2 of 2

ঘটনা – বনফুল

ঘটনা – বনফুল

আমি তখন মেডিকেল কলেজে পড়ি।

তখনও মড়া কাটা চলছে। হাত, পা, পেট, বুক হয়ে গেছে। গলা এবং মাথা বাকি। আমাদের নিয়ম ছিল, কোনও অংশ ব্যবচ্ছেদ করবার পূর্বে সেই অংশটির অস্থিগুলির সম্বন্ধে সম্যকরূপে জ্ঞানার্জন করতে হত। না করতে পারলে সেই অংশটি ব্যবচ্ছেদ করবার অনুমতি কর্তৃপক্ষরা দিতেন না। অস্থি-বিষয়ক একটা পরীক্ষা দিতে হত—তাতে পাশ করলে তবে পার্ট পাওয়া যেত। গ্রে-র অ্যানাটমি খুলে গলার কয়েকটা হাড় এবং মড়ার মাথা নিয়ে সন্ধ্যা থেকেই তাই পড়তে বসেছিলাম সেদিন। ডাক্তার বসাক বড় কড়া পরীক্ষক, তাঁর কাছে ফাঁকি চলবে না। মড়ার মাথাটাও দিন-দুই পরে মুন্না ডোমকে ফেরত দিতে হবে। কলেজের সম্পত্তি। বকশিশের লোভে লুকিয়ে আমাকে দিয়েছিল। মাথায় এমন অনেক পাতলা কাগজের মতো হাড় আছে, যা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ঠিক পাঠোপযোগী করা দুঃসাধ্য, সেসব হাড় তাই দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্মূল্য। আমরা অনেকেই তা কিনতে পারতাম না। কলেজে প্রফেসরের পড়াবার জন্য অবশ্য একাধিক সেট থাকত মুন্না ডোমের জিম্মায়। আমরা তাকে বকশিশ দিয়ে সেইসব হাড় একদিন কিংবা দু-দিনের কড়ারে মেসে নিয়ে এসে পড়তাম। মড়ার মাথাটা মুন্নাই দিয়েছিল। বেশি বড় নয়, ছোট্ট মাথাটি।

সেদিন পড়া আরম্ভ করবার আগেই কেন জানি না—রেণুকে মনে পড়ল। প্রায় বছর-ছয়েক পূর্বে রেণু মেয়েটি আমাদের বাড়িতে এসেছিল। রেণুর বাবা যোগেনবাবু কী একটা আপিসে চাকরি করতেন। কোথা থেকে যেন বদলি হয়ে এসে আমাদের প্রতিবেশী হয়েছিলেন অল্প কিছুদিনের জন্যে। তখন আমরা পাটনায় থাকি—আমি সবে তখন ম্যাট্রিক ক্লাসে উঠেছি। বয়স মাত্র পনেরো বছর। কিন্তু সেই বয়সেই বেশ মনে আছে, রেণুর প্রেমে পড়েছিলাম। রেণুর বয়সও তখন দশ-এগারোর বেশি নয়, কিন্তু আমার মনে হয়, রেণুও আমার প্রেমে পড়েছিল। কারণও ছিল একটু। যোগেনবাবু আমাদের স্বজাতি এবং পালটি ঘর ছিলেন, আমার সঙ্গে নাকি রেণুর বিয়ের প্রস্তাব করেছিলেন তিনি বাবার কাছে। তাই আমাদের উভয়ের মধ্যে প্রচ্ছন্ন প্রেমের উদ্ভব হয়েছিল। একটু রোগা কালো ছিপছিপে ধরনের চেহারা ছিল রেণুর। ভাসা-ভাসা বড়-বড় চোখ দুটি। জানলার গরাদ ধরে সে প্রায়ই আমাদের বাড়ির দিকে চেয়ে থাকত, আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই পালিয়ে যেত। বিয়ের প্রস্তাব অবশ্য বেশিদূর এগোয়নি—বাবা আমল দেননি বিশেষ। উপার্জনক্ষম না হলে ছেলের বিয়ে দেবেন না, এই তাঁর মত ছিল। কিছুদিন পরে যোগেনবাবু বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। রেণুর সঙ্গে প্রত্যক্ষ আর-কোনও সম্পর্ক রইল না। রেণুকে কিন্তু অনেকদিন ভুলতে পারিনি আমি। তার রোগা মুখের বড় চোখদুটো অনেকদিন পর্যন্ত আমার মনে ছিল—পরে অবশ্য ভুলে গেছি। সেদিন পড়তে বসার আগে এবং অনেকদিন পর অকারণে রেণুকে মনে পড়ল আবার। কেন জানি না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম। বেশিক্ষণ কিন্তু নয়। মিনিট-দুই পরেই তোয়ালে-কাঁধে শিবুদা প্রবেশ করলেন। ঘর্মাক্ত কলেবর। ডনবৈঠক সেরে স্নান করতে যাচ্ছিলেন। বললেন, ‘আমি স্লাইডটা পরীক্ষা করে দেখলাম হে। প্রচুর গনোককাস। ও-ব্যাটাকে আর রাখা চলবে না—’ বলেই বেরিয়ে গেলেন। সেদিন সকালে আমাদের মেসের ঠাকুরটা শিবুদার হাতে মার খেয়েছিল খুব। আমরা সকালে স্নান করতে গেছি নীচের কলতলায়—শিবুদা দেখি ঠাকুরটাকে ঠ্যাঙাচ্ছেন।

কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, ‘গনোরিয়া হয়েছে ব্যাটার।’

মাধববাবু (শিবুদার সহপাঠী—তিনিও স্নান করছিলেন) বললেন, ‘গনোরিয়া হয়েছে, আগে সেটা প্রমাণ করো। আগে থাকতেই মারছ কেন ব্রাহ্মণকে—?’

‘গলগল করে পুঁজ বেরুচ্ছে—আর অন্য কী হবে? আচ্ছা, একটা স্লাইড নিচ্ছি আমি—।’

শিবুদা একটা স্লাইডে পুঁজ মাখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরীক্ষার ফলটা আমাকেও জানিয়ে গেলেন। ঠাকুরটা যে দুশ্চরিত্র তাতে আর সন্দেহ রইল না।

বাজে চিন্তা মন থেকে সরিয়ে পড়া শুরু করলাম। অনেক পড়তে হবে। রাত্রি প্রায় বারোটা পর্যন্ত পড়লাম। তবু সবটা শেষ হল না। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতে লাগল। বাধ্য হয়ে অ্যানাটমি বন্ধ করে মড়ার মাথাটা শেলফের ওপর তুলে রেখে শুয়ে পড়তে হল। মনে ক্ষীণ আশা নিয়ে শুলাম যে, ভোরে উঠে বাকিটা পড়ে ফেলতে পারব। আশা কিন্তু অতিশয় ক্ষীণ। কারণ, আমি কোনওদিনই ভোরে উঠতে পারি না। আমার রুমমেট জিতেন রোজ আমাকে আটটার সময় টেনে তোলে। জিতেনও বাড়ি গেছে, সুতরাং ভোরে ওঠার আশা কম। তবু শুয়ে পড়লাম।

সেদিন কিন্তু খুব আশ্চর্য কাণ্ড হল—রাত দুটোর সময় ঘুম ভেঙে গেল আমার। পাশের বাড়ির ঘড়িতে টং-টং করে দুটো বাজল স্পষ্ট শুনতে পেলাম। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি—কিছুতেই ঘুম আসে না। একবার মনে হল, ঘুম যখন আসছে না, তখন উঠে পড়তে আরম্ভ করি—কিন্তু কুঁড়েমি করে উঠতেও ইচ্ছে করছে না—উঠি-উঠি করে চোখ বুজেই পড়ে আছি বিছানায়। এমন সময় গাড়িবারান্দায় কার যেন পায়ের শব্দ পেলাম। মনে হল, কে যেন আমার ঘরের দিকে আসছে। আমার ঘরের কোণে প্রকাণ্ড একটি কুঁজোয় গ্লাস-ঢাকা জল থাকত। শিবুদা পাশের ঘর থেকে মাঝে-মাঝে জল খেতে আসতেন। আমরা থাকতাম দোতলায়। রাত্রে সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ থাকত খালি—আমাদের সকলের ঘরের দরজা খোলা থাকত। মনে করলাম, শিবুদাই আসছেন বোধহয় জল খেতে। প্রতি মুহূর্তেই প্রত্যাশা করছি, এইবার কুঁজোর ভকভক শব্দটা শুনতে পাব। কোনও শব্দ হল না। পায়ের শব্দটা যেন আমার ঘরের দরজা পর্যন্ত এসে থেমে গেল। কে এসেছে, দেখবার জন্যে উঠে বসলাম। দেখি, কলেজ স্কোয়ার থেকে একঝলক আলো এসে আমার দরজার সামনে পড়েছে, আর সেই আলোয় শ্বেতবসনা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখতে পাচ্ছিলাম না যদিও, কিন্তু সে যে মেয়ে তাতে সন্দেহ ছিল না। মনে হল, নির্নিমেষে আমারই দিকে চেয়ে আছে যেন।

মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল, ‘কে?’

কথাটা উচ্চারিত হওয়ামাত্র মেয়েটি ঘরের ভিতর ঢুকে অপর দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। আমার ঘরের সামনা-সামনি দুটো দরজা ছিল—একটা গাড়িবারান্দার দিকে, আর-একটা বাথরুমের দিকে। মনে হল, মেয়েটি বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। ঠাকুরটা তার প্রণয়িনীকে ডেকে আনেনি তো! তৎক্ষণাৎ আলো জ্বেলে অনুসরণ করলাম।

বাথরুমে কেউ নেই। সিঁড়ির দরজা খিল লাগানো। তেতলার ছাদে উঠে গেলাম, সেখানেও কেউ নেই। সম্ভব-অসম্ভব সব জায়গায় খুঁজলাম, কোথাও কারও চিহ্ন পর্যন্ত নেই। সিঁড়ির দরজা খুলে নীচে নেমে গেলাম। দেখি, ঠাকুরটা নিজের ঘরে শুয়ে অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ওঠালাম তবু তাকে।

‘এই, কে এসেছিল এখন?’

‘কই, কেউ তো না বাবু।’

চোখ মিটমিট করে বিস্মিত ঠাকুর চেয়ে রইল আমার দিকে। মুখ দেখে মনে হল, সত্যিই সে কিছু জানে না।

আশ্চর্য! কোথা গেল মেয়েটা! স্বচক্ষে স্পষ্ট দেখলাম, অথচ—, নানারকম ভাবতে-ভাবতে ঘরে ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল মড়ার মাথাটা। শূন্য অক্ষি-কোটর দুটো যেন নির্নিমেষে আমার দিকে চেয়ে আছে। গা ছমছম করতে লাগল। শিবুদার ঘরে গিয়ে তাঁর লেপের তলায় ঢুকে পড়লাম। শিবুদা জিগ্যেস করলেন, ‘কে, যতীন নাকি—?’

‘হ্যাঁ। ও-ঘরে ভয় করছে একা—।’

শিবুদা ‘হঃ’ জাতীয় একটা শব্দ করে সরে শুলেন একটু।

ভোর হতে-না-হতেই মড়ার মাথাটা নিয়ে হাজির হলাম মুন্না ডোমের কাছে।

‘এটার বদলে আর-একটা মাথা দে আমাকে।’

তার নিজস্ব বাঁকা বাংলায় মুন্না বললে, ‘কেন বাবু, এ তো বেশ ভালো স্কাল আছে। আপনাদের জন্যে ভালো বানিয়ে রেখেছি—।’

‘প্রফেসর যেটা থেকে পড়ান সেইটে দে আমাকে।’

‘উ হোবে না, বাবু। নির্মলবাবুকে উঠো দিয়েছিলাম। সাহেব কী করে টের পেয়ে গেলেন। হামার পাঁচ টাকা জোরমানা করে দিলেন। একটা ফিমেল বডি থেকে তাই এ-মাথাটা আপনাদের জন্যে আলাদা বানিয়ে রেখেছি—।’

‘ফিমেল বডি থেকে?’

‘হাঁ, বাবু। মোটর অ্যাক্সিডেন্টের একটা বেওয়ারিশ বডি মর্গে এসেছিল, তাই থেকে বানিয়েছি—।’

চুপ করে রইলাম খানিকক্ষণ।

মুন্না বলতে লাগল, ‘খুব মেহন্নতসে ভালো করে বানিয়েছি আপনাদের জন্যে। মার্কিং তো খুব ভালো আছে, বাবু—।’

‘না, এটা চাই না, আর-একটা দে—।’

দাঁত বের করে মুন্না বললে, ‘আর-একঠো টাকা লাগবে, বাবু। খুব জরুরত, হুজুর—।’

সেলাম করলে একবার।

‘আচ্ছা দেব। এটা বদলে দে তুই।’

মুন্না ডোম আর-একটা মাথা বের করে দিলে।

পরীক্ষায় যথাসময়ে পাশ হলাম—পার্ট পেলাম।

মাসখানেক পরে মায়ের চিঠি এল একটা।

নানা কথার পর মা লিখেছেন ‘রেণুকে মনে আছে তোর? আহা, বেচারির কী শোচনীয় মৃত্যুই হয়েছে! কলকাতায় কোথায় নাকি বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল তার। যোগেনবাবু তাঁর অফিসের একজন লোকের সঙ্গে তাকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। কথা ছিল, যোগেনবাবুর এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে উঠবে। সেখানেই তাকে বরপক্ষের লোকেরা দেখতে আসবে। কিন্তু সেখানে পৌঁছতেই পারেনি বেচারি। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে যাচ্ছিল, মোটরে-মোটরে ধাক্কা লাগে। রেণু এবং সেই লোকটি দুজনেই অজ্ঞান হয়ে যায়। পুলিশ তাদের নাকি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। রেণু সঙ্গে-সঙ্গে মারা যায়, অপর লোকটি দশদিন অজ্ঞান হয়ে ছিলেন, তারপর ক্রমশ ভালো হন। রেণু বেচারির সৎকার পর্যন্ত হয়নি—ডোমেরা নাকি ফেলেছে। যোগেনবাবু চিঠি লিখেছেন, তুই যদি একটু খোঁজ করিস—।’

চিঠিটা পেয়ে চুপ করে বসে রইলাম খানিকক্ষণ। রেণুর মুখখানা মনের ওপর ফুটে উঠল আবার।

মাসিক রোমাঞ্চ

পুজো সংখ্যা, ১৯৭৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *