1 of 2

গায়ে-হলুদ – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

গায়ে-হলুদ – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

শ্রাবণ মাসের দিন। বর্ষার বিরাম নেই, এই বৃষ্টি আসচে, এই আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাচ্চে। ক্ষেতে আউশ ধানের গোছা কালো হয়ে উঠেচে, ধানের শিষ দেখা দিয়েচে অধিকাংশ ক্ষেতে।

পুঁটি সকালে উঠে একবার চারিদিকে চেয়ে দেখলে—চারিদিক মেঘে মেঘাচ্ছন্ন। হয়তো বা একটু পরে টিপটিপ বিষ্টি পড়তে শুরু করে দেবে। আজ তার মনে একটা অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি, সেটাকে আনন্দও বলা যেতে পারে, ছদ্মবেশী বিষাদও বলা যায়। কি যে সেটা ঠিক করে না যায় বোঝা, না যায় বোঝানো। আজ তার বিয়ের গায়ে-হলুদের দিন। এমন একটা দিন তার বার বৎসরের ক্ষুদ্র জীবনে এইবার এই প্রথম এল। সকালে উঠতেই জেঠিমা বলেচে—ও পুঁটি, জলে ভিজে ভিজে কোথাও যেন যাস্‌ নি; আর তিনটে দিন কোনও রকমে ভালোয় ভালোয় কেটে গেলে যে বাঁচি।

আজ কি বার, মঙ্গলবার। শনিবার বুঝি বিয়ের দিন। পুঁটির মনে সত্যিই কেমন হয়, আনন্দের একটা ঢেউ যেন গলা পর্যন্ত উঠে আটকে গেল। বিয়ে বেশি দূরে কোথাও নয়, এই গ্রামেই, এমন কি এই পাড়াতেই। এক ঘর ব্রাহ্মণ আজ বছরখানেক হল অন্য জায়গা থেকে উঠে এসেচেন এখানে, দুখানা বড় বড় মেটে ঘর বেঁধেচেন—একখানা রান্নাঘর। এতদিন ধরে সে সঙ্গিনীদের সঙ্গে সেই বাড়িতে কুল পাড়তে গিয়েচে, সত্যনারানের সিন্নি আনতে গিয়েচে, যখন পাড়ার প্রান্তের ঘন জঙ্গল কেটে সে ভদ্রলোক বাড়ি তৈরি করেন ঘাটে যাবার পথের একেবারে ডান ধারে, তখন সে কতবার ভেবেচে এই ঘন বনের মধ্যে বাড়ি করে বাস করবার কার না জানি মাথাব্যথা পড়ল।

কে জানত, সেই বাড়িটাই—আজ এক বছর এখনও পোরেনি—তার শ্বশুরবাড়ি হবে!

কতদূর আশ্চর্যের কথা, কতদূর বিস্ময়ের কথা, ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়! অথচ তারই ক্ষুদ্র জীবনে এমন একটা মহাশ্চর্য ব্যাপার সম্ভব হল! যখনই সে এ কথাটা ভাবে, তখনই সে সুদ্ধু তার মন সুদ্ধু যেন কতদূরে কোথায় চলে যায়।

ঐ ভদ্রলোকের একটি মাত্র ছেলে, নাম সুবোধ, তারই সঙ্গে তার বিয়ের সম্বন্ধ হয়েচে। সুবোধকে এই সম্বন্ধর আগে তাদের বাড়িতে কয়েকবার যাতায়াত করতে দেখেচে—বেশ ফর্সা, লম্বামত মুখ, এবার ম্যাট্রিক দিয়েচে, এখনও পরীক্ষার ফল বার হয়নি। আগে আগে, সত্যি কথা বলতে গেলে সুবোধের মুখ পুঁটি তত পছন্দ করত না। তার দাদার সঙ্গে যতবার এসেচে তাদের বাড়িতে—পুঁটি ভাবত —দেখো না, ঘোড়ার মত মুখখানা। কিন্তু আজকাল আর সুবোধের মুখ ঘোড়ার মত ত মনে হয়ই না, মনে হয় বেশ চমৎকার মুখ। গ্রামের ছেলেদের মধ্যে অমন চোখ, অমন রং, অমন মুখের গড়ন কার আছে?

রায়েদের পাঁচি সেদিন বলেছিল তাকে—হ্যাঁরে, তুই যে বড় ঘোড়ামুখো বলতিস্‌, তোর অদেষ্টে শেষকালে কিনা সেই ঘোড়ামুখোই জুটল!

পুঁটি মারতে ছুটে গিয়েছিল তার পিছু পিছু।

পুঁটির বাবা গোলার দোরে দাঁড়িয়ে ধান পাড়বার ব্যবস্থা করচে। তার বাবা বেশ চাষীবাসী গেরস্ত। পুঁটিদের বাড়িতে চারটা বড় বড় ধানের আউড়ি আছে, গোলা আছে একটা। আউড়ি জিনিসটা গোলার চেয়ে অনেক ছোট, তিন-চার বিশ ধান ধরে—আর একটা গোলায় ধরে এক পৌটি অর্থাৎ ষোল বিশ ধান।

তাদেরও ধান আছে গোলাভর্তি, সব ক’টা আউড়ি ভর্তি। কলকাতায় চাকুরি করেন এ পাড়ার হরিকাকা, তিনি মাঝে মাঝে গাঁয়ে এসে পুঁটির বাবাকে বলেন—আর কি রায়মশায়, এ বাজারে ত আপনিই রাজা। গোলাভর্তি ধান রেখেচেন ঘরে, আপনার মহড়া নেয় কে? কলকাতায় কিউতে দাঁড়িয়ে এক সের চাল নিতে হচ্চে—আর আপনি—।

পুঁটি জিগ্যেস করেছিল—কিসে দাঁড়িয়ে চাল নিতে হয় বাবা, বলছিল হরিকাকা?

—কে জানে কিসে দাঁড়িয়ে, তুই নিজের কাজ কর, আমি নিজের করি—মিটে গেল।

—তুমি জান না বুঝি ও কথাটার মানে? না বাবা?

—না জেনেও ত পায়ের ওপর পা দিয়ে এ বাজারে চালিয়ে দিলাম মা। কলকাতার মুখ না দেখেও ত বেশ চলে যাচ্চে। কলকাতায় নাকি মানুষের এক সের চালের জন্যে চার ঘণ্টা কোথায় নাকি দাঁড়িয়ে থাকতে হয়—কিন্তু যে বাড়িতে তার বিয়ে হচ্চে, তাদের অবস্থা এত ভাল নয়। সুবোধ যদি পাস করে, তবে হরিকাকা ভরসা দিয়েচেন কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তাকে ওঁর আপিসে চাকুরি করে দেবেন। তা হলে তাকেও কি কলকাতায় গিয়ে বাসায় থাকতে হবে আর সেই কিসে দাঁড়িয়ে রোজ এক সের চাল নিয়ে এসে রাঁধতে হবে? সে যে বড় কষ্ট—তবে, মানে সুবোধ যদি সঙ্গে থাকে, সে বোধ হয় সব রকম কষ্টই করতে প্রস্তুত আছে।

তাদের ধানের গোলা থেকে ধান পাড়া হচ্চে, খাবরাপোতা থেকে সীতানাথ কলু আড়তদার এসেচে—ধান কিনে নিয়ে যাবে। বিয়ের খরচপত্র ধান বেচে করতে হবে কিনা!

ওর জেঠিমা বললেন—ও পুঁটি, আজ কোথাও বেরিও না। নাপিত ও বাড়ি থেকে হলুদ নিয়ে আসবে, সেই হলুদ গায়ে দিয়ে তোমায় নাইতে হবে।

এমন সময় সাধন জেলে এসে ভিজতে ভিজতে উঠোনে দাঁড়াল। হাত জোড় করে মাথা নিচু করে প্রণাম করে বললে—প্রাত পেন্নাম।

তার বাবা বললে—ও সাধন, বাবা তোমায় ডেকেছি যে একবার। আমার যে কিছু মাছের দরকার এই শনিবারে।

কি জানি কেন, পুঁটির বুকটা দুলে উঠল। এই শনিবার—এই শনিবারে তাহলে সত্যিই তার—

সাধন বললে—আজ্ঞে, মাছের যে বড্ড গোলমাল যাচ্চে। গাঙে কি মাছ আছে? ডুমোর বাঁওড়ের মাছ সব যাচ্চে কলকাতায়। বিরাশি টাকা দর। এমন দর বাপের জম্‌মে কোনও কালে শুনিনি রায়মশায়। এক সের দেড় সের পোনা ইস্তক পড়তে পাচ্চে না। মরগাঙে বাঁধাল দিয়েলাম—একদিন কেবল এক সাড়ে এগার সের গজাড় মাছ—

পুঁটির বাবা বিস্ময়ের সুরে বললে—সাড়ে এগার সের গজাড়! এমন কথা ত কখনও শুনিনি—

—অরিবৎ গজাড় রায়মশায়। মাছের এমন দর, গজাড় মাছই বিক্রি হয়েল দশ আনা সের।

পুঁটি আর সেখানে দাঁড়াল না। মাকে এমন আজগুবি খবরটা দিতে ছুটল বাড়ির মধ্যে। বিষ্টি একটু থেমেচে, একটু কোথাও বেরুতে পারলে ভাল হত। তার জীবনে যে এমন একটা আশ্চয্যি ব্যাপার হতে চলেচে এ কথাটা কারও সঙ্গে আনন্দ করে বলাও চলে না। বেহায়া বলবে, নিন্দে করবে। কেবল বলা চলে তার সমবয়সী পাঁচি আর ক্ষেন্তি জেলেনির মেয়ে টুনির কাছে। আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার—তার চেয়ে অন্তত সাত বছরের বড় লতিদিদির এখনও বিয়ে হয়নি—অথচ লতিদিকে সবাই বলে সুন্দরী, লতিদি’র বাপের অবস্থা ভাল। লতিদি লেখাপড়া জানে, ভাল গান করে, ওর বাবা যখন কলকাতায় চাকুরি করত, তখন লতিদি স্কুলে পড়ত সেখানে। কত বই পড়ে বসে বসে দুপুর বেলা। পুঁটি ওদের বাড়ি যায় যখনই, তখনই দেখে লতিদি বই মুখে বসে। পুঁটি ভাল লেখাপড়া জানে না, বইয়ের নাম পড়তে পারে না, লতিদি একটু ঠ্যাকারে, সে লেখাপড়া জানে না বলে বুঝি আর মানুষ না?

তাকে বলে—তুই বইটই নাড়িস নে পুঁটি। কি বুঝিস্‌ তুই এর আস্বাদ?

পুঁটি হয়ত বলে—এ কি বই বল না লতিদি?

—যা যাঃ, আর বইয়ের খবরের দরকার নেই। শরৎ চাটুজ্যের নাম শুনেচিস? কোথা থেকে শুনবি? তোরা শুধু জানিস্ ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে কি করে চিঁড়ে কুটতে হয়। তাই করগে যা—এদিকে কেন আবার?

আচ্ছা, আজ তার লতিদিকে বলতে ইচ্ছে হচ্চে কই লতিদি, তুমি এত বই পড়েটড়ে বসে আছ, এত সব নাম জান—কই তোমার ত আজও বিয়ে হল না। আমার জীবনে এত বড় একটা আশ্চর্যি কাণ্ড ত টুক্‌ করে ঘটে গেল। ধানের নিন্দে কর, বাবার গোলায় ধান ছিল বলে ত আজ—কই তোমাদের ত—তারপর ম্যাট্রিক পাস বর। এ গাঁয়ে পাসকরা ছেলে একমাত্র আছে মুখুজ্যেদের জীবনদা। সে নাকি দুটো পাস—কোথায় চাকুরি করচে যেন—ঐ দিকে কোথায়। যার সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্চে, সে. মুখ্যু নয়। পাসের খবর বেরুবার দেরি নেই—বাবা বলেন, সুবোধ নিশ্চয়ই পাস করবে। হে ভগবান, তাই করো, পাস যেন সে করে, সত্যনারানের সিন্নি দেবে সে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে।

নাপিত এসে বললে—মা-ঠাকুরুন, ও-বাড়ি থেকে দেখে এলাম। গায়ে-হলুদের লগ্ন বেলা দশটার পর। আপনাদের যা দিতে হবে তার আগে দিয়ে দেবেন।

গায়ে-হলুদের তত্ত্ব আসবে ও-বাড়ি থেকে। কি রকম জিনিসপত্র না জানি আসে। পুঁটির মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। একখানা লাল কাপড় নিশ্চয়ই তারা দেবে। পুঁটির মোটে তিনখানা শাড়ি—আর একখানা ডুরে শাড়ি আছে মায়ের বাক্সে তোলা। এবার তার অনেক কাপড় হবে, গহনাও হবে। পাঁচ ভরি সোনা দেবার কথাবার্তা হয়েচে। এতদিন দুটি দুল ছাড়া অন্য কোনও গহনা তার অঙ্গে ওঠেনি—অথচ ঐ কুমারী মেয়ে লতিদিরই হাতে ছ’গাছা করে চুড়ি, গলায় লকেট ঝোলানো হার, কানে পাশা, হাতে আংটিও আছে। ও থাকত শহরে। সেখানে মেয়েদের চালচলন আলাদা। এসব পাড়াগাঁয়ে কুমারী মেয়েরা কাঁচের চুড়ি ছাড়া আবার কি গহনা পরে? অত পয়সাও নেই তার বাপের। গোলায় দুটো ধান আছে মাত্র, নগদ পয়সা কোথায়। যা কিছু করতে হয় সে ঐ ধান বেচে।

ভীষণ বৃষ্টি এসেচে। সঙ্গে সঙ্গে সামান্য ঝড়। রান্নাঘরের ছাঁচতলায় দাঁড়িয়ে বক্‌না বাছুরটা ভিজচে। কচুপাতায় জল জমে আবার গড়িয়ে গড়িয়ে পড়চে। তাদের কৃষাণ বীরু মুচি বলচে—ও দিদি ঠাকরোন, তা একটু তামাক দ্যাও মোরে, বিয়েবাড়ি যে মনেই হচ্ছে না। দু-দশ ছিলিম তামাক পোড়বে, তবে ত বোঝবো যে নগনসা লেগেচে।

পুঁটি বীরুকে ধমক দিয়ে বললে—যাঃ, তোর আর বক্তৃতা দিতে হবে না। তামাক আমি কোথায় পাবো? কাকিমার কাছে গিয়ে চাইগে যা—

একটু বেলা হয়েচে। বাড়িতে অনেক লোক এসেচে বিয়ের জন্যে। বিয়েবাড়ির মত দেখাচ্চে বটে—কুমোরপুরের কাকিমা, পাঁচঘরার মাসিমা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেচেন—আজ বেলা এগারোটার সময়ে আরও একদল আসবে, ইস্টিশানে গাড়ি গিয়েছে। মেয়েরা সবাই দল বেঁধে নদীতে নাইতে গেল। কুমোরপুরের কাকিমা যাবার সময়ে তাকে বলে গেল—বাঁড়ুজ্যেবাড়ি পিঁড়ি চিত্তির করতে দিয়ে আসা হয়েচে, দেখে আসিস্‌ পুঁটি সে-দুখানা পিঁড়ি হয়েচে কি না।

কাকিমার এটা অন্যায় কথা! তার লজ্জা করে না? নিজের বিয়ের পিঁড়ি নিজে বুঝি সে চাইতে যাবে? এত বেহায়া সে এখনও হয়নি।

তার বাবা চণ্ডীমণ্ডপ থেকে হেঁকে বললেন—ও পুঁটি, হাতায় করে একটু আগুন নিয়ে এসো মা—

চণ্ডীমণ্ডপের দোর পর্যন্ত গিয়ে ও শুনলে ওর বাবা ও আর একজন অজ্ঞাত লোকের মধ্যে নিম্নোক্ত কথাবার্তা।

—তা হলে পাল্‌কির বন্দোবস্ত দেখতে হয়—

—আজ্ঞে পাল্‌কি কোথায় মিলবে? ঘোলডুবুরির কাহারপাড়া নির্বংশ। পাল্‌কি বইবার মানুষ নেই এ দিগরে।

—তবে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এস বনগাঁ থেকে।

—এ কাদাজলে দশ টাকা দিলেও আসবে না। আসবার রাস্তা কই?

—ওরা বিদেশী লোক। বর আসবার ব্যবস্থা আমাদেরই করে দিতে হবে, বুঝলে না? আমরাই পারচি নে, ওরা কোথায় কি পাবে? হিম হয়ে বসে থাকবে না। যা হয় হিল্‌লে লাগিয়ে দ্যাও একটা।

—আচ্ছা বাবু, বলদের গাড়িতে বর আন্‌লি কেমন হয়?

—আরে না না—সে বড় দেখতে খারাপ হবে। সে কি—না, না। শুন্‌চি ওরা ইংরিজি বাজনা আনচে। বলদের গাড়ির পেছনে ইংরিজি বাজনা বাজিয়ে বর আসবে, তাতে লোক হাসবে।

—কেন বাবু, তাতে কি? বলদের গাড়িতে কি আর বর যায় না? একেবারে আপনাদের বাড়ির পেছনে এসে থামবে—সেই ত ভাল।

—বলদের গাড়িতে বর যাবে না কেন? সে কি আর ভদ্দরলোকের বর যায়? তা ছাড়া পেছনের ও-পথ আইবুড়ো পথ। ওখান দিয়ে বর আসবে না, সামনের তেঁতুলতলার রাস্তা দিয়ে বরকে আনতে হবে। তুমি আজই যাও দিকি ষষ্ঠীতলা। সেখানে ক’ঘর কাহার আছে শুনিচি। সেখান থেকেই পাল্‌কি আনাতে—

—সে যে এখান থেকে তিনকোশ সাড়ে তিনকোশ রাস্তা বাবু।

পুঁটি সেখানে আর দাঁড়াল না! সুবোধ আসবে বর সেজে বলদের গাড়িতে? হি—হি—সে বড় মজা হবে এখন। ধুতরো ফুলের মালা গলায় দিয়ে?

দৃশ্যটা মনে কল্পনা করে নিয়েই হাসতে হাসতে পুঁটির দম বন্ধ।

—ও—তিনু—রে—শোন্‌ শোন্‌ একটা মজার কথা—

তিন চার বছরের খুড়তুতো ভাই। উঠোনের নিচে দিয়েই যাচ্চে। সে মুখ উঁচু করে ওর দিকে চেয়ে বললে—কি লে ডিডি?

—জানিস্‌? এই আমাদের বাড়ি বর আসবে—

—বল?

—হ্যাঁ রে। ধুতরো ফুলের মালা পরে বলদের গাড়ি চেপে ইংরিজি বাজনা বাজিয়ে—হি—হি—

তিনু না বুঝে হাসলে—হি—হি—

এই সময়ে ওদের জ্যাঠাইমা বাড়ির ছেলেমেয়েদের ডাক দিলেন—ওরে, সবাই এসে কাঁটাল খেয়ে যা—ও হিমু পান্ত ভাত কে কে খাবে ডাক দিয়ে নিয়ে আয়। এক হাঁড়ি পান্ত রয়েচে সেগুলো কাঁটাল দিয়ে ওঠাতে তো হবে। ভাত ফেলতে পারবো না এই যুজ্যের বাজারে—

পান্ত ভাত ও কাঁটাল পুঁটির অতি প্রিয় খাদ্য। কিন্তু আজ এখন তার খাবার নাম করবার জো নেই—খিদেও পেয়েছিল, ইচ্ছে করলে সে কলসী থেকে কাঁটালবিচি ভাজা আর মুড়ি লুকিয়ে পেড়ে নিয়ে খেতে পারত —কিন্তু সে ইচ্ছে তার নেই। তাতে ভগবান রাগ করবেন। আজকের দিনে সে ভগবানকে রাগাবে না।

বেলা বাড়লো। ও বাড়িতে শাঁক ও হুলুর শব্দ শোনা গেল। অবিশ্যি খুব কাছে নয় পুঁটির ভাবী শ্বশুরবাড়ি। তা হলেও শাঁকের শব্দ না আসবার মত দূরও নয়।

ওর খুড়তুতো বোন শ্যামা বল্‌লে—ওই শোন দিদি, দাদাবাবুর গায়ে-হলুদ হচ্চে—

পুঁটি ধমক দিয়ে বল্‌লে—চুপ্‌। মেরে ফেলে দেবো। দাদাবাবু কে?

—বা-রে, হয়েচেই তো—আর দুদিন দেরি—

—না। তা হোক্‌। আগে থেকে বলতে নেই।

—জ্যাঠাইমা তো বলচে?

—কি বলচে?

—বলচে, আমাদের জামাইয়ের গায়ে-হলুদ হচ্চে—সেখান থেকে তত্ত্ব নিয়ে নাপিত এবার এসে পৌঁছে যাবে—

—তা বলুক গে। আমাদের বলতে নেই।

—আচ্ছা দিদি—দাদাবাবু—ইয়ে সুবোধবাবু পাস করেচে?

—খবর এখনও বের হয়নি।

—আমি ও পাড়ায় রাধীদের বাড়ি গিইছিলাম এই এট্টু আগে। রাধীর দাদা পাস করেচে, কাল বিকেলে কলকাতা থেকে ওর কাকা খবর দিয়েচে।

—তোর দাদাবাবুর—ইয়ে মানে ওর—দুর, ওই কেশববাবুর ছেলের খবর কে পাঠাবে কলকাতা থেকে? ওদের তো কেউ নেই কলকাতায়।

একটু পরে ওদের বাড়িতে শাঁক বেজে উঠলো, হুলু পড়লো। নাপিতে তত্ত্ব নিয়ে আসচে তেঁতুলতলার পথে, বাড়ি থেকে দেখা দিয়েচে।

পুঁটির বুক আনন্দে দুলে উঠলো—জ্যাঠাইমা বলছিলেন, আশীর্বাদ হয়ে গেলেও বিয়ে না হতে পারে, কিন্তু গায়ে-হলুদ হয়ে গেলে বিয়ে নাকি আর ফেরে না।

এবার তা হলে সেই আশ্চর্য ব্যাপারটা তার জীবনে ঘটে গল।

কেউ আর বাধা দিতে পারবে না। পাড়াগাঁয়ে কত রকমে ভাঙ্‌চি দেয় লোকে। তার বিয়েতেও ভাঙ্‌চি দিয়েছিল। বলেছিল, মেয়ের রং কালো, মুখ-চোখ ভাল না—লেখাপড়া জানে না—আরও কত কি। কিন্তু সুবোধ—না। ছিঃ, ও নাম করতে নেই, নাম হিসেবে মনে ভাবতে নেই।

তারপর বাকি অনেকগুলো কি ব্যাপার স্বপ্নের মত তার চোখের সামনে দিয়ে ঘটে গেল। শাঁকের ডাক, হুলুধ্বনি, মা, কাকিমা, জ্যাঠাইমা তাকে তেল-হলুদ মাখিয়ে দিলেন। গায়ে-হলুদের তত্ত্ব এল লালপাড় শাড়ি, তেল-হলুদ, একটা বড় মাছ, এক হাঁড়ি দই। তার সমবয়সী বন্ধু তিনজন খেতে এল তাদের বাড়ি। তাকে কাছে বসিয়ে কত যত্ন করে মাছ দিয়ে, দই দিয়ে মা, জ্যাঠাইমা কত আদর করে খাওয়ালেন, কত মিষ্টি কথা বললেন। সোনার পিড়িতে সিদুর দেওয়া হল, প্রদীপ দেখানো হল—যাতে শূন্য ধানের গোলা সামনের ভাদ্র মাসে আউশ ধানে অন্তত অর্ধেকটা পুরে যায়। বাবা বলেন, গোলার ধান খালি হয়ে যেত না। মধ্যে কি একটা গভর্নমেন্টের হাঙ্গামা এল—কেউ গোলায় ধান জমিয়ে রাখতে পারবে না। তাতেই অনেক ধান কর্জ দিতে হল গ্রামের লোকজনকে।

গায়ে-হলুদের তত্ত্বে আরও অনেক জিনিস এসেছিল, খাওয়া-দাওয়ার পরে গাঁয়ের মেয়েরা কেউ কেউ দেখতে এল—তখন সে নিজেও দেখলে। আগে লজ্জায় ও-দিকেও সে যায়নি। একটা শাড়ি, একটা ব্লাউস, সায়া একটা—আলতা, সাবান, আয়না আর গন্ধ তেল। এসব জিনিস তার নিজস্ব। কারও ভাগ নেই এতে। সে ইচ্ছে করে যদি কাউকে দেয় তবেই সে পাবে, নইলে নিজের বাক্সে রেখে দিতে পারে, কারও কিছু বলবার নেই।

সব কাজ মিটতে বেলা দুটো বেজে গেল।

পুঁটির মন ছটফট করছিল, ও-পাড়ার লতিদি, হিমি, অন্ন, রাধী—এরা কেউ আসেনি—এদের গিয়ে একবার দেখা দেওয়া দরকার—যাতে তারা বুঝতে পারে যে, তার গায়ে-হলুদের মত আশ্চর্য ব্যাপারটা আজ সত্যিই ঘটে গিয়েচে। আচ্ছা, যখন ইংরিজি বাজনা বাজিয়ে বর আসবে তাদের বাড়ির দোরে তেঁতুলতলার ওই পথটা দিয়ে, বোধনতলার কাছে পাল্‌কি নামিয়ে প্রণাম করে—বাজি পুড়বে, লোকজনের হই-হই হবে—ওঃ, সে সময়ের কথা ভাবাও যায় না। দেখে যেন পাড়ার সব মেয়েরা এসে।

সে বেড়াতে বেড়াতে গেল মুখুজ্যেবাড়ি। মুখুজ্যেগিন্নি ওকে দেখে বললেন—কি রে পুঁটি, আয় মা আয়। গায়ে-হলুদ হয়ে গেল? আহা, এখন ভালোয় ভালোয় দু-হাত এক হয়ে গেলে—বোসো মা, বোসো।

একটু পরে লতিকাও সেখানে এসে হাজির হল। পুঁটিকে দেখে বললে—ও পুঁটি, তোর আজ গায়ে-হলুদ ছিল না? হয়ে গেল? কি তত্ত্ব এল শ্বশুরবাড়ি থেকে?

মুখুজ্যেগিন্নি বললেন— বোস্‌ মা তোরা। লতি পুঁটির সঙ্গে গল্প কর। একটু চা করে আনি। যাক্‌, ভালোই হল, আজকাল মেয়ের বিয়ে দেওয়া যে কি কষ্ট, যে দেয় সেই জানে।

পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে গাঙ্গুলিদের ছোট বউ ডেকে বললে—ও কে, পুঁটি নাকি? গায়ে-হলুদ হয়ে গেল? তা কই আমাদের একবার বলতেও তো হয়। এই তো বাড়ির পেছনে বাড়ি—

পুঁটি বললে—গেলেন না কেন বউদি? আমরা তো বারণ করিনি যেতে। শাঁক যখন বাজলো, তখনও যদি যেতেন—

লতিকা ভাবলে, পুঁটি ছেলেমানুষ, এ উত্তরটা দেওয়া ওর উচিত হল না। এখানে ও-কথা বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু এর পরবর্তী ব্যাপারের জন্যে সে বা পুঁটি কেউ প্রস্তুত ছিল না। গাঙ্গুলিদের ছোট বউ মুখ লাল করে উত্তর দিলে—কি বললি? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। আমরা কখনও গায়ে-হলুদ দেখিনি, শাঁকে ফু পড়লে অমনি কুকুরের মত ছুটে যাব তোমাদের বাড়ি পাতা পাততে। অত অংখার ভাল না রে পুঁটি। তোমার বাপের বড্ড ধানের গোলা হয়েচে, না? অমন বিয়ে আমরা কখনও কি দেখিচি জীবনে? ছেলের না আছে চাল, না চুলো—সংসারে মানুষ নেই বলে হাঁড়ি ঠেলতে নিয়ে যাচ্চে। ছেলের বিদ্যে কত, তা জানতে বাকি নেই—এবার তো ম্যাট্রিক ফেল করেচে—

এখানে লতিকা আর না থাকতে পেরে বললে—কে বললে ছোটবউদি? সুবোধবাবুর পাসের খবর তো পাওয়া যায়নি?

—কেন পাওয়া যাবে না? চিঠি এসেচে ফেল করেচে বলে—ওরা সে চিঠি লুকিয়ে ফেলেচে। বিয়ের আগে ও খবর জানাজানি হতে দেবে না। উনিই হাট থেকে চিঠি আনেন। পোস্টকার্ডের চিঠি। উনি সন্দের পর সুবোধদের বাড়ি দিয়ে এলেন। আমাদের চোখে ধূলো দেওয়া—

পুঁটির চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে বিশ্বসংসার লেপে মুছে গিয়েচে। মুখরা দর্পিতা ছোট বউয়ের মুখের কাছে সে কি করে দাঁড়াবে। চেঁচামেচি শুনে মুখুজ্যেগিন্নি হাঁ-হাঁ করে ছুটে এলেন, লতিকা ওর হাত ধরে নিয়ে ঘরের মধ্যে গেল।

মুখুজ্যেগিন্নি ঘরের মধ্যে এসে চাপা গলায় বললেন—আহা, ছেলেমানুষ—ওর সাধ আহ্লাদের দিনটা অমন করে বিষ ছড়াতে আছে—ছিঃ ছিঃ—দ্যাখ তো মা লতি কাণ্ডটা—

কাঠের পুতুলের মত আড়ষ্ট পুঁটির হাত ধরে ততক্ষণ লতিকা বলচে—চল্ চল্‌ পুঁটি, তোকে বাড়ি দিয়ে আসি—ছিঃ, বউদির কি কাণ্ড! ওসব কথা মনে করিস্‌ নে, মিথ্যে কথা। চল্‌ পুঁটি—ভাই—লতিকার গলার সুরে ও কথার ভাবে কিন্তু পুঁটির মনে হল লতিদিও এ খবরটা জানে—কি জানি হয়তো গাঁয়ের সবাই জানে—সে-ই কেবল জানতো না এতক্ষণ। পথে পা দিয়েই লজ্জায় অপমানে সে ছেলেমানুষের মত কেঁদে ফেলে বললে—লতিদি? আমি কি বলেছিলাম ছোটবউদিকে?—খারাপ কথা কিছু?

১৩৫০ (১৯৪৩)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *