিল্লি—দিল্লি ঘুরেছে, ভালো ভালো হোটেলের ঘরে থেকেছে, ট্যাক্সি চেপে শত শত মাইল পাড়ি দিয়েছে আর দিন গুনেছে। কিন্তু হাওড়া স্টেশনে এসে দেখল, মামা কুলিদের হাঁ—হাঁ করে বলছেন, ‘নেহি নেহি। ফাস্টো কিলাস মে নেই হ্যায়।’

অনেক যুদ্ধ করে অবশেষে একটা থার্ডক্লাস কামরায় বসে পড়ে ঘনরাম তাঁর ভাগনে সীতারামের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললেন, ‘থার্ডক্লাস রেলে না—চড়লে বেড়ানোটা ঠিক এনজয় করা যায় না বুঝলি? স্টেশনে স্টেশনে ভাঁড়ের চা খাবো, খোসা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে চিনেবাদাম খাবো, কৌটো খুলে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা লুচি আলুচচ্চড়ি খাবো, তবে না বেড়ানো। …স্টুডেন্ট লাইফে এরকম কত বেড়িয়েছি। কিন্তু এই তাজমহলটি দেখা হয়নি। মামা—ভাগ্নেতেই দেখা যাবে। ‘প্রাতে তু ষোড়শ বর্ষে ভাগ্নে মিত্র বদ সম।’

কী আর করবে সাঁটু? জিজ্ঞেস করতেও সাহস হল না ‘বদ সম’ মানে কী মামা?

তবু ভরসা ছিল রেলগাড়ির ‘থার্ডক্লাস’ও এনজয়টা করে নিয়ে মামা পরবর্তী ভারটা সাঁটুর ইচ্ছের ওপরেই ছেড়ে দেবেন। হায় ভগবান!

শুধু ধর্মশালা নয়, আবার ‘বহোৎ পুরানা’ ধরমশালা!

হাড়গোড়গুলো নাচতে নাচতে এক সময় যখন নাচেতেই রপ্ত করে ফেলেছে, তখন সাঁটু বেজার মুখে বলে উঠল, মামা, পুরোনো ধর্মশালা কেন?’

কেন?

ঘনরাম উদ্দীপ্ত হয়ে বলেন, ‘কেন তা বুঝতে পারলি না? ভ্যাপসা ভ্যাপসা পুরোনো পুরোনো বাড়ির আবহাওয়াটা আমাদেরকে ঐতিহাসিক কালের মধ্যে নিয়ে যাবে। মনে হবে যেন নূরজাহানের কালেই রয়ে গেছি। আমরা যখন তিন বন্ধুতে বৃন্দাবনে গেছিলাম—’

‘মামা, নূরজাহান কেন?’

ঘনরাম ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘নূরজাহান কেন কী রে? যাঁর জন্যে তাজমহল, তাঁকেই মনে পড়ছে না?’

সাঁটুর মেজাজ খারাপ তাই হেসে ফেলে না, বেজার মুখেই বলে, ‘তাজমহল বানানো হয়েছে নূরজাহানের জন্যে নয়, মমতাজ বেগমের জন্যে।’

ঘনরাম বিচলিত হন না, অগ্রাহ্যভরে বলেন, ‘ও একই কথা? যার নাম ভাজা চাল, তার নামই মুড়ি।’ …এই টাঙাওলা, কিধারসে লে যাচ্ছো ভাই? এৎনা ঘুমতে ঘুমতে—

টাঙাওয়ালা আবার ঘোড়ার গায়ে ছপটি লাগায়। আবার ঝাঁকুনির চোটে তোলপাড়। তার মধ্যেই টাঙাওয়ালা হড়বড়িয়ে যা বলে তা থেকে আন্দাজে বোঝা যায়, পুরোনো জায়গায় যেতে হলে গলি ঘুঁজি তো ঘুরতেই হবে। ঘনরাম যা চান তাই জুটিয়ে দেবে।

ক্রমশই বোঝা যায় লোকটা সত্যভাষী! ঘনরাম যা চেয়েছিলেন তাই পাইয়ে দিল সে। গলির পর গলি, তারপর গলি! দিনে বাতি নিয়ে পথ হাঁটতে হয়। এই রকম বিদঘুটে বিদঘুটে সব গলি পার হয়ে টাঙাওয়ালা একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ময়লা ন্যাকড়া দিয়ে গলার ঘাম মুছতে মুছতে জানাল, গাড়ি আর ভিতরে ঢুকবে না, থোড়া হেঁটে যেতে হবে।

ঘনরাম নিজে নেমে পড়ে বললেন, সাঁটু নাম।

সাঁটু ভয়ে ভয়ে মামার পাঁজর চেপে ধরে বলে, মামা, এর মধ্যে থাকতে হবে?

ঘনরাম উল্লাসিত গলায় বলেন, এই তো মার্ভেলাস জায়গা রে! লোকটাকে বকশিস করতে হবে। কী রকম একখানা আবিষ্কার! মনে হচ্ছে পাঁচশো বছর পিছনে চলে গেছি। কেমন একখানা ভ্যাপসা ভ্যাপসা স্যাঁতা স্যাঁতা গন্ধ, কেমন জরাজীর্ণ সব দেওয়াল। বাড়িগুলোর দরজা—জানালা দেখেছিস? যেন ঐতিহাসিক চিত্র দেখেছিস! আধুনিক সভ্যতার কোনো ছোঁওয়াচ পায় নি। নাঃ, বাস্তবিক একটা জায়গা বটে। তোদের সত্যজিৎ রায় এ—রকম জায়গার সন্ধান পেলে লুফে নেবে।

কিন্তু সাঁটু কি সত্যজিৎ রায়?

আশ্চর্য, এ—রকম জায়গায়ও জায়গার অভাব।

ঘর খালি নেই।

অন্ধকার একটা প্যাসেজ পার হয়ে একখানা চৌকো উঠোন মতো জায়গায় পড়ে দেখা গেল, সেটাকে ঘিরে চারিদিকেই দোতলা ঘরের সারি, এবং সেই চৌকোটুকুর মাথায় যেখান থেকে আকাশটা এই ঘুটঘুটে বাড়িটার দিকে একটু উঁকি মারতে পারে, সেইখানটায় তারের জাল চাপা। বোধ হয় বাঁদরের প্রবেশাধিকার রোধ করতে। তা সেটা হয়তো রোধ হয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে আকাশের চোখ ফেলাও রোধ হয়েছে। কারণ তারের জালের উপর অনন্তকালের ঝড়ে উড়ে এসে পড়া শুকনো পাতা, ময়লা কাগজের টুকরো, ছেড়া চুলের নুটি এবং তাদের সঙ্গে লম্বা হয়ে নেমে আসা দড়া দড়া ঝুল, প্রায় ঢালাই ছাদের কাজ করছে। অবধারিত যে বৃষ্টি পড়লে এ উঠানে জল পড়ে না।

* * *

ঘেরা দাওয়ার ওপর যে সারি সারি ঘর, তার প্রত্যেকটির দরজায় একটি করে সিঁদুর মাখা গণেশের ছাঁচ তোলা। ধর্মশালার প্রতিষ্ঠাতা নিশ্চয়ই গাণপত্য ছিলেন।

কিন্তু একী দরজা রে বাবা!

লম্বা লোক তো দূরের কথা, নিতান্ত বেঁটে লোককেও মাথা নীচু করে ঘাড় হেঁট করে ঢুকতে হবে। … আর তার প্রস্থ?

মনে মনে হেসে ফেলে সাঁটু।

এখানের বিশাল ভুঁড়িদার সব লোকেরা কী করে ঢোকে? কোনো দরজাটাই তো দু—ফুটের বেশি চওড়া নয়। অথচ ঘরগুলো সবই মানুষে ভরতি এবং বিশাল ভুঁড়িদার মানুষেই।

ধর্মশালার কেয়ারটেকার ঘনরামকে আর সাঁটুকে নিয়ে দরজায় দরজায় উঁকি মেরে মেরে খোঁজ নিতে থাকে কোনো ঘর খালি আছে কিনা, কিন্তু নেই, নেই। এই অন্ধকূপ মার্কা ঘরগুলোও জমজমাট। ঘরের মেঝেয় ছড়ানো চকচকে করে মাজা পেতলের ঘটি কাঁসি থালা গামলাদের নিজস্ব আলোতেই বোঝা যাচ্ছে এর মধ্যে ঘর গেরস্থালি বসে গেছে।

জিজ্ঞেস করতে করতে একটি মহিলা একটা হাত হাতে নিয়ে দরজার কাছে সরে এসে খিঁচিয়ে উঠে বললেন, কিঁ ওঁ?

টাঙাওয়ালার ঘাড়ে বিছানা, হাতে সুটকেস, সেই অবস্থাতেই কাতর গলায় বলল, ‘রুম হ্যায়?’

রুম?

মহিলা চোখ ছানাবড়া করে অদ্ভুত কৌশলে পাশ ফিরে দু—মণী ভুঁড়িটাকে কেৎরে বার করে নিয়ে সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন, রুম!!

চোখ বিস্ফারিত, আঁচল বিদলিত।

সাঁটু কাতর বচনে চুপি চুপি বলে, মামাগো এখান থেকে বেরিয়ে চলো। এখানে কখনো থাকা যায়?

ঘনরাম তখন মহানন্দে অট্টালিকাটির প্রাচীনত্ব নিরীক্ষণ করছেন চারিদিক তাকিয়ে তাকিয়ে।

আহা! নির্ঘাত বাবরের আমলের বাড়ি।

দেয়ালে দেয়ালে কী চমৎকার ভূষো পড়া পড়া কুলুঙ্গী! যেন শত শত বছর ধরেত ওর মধ্যে প্রদীপ বসিয়ে বসিয়ে রেখে জ্বালা হয়েছে। পাথুরে ইটের দেওয়াল, কিন্তু কী পাতলা পাতলা ইট। এত পাতলা পাথুরে ইটের চলন ছিল কোন যুগে? —ভাবছেন ঘনরাম।

ভাগ্নের কথায় চমকে উঠে বলেন, ‘বলিস কী? এমন একখানা জায়গা আবিষ্কার করে তাকে ত্যাগ করে চলে যাব? পাগল না খ্যাপা! এ বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস! বাতাসে বাতাসে হারিয়ে যাওয়া—’

‘মামা, বাতাস কোথায়?’

‘ওই হল বাবা! সব কথায় তোর ইয়ে। … মেনেজার দাদা, একঠো কামরা হামকো জরুর দে দেগা ভাই! আপকো খৈনি খানেকো কিছু দিয়ে দেব।’

‘কেয়া বোলতা?’

ম্যানেজার অথবা কেয়ারটেকার রেগে বলে ওঠে, ‘ই ধরমশালা হ্যায় জনতা নেই?’

টাঙাওয়ালা ক্রমশ অধৈর্য হয়, হড়বড় করে কী সব বলে, ম্যানেজারের সঙ্গে কী যেন রফা হয়, তারপর বলে, ‘চলিয়ে।’

এবার ওই সারিরই একটা কোণের দিকের খালি ঘরে নিয়ে যায়, মালপত্তর নিয়ে ঢুকিয়ে ফেলে সেই ঘরের মধ্যে। অবশ্য তাকে যদি ‘ঘর’ বলা হয়। জানালা বলে কোনো বস্তু নেই, পিছনে দেওয়ালে শুধু গোটাকয়েক ঘুলঘুলি। সামনের দুফুট বাই সাড়ে তিন ফুট দরজাটি বন্ধ করলে শুধু ওই ক—টিই ভরসা।

মেজেটা যে একদা কিসের ছিল জানবার উপায় নেই, বোধ হয় পাথরেরই তবে সবটাই ক্ষতবিক্ষত।

টাঙাওয়ালা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

কথাবার্তায় বোঝা গেল এই ঘরটুকুই মাত্র খালি আছে, ম্যানেজারের নিজের। নেহাতই সাঁটু কোম্পানির বিপদগ্রস্ত অবস্থা দেখে এঁরা দয়া করে—

ঘনরাম বিশুদ্ধ হিন্দিতে বললেন, চমৎকার, চমৎকার। আমরা দুজনই তেমন লম্বা নই, একটু পা গুটিয়ে শুলেই যাবে। কী বলিস সাঁটু? তবে অ্যাডভেঞ্চারটা তো জব্বর হবে।

সাঁটু এর উত্তরে বলে, ‘মামা, কিছু খাওয়া—দাওয়া হবে?’

‘খাওয়া!’

ঘনরাম চমকে ওঠেন, ‘এখন খাওয়া কীরে? আগে তাজমহল দেখে আসি।’

‘এখন? এই বেলা বারোটার সময় তুমি তাজমহল দেখবে?’

ঘনরাম বললেন, আরে বাবা, একী দেখার মতো দেখা? যাকে বলে ‘ঝাকি দর্শন!’ যেমন পুরী গিয়ে ধুলো পায়ে জগন্নাথ দর্শন করতে হয়। ওহে টাঙাওলা, ‘ফিন হামকোদের লে চলো বাবা। আভি তাজমহল দেখেগা।’

‘আভি? আভি তাজমহল দেখেগা।’

লোকটা ভাঙা গলায় হো—হো করে হেসে ওঠে।

ঘনরাম কিন্তু দমেন না, আত্মস্থ গলায় বলেন, ‘আরে বাবা, তাজ কো তো বহোৎ দফা দেখনে হোগা। দিনে ভি রাতে ভি, সানলাইটে ভি। চলিয়ে চলিয়ে।’

ঘনরাম পকেট থেকে একটা তালাচাবি বার করে দরজাটায় লাগাতে গিয়ে দেখেন, দরজায় কড়াও নেই শেকলও নেই। তাহলে?

তাহলে আর কী? চেপে ভেজিয়ে রেখে চলে যাওয়া ছাড়া কী করার আছে?

সাঁটু চুপি চুপি বলে মামা, টাকাগুলো সুটকেস থেকে বার করে সঙ্গে নিলে হত না?

ঘনরাম আরও চুপিচুপি বলেন, এমন নইলে বুদ্ধি। টাঙাওয়ালাটা প্যাঁটপেঁটিয়ে তাকিয়ে আছে না? বার করে নিয়ে ওর টাঙায় গিয়ে উঠি, আর ও খানিকদূর গিয়ে ছোরা বসিয়ে কেড়েফেড়ে নিক!

শুনে সাঁটুর বুকের মধ্যে গুর গুর করতে থাকে, সাঁটুর মাথা ঝিমঝিম করে। সাঁটু একলা কলকাতায় ফিরে যাবে সাঁটুর আর মামার সঙ্গে ভ্রমণে দরকার নেই।

* * *

আবার সেই গলির গোলকধাঁধা।

আবার সেই ডাইনে আর বাঁয়ে—বাঁয়ে আর ডাইনে। কোনো কোনোখানে টাঙার দু—পাশ দু—ধারের বাড়ির গায়ে ঘষটে গিয়ে এমন ঝনঝন ঝড়াং শব্দ হচ্ছে যে প্রাণের মধ্যে হাঁকপাক করে উঠছে সাঁটুর।

* * *

অবশেষে বড়ো রাস্তায় পড়া গেল।

তারপর কত কত রাস্তা ঘুরুনি খেয়ে তাজমহল।

কিন্তু এখন কে পাবে ঢুকতে? এই দুপুর রোদ্দুরে? গেট বন্ধ। খোলা হবে বেলা চারটেয়।

মামা, ততক্ষণের মধ্যে তো আমাদের খেয়ে নিলে হত! পেটের মধ্যে যে ইঞ্জিন চলছে। কাতর ক্রন্দন সাঁটুর।

ঘনরামের এতক্ষণে চমক ভাঙে। বলেন, ও হ্যাঁ, তাই ভালো। কিন্তু চান—টান না করে—

চান কোথায় করবে?

ঘনরাম বলে ওঠেন, কেন ধর্মশালায়? সেখানেই তো তেল সাবান তোয়ালে সব। এই টাঙাওয়ালা ভাই—

সাঁটু এবার আর পারে না, রেগে উঠতে গিয়ে প্রায় কেঁদেই ফেলে। মামা! আবার সেখানে? আমায় কলকাতা যাবার রেলে চাপিয়ে দাও। আর বেড়াতে চাই না।

কেন? কেন? কী হল?

ঘনরাম অনুতপ্ত অথচ ছেলেভোলানো গলায় বললেন, সেরেছে। খুব খিদে পেয়ে গেছে তাই না? তবে বাবা চল, শুধু হাত—মুখ ধুয়েই কোনো হোটেল থেকে খেয়ে নিই। সে—রকম জল পাওয়া যাবে বোধ হয়? অ্যাঁ?

* * *

কিন্তু টাঙাওয়ালা আর এক পাও যেতে নারাজ। চেঁচামেচি করে যা বলে তার অর্থ, এ—রকম বোকা সওয়ারি সে জীবনে দেখে নি। ইচ্ছে করে পচা পুরোনো ধর্মশালায় গিয়ে ওঠে, চান খাওয়া না করেই আবার বেরোয়, ফের আবার গাড়ি চড়াতে বলে। ওঃ, পাগল না কি? তাকে নগদ পঞ্চাশটি টাকা গুনে দেওয়া হোক, সে চলে যাবে।

পঞ্চাশ টাকা!

ঘনরাম রেগে কাঁই। মগের মুলুক পায়েগা? পঞ্চাশ রুপেয়া খোলামকুচি হ্যায়?

কিন্তু কতটুকু চেঁচামেচিই বা ঘনরাম করতে পারেন? কতই বা দম তাঁর?

রোগা হাড়গিলে টাঙাওয়ালাটি মস্তানদের ফাংশানের ‘ওপনিং সঙের মাইক’—এর ভূমিকা নেয়, এবং পুরো পঞ্চাশটি টাকা নিয়ে তবে ছাড়ে। তবু ঘনরাম তাকে খোসামোদ করেন একটা ‘খানেবালা’ হোটেলে নিয়ে যাবার জন্যে। না হয় তাকেও খাইয়ে দেবেন।

অগত্যাই গজগজ করতে করতে আবার গাড়িয়ে ওঠে সে। মামা—ভাগ্নেও। আর উঠে বসেই আসল সমস্যা ফাঁস করে বসেন ঘনরাম। তুই তো এক মস্ত ফ্যাসাদ বাধালি সেঁটো! এখন কী হয়?

আমি? আমি আবার কী ফ্যাসাদ বাধালাম?

সাঁটু উত্তেজিত।

আহা, তুইই তো চান করতে ধর্মশালায় ফিরতে চাইলি না। অথচ টাকাপত্তর সেখানে পড়ে। পকেটে যা ছিল সব তো টাঙাওয়ালা ব্যাটা সব ফরসা করে দিল।

তার মানে পেটও ফরসা রাখতে হবে।

শুনে সাঁটুর ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে হয়। চোখ দিয়ে প্রায় জল গড়িয়ে পড়ে।

ঘনরাম বলেন, আহা, থাক, থাক, হচ্ছে। তা তোর কাছে কিছু আছে—টাছে? পরে দিয়ে দেব বাবা, থাকে তো দে! নাকি সেও সুটকেসে?

এ কথা শুনেও সাঁটুর মুখ শুকিয়ে যায়।

‘আছে’ বলতেও কষ্ট, ‘নেই’ বলতেও বিবেকের কামড়। আসার আগে মা পঞ্চাশটি টাকা দিয়েছিলেন ইচ্ছে মতন হাত খরচ করবার জন্যে।

বলেছিলেন মামা সবই করবেন জানি, তবু নেহাত কিছু ইচ্ছে হলে—

মলিন মুখে বলে, কাছেই আছে।

কত টাকা?

পন চা—স।

ওঃ, তাতেই হবে, তাতেই হবে

ঘনরাম মহোৎসাহে সাঁটুর টাকাটা নিয়ে হোটেলে তিনজনের খাবারের অর্ডার দেন এবং তিন দশে তিরিশ টাকার রুটি, মাংস আর ডাল খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে বললেন, চল, এবার ফেরা যাক। আবার তো সন্ধের আগেই বেরুতে হবে। চাঁদের আলোয় না দেখলে তো তাজ দেখাই বৃথা।

* * *

কিন্তু আর কে নিয়ে যাবে?

সে টাঙাওয়ালা তো খেয়ে—দেয়ে লম্বা দিয়েছে।

ঘনরাম বলেন, গেল তো বয়ে গেল, সে ব্যাটা তো, গলাকাটার ছুরি। টাঙার অভাব আছে নাকি? ওই তো ওখানে দুটো দাঁড়িয়ে।

কথাটা ঠিক এই ‘হোটেল গুলবাগ’—এর কাছেই টাঙার স্ট্যান্ড।

* * *

মামা তুমি রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে?

ঘনরাম বুক পকেটে একটু হাত চাপড়ে আত্মস্থ গলায় বলেন, চেনাবার চাবিকাঠিটি সঙ্গে আছে রে বাবা! তোর মামার চারদিকে চোখ—কান। ম্যানেজার না কেয়ারটেকার, তার কাছ থেকে ঠিকানাটি লিখিয়ে নিয়েছি।

* * *

হ্যাঁ, হুঁশিয়ার ঘনরামবাবু ঠিকানাটি লিখিয়ে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ঠিকানা পড়বে কে? টাঙাওয়ালা? একটির পর একটি টাঙাওয়ালা ধরেন, তারা কাগজটা দেখে অথবা না দেখে অবজ্ঞাভরে চলে যায়। ময়লা ময়লা এক টুকরো কাগজে ‘কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং’ অক্ষরগুলো যেন ঘনরামের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ হাসি হাসে।

* * *

পথচারী লোক, হোটেলের মালিক থেকে চাকর পর্যন্ত কাউকে দেখাতে বাকি রাখলেন না ঘনরাম সে কাগজ। কিন্তু নাঃ, কোনো কাজ হল না। কেউ পাঠোদ্ধার করতে পারল না।

ওদিকে বিকেল পড়ে এসেছে, আর একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। আকাশে চাঁদ উঠবে।

ঘনরাম বীরদর্পে বলেন, ঠিকানা কেউ না পড়তে পারুক, পুলিশকে দিয়ে পড়াব। পুলিশ শহরের সব রাস্তা চিনতে বাধ্য। এখন চাঁদ উঠতে না উঠতে তাজে পৌঁছে যাই চল।

আগে কখনো সাঁটু মামার কথার প্রতিবাদ করত না, কিন্তু মামার সঙ্গে তাজ দেখতে এসে সাঁটুর স্বভাব বদলে যাচ্ছে। সাঁটু বিদ্রোহের গলায় বলে ওঠে, মামা, তাজমহল তো পালিয়ে যাচ্ছে না! কাল দেখা হবে। আমাদের তো সাত দিন থাকার কথা!

কাল!

ঘনরাম হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলেন, ইয়াং ছেলে হয়ে এই বললি সাঁটু? আজ এসে তাজ দেখবি কাল? ফার্স্ট নাইটেই যদি না দেখলি তো বিবেককে কী জবাব দিবি? বন্ধুবান্ধবকে কী বলবি? আর রাতে ঘুম হবে কী করে?

তোমার ওই সাধের ধর্মশালার ঘরে ঘুম তো হবে না মামা। এদিকে আমার তো দারুণ বাথরুম পেয়ে গেছে!

ঘনরাম অবাক গলায় বলেন, তা সেইখানে তুই বাথরুমের আশা করছিস? বাবরের আমলে কেউ ‘বাথরুম’ শব্দটা শোনে নি বাপ! ও এখন সামলে থাক, পরে যা হয় হবে।

ঠিক আছে। গিয়ে যখন দেখবে জিনিসপত্তর সব চুরি হয়ে গেছে দেখবে মজা!

চুরি!

ঘনরাম হা—হা করে হেসে ওঠেন, চোরের ঠাকুরদার সাধ্যি আছে ওই গোলকধাঁধা পার হয়ে চুরি করে পালাবে?

বাইরের চোর কেন? ওরাই চুরি করবে।

ঘনরাম আহত হন ভাগ্নের নীচ কথায়।

বলেও ফেলেন, ছি ছি সেঁটো, এ—রকম মীন মাইন্ডের মতো কথা বললি? জায়গাটা ‘ধর্মশালা’ তা মনে রাখিস! দেখলি খৈনি খেতে বকশিশ পর্যন্ত নিল না!

সাঁটু মনে মনে গজগজ করে, তা নেবে কেন। একেবারে যথাসর্বস্বই নেবে তো! চেনা নেই, জানা নেই, চাবি পর্যন্ত দেওয়া নেই, সেইখানে সাঁটুর যথাসর্বস্ব পড়ে। আসার আগে দু—দুটো ভালো ভালো প্যান্ট করানো হয়েছে, দু—তিনটে শার্ট কেনা হয়েছে। তা ছাড়া তোয়ালে, জীবনে যা কখনো ব্যবহার করতে পায়নি সাঁটু। গামছাতেই জীবন কাটছে।

সব থাকবে সাঁটু, সব থাকবে। ঘনরাম বলেন, কবি কালিদাসের সেই কবিতাটি পড়িস নি? ‘তোমার মহা বিশ্বে কিছু হারায় না কো কভু—’, চল বাবা, চল, চাঁদ উঠে গেল।

সাঁটু ঠিক করেছে আর মামার কথার প্রতিবাদ করবে না। কবি কালিদাসেরও না।

অতএব আবার একটা টাঙাওয়ালাকে ডেকে উঠে পড়েন ঘনরাম। বলেন জোরে চালাতে। বলেন, তাজমহল মে জায়েগা। রাস্তা জানতা হ্যায়?

টাঙাওয়ালা অবজ্ঞার ভাবে ঘোড়ার পিঠে ছপটি মারে।

না, এমন কোনো টাঙাওয়ালা নেই আগ্রায় যে তাজের রাস্তা চেনে না।

* * *

চাঁদের আলোয় তাজমহল দেখলেন ঘনরাম!

ঘাসের ওপর বসে, চত্বরের ওপর উঠে দূর থেকে, কাছে থেকে। দেখেন আর বলতে থাকেন, সেঁটো দেখেছিস? সেঁটো দেখেছিস? আহা, এতো দিনে সেই গানটার মানে বুঝতে পারছি, ‘তাজমহলের মর্মরে গাঁথা কবির অশ্রুজল।’ আরও একটা কী ছিল, ‘নেমে এল শুভ্র মেঘের দল’ না কি। আহা! সেঁটো বুঝতে পারছিস কেন আমি পুরোনো ধর্মশালা চেয়েছি। এই দেখার পর হোটেল বাড়ির চড়া আলো, কড়া অ্যাটমোসফিয়ার আর আধুনিক প্যাটার্নের মধ্যে গিয়ে পড়ে এই দেখার রেশটুকু মনে ধরে রাখতে পারা যাবে? সব রেশ মুছে যাবে। ধর্মশালার সেই ঘরখানা ভাব? মিটমিটে বাতি জ্বেলে শুয়েছি, মনে হবে সেই সাজাহান নূরজাহানের আমলে পৌঁছে গেছি।

মামা, নূরজাহান নয়, মমতাজ।

আচ্ছা বাবা, তাই, তাই।

ঘনরাম বলেন, তা সাজাহান’টা তো আর ভুল নয়? ‘কালের কপালতলে সাদা সমুজ্জ্বল, এক ফোঁটা নয়নের জল! ওঃ, কী লাইন! অবিস্মরণীয়!’

ঘনরাম ভাবগম্ভীর মুখে তাকান ভাগ্নের দিকে, পড়েছিস এ কবিতা? ভারতঈশ্বর সাজাহান?

হ্যাঁ, পড়েছি।

সাঁটুও গম্ভীর গলায় বলে, ‘কপাল’ নয় মামা, কপোল, ‘সাদ’ নয় শুভ্র, ‘ফোঁটা’ নয় বিন্দু।

হয়েছে বাবা, হয়েছে। সব সময় পড়া ধরা। ভবিষ্যতে মাস্টারি তোর উপযুক্ত পেশা হবে। যাক, এইবার ওঠা যাক। তুই যা ব্যস্ত হয়েচিস। নইলে এই দৃশ্য ছেড়ে কি আর উঠে যেতে ইচ্ছে করে রে?

রাত্তিরে খাওয়ার প্রশ্ন নেই।

ঘাসের ওপর বসে থাকা ঘুঘনিওলার কাছ থেকে এক পেট করে ছোলার ঘুগনি নেওয়া হয়েছে।

এখন টাঙা।

গেটের বাইরে অনেক টাঙা। সারি সারি।

ভাঙা আস্ত। রংদার, রংজ্জ্বলা।

টাঙাওয়ালাও জোয়ান, মাঝারি, বুড়োহাবড়া।

ঘনরাম প্রসন্ন হাসি হাসেন, এরা এই ঠিকানটা ঠিক বুঝবে।

কিন্তু কোথায়?

কেউ বুঝতে পারে না, মাথা নাড়ে লেখাটার ভাষাটা নাকি হিন্দিই নয়।

নাঃ এদের কর্ম নয়।

ঘনরাম বলেন, তার মানে সেকেলে হিন্দি। দেখি তো ওই বুড়োটাকে। সেই থেকে দেখছি গাছতলায় বসে ঘুমোচ্ছে।

হ্যাঁ, বসেই ঘুমোচ্ছিল লোকটা, হাঁটুতে মাথা গুঁজে। ঘনরামের ডাকে মাথা তুলে তাকাল। সেই তাকানো দেখে সাঁটুর বুকটা কেমন গুরগুরিয়ে উঠল। মনে হল লোকটা যেন অনন্তকালের ঘুম ভেঙে চোখ খুলেছে।

ঘনরাম হাত মুখ নেড়ে এবং তাঁর বিশুদ্ধ হিন্দিতে অবস্থাটা বুঝিয়ে কাগজটুকু ধরে দেন তার সামনে।

লোকটা প্রথমে ভুরু কুঁচকে তাকায়, তারপর আস্তে আস্তে ভুরুটা ফ্ল্যাট হয়ে যায়। অতঃপর ওই জরাজীর্ণ বুড়োটার মুখে ফুটে ওঠে একটি ভয়াবহ অলৌকিক হাসি।

দেখে সাঁটুও চোখ বুজে ফেলে।

উঠে দাঁড়ায়, মাথার টুপি ঠিক করে।

ঘনরাম বলেন, সমঝা?

লোকটা ওপর নীচে মাথা নাড়ে।

উঠে বসে বলে ওঠেন ঘনরাম, দেখলি তো সেঁটো, কেমন করে এক নজরে আসল লোককে চিনে ফেললাম! চোখ থাকলে চৌখোস হয় নারে। চোখের মতন চোখ থাকা চাই। চলিয়ে ভাই।

* * *

এখন রাত প্রায় নটা, তাজের গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চারিদিক ঝিমঝিমে। হাওয়া বইছে কেমন একরকম উড়ো উড়ো প্রাণ কেমন করা। মায়ের জন্যে মনটা হু—হু করে ওঠে সাঁটুর।

টাঙা চলার পেটেন্ট ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দটা ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। রাস্তাও জনবিরল।

সাঁটুর যেন হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসে।

সাঁটু মামার হাঁটুতে হাত ঠেকিয়ে আস্তে বলে, মামা, কোন দিকে যাচ্ছি আমরা?

এতক্ষণে যেন ঘনরামেরও ভয় ভয় করে।

তাই তো। এ কোন রাস্তা? রাস্তাই বা কোথা? মাঠের মাঝখান। আর আশেপাশে সামনে পিছনে শুধু কবর আর কবর। ছোটো বড়ো মাঝারি ফরসা কালো মেটে। প্রখর চাঁদের আলো, তাই এতোটা দেখা যাচ্ছে। ধর্মশালা কোন দিকে?

দুপুরবেলা তো সেই ধর্মশালা থেকেই তাজমহলে আসা হয়েছিল, কই এমন ভয়াবহ দৃশ্যতো চোখে পড়ে নি।

মামা, মনে হচ্ছে সকালের সেই গাড়িটা আর সেই ঘোড়াটা। ঠিক সেই রকম ভাঙা আর মড়াখেকো।

দূর পাগল!

শুকনো গলায় বলেন ঘনরাম।

আমি বলছি। আমার রুমালটা তখন হারিয়ে গিয়েছিল, এখন দেখছি সিটের খাঁজে গোঁজা! মামা!

ঘনরাম আরও শুকনো গলায় বলেন, কী যে বলিস।

তারপর আরও শুকনো গলায় বলেন, টাঙাওয়ালা, আউর কেতনা দূর?

টাঙাওয়ালা নিরুত্তর।

জবাব দেতা নেই কাহে? ও টাঙাওয়ালা, এ কোন সড়কমে লে যায়েগা ভাই?

টাঙাওয়ালা নীরব।

লোকটা কি আবার তখনকারের মতো ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? কিন্তু ঘোড়া তো ছুটছে! যেন অনন্তকাল ধরেই ছুটে চলেছে খোঁচা খোঁচ, পাঁজরে ভাঙা লোহার ‘সাজ’গুলোর ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দ তুলে। ওই মড়াখেকো দেহ নিয়ে এত ছুটছেই বা কী করে? বিশাল কবরখানার ওপর চাঁদের আলোর ছাউনি, তার মধ্যে দিয়ে ঘোড়াটা ছুটে চলেছে যেন একটা ভূতুড়ে যন্ত্রের মতো।

* * *

ঘনরামের সব জারিজুরি লোপাট।

হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, এই টাঙাওয়ালা, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাদের?

ভাঙাচোরা আতঙ্কে কাঁপা গলায় শব্দে টাঙাওয়ালাটাও হঠাৎ চেঁচিয়ে হেসে ওঠে, হা—হা—হা! হা—হা—হা! হা—হা—হা। থামতেই চায় না।

যতক্ষণে থামল, ততক্ষণে মামা—ভাগ্নে দুজনের নাড়ির গতি প্রায় থেমে গেছে। শুধু বাতাসে একটা আর্তনাদের রেশ যেন থেমেও রয়ে গেছে ‘আঁ আঁ আঁ আঁ।’

* * *

নাড়ির গতি ফিরল, যখন সকালের রোদ চোখে মুখে এসে লেগেছে। কথা বলার শক্তি নেই, সাহসও বুঝি নেই। ঘনরাম আস্তে হাত বাড়িয়ে সাঁটুর গায়ে হাত ঠেকালেন।

মামা! তুমি বেঁচে আছ?

ডুকরে উঠল সাঁটু।

সেঁটো, তুই আছিস তাহলে?

ডুকরে উঠলেন ঘনরাম।

তারপর উঠে বসলেন দুজনে। দেখলেন বিরাট একটা কবরখানার মধ্যে পড়ে রয়েছেন তাঁরা। আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। কিন্তু এখানে রাস্তা কোথায়? মাঠ কোথায়? সামনে পিছনে এপাশে—ওপাশে তো শুধু কবর আর কবর! বড়ো ছোটো মাঝারি, ময়লা, মেটে ধূলি—ধূসর। ‘কালে’র ঝড় কতকাল ধরে বয়ে চলেছে এদের উপর দিয়ে কে জানে? ঘোড়াটা তবে গাড়ি আর সওয়ারি নিয়ে ছুটে চলেছিল কোনখান দিয়ে?

শূন্য দিয়ে?

তবে ঘোড়ার পায়ের শব্দ উঠছিল কী করে? যে শব্দ এখনো সাঁটুর বুকের মধ্যে বেজে চলেছে খটাখট খটাখট!

মামা বুঝতে পারছে টাঙাওয়ালা মানুষ নয়।

সাঁটুর গলার মধ্যে যেন গোবি মরুভূমির সমস্ত বালি।

ঘনরাম বিজবিজ করে ‘রাম রাম’ জপতে জপতে বলেন, ‘সাঁটু, আমার গায়ে চিমটি কেটে দেখতো, আমিও মানুষ আছি কিনা!’

তা গুরুজনের আজ্ঞা, অবহেলা করে না সাঁটু, জোর চিমটিই কাটে। ‘রাম চিমটি’।

হয়েছে, হয়েছে’!

ঘনরাম গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলেন, ‘ভূতের হাতে পড়েও আমরা বেঁচে উঠেছি কিসের জোরে বুঝতে পারছিস? নামের জোরে। তুই সীতারাম আমি ঘনরাম। ডবল রামনাম।

‘মামা, মামদো ভূতেরা রামনামের ধার ধারে?

ধারে না তো দেখলি? ভূতের কি আর জাত ধর্ম থাকে রে? তারা একটাই জাত ‘ভূত’। আর তাদের একটাই ধর্ম, মানুষকে বেকায়দায় পেলেই নিজেদের জাতে ভরতি করে ফেলার চেষ্টা! নেহাত নামের গুণে তরে গেলাম। এখন দেখা যাকে এখান থেকে বেরোবার পর কোথায়?

চারিদিকে তো উঁচু পাঁচিল মামা।

আহা, গেট তো একটা আছেই।

আছেই। কিন্তু কোথায় আছে সেটাই সমস্যা! কবরদের পাশ কাটিয়ে গা ঘষটে গোলক ধাঁধার পথ ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে স্ট্যাচু হয়ে যান ঘনরাম। শুধু অস্ফুটে বলেন, সেঁটো?

হ্যাঁ, সেঁটোও দেখেছে বইকি।

গেট পাওয়া গেছে। চৌকো একটা ঘেরা জায়গাটার বাইরের মুখে শতবর্ষের জং ধরা একটা লোহার গেট। সেই চৌকো ঘেরা জায়গাটার মাথাটা একটা তারের জালে মোড়া, সেই জালের উপর অনন্তকালের ঝড়ে উড়ে পড়া শুকেনা পাতা, কুচো কাগজ, ছেঁড়া চুলের নুড়ো আর লম্বা লম্বা দড়া দড়া ঝুল প্রায় ঢালাই ছাদের কাজ করছে। এখানে যদি দারোয়ান থাকে, কখনোই বৃষ্টির সময় ভিজে যাবে না।

সাঁটু জম্পেস করে মামাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মামাগো, আমার পেট গুলোচ্ছে।

পেট! চুলোয় যাক। ভারি তো জিনিস! আমার যে মাথার মধ্যে চরকিপাক—

মামাগো, আমাদেরও তাহলে এইখানেই কবর?

সাঁটুরে। কী মুখে আনছিস? আমরা যে হিঁদুর ছেলে?

মামা! তখন তো আমরা ভূত হয়ে যাব! আমাদের কী জাত, ধর্ম বলে কিছু থাকবে?

সাঁটু দুঃসময়ে ফাজলামি করিস না।

ফাজলামি কীগো মামা? এই বাঁচন—মরণের মুখে দাঁড়িয়ে ফাজলামি করব?

তোরা একেলের ছেলেরা সব পারিস! তবু যাই ভাগ্যিস চাঁদের আলোয় তাজটা দেখা হয়ে গেছে! নইলে চিত্রগুপ্তের কাছে কী জবাব দিতাম বল? তোর গোঁয়ারতুমিতে কান দিয়ে এনজয়টা কালকের জন্যে তুলে রাখলে কী হত?

মামা, ও কথা রাখো। ভাবো, মা বাবা দিদি বড়দা কেউ জানতেও পারবে না আমরা এইখানে দুজনে একলা পড়ে পড়ে শুকিয়ে শুকিয়ে পরছি।

ঘনরাম একটা ঘনায়িত নিশ্বাস ফেলেন।

তারপর বলেন এত সহজে হাল ছাড়ব নারে সেঁটে, অঅয় সমবেত চেষ্টায় গেটটায় ধাক্কা দিই। দেখি যদি জীর্ণ লোহা ঝুরঝুরিয়ে ঝরে পড়ে।

আয়, হেঁইয়ো মারি হেঁইয়ো।

* * *

আচ্ছা, ধাক্কা কি দিতে হল?

হল না তো। কাছে গিয়েই তো দেখতে পাওয়া গেল বিরাট গেটটার মাঝখানে, সচরাচর যেমন থাকে, একটা কাটা দরজা। সেটার পাল্লা ঠেলতেই খুলে গেল!

কিন্তু তারপর?

তারপর, সঙ্গে সঙ্গেই ঘনরাম আর সীতারাম, এই দুই রামের হাড়ের জোড়গুলোও খুলে খুলে পড়তে শুরু করল। কারণ দু—জনেরই যে গায়ের সব রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে সামনের দৃশ্য দেখে! আর রক্তরা সব জমে বরফ হয়ে যাওয়ার জন্যে মাথার চুলেরা সব পুরো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছে।

কিন্তু এত সবরে ধাক্কায় ‘রামে’রা নিজেরা আর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। কাল থেকে এত বিপর্যয়ে যা না হয়েছিল তাই হল। দুটো মানুষেই তালগোল পাকিয়ে গড়গড়িয়ে গড়িয়ে মুখ গুজড়ে পড়ে গেল গোঁ—গোঁ শব্দ করতে করতে!

* * *

তারপর? তারপর কী হল বলা শক্ত।

মানুষরই নার্ভ তো?

আচ্ছা, কী সেই দৃশ্য?

ভৌতিক? রাক্ষসিক? শয়তানিক? পৈশাচিক? নাকি ব্যাঘ্রিক? বদন ব্যাদান করা ‘রয়েল বেঙ্গল?’

* * *

মোটেই না।

সে সবের কিছু না। অতি সাধারণ অতিনিরীহ একটি দৃশ্য, যা হামেশাই দেখতে পাওয়া যায় রেলগাড়িতে, রেলের প্ল্যাটফর্মে, হোটেলে, ধর্মশালায়, এখানে—সেখানে।

একত্রে জড় করা দুটি হালকা বেডিং দুটি মাঝারি সুটকেস, দুটি বিগ সাইজের ওয়াটার বটল আর ভেরি ভেরি বিগ সাইজের একটি ঝকঝকে স্টেনলেস স্টিলের টিফিন কৌটো! মাত্র এই তা ছাড়া জিনিসগুলো দুজনেরই একেবারে প্রাণের পরিচিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *