ঘোরকলি

ঘোরকলি

‘আপনার নাম?’

‘বিমানবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়। স্কুলে, কলেজে, কর্মস্থলে এবং পাড়ায় আমাকে থ্রি বি বলে। শুনেছি, ওটা একটা বাসরুট। তা, আমিও তো সারাজীবন একটা বাসই। পরিবার-পরিজন জানালায় চাঁদপনা মুখ করে বসে আছে। ফরফর আমি চালিয়েই যাচ্ছি। ড্রাইভার কাম কনডাক্টর।’

‘কী করতেন আপনি?’

‘শিক্ষকতা।’

‘শিক্ষা সম্পর্কে আপনার ধারণা?’

‘জীবনটাকে নষ্ট করার নাম শিক্ষা। লেখাপড়া করিবে মরিবে দুখে, মাস্তানি করিবে, বাঁচিবে সুখে। স্কুলে-স্কুল ইউনিয়ন, কলেজে-কলেজ ইউনিয়ন, অপিসে অফিস-ইউনিয়ন। অত:পর এম এল এ, মন্ত্রী। মন্ত্রী না হলেও তাঁর তাঁবেদার হতে পারলেও অনেক পাওয়ার। হুতোম বলেছিলেন, একটি বড়লোকের পুত্রকে মদ ধরাতে পারলে, পরে আরও পাঁচটা অপোগণ্ড মাতাল প্রতিপালিত হয়। শৈশবে শুনেছিলাম, একজন বাজারে গিয়ে ব্যাগ ভরতি করেছে। এইবার সে চলে আসছে। আনাজঅলা বলছে, এ কী চলে যাচ্ছেন! আমার মূল্য। সে তখন বলছে, ব্যাটা! তোর তো সাহস কম নয়, জানিস আমি কে? ওই যে থানার দারোগা, তার যে নৌকো চালায়, সেই নৌকোর যে কাছি বানায়, সেই কাছির যে লেছি দেয়, সেই লেছির যে শন দেয়, সেই শন যে চাষ করে, সেই চাষের খেতে যে জল দেয়, সেই জল দেওয়ার যে ডোঙ্গা তৈরি করে, তার বাড়ির কাছে আমার বাড়ি। উঠে স্যালুট কর। আনাজঅলা উঠে দাঁড়িয়ে বললে, দণ্ডবৎ হই প্রভু। মূল্য আর দিতে হবে না, এই মূল্যের বান্ডিলটাও ব্যাগে ভরে নিন, আমি ঝাঁপে লাঠি মারি। লেখাপড়া শিখলে চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়।’

‘এ আবার কী কথা!’

‘কেন? কাগজ দেখুন। ছাত্র অ্যাসিড মেরে প্রবীণ, সম্মানিত শিক্ষকের চোখ কানা করে দিয়েছে। এর আগে কলেজের ছেলে আর মেয়েরা এক অধ্যক্ষকে অ্যায়সা ঘেরাও করে রাখলে যে ভয়ে মরেন আর কি। শেষে ক্যাথিটার দিয়ে টয়লেট করানো হল। এরপর যে কয়েকবছর শিক্ষকতা করেছিলেন, ছেলেদেরকে স্যার, মেয়েদেরকে ম্যাডাম বলতেন। আমার এক ছাত্রকে ক্লাস থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছিলুম। সেই অপরাধে পরে পকেটমার, পকেটমার বলে চিৎকার করে আমাকে পাবলিক-ধোলাই খাইয়েছিল। তিনি এখন সম্মানিত নেতা। তাঁর দু-লাইন রেকমেন্ডশানে মানুষের ভাগ্য ফিরে যায়। এইবার বিদেশে চলুন। ইটনের এক সুখ্যাত অধ্যাপক স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছেন। দেখলেন তাঁরই কয়েকজন সাদা ছাত্র এক কালো সহপাঠীকে পিটিয়ে মারছে। তিনি বাঁচাতে এলেন। এক ধমক দিতেই ছেলেরা পুরোনো সংস্কারের বশে পালাচ্ছিল, হঠাৎ একটি ছেলের মনে হল, পালাচ্ছি, ছি ছি! বাঁদরামির এই রেনেসাঁয় এ আমার কী আচরণ। একটা দু’ ইঞ্চি ঢুকিয়ে দিলে পেটে। লং লিভ আওয়ার রেসপেকটেড টিচার। এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের টনক নড়েছে। কড়া আইন তৈরি হচ্ছে। একালের শিক্ষা সম্পর্কে বিলেত কী বলছে শুনুন—Modern education has changed the commandment to read, ‘‘Parents obey your children.’’

‘আত্মরক্ষার জন্যে শিক্ষকদের কী করা উচিত!’

‘ক্লাসে না যাওয়া। বুদ্ধিমান শিক্ষকরা তাই করছেন।”

‘শিক্ষায় শান্তি আনতে গেলে কী করা উচিত?’

‘প্রথমত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে সব পার্টি-অফিস করে দিতে হবে। পরীক্ষা থাকবে কিন্তু পড়া থাকবে না। ছাত্রদের হয়ে অভিভাবকরাই পরীক্ষা দেবেন। লেটার থাকবে কিন্তু ম্যান অফ লেটার্স থাকবে না। অকারণে অশান্তি বাড়িয়ে লাভ কী। টাকা এখন অন্য সার্কিটে ঘুরছে। ডিগ্রি-ডিপ্লমা চোতা কাগজ মাত্র। পণ্ডশ্রম।’

‘কী রকম, A young man, having just received his degree from the University, rushed out saying. Here I am, world; I have a B.A.

The world replied : Sit down son, and I’ll teach you the rest of the alphabet.’

‘আদর্শ শিক্ষক হিসেবে আপনি আপনার ছেলেকে নিশ্চয় খুব মানুষ করেছেন?’

‘অবশ্যই। যত অর্থ ছিল সব ইনভেস্ট করেছি, যত উপদেশ ছিল সব ঢেলেছি, যত সেবা ছিল উজাড় করে দিয়েছি। শীতে কমলালেবু, চিড়িয়াখানা, গ্রীষ্মে লিচু-ল্যাংড়া, টিফিন আর ডাব হাতে পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে গাছতলায় জননী খাড়া।”

‘অত:পর!’

‘বুড়ি গেল সগ্গে, বুড়ো এই বুড়োখানায়।’

‘এই বৃদ্ধনিবাসে এলেন কেন?’

‘ প্রাোডাকশন ফ্লপ করল। নায়ক হয়ে গেল খলনায়ক। সার্ভিস খুব একটা খারাপ দিচ্ছিলুম না। গ্যাস ফুরোলে লিখিয়ে আসা, ইলেকট্রিক বিল টেলিফোন বিল জমা দেওয়া, ডাক্তারকে কল দেওয়া, নাতিকে স্কুলে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা। বাড়ি পাহারা দেওয়া। বাজার করা। বাথরুম পরিষ্কার করা। ঝড়বৃষ্টি এলে ছাত থেকে সব তোলা, জানলা বন্ধ করা ঝুল ঝাড়া। গাছে জল দেওয়া। হঠাৎ কেউ এসে পড়লে দোকানে গিয়ে মিষ্টি আনা। আলনা, আলমারি, গুছনো। এ লাইফ ফুল অফ অ্যাকটিভিটি।’

‘তা হলে গৃহত্যাগ করলেন কেন?’

‘মালকিনের ঠিক পছন্দ হল না। কলমি শাক আনলুম, বললে, নর্দমার ধারের এই আবর্জনা কেন আনলেন? চিচিঙ্গা নিয়ে এলুম, বললে, সাপ আবার খায় না কি? ঝিঙে আনলুম, বললে, ভালোই করেছেন, শুকোলে ছোবড়া হবে। রাঙালু আনলুম, বললে, বিহারীদের দিয়ে আসুন। চুনো মাছ আনলুম, বললে, বেড়াল খুঁজে আনুন। একালের মানুষ এসব খায় না।’

‘একালের মানুষ কী খায়?’

‘রোল, পিৎজা, ফিশফিঙ্গার, ম্যাগি চাওমিন, প্যাটিজ, নুডল স্যুপ। কিচেনে নষ্ট করার মতো সময় আধুনিকাদের নেই। পুঁইশাক আর কুমড়ো আনলুম। বললে, এ তো ফুড নয় ফডার। নাতি একদিন জীবনমুখী গান গাইছে :

রান্নাঘরে চলছে ক্লোজার

রকের পাশে রোল কাউন্টার

হাই মাম্মি, হোয়ার ইজ মাই ব্রেড অ্যান্ড বাটার।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *