গীতা

গীতা

গোবিন্দবাবু ও মুকুন্দবাবু দুই ভাই একান্নবর্তী ছিলেন। উভয়ে মিলিয়া বহু সম্পত্তি অর্জন করিয়াছিলেন। গোবিন্দবাবুর দুই ছেলে, খগেন ও নগেন। মুকুন্দবাবু নিঃসন্তান।

গোবিন্দবাবু যখন পরিণত বয়সে দেহরক্ষা করিলেন তখন খগেন ও নগেন সাবালক হইয়াছে, তাহারা সম্পত্তি ভাগ করিয়া লইতে চাহিল। খগেন অত্যন্ত বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন লোক, সে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করিতে চায়; নগেন ফুর্তিবাজ, সে ফুর্তি করিতে চায়। দু’জনেরই টাকা চাই, খুড়ার হাত-তোলায় থাকিতে তাহারা রাজী নয়।

মুকুন্দবাবু ধর্মিক ও ধীরবুদ্ধি লোক। তিনি ভাইপোদের, বিশেষত ফুর্তিবাজ নগেনকে মনে মনে ভালবাসিতেন। তিনি তাহাদের সৎপথে থাকিবার উপদেশ দিলেন, তারপর চুল চিরিয়া বিষয় ভাগ করিয়া দিলেন। কলহ মনান্তর কিছু হইতে পাইল না। খগেন ও নগেন নিজ নিজ অংশ লইয়া কলিকাতায় গেল। খগেন শেয়ার বাজারে ঢুকিল। নগেন পঞ্চমকার লইয়া পড়িল। এতদিন যাহারা একসঙ্গে ওঠা-বাসা করিয়াছে তাহারা তিন ভাগ হইয়া গেল।

কয়েক বছর কাটিল। খগেন একাগ্রমনে ব্যবসা করিতেছে, নগেন অনন্যমনে ফুর্তি করিতেছে। খুড়া মুকুন্দবাবু মাসে একখানি করিয়া চিঠি লিখিয়া ভাইপোদের তত্ত্বতল্লাস লন। খগেন মাঝে মাঝে আসিয়া খুড়ার সঙ্গে দেখা করিয়া যায়। নগেন বড় একটা আসে না। নগেনের চেয়ে খগেনের বিষয়বুদ্ধি বেশী। কিন্তু তবু এমনই মানুষের মন যে, ধার্মিক মুকুন্দবাবু মনে মনে উচ্ছৃঙ্খল নগেনকে বেশী ভালবাসেন।

একদিন মুকুন্দবাবু বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার সময় হইয়াছে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি নিজ সম্পত্তির ব্যবস্থা করিলেন। ব্যবস্থা দেখিয়া সকলের হৃদয়ঙ্গম হইল যে, মুকুন্দবাবু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি বটে।

খগেন নিজের অফিসে কাজ করিতেছিল, খুড়ার এক পত্র পাইল। খামের মধ্যে এক তা কাগজ, মুকুন্দবাবু স্বহস্তে লিখিয়াছেন—

আমি আজ ১৮ জুলাই ১৯২১ তারিখে সুস্থ মনে স্বেচ্ছায় এই উইল করিতেছি যে আমার মৃত্যুর পর আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীমান খগেন্দ্রনাথ আমার যাবতীয় সম্পত্তি পাইবে। শ্রীমুকুন্দলাল গাঙ্গুলী, বকলম খাস।

এই সময়ে কলিকাতার অন্য প্রান্তে নগেন খুড়ার নিকট হইতে একখানি চিঠি ও রেজিস্ট্রি-করা একটি প্যাকেট পাইল। নগেন তখন সবে ঘুম ভাঙিয়া বৈঠকখানায় বসিয়া আড়মোড়া ভাঙিতেছিল, চিঠি পড়িয়া দেখিল—

কল্যাণবরেষু,

নগেন, আমার শরীর ভাল নয়, বোধ হয় আর বেশী দিন বাঁচিব না। মৃত্যুর পূর্বে তোমার সঙ্গে দেখা হইবে এমন আশা করি না। তোমাকে দূর হইতেই আশীর্বাদ করিতেছি এবং সৎপথে চলিবার উপদেশ দিতেছি। আজ রেজিস্ট্রি ডাকে তোমার নামে একখানি শ্রীমদ্‌ ভগবদ্‌গীতা পাঠাইলাম, বইখানি যত্ন করিয়া পড়িও। মৃত্যুকালে আমি তোমাকে ইহাই দান করিয়া গেলাম।

ইতি আশীর্বাদক—তোমার কাকা শ্রীমুকুন্দলাল গাঙ্গুলী।

চিঠি পড়িয়া নগেন মুখ বিকৃতি করিল। বিষয় সম্পত্তি টাকাকড়ি বোধহয় দাদা পাইবে! আর আমার জন্য শ্রীমদ্‌ ভগবদ্‌গীতা। নগেন রেজিষ্ট্রি প্যাকেটখানা তুলিয়া লইয়া ঘোর ভক্তিভরে নিরীক্ষণ করিল, তারপর টান মারিয়া ঘরের এক কোণে ফেলিয়া দিল।

ভৃত্য আসিয়া প্যাকেট তুলিয়া লইয়া বলিল, ‘এটা কি বাবু?’

নগেন মুখ বাঁকাইয়া হাসিল, ‘গীতা। নিয়ে যা—যত্ন করে পড়িস।—আর, বীয়ার নিয়ে আয়।’

মাসখানেক পরে মুকুন্দবাবু মারা গেলেন। খগেন যথারীতি তাঁহার শ্রাদ্ধ করিল এবং উইল প্রুভ করিয়া সম্পত্তি দখল করিয়া বসিল। নগেন কোনও প্রকার আপত্তি উপস্থিত করিল না। তাহার হাতে এখনও অনেক টাকা, খুড়ার অনুগ্রহ সে চায় না।

তারপর দশ বছর কাটিয়া গিয়াছে। নগেন এখন নিঃস্ব। সম্পত্তি ফুরাইয়া গিয়াছে, বাড়ি বিক্রি হইয়াছে, এমন কি আসবাবপত্র লাটে উঠিয়াছে। বাড়ির নূতন মালিক নোটিশ দিয়াছে, আজ বাড়ি ছাড়িয়া দিতে হইবে।

নিরাভরণ বাড়ির মধ্যে নগেন ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। কলসীর জল ঢালিতে ঢালিতে শেষ হইয়া গিয়াছে, কিন্তু তৃষ্ণার শেষ নাই। নগেন বুকফাটা তৃষ্ণায় ছটফট করিয়া ফিরিতেছিল। মদ—এক গ্লাস মদ। আজ তাহার এমন অবস্থা যে এক গ্লাস মদ কিনিয়া খাইবার সামর্থ্য নাই। কেহ একটা টাকা ধার দিবে না। যে-সব বন্ধু তাহার পয়সায় মদ খাইত তাহারা সরিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু—এক গ্লাস মদ না পাইলে তাহার তৃষ্ণা মিটিবে কি করিয়া! কাল কি হইবে তাহা তো কালকের কথা, আজ এক গ্লাস মদ পাওয়া যায় কোথায়? একটা টাকা—আট আনা পয়সা কি কোথাও পাওয়া যায় না?

অশান্ত চামচিকার মতো ঘুরিতে ঘুরিতে হঠাৎ তাহার নজর পড়িল—ঘরের একটা উঁচু তাকের উপর কি যেন রহিয়াছে। নগেন হাত বাড়াইয়া সেটা তাক হইতে পাড়িল। ধূলিধূসর একটা বাদামী কাগজ-মোড়া প্যাকেট। কিসের প্যাকেট নগেন মনে করিতে পারিল না। ধূলা ঝাড়িয়া দেখিল রেজিষ্ট্রি—খোলা হয় নাই—প্রেরকের নাম মুকুন্দলাল গাঙ্গুলী। তখন মনে পড়িয়া গেল—গীতা! মৃত্যুর পূর্বে কাকা পাঠাইয়াছিলেন।

গীতা…গীতা বিক্রয় করিলে কত পয়সা পাওয়া যায়। গীতা কি কেউ কেনে? হয়তো এমন লোকও পৃথিবীতে আছে যাহারা গীতা কিনিয়া পড়ে। নগেন মোড়ক খুলিয়া ফেলিল।

সোনার জলে নাম লেখা কাপড়ের বাঁধাই গীতা—এখনও বেশ ঝক্‌ঝক্ করিতেছে। কত দাম কে জানে। নগেন প্রথম পাতাটা খুলিল—

একখানা ভাঁজ করা কাগজ রহিয়াছে। নগেন খুলিয়া পড়িল, তাহার খুড়ার হস্তাক্ষর—

আমি আজ ১৯শে জুলাই ১৯২১ তারিখে সুস্থ মনে স্বেচ্ছায় এই উইল করিতেছি। পূর্বে যে উইল করিয়াছিলাম তাহা অত্র দ্বারা নাকচ করা হইল। আমার মৃত্যুর পর আমার দুই ভ্রাতুষ্পুত্ৰ খগেন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথ আমার যাবতীয় সম্পত্তি ও টাকাকড়ি সমান ভাগে পাইবে। শ্রীমুকুন্দলাল গাঙ্গুলী, বকলম খাস।

পড়িতে পড়িতে নগেন তৃষ্ণা ভুলিয়া গেল। কাকার সম্পত্তির অর্ধেক, অর্থাৎ অন্তত লাখ খানেক টাকা। হায় হায়, এত দিন সে মোড়কটা খুলিয়া দেখে নাই কেন? যে উইলের জোরে দাদা সমস্ত সম্পত্তি দখল করিয়াছিল সে উইল কাকা নাকচ করিয়াছেন। এই উইলই বলবৎ। আর যাইবে কোথায়! দাদার গলা টিপিয়া সে নিজের ভাগ বাহির করিয়া লইবে।

গীতা মাটিতে আছড়াইয়া ফেলিয়া নগেন পাগলের মতো ছুটিল। আগে সে উকিলের কাছে যাইবে, সেখান হইতে উকিলকে সঙ্গে লইয়া দাদার অফিসে যাইবে—

কিন্তু অতদূর যাইতে হইল না, দ্বারের কাছেই খগেনের সঙ্গে তাহার দেখা হইল। খগেন হাঁটিয়া আসিয়াছে—তাহার মুখ শুষ্ক, চুল উস্কখুস্ক। বারো বছর পরে দুই ভাইয়ে সাক্ষাৎ।

খগেন ব্যগ্রস্বরে বলিল, ‘নগেন, তোর কাছে এসেছি, বড় দরকার। কিছু টাকা ধার দিতে পারিস?’

‘ধার—!’ নগেন ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল।

খগেন বলিল, ‘হ্যাঁ। আমার সব গেছে। বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে, গাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে—তবু ধার শোধ হয়নি। এখন দশ হাজার টাকা বার করতে না পারলে শেয়ার মার্কেট থেকে নাম কেটে দেবে।’

নগেন হঠাৎ খগেনের ঘাড় ধরিয়া ঝাঁকুনি দিতে লাগিল—‘কিন্তু কাকার যে এত টাকা পেয়েছিলি তার কি হল? তার অর্ধেক ভাগ যে আমার! এই দ্যাখ্‌ উইল—’ নগেন খগেনের নাকের কাছে উইল মেলিয়া ধরিল।

খগেন বলিল, ‘কিচ্ছু নেই, কিছু নেই। তুই পারবি না দিতে? দিবি না? দশ হাজার টাকা—’

এবার নগেন হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিল—‘দশ হাজার টাকা!—একটা জিনিস আছে—গীতা। আয় দাদা, গীতা বিক্রি করব। একটা টাকা পাওয়া যাবে না? তুই আট আনা নিস, আমি আট আনা নেব। কেমন, হবে তো? হা হা হা—’

৭ চৈত্র, ১৩৬১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *