গুহা
একটি গুহার অভ্যন্তর। পিছন দিকে পাথরের গায়ে আঁকাবাঁকা ফাটল রহিয়াছে, উহাই গুহার প্রবেশ-পথ। ফাটল দিয়া দেখা যায় বাহিরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়িতেছে, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাইয়া মেঘ ডাকিতেছে। গুহার ভিতরে মলিন স্যাঁতা আলোয় স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না।
পিছনের ফাটল দিয়া একটি যুবক ও একটি যুবতী ঢুকিয়া পড়িল। তাহাদের কাপড়-চোপড় ভিজিয়া গিয়াছে। যুবকের হাতে একটি বড় টিফিন-বক্স, যুবতীর কাঁধ হইতে চামড়ার ফিতায় জলের বোতল ঝুলিতেছে।
যুবতী: বাবা—কি বিষ্টি! কি বিষ্টি!
যুবক: দুর্যোগ! আকাশ ভেঙে পড়ছে—বাপ! ভাগ্যিস গুহাটা ছিল—
যুবক হাতের টিফিন-বক্স মাটিতে রাখিল, যুবতী জলের বোতল নামাইল। ইতিমধ্যে পিছনের ফাটল দিয়া তৃতীয় ব্যক্তি প্রবেশ করিল। বিরাটকায় এক কুলি; মাথার উপর সুটকেস ও বিছানার হোল্ডল্, হাতে বল্লমের মতো তীক্ষ্ণাগ্র একটি লাঠি। সে আসিয়া মোট নামাইল, গামছা দিয়া মুখের ও গায়ের জল মুছিতে মুছিতে ভারী গলায় বলিল—
কুলি: আজ রাত্তিরে বিষ্টি ছাড়বেন না কর্তা।
কুলির চেহারা ভীমদর্শন হইলেও কথা বলিবার ভঙ্গিটি বেশ সরল ও গ্রাম্য—
যুবক: বলিল কি রে! তাহলে উপায়?
কুলি: উপায় আর কি আজ্ঞে, রাত্তিরটা এখানেই কাটাতে হবে।
যুবতী শঙ্কিতভাবে গুহার চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিল।
যুবক: নাও—বোনের বিয়ে দ্যাখো এবার। এমন হতচ্ছাড়া দেশ তোমার বাপের বাড়ি যে স্টেশন থেকে তিন মাইল দূরে শহর। স্টেশনে একটা ট্যাক্সি পর্যন্ত পাওয়া যায় না।
কুলি: আজ্ঞে, টেক্সি পাওয়া যায় কর্তা। আজ রেলগাড়ি দু’ঘণ্টা লেট ছিলেন, তাই টেক্সিওয়ালারা যে-যার ঘরে চলে গিয়েছেন।
যুবক: তখনই বলেছিলুম আজ ওয়েটিংরুমে রাত কাটানো যাক, কিন্তু তুমি বোনের বিয়ে দেখবার জন্যে একেবারে ছিঁড়ে পড়লে।
যুবতী স্বামীর পাশে আসিয়া দাঁড়াইল, স্বামীর মুখের পানে ভীরু দৃষ্টি তুলিয়া বলিল—
যুবতী: আমি কি জানতুম রাস্তার মাঝখানে ঝড়-বিষ্টি শুরু হয়ে যাবে? বোনের বিয়েতে এসেছি, বিয়েটাই যদি না দেখতে পেলুম—
যুবক: যাক গে, এখন আর ভেবে লাভ কি?—হ্যাঁ রে, বিষ্টি থামবে না তুই ঠিক জানিস?
কুলি: আজ্ঞে, এ সময়ের বিষ্টি একবার আরম্ভ হলে সহজে ছাড়েন না কর্তা, যদি ছাড়েন তো সেই শেষ রাত্তিরের দিকে।
যুবক: তাহলে আর উপায় কি? এ দুর্যোগে বেরুনো যাবে না, বেরুলে হয়তো পথ হারিয়ে বাঘের মুখে পড়ব। হ্যাঁ রে, এ গুহায় বাঘ ভাল্লুক আসে না তো?
কুলি: না কর্তা, বাঘ ভাল্লুক তো জঙ্গলে থাকেন, এখানে আসবেন কি জন্যে! আগে এই গুহায় সায়েব মেমেরা আসত চড়ুইভাতি করতে, রাত্তিরে থাকত। ভয়ের কিছু নেই আজ্ঞে। এই দেখেন না ছাই পড়ে রয়েছে, কেউ আগুন জ্বেলেছিল।
যুবকের ক্ষোভ ও দুশ্চিন্তা কাটিয়া গেল, অনিবার্যের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া সে হাসিয়া উঠিল।
যুবক: তাহলে আমরাও আজ চড়ুইভাতি করি। (স্ত্রীকে) কি বল? বোনের বিয়ে দেখতে পেলে না বটে, কিন্তু একটা অ্যাড্ভেঞ্চার তো হল।
যুবতীর মুখ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল।
যুবতী: আমার খুব ভাল লাগছে। সঙ্গে খাবার আছে, বিছানা আছে, কোনও কষ্ট হবে না। বরং—
যুবতী স্বামীর মুখের পানে অর্থপূর্ণ সলজ্জ দৃষ্টিতে চাহিল, তারপর বাহুতে হাত রাখিয়া হ্রস্বকণ্ঠে বলিল—
যুবতী: হ্যাঁ গা, কুলিটাও থাকবে নাকি?
যুবক যুবতীর মনের ভাব বুঝিয়া মৃদু হাসিল, তারপর কুলিকে প্রশ্ন করিল—
যুবক: তুই কি ঘরে ফিরে যেতে চাস?
কুলি: এই ঝড়-বাদলে কোথায় যাবো কর্তা। এখানেই এক পাশে গামছা পেতে শুয়ে থাকব আজ্ঞে।
যুবক: তা—বেশ।
যুবক যুবতী পরস্পরের পানে চাহিয়া নিরাশাব্যঞ্জক মুখভঙ্গি করিল। তারপর যুবক গুহার চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া বলিল—
যুবক: এস, গুহাটা ঘুরে ফিরে দেখা যাক।—বেশ বড় গুহা। হয়তো হাজার হাজার বছর আগে এখানে বর্বর মানুষ বাস করত। কে জানে—কেমন ছিল তাদের জীবনযাত্রা—
যুবক যুবতী অসমতল গুহাগাত্রের পাশে পাশে ঘুরিয়া দেখিতে লাগিল। কুলিটা দুই হাঁটু তুলিয়া বসিয়া করতলে খৈনি ডলিতে আরম্ভ করিল। বাহিরে একবার বিদ্যুৎ চমকিয়া উঠিল, বাঘের অন্তর্গূঢ় গর্জনের মতো মেঘ ডাকিল।
যুবতী: ওগো, দ্যাখো দ্যাখো—
যুবতী যুবতী পরস্পর হইতে একটু পৃথক হইয়া পড়িয়াছিল, এখন যুবক যুবতীর কাছে গেল।
যুবক: আরে! এ যে একটা পাথরের পাটা, খাসা বিছানা হবে এর ওপর।
যুবতী কিছুক্ষণ মোহাচ্ছন্ন চক্ষে প্রস্তরপট্ট নিরীক্ষণ করিল।
যুবতী: মনে হচ্ছে যেন এই পাথরের ওপর কতবার শুয়েছি—(বিভ্রান্তভাবে চারিদিকে চাহিয়া) এখন যেন সব চেনা-চেনা লাগছে—তোমার লাগছে না?
যুবক: সে কি, চেনা-চেনা লাগবে কি করে, আগে তো কখনো এখানে আসিনি। তুমি হয়তো ছেলেবেলায় এসেছিলে—
যুবতী: না, এ গুহার কথা আমি জানতুমই না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে—(হঠাৎ) দ্যাখো তো, ওই দেয়ালের খাঁজে কুলুঙ্গির মতো একটা ফুটো আছে কিনা।
যুবতী অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইল। যুবক নির্দিষ্টস্থানে গিয়া দেখিল সত্যই দেয়ালের গায়ে একটি গর্ত আছে। সে বিস্মিত মুখে স্ত্রীর দিকে ফিরিল।
যুবক: হ্যাঁ—আছে। তুমি জানলে কি করে?
যুবতী: কি জানি।—কুলুঙ্গির মধ্যে কিছু আছে?
যুবক: (দেখিয়া) কিছু না—
যুবতী কাছে আসিল।
যুবতী: কিচ্ছু নেই?…কি যেন একটা থাকত ওখানে…মনে করতে পারছি না—
যুবক যুবতীর কাঁধ ধরিয়া নাড়া দিল।
যুবক: কী যা তা বকছ? মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?
যুবতী এতক্ষণ তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে কথা বলিতেছিল, এখন যেন তন্দ্রা ভাঙিয়া জাগিয়া উঠিল। চোখের উপর দিয়া হাত চালাইয়া একটু হাসিবার চেষ্টা করিল।
যুবতী: না—না—কল্পনা। আজ তো এখানেই থাকতে হবে। তোমার ক্ষিদে পেয়েছে?
যুবক: একটু একটু পেতে আরম্ভ করেছে।
যুবতী: এস, খেয়ে নিই।
দু’জনে সম্মুখ দিকে অগ্রসর হইয়া আসিল। দেখিল, কুলি দুই হাঁটুর উপর মাথা রাখিয়া বোধহয় ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।
যুবক: তুমি খাবার বের কর, আমি ততক্ষণ বিছানাটা পেতে ফেলি।
হোল্ডল্ তুলিয়া লইয়া যুবক প্রস্তরপট্টের দিকে চলিয়া গেল, যুবতী টিফিন-বক্স খুলিয়া খাবার বাহির করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে যুবক বিছানা পাতিয়া ফিরিয়া আসিল। যুবতী তাহার হাতে টিফিন-বক্সের একটি বাটি দিল। যুবক খাবার মুখে তুলিতে গিয়া নিম্নস্বরে বলিল—
যুবক: কুলোবে তো?
যুবতী: কুলোবে।
যুবতী একটি বাটি হাতে কুলির কাছে গিয়া দাঁড়াইল।
যুবতী: শুনছ? একটু খেয়ে নাও—
কুলি হাঁটু হইতে মুখ তুলিয়া আরক্ত চক্ষে যুবতীর পানে চাহিল। যুবতী হঠাৎ ভয় পাইয়া পিছাইয়া গেল। কুলি হাত বাড়াইল, যুবতী বাটি মাটিতে রাখিয়া পিছনে সরিয়া গেল। কুলি বাটি টানিয়া লইয়া খাদ্যদ্রব্যগুলি নিরীক্ষণ করিল, তারপর খাইতে আরম্ভ করিল।
যুবতী ফিরিয়া গিয়া স্বামীর পাশে দাঁড়াইল এবং শঙ্কিত চক্ষে কুলির দিকে চাহিয়া রহিল। যুবক আহার করিতে করিতে প্রশ্ন করিল—
যুবক: কী দেখছ?
যুবতী: (চুপিচুপি) কিছু নয়…লোকটা এমনভাবে আমার পানে তাকালো যে আমার বুক কেঁপে উঠল। হ্যাঁগা, লোকটা ভাল তো? যদি রাত্তিরে—
যুবক: কোনও ভয় নেই, আমার সঙ্গে পিস্তল আছে।—তুমি খেয়ে নাও।
দুইজন বাটি হাতে লইয়া ইতস্তত বিচরণ করিতে করিতে আহার করিল। যুবতীর উদ্বিগ্ন চক্ষু কিন্তু বারংবার কুলির দিকে ফিরিয়া যাইতে লাগিল। কুলির বাটিতে অন্যান্য খাদ্যের সঙ্গে মাংসের হাড় ছিল, সে সেই হাড় মুঠিতে ধরিয়া অনেকক্ষণ চিবাইল। তাহার হাড় চিবাইবার ভঙ্গিতে যেন একটা বন্য ভাব রহিয়াছে।
ক্রমে আহার শেষ হইল। যুবক বোতল হইতে জল ঢালিয়া যুবতীকে দিল, নিজে পান করিল। তারপর কুলিকে লক্ষ্য করিয়া বলিল—
যুবক: তুমি জল খাবে?
কুলি: না খেলেও চলে। যদি থাকে, দেন একটু।
যুবক কুলির অঞ্জলিতে জল ঢালিয়া দিল, কুলি পান করিল। পান করিতে করিতে সে চোখ তুলিয়া যুবকের পানে চাহিতে লাগিল। দু’জনের চোখেই উৎকণ্ঠিত জিজ্ঞাসা। শেষে কুলি মুখ মুছিয়া বলিল—
কুলি: এবার আপনারা শুয়ে পড়ুন আজ্ঞে। কোনও ভয় নেই, আমার সঙ্গে বরছা আছে। আমি গুহার মুখ আগ্লে শুয়ে থাকব।
যুবক: তোমারও কোনও ভয় নেই। আমার সঙ্গে পিস্তল আছে–এই দ্যাখো।
যুবক পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া দেখাইল।
কুলি: আজ্ঞে, ওটা কী কর্তা?
যুবক: পিস্তল—ছোট বন্দুক। ফায়ার করব—দেখবে?
যুবক পিস্তল ঊর্ধ্বদিকে ফায়ার করিল। গুহার মধ্যে প্রতিহত শব্দ ভীষণ শুনাইল।
কুলি: ওরে ব্বাস্ রে।
কুলি বিস্ময়-বিমূঢ় হইয়া পিছু হটিতে হটিতে গুহার মুখের দিকে চলিয়া গেল এবং সেখানে গামছা পাতিয়া শয়নের উপক্ৰম করিল।
যুবক তখন যুবতীর পানে চাহিয়া একটু অর্থপূর্ণ হাসিল, তারপর সুটকেস তুলিয়া সেই প্রস্তরপট্টের অভিমুখে গেল। জলের বোতল ও টিফিন-বক্সের বাটিগুলি লইয়া যুবতী তাহার পিছনে গেল। দুইজনে প্রস্তরপট্টের পাশে বসিল।
যুবক: (হাতের ঘড়ি দেখিয়া) রাত হয়েছে, এবার শুয়ে পড়া যাক।
যুবক কোট খুলিতে খুলিতে গুহার ঊর্ধ্বদিকে ইতস্তত তাকাইতে লাগিল, যুবতী নিজের খোঁপাটিকে কাঁটা দিয়া শক্ত করিয়া আঁটিতে প্রবৃত্ত হইল। যুবক যুবতীর দিকে দৃষ্টি নামাইল, তাহাকে কাছে টানিয়া লইয়া বলিল—
যুবক: বেশ নতুন নতুন লাগছে—না?
যুবতী: না।
যুবক একটু বিস্মিতভাবে চাহিল।
যুবক: নতুন লাগছে না?
যুবতী: ভাল লাগছে, কিন্তু নতুন লাগছে না। মনে হচ্ছে এই পাথরের ওপর আমরা দু’জনে কতবার শুয়েছি—
যুবক: তোমার মাথা গরম হয়েছে। নাও, শুয়ে পড়।
যুবকের মুখে কিন্তু বিস্ময়ের সহিত উদ্বেগ মিশ্রিত হইয়া রহিল।
গুহার মধ্যে আলো ক্রমশ কমিতে লাগিল, তারপর গাঢ় অন্ধকারে সব ঢাকা পড়িয়া গেল। কেবল গুহার প্রবেশপথের ফাটল দিয়া মাঝে মাঝে বিদ্যুচ্চমকের প্রভাব স্ফুরিত হইতে লাগিল।
কিছুক্ষণ পরে আবার ধীরে ধীরে গুহার মধ্যে আলো ফুটিতে আরম্ভ করিল। আলো স্পষ্ট হইলে দেখা গেল, গুহা ঠিক তেমনি আছে; কেবল বিছানা সুটকেস প্রভৃতি আধুনিক জিনিসপত্র অন্তর্হিত হইয়াছে। গুহার মধ্যস্থলে খানিকটা ভস্ম পড়িয়া আছে, যুবতী নতজানু হইয়া অঙ্গার-গর্ভ ভস্মের উপর শুষ্ক কাষ্ঠখণ্ড নিক্ষেপ করিয়া তাহাতে ফুঁ দিতেছে। যুবতীর পরিধানে হাঁটু হইতে কাঁধ পর্যন্ত পশুচর্ম, মাথায় একমাথা জটিল রুক্ষ চুল। গুহায় আর কেহ নাই, পিছনের ফাটল দিয়া বাহিরের উজ্জ্বল দিবালোক দেখা যাইতেছে।
যুবতীর ফুৎকারে আগুন জ্বলিল। সে তখন উঠিয়া কুলুঙ্গির কাছে গেল। এই কুলুঙ্গি তাহার ভাঁড়ার, তাহার ভিতর হাত ঢুকাইয়া একটি মুষলাকৃতি আস্ত হরিণের রাং বাহির করিয়া আনিল এবং আগুনের উপর ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া সেটি ঝল্সাইতে লাগিল। মাংস ঝল্সাইতে ঝল্সাইতে সে মাঝে মাঝে তাহা আঘ্রাণ করিয়া দেখিতে লাগিল এবং উৎসুক চক্ষে বারবার ফাটলের দিকে চাহিতে লাগিল। যেন কাহারও প্রতীক্ষা করিতেছে।
গুহার বাহির হইতে দূরাগত মনুষ্যকণ্ঠের আওয়াজ আসিল—‘কুউ—উ—’
যুবতী তৎক্ষণাৎ মুখ তুলিয়া উত্তর দিল—
যুবতী: কুউ—উ—’
কিছুক্ষণ পরে ফাটলের ভিতর দিয়া যুবক প্রবেশ করিল, পরিধানে মৃগচর্ম, হাতে তীরধনুক, চক্ষে ভয়ার্ত উত্তেজনা। আগুনের কাছে আসিয়া তীরধনুক ফেলিয়া হাঁপাইতে লাগিল। বহুদূর ছুটিয়া আসিয়াছে।
যুবতীর হাত হইতে অর্ধদগ্ধ রাং পড়িয়া গেল।
যুবতী: কি—কী হয়েছে?
যুবক: (হাঁপাইতে হাঁপাইতে) ভিল্লা জানতে পেরেছে।
যুবতী: (সংহতস্বরে) জানতে পেরেছে!
যুবক: হ্যাঁ, আমরা কোথায় লুকিয়ে আছি জানতে পেরেছে, আমাদের গুহার সন্ধান পেয়েছে—
যুবতীর মুখ হইতে একটা অবরুদ্ধ কাকুতি বাহির হইল, সে যেন তাহা রোধ করিবার জন্যই বাঁ হাতের কব্জি তীক্ষ্ণদন্তে কামড়াইয়া ধরিল।
যুবক: (অসংলগ্নভাবে) বনের মধ্যে শিকার পেয়েছিলাম—একটা হরিণের পিছু নিয়েছিলাম—কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ দেখলাম ভিল্লাও হরিণটার পিছু নিয়েছে—ভিল্লার হাতে ছিল শুধু বশা—আমি তাকে দেখবার আগেই সে আমাকে দেখেছিল—বর্শার পাল্লার বাইরে ছিলাম তাই মারতে পারেনি—আমি তাকে যেই দেখতে পেয়েছি অমনি সে হা হা করে হেসে উঠল—হরিণটা পালিয়ে গেল—
যুবতী: তারপর?
যুবক: ভিল্লা হেসে বললে—‘আর তুই যাবি কোথায়, আমার তিন্নিকে চুরি করে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস আমি জানতে পেরেছি, এবার তোকে কুচি কুচি করে কাটব।’ আমি ধনুকে তীর পরালাম, অমনি ভিল্লা একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আমি তখন ছুটে চলে এলাম।
যুবতী: (কাঁদিয়া উঠিয়া) কী হবে—কী হবে! ভিল্লা ভয়ানক কুচুটে, সে তোকে মেরে ফেলবে—তার গায়ে ভীষণ জোর—
যুবক তীরধনুক তুলিয়া লইল, তাহার চক্ষু হিংস্রভাবে জ্বলিয়া উঠিল।
যুবক: ভিল্লা যদি আমার গুহায় আসে আমি তাকে তীর দিয়ে বিঁধে মেরে ফেলব।
যুবতী: তাকে মারতে পারবি না—সে কুচুটে—ভয়ানক ফন্দিবাজ—তার গায়ে গণ্ডারের মতো জোর—আমি জানি তুই তাকে মারতে পারবি না—
যুবতী মাটিতে বসিয়া পড়িল, সম্মুখে ও পিছনে দুলিতে দুলিতে সুর করিয়া বলিতে লাগিল—
যুবতী: আমি জঙ্গলের মেয়ে, নিজের জাতের মধ্যে জঙ্গলে ছিলাম—ভিল্লা ছিল সর্দারের ছেলে—সে আমাকে চাইত, ভাল্লুক মেরে আমাকে চামড়া এনে দিত—আমার তাকে ভাল লাগত না—তুই ভিনজাতের মানুষ, তোকে ভাল লাগ্ল—তোর সঙ্গে তোর গুহায় পালিয়ে এলাম!—এখন কী হবে—ভিল্লা তোকে মেরে ফেলবে—সে বড় হিংসুক—
সহসা যুবতী ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, যুবকের বাহু দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া ব্যগ্রস্বরে বলিল—
যুবতী: চল আমরা পালিয়ে যাই, গুহা ছেড়ে পালিয়ে যাই, তাহলে ভিল্লা আমাদের খুঁজে পাবে না—
যুবক: (গর্জিয়া উঠিল), না, আমার গুহা আমি ছাড়ব না—ভিল্লাকে আমার গুহা দেব না—
এই সময় বাহিরে একটা বিকট শব্দ হইল। যুবক যুবতী ক্ষণকাল স্তব্ধ একাগ্রভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। আবার বিকট শব্দ হইল। যুবতী উত্তেজিত নিম্নস্বরে বলিল—
যুবতী: ভাল্লুক! ভাল্লুক ডাকছে। বোধহয় পোড়া মাংসের গন্ধ পেয়ে এদিকে আসছে—
যুবক ত্বরিতে তীরধনুক তুলিয়া লইল।
যুবতী: তীরধনুক নিয়ে ভাল্লুক মারতে পারবি না। দাঁড়া, আমি ভাল্লুক তাড়াচ্ছি। আগুন দেখলেই পালাবে।
যুবতী একখণ্ড ধূমায়িত কাঠ তুলিয়া মশালের মতো ঊর্ধ্বে ধরিয়া ফাটলের দিকে ছুটিয়া চলিয়া গেল। যুবক ধনুকে তীর সংযোগ করিয়া শক্ত সতর্কভাবে দাঁড়াইয়া রহিল।
যুবতী ফাটল দিয়া বাহির হইয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে তাহার কণ্ঠের তীব্র মর্মান্তিক চিৎকার শোনা গেল। যুবক ধনুর্বাণ হাতে ফাটলের দিকে ছুটিল, তারপর থমকিয়া দাঁড়াইল।
ফাটলের ভিতর দিয়া যুবতী আসিতেছে, তাহার পিছনে ভালুকের মতো কালো রোমশ একটা জীব। যুবতীর দুই হাত ভীতভাবে সম্মুখে প্রসারিত; ওষ্ঠাধর চিৎকারের ভঙ্গিতে উন্মুক্ত, কিন্তু কণ্ঠ দিয়া চিৎকার বাহির হইতেছে না।
যুবক: (চমকিয়া) ভিল্লা!
যুবতীর পিছনে ভাল্লুকের চামড়া পরিয়া আসিতেছিল ভিল্লা। সে বিকট অট্টহাস্য করিয়া উঠিল।
ভিল্লা: হ্যাঁ, ভাল্লুক নয়—আমি ভিল্লা। তীরধনুক ফেলে দে, নইলে তিন্নিকে বরছা বিঁধে মেরে ফেল্ব।
ভিল্লা: ভিল্লা, ছেড়ে দে—আমার তিন্নিকে ছেড়ে দে—
ভিল্লা: তুই আগে তীরধনুক ফেলে দে।
যুবক তীরধনুক ফেলিয়া দিতেই ভিল্লা যুবতীকে সজোরে সামনে ঠেলিয়া দিল। যুবতী কয়েক পা আসিয়া হুম্ড়ি খাইয়া পড়িয়া গেল; সঙ্গে সঙ্গে ভিল্লা হাতের বল্লম ছুঁড়িয়া যুবককে মারিল। যুবক আর্তনাদ করিয়া পড়িয়া গেল।
এতক্ষণে ভিল্লাকে দেখা গেল। সে আর কেহ নয়, পূর্বে যাহাকে কুলিরূপে দেখা গিয়াছিল সেই ভীষণাকৃতি লোকটা। সে এখন ভল্লবিদ্ধ যুবকের বুকের উপর লাফাইয়া পড়িল এবং তাহার মাথাটা বারবার মাটিতে ঠুকিতে লাগিল।
যুবতী ছুটিয়া আসিয়া পিছন হইতে ভিল্লার চুল ধরিয়া টানিতে টানিতে উন্মত্তার মতো বলিল—
যুবতী: ছেড়ে দে—ওকে ছেড়ে দে—রাক্ষস—
ভিল্লা উঠিয়া যুবতীর হাত পা চাপিয়া ধরিল, তাহাকে সবলে আকর্ষণ করিয়া উল্লসিত স্বরে বলিল—
ভিল্লা: মরে গেছে—ওকে মেরে ফেলেছি। এখন তুই আমার—আমার—
যুবতী হাত ছাড়াইবার প্রাণপণ চেষ্টা করিল কিন্তু পারিল না। ভিল্লা তাহাকে আগুনের দিকে টানিয়া লইয়া চলিল। আগুনের পাশে অর্ধদগ্ধ অস্থি-মাংস পড়িয়াছিল, সে তাহা বাঁ হাতে তুলিয়া লইয়া মহানন্দে হা হা হাস্য করিয়া খাইতে আরম্ভ করিল। যুবতী হাত ছাড়াইবার ব্যর্থ চেষ্টায় ফুঁপাইতে লাগিল—
যুবতী: ছেড়ে দে রাক্ষস! ছেড়ে দে আমায়—
ভিল্লা তাহার আকুতি গ্রাহ্য করিল না, বিজয়দীপ্ত চক্ষে গুহার চারিদিকে চাহিল, মাংসে কামড় দিয়া পরিপূর্ণ মুখে বলিল—
ভিল্লা: এ গুহা আমার—তুই আমার—(যুবকের মৃতদেহ দেখাইয়া) ওকে গুহার মুখের কাছে পুঁতে রাখব—ও যক্ষি হয়ে আমার গুহা পাহারা দেবে।
ভিল্লা ভুক্তাবশিষ্ট মাংস যুবতীর মুখের কাছে ধরিয়া বলিল—
ভিল্লা: নে—খা—
যুবতী: (সতেজে) খাব না।
ভিল্লা হাড়সুদ্ধ মাংস যুবতীর মুখে গুঁজিয়া দিয়া ক্রুদ্ধ গর্জনে বলিল—
ভিল্লা: খা—খেতে হবে। আজ থেকে তুই আমার—তোকে আমার এঁটো খেতে হবে। কী খাবি না?
ভিল্লা মুগুরের মতো অস্থিখণ্ড দিয়া যুবতীর মাথায় প্রহার করিল, যুবতী মূৰ্ছিতা হইয়া পড়িয়া গেল। ভিল্লা অস্থিখণ্ড ফেলিয়া দিয়া আরক্ত চক্ষে মূৰ্ছিতা যুবতীর পানে চাহিয়া রহিল—
ভিল্লা: আজ খাবি না কাল খাবি না। না খেয়ে তুই যাবি কোথায়! তুই আমার—একবার পালিয়েছিলি, আর পালাতে দেব না।
যুবকের দিকে ফিরিয়া সে তাহার দেহ হইতে বর্শা টানিয়া বাহির করিয়া লইল, কিছুক্ষণ তৃপ্তিপূর্ণ চক্ষে তাহাকে নিরীক্ষণ করিল—
ভিল্লা: তোকে পুঁতবো—তুই আমার গুহা পাহারা দিবি—
ভিল্লা নতজানু হইল, ভল্লের অগ্রভাগ দিয়া মাটি খুঁড়তে আরম্ভ করিল…
আবার গুহার আলো ক্ষীণ হইয়া সম্পূর্ণ অন্ধকার হইয়া গেল। অন্ধকারের মধ্যে যুবতীর কণ্ঠের তীব্র চিৎকার শোনা গেল—তারপর দ্রুত আলো ফুটিয়া উঠিল।
দেখা গেল গুহা আবার বর্তমান কালে ফিরিয়া আসিয়াছে, প্রস্তরপট্টের শয্যায় যুবতী আলুথালুভাবে উঠিয়া বসিয়া যুবকের পা ঠেলিয়া জাগাইবার চেষ্টা করিতেছে। যেখানে ভিল্লা মাটি খুঁড়িতেছিল সেখানে কুলি বল্লম দিয়া মাটি খুঁড়িতেছে। মানুষগুলির বেশবাস পরিবর্তিত হইয়া বর্তমান কালের বেশবাসে পরিণত হইয়াছে।
যুবতী: ওগো—ওগো—
যুবক ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল।
যুবক: কে?—কী—ভিল্লা কোথায়?
যুবতী: অ্যাঁ! তুমিও স্বপ্ন দেখেছ?
দুইজনে ব্যাকুলভাবে পরস্পরের পানে চাহিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রহিল, তারপর যুবক শয্যা ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; পিস্তলটা বিছানা হইতে তুলিয়া পকেটে রাখিল, বলিল—
যুবক: স্বপ্ন!—ভিল্লা কোথায় গেল?
যুবতী কুলির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া শিথিল দেহে আবার শুইয়া পড়িল। যুবক দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিল, কুলি তাহাদের দিকে পিছন করিয়া বল্লম দিয়া মাটি খুঁড়িতেছে। যুবক বিস্ফারিত নেত্রে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে কুলির পিছনে গিয়া দাঁড়াইল।
যুবক: এই! কি করছিস?
কুলি বল্লম ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, তন্দ্রাবিষ্ট চোখে যুবকের পানে চাহিয়া রহিল। যুবক তাহার গায়ে একটা মৃদু রকমের ঠেলা দিল।
যুবক: কি করছিস? মাটি খুঁড়ছিস কেন?
কুলি যেন চমকিয়া তন্দ্রাবেশ হইতে জাগিয়া উঠিল, চকিতে চারিদিকে চাহিয়া স্খলিতস্বরে বলিল—
কুলি: অ্যাঁ! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না আজ্ঞে—
যুবক: মাটি খুঁড়ছিলি কেন? মাটির তলায় কি আছে?
কুলি: (মাথা চুলকাইয়া) তা তো জানিনে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি যেন স্বপ্ন দেখলাম আজ্ঞে—
যুবক: তুইও স্বপ্ন দেখেছিস? বেশ, তবে খোঁড়্!
কুলি: খুঁড়ব?
যুবক: হ্যাঁ খোঁড়্। হয়তো কিছু আছে।
কুলি: আজ্ঞে।
কুলি আবার খুঁড়িতে আরম্ভ করিল, যুবক কিছু দূরে সরিয়া আসিয়া দেখিতে লাগিল। হঠাৎ কুলি ভীতভাবে বল্লম ফেলিয়া পিছু সরিয়া আসিল—
কুলি: ওরে ব্বাবা।
যুবক: কী হল?
কুলি: ওখানে কি একটা রয়েছেন।
যুবক: কী রয়েছে?
কুলি: আজ্ঞে, মড়ার মাথা। আপনি দেখেন না কর্তা—মড়ার খুলি। ওরে ব্বাবারে!
যুবক গর্তের কাছে গিয়া বল্লমের চাড় দিয়া একটা নর করোটি বাহির করিল। করোটি দুই হাতে তুলিয়া লইয়া সে একদৃষ্টে তাহা দেখিতে লাগিল।
যুবক: কার করোটি…আমার?
কুলি: (কাছে আসিয়া) মড়ার খুলি এত কী দেখতেছেন কর্তা।
যুবকের হাত হইতে খুলিটা পড়িয়া গেল, সে কুলির দিকে প্রজ্বলিত চক্ষে চাহিল, তারপর পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া পাশব কণ্ঠে গর্জিয়া উঠিল—
যুবক: ভিল্লা! এই নে—মর্।
যুবক পিস্তল ছুঁড়িল, কুলি পড়িয়া গেল। যুবক কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল; তারপর নত হইয়া কুলিকে দেখিল।
যুবক: মরে গেছে।—এ কি করলাম—এ কি করলাম!
৩১ শ্রাবণ, ১৩৬২