ঘুম (১)
ঘুমের কথা লিখতে গেলে প্রথমেই সেই বিখ্যাত বালিকাটির কথা বলে নেওয়া ভাল।
ছাত্রজীবনে এবং তারপরেও কিছুদিন গৃহশিক্ষকতা করেননি এমন বাঙালি বিরল। আমার বন্ধুবান্ধবেরা সকলেই টিউশনি করেছেন, কিন্ডারগার্টেন থেকে এম এ পরীক্ষার ছাত্রছাত্রী পর্যন্ত যে যার যোগ্যতা অনুযায়ী পড়ানোর চেষ্টা করেছেন। আমার এই বন্ধুরা প্রায় সকলেই দাবি করেন উপরিউক্ত বালিকাটি তাঁরই ছাত্রী ছিল।
বালিকাটির ছিল ঘুমের দোষ। ঘুমের জন্য পড়াশুনা তার মাথায় উঠেছিল। আমি নিজেও তাকে কিছুদিন পড়িয়েছি। সে এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। প্রথম সপ্তাহে কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহেও যখন দেখলাম যা পড়া দিয়েছি কিছুই করে রাখছে না, তার উপরে পড়তে বসে কেবলই হাই তোলে; হাই শুধু হাই, হাইয়ের পর হাই; আমি ছাত্রীটিকে এক চোট খুব ধমকালাম। বেশ ধমকানোর পরে মেয়েটির কাছে সোজাসুজি জানতে চাইলাম, ‘পড়া করে রাখোনি কেন?’ মেয়েটি নির্বিকার কণ্ঠে একটা ছোট হাই দমন করতে করতে উলটো প্রশ্ন করল, ‘কখন পড়ব, স্যার?’
আমি বললাম, ‘কেন, সন্ধ্যাবেলা’।
‘সন্ধ্যাবেলা বড় ঘুম পায়, স্যার।’ মেয়েটি এবার আর তার হাই-কোলা আটকাতে পারল না।
কিন্তু আমি ছাড়লাম না, ‘ঠিক আছে, সন্ধ্যাবেলই ঘুমোবে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়া করবে।’
মেয়েটি ইতিমধ্যেই বাঁ হাতের তর্জনী ও মধ্যমার সাহায্যে ছোট একটা তুড়ি তুলে সমুদ্রের জলোচ্ছাসের মতো একটা বিপুল হাই ঠেকানোর চেষ্টা করছিল। ওই অবস্থাতেই আলতো করে উত্তর দিল, ‘সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বড় খিদে পায়, স্যার’।
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, তোমাকে না খেয়ে পড়তে বসতে হবে না, তুমি আগে খেয়ে নেবে।’
মেয়েটি এবার আমতা আমতা করে বলল, ‘না স্যার, খেলে আমি পড়তে পারব না।’
আমি অবাক হয়ে গেলাম, ‘কেন?’
মেয়েটি অম্লানবদনে বলল, ‘খেলেই আমার ভীষণ ঘুম পায়’।
সেই মুহূর্তে আমি মেয়েটিকে চিনতে পারলাম। এই সেই বিখ্যাত বালিকা যার কথা অনেক শুনেছি, অনেক পড়েছি। যার ঘুম থেকে উঠলেই খিদে পায়, আর খেলেই ঘুম পায়।
খাওয়া-ঘুম-খাওয়া-ঘুম-খাওয়া—এইরকম চক্রাকারে চলেছে এর জীবনযাত্রা, এর মধ্যে আর কিছুর জন্য কোনও ফুরসত নেই। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে কুটিল চক্র বা ভিসাস সার্কল, যার উদাহরণ হল ভারী শিল্প নেই বলে আমরা গরিব এবং আমরা গরিব বলেই আমাদের ভারী শিল্প নেই। এই মেয়েটিও একই রকম কুটিল বৃত্তে আবদ্ধ, ঘুমোলেই খিদে আর খেলেই ঘুম।
কিন্তু অন্যের ঘুম নিয়ে রসিকতা করার অধিকার আমার নেই। আমি ঘুমোইনি এমন কোনও জায়গা নেই। যে কোনও জায়গায় সামান্য এলিয়ে পড়তে পারলেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে, ট্রেনের পাদানিতে’ ঝুলতে ঝুলতে বিভিন্ন বিপজ্জনক অবস্থায় আমি ঘুমিয়েছি। একবার চিৎ সাঁতার দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আড়াই ঘণ্টা পরে ঘুম ভেঙে দেখি— নদীর ঘাটে ছিলাম, মধ্য নদীতে চলে এসেছি; গায়ের চামড়া সাদা হয়ে কুঁচকে গেছে।
ক্লাবে বা বৈঠকখানায় আড্ডা দিতে দিতে, অফিসের টেবিলে ফাইল করতে করতে, এমনকী প্রমত্ত যৌবনে নিজের ফুলশয্যার রাতে আমি নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছি।
আমি যখন প্রথম অফিসে ঢুকেছি, কালীঘাটের বাড়িতে তখন একা একা, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে অনেকদিন দেরি হয়ে যেত, আগের দিন হয়তো খুব রাত জাগা হয়েছে। এই রকম এক দেরির দিন, বেলায় উঠে চা খেয়ে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি। দ্বিতীয় দফায় ঘুম থেকে উঠে স্নান-খাওয়া করে অফিস যেতে সাড়ে বারোটা হয়ে গেল। ওপরওলা আমাকে ধরলেন, দেরির ব্যাখ্যা চাইলেন। তখন আমার সত্যভাষণের খুব ঝোঁক ছিল, মুখ কাঁচুমাঁচু করে বললাম, ‘স্যার, ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম’। ভদ্রলোকের মুখ দেখে মনে হল আমার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন, চোখ থেকে চশমা খুলে অবাক দৃষ্টিতে আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। তারপর আবার চশমাটা চোখে দিয়ে ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘সে কী মশাই! আপনি বাড়িতেও ঘুমোন নাকি?’
আমার সেই ওপরওলা বেশ কিছুদিন হল চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। মধ্যে একদিন রাস্তায় দেখা দিয়েছিল, আমাকে দেখে খুশি হয়ে এগিয়ে এলেন। আমাকে বললেন, ‘আপনাকেই খুঁজছিলাম, আপনি আমার দুঃখটা বুঝবেন’।
আমি বললাম, ‘কীসের দুঃখ আপনার? আপনার চেহারা দেখে তো শরীর ভালই মনে হচ্ছে।’ ভদ্রলোক ম্লান হেসে বললেন, ‘শরীর যে খারাপ ঠিক তা নয়। কিন্তু ঘুমের একটু কষ্ট পাচ্ছি। আপনি কষ্টটা একটু বুঝতে পারবেন, তাই বারবার আপনার কথাই মনে হচ্ছিল’।
আমি স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার রাতে ঘুম হচ্ছে না?
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, সেকথা বলা ঠিক হবে না। রাতে ঘুম মোটামুটি হচ্ছে’।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘তবে?’
উনি বললেন, ‘তবে আর কী? সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে, হাতমুখ ধুয়ে, চা খেয়ে, খবরের কাগজ পড়ে আরেকটু ঘুমিয়ে নিই। আর তো কাজ নেই, কী আর করব বলুন?’
আমার সমাহিত মুখের দিকে তাকিয়ে আমার প্রাক্তন ওপরওলা নিজেই বলে চললেন, ‘না, সত্যি কথা বলছি। সকালবেলা ঘুমোতে খুব কষ্ট হয় না। তারপর ঘুম থেকে উঠে স্নান-খাওয়া সেরে মধ্যাহ্ন নিদ্রা। দুপুরে আর এই বুড়ো বয়সে কী-ই বা করার আছে; কষ্টেসৃষ্টে একটু ঘুমিয়ে নিই। কিন্তু আসল অসুবিধা হয় ওই বিকেলের দিকে। বিকেলের চা খেয়ে কত চেষ্টা করি কিছুতেই আর ঘুম আসতে চায় না। সে যে কী কষ্ট, রাত ন’টার আগে আর কিছুতেই ঘুম আসবে না’।
ভদ্রলোক সত্যি কথা বলছেন, নাকি আমার নিদ্রালু স্বভাবকে ঠাট্টা করছেন, কিছু বুঝতে না পেরে একটি ক্ষীণ নমস্কার করে তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে এলাম।
পুনশ্চ: একজন পাঠিকা অভিযোগ করেছেন ‘কাণ্ডজ্ঞান’-এ বড় কুকুরের উৎপাত। সুতরাং ঘুমের প্রসঙ্গে কুকুরের কথা বলব না, তবে একটা বেড়ালের কথা বলি।
এই পত্রিকারই এক বিখ্যাত লেখিকার বাড়িতে অগুন্তি বেড়াল। তারই একটা, আমার চোখের সামনে, ইঁদুর তাড়া করে লাফ দিয়ে উঠল আলমারির মাথায়। আলমারির পিছনে ইঁদুর। ওত পেতে স্থির হয়ে বসে রইল বেড়ালটি, ওত পেতেই ঘুমিয়ে পড়ল। বেড়ালের যে নাক ডাকে সেই প্রথম জানলাম। সেই গুরু গুরু নাক ডাকতে ডাকতেই বেড়ালটি আলমারির মাথা থেকে নীচে পড়ে গেল। এরপর এক সেকেন্ড নীরবতা, তারপর ওই পতিত অবস্থাতেই আবার সে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগল।