2 of 3

চর, শহর এবং একটি বেকুফ

চর, শহর এবং একটি বেকুফ

দিনরাত এখানে হাওয়া উথালপাথাল হয়। চিকন বালির সর গায়ে মেখে পাক খায় নিচু আকাশে। সূর্যের কড়া টানে ঝুরু-ঝুরু হয়ে গিয়েছে চরের বালি। কাশ আর বুনো ঝোপে ছেয়ে গেছে চওড়া নদীর বুক। শুধু এক পাশে, সেই সে-পাড়ে, পঞ্চাশ গজ চওড়া একটা জলের ধারা তিরতিরিয়ে। বয়ে যায় বাংলাদেশের দিকে। ওপারের গরু হেঁটে পেরিয়ে আসে এদিকের চরে। স্বচ্ছন্দে।

দুই মাইল চওড়া এই নদী সেদিনও পৃথিবী কাঁপাতো। ছ-মাস নিরীহ সাপের মতো গা এলিয়ে যে ঘুমুতো, তার গায়ে খুঁটি পোতার সাহস হয়নি কারো। যেই বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল, পাহাড়ে নাচন শুরু হল বর্ষার, সঙ্গে-সঙ্গে নদী দাঁড়াতো ফণা তুলে। তারপর ছোবল আর ছোবল। দু-মাইল চওড়া। ঘোলা জল দিনরাত গর্জে উঠত আর পাশের শহরটার প্রাণ সেই শাসানিতে হয়ে থাকত আধমরা। হঠাৎ একদিন জলগুলো নদী ছেড়ে উঠে এল দুই পাড়ে। দুমড়ে মুচড়ে শহরটাকে ভেঙে ছুঁড়ে ফেলে নেমে গিয়েছিল আবার। লোকে বলল, প্রলয়, মহাপ্রলয়। মানুষ মরল, সম্পত্তি গেল, অতবড় শহরটাকে মৃত্যুপুরীর মতো দেখাচ্ছিল।

ব্যাস, সঙ্গে-সঙ্গে নদীর দাঁত ভাঙার কাজ শুরু হয়ে গেল। আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হল নদীটাকে। সেই পাহাড়ের তলা থেকে বোল্ডার সাজানো হল, বাঁধ তোলা হল শহরের খানিক ওপর থেকে। ফণা তোলার আগেই কোমরে ঠিকঠাক ঘা মেরে রাখা হল। পোষা কুকুরের মতো তখন ওই পঞ্চাশ গজে জল নেমে যায় বাংলাদেশের দিকে।

আশ্চর্য, নদী এই বাঁধন মেনেও নিল। আর তার ফণা নেই, নেই ফোঁসফোঁসানি। যদি কিছু বাড়তি জল বর্ষায় নেমে আসে তা চালান করে দেয় অন্য দিকে। পাহাড়ের গা থেকেই আর একটা ধারা অন্য দেশ অন্য গ্রাম দিয়ে বয়ে যায়। তাই শহরের মানুষ নিশ্চিন্ত। আর দিনের পর দিন বয়ে যাওয়া জল ক্রমাগত বালি ফেলে-ফেলে চরের শরীর মোটা করেছে। নদী তাই নিজের বালি নিজেই অতিক্রম করতে পারে না। পঞ্চাশ গজেই প্রাণভোমরা ধুকপুক করে।

শহরটা কিন্তু চটপট নিজেকে সারিয়ে নিল। বেশ রঙচঙে হয়ে উঠেছে আবার। সেখান থেকে একটা লোক একদিন উঠে এল বাঁধে। উঠে জরিপ করল নদীর বুক। তারপর পেছন ফিরে চিৎকার করল শহরটার উদ্দেশ্যে। তার ঝুপড়িটা ভেঙে দিয়েছে নগরপাল। ঘর ভাড়া পাওয়া ওখানে স্বপ্নের মতো ব্যাপার। শুধু দিনমজুরি করে যাও, তা বেশ, কিন্তু রাত্তির বেলায় ফুটপাতে থাকা যাবে না। একটা ভিখিরিকেও এই শহরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। ঝুপড়ি ভেঙে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জেলখানায়। তিনদিন বেদম পিটুনি দিয়ে বলে দেওয়া হয়েছে ঘর ভাড়া নিয়ে। থাকো। পকেটে যার টাকা নেই তাকে কে দেবে ঘর! অন্য মজুররা ওই ভিনদেশিকে দেয়নি ঠাঁই। ফলে লোকটা উঠে এল বাঁধে। এসে বলল, শহরের মুখে আমি ইয়ে করি।

লোকটা বালির মধ্যে হেঁটে বেড়ালো কিছুক্ষণ। তারপর কয়েকটা বাঁশ আর দরমা দিয়ে তৈরি করে নিল মাথা গোঁজার জায়গা। নিচু হয়ে ঢুকতে হয় কিন্তু জানালা কেটে নিল সে। ফুরফুরে বাতাস ঢুকতে লাগল অবিরত।

আর তাই দেখে শহরের লোক উঠল আঁতকে। একি পাগল! ওই সাপের গালে গাল রেখে কেউ ঘুমাতে পারে? খবরটা পৌঁছালো নগরপালের কাছে। তাঁরা কাগজ নেড়ে দেখলেন নদীর চর। শহরের সম্পত্তি নয়। অতএব যে মরতে চায় সে মরুক, শহরের লোকের তাতে কি যায় আসে! অতএব তিনমাসের মধ্যেই চালার গায়ে লতানো গাছের কচিপাতা বাতাসে দোল খেতে লাগল। সারাদিনে ম জ্বরের কাজ সেরে বিকেলে ফিরে যায় তোকটা চালায়। শহরের লোক ভুলেও চরে পা দিত না। দূরের বাঁধে দাঁড়িয়ে তারা চালাটাকে দেখত আর হাসত। লতানো গাছে কী যেন একটা ফলও ফলিয়েছে লোকটা। খবরটা শহরের নিচুতলায় পৌঁছে গেল। যারা কোনওমতে ঘর। জোগাড় করে আধপেটা খেয়ে পড়েছিল তাদের দু-জন সাহস পেল। কোনওরকমে আর একটা চালা তৈরি করে নিল খানিক তফাতে। তবে সে কিনা সংসারী মানুষ, বউ বাসন মাজে বাড়ি বাড়ি। দ্বিতীয় লোকটা অবশ্য সেই পয়সার খায় না। তার গাঁজার মশলার হাত চমৎকার। এরকম একটা নির্জন চরে ব্যাবসা জমে গেল খুব। সন্ধে হলেই শহরের ছোঁকরারা বাঁধ পেরিয়ে নেমে আসে গাঁজার টানে। অবশ্য বউটি ফিরে এলেই হাওয়া হয়ে যায় বাউন্ডুলেরা। তখন চড়চাপড় পড়ত সেঁজেলের ওপরে। প্রথম লোকটা শেষে চিৎকার করে বলেছিল, আই, যা কিছু ঝামেলা শহরে গিয়ে করবি, এই চরে যেন কোনও শব্দ না হয়। লোকটার বিশাল চেহারা, একমুখ দাড়ি দেখে ভয় পায় এরা।

তারপর একদিন মেঘ পাক খায় আকাশে। ফিনকি দিয়ে জল ঝরতে থাকে। দ্বিতীয়জনের বউ ছুটে যায় প্রথমজনের কাছে, কী হবে, বর্ষা এল যে!

লোকটা হাত ঘোরায়, যা ভাগ! বৃষ্টি দেখতে দে। ভয় তো এলি কেন? গায়ে পড়া ভাবটা একদম সহ্য হয় না তার। বউটা দুতিনদিন চেষ্টা করেছিল ভালোমন্দ খাওয়ার পাঠিয়ে দিয়ে ভাব জমাতে। যেমন আছ তেমন থাকো, অত গা শোঁকাশোঁকির কী দরকার? সেঁজেলের খদ্দের কমেছে। বৃষ্টিতে চরে আসতে ভয় পায় সবাই। বউটা একটু নরম হয়েছে যদিও কিন্তু হঠাৎ। জলের ভয় ধরেছে গেজেলেরও মনে। কিন্তু নদীটা যেন চিরে গেল হঠাৎ। ওপাশে ছিল পোষা কুকুরের মতো, একটা ধারা হঠাৎ এপাশে এসে গেল বর্ষার জল পেয়ে, কিন্তু স্বভাব হল আদুরে বেড়ালের। মাঝখানের চরটা উঁচু হয়ে শক্ত বালি আর দুটো চালা নিয়ে হাওয়া খেতে লাগল বেশ। এখন বেশ সুবিধে হয়েছে বউটার। জলের ধারায় গা ডুবিয়ে স্নান করে। চরের দিকে ফিরে বুকের কাপড় ছাড়ে। লোকটাকে চোখ বন্ধ করতে হয়। ছুটে গিয়ে শাসায় গেঁজেলটাকে, ভালোভাবে যদি এখানে না থাকো তাহলে উড়িয়ে দেব চালা।

গেঁজেলটা বুঝতে পারে না কিন্তু বউটা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, ঢং।

একটা বর্ষা ফুরোলেই শুকনো বালি ওড়ে হাওয়ায় আর দুটো রিকশাওয়ালা নেমে আসে চরে। তাদের ডেরা ভেঙেছে নগরপাল। সুন্দর উদ্যান হবে সেখানে। এসে জিজ্ঞাসা করে প্রথমজনকে, এখানে ঘর তুলব? শহরে থাকার জায়গা নেই।

লোকটা মাথা নাড়ে, নিশ্চয়ই-নিশ্চয়ই। তবে আমার চালা থেকে তফাতে। আঁটোসাঁটো চালা বানায় তারা। তাই দেখে ভরসা বেড়ে গেল শহরের নড়বড়ে আধ-পেটাদের। তিনমাস না ঘুরতে পনেরো ঘর বাসিন্দা হয়ে গেল চরের। বালির ওপর বুনো ঘাস গজাচ্ছে, নধর লতানো গাছে। চালাগুলো ছেয়ে যায়। আর একটা চালায় রেডিও বাজে সারাক্ষণ। তবে লোকটা ফিরে এলেই তার গলা নেমে যায়। শহরের লোক সকাল বিকেল বাঁধে বেড়াতে এসে বলাবলি করে, সাহস খুব। একটা বর্ষা কোনওমতে কেটেছে কিন্তু পরের বর্ষার নদী খেপলে দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে। ব্যাটারা। নদীর স্বভাব জানে না এই পরগাছাগুলো। কিন্তু একদিন দারোগাবাবু এলেন চারজন। পুলিশ পেছনে নিয়ে। বাঁধ থেকে বালিতে পা উঠিয়ে চালা অবধি হেঁটে এসে হাঁক দিলেন, এই, তোদের মোড়ল কে? সর্দার কোন হ্যায়?

গেঁজেলটার বউ আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল আলাদা চালাটাকে। দারোগা তার সামনে গিয়ে গর্জন করল, কে আছিস বেরিয়ে আয়!

সারাদিন খেটেখুটে লোকটা তখন সবে শুয়েছিল, অবাক হয়ে বেরিয়ে এসে দেখল পুলিশ। তুই এই চরের মোড়ল?

লোকটা ঠোঁট নাড়ল। সে মোড়ল হতে যাবে কেন? সে কারও সাতে-পাঁচে থাকে না।

পিছন থেকে বউটা চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাঁ বাবু ও মোড়ল।

শোন। এই চর তোমাদের ছাড়তে হবে। দারোগাবাবু হুকুম করলেন।

ছাড়তে হবে? লোকটার চোখ ছোট হল, কেন? অপরাধটা কী?

এই চরে লোক বাড়ার পর থেকে শহরে চুরিচামারি বেড়ে গেছে। লোকে বলছে চরের লোকই রাতে শহরে চুরি করতে যায়। এটা বেআইনি বসতি অতএব উঠে যাও তোমরা। আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। দারোগাবাবু লাঠি নাচালেন।

লোকটা মাথা চুলকালো, অভয় দেন তো একটা কথা বলি।

কী?

আপনার হাতে খারাপ ফোঁড়া হয়েছে।

আমার হাতে? দারোগাবাবু হকচকিয়ে দুটো হাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে-দেখতে বললেন, কই, নেই তো! ইয়ার্কি হচ্ছে হারামজাদা শুয়ার–!

লোকটা হাতজোড় করল, অভয় দিয়েছেন তাই বললাম। হুজুর, খারাপ ফোঁড়ার কথা শুনেই আপনি সেটাকে ডাক্তার দেখাতে গেলেন না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন ঠিক কিনা? তাই তো?

কী বলতে চাস?

হুজুর ভালো করে দেখুন, এখানকার কেউ চুরি করে কিনা। সত্যি হলে আমি তাকে আপনার হাতে তুলে দেব।

দারোগাবাবু হাসলেন, বুদ্ধিমান লোক মনে হচ্ছে। বেশ, ধরতে পারলে আমি সব চালায় আগুন ধরিয়ে দেব, মনে রাখিস।

দারোগাবাবু চলে গেলে আনন্দিত লোকগুলো ঘিরে ধরল লোকটাকে, দাদা, তুমি বাঁচালে এ যাত্রা। তোমাকে আমরা সবাই মোড়ল বলে মেনে নিলাম।

লোকটা হুংকার দিল, ভাগ শালারা। আমাকে একা থাকতে দে।

লোকগুলো হেসে বলল, দাদার মন সরল, ঠিক সন্ন্যাসীর মতো।

লোকটা চেঁচাল, দারোগা কী বলে গেল সবাই নিশ্চয় শুনেছ। চোর-ছ্যাঁচোর এখানে থাকতে পারবে না বলে দিচ্ছি।

লোকগুলো হেসে উঠল, তারপর ফিরে গেল যে যার ডেরায়। এই সময় একটি স্ত্রীলোক এগিয়ে এল হেলতে দুলতে। তার শরীর ভারি এবং চোখ চড়ুইপাখির মতো উড়ছে বসছে। এসে বলল, চুরিচামারি মানে কী?

লোকটা নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে ফিরে তাকাল, এটা আবার কে?

দ্বিতীয়জনের বউ এগিয়ে এল পাশে, আমার বোন। এখন থেকে এখানে থাকবে।

অ। তা বোনকে চুরির মানে শিখিয়ে দাও।

আহা, তুমিই বলোনা শুনি। হুকুম করলে, চোর-ছ্যাঁচোর থাকতে পারবে না। তা চুরি করা কাকে বলে সেটা বলে দাও। মেয়েটি চোখ ঘোরাল।

অন্যের জিনিস না বলে নিলে চুরি করা হয়। লোকটি ভেবেচিন্তে জবাব দিল।

সঙ্গে-সঙ্গে খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটি। তারপর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, কেউ যদি জিনিসটা হারিয়ে ফেলে, আর একজন যদি তা টুক করে তুলে নেয়?

সেটাও চুরি বলে। লোকটা গম্ভীর গলায় জবাব দেয়।

তাই? চোখ ঘোরাল মেয়েটা, তাহলে তো চোর খুঁজতে যেতে হয়।

মানে?

আমার একটা জিনিস যে চুরি গেছে।

কী জিনিস?

আঙুল তুলে ধীরে-ধীরে বুকের ওপর রাখল মেয়েটা। রেখে হেসে উঠল উচ্চস্বরে। সঙ্গে-সঙ্গে তার বোন আঁতকে উঠল, ওমা, কখন?

ওই যে, যখন দারোগার সঙ্গে কথা বলছিল। কী চমত্তার কথা বলে, না দিদি?

লোকটা আর অপেক্ষা করল না। চালায় মাথা নামাবার আগে চিৎকার করল, ওসব ছেনালি কথাবার্তা আমার কাছে বলে সুবিধে হবে না। আমি মেয়েমানুষের ছায়া মাড়াই না।

সঙ্গে-সঙ্গে হাসির ফোয়ারাটাকে তুলে নিল হাওয়া, সমস্ত চরময় ছড়িয়ে দিল যেন।

নদীর বুকে বালি জমে যাওয়ায় খালটার অবস্থা কাহিল। শহরের ঠিক মাঝখান দিয়ে খালটা বয়ে যেত। জল গিয়ে পড়ত নদীর বুকে। সেই মহাপ্রলয়ের সময় এই খালটাকেও সঙ্গী হিসেবে। ব্যবহার করেছিল নদী। নিজের জল উজিয়ে দিয়েছিল খালের বুকে। শহরের মানুষ সে রাস্তাও বন্ধ করেছে বাঁধ বেঁধে। ঠুটো জগন্নাথ হয়ে গেছে লম্বা খালটা। একটু-একটু করে মজে গেছে জল, তলায় শ্যাওলারা পর্যন্ত অখুশি এখন। গেল বিজয়ার ভাসান পর্যন্ত নৌকোয় চেপে হয়নি খালের বুকে। একটা মরা আঁশটে গন্ধ ছড়ায় খালটা সারাদিন। শহরের মাতব্বররা বলল, এভাবে খালটাকে মেরে ফেলা ঠিক নয়। বেশ টলটলে জল থাকবে, নৌকো চলবে। হাউসবোট ভাসলে লোকে বেড়াতে আসবে এখানে, শহরটারও ইজ্জত বাড়বে। নানারকম ফন্দিফিকির চলতে লাগল খাল উন্নয়নের জন্যে কিন্তু কোনও রাস্তা বের হয় না। খালের সামান্য ঘোলাটে জল বাঁধের গায়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। বাঁধের ওপাশে বালির চর। তার বহুদূরে নদীর ধারাটি বয়ে যায়। আগের মতো খাল তার বুকে মুখ ডোবাতে পারে না। এমন কি তার শরীরের মাছগুলো গত গ্রীষ্মে পেট উলটে ভেসে উঠেছে। এখন চওড়া খালের ওপরের সুন্দর সেতুগুলোকে কেমন ন্যাড়া-ন্যাড়া দেখায়।

তবে এটা ঠিক, খালটা শহরের লোকের কাছে নদীর তুলনায় অনেক আপন। এটা যদি সম্পূর্ণ বুজিয়ে দেওয়া হয় তাহলে হাজার টাকায় কাঠা কিনে বাড়ি বানাবার লোকের অভাব হবে না। বোধ হয় তাই এই মরা খালের গায়ে কোনও চালাঘর তুলতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। আবর্জনা বাড়াতে দেওয়া চলবে না। বাস করতে চাও চলে যাও নদীর চরে। সেখানে তোমার কি হল না হল তাতে কর্তৃপক্ষের কোনও দায়িত্ব নেই। তবু শহরের মানুষ অবাক হয়ে দ্যাখে নদীর চরের মানুষের সংখ্যা দিন-দিন বাড়ছে। বেশ গাছগাছালির লাগানো শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যে। ঘরদোরের গঠনও পালটাচ্ছে। বেশ শৌখিন আর মজবুত চেহারা নিচ্ছে সেগুলো। রিকশাওয়ালা ঠেলাওয়ালা দিনম জ্বর আর ঠিকে ঝিদের চমৎকার পাড়া হয়ে গিয়েছে ওটা। বর্ষায় যখন এদিকে একটা ধারা গজিয়ে যায় তখন ভেলা করে পারাপার করে ওরা। সুন্দর হাওয়া বয় সারাদিন ওখানে। চাষবাসের একটা চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে এর মধ্যে। রাত্রে কাছে পিঠে শেয়াল ডাকে না। শহরের কিছু বাউন্ডুলে ছেলে চলে যায় ওখানে। লুকিয়ে গাঁজা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে নিয়েছে ওরা। এই নিয়ে ঝামেলা লেগেই আছে। আর গেল বর্ষায় খালটা জলে ভরে গিয়েছিল। সেই জল স্থির হয়ে। থেকে একটা পচা গন্ধ আরও তীব্র হয়ে শহরে ছড়াচ্ছে। অসুখবিসুখ হচ্ছে মানুষের। খালের জল ব্যবহার করা নিষেধ হয়ে গিয়েছে। কর্তৃপক্ষ স্থির করেছেন এবার খালটাকে বুজিয়েই ফেলবেন। ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ করার যে পরিকল্পনা ছিল, অর্থাভাবে বাতিল করে দিয়ে মোটা দামে জমি বিক্রি করে আর পাঁচটা ভালো কাজ করা যাবে।

সন্ধে নাগাদ চরে ফিরে এল লোকটা একটা মাছ হাতে ঝুলিয়ে। চমৎকার নাদুস-নুদুস কালা মাছ। এসে ঝাঁপ খুলে ওটাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে বলল, যা খুব ভুল হয়ে গেল। লোভে-লোভে কিনে ফেললাম, এখন কাটবে কে?

চিন্তা কি, কেটে দেব, বেঁধে দেব, খাইয়েও দিতে পারি।

কে? চমকে উঠল লোকটা। ঘরটায় এখন আঁধার, এই ঘরে কে?

লোকটার হাঁকডাকের উত্তরে একটা ছোট্ট হাসি বাজল, পেতনি। চরের পেতনি।

দ্রুতহাতে কুপি জ্বালাল লোকটা। তারপর সেটাকে উঁচু করে তোক খুঁজল। আলো পড়তে বুকে আঁচল টানল মেয়েটা, আঃ, লজ্জা লাগে না। ব্যাটাছেলের চোখ না তো করাতের দাঁত। নামাও ওটাকে।

বাজ পড়ল ঘরে, অ্যাই, এখানে কী চাই? চুরি করার মতলব?

চুরি! হাসল মেয়েটা, ডাকাতের ঘরে চুরি? লোকে হাততালি দেবে।

মানে? আমি ডাকাত?

নিশ্চয়ই। আমার মন ডাকাতি করেছ গো। তারপর সুর ধরল, ও যে দিন-দুপুরে চুরি করে রাত্তিরে তো কথা নাই। শুয়ে-শুয়ে পা নাচাল, কী মাছ গো?

লোকটি তখন তার বিশাল চেহারা নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না নিচু ছাদের জন্যে। ঘাড় নামিয়ে তবু ছুটে এল পাশে, অ্যাই ওঠ, বেরো এখান থেকে। যা, চলে যা।

কোথায় যাব?

কেন তোর দিদির ঘর নেই! সেখানে গিয়ে জামাইবাবুর গাঁজা সাজ।

ওই জন্যে তো পালিয়ে এলাম। যত রাজ্যের বাবু ছোঁকরাগুলো দিনরাত সেখানে জাঁকিয়ে বসে থাকে। আমি গেলেই ড্যাবডেবিয়ে তাকায়। বুকের আঁচল ফেলে যে শোব তার উপায় নেই। রাক্ষসগুলোর মধ্যে আমি থাকতে পারি, তুমি বলো? ঠোঁট ফোলাল মেয়েটি।

কেন, তোর দিদি কোথায়? সে মাগির তো বড় মুখ।

অ, দিদির কথা বলোনা। সে তো এখন জামাই-এর দোসর হয়েছে। গাঁজা খেতে এসে ছোঁকরাগুলো ভালো টাকা দেয় বলে রসের কথা বলে। দিদির এখন গতর খাঁটিয়ে ঝি-গিরি করতে বয়েই গেছে। ছিলিমে টান দিচ্ছে আর এর ওর সঙ্গে রস করছে। ওর মনে খুব দুঃখ।

দুঃখ? দুঃখ কেন?

বাঃ, দুঃখ হবে না? তোমার দিকে নাকি প্রথমে ঝুঁকেছিল। তখন এই চরে তোমরা দুই ঘর ছাড়া নামি মানুষ ছিল না। তা তুমি পাত্তা দাও নি।

পাত্তা দেব কেন? সে অন্যের বউ না?

তাই তো। তবে  কাঁচ তো আর ছুরি দিয়ে কাটা যায় না, তার জন্যে হীরে চাই। বলে খিলখিলিয়ে উঠল মেয়েটি।

তা আমি কী করব এসব শুনে? যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাও, আমায় একা থাকতে দাও। লোকটার গলার স্বর ভাঙছিল।

বাঃ, তুমি জানো না তো কে জানবে? তুমি এখানকার মোড়ল।

না, আমি কেউ নই। একা থাকতে চরে এলাম তাও সব ভিড় জমালো।

তাহলে ওরা ঠিকই বলে।

কী বলে?

তুমি পুরুষমানুষ নও। তাই লুকিয়ে থাকতে চাও।

কে বলে? গর্জে উঠল লোকটা।

ছেড়ে দাও ওসব কথা। আমি বলি কী, আজকের রাতটা এখানেই থাকি।

না কক্ষনো না।

তোমার পায়ে পড়ি, চেঁচিয়ে ওদের জানিও না, তাহলে ঠিক টেনে নিয়ে যাবে আমাকে। কাল সূর্য

উঠলে আমি চলে যাব।

কোথায়?

যেখানে দুচোখ যায়। মেয়েছেলের শরীরে যৌবন থাকলে ঠিকানার অভাব হয় না। এখন মাছটা কাটব?

মাছ?

ওই যে পড়ে আছে। দেখি-দেখি, ভালো করে আলো ফেলো তো! এমা, এ যে পোয়াতি মাছ। ব্যাটাছেলেদের কাটতে নেই।

পোয়াতি?

হ্যাঁ, দেখছনা পেটভরতি ডিম?

লোকটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। সত্যি মাছটার পেট বেশ ফোলা। কোনওরকমে বলল, ঠিক আছে।

সঙ্গে-সঙ্গে ফুঁ দিয়ে কুপির আলো নিবিয়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটা, তুমি কেমন পুরুষ দেখব আমি!

ঝটকা মেরে ফেলে দিতে চাইল লোকটা। কিন্তু তাকে আঁকড়ে ধরে মেয়েটা চাপা গলায় হিসহিস করল, ওরকম করলেই চেঁচাব। বলব তুমি আমার ইজ্জত নিয়েছ। আমি? লোকটার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।

হুম। লোকে দেখবে আমার শরীরে কাপড় নেই। দ্যাখো না, দ্যাখো! মিথ্যে বলছিনা!

মাঝরাত্তিরে লোকটার মনে হল মেয়েরা হল নদীর মতো। শুকিয়ে থাকলে মরা চর আর ঢল নামলেই কালনাগিনীর মতো হিংস্র, যতক্ষণ না গিলছে ততক্ষণ শান্ত হয় না। এই যে মেয়েটা এখন তার শরীরের ওপর হেলান দিয়ে কি আরামেই না ঘুমোচ্ছে। দু-দুবার সে ঝড় তুলেছে তবে এই শান্তি। অবশ্য সুন্দর করে মাছ বেঁধেছিল, তাই দিয়ে পেট ভরে ভাত খাওয়া গেছে। বেশ সুখী-সুখী লাগছে আজ। ঘরে মেয়েছেলে থাকলেই হবে না, সে মেয়েছেলেকে সুখ দিতে জানতে হবে তবেই পৃথিবীটাকে অন্যরকম লাগবে। তবে এ মেয়ে নির্ঘাত ভালো মেয়ে নয়। নিশ্চয়ই অনেক ঘাট ঘুরছে এর মধ্যে, নইলে এত ছলাকলা শিখল কী করে? যদি ভাবো খারাপ তো খারাপ, নইলে নয়। ওই নদীর কথাটাই ফিরে আসে। এ ঘাটে ছলাৎ ও ঘাটে ছলাৎ, কেউ করল স্নান কেউ কাচল কাপড় কিন্তু পরের ঘাটে নদী আবার নতুন। লোকটা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরল হঠাৎ। ঘুম ভেঙে হাঁসফাঁস করল মেয়েটি অস্ফুট আওয়াজ বেরুল, কী হল?

লোকটা বলল, বাঁধ দিলাম, বেঁধে নিলাম।

মেয়েটি হেসে ফেলল অস্বস্তিতে, ওমা, আমি কি নদী?

লোকটি বলল, তাই।

রোদ উঠলে চরে শুরু হল হইচই। মেয়েটির বোন আর গেঁজেলটা এল তেড়ে। চেঁচিয়ে লোক জুটিয়ে আনল, সোম মেয়েকে নিয়ে শুয়েছে সারা রাত, বিচার চাই।

লোকজন উত্তেজিত হল। মেয়েটার জন্যে যাদের জিভে লালা জমত তারা বলল বেশি। থানায় যাও, পুলিশ ডাকো। একি কেলেঙ্কারি, যাকে মোড়ল ভাবা হয় সে-ই কিনা এই পাপ করল। লোকটা মেয়েটার দিকে তাকল, কী বলছে, সবাই, শুনেছিস?

মেয়েটা শরীর মোচড়াল, তুমি শোন, ঘুম পাচ্ছে আমার।

মেয়েটার বোন তাতে ভোলে না। তার টাকা চাই। ক্ষতিপূরণ করতে হবে। খাইয়েছে পরিয়েছে যাকে, তাকে বেইজ্জত করেছে। লোকটা বলল, আমার টাকা নেই।

এরা নাছোড়বান্দা। কাজে যাওয়া হল না লোকটার। দুশ টাকা চাই। নগদ। এক পয়সা কম নয়। লোকটা মাথা নাড়ে, অসম্ভব। দুপুর নাগাদ ঘুমিয়ে টুমিয়ে মেয়েটা বেরিয়ে এল চালা থেকে, দিয়ে দাও দুশো।

লোকটা বলল, কোথায় পাব?

মেয়েটা বলল, তা বললে চলে। ঠিক আছে, আমি দিদির কাছে রইলাম, তুমি টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এসো আমাকে। গতর দুলিয়ে সে চলে গেল বোনের সঙ্গে। লোকটার সামনে শুয়েছিল একটা নেড়ি, প্রচণ্ড লাথি খেয়ে সেটা চর ফাটাতে লাগল চিঙ্কারে। কী করা যায় বুঝতে পারছিল না লোকটা। ভিড় এখন পাতলা। রেডিও বাজছে কোনও এক চালায়। গেজেলের ঘরে মেয়েটা সেঁধিয়েছে বোনের হাত ধরে। সেখানে জমেছে শহরের ছোঁকরাগুলো। লোকটা ছটফট করছিল। টাকা তার আছে। সর্বসাকুল্যে আড়াইশো টাকা। তার নিজের চালার তলায় বালি খুঁড়ে এক হাত গেলে টিনের কৌটোয়। কিন্তু সে টাকা জমিয়েছে আপদবিপদের জন্যে। দূরের চালাগুলোর দিকে তাকাল সে। বেশ সংসারী-সংসারী চেহারা। ওপাশের ধুধু-চর ঝলকাচ্ছে এখন। বুকের ভেতরটা খাঁ-খাঁ করে উঠল। চালায় ঢুকতেই মোচড় দিল মন। এরকমটা কখনও হয়নি। কালকের রাতটাই সব গোলমাল পাকিয়ে দিল। সারাদিন খাওয়া হয়নি তবু খিদে পাচ্ছে না। বিছানার দিকে তাকাতেই কষ্টটা বেড়ে গেল। মেয়েমানুষের শরীর, তার ব্যবহার, দুটো কথাবার্তার টোকা আর রান্নার স্বাদ শালা পাইথনের মতো। একবার গিললে আর ছাড়ে না। দ্রুতহাতে বালি খুঁড়ে কৌটোটা বের করল সে।

গেজেলের চালার দরজা সরিয়ে উঁকি মারতেই মনে হল দম বন্ধ হয়ে যাবে। বাপরে বাপ। গাঁজার ধোঁয়ায় ঘর এখন ভাসছে। ওকে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মেয়েটা। পা ছড়িয়ে সে শুয়েছিল বোনের পাশে। সেই পায়ে হাত বোলাচ্ছে শহরের ছোঁকরা। লোকটা চেঁচাল, উঠে আয়। তারপর ছুঁড়ে দিল টাকাগুলো। বোনটা দ্রুত হাতে কুড়িয়ে নিয়ে গুণে বলল, দুশো। তড়াক করে বেরিয়ে এল মেয়েটা, তবে যে বললে টাকা নেই। মরণ! এই না হলে পুরুষমানুষ!

মাসতিনেক বাদে এক সকালে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল মেয়েটা। অবাক হয়ে লোকটা জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

মেয়েটা পা ছড়িয়ে বলল, কী হবে আমার। পেটে একজন এসে গেল সাত তাড়াতাড়ি।

লোকটা হেসে বলল, এই কথা।

হেসো না। এখন তোয়াজ করবে কী দিয়ে? কটা টাকা কামাও? আমার এখন ঝাল মাংস খেতে ইচ্ছে করছে, খাওয়াও দিকি। মেয়েটা চোখ ঘোরাল।

লোকটার জিভ শুকিয়ে এল। শহরে মাংসের দাম অনেক। মাল বয়ে যা পায় তাতে দুবেলা ভাত আর সেদ্ধ জোটে। তবু কোনওরকমে একজনের জন্যে মাংস নিয়ে এল বিকেল বেলায়। চেটেপুটে খেয়ে নিল মেয়েটা। খেয়ে বলল, আমি খাচ্ছি না, পেটেরটা খেলো। কাল একটু ইলিশ এনো।

লোকটা বলল, টাকা নেই। অত নোলা কেন?

মেয়েটা বলল, পুরুষমানুষ তো বাচ্চা ধরে না, বুঝবে কি! লোকটা গোঁজ হয়ে রইল।

দুদিন বাদে মেয়েটা বলল, দিদির যে কাজ ছিল শহরে তা আমায় নিতে বলল। ভালোই হবে, দুটো পয়সা পাব।

লোকটা বলল, খবরদার, তুই শহরে যাবি না।

কেন, গেলে কি আমাকে খেয়ে ফেলবে? পেটে বাচ্চা আছে না? মেয়েটা রুখে দাঁড়াল। লোকটা ভাবল, তা বটে। রক্ষাকবচ তো পেটে বাঁধা। ভয় কী!

দুদিন বাদে বেশ রগরগে ইলিশ রাঁধল মেয়েটা। লোকটার পাতে ধরে দিয়ে বলল, পেটি খাও।

লোকটা অবাক গলায় বলল, পেলি কোথায়? এর তো বহুত দাম।

মেয়েটা হাসল, যে বাড়িতে কাজ করি তার বাবু দিয়েছে। বাজার থেকে আসছিল, পথে দেখা হতে হেসে বললাম, কতকাল খাইনি! বাবু গলে গিয়ে দিয়ে দিল।

মাথায় আগুন চড়ে গেল লোকটার, খবরদার, ও বাড়িতে আর ঢুকবি না।

মেয়েটা বলল, কেন?

ও তো সর্বনাশ করবে। লোকটা গর্জালো।

মাথা খারাপ তোমার। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। কাল সন্দেশ আনব।

কোত্থেকে?

আর একটা বাবু দেবে বলেছে।

লোকটা আর পারল না। লাথি মারল ইলিশ মাছে। তারপর চিৎকার করে বলল, ফের যদি শহরে ঢুকিস তাহলে গলা টিপে মারব। সেদ্ধভাতে সুখ হবে কিনা বল?

মূর্তি দেখে কুঁকড়ে গেল মেয়েটা। ভয়েভয়ে বলল, হবে।

লোকটা চেঁচাল, শহরে কেউ তোর গায়ে হাত দিয়েছে?

মেয়েটা সভয়ে মাথা নাড়ল, না।

দুদিন বাদে মেয়েটা আবার উসখুস করল। লোকটা বলল, কী চাই?

আচার। আমের।

এই চরে ওসব পাওয়া যায় না। আমার কাছে ঘ্যানর-ঘ্যানর করিস কেন, দিদির কাছে গিয়ে চাইতে পারিস না? লোকটা মুখ ফেরালো।

দিদির কাছে চাইলে তোমার মানে লাগবে না?

একি কথা! বোন দিদির কাছে চাইলে আমার মান যাবে কেন?

তিনদিন বাদে এক বোতল বড় আচার এল। লোকটা বলল, বাবা, এত কে দিল?

মেয়েটা লাজুক হাসল, খেয়ে দ্যাখো।

কে দিল? তোর দিদি?

না, দিদির খদ্দের। ওই যে শহরের লোকটা যে গাঁজা খেতে আসে। আমার ইচ্ছের কথা শুনে শহর থেকে এনে দিল।

এমনি-এমনি কেউ দেয়? কী করেছিল ও?

কিছু না। শুধু বলেছিল তোমার মিষ্টি হাতে গাঁজা সাজিয়ে দাও, দিয়েছিলাম।

আগুন হল লোকটা, খবরদার, আর ও ঘরে যাবি না। হাত কেটে ফেলব।

অনেক রাত্তিরে মেয়েটা আদর খেতে-খেতে বলল, তবে যে তুমি বল আমি নদীর মতো, তাহলে এত অবিশ্বাস করো কেন?

লোকটা সরল গলায় বলল, নদীর মতো হারামি আর কেউ নেই।

এবার বর্ষার রোয়াব যেন বেড়ে গেল দশগুণ। ভেলায় চেপে পারাপার শুরু হল চর থেকে। শহরের ভেতর যে খাল সেটা হয়ে গেল টইটুম্বর। সাত দিনেও বৃষ্টি থামে না। বৃষ্টির জল জমছে। শহরের রাস্তায়। খালের জল উপচে উঠল দু-পাশের শহরে। জলটা বাড়ছেই কারণ বেরিয়ে। যাওয়ার মুখ বন্ধ। সেখানে বাঁধ আছেনদীকে আগলাতে। খবর এল পাহাড়ে জব্বর জল ঝরছে। সব ঝোরা এসে লাফিয়ে পড়ছে নদীতে। পুলিশ হেঁকে বলে গেল, চরের লোক পালাও নইলে এবার ডুববে। পড়ি কি মরি করে পালানো শুরু হল। যা কিছু শখের তাই নিয়ে লোকজন উঠল বাঁধে। প্রসববেদনা সামলে মেয়েটা বলল, পালাবে না?

লোকটা মাথা নাড়ল না।

মেয়েটা আঁতকে উঠল, জল আসছে, ভাসবে সব।

আসুক আগে। অত মানুষের দঙ্গল আমার ভালো লাগে না। বলে মেয়েটির স্ফীত উদরে হাত বুলিয়ে দিল, এখানেই বাচ্চাটা হোক। এই নিরিবিলিতে।

তুমি কি পাগল? যেটা আসছে তার কথা ভাবো। মেয়েটা ককিয়ে উঠল।

ভাবনার কিছু নেই।

মেয়েটা অসহায় চোখে তাকাল। এখন এই লোকটার ওপর নির্ভরতা এত বেড়েছে যে একা চলে যাওয়ার সামর্থ্য তার নেই। সে দুহাতে লোকটাকে জড়িয়ে কষ্ট সামলাল।

নদীর বুকে ঢল নেমেছিল পাহাড়ের নীচে। সেটা গড়িয়ে আসতে-আসতে দুদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। চরের বালি এত উঁচু যে সোজা আসতে পারছে না। ফলে জলের ধারা মাঠ ভাসিয়ে পাকা রাস্তাটাকে বেছে নিল খাত হিসেবে। যেহেতু নদীর বিপরীত দিকে তাই ওই অংশ বাঁধ গড়া হয়নি। নিচু জমি পেয়ে ছুটে যাচ্ছিল জল। বৃষ্টি থামছিল না। ময়লা ন্যাতার মতো চপচপে। আকাশটা ছিঁড়ে-ছিঁড়ে পড়ছিল। নদীর জল সেই মদত পেয়ে ঢুকে গেল খালে। টইটুম্বর খালটা বহুদিন পরে নদীর স্পর্শ পেয়ে ছিটকে উঠল আকাশে। আর তখনই ডুবে গেল শহরটা। উলটো দিক থেকে জল ঢুকছে কিন্তু বেরোবার পথ বাঁধের জন্যে বন্ধ। সমস্ত শহরের লোক যে যেভাবে পারে ছুটে এল বাঁধের ওপর প্রাণ বাঁচাতে। জলটা পাক খাচ্ছে শহরে। একতলা বাড়িগুলো গেল তলিয়ে। মানুষ আর জন্তুর মৃতদেহ ভাসতে লাগল সেই ঢেউয়ে। অতবড় শহরটা অতিকায় হ্রদ এর চেহারা নিয়ে নিল এবার। বাঁধগুলো তার দেওয়াল।

বাঁধে আর মানুষ ধরে না। হঠাৎ ওদের নজর পড়ল চরটার দিকে। বিশাল নদীর চর শুকনো পড়ে রয়েছে। নিজের জমা করা বালি ঠেলে নদীর জল এদিকে আসতে পারেনি। কিছু লোক নেমে এল চরে। এসে হাত-পা ছড়িয়ে বলল, কী আরাম!

তাদের আরাম দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হল। মুহূর্তেই বাঁধের সংকীর্ণ জায়গা ছেড়ে শহরের সব মানুষ পিলপিল করে নেমে এল চরে। বাতিল চালার মালিকরা অসহায় চোখে দেখছিল তাদের চালাগুলো বেহাত হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তারাও মিশে গেল শহরের লোকদের মধ্যে। এই মুহূর্তে পোশাক আচরণে ওদের আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না।

লোকটা এক হাতে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে দেখছিল এই জনস্রোত। এখন তার চারপাশে শুধু মানুষের মুখ। সে চাপা গলায় বলল, শালা!

মেয়েটা বলল, ওরা যে শহর ছেড়ে এখানে পালিয়ে এল।

লোটা দ্রুত হাতে বালি খুঁড়ে টাকা বের করে বলল, চল।

কোথায়? মেয়েটা ভয়েভয়ে জিজ্ঞাসা করল।

লোকটা কোনও উত্তর দিল না। মেয়েটাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে এল বাঁধের ওপরে। তখন শহরের কোনও মানুষ বাঁধে নেই। এমনকি চরের লোকেরাও এখন সেখানে। লোকটা দেখল শহরটা এখন বিশাল হ্রদ, জল ফুসছে। আর চরটা যেন আচমকা শহর হয়ে গিয়েছে। রাত ঘনালে চরে আলো জ্বলে উঠল। লক্ষ-লক্ষ হায়নার চোখের মতো জ্বলতে লাগল চরটা। আর শহরটা গভীর জঙ্গলের মতো অন্ধকারে মাখামাখি। মেয়েটার যন্ত্রণা বাড়ছিল। শেষে চিৎকার করে উঠল, ও মাগো!

লোকটা তাকে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে রেখেছিল। এবার কষ্ট মুছিয়ে দেওয়ার গলায় বলল, বিয়ো, খুশি মনে বিয়ো। মেয়েটার কানে সে কথা ঢুকল না। কাটা ছাগলের মতো ছটফট করছিল সে। ওলট-পালট হওয়া শহর আর নদীর শব্দ শুনতে-শুনতে গালে হাত দিয়ে লোকটা বিহুল গলায় বলল, এখানে কেউ নেই, এই বেলা সেরে নে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *