চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়লাম। আমি, আমার স্ত্রী, বড় শ্যালক নন্দু এবং ভৃত্য মহাবীর। নন্দু আর ইহজগতে নেই; সেদিন আমাদের অনিশ্চিত বিদেশ যাত্রার আরম্ভে সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাকে কৃতজ্ঞ অন্তরে স্মরণ করছি।
যাত্রাপথটি কম নয়, মুঙ্গের থেকে বোম্বাই—১১০০ মাইল। আমাদের স্থির হয়েছিল, থামতে থামতে যাব। এক দৌড়ে বোম্বাই যাওয়া কিছু নয়, তাজা অবস্থায় বোম্বাই পৌঁছুতে হবে।
দিনটা ছিল ২৪শে জুলাই ১৯৩৮। বিকেলবেলা বাবা এসে জামালপুর স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন। কয়েকজন বন্ধুও এসেছিলেন বিদায় দিতে। আমাদের যাত্রা হল শুরু।
আমার জীবনে একটা বৈচিত্র্য আছে; আমি জন্মেছি উত্তর প্রদেশের জৌনপুর শহরে, বড় হয়েছি বেহারের মুঙ্গের শহরে, লেখাপড়া করেছি কলকাতায়, কাজ করেছি বম্বেতে, এবং বাণপ্রস্থ অবলম্বন করেছি পুণায়। নিখিল-ভারতীয় বাঙালী যদি কেউ থাকে সে আমি।
রাত্রিটা ট্রেনে কাটিয়ে পরদিন সকালবেলা এলাহাবাদে নামলাম। এলাহাবাদে আমার মামার বাড়ি। সেদিনটা এখানে বিশ্রাম করে রাত্রি দশটার সময় আবার ট্রেন ধরলাম। ইন্টার ক্লাসে যাচ্ছি, কিন্তু তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ইন্টার ক্লাসেও ভিড় থাকত না। দিব্যি ঘুমোতে ঘুমোতে চলেছি।
পরদিন সকালে আবার জব্বলপুরে নেমে পড়লাম। এখানে সারাদিন কাটিয়ে বিকেলবেলা বোম্বাই রওনা হব। জব্বলপুরে চেনাশোনা কেউ নেই। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে রইলাম; দুপুরবেলা কেল্নারে খেলাম। মেঘলা আকাশ, মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামছে। ইচ্ছে ছিল মর্মর-পাহাড় দেখে আসব, কিন্তু যাওয়া হল না।
বিকেল চারটের সময় বম্বে মেল এল। আমরা চড়ে বসলাম। এর পর আর কোথাও থামব না, পরদিন বেলা দশটার সময় একেবারে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস।
বম্বে মেল গম্গম্ করে ছুটেছে। অপরাহ্নের আকাশে শ্রাবণের মেঘাড়ম্বর। বম্বে যতই এগিয়ে আসছে আমার মনও ততই উদ্বিগ্ন হচ্ছে। কোথায় যাচ্ছি? বম্বে শহরের কাউকে চিনি না। যারা চাকরি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা কেমন লোক? তাদের সঙ্গে বনিবনাও হবে তো? জীবনে এই প্রথম চাকরি করছি, চাকরি করার ভাবভঙ্গি কিছুই জানি না। পারব তো?
বম্বের সিনেমা-কোম্পানীতে আমার চাকরি পাওয়া এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ১৯২৯ সালে সাহিত্য-সেবা আরম্ভ করি। তারপর আট-নয় বছর কেটে গেছে, কয়েকখানা বই বেরিয়েছে; মুঙ্গেরেই আছি। হঠাৎ সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মশায়ের কাছে থেকে এক চিঠি পেলাম। দাশগুপ্ত মশায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না; তিনি লিখেছেন তাঁর শ্যালক হিমাংশু রায় বম্বে টকীজ নামক ফিল্ম-প্রতিষ্ঠানের কর্তা, তিনি একজন গল্প-লেখক চান। দাশগুপ্ত মশায় জানতে চেয়েছেন আমি বম্বে গিয়ে ফিল্ম-কোম্পানীতে গল্প-লেখকের চাকরি নিতে রাজী আছি কিনা।
ফেরত ডাকে উত্তর দিলাম, আমি রাজী। তারপর দাশগুপ্ত মশায়ের দ্বিতীয় চিঠি পেলাম, আমি কলকাতায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারব কিনা। খুব পারব। দু’দিন বাদেই কলকাতা রওনা হলাম।
সংস্কৃত কলেজে গিয়ে দাশগুপ্ত মশায়ের সঙ্গে দেখা করলাম। প্রবীণ মোটাসোটা মানুষ, ক্রমাগত সিগারেট খান। প্রকাণ্ড টেবিলের দু’পাশে বসে অনেকক্ষণ কথাবার্তা হল। পরে জানতে পেরেছিলাম, দাশগুপ্ত মশায় আরো দু’জন লেখককে ডেকেছিলেন। কিন্তু সে-কথা থাক।
যথাসময় খবর পাব এই আশ্বাস নিয়ে মুঙ্গেরে ফিরে এলাম। কয়েকদিন পরে বম্বে থেকে চিঠি এল, হিমাংশুবাবু লিখেছেন—আপনাকে কোম্পানীর গল্প-লেখক নিযুক্ত করা হল, যত শীঘ্র পারেন চলে আসুন।
সুতরাং দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়লাম।
২৭শে জুলাই বেলা দশটার সময় যখন ভি টি পৌঁছুলাম তখন অবিশ্রাম বৃষ্টি পড়ছে। বোম্বাই বৃষ্টির এই প্রথম নমুনা। স্টেশনের বাইরে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল বম্বে টকীজের স্টেশন-ওয়াগন আসেনি।
খাস বোম্বাই থেকে ১৮/১৯ মাইল উত্তরে মালাড্ নামক স্থান, সেখানে বম্বে টকীজের আস্তানা। চিঠি-পত্রে ব্যবস্থা হয়েছিল, স্টুডিওর গাড়ি এসে আমাদের স্টেশন থেকে তুলে নিয়ে যাবে। গাড়ি আসেনি দেখে দমে গেলাম। বম্বে থেকে মালাডে যাবার মোটর রোড আছে, আবার লোকাল ট্রেনও পাওয়া যায়। কিন্তু এত খবর তখন জানা ছিল না।
অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে স্টুডিওতে ফোন করলাম। হিমাংশু রায়ের সেক্রেটারি ফোন ধরল। আমি পৌঁছে গেছি শুনে সে বলল, ‘মালাড্ স্টেশনে গাড়ি পাঠান হয়েছে; যাহোক, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ভি টি-তে গাড়ি যাচ্ছে, আপনারা অপেক্ষা করুন।’
অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম। ওয়েটিং রুমে স্নান সেরে স্টেশনের তেতলার হোটেলে গিয়ে খেয়ে নিলাম। কখন মালাডে পৌঁছুব ঠিক নেই।
যথাসময় স্টেশন-ওয়াগন এল। আমরা লটবহর নিয়ে উঠে বসলাম। স্টেশন-ওয়াগন ফিরে চলল। এই আমার দূর যাত্রার শেষ ধাপ।
মালাড্ জায়গাটাকে তখন বড় গ্রাম কিংবা ছোট শহর বলা চলত। একটি মাত্র বড় রাস্তা, আর সব শাখা-প্রশাখা। বেশ নির্জন। আমাদের গাড়ি বৃষ্টি-ভেজা রাস্তা দিয়ে বম্বে টকীজের পাঁচিল-ঘেরা হাতায় প্রবেশ করল। চারিদিকে গাছপালা ফুলের বাগান, মাঝখানে দোতলা অফিস-বাড়ি। তার পাশে কিছু দূরে করোগেট্ দেওয়া প্রকাণ্ড গুদাম-ঘরের মতো স্টুডিও। এই গুদাম-ঘর থেকে ‘অছুৎকন্যা,’ ‘জীবনপ্রভাত’ প্রভৃতি ছবি বেরিয়েছে।
লোকজন কিন্তু বেশী নেই। অফিসের সামনে গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, দেখি স্টুডিওর দিক থেকে প্ল্যান্টুলুন ও শার্ট পরা একটি ভদ্রলোক আসছেন। চেহারা অতি সুন্দর, বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ। কাছে এসে হাসিমুখে নিজের পরিচয় দিলেন—হিমাংশু রায়।
এই পরম প্রাণবন্ত মানুষটিকে দেখে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারলাম না যে, এঁর আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। আর দু’-বছরও বাঁচবেন না।
সমাদর করে নিজের অফিস-ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। ভারি চমৎকার কথা বলেন। আমাদের জন্যে কয়েকটি বাড়ি দেখে রেখেছেন, আমাদের যেটাতে ইচ্ছা থাকব। আমরা বেশীক্ষণ বসলাম না, বাড়ি দেখার জন্যে উঠে পড়লাম, কারণ কাজের কথা পরেও হতে পারবে, সর্বাগ্রে একটা আস্তানা চাই। হিমাংশুবাবু বললেন, ‘আজ আমাদের রাত্তিরে শুটিং; ন’টা থেকে আরম্ভ হবে। আপনারা বাসা ঠিক করে বসুন, সন্ধ্যের পর যদি ইচ্ছে হয় স্টুডিওতে আসবেন। শুটিং দেখাব।’
বম্বে টকীজে তখন ‘বচন’ নামে একটি ফিল্মের শুটিং চলছিল। কিন্তু তার কথা পরে হবে।
যে গাড়িতে এসেছিলাম সেই গাড়িতে চড়ে বাড়ি দেখতে বেরুলাম। সঙ্গে চলল হিমাংশুবাবুর সেক্রেটারি পেরেরা। গোয়ানিজ ক্রিশ্চান, বছর পঁচিশেক বয়স হবে, ভারি কাজের ছেলে।
প্রথম যে বাড়িটা দেখলাম সেটা পছন্দ হল না। ভিত নীচু, মেঝে স্যাঁৎসেঁতে, মাত্র দুটি ঘর। পেরেরাকে বললাম, ‘এর চেয়ে ভাল যদি কিছু থাকে, দেখাও।’
পেরেরা এবার আমাদের যে বাড়িতে নিয়ে গেল, সেটি একটি ছোটখাটো প্রাসাদ। বাড়ির মালিক বিখ্যাত ব্যারিস্টার মিস্টার দপ্তরী আগে এখানে থাকতেন, এখন খাস বম্বেতে উঠে গেছেন। আসবাব দিয়ে সাজানো বাড়ি, গোটা পাঁচেক ঘর, রান্নাঘর, চাকরের ঘর; বাগান দিয়ে ঘেরা বাড়ি। দেখেই লোভে পড়ে গেলাম। ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘ভাড়া কত?’
পেরেরা বলল, ‘পঞ্চাশ টাকা।’
আর দ্বিরুক্তি করলাম না, মোটঘাট নামিয়ে বাড়ি দখল করে বসলাম। পেরেরা চলে গেল, আধ ঘণ্টা পরে চাল ডাল ময়দা মাছ মাংস তরকারি নিয়ে এল। বলল, ‘মিস্টার রায় পাঠালেন, আপনাদের কাল দুপুর পর্যন্ত চলে যাবে। তারপর আপনারা নিজের ব্যবস্থা করে নেবেন। আজ রাত্রে শুটিং দেখতে যাবেন কি? যদি যান গাড়ি পাঠাব।’
বললাম, ‘যাব। আটটার সময় গাড়ি পাঠিও।’
পেরেরা চলে গেল। বেলা তখন চারটে, সারাদিন পরে বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে। গৃহিণী মহাবীরের সঙ্গে সংসার পাততে লেগে গেলেন। আমি আর নন্দু মুখোমুখি বসে সিগারেট টানতে লাগলাম। চাকরি করতে এসেছি, সুদূর বিদেশে পদার্পণ করেই এমন আদর-যত্ন পাব কল্পনা করিনি। হিমাংশুবাবুর প্রতি মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল; তিনি শুধু খ্যাতিমান চিত্র-প্রণেতা নন, অতি হৃদয়বান ব্যক্তি।
নন্দু আমার মনের কথার প্রতিধ্বনি করে বলল, ‘আমাদের যাত্রাটা ভালই হয়েছে মনে হয়।’
আটটার সময় গাড়ি এল। আমরা খেয়ে-দেয়ে তৈরি ছিলাম, পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি থেকে স্টুডিও আন্দাজ আধ মাইল দূরে। যেতে যেতে মনটা বেশ উৎসুক হয়ে উঠল। সিনেমার শুটিং আগে কখনো দেখিনি।
স্টুডিওর হাতার মধ্যে চারিদিকে বড় বড় আলো জ্বলছে, অনেক লোক রঙবেরঙের কাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা গাড়ি থেকে নামতেই পেরেরা এসে দাঁড়াল, বলল, ‘মিস্টার রায় মিউজিক-রুমে আছেন, চলুন আপনাকে নিয়ে যাই।’
অফিস-বাড়ি থেকে মিউজিক রুম খানিকটা দূরে, হাতার এক কোণে। এখানকার অধিষ্ঠাত্রী হচ্ছেন মিউজিক-ডিরেক্টর সরস্বতী দেবী। তিনি জাতে পার্সী ছিলেন, সিনেমার খাতিরে হিন্দু নাম নিয়েছিলেন। সে-রাত্রে তাঁকে দেখিনি, পরে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।
মিউজিক-রুমে আজ মিউজিক নেই; হিমাংশু রায় টেবিল পেতে সস্ত্রীক খেতে বসেছিলেন, আমাদের দেখে তাড়াতাড়ি উঠে এলেন। মহিলাটির পরিচয় দিলেন, ‘ইনি আমার স্ত্রী—দেবিকারাণী।’
দেবিকারাণীকে আগে কয়েকবার চলচ্চিত্রে দেখেছি, এখন সশরীরে দেখলাম। তখনকার দিনের ভারতীয় সিনেমা-রাজ্যের একচ্ছত্রী সম্রাজ্ঞী। ছোটখাটো মানুষটি, মুখে-চোখে সাবলীল লাবণ্য, বাংলা কথা একটু থেমে থেমে বলেন। ইনি বাংলাদেশের বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারের মেয়ে, প্রমথ চৌধুরী এঁর সাক্ষাৎ কাকা ছিলেন। এঁর শৈশবকাল বিলেতে কেটেছিল। তবু বাংলা মন্দ বলেন না, হিন্দীও শিখেছেন। হিন্দী-বাংলা-ইংরেজী মিশিয়ে বেশ কাজ চালিয়ে নেন।
আমার গৃহিণীর সঙ্গে অবিলম্বে দেবিকারাণীর ভাব হয়ে গেল। সে ভাব এখনও অটুট আছে। দু’জনের বয়স প্রায় সমান। তারপর ছাব্বিশ বছর কেটে গেছে, দেবিকারাণীর জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, এঁদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ আর হয় না। তবু আমার গৃহিণী দেবিকারাণীর প্রতি তেমনি প্রীতিমতী। অন্য পক্ষের কথা জানি না।
স্টুডিও থেকে ডাক এল—সেট তৈরি। হিমাংশুবাবু আমাদের নিয়ে স্টুডিওর বিরাট ছাউনির দিকে চললেন। আমি জীবনে প্রথম সিনেমা-স্টুডিওর আলোকোজ্জ্বল গহ্বরে প্রবেশ করলাম।
সামনেই বিরাট একটি দুর্গ।
‘বচন’ ছবির কাহিনী সেকালের রাজপুতদের নিয়ে। এই দুর্গটি গল্পের নায়কের দুর্গ, শত্রুপক্ষ এসে দুর্গের সিংহদ্বার ভেঙে ফেলবার চেষ্টা করছে—আজ সেই দৃশ্য তোলা হবে।
নকল কেল্লা বটে কিন্তু চোখে দেখে নকল বোঝা যায় না, আঙুল দিয়ে টিপলে বোঝা যায় পাথর নয়, ক্যাম্বিসের ওপর রঙ চড়ানো।
স্টুডিওর মধ্যে আরও কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হল। ফ্রান্জ্ অস্টেন নামে একজন জার্মান ছিলেন বম্বে টকীজের চিত্র-পরিচালক, কোম্পানীর গোড়াপত্তন থেকে ইনিই সব ছবি পরিচালনা করেছিলেন। বেঁটে গোলগাল বয়স্থ লোক, ভাল ইংরেজি বলতে পারতেন না, বুঝতেন আরও কম। কিন্তু অতি উচ্চাঙ্গের চিত্র-পরিচালক ছিলেন। তিনি প্রবল বেগে আমার সঙ্গে শেকহ্যান্ড করে জার্মান সুরে গলার মধ্যে ঘড়ঘড় করে যা বললেন তার অধিকাংশই ধরতে পারলাম না। সৌজন্য দেখিয়ে বললাম, ‘প্লিজড্ টু মীট ইউ।’
আরও দু’জন জার্মান তখন বম্বে টকীজে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজনের নাম ছিল উইরশিঙ। ইনি ছিলেন স্টুডিওর সর্দার ক্যামেরাম্যান। হিমাংশু রায় তাঁকে বীর সিং বলে ডাকতেন। অন্য লোকটির নাম ভুলে গেছি, কারণ আমি যাবার কিছুদিন পরেই তিনি কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যান।
বম্বে টকীজে হিমাংশু রায় ও দেবিকারাণী ছাড়া অন্য বাঙালীও আছে দেখে চমৎকৃত হলাম। সে-রাত্রে একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তার নাম অশোককুমার। অশোক যে বাঙালী তা তখনও জানি না। সে রাজপুত যুবকের সাজপোশাক পরে সামনে এসে দাঁড়াল, হিমাংশু রায় পরিচয় করিয়ে দিলেন। ছিপছিপে গড়ন, সুন্দর মুখ। ক্রমশ জানতে পেরেছিলাম তার স্বভাবটি চেহারার মতোই মধুর।
ন’টা বাজল। শুটিং আরম্ভ হল। সারারাত চলবে। সিনেমার দিবারাত্রি নেই, কৃত্রিম আলোতে ছবি তোলা হয়, একসঙ্গে দেড়শো-দুশো কিলোওয়াটের আলো জ্বলে, রাতকে দিন করে তোলে। আমরা সাড়ে দশটা পর্যন্ত শুটিং দেখে বাড়ি ফিরে এলাম।
দিন দশেক পরে নন্দু আমাদের ঘর-বসত করে দিয়ে মুঙ্গেরে ফিরে গেল। বিরাট বাড়িতে রয়ে গেলাম আমি, গৃহিণী এবং মহাবীর।
মহাবীর আমাদের মুঙ্গেরের বাড়ির পুরনো চাকর। বাবা তাকে মোটা চাকর বলতেন, অর্থাৎ মোটা কাজের চাকর। বাড়িতে সে গরুর জাবনা কাটত, ঘুঁটে দিত, শিলে মশলা বাটত। এখানে এসে সে একাধারে সরু-মোটা চাকর হয়ে দাঁড়াল; বাড়ির যাবতীয় কাজ সে-ই করে, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। গিন্নী কেবল রান্না করেন।
একদিন মহাবীরের একটি নতুন প্রতিভার পরিচয় পেয়ে চম্কে উঠলাম। বিকেলবেলা বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, সন্ধ্যের পর ফিরে এসে দেখি রান্নাঘরে গিন্নী রান্না করছেন, আর মহাবীর দোরগোড়ায় বসে তাঁকে রূপকথা শোনাচ্ছে। মহাবীরের গল্প বলার ভঙ্গি ভাল, স্টাইল আছে। মনে মনে শঙ্কিত হলাম। একই বাড়িতে একজন গল্প-লেখক এবং একজন গল্প-কথকের সহাবস্থান শান্তিপ্রদ না হতে পারে। কোন্ দিন হয়তো মহাবীর আমার গল্পের ভুল ধরতে আরম্ভ করে দেবে।
ইতিমধ্যে আরো অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। বম্বে টকীজ তখন ছিল সর্বজাতির জগন্নাথ-ক্ষেত্র; ইংরেজ-জার্মান-বাঙালী মাদ্রাজী-গুজরাতী-মারাঠী-পাঞ্জাবী-পার্সী, কেউ বাদ পড়েনি। ইংরেজ ছিলেন স্যর রিচার্ড টেম্পল্, ইনি বম্বে টকীজ কোম্পানীর বোর্ড অফ্ ডিরেক্টর্সের একজন সদস্য, স্টুডিওর অফিস-বাড়ির দোতলায় থাকতেন। আমি যখন তাঁকে দেখলাম তখন তাঁর বয়স ষাটের ওপর। এঁর বাবা এক সময় বাংলাদেশের লেফটেনান্ট্ গভর্নর ছিলেন। কিন্তু স্যর রিচার্ডের মেজাজ মোটেই ব্যুরোক্র্যাটের মতো নয়, অত্যন্ত সরল সাদাসিদে প্রকৃতির মানুষ। একেবারে মাটির মানুষ। সম্প্রতি কাগজে দেখলাম, বিলেতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আমার প্রতি এবং আমার স্ত্রীর প্রতি তিনি অত্যন্ত স্নেহশীল হয়েছিলেন, প্রায়ই আমাদের বাড়িতে গল্প করতে আসতেন। মনে হচ্ছে যেন সেদিনের কথা।
আরো কয়েকজন বাঙালীর সঙ্গে পরিচয় হল, সকলেই বম্বে টকীজে কাজ করে। শশধর মুখুজ্জে ছিল স্টডিওর দু’-নম্বর সাউন্ড-রেকর্ডিস্ট, সে আবার অশোকের ভগিনীপতি। জ্ঞান মুখুজ্জে কাজ করত ল্যাবরেটরিতে। পরবর্তীকালে যখন হিমাংশু রায়ের মৃত্যুর পর বম্বে টকীজে ভাঙল ধরল, তখন তারা দু’জনেই চিত্র-পরিচালক হয়েছিল। এই ভাঙা-গড়ার ইতিহাস বড় পঙ্কিল, তাই বাদ দিয়ে গেলাম।
একটি মেয়ের সঙ্গে জানাশোনা হল; হিমাংশুবাবুর ছোট বোন, নাম লীলু। অবিবাহিতা মেয়ে, বম্বের আর্ট স্কুলে পড়ে; বাংলা সাহিত্যের খবর রাখে। হিমাংশুবাবু এবং দেবিকারাণী বাংলা সাহিত্যের খবর রাখতেন না, লীলুই যোগাযোগ ঘটিয়েছিল। মেয়েটি একটু ভাবপ্রবণ, সাহিত্য ও শিল্পকলা নিয়ে মেতে থাকত।
হিমাংশুবাবু আমাকে ছাড়পত্র দিয়েছিলেন, নিয়মিত অফিসে আসবার দরকার নেই, যখন ইচ্ছা আসব। বাড়িতেই কাজ করব, স্টুডিওর গণ্ডগোল থেকে দূরে থাকলেই মাথার কাজ ভাল হবে।
তবু রোজ সকালের দিকে একবার স্টুডিও যাই। হিমাংশুবাবুর অফিসে বসে গল্প করি, শুটিং থাকলে শুটিং দেখি। দেখে দেখে চিত্রের মাধ্যমে কাহিনী বলার শৈলী অনেকটা আয়ত্ত করলাম। বন্ধুবর বীরেন ভদ্র চিত্রনাট্য রচনা সম্বন্ধে একটি ইংরেজি বই দিয়েছিলেন—দি ঘোস্ট গোজ ওয়েস্ট; বইখানি আমার খুব কাজে লেগেছিল, তা থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম।
যাহোক, চিত্র-কাহিনী রচনার কৌশল তো মোটামুটি আয়ত্ত করলাম, এখন ভাবনা হল গল্প লিখব কোন্ ভাষায়। বাংলা লিখলে এখানে কেউ বুঝবে না, অন্য লোক তো দূরের কথা, বাঙালীদের কাছেও বাংলাভাষা মাতৃভাষা নয়, বিমাতৃভাষা। হিন্দীতে লেখা আমার সাধ্যাতীত। একমাত্র উপায় ইংরেজি। যদিও ইংরেজি ভাষায় আমি মহাপণ্ডিত নই, তবু মনের কথা যোগেযাগে প্রকাশ করতে পারব। হাজার হোক, অজস্র ইংরেজি গল্পের বই পড়েছি। গল্প লেখার ভঙ্গিটাও রপ্ত আছে। ভাষা যদি উৎকৃষ্ট নাও হয়, কাজ চালিয়ে নেব। যারা পড়বে তারাও তো ইংরেজিতে আমার মতোই পণ্ডিত।
হিমাংশুবাবুর অফিসে গিয়ে বললাম, ‘ইংরেজিতে গল্প লিখব ঠিক করেছি।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে তো ভালই হয়। নিরঞ্জন পালও ইংরেজিতে লিখতেন।’
নিরঞ্জন পাল ছিলেন বম্বে টকীজের সাবেক গল্প-লেখক, অছুৎকন্যা জীবনপ্রভাত প্রভৃতি তাঁরই লেখা। হিমাংশু রায়ের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় তিনি বম্বে টকীজের কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি কিছুদিন আগে মারা গেছেন, তাঁর ছেলে কলিন পাল এখনো সিনেমার সঙ্গে জড়িত আছে।
আমি মিঃ রায়কে বললাম, ‘আমি চিত্রনাট্য লেখার জন্যে তৈরি হয়েছি, কী গল্প লিখব বলুন।’
নিজের ইচ্ছামত গল্প লিখলে চলবে না। যিনি ছবি করবেন তাঁর মনের মতো হওয়া চাই।
মিঃ রায় বললেন, ‘‘বচন’ শেষ হতে মাসখানেক দেরি আছে। এর মধ্যে আপনি গল্প শেষ করতে পারবেন?’
বললাম, ‘পারব। কিন্তু কোন ধরনের গল্প আপনি চান সেটা জানা দরকার।’
তিনি বললেন, ‘আপনি দু’চারটে গল্প আমাকে শোনান, তার মধ্যে যেটা পছন্দ হবে আমি বেছে নেব।’
বললাম, ‘বেশ। কাল আমি আপনাকে কয়েকটা গল্পের আইডিয়া শোনাব।’
সেদিন বিকেলবেলা লীলু আমাদের বাড়িতে এল। বলল, ‘দাদার কাছে শুনলাম, আপনি গল্প লেখার জন্যে তৈরি হয়েছেন। তা ‘বিষের ধোঁয়া’র গল্পটাকে চিত্রনাট্য করুন না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, “বিষের ধোঁয়া”! কিন্তু তাতে তো ছুরি-ছোরা-গোলা-গুলি-নারীহরণ এসব কিছুই নেই।’
লীলু বলল, ‘তা হোক। আপনি লিখুন। নতুন জিনিস হবে। আমি দাদাকে গল্প শুনিয়েছি। তাঁর ভালই লেগেছে।’
লীলুর দেখলাম খুবই উৎসাহ, কিন্তু আমার মনটা সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে রইল। নিরামিষ গার্হস্থ্য উপন্যাস কি অ-বাঙালীদের ভাল লাগবে?
পরদিন অফিসে মিঃ রায়কে আমার সংশয়ের কথা বললাম। তিনি বেশী উৎসাহ দেখালেন না। নিরুৎসাহও করলেন না, বললেন, ‘আপনি লিখতে আরম্ভ করে দিন, তারপর দেখা যাবে।’
বিকেলবেলা পেরেরা একটা টাইপ-রাইটার, রাশীকৃত ছাপার কাগজ ও কার্বন পেপার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল।
সুতরাং তোড়জোড় করে লেখা আরম্ভ করে দিলাম, একেবারে ছাপার অক্ষরে, টাইপ-রাইটার চালানোর অভ্যাস আগে থাকতেই ছিল। মনে মনে হিসেব করে নিলাম, রোজ যদি তিন পাতা লিখি তাহলে এক মাসে সীনেরিও শেষ করতে পারব।
এক মাসের মাথায় সীনেরিও শেষ হল। ওদিকে ‘বচন’-এর শুটিংও শেষ হয়েছে, শিগ্গিরই রিলিজ হবে। মিঃ রায় তাই নিয়ে খুব ব্যস্ত। আমি তাঁকে বললাম, ‘লেখা শেষ করেছি। কবে শুনবেন বলুন?’
তিনি বললেন, ‘এখন নানা ঝামেলার মধ্যে রয়েছি, একটু ফুরসৎ পেলেই আপনাকে খবর দেব।’
পরদিন দুপুরবেলা পেরেরা এসে খবর দিয়ে গেল, মিঃ রায় তিনটের সময় গল্প শুনতে বসবেন, আমি যেন ঠিক সময় স্টুডিওতে যাই। পৌনে তিনটের সময় গাড়ি আসবে।
যথাসময়ে গল্পের ফাইল নিয়ে উপস্থিত হলাম। দেখলাম, শ্রোতা শুধু মিঃ রায় নন, সেই সঙ্গে আর একজন আছেন—যমুনাস্বরূপ কশ্যপ।
যমুনাস্বরূপ কশ্যপের নাম সম্প্রতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, বিলিতি ছবি নাইন আওয়ারস টু রাম-এ মহাত্মা গান্ধীর চরিত্র অভিনয় করে তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছেন। তখন তিনি ছিলেন বম্বে টকীজের হিন্দী সংলাপ-লেখক ও গীতকার। কশ্যপ অদ্ভুত সংলাপ লিখতে পারতেন। কিন্তু একবার লিখতে আরম্ভ করলে সহজে থামতে পারতেন না, অতি কষ্টে তাঁকে সংযত করে রাখতে হতে। পরম হাস্যরসিক এই মানুষটিকে অনেক দিন পরে সেদিন দেখলাম। বুড়ো হয়েছেন বটে, কিন্তু মনের রস এখনো অক্ষুন্ন আছে।
যাহোক, একটি নিভৃত কক্ষে আমরা তিনজনে বসলাম। গল্প পড়া আরম্ভ হল। কেউ অবান্তর কথা বললেন না, নিবিষ্ট মনে শুনলেন। মাঝে মাঝে চা-কফি-বিস্কুট আসতে লাগল। ঘণ্টা তিনেক পরে গল্প পড়া শেষ হল।
ঘর তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। তিনজনে চুপ করে বসে আছি, কারুর মুখে কথা নেই। শেষে আমিই প্রশ্ন করলাম, ‘কেমন শুনলেন?’
কশ্যপ গলার মধ্যে পাঁচমিশেলি আওয়াজ করলেন, তারপর ‘কাল সকালে কথা হবে’ বলে চলে গেলেন। তিন মাটুঙ্গায় থাকেন। ট্রেন ধরতে হবে।
দু’জনে মুখোমুখি বসে আছি। আমার রসনা তিন ঘণ্টা সচল থাকার পর একটু ক্লান্ত। মিঃ রায় কী ভাবছেন তিনিই জানেন। এক মাসের পরিশ্রম নষ্ট হল এই ভেবে আমার মনটা দমে যাচ্ছে।
বললাম, ‘কি ভাবছেন?’
মিঃ রায় নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘অস্টেনকে গল্পটা বোঝাতে হবে। কিন্তু সে তো ভাল ইংরেজি জানে না। তাই ভাবছি কি করা যায়।’
বুঝলাম, নিজের অভিমত প্রকাশ করার আগে তিনি চিত্র-পরিচালক অস্টেন সাহবের মতামত জানতে চান। খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু গল্প এবং অস্টেন সাহবেরে মাঝখানে ভাষার দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান। আমি একটু চিন্তা করে সঙ্কুচিতভাবে বললাম, ‘গল্প যদি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করানো যায়, অবশ্য তাতে খরচ অনেক—’
মিঃ রায় চকিত হয়ে আমার মুখের পানে চাইলেন, খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ‘মন্দ কথা নয়। একটি জার্মান মেয়ে আছে, অবস্থা ভাল নয়, কিন্তু ভাল ইংরেজি জানে। দু’তিনশো টাকা পেলে সে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে দেবে।’
মিঃ রায় পেরেরাকে ডাকলেন। আমি কতকটা আশ্বস্ত হয়ে ফিরে এলাম।
তারপর দিন কয়েক ‘বচন’-এর রিলিজ নিয়ে হুড়োহুড়ির মধ্যে কেটে গেল। বম্বের ‘রক্সি’ সিনেমায় ‘বচন’-এর উদ্বোধন হল। আমরা স্টুডিওসুদ্ধ লোক উদ্বোধনে উপস্থিত। লোকে লোকারণ্য, ছবি দেখানোর অনেক আগেই টিকিট-বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে; বোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে—হাউস ফুল!
ছবি কিন্তু বেশী দিন চলল না।
হিমাংশু রায় যখন বুঝতে পারলেন যে ছবিটা দীর্ঘায়ু হবে না, তখন তিনি যত শীঘ্র সম্ভব নতুন ছবি তৈরি করার জন্যে প্রস্তুত হলেন। পর পর তিনটি ছবি মার খেয়েছে, এবার ভাল ছবি তৈরি না হলে বম্বে টকীজ ডুববে।
হিমাংশু রায় বোধহয় মনে মনে ‘বিষের ধোঁয়া’র গল্প পছন্দ করেননি। কিন্তু পর পর তিনবার মার খেয়ে তাঁর আত্মবিশ্বাস অনেকখানি কমে গিয়েছিল; বিশেষত তখন ‘বিষের ধোঁয়া’ ছাড়া অন্য কোনও গল্প তাঁর হাতে ছিল না। তাই লীলুর সনির্বন্ধ প্ররোচনায় তিনি ‘বিষের ধোঁয়া’ তুলে নিলেন। আমার চিত্রনাট্য থেকে শুটিং স্ক্রীপ্ট লিখতে শুরু করে দিলেন।
বম্বে টকীজের ছবি তৈরি করার পদ্ধতি ছিল এই রকম : মূল লেখক গল্প ও সীনেরিও লিখবে, সংলাপ-লেখক হিন্দীতে সংলাপ লিখবে, হিমাংশু রায় শুটিং স্ক্রীপ্ট লিখবেন, সেই স্ক্রীপ্ট সামনে রেখে ফ্রান্জ্ অস্টেন ছবি তুলবেন। এই চারজনের মধ্যে হিমাংশু রায়ের ভূমিকাই প্রধান। গল্প যেমনই হোক, হিমাংশু রায় যে স্ক্রীপ্ট লিখবেন তাই হবে চরম, অর্থাৎ ফাইনাল। তিনিই ছবির স্রস্টা, অন্য সবাই তাঁর সহযোগী মাত্র।
একদিন ফ্রান্জ্ অস্টেন আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আপনার গল্পের অনুবাদ আমি পড়েছি। আমার খুব ভাল লেগেছে। যদি রায় ভাল স্ক্রীপ্ট লিখতে পারে, ভাল ছবি হবে।’
মন উল্লসিত হয়ে উঠল।
কিন্তু মনের উল্লাস বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না। মিঃ রায়ের অফিস-ঘরে গিয়ে দেখলাম একটি যুবক তাঁর সঙ্গে বসে গল্প করছে। বেশ চটপটে স্মার্ট পাঞ্জাবী যুবক। মিঃ রায় পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ইনি মিঃ বেরী। পাঞ্জাবে একটি ইংরেজি সিনেমা-পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, এখন বম্বে টকীজের পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে ওঁকে নিয়োগ করেছি।’
মিঃ বেরীর সঙ্গে শেকহ্যান্ড করলাম।
মিঃ রায় একটু অপ্রস্তুতভাবে বললেন, ‘মিঃ বেরীকে ‘বিষের ধোঁয়া’র চিত্রনাট্য পড়তে দিয়েছিলাম।
মিঃ বেরী বললেন, ‘আমি পড়েছি। গল্প ভালই, তবে কি জানেন, গল্পের মধ্যে সিনেমা মীট নেই।’ তাঁর কণ্ঠস্বরে মুরুব্বিয়ানার আমেজ।
মিঃ রায়ের দিকে তাকালাম, ‘সিনেমা মীট কী বস্তু?’
মিঃ বেরীই উত্তর দিলেন, ‘সিনেমা মীট বুঝলেন না? প্যাশন, টেনসন, রোমান্স, ডেরিং-ডু—এই সব। আপনার গল্পে এসব কিছু নেই। আমার বিশ্বাস এ গল্প সিনেমায় চলবে না।’
মিঃ রায়কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারও কি তাই মত?’
মিঃ রায় উদ্বিগ্নভাবে সিগারেট টানতে টানতে বললেন, ‘এখন তো আর অন্য গল্প ধরবার সময় নেই, কাজ আরম্ভ করে দিয়েছি। ‘বচন’ চলল না। সাত দিনের মধ্যে নতুন ছবির শুটিং শুরু করতে হবে।’
সাত দিনের মধ্যে শুটিং শুরু হবে, অতএব ছবির পাত্র-পাত্রী স্থির করা দরকার। মিঃ রায় বললেন, ‘দেবিকা আর অশোক ক্রমাগত ছবির পর ছবি প্লে করে যাচ্ছে, ওদের এবার বিশ্রাম দরকার। নতুন আর্টিস্ট দিয়ে ছবি করব।’
সুতরাং প্রোডাকশন ম্যানেজার মিঃ আচারিয়া আর্টিস্টের খোঁজে বেরুলেন। বম্বে টকীজে অবশ্য মাইনে-করা বাঁধা আর্টিস্ট আছে, হিরো-হিরোইন অশোক ও দেবিকা ছাড়াও গৌণ চরিত্রাভিনেতা পিঠাওয়ালা, মমতাজ আলি, মায়া, মীরা, সরোজ বোরকর ইত্যাদি। তাদের দিয়েই মোটামুটি কাজ চলে যেত। কিন্তু এখন নতুন হিরো-হিরোইন চাই, গৌণ চরিত্রের জন্যেও আরো লোক দরকার। ‘বিষের ধোঁয়া’য় কিশোর, সুহাসিনী, বিনয়বাবু, দীনবন্ধু, অনুপম, করবী, হেমাঙ্গিনী—অনেকগুলি বড় বড় চরিত্র আছে।
কাতারে কাতারে আর্টিস্ট আসতে লাগল। মিঃ রায় তাদের সঙ্গে কথা বলতেন, আমি বসে বসে শুনতাম। তখনকর দিনে বম্বে টকীজের প্রচণ্ড নাম-ডাক, তার পতাকাতলে অভিনয় করবার জন্যে সকলেই উৎসুক।
হিরোর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্যে একটি যুবককে মিঃ রায় নির্বাচন করলেন, তার নাম জয়রাজ। মুখশ্রী এমন কিছু আহা-মরি নয়, দৃঢ় স্বাস্থ্যের লাবণ্যে আপাদমস্তক ভরপুর। সে অনেক স্টান্ট ছবিতে হিরোর পার্ট করেছে, অনেক মারামারি কাটাকাটি করেছে, কিন্তু ভদ্র ছবিতে কখনও অভিনয় করেনি। বম্বে টকীজের ছবিতে হিরোর পার্ট পেয়ে সে কৃতার্থ হয়ে গেল।
একে একে সব ভূমিকার জন্যে আর্টিস্ট জোগাড় হল। হিরোইন হবেন রেণুকা দেবী, করবী—মীরা, বিমলা—মায়া, দীনবন্ধু—পিঠাওয়ালা। কেবল বিনয়বাবুর ভূমিকার জন্যে মনের মতো লোক পাওয়া গেল না। বিনয়বাবুর মতো সরল পণ্ডিত পাগলাটে প্রফেসরের ভূমিকায় অভিনয় করা যার-তার কাজ নয়। একাধারে হাস্যরসিক এবং অভিনেতা হওয়া চাই।
আমার মনে শান্তি নেই। আমার প্রথম ছবি হবে, তার প্রধান ভূমিকাগুলিতে নতুন লোক। ওরা কি পারবে? যদি না পারে, যদি ছবি ফ্লপ করে, সবাই গল্পের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেবে। আমি মারা পড়ব।
অস্থির মন নিয়ে সেদিন বিকেলবেলা স্টুডিওতে গেলাম। মিঃ রায় আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর অফিস-ঘরে গিয়ে দেখলাম তিনি একলা বসে সিগারেট টানছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘বসুন। আপনি ঘাবড়ে গেছেন মনে হচ্ছে। ভয় পাবেন না। আমি আর অস্টেন চিরকাল নতুন আর্টিস্ট নিয়ে কাজ করেছি, আর্টিস্ট তৈরি করেছি। অশোক আর দেবিকাও একদিন নতুন আর্টিস্ট ছিল।— যাই হোক, একজন আনকোরা নতুন আর্টিস্ট জোগাড় করেছি। তাকে দেখবেন?’
‘দেখব। কোন্ ভূমিকার জন্যে?’
‘আগে দেখুন তো।’
মিঃ রায় পেরেরাকে ডেকে বললেন, ‘দেশাইকে পাঠিয়ে দাও।’
অল্পক্ষণ পরে একটি মূর্তি এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। দোহারা বেঁটে-খাটো চেহারা। ধবধবে ফরসা রঙ, গোল মুখের ওপর গোল চশমা। পিট্-পিট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে ভাঙা-ভাঙা গলায় বলল, ‘নমস্তে।’
আমি হেসে উঠলাম, ‘আরে, এ তো বিনয়বাবু।’
হিমাংশুবাবুও মুচকি হাসলেন, ‘হ্যাঁ, ওকে বিনয়বাবুর পার্ট করবার জন্যে নিয়েছি। এই প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবে। কেমন মনে হচ্ছে?’
‘ভাল। চেহারায় অবিকল বিনয়বাবু। যদি অভিনয় করতে পারে—’
‘অস্টেন আছে, অভিনয় করিয়ে নেবে।’
সেদিন প্রফুল্লমনে বাড়ি ফিরলাম। মনে হল দৈব অনুকুল, নইলে দেশাইয়ের মতো একটা জলজ্যান্ত বিনয়বাবু কোথা থেকে এসে জুটল?
সাত দিন পরে শুভদিনে মহরৎ করে শুটিং আরম্ভ হয়ে গেল।
যদিও আমার কাজ ছিল কেবল গল্প লেখা, ছবি তৈরি করার কোনও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার ছিল না, তবু একটা বিষয়ে আমি জোর করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, চরিত্রগুলিকে বাঙালী সাজপোশাক পরাতে হবে; অর্থাৎ ধুতি-পাঞ্জাবি। সেখালে বিলিতি সাজপোশাক পরার রীতি বম্বে টকীজে চালু ছিল। মিঃ রায় প্রথমে নানারকম আপত্তি তুলেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে গেলেন।
ছবির নাম হল—ভাবী। অর্থাৎ, বউদি। কশ্যপ নাম রেখেছিলেন। খুব লাগসই নাম হয়েছিল।
শুটিং চলতে লাগল। আমি মাঝে মাঝে সেটে গিয়ে বসি, ফ্রান্জ্ অস্টেনের পরিচালনা দেখি। লোকটির পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা অদ্ভুত। বাঙালী মেয়েরা কি ভাবে শাড়ি পরে তা তিনি জানেন, তারা কেমন করে পান সেজে পানু মুখে দেয়, তাও তাঁর অজানা নয়। প্রত্যেক আর্টিস্টের কাছ থেকে ষোল আনা কাজ তিনি আদায় করে নিতে পারনে, যতক্ষণ না ষোল আনা কাজ আদায় হয় ততক্ষণ আর্টিস্টের নিষ্কৃতি নেই। একবার একটি ভারি মজার ব্যাপার দেখেছিলাম।
যে মেয়েটি বিমলার ভূমিকা করছে তার নাম মায়া; একটি দৃশ্যে তাকে কাঁদতে হবে। তাকে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানো হল; মিঃ অস্টেন তাকে কান্নার ভঙ্গিটা অভিনয় করে দেখিয়ে দিলেন। মায়া কান্নার ভঙ্গিটা ঠিকই করল, কিন্তু তার চোখ দিয়ে জল বেরুল না। অস্টেন সাহেবের হুকুম চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চাই। মায়ার চোখে জল নেই দেখে তিনি খুব খানিকটা তর্জন-গর্জন করলেন, কিন্তু কোনও ফল হল না; তখন তিনি দুই হাত উর্ধ্বে আস্ফালন করে জার্মান ভাষায় গালমন্দ দিলেন; তবু মায়ার চোখ দিয়ে একফোঁটা জল বেরুল না। অস্টেন মোটা একটা লাঠি এনে তার মাথার ওপর ঘোরাতে লাগলেন, কিন্তু মায়ার চোখ মরুভূমি। অস্টেন লাঠি ফেলে দিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘কাঁদবে না? আচ্ছা মজা দেখাচ্ছি। তুমি এইখানে দাঁড়িয়ে থাক, তোমার মুখের ওপর ক্যামেরা চালু করলাম যতক্ষণ না চোখ দিয়ে জল বেরোয় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাক।—চালাও ক্যামেরা।’
ক্যামেরা চলল। এক মিনিট, দু’মিনিট; প্রতি মিনিটে নব্বই ফুট ফিল্ম খরচ হয়ে যাচ্ছে। আমরা স্টুডিওসুদ্ধ লোক একদৃষ্টে মায়ার মুখের দিকে চেয়ে আছি। পাঁচ মিনিট পরে মায়ার চোখ দুটি একটু ঝাপ্সা হয়ে গেল। তারপর দরদর ধারায় চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
আমরা সমস্বরে জয়ধ্বনি করে উঠলাম।
১৯৬৪