ঘড়িদাসের গুপ্তকথা

ঘড়িদাসের গুপ্তকথা

চল্লিশ বছর কাটিয়া যাইবার পর কোনও গুপ্ত কথারই আর ঝাঁঝ থাকে না, ছিপি-আঁটা বোতলের আরকের মতো অলক্ষিতে নিস্তেজ হইয়া পড়ে। বিশেষত গুপ্তকথার স্বত্বাধিকারী যদি সামান্য লোক হয়। আমার তরুণ বয়সের বন্ধু ঘড়িদাস অসামান্য লোক ছিল না; তাই চল্লিশ বছর আগে তাহার গুপ্তকথায় যে বিচিত্র চমৎকারিত্বের স্বাদ পাইয়াছিলাম, তাহা হয়তো বহু পূর্বেই পান্‌সে হইয়া গিয়াছে। সে এখন কোথায় আছে, বাঁচিয়া আছে কিনা, কিছুই জানি না। সম্ভবত মরিয়া গিয়াছে, কারণ বাঁচিয়া থাকিলে তাহার বয়স এতদিনে সত্তরের কাছাকাছি হইত। এত বয়স পর্যন্ত কয়জন বাঙালী বাঁচিয়া থাকে? সে বিবাহ করে নাই, সন্তান সন্ততির অভাব। তাই ভাবিতেছি, ঘড়িদাসের গুপ্তকথা এখন প্রকাশ করিলে অন্যায় হইবে না।

বাংলা দেশের প্রত্যন্তভাগে মধ্যমাকৃতি একটি জেলা-শহরে তখন বাস করিতাম। রাস্তায় মোটর গাড়ির চেয়ে ঘোড়ার গাড়ি বেশী চলিত, রাত্রে কেরোসিনের বাতি জ্বলিত। ফ্রয়েডের নাম তখনও ভারতবর্ষে কেহ শোনে নাই।

ঘড়িদাসের আসল নাম হরিদাস। তাহার একটি ঘড়ি মেরামতের দোকান ছিল, তাই স্বভাবতই সকলে তাহাকে ঘড়িদাস বলিয়া ডাকিত। আমি যদিও ঘড়িদাসের চেয়ে চার-পাঁচ বছরের ছোট ছিলাম, তবু তাহার সহিত আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব জন্মিয়াছিল। আমার বয়স তখন ছিল উনিশ-কুড়ি; তাহার কাছে আমি দাবা খেলিতে ও সিগারেট খাইতে শিখিয়াছিলাম।

বাজারের মণিহারী পটির একপাশে ঘড়িদাসের দোকান ছিল। সামনে পিছনে দুটি ঘর। সামনের ঘরে দোকান, পিছনের ঘরে ঘড়িদাস বাস করিত। মনে আছে, তাহার বাসার ভাড়া ছিল সাড়ে চার টাকা। একবার তাহাকে ভাড়ার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, সে সগর্বে বলিয়াছিল—‘হাফ পাস্ট ফোর।’ ঘড়িদাসের বিদ্যা ছিল স্কুলের সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত, কিন্তু সুবিধা পাইলেই ইংরেজি বলিত।

ঘড়িদাসের মা-বাপ ছিল না। এক মামা ছিল, কলিকাতায় চাকরি করিত; মাঝে-মধ্যে ঘড়িদাসকে চিঠি লিখিত। তাহার বাসায় আত্মীয়স্বজন কাহাকেও কখনও দেখি নাই। সকালবিকাল সে দোকানে একটি দেরাজযুক্ত জলচৌকির সম্মুখে বসিয়া ঘড়ি মেরামত করিত, বাকি সময়টা পিছনের ঘরে শুইয়া কাটাইত। আমার সহিত তাহার আলাপের সূত্র, পরীক্ষার আগে আমার এলার্ম ঘড়িটা খারাপ হইয়া গিয়াছিল, তাহার কাছে মেরামত করাইতে লইয়া গিয়াছিলাম। সে মেরামত করিয়া দিয়াছিল, পয়সা লয় নাই। লোকটিকে আমার ভাল লাগিয়াছিল। তারপর হইতে দুপুরবেলা অবসর থাকিলে তাহার ঘরে গিয়া আড্ডা দিতাম। লুকাইয়া ধূমপান ও দাবা খেলা চলিত।

একদিন জ্যৈষ্ঠের আম-পাকানো দুপুরবেলা ঘড়িদাসের দোকানে গিয়াছি। দুপুরবেলা যদি কোনও খদ্দের আসে, এইজন্য সদরের দরজা ভেজানো থাকে। আমি তাহার দোকানঘর পার হইয়া শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলাম; সে তক্তপোশে লম্বা হইয়া একখানা পোস্টকার্ড পড়িতেছে। আমি বলিলাম—‘এ কি ঘড়িদা, তোমাকে চিঠি লিখল কে? প্রেমপত্র নাকি?’

ঘড়িদাস হাসিতে হাসিতে উঠিয়া বসিল—‘প্রেমপত্রই বটে। মামা কলকাতা থেকে চিঠি লিখেছে, আমার বিয়ের সম্বন্ধ করেছে।’

বলিলাম—‘বেশ তো, লাগিয়ে দাও। আমি বরযাত্ৰ যাব।’

ঘড়িদাস বলিল—‘তুই ক্ষেপেছিস। যা আমার চেহারা, বৌ শেষকালে ছাঁদনাতলা থেকে abscond করুক আর কি! ওসবের মধ্যে আমি নেই বাবা।’

বস্তুত ঘড়িদাসের চেহারা মনোমুগ্ধকর নয়। কালো রোগা লম্বা দেহ, হাড় বাহির করা মুখ, নাকটা মুচড়াইয়া একদিকে বাঁকিয়া আছে, মাথার চুল খোঁচা খোঁচা। তাছাড়া তাহার পা দু’টার দৈর্ঘ্যও সমান নয়, তাই সে বেশ একটু খোঁড়াইয়া চলে। এরূপ স্বামী পাইয়া কোনও মেয়ে আনন্দে আত্মহারা হইবে সে সম্ভাবনা কম।

ঘড়িদাস চিঠিখানা বালিশের তলায় রাখিয়া বলিল—‘আয়, এক দান খেলা যাক।’

বিছানার উপর দাবার ছক পাতিয়া ঘুঁটি সাজাইতে সাজাইতে সে বলিল—‘মেয়েমানুষ ভারি ডেঞ্জারাস্‌, বিয়ে হয়েছে কি পট করে বাচ্চা! আমার মামার সাত মেয়ে তিন ছেলে, মাইনে পায় কুল্‌লে দেড়শো টাকা। মানে গড়পড়তা সাড়ে বার টাকা per head! বাপস্‌! আমি একলা মানুষ, আমারই মাসে ত্রিশ টাকা খরচ!’

সে আমাকে একটা কাঁচি সিগারেট দিল, নিজে একটা ধরাইল। খেলা আরম্ভ হইল। কিছুক্ষণ খেলা চলিবার পর লক্ষ্য করিলাম, অন্য দিন যেমন পাঁচ-সাত দান দিবার পরই সে আমার টুঁটি টিপিয়া ধরে আজ তাহা পারিতেছে না। মামার চিঠিখানা বোধ হয় ভিতরে ভিতরে তাহার মনকে বিক্ষিপ্ত করিয়াছে।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য মাৎ হইয়া গেলাম। ঘড়িদাস ঘুঁটিগুলি কৌটার মধ্যে ভরিতে ভরিতে বলিল—‘শশা, একটা কুকুরছানা জোগাড় করতে পারিস?’

অবাক হইয়া বলিলাম—‘কুকুরছানা কি হবে?’

সে বলিল—‘পুষব। বেশ একটা তুলতুলে লোমওলা কুকুরছানা। জানিস তো কুকুর হচ্ছে মানুষের best friend.’

আমি বলিলাম—‘কুকুর তুমি পুষো না ঘড়িদা, ভারি ঘরদোর নোংরা করে। তার চেয়ে পাখি পোষো, কোনও ঝামেলা নেই।’

‘পাখি!’ ঘড়িদাস চিন্তা করিয়া বলিল—‘মন্দ বলিসনি। টিয়া পাখি! রাধা কেষ্ট পড়বে। কিংবা এক খাঁচা মুনিয়া পাখি—’

তখন আমার বয়স কম ছিল, ঘড়িদাসের পশুপক্ষী-প্রীতির মর্মার্থ বুঝি নাই।

আর একদিন দুপুরবেলা এমনি খেলিতে বসিয়াছি। সে দিনটা বোধ হয় ঘড়িদাসের জীবনে সব চেয়ে স্মরণীয় দিন। খেলিতে খেলিতে দু’জনেই তন্ময় হইয়া গিয়াছিলাম, যে অবস্থায় দাবা-খেলোয়াড় ‘কাদের সাপ?’ প্রশ্ন করে আমাদের তখন সেই অবস্থা। তাই বাহিরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ কানে প্রবেশ করিলেও মন পর্যন্ত পৌঁছায় নাই। হঠাৎ যখন চমক ভাঙিল তখন ঘাড় তুলিয়া দেখি, একটি যুবতী শয়নকক্ষের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

দু’জনে হতভম্ব হইয়া চাহিয়া রহিলাম। সেকালে পথেঘাটে ভদ্ৰশ্রেণীর যুবতী চোখে পড়িত না, কদাচিৎ চোখে পড়িলে মনে হইত বুঝি অলৌকিক আবির্ভাব। হৃদয় রসায়িত হইত, কল্পনা জাল বুনিতে আরম্ভ করিয়া দিত। এই যুবতীটি কিন্তু আমাদের অপরিচিত নয়, শহরের পথে বিপথে বিদ্যুচ্চমকের মতো তাহাকে বহুবার দেখিয়াছিল। সিভিল সার্জন সুব্রত ঘোষালের কন্যা প্রমীলা।

প্রমীলা ঘোষাল সত্যই সুন্দরী ছিল, কিংবা আমরা অবরুদ্ধ কৌমার্যের চক্ষু দিয়া তাহাকে সুন্দর দেখিয়াছিলাম, তাহা আজ আর স্মরণ করিতে পারি না। মনে হয় তাহার গায়ের রঙ ফরসা ছিল, চোখে ছিল প্রগল্‌ভ চটুলতা, আর সারা গায়ে ছিল ভরা যৌবন। এ ছাড়া তাহার চেহারার সমস্তই ঝাপসা হইয়া গিয়াছে। তাহার একটি ছোট্ট মোটর-গাড়ি ছিল, সেটি নিজে চালাইয়া সে যখন রাস্তা দিয়া চলিয়া যাইত তখন মনে হইত যেন একটা রোমহর্ষণ কাণ্ড ঘটিয়া গেল। এই নিজে মোটর-গাড়ি চালানোই ছিল তখন এক অপরিমেয় বিস্ময়। তাছাড়া জনশ্রুতি ছিল, সে সাহেবদের ক্লাবে গিয়া বলডান্স করে। সব মিলিয়া প্রমীলা ঘোষাল এক পরম রমণীয় রোমান্টিক মূর্তি হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। কল্পনাবিলাসী যুবকেরা ঘুমাইয়া তাহাকে স্বপ্ন দেখিত।

এমন যে প্রমীলা ঘোষাল, সে ঘড়িদাসের শয়নকক্ষের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে; আমরা নির্বাক, নিষ্পলক, প্রায় নিস্পন্দ। তারপর বাঁশীর মতো কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম—‘ঘড়িদাস কার নাম?’

ঘড়িদাস সূচীবিদ্ধবৎ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল—‘আমি—মানে আমি হরিদাস—’

প্রমীলা তাহার পানে চাহিয়া মুচকি হাসিল—‘কড়া নেড়ে সাড়া পেলুম না, তাই ভেতরে ঢুকেছি। আপনি ঘড়ি মেরামত করেন?’

ঘড়িদাস বলিল—‘হ্যাঁ—আমি—হ্যাঁ।’

প্রমীলা বলিল—‘আমার রিস্ট-ওয়াচটা চলছে না, আপনি ঠিক করে দিতে পারবেন?’

ঘড়িদাস বলিল—‘রিস্ট-ওয়াচ! হ্যাঁ পারব—নিশ্চয় পারব।’

প্রমীলার কব্জি হইতে একটি ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলিতেছিল, সে তাহা খুলিয়া ছোট্ট একটি সোনার ঘড়ি বাহির করিয়া ঘড়িদাসের হাতে দিল। ঘড়িদাস নাড়িয়া চাড়িয়া পরীক্ষা করিল, দম দিয়া দেখিল, তারপর বলিল—‘মেন্-স্প্রিং ভেঙে গেছে।’

প্রমীলা বলিল—‘ও।—তা আপনি মেরামত করতে পারবেন তো? নইলে আবার কলকাতায় পাঠাতে হবে।’

‘না না, আমি পারব।’

‘আমার কিন্তু শিগ্‌গির চাই।’

‘কাল পরশুর মধ্যে ঘড়ি মেরামত করে আমি আপনার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব।’

প্রমীলা তাহার প্রতি স্মিত কটাক্ষপাত করিল—‘আপনি আমার বাড়ি চেনেন? ভালই হল, বাড়িতেই পৌঁছে দেবেন। বিল নিয়ে যাবেন, টাকা চুকিয়ে দেব।’

ঘড়িদাস কি একটা বলিতে চাহিল, কিন্তু বলিতে পারিল না। প্রমীলা একটু ঘাড় হেলাইয়া প্রস্থানোদ্যতা হইল, তারপর ফিরিয়া বলিল—‘ঘড়িটা দামী, দু’শো টাকা দাম। আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি, হারিয়ে-টারিয়ে যাবে না তো?’

‘না না, কোনও ভয় নেই—’

‘আচ্ছা। কাল পরশুর মধ্যে নিশ্চয় যেন পাই।’

প্রমীলা খুট্‌ খুট্‌ জুতার শব্দ করিয়া চলিয়া গেল, ঘড়িদাস তাহার পিছন পিছন গেল। আমি ঘরে বসিয়া শুনিতে পাইলাম প্রমীলার মোটর চলিয়া গেল। তারপর ঘড়িদাস ফিরিয়া আসিয়া তক্তপোশের পাশে বসিল। তাহার মুঠির মধ্যে ঘড়িটা ছিল, মুঠি খুলিয়া সম্মোহিতের মতো সেটাকে দেখিতে লাগিল।

আমি বলিলাম—‘ঘড়িদা, তোমার খ্যাতি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে দেখছি, প্রমীলা ঘোষালও নাম জানে!’

ঘড়িদাস একবার চোখ তুলিয়া ফিকা হাসিল, তারপর আবার ঘড়ির প্রতি মনঃসংযোগ করিল।

জিজ্ঞাসা করিলাম—‘বাজিটা শেষ করবে নাকি?’

‘বাজি? ও—না ভাই, আজ থাক, আর একদিন খেলা শেষ করা যাবে।’ বলিয়া ঘড়িদাস দোকানঘরে তাহার জলচৌকির সামনে গিয়া বসিল। চৌকির উপর কয়েকটা ঘড়ি যত্রতত্র ছড়ানো ছিল, সেগুলা এক পাশে সরাইয়া প্রমীলার ঘড়ি খুলিতে প্রবৃত্ত হইল।

আমি চলিয়া আসিলাম।

পরদিন দুপুরে ঘড়িদাসের কাছে যাই নাই। সন্ধ্যার পর পড়িতে বসিয়াছি, ঘড়িদাস আসিয়া উপস্থিত। মাথার চুল উস্কখুস্ক, চোখের দৃষ্টি বিভ্রান্ত, নাকটা যেন আরও বাঁকিয়া গিয়াছে, খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে আমার পড়ার ঘরে ঢুকিয়া বলিল—‘ওরে শশা, সর্বনাশ হয়েছে, ঘড়িটা চুরি গেছে।’

‘কোন ঘড়ি? প্রমীলা ঘোষালের ঘড়ি?’

‘হ্যাঁ। এখন আমি কি করি?’

‘চুরি গেল কি করে?’

‘দুপুরবেলা কেউ ঘরে ঢুকে চুরি করে নিয়ে গেছে। আমি শোবার ঘরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম—’

‘পুলিসে খবর দিয়েছ?’

‘ও বাবা, পুলিসে খবর দিলে তারা হয়তো আমাকেই ধরে হাজতে পুরবে। সিভিল সার্জনের মেয়ের ঘড়ি।’

‘তবে কি করবে?’

‘কি করব ভেবে পাচ্ছি না। তুই বল্‌ না।’

আমি কি বলিব ভাবিয়া পাইলাম না। তখন ঘড়িদাস নিজেই বলিল—‘এক উপায় দাম দিয়ে দেওয়া। প্রমীলা বলেছিল ঘড়ির দাম দু’শো টাকা—’

জিজ্ঞাসা করিলাম—‘দু’শো টাকা তুমি দিতে পারবে?’

‘কোথায় পাব দু’শো টাকা? কুড়িয়ে বাড়িয়ে টাকা পঞ্চাশেক হতে পারে।’

‘তাহলে উপায়?’

ঘড়িদাস আমার হাত ধরিয়া করুণ বচনে বলিল—‘শশা, তুই আমাকে বাঁচা, নইলে সুইসাইড হয়ে যাব। যেখান থেকে হোক শ’ দেড়েক টাকা জোগাড় করে দে। আমি যেমন করে পারি তিন মাসে শোধ করে দেব।’

শেষ পর্যন্ত সেই রাত্রেই দেড়শো টাকা সংগ্রহ করিলাম। সংগ্রহ করা খুব সহজ হয় নাই, অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করিতে হইয়াছিল। কিন্তু সে যাক। সুখের বিষয় ঘড়িদাস মেয়াদ পূর্ণ হইবার পূর্বেই টাকা শোধ করিয়াছিল, কথার খেলাপ করে নাই।

পরদিন সকালবেলা ঘড়িদাস আবার আসিয়া উপস্থিত। বলিল—‘ভাই, একলা যেতে ভয় করছে, তুইও সঙ্গে চল। সিভিল সার্জন সায়েব শুনেছি কড়া পিত্তির লোক, যদি মারধর করে!’

সুতরাং আমিও সঙ্গে গেলাম।

সাহেব-পাড়ায় ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোর পাশে সিভিল সার্জনের বাংলো। বাগানের মাঝখানে বাড়ি, উর্দি-পরা আর্দালি বেয়ারা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আমরা এত্তালা পাঠাইয়া বলিদানের জোড়া পাঁঠার মতো ঘোষাল সাহেবের সম্মুখীন হইলাম।

ঘোষাল সাহেব রীতিমত সাহেব, চেহারাও সাহেবের মতো। অফিসে বসিয়া কাগজপত্র দেখিতেছিলেন, আমাদের দিকে ভ্রূ বাঁকাইয়া চাহিলেন। ঘড়িদাস আমার পানে কাতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, আমি কোনও রকমে বক্তব্যটা বলিয়া ফেলিলাম।

‘আমার মেয়ের ঘড়ি চুরি গেছে!’ ঘোষাল সাহেবের গৌরবর্ণ মুখ অগ্নিবৎ জ্বলিয়া উঠিল। তিনি টেবিলস্থ ঘণ্টির উপর মুষ্ট্যাঘাত করিলেন, আর্দালি ছুটিয়া আসিল। তিনি চাপা গর্জনে বলিলেন—‘মিসিবাবাকো বোলাও।’

আর্দালি ছুটিয়া ভিতরের দিকে চলিয়া গেল। ঘোষাল সাহেব ব্যাঘ্র-দৃষ্টিতে আমাদের পানে চাহিয়া রহিলেন।

দুই মিনিট পরে প্রমীলা প্রবেশ করিল। সে বোধ হয় সবেমাত্র ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়াছে, মুখ থম্‌থমে, চোখে ঘুম-ঘুম ভাব, অবিন্যস্ত বেণীর প্রান্তে বিনুনি একটু শিথিল হইয়া আছে। আমাদের দিকে একবার অলস কটাক্ষপাত করিয়া বাপের টেবিলের পাশে গিয়া দাঁড়াইল—‘কি বাবা?’

ঘোষাল সাহেব আমাদের দিকে তর্জনী নির্দেশ করিয়া বলিলেন—‘তুমি এদের ঘড়ি মেরামত করতে দিয়েছিলে। আমি তখনি মানা করেছিলাম। তোমার ঘড়ি চুরি গেছে। অন্তত এরা তাই বলছে।’

প্রমীলা আমাদের দিকে ফিরিয়া বিস্ফারিত চক্ষে চাহিল, তারপর আর্ত স্বরে বলিল—‘অ্যাঁ,—চুরি গেছে। সে যে আমার জন্মতিথির ঘড়ি। বাবা!’

ঘোষাল সাহেব তর্জন ছাড়িলেন—‘পুলিসে দেব! আমার সঙ্গে চালাকি! ঘড়ি হজম করবে!—এই বেয়ারা!’

আমি মরীয়া হইয়া বলিলাম—‘ঘড়ির দাম ইনি দিতে রাজী আছেন। আপনার মেয়ে বলেছিলেন ঘড়ির দাম দু’শো টাকা। ইনি দু’শো টাকা এনেছেন।’

সঙ্গে সঙ্গে ঘরের হাওয়া যেন বদলাইয়া গেল। প্রমীলার আর্ত ব্যাকুলতার ভাব আর রহিল না, ঘোষাল সাহেবের রক্ত-চক্ষু নিমেষ মধ্যে ঠাণ্ডা হইয়া গেল। পিতাপুত্রীর মধ্যে একবার চকিত দৃষ্টি বিনিময় হইল। তারপর ঘোষাল সাহেব অপেক্ষাকৃত নরম সুরে বলিলেন—‘টাকা এনেছ?’

‘আজ্ঞে এই যে—’ বলিয়া ঘড়িদাস পকেট হইতে টাকা বাহির করিল।

ঘোষাল সাহেব প্রসন্ন স্বরে বলিলেন—‘রেখে যাও। তোমার কম বয়স তাই এবার ছেড়ে দিলাম। ভবিষ্যতে সাবধান থেকো। যাও।’

ঘর হইতে বাহির হইবার সময় আমি একবার পিছু ফিরিয়া চাহিলাম। দেখিলাম পিতাপুত্রী পরস্পরের পানে চাহিয়া সানন্দে মৃদু মৃদু হাসিতেছেন।

রাস্তায় চলিতে চলিতে আমার মনটা কেমন খুঁত খুঁত করিতে লাগিল। বলিলাম—‘ঘড়িটার দাম বোধ হয় দু’শো টাকা নয়, বোধ হয় গিল্টি সোনা।’

ঘড়িদাস আমার দিকে তাকাইল না, অন্য দিকে ঘাড় ফিরাইয়া বলিল—‘হুঁ!’

দেখিলাম ঘড়িদাস জানে। সে ঘড়ির কাজ করে, ঘড়ির দাম জানা তাহার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু জানিয়া শুনিয়া বেশী দাম কেন দিল বুঝিলাম না। হয়তো ভাবিয়াছে এ লইয়া ঘাঁটাঘাঁটি করিলে লোকে জানিতে পারিবে, তাহার ব্যবসার ক্ষতি হইবে, তাই চাপিয়া গিয়াছে।

যাহোক, এই ঘটনার পর কয়েক মাস কাটিয়া গিয়াছে। গ্রীষ্ম গিয়া বর্ষা আসিয়াছিল, তাহাও বিগত হইয়া শারদীয়া পূজা আসিয়া পড়িয়াছে। আমরা ক্লাবে থিয়েটারের মহলা আরম্ভ করিয়াছি।

দিন ছয়-সাত ঘড়িদাসের ওখানে যাই নাই, একদিন বিকালে গিয়া দেখি, সে কম্বল মুড়ি দিয়া শুইয়া আছে। বলিলাম—‘একি ঘড়িদা, এই গরমে কম্বল?’

ঘড়িদাস কম্বলের ভিতর হইতে মুণ্ড বাহির করিল—‘ম্যালেরিয়া ধরেছে রে শশা’ বলিয়া আবার কম্বলে মুখ লুকাইল।

ম্যালেরিয়ার সময় বটে। বলিলাম—‘কবে থেকে ধরেছে?’

ঘড়িদাস কম্বলের ভিতর হইতে বলিল—‘পরশু থেকে।’

‘কুইনিন্ খেয়েছ?’

‘না।’

আমি তক্তপোশের পাশে গিয়া বসিলাম। জ্বরের ঝোঁকে তাহার সর্বশরীর কাঁপিতেছে, এমন কি তক্তপোশটা পর্যন্ত কাঁপিতেছে। বলিলাম—‘খেলে না কেন? দশ গ্রেন পেটে পড়লেই জ্বরটা বন্ধ হত!’

সে উত্তর দিল না, লেপ মুড়ি দিয়া কাঁপিতে লাগিল। আমি বলিলাম—‘তোমার দেখাশোনা করছে কে?’

এবার সে বলিল—‘দেখাশোনা কে করবে? একলাই তিনদিন পড়ে আছি। তুই ছিলি কোথায়?’

থিয়েটার লইয়া মত্ত ছিলাম বলিতে পারিলাম না। বলিলাম—‘আমি কি জানতাম তুমি জ্বরে পড়েছ? যাহোক, তুমি শুয়ে থাকো, আমি ডাক্তারখানা থেকে ওষুধ নিয়ে আসি।’

সে কম্বল হইতে মুখ বাহির করিল, আরক্ত চক্ষু আমার মুখের উপর স্থাপন করিয়া বলিল—‘আমার কিন্তু হাতে একটি পয়সা নেই। মামা পুজোর সময় টাকা চেয়েছিল, হাতে যা ছিল পাঠিয়ে দিয়েছি। ওষুধের দাম তোকেই দিতে হবে।’

‘দেব’ বলিয়া আমি বাহির হইলাম।

আধ ঘণ্টা পরে কুইনিন্‌-মিক্‌শ্চারের শিশি, বিস্কুট সাবু বার্লি প্রভৃতি লইয়া ফিরিয়া আসিয়া দেখি ঘড়িদাসের কাঁপুনি কমিয়াছে, জ্বর ছাড়িতেছে। তাহাকে এক দাগ মিক্‌শ্চার গিলাইয়া সাবু করিতে বসিলাম। ঘড়িদাসের একটা প্রাচীন স্টোভ ছিল।

সন্ধ্যার সময় তাহার জ্বর ছাড়িয়া গেল, সে কম্বল ফেলিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিল। গদ্‌গদ স্বরে বলিল—‘তুই না থাকলে আমার কি হত রে শশা?’

বলিলাম—‘শেয়ালে টেনে নিয়ে যেত। এখন একটু নড়ে বসো দেখি, ভাল করে বিছানাটা পেতে দিই। ভারি অপরিষ্কার হয়েছে।’

সে ব্যগ্র হইয়া বলিল—‘না না, কিছু দরকার নেই। তুই এবার বাড়ি যা।’

আমি তাহার আপত্তি উপেক্ষা করিয়া প্রথমেই মাথার বালিশটা তুলিয়া উল্টাইতে গেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে স্থিরচক্ষু হইয়া গেলাম। বালিশের তলায় যে বস্তুটি ছিল তাহার আমার চক্ষু এবং মনকে যুগপৎ ধাঁধিয়া দিল।

প্রমীলা ঘোষালের সোনার ঘড়ি।

‘একি, এ যে প্রমীলার ঘড়ি!’ বলিয়া আমি ঘড়িটা তুলিয়া লইতে গেলাম।

ঘড়িদাস ঝাঁপাইয়া পড়িয়া ঘড়িটা আমার হাত হইতে প্রায় কাড়িয়া লইল। তারপর গুটিশুটি পাকাইয়া বিছানায় শুইয়া মাথায় কম্বল চাপা দিল।

কিছুই বুঝিতে বাকী রহিল না। প্রমীলার ঘড়ি চুরি যায় নাই, ঘড়িদাস কম দামী ঘড়ির দু’শো টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়া নিজের কাছে রাখিয়াছে। ঘড়ি চুরি গিয়াছে বলিয়া খাসা অভিনয় করিয়াছে। কিন্তু কেন? কেন?

কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া আমি দ্বারের দিকে চলিলাম—‘আচ্ছা চলি। তুমি কিন্তু চমৎকার অভিনয় করতে পার ঘড়িদা।’

ঘড়িদাস কম্বল হইতে মুখ বাহিরে করিয়া সলজ্জকণ্ঠে বলিল—‘শশা, কাউকে বলিস্‌নি ভাই।’

সেদিন ঘড়িদাসের অদ্ভুত আচরণের অর্থ খুঁজিয়া পাই নাই। এখন ফ্রয়েড্‌ পড়িয়া বুঝিয়াছি। সে কুকুর পুষিতে চাহিয়াছিল, পাখি পুষিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না।

ঘড়িদাস যদি বাঁচিয়া থাকে, ঘড়িটা এখনও তাহার কাছে আছি কি? না যৌবনের নেশা যৌবনের সঙ্গে শেষ হইয়া গিয়াছিল?

৩২ আষাঢ় ১৩৬৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *