ঘড়ি
ঘড়ি হারায়নি বা ঘড়ি চুরি যায়নি, জীবনে ঘড়ি খোয়ানোর একটি ঘটনাও ঘটেনি এমন খুঁজে পাওয়া খুব সোজা নয়। ঘড়ি যেমন ভেতরে ভেতরে চলে এবং সময় দেয়, সেই রকম বাইরে বাইরেও চলে এবং একজনের কাছ থেকে অবলীলাক্রমে আরেকজনের কাছে চলে যায়।
আমি জীবনে এখনও পর্যন্ত অন্তত পাঁচ-সাতটি ঘড়ি হারিয়েছি এবং প্রায় প্রত্যেকটিই চুরির ঘটনা। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ঘড়ির ডায়ালে যেখানে সুইস মেড়, শক প্রুফ ইত্যাদি লেখা থাকে, সেখানে পয়সা খরচ করে ‘স্টোলেন ফ্রম তারাপদ রায় (Stolen from Tarapada Roy) লিখে নিয়েছি। এতে চুরি যাওয়ার সম্ভাবনা কিছু কমেছে এমন নিশ্চয় নয়, কিন্তু যে চুরি করবে সে বেচতে গিয়ে বেকায়দায় পড়বে এই আনন্দে আছি।
ঘড়ির কথা আরম্ভ করে প্রথমেই ঘড়ি চুরির ব্যাপার বলে ফেললাম বোধ হয় মনের মধ্যে এ বিষয়ে বেদনা বহমান বলে। তবে আমার সব ঘড়িই যে চুরি হয়েছিল তা নয়। আমার একটা ঘড়ি হনুমানে নিয়ে গিয়েছিল।
তখন আমি থাকতাম এসপ্ল্যানেড় অঞ্চলের একটা গলিতে, ভীষণ হনুমানের উৎপাত ছিল এই অঞ্চলে সেই সময়, সেই পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন সালে। এখন আর ওসব এলাকায় হনুমান দেখা যায় না। সব বিদেশে চালান হয়ে গেছে।
হনুমানের উৎপাতে আমরা অধিকাংশ জিনিসপত্র টেবিলের ড্রয়ারের ভিতরে কিংবা আলমারির মধ্যে রাখতাম। সেদিন কী একটা তাড়াতাড়িতে টেবিলের উপরে আমার প্রায় আনকোরা ঘড়িটা রেখে ঘরের বাইরে গেছি, হঠাৎ হনুমানটা জানলা দিয়ে লাফিয়ে ঢুকে আমার সেই ঘড়িটা আর একটা ডায়েরি মতন খাতা নিয়ে ছুটে পালিয়ে যায়। ওই ডায়েরি মতন বস্তুটি ছিল আমার প্রথম কবিতার খাতা। হনুমানটি বাংলা সাহিত্যের অশেষ উপকার করার চেষ্টা করেছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, তবে আমি দমে যাইনি। এক সপ্তাহের মধ্যে শুধু হনুমানের উপরেই ‘ওগো শাখামৃগ’ নামে এক খাতা কবিতা লিখেছিলাম।
ঘড়িটা উদ্ধার করার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছিল। আমার ছোট মেলোমশাই দুঁদে পুলিশকর্তা। তখনও লালবাজারে স্ন্যাচিং স্কোয়াড হয়নি। তিনি অ্যান্টি-রাউডি এবং অ্যান্টি-রবার শাখার দুই দুই চারজন সেপাইকে ভার দিয়েছিলেন ঘড়িটি উদ্ধার করার জন্যে। হনুমানটি কিন্তু ঘড়ি হাতছাড়া করেনি। মাঝে মাঝেই দেখা যেত এ-বাড়ির ছাদে, ও-বাড়ির দেয়ালে গভীর অভিনিবেশ সহকারে ঘড়িটি কানের কাছে ধরে টিকটিক শব্দ শুনছে। চব্বিশ ঘণ্টার পরে চাবি না দেওয়ায় ঘড়িটির দম নিশ্চয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখনও দেখতে পেতাম হনুমানটি শক্ত মুঠিতে ঘড়িটি ধরে কানের কাছে নিয়ে খুব ঝাঁকি দিচ্ছে।
ওই বন্ধ ঘড়িটা কিন্তু হনুমানের খুব উপকারে লেগেছিল। আমি নিজে দেখেছি লোকে ওকে কলাটা-মুলোটা খাওয়াত ওই ঘড়িটা হাতাবার জন্যে। কিন্তু সে সুবিধে কারও হয়নি। হনুমান একটি শতাব্দী প্রাচীন সহকার তরুর উচ্চতম কাণ্ডশীর্ষে ঘড়িটি রেখে তবে নীচে কলা খেতে আসত।
একবার সেপাইরা ওই রকম এক সময়ে ওই গাছের উপরে উঠে ঘড়িটি খুঁজে আনতে গিয়েছিল। ব্যাপারটা টের পাওয়া মাত্র দুই লাফে হনুমানটি গাছে ফিরে যায় এবং সবচেয়ে আগে যে সেপাইটি উঠছিল তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং আশ্চর্য যে, সে সেই সেপাইটির হাতে যে হাতঘড়িটা ছিল সেটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তখন সেপাইরা আমার ঘড়ি আর উদ্ধার করবে কী, নিজেদের ঘড়ি রক্ষা করতেই ব্যস্ত।
এরই পরে হনুমানটির নামকরণ হয়। ঘড়িয়াল হনুমান নামে ওই জন্তুটি আমাদের এলাকায় রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। অনেকের ধারণা হয়েছিল, হনুমানটির দৈবশক্তি আছে, সে সময় বলতে পারে। লোকে তাকে একটা কলা খাইয়ে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করত, ‘কেয়া হনুমানজি, সাড়ে পাঁচ বাজ গিয়া?’ কেন যে বাঙালিরা পর্যন্ত হনুমানের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলত তা আমি বলতে পারব না। কিন্তু কলা দিয়ে এ রকম প্রশ্ন করলেই হনুমানটি যে কোনও একদিকে ঘাড় নাড়াত, লোকে বলত, ‘দেখো, হনুমানজি বোলতা হায় সাড়ে পাঁচ বাজ গিয়া।’
ঘড়ির কথা বলতে গিয়ে হনুমানের গল্প করে বসলাম। আসল গল্পটাই বলা হয়নি। গল্পটা পুরনো, পড়বার পরে যাঁদের মনে হবে গল্পটা তিনিও জানতেন, দয়া করে মনে মনে হাত তুলবেন, আমিও তাঁদের মনে মনেই রসিক চূড়ামণি উপাধি দেব।
আমার এক বন্ধুর একটা পুরননা দেয়ালঘড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কালো মেহগনি কাঠের ফ্রেমে বিরাট গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। সেটা সে সারাতে নিয়ে যাচ্ছিল ঘড়ির দোকানে। আমরা দু’জনে গল্প করতে করতে যাচ্ছিলাম, একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। তা ছাড়া সন্ধ্যার সময়, হাজরার মোড়, লোকজন গিজগিজ করছে। এক মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলা উলটোদিক থেকে আসছিলেন। তিনিও নিশ্চয় খেয়াল করেননি, হঠাৎ তাঁর মাথাটা ঠুকে গেল আমার বন্ধুর হাতে উঁচু করে ধরা দেয়ালঘড়িটার কাঠের ফ্রেমে।
আচমকা আহত হয়ে মাথা তুলে তাকিয়েই মহিলা দেখেন ওই অত বড় একটা ঘড়ি। তিনি হয়তো কোথাও শিক্ষয়িত্রী-টিক্ষয়িত্রী হবেন, সে কী রাগারাগি শুরু করলেন আমাদের উপরে, ‘হাতঘড়ি ব্যবহার করতে পারেন না? এত বড় একটা ঘড়ি হাতে করে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন!’ যত বোঝাতে যাই, ঘড়ি সারাতে নিয়ে যাচ্ছি, কে শোনে কার কথা।
ঘড়ির সম্পর্কে সবচেয়ে গোলমেলে ব্যাপারটি ছিল গোপাল ভাঁড়ের বইয়ের মলাটে। গোপাল ভাঁড়ের আমলে অবশ্যই ঘড়ি ছিল না, ঘড়ি নিয়ে তাঁর কোনও রসিকতাও মনে পড়ছে না। কিন্তু ‘সচিত্র গোপাল ভাঁড়’ বইয়ের পুরনো চিৎপুর সংস্করণের কভারে ছবি ছিল ঘড়ি নিয়ে। একজন লোক ঘড়ি হাতে যাচ্ছে, তাকে আরেকজন জিজ্ঞাসা করছে, ‘দাদা, ক’টা বাজে?’ ঘড়িধারী দাঁত বার করে পালটা জিজ্ঞাসা করছেন, ‘দাদা, ক’টা চাই?’ অনেক মহৎ সমস্যার মতোই এই দ্বিতীয় প্রশ্নের আদি-অন্ত আমি আজও খুঁজে পাইনি।
আজকাল ডিজিটাল ঘড়ি চলছে। আলো জ্বলে-নেবে, মুহূর্তে মুহূর্তে সময় এগিয়ে যাচ্ছে। আমার এক তরুণ ব্যক্তিগত উপদেষ্টা আছেন। তিনি বলেছেন, ডিজিট্যাল ঘড়ি চলবে না, আবার ডায়াল ঘড়িতেই পশ্চিমিরা ফিরে যাচ্ছে। কারণ হল, ডিজিট্যাল ঘড়িতে মাত্র একটাই সময় দেখায়, যেমন বারোটা সাতান্ন কিংবা সাতটা তেত্রিশ। ব্যাপারটা খুবই ক্ষণিক। সিনেমার শো সাড়ে পাঁচটায়, সিনেমা হল বাড়ি থেকে দেড় মাইল দূরে, ডিজিটাল ঘড়িতে পাঁচটা তেরো, তাড়াতাড়ি করা দরকার কিন্তু সময়টা আমার মনে রেখাপাত করল না, কারণ শুধু একটা সময়ই দেখতে পেলাম। কিন্তু ডায়াল ঘড়িতে শুধু পাঁচটা তেরোই দেখতাম না, দেখতে পেতাম নির্দিষ্ট সময় থেকে মাত্র সতেরো ঘর দূরে আছি, মনের মধ্যে একটা তাড়া আসত। সময় তো শুধু সময় নয়, সে বহমান ও আপেক্ষিক, তাকে মুহূর্তের বিন্দুতে আবদ্ধ করলে চলবে না। সময় সম্পর্কে সচেতন হওয়ার ভাবটাই উবে যাবে।
অনেক সময় অনেকজনের কথা বলেছি। সময় সচেতনতা সম্পর্কে আমার ছোট ভাই বিজনের কথা বলি। আমার জানাশোনার মধ্যে সময়-জ্ঞানহীনতায় সেই ফার্স্ট যাচ্ছে। সে সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতে গেলে মহাভারত হবে। কিন্তু তার এই সময়জ্ঞানের অভাবের একটা প্রকৃত কারণ আছে। ওর দশ-বারো বছর বয়সে মামার বাড়িতে একটা দেয়াল-ঘড়ি দেয়াল থেকে খুলে ওর মাথায় পড়ে, ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আমার নিজের ধারণ, সেই থেকেই সময়বোধ ওর হারিয়ে গেছে। কিন্তু বিজন যেদিন বলল, ‘না দাদা, কারণ তা নয়।’ বলে ওর ডিজিট্যাল ঘড়িটা দেখিয়ে বলল, ‘এটাই কারণ।’ কারণটা দেখলাম ওর ডিজিটাল ঘড়িতে তেরোটা নিরানব্বই বেজেছে। বিজন একটু মৃদু হেসে বলল, ‘তেমন মারাত্মক কিছু নয়, অত ভয় পেয়ো না। ব্যাটারি ডাউন, পালটালেই আবার একটা থেকে বারোটার মধ্যে থাকবে।’